Banner
জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা কেন? ─ শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 26, 2015, 12:00 AM, Hits: 1131

 

আমি বিশেষ করে পণ্ডিতদের দিক থেকে জাতীয়তাবাদের অনেক রকম বিরোধিতা দেখেছি। তাদের অনেকের লেখা যেমন পড়েছি তেমন অনেকের কথাও শুনেছি। তাদের অনেকে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন এই যুক্তি থেকে যে এটা অন্য জাতির সঙ্গে বিরোধাত্মক একটা চেতনার জন্ম দেয়। অর্থাৎ নিজেকে এক জাতির মানুষ মনে করলে অন্য জাতিকে নিজ জাতির প্রতিপক্ষ বা শত্রু মনে করতে হবে। তাদের যুক্তি হল এটা ‘আমরা আর তারা’ এই বোধের জন্ম দিয়ে এক জাতিকে আর এক জাতির বিরুদ্ধে দাঁড় করায়।

 

মানলাম তাদের যুক্তি। কিন্তু এই একই যুক্তি অনুযায়ী কি ব্যক্তিরও স্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দিতে হয় না? সে ক্ষেত্রে কী করতে হবে? সবচেয়ে ভাল হয় দৈহিকভাবে আত্মহত্যা করে নিজের অস্তিত্বকেই বিলুপ্ত করা। তা হলে তো আর অন্য ব্যক্তির সঙ্গে সত্তাগত কোনও দ্বন্দ্বের জায়গাই থাকে না। ব্যক্তিই যখন নাই তখন আর অন্য ব্যক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রশ্নই বা কী করে আসবে? অবশ্য আত্মহত্যা করে ভবলীলা সাঙ্গ করতে যারা রাজী হবে না কিন্তু মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে যারা উঠতে চাইবে তাদের সামনে কী করণীয় বা উপায় থাকতে পারে? আমি একটাই উপায় সেক্ষেত্রে দেখি সেটা হল নিজ ব্যক্তিসত্তা তথা ব্যক্তিত্বকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে ভিন্ন কোনও ব্যক্তিসত্তার ভিতর নিজ সত্তাকে বিলুপ্ত করা। যেহেতু ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের জন্য এ ক্ষেত্রেও কিছু সমস্যা থাকে তবু অন্যের ব্যক্তিসত্তার নিকট প্রশ্নহীন ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পথ অনুসরণ করে সমস্যা কিছুটা কমানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। এটা আসলে মানসিক দাসত্বের পথ। তবু মানসিক দাসত্বের মাধ্যমেও কিছু দ্বন্দ্বের নিরসন হলেও হতে পারে।

 

যারা জাতীয়তাবাদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে এমন সব উদ্ভট যুক্তি হাজির করেন তারা কিন্তু বেশীর ভাগই পণ্ডিত ব্যক্তি। বিশেষত তাদের কথাটাই আমি এখানে বলছি। তাদের কেউ কেউ মার্কসবাদী হলেও সবাই যে মার্কসবাদী তাও কিন্তু নয়। মার্কসবাদীদের ব্যাপারটা বোধগম্য হতে পারে। নিজ জাতিকে বিসর্জন দিয়ে বিশ্বমানবতার স্বার্থে যারা নিজেদেরকে নিবেদিত মনে করেন তাদের মধ্যে এমন জাতি-বিরোধী ভাবনা অস্বাভাবিক না। কিন্তু বাদবাকী পণ্ডিতদেরকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?

 

যাইহোক, এখন যারা ‘আমরা আর তারার’ ভেদাভেদ দূরীকরণের যুক্তি তুলে জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেন তারা কি তাদেরই যুক্তি অনুসরণ করে নিজেদের ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দিতে রাজী হবেন? বরং উল্টা কাজটাই তাদেরকে অনেককেই করতে দেখি। তাদের অনেকে সুযোগ পেলেই নিজেদের জ্ঞান-বিদ্যার শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সেটা সেমিনার-সভার বক্তৃতায় হোক, পুস্তক এবং পত্র-পত্রিকায় লেখনীর মাধ্যমে হোক আর টেলিভিশনের টকশোতে হোক। তখন তাদেরকে কিন্তু কারও কাছে আত্মসমর্পিত মানুষ আর মনে হয় না। তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিত্ব বা ব্যক্তিসত্তাই তখন কিন্তু থাকে প্রবলভাবে উচ্চকিত। তাহলে জাতির প্রশ্নে তাদেরকে কালী দেবীর শ্রীচরণে নিবেদিত এমন রামকৃষ্ণ পরমহংস মার্কা অবস্থান নিতে দেখা যায় কেন?

 

আসলে এই পণ্ডিতরা অথবা এই পণ্ডিতরা যাদের আজ অনুসারী তাদের সেই পূর্বসূরীরা এক সময় জাতীয়তাবাদী হয়েছিলেন পশ্চিম ইউরোপের প্রভাবে। আজ তারা জাতীয়তাবাদ বিরোধী যে হয়েছেন সেটাও হয়েছেন পশ্চিম ইউরোপের প্রভাবে। এক সময় পশ্চিম ইউরোপের উত্থানের পিছনে যে সব চিন্তা বা ভাবনা কাজ করেছিল সেগুলির মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা ছিল জাতীয়তাবাদ। ইউরোপ জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে আধুনিক লোকবাদী বা ‘সেক্যুলার’ রাষ্ট্র গঠনের কাজ সম্পন্ন করেছে। এই রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় ব্রিটেন, ফ্রান্সের মত কোনও কোনও রাষ্ট্র সমগ্র পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ বিস্তার করেছিল। এভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী ইউরোপের উত্থান হল। জার্মানীর মত রাষ্ট্র উপনিবেশ বিস্তারের এই প্রতিযোগিতায় দেরীতে যোগ দিতে গিয়ে দুই দুইটা মহাযুদ্ধ বাধিয়ে ফেলল।

 

এরপর ক্রমে সরাসরি উপনিবেশ বা সাম্রাজ্য রক্ষার যুগের অবসান হল। পশ্চিম ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি পৃথিবীব্যাপী আধিপত্যের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিল এখন সেটা রক্ষা করতে পারলে তারা নিশ্চিন্ত মনে পৃথিবীতে তাদের ভোগদখল বজায় রাখতে পারে। সুতরাং এখন তাদের জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের সীমানার অসারত্বের তত্ত্ব আওড়ানোর যুগ এসেছে। বিশেষত দুইটা মহাযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা নিজেদের মধ্যে সহিংস প্রতিযোগিতা বর্জন করে আপোসের মাধ্যমে সবাই মিলে ভাগযোগ করে পৃথিবীতে আধিপত্য বজায় রাখার পথ বেছে নিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের আধিপত্য রক্ষার এই নেতৃত্বটা নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাশ্চাত্য তথা পশ্চিম ইউরোপের সব ক’টি রাষ্ট্র এই বাস্তবতা মেনে নেওয়াটাই নিজেদের সবার জন্য নিরাপদ ও লাভজনক মনে করছে। ফলে সাম্রাজ্যবাদের নূতন রূপে যে বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটার নেতা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

 

সুতরাং জাতি-রাষ্ট্র ভাবনা, জাতীয়তাবাদ এগুলি এখন তাদের জন্য অপ্রয়োজনীয়। এগুলি তাদের হয়েই গেছে। এখন এগুলির প্রয়োজন হতে পারে সেই সব দেশের যারা এখনও উপনিবেশ কালের ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে আছে এবং বাস্তবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের অধীনস্থ কিংবা পাশ্চাত্যের উপর নির্ভরশীল রাষ্ট্র হয়ে আছে। তারা যদি পাশ্চাত্যের সমকক্ষ হয়ে উঠতে চায় তাহলে পাশ্চাত্যের বিপদ না? আধিপত্য ও শোষণের এমন সুযোগ কি হাতছাড়া হবে না? সুতরাং তাদের পণ্ডিতদের অনেকের অনেক কাজের মধ্যে কাজ হয়েছে নানান যুক্তি, নানান কথার জাল রচনা করে জাতীয়তাবাদের অসারত্ব ও ক্ষতিকর দিক বয়ান করা। তা জাতীয়তাবাদের মন্দ দিক থাকবে না কেন? অবশ্যই সবচেয়ে উপকারী কিংবা আবশ্যক ওষুধও যদি মাত্রাহীনভাবে প্রয়োগ করা যায় তবে তাতে কি ক্ষতি হয় না? বেশী মাত্রায় ভাত খাবার পরিণামে যদি পেট খারাপ হয় তবে কি চিরতরে ভাত খাওয়া বন্ধ করার বিধান কোনও সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন চিকিৎসক দিবেন? আমাদের জন্য সেই বিধান পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক পণ্ডিত এবং তাদের এ দেশীয় অনুসারীরা দিচ্ছেন।

 

সবচেয়ে বড় কথা পাশ্চাত্য তার উন্নতির একটা পর্যায়ে তার জন্য অনুপযোগী বা অপ্রয়োজনীয় হওয়ার কারণে যে ধারণা বা ব্যবস্থা বর্জন করছে সেটা সবার জন্য প্রযোজ্য এমন মনে করাটা কি পাশ্চাত্যের মানসিক দাসত্ব নয়? আমাদের কি নিজস্ব কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে নিজেদের ভাল-মন্দ বুঝবার ক্ষমতা এতদিনেও হয় নাই?

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ