Banner
বাংলাদেশের জয়-পরাজয় ─ ইমাম গাজ্জালী

লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ December 15, 2015, 12:00 AM, Hits: 1342

 

এক

 

প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে উপনিবেশগুলোতে অবাধ শোষণ, লুটতরাজ, দুর্বৃত্তায়ন, নির্যাতন ইত্যাদি জারি রাখার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের ভিত্তি ছিল দুইটি, প্রথমটি তাদেরই সৃষ্ট একটা অনুগত দালাল শ্রেণি, দ্বিতীয়টি হল আমলাতন্ত্র। এই দুই নিয়েই তারা বিনির্মাণ করেছিল নিজেদের সুবিধামত একটি রাষ্ট্রযন্ত্র। এই অনুগত দালাল শ্রেণির হাতে ভূমির মালিকানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের এমনভাবে তৈরি করেছিল যে, সমাজে এরা অসম্ভব প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে। এরা রক্তে মাংসে দেশীয় হলেও রুচিতে, সংস্কৃতিতে, শিক্ষায় ও চলনে-বলনে ছিল ইংরেজ। যেন কাকের পুচ্ছে ময়ুরের পেখম। এই অনুগত শ্রেণিটি নিজেদের দেশকে দেখত ব্রিটিশদের চোখ দিয়ে। নিজ দেশের ইতিহাস লিখত ‘ব্রিটিশ মন’ দিয়ে। সেই ইতিহাস এখনো আমাদের পড়ানো হচ্ছে। এরা শিখত এবং শেখাত যে, ইংরেজ তথা ইউরোপীয়দের সবকিছুই যেন বিনা বাক্যব্যয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধ, সুতরাং তা অনুকরণীয়। পক্ষান্তরে দেশীয়দের অভিজ্ঞতা ও অর্জনসমূহ বিনা বাক্যব্যয়ে অপাঙ্ক্তেয়, যা অবহেলা ও তাচ্ছিল্য করার মত, সুতরাং তা বর্জনীয়। নিজ প্রভুদের (ইংরেজদের) অনুকরণ করা ও দেশীয় অভিজ্ঞতাকে বর্জন করাকেই ওরা ‘সভ্যতা’ জ্ঞান করত। সেই ধারাটি এখনো ক্রিয়াশীল।

 

অপরদিকে ব্রিটিশ সৃষ্ট আমলাতন্ত্র ছিল ব্রিটিশ রাজকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম ভিত্তি। দেশীয়দের দমন ও ব্রিটিশদের স্বার্থ দেখে চলতেই এই আমলাতন্ত্রের সৃষ্টি। এই অনুগত শ্রেণি ও আমলাতন্ত্র-এই দুইয়ের চরিত্র, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। উল্লেখ্য, ব্রিটিশরা এখানে যে আমলাতন্ত্র এবং যে রাষ্ট্রযন্ত্রটি সৃষ্টি করেছিল তা কিন্তু নিজ দেশে তৈরি করেনি। সেখানে গড়ে তুলেছিল জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক প্রশাসন। তারা এখানে যেভাবে লুটতরাজ, নির্যাতন, দুর্বৃত্তায়ন শুরু করেছিল তা কিন্তু একইভাবে নিজ দেশে করেনি। নিজ দেশের ক্ষেত্রে তাদের নজর ছিল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো সমুন্নত রাখা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলা ─ ইত্যাদির দিকে। অর্থাৎ তারা উপনিবেশের জন্য ছিল সাক্ষাত দুর্বৃত্ত আর নিজ দেশের জন্য ছিল উদারনৈতিক গণতন্ত্রী। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় অনেকটা আপোষরফার মাধ্যমে এই অনুগত শ্রেণিটির হাতেই ক্ষমতা দিয়ে চলে যায়। আর রেখে যায় ইতিহাসের আবর্জনা সেই রাষ্ট্রযন্ত্র, সেই আমলাতন্ত্র। ক্ষমতা হাতে পেয়েই এই অনুগত শ্রেণিটি শোষণ-নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটায় এবং অবাধ লুটতরাজ জারি রাখে। যে কাজটি সাম্রাজ্যবাদীরা করত বাইরের দেশ থেকে এসে, একই কাজ নিজ দেশে আরো নিষ্ঠুর, আরো পাশবিক, আরো হিংস্রভাবে করা শুরু করে দেশীয় শাসকেরা। এ কথাটি শ্রীলঙ্কাসহ উপমহাদেশের সকল দেশের ক্ষেত্রেই খাটে। ব্রিটিশ সৃষ্ট এই রাষ্ট্র ও তার আমলাতন্ত্র এবং অনুগত শাসক শ্রেণি হল যে কোনো দেশের অগ্রগতির জন্য বাধা। এই বাধা অপসারণ না করে কোনো জাতি কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। অথচ নির্মম হলেও সত্য যে, এই বাধার জগদ্দল পাহাড়ের ভার বহনের ‘নিয়তি’ থেকে এখনো বের হতে পারেনি দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ এই ‘নিয়তি’ থেকে বের হতে না পারলেও একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাযুদ্ধ সেই জগদ্দল পাহাড়কে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে জাতিকে স্বাধীন বিকাশের শর্ত তৈরি করে দিয়েছিল, অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসার এক অপার সম্ভবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশের জনগণের সামনে।

 

কারণ সেটা ছিল জনযুদ্ধ, আভ্যন্তরীণ জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী আপোষহীন লড়াই, সকল ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে শেষমেশ রক্তপাতময় রাজনীতিতেই যার আপাত ফয়সালা হয়। সেখানে অনুগতদের কাছে ক্ষমতা দেয়ার কোনো সুযোগই রাখেনি ইতিহাস। আর ব্রিটিশ সৃষ্ট সেই অনুগত শ্রেণি! ৪৭ দেশভাগের পর পূর্ব বাঙলা (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) থেকে পর্যায়ক্রমে যাদের অধিকাংশই দেশত্যাগ করে। ফলে শ্রেণি হিসেবে তারা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, শাসন কাঠামোর মধ্যে থাকার আর কোনো সুযোগই তাদের ছিল না। অর্থাৎ নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে এরা আর বাধা নয়। ফলে দুই শতকের উপনিবেশিকতার জঞ্জাল ঝেড়ে ফেলে, নিজেদের মত করে একটা রাষ্ট্র বিনির্মাণ করার এমন মোক্ষম সুযোগ দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো দেশের কাছে ধরা দেয়নি। অথচ অসীম সম্ভবনার এমন সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশের সেই সময়ের নেতৃত্ব। মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্খা, উদ্দীপন, উজ্জীবনকে উল্টো শোষণ, লুন্ঠনের কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবেই দেশীয় দুর্বৃত্তায়নের ক্ষমতায়নই প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ। জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তজার্তিক ষড়যন্ত্রের শিকারের জায়গায় দেশকে ঠেলে দিয়েছে ওই নেতৃত্ব। ফলে আপোষহীন লড়াইয়ের ভেতর আপোষে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রায় সকল উপাদানই বিদ্যমান ছিল।

 

 

দুই

 

পূর্ব বাঙলায় ষাটের দশকে কয়েকটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটে, তা হল একটা প্রায় অপ্রতিরোধ্য তরুণ প্রজন্মের উত্থান, যাদের ভেতর জন্ম নেয় বাঙালী জাতি চেতনার স্ফুরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই নতুন তরুণ প্রজন্ম একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, সুখী, সমৃদ্ধিশালী, শোষণহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। যে স্বপ্ন প্রভাবিত করে গোটা জাতিকে। স্বপ্নবান হয়ে উঠে পূর্ব বাঙলা। জাতির সামনে আলোকবর্তিকা হিসাবে ইতিহাসের মঞ্চে আবির্ভূত হয় ওই তরুণ প্রজন্ম। ষাটের দশকজুড়ে ওই প্রজন্মের হাত ধরে উঠে আসে  দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, কারখানার মজুর এবং গাঁয়ের চাষীসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। ওই তরুণ প্রজন্ম ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলনের সকল ‘মহিমাকে’ ছুঁড়ে ফেলে দেয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে, এরই ধারাবাহিকতায় ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তার কবর রচনা হয়। এরাই বাংলাদেশ আন্দোলনের রাজনীতি হাজির করে জাতির সামনে।

 

এই প্রজন্ম জাতিকে দিশা দিয়েছে, আবার নিজেরা থেকেছে নেতৃত্বহীন। এরা দিক নির্দেশনা দিয়েছে আবার বিভ্রান্তিতেও পড়েছে। এরা পথ পেয়েছে, পথ দেখিয়েছে, আবার পথ হারিয়েছে। বিপ্লবের পথে অসম সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার চরম হঠকারিতার পথেও হেঁটেছে। হঠকারিতায় ও বিভ্রান্তিতে পড়ে বিপ্লব বিরোধী শিবিরে নিজের অজান্তেই নিজেকে ঠেলে দিয়েছে। এরা জাতিকে জাগিয়ে তুলেছে, নবজাগরণের উত্থান ঘটিয়েছে কিন্তু সে জাগরণ কোনো ভাষা পায়নি। দেশের বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার ও উপন্যাসিকগণ সেই জাগরণকে যথাযথভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হননি। গুরুত্বের বিবেচনায় ষাটের দশকের নবজাগরণ উনিশ শতকের কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালী মধ্য শ্রেণির নবজাগরণের সমতুল্য হলেও তার মত বাঙময় নয়। এখনো সেখানে পর্যাপ্ত আলো ফেলা হয়নি, বরং অন্ধকারেই রয়ে গেছে। একে এখনো ব্যখ্যা করা হয়নি। একে ব্যাখ্যা করা এখনো ইতিহাসের মর্জ্জিনির্ভর। বিভ্রান্তি, হঠকারিতা, আপোষসহ ঘটন-অঘটনের জটিল বিন্যাসের মধ্যেও এই তরুণ প্রজন্মই ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টির আঁতুড়ঘর। এদের স্বপ্নের রূপায়নই বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দার্শনিকভাবে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধান খুঁজতে হবে ষাটের দশকের রাজনীতির ভেতর।

 

এই স্বপ্নের কারিগর কারা ছিল?  ছাত্র-তরুণদের সেই প্রজন্মকে সংগঠিত করেছিল দুইটি সংগঠন, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। উভয় সংগঠনই বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের গণভিত্তি রচনা করেছিল। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে দুইটি ধারা বিদ্যমান ছিল। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারা ও জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের কমিউনিস্ট ধারা। কমিউনিস্ট ধারা ছিল ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু, দুর্বল, বিভক্ত ও তত্ত্বগত বিভ্রান্তিতে নিমজ্জিত। অপরদিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারা ছিল ক্রমশ শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, তার প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্র ইউনিয়ন সাংগঠনিক দিক থেকে ছিল খুবই শক্তিশালী ও মেধাবী ছাত্রদের সংগঠন যা ছিল কমিউনিস্ট ধারার অধীন। ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের উত্থানের সূচনাকারী। ওই প্রজন্মের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ে তোলার প্রধান কৃতিত্ব এদের। কমিউনিস্ট প্রভাবিত ছাত্র ইউনিয়নই দার্শনিক অর্থে ইহজাগতিকতার (secular) মতাদর্শ সামনে নিয়ে এসেছিল। বাঙালী মুসলমানের সন্তানের কাছে ইহজাগতিকতার মতাদর্শ নিয়ে আসার আর কোনো উৎস ছিল না। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিগুলির (প্রধান অংশের) বিভ্রান্তিমূলক তত্ত্বগত অবস্থানের প্রভাবে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে এরাও দিকভ্রান্ত, বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে বিপ্লবী অংশটি ছিল রাজনৈতিকভাবে নেতৃত্বহীন। তাদের প্রভাব ও শক্তি ক্ষয় পেতে পেতে শেষের দিকে এই ধারাটি প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়।

 

স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এটা একটা ট্রাজেডি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই শক্তিটির ক্রমশ অনুপস্থিতি জাতির জন্য বড় দুঃসংবাদ। উল্লেখ্য, যুদ্ধপূর্ব সময়ে শ্রমিক সংগঠন ও কৃষক সংগঠনগুলোও ছিল একচ্ছত্রভাবে কমিউনিস্টদের দখলে। এত কিছুর পরেও মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট ধারা কেন প্রভাবশালী হতে পারেনি, তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে পার্টির বিভ্রান্তিকর রাজনীতির মধ্যে। শুধু সংগঠন বড় হলেই কিংবা তার গণ-সংগঠনগুলো জোরালো থাকলেই যে কিছু হয় না, এই ঘটনাসমূহ তারই উদাহরণ।

 

অপরদিকে ছাত্রলীগ ছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারার অধীন। প্রথমদিকে এই অংশটি ছিল আপেক্ষিকভাবে দুর্বল। তা সত্ত্বেও পরবর্তীতে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসায় এরাও ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে, কমিউনিস্টদের প্রভাব এবং ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে এরাও ইহজাগতিকতার (secular) মতাদর্শকে গ্রহণ করে। সেই মতাদর্শের ওপর দাঁড়িয়েই পরবর্তী পর্যায়ে ছাত্র সমাজের বৃহৎ অংশের ঠিকানা হয় সংগঠনটি।

 

ছাত্রলীগের মধ্যে ছিল দুইটি ধারা। নিউক্লিয়াস নামে একটি গোপন সেলের জন্ম দিয়েছিল সংগঠনটির সে সময়ের অগ্রসর তরুণ নেতৃত্ব। এরা হলেন সিরাজুল আলাম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। পরবর্তীতে আরো অনেকে ওই গোপন সেলে যুক্ত হন। নিউক্লিয়াসপন্থীরা ছাত্রলীগের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সক্ষম হন। স্বাধীনতার প্রশ্নে এই ধারাটি আপোষহীন অবস্থান গ্রহণ করে। নিউক্লিয়াসপন্থীরা জাতীয় মুক্তির লড়াইকে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়। মূলত নিউক্লিয়াসপন্থীরাই ছিল বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ও স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রাণসত্তা।

 

’৭০-এর নির্বাচনের পরও ছাত্রলীগের অপর ধারাটি শেখ মুজিবুর রহমানকে উভয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করার বিষয়টিকে সামনে রেখে আন্দোলন করার পক্ষপাতী ছিলেন, এদের চিন্তাশক্তির দৌড় স্বাধিকারের আন্দোলনের সীমানা কখনো অতিক্রম করেনি। এই অংশের নেতা ছিলেন শেখ মনি, নূরে আলম সিদ্দিক ও আবদুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ। নিউক্লিয়াসপন্থীরা স্বাধীনতাপন্থী হলে অপর ধারাটিকে স্বাধিকারপন্থী ধারা হিসাবে অভিহিত করা যেতে পারে।

 

এছাড়া আওয়ামী লীগের মধ্যেও ছিল দুইটি ধারা, এক. তাজউদ্দিন আহমেদের ধারা, দুই. খন্দকার মোস্তাক আহমেদের ধারা। তাজউদ্দিন ধারাটি ছিল সীমাবদ্ধতাসহ উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ও আপেক্ষিকভাবে প্রগতিশীল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বুর্জোয়া ধারার প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে পুরো মুক্তিযুদ্ধকে সুচারুভাবে পরিচালনা করা দলটির মধ্যে তাজউদ্দিন ছাড়া আর কার পক্ষেই বা সম্ভব ছিল? অনেক ক্ষেত্রেই তাজউদ্দিন ধারাটি মূল নেতৃত্বের আনুকুল্য পেতে সক্ষম হয়নি। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে নিউক্লিয়াসপন্থী ধারা ও তাজউদ্দিন ধারাই ছিল স্বাধীনতার আন্দোলনের মূল কারিগর। অপরদিকে খন্দকার মোস্তাক ধারাটি ছিল মার্কিন ঘেঁষা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে নমনীয় ও আপোষকামী।

 

 

তিন

 

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কমিউনিস্ট ধারা, বিশেষত চীনপন্থী বলে পরিচিত অংশটি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, রুশপন্থী বলে পরিচিত অপর অংশটি শাসক দল আওয়ামী লীগে পর্যায়ক্রমে বিলীন হয়ে যায়। উভয় অংশের ছাত্র সংগঠনগুলোও হারিয়ে ফেলে পূর্বেকার ইমেজ। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সরকারে উল্ল্যেখযোগ্য ভূমিকা রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কী ক্ষমতা কাঠামোয়, কী বিরোধিতায় ─ কোনো পরিস্থিতিতেই কার্যকর রাজনীতি তুলে আনতে সক্ষম হন নি তারা।

 

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর বছরও গড়াতে পারেনি, মাত্র ৭ মাস ৫ দিনের মাথায় ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থীরা রাজনীতির মূল ধারা থেকে ছিটকে পড়ে। তাজউদ্দিনকেও বরণ করতে হয় একই পরিণতি। এসব ঘটনা জাতি প্রত্যক্ষ করে অবাক বিস্ময়ে।

 

মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যাদের হাত ধরে ক্ষমতার কাঠামো নির্মিত হল, ব্রিটিশ শাসনের পচাগলা কলঙ্ক ঝেড়ে ফেলে একটা জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হল। সেই ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে স্বাধীনতার মূল কারিগরদের আত্মীকৃত করল না তাদের ‘নিয়তি’। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল কারিগররা কেন এভাবে ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে থাকল, তা নিয়ে এখনো বিস্তর গবেষণার দাবি রাখে। এই বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট হওয়া না হওয়ার ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির নিশানা। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল কারিগরদের এভাবেই ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে রেখে যে রাষ্ট্রটি তার যাত্রা শুরু করেছিল, সেখানেই নিহিত রয়েছে দুর্বৃত্তায়নের বীজ। সেই দুর্বৃত্তায়ন এখন ষোলকলায় পরিপূর্ণ। ভাঙ্গা হয়নি আমলাতন্ত্র ও ব্রিটিশ সৃষ্ট্র রাষ্ট্রযন্ত্র। বরং সেটা আরও দুর্নীতিগ্রস্ত, স্থবির ও অমানবিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখান থেকেই বাংলাদেশের পরাজয় শুরু। এভাবেই একটা স্বাধীন দেশে পর্যায়ক্রমে ফিরে এসেছে পাকিস্তানী ভাবাদর্শের কলঙ্ক — ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, সাম্প্রদায়িকতা ও সামরিক শাসন। একই সঙ্গে ক্ষমতার ড্রয়িং রুমে তুলে আনা হয়েছে পাকিস্তানের ও ব্রিটিশের ফেলে দেয়া ইতিহাসের আবর্জনাগুলো। এখন আমরা একটা পরাজিত বাংলাদেশে বসবাস করছি। আমাদের মতে, এই বিষয়টা উপলব্ধি করলেই ফের লড়াইয়ের দিশা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।

 

বাংলাদেশের মানুষ সাময়িকভাবে পরাজিত হয়, কিন্তু পরাজয় মেনে নেয় না। এরা লড়তে থাকে, লড়তে থাকে, লড়াই করে যতক্ষণ না বিজয় অর্জিত হয়। শেষ বিচারে জনগণের শত্রুরাই পরাজিত হবে, জনগণ আবারো বিজয়ী হবে। মুক্তিযোদ্ধারা ফের বিজয়ী হবে।

      

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ