Banner
সমাজতন্ত্র অভিমুখী বিপ্লবের স্থানপর্ব, কালপর্ব ─ ইমাম গাজ্জালী

লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ October 25, 2017, 12:00 AM, Hits: 1363

 


ইউরোপের প্রকল্প

 

বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কিংবা সমাজতন্ত্র অভিমুখী বিপ্লবের কালপর্বকে সাধারণভাবে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এর প্রথম কালপর্বটি হল মহান অক্টোবর বিপ্লব কেন্দ্রিক। যেখান থেকে পরবর্তীতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনা। শ্রমিকদের রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা আরো আগে, প্যারি কমিউন থেকে শুরু। ইউরোপজুড়েও দেখা দিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব প্রচেষ্টা। এ কারণেই কমিউনিস্ট ইশতেহারের প্রথমেই জানান দেওয়া হয়েছিল, ‘ইউরোপ ভুত দেখছে, কমিউনিজমের ভুত’। কিন্তু কমিউনিজমের এই ভুত তখনো এশিয়ায় দেখা যায়নি, দেখা যায়নি আফ্রিকায় কিংবা ল্যাটিন আমেরিকায়।

 

সারা ইউরোপে তখন বিকশিত হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য শ্রমিক আন্দোলন। প্রবল শক্তি নিয়ে জেগে উঠেছিল এসব শ্রমিক, কিছুদিন আগেও তারা ছিল ভূমিদাস, মহান ফরাসী বিপ্লব যাদের ভূমির দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল, কিংবা বুর্জোয়ারা যাদের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়ে বুর্জোয়া বিপ্লবে শামিল করেছিল, আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণিই আবার তাদের শ্রম শোষণের নতুন শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে। বুর্জোয়া বিপ্লবে লড়াকু সৈনিক হিসেবে যে সমাজটি এসব ভূমিদাসরা নির্মাণ করেছিল, সেই সমাজের শোষণ উচ্ছেদে এদের লড়াই ছিল শতভাগ ন্যায্য, শতগুণ তেজি।

 

এসব শ্রমিক ছিলেন শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতি। যুগটা ছিল ক্লেদাক্ত পথে পুঁজি গঠনের যুগ। এটা ঠিক যে, পৃথিবীতে পুঁজি সাধারণত ক্লেদাক্ত পথেই গঠিত হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন শক্তি নিয়ে ইতোপুর্বে আর কোনো শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেনি। এই শ্রমিক আন্দোলন এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল যে, এতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল পৃথিবীতে একটা নতুন শ্রেণির, নতুন শক্তির উদ্বোধন ঘটে গেছে। তাদের হাতেই ভুবনের ভার ছেড়ে দিতে হবে। এ ছাড়া যেন আর কোনো গত্যন্তর নাই। এই শক্তিটাকে ব্যাখ্যা করা জরুরি হয়ে উঠেছিল। এরই প্রেক্ষাপটে ১৮৪৭ সালের নভেম্বরে শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘কমিউনিস্ট লীগ’ এর কংগ্রেস বসে লন্ডনে। লন্ডনের কংগ্রেস থেকে মার্ক্স-এঙ্গেলসকে ভার দেওয়া হয় কমিউনিস্ট পার্টির একটি বিশদ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কর্মসূচি রচনার জন্য। সেই নিরিখ থেকেই লিখিত হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার। কীভাবে শ্রমিকরা ক্ষমতা নিতে পারে, সেই ক্ষমতা নেওয়ার ন্যয্যতা কোথায়, তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ঝোঁক কোনদিকে, সেটাও উল্লেখ আছে কমিউনিস্ট ইশতেহারে। ‘আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্য আগতপ্রায় অবসান ঘোষণা করাই ছিল ইশতেহারের লক্ষ্য।’

 

এখানে ইউরোপজুড়ে গড়ে ওঠা শ্রমিক আন্দোলনকেই আন্তর্জাতিকতার অভিধা দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, তখন এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় এ ধরনের কোনো শ্রমিক আন্দোলনের অস্তিত্ব ছিল না। অপ্রতিরোধ্য শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ হল ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতি। অপরদিকে, ইউরোপের রেনেসাঁর ধারণার সঙ্গে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার অবসানের তত্ত্বগত অগ্রগতিই হল কমিউনিজম। সেই কালপর্বে কমিউনিজম প্রধানত: ছিল ইউরোপের প্রকল্প, যেটাকেই ব্যাখ্যায় এনেছেন মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন। সেখান থেকেই দুনিয়াকে দেখা হয়েছে। এটা ঠিক যে অগ্রসর জায়গা থেকেই পৃথিবীর ব্যাখ্যা চলে। উঁচু জায়গা থেকেই বেশি জায়গা নজরে আসে।

 

 
জাতিগত মুক্তির লড়াইয়ের কালপর্ব

 

বিশ শতকজুড়ে উপনিবেশিক দেশগুলোতে জেগে ওঠে জাতিগত মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। দেশে দেশে জাতিগত মুক্তির লড়াই প্রবল হয়ে ওঠে। তীব্রতর হয়ে উঠে জাতীয়তাবাদী আবেগ আর স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজী রেখে লড়বার সাহস। আঠারো শতকে এসব দেশ উপনিবেশে চলে যাওয়ার পর সেখানে বেশকিছু শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। নির্মিত হয় রেললাইন, টেলিফোন, বিদ্যুৎসহ অর্থনৈতিক অবকাঠামো। সেইসঙ্গে গড়ে ওঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সঙ্গতকারণে সৃষ্টি হয় শ্রমিক শ্রেণির ও শিক্ষিত সমাজের। যেমন, ১৮৪৩ সাল থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত ভারতে কয়লা খনিতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৩০,৭৭৩ জন, চা বাগান শিল্পে ১৮৩৯ সাল থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪,০৬,০৮৯ জনে, পাটকলে ১৮৫৪ সাল থেকে  ১৮৮০ সালের মধ্যে শ্রমিকের সংখ্যা ২৭,৪৯৪ জনে উন্নীত হয়। এছাড়া কাপড় কলে ১৮১৮ সাল থেকে ১৮৮৬ সালের মধ্যে ৭৪,০০০ জনে উন্নীত হয়। অপরদিকে, ১৮৬২ সালে শুধু হাওড়া স্টেশনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১২০০ শ্রমিক ধর্মঘটে অংশ নেয়। এ ঘটনার দুই যুগ পর ১৮৮৬ সালের আমেরিকার হে মার্কেটে একই দাবিতে ধর্মঘট হয়েছিল। যে দিনকে ‘মহান মে দিবস এবং আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিশেবে পালন করা হয়। এদিক থেকে হাওড়ার শ্রমিক ধর্মঘটটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এই ধর্মঘট থেকে ওই সময় ভারতবর্ষে শ্রেণি হিসেবে শ্রমিকদের বিকাশ আঁচ করা যায়।

 

অপরদিকে, ভারত স্বাধীন হওয়ার বছর চারেক আগে ১৯৩৯ সালে বিভিন্ন শিল্পে নিযুক্ত দেশটিতে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল, ১৭,৫১,১৩৭ জন। আর ১৯৪৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২৬,৪২,৯৭৭ জনে। ১৯৪২-৪৩ ও ১৯৪৪-১৯৪৫ সালে রেজিস্ট্রিকৃত ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬৯৩ ও ৮৬৫; ওই দুই সালে রেজিস্ট্রিকৃত ইউনিয়নগুলির সদস্য সংখ্যা ছিল যথাক্রমে, ৬,৮৫,২৯৯ ও ৮,৮৯,৩৮৮। ১৯৩৯ সালে কৃষক সভার সদস্য সংখ্যা ৮,০০,০০০-এ উন্নীত হয়েছিল।

 

শ্রমিক শ্রেণির এই বিকাশ শ্রেণি সংগ্রামের পাশাপাশি উপনিবেশিক দেশগুলোর জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত করে দেয়। কিন্তু শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে জাতীয় সংগ্রামের মেলবন্ধন ঘটাতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হন সেখানকার ক্রিয়াশীল কমিউনিস্টগণ। এদের কারো কারো মধ্যে জাতীয় সংগ্রামকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের থেকে নিজেদের পার্থক্য রাখেন নি। পাশাপাশি তারা শ্রেণিসংগ্রামকেও করে তুলেছেন গুরুত্বহীন। আবার কেউ কেউ বিশুদ্ধ শ্রেণি সংগ্রামকে সংগঠিত করতে গিয়ে জাতীয় সংগ্রামকেই গুরুত্বহীন করে তুলেছেন।

 

উদাহরণ স্বরূপ, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (১৯ জুলাই-৭ আগস্ট, ১৯২০) এসব প্রশ্নে লেনিনের উপস্থাপনা ছিল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং কমিউনিস্ট দলগুলি উপনিবেশ এবং পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনকে অবশ্যই সমর্থন জানাবে তবে এই শর্তে যে, সর্বহারা আন্দোলনের স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতা, যত ভ্রুণ আকারেই থাকুক না কেন, তা বজায় রাখতে হবে। ‘এই শর্তে যে, …. সেখানকার কৃষক ও ব্যাপক মেহনতী জনগণকে বিপ্লবী প্রেরণায় শিক্ষিত ও সংগঠিত করার কাজে ওই আন্দোলনের প্রতিনিধিরা আমাদের বাধা দেবে না।’

 

অপরদিকে লেনিনীয় তত্ত্বের বিরোধিতা করে ওই কংগ্রেসে উপস্থিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি এমএন রায়ের মত ছিল,

 

‘শোষক দেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণি এবং উপনিবেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে, যার ফলে প্রায়শই দেখা যায় যে, শোষিত দেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণি জাতীয় আন্দোলনের সমর্থক হয়েও সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করে। অর্থাৎ সমস্ত বিপ্লবী সংগ্রাম এবং বিপ্লবী শ্রেণির বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে তাদের সঙ্গে হাত মেলায়।’

 

এই ধরনের তত্ত্বায়নের প্রভাবে ভ্রুণেই শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে জাতীয় সংগ্রামের মেলবন্ধনের সুযোগটি মার খেয়ে যায়। প্রায় একই ধরনের তত্ত্বগত বিভ্রান্তি লক্ষ করা গেছে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে কমিউনিস্টদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে। জাতীয় মুক্তির কালপর্বে উপনিবেশিক দেশে দেশে যেখানে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটে, সেখানে সমাজতন্ত্র অভিমুখি বিপ্লব সাধিত হয়েছে। যেমন চীন, ভিয়েতনাম ইত্যাদি। এই কালপর্বে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা দেখেছিল কমিউনিজমের ভুত। অপরদিকে, যেসব উপনিবেশিক দেশে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব দিতে সফল হননি, সেখানে সময় তাদের জন্য বসে থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর পৃথিবী থেকে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটে। সেইসঙ্গে জাতীয় মুক্তির কালপর্বে সমাজতন্ত্র অভিমুখী বিপ্লবের সুযোগ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ইতিহাস পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রবেশ করে।


 

স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর কমিউনিস্ট আন্দোলন

 

ব্রিটিশরা এখানে যে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রটি সৃষ্টি করেছিল তা কিন্তু নিজ দেশে তৈরি করেনি। সেখানে গড়ে তুলেছিল জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক প্রশাসন। তারা এখানে যেভাবে লুটতরাজ, নির্যাতন, দুর্বৃত্তায়ন শুরু করেছিল তা কিন্তু একইভাবে নিজ দেশে করেনি। নিজ দেশের ক্ষেত্রে তাদের নজর ছিল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো সমুন্নত রাখা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলা – ইত্যাদির দিকে। অর্থাৎ তারা উপনিবেশের জন্য ছিল সাক্ষাৎ দুর্বৃত্ত, আর নিজ দেশের জন্য ছিল উদারনৈতিক গণতন্ত্রী। এদেশে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি ছিল তাদের অনুগত দালাল শ্রেণি ও তাদের সৃষ্ট আমলাতন্ত্র। প্রবল আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার সময় অনেকটা আপসরফার মাধ্যমে এই অনুগতদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যায়। আর রেখে যায় তাদের সৃষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রশাসন। শাসন ক্ষমতা হাতে পেয়েই এই অনুগত শ্রেণিটি শোষণ-নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার পূনরুজ্জীবন ঘটায় এবং অবাধ লুটতরাজ জারি রাখে। যে কাজটি সাম্রাজ্যবাদীরা করতো বাইরের দেশ থেকে এসে, একই কাজ নিজ দেশে আরো নিষ্ঠুর, আরো পাশবিক, আরো হিংস্রভাবে করা শুরু করে দেশীয় এই শাসকেরা। এ কথাটি শ্রীলঙ্কাসহ উপমহাদেশের সকল দেশের ক্ষেত্রেই খাটে। যে রাষ্ট্র প্রশাসন এখনো জারি আছে, যার ভার এখনো আমরা বহন করে চলেছি সেই রাষ্ট্র হল প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদী যুগের ইতিহাসের আবর্জনা। ব্রিটিশসৃষ্ট এই রাষ্ট্র ও তার আমলাতন্ত্র এবং অনুগত শাসক শ্রেণি যে কোনো দেশের অগ্রগতির বাধা স্বরূপ। কী সমাজতন্ত্র, কী গণতন্ত্র, কোনো পথেই এই বাধা অপসারণ না করে কোনো জাতি কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। এই দেশীয় শাসকদের উচ্ছেদের কর্তব্য হল প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম।

 

আমাদের মতে, ইউরোপের দেশে দেশে যেভাবে আধুনিক পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল, যে ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, বাংলাদেশসহ এসব স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশসমূহে সেভাবে পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজ ও রাষ্ট্র এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেনি। তবে ইউরোপের মত না হলেও এসব দেশে আধুনিক সমাজের আদলে এক ভিন্ন ধরনের বিকৃত, অনুন্নত, অপরিপক্ব আধা খেচড়া আধুনিক সমাজ ও বুর্জোয়া রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। তারপরেও এসব দেশের শাসক শ্রেণি নানা বিকৃতি ও সীমাবদ্ধতাসহ বুর্জোয়া শ্রেণি। এই শ্রেণিটিই জারি রেখেছে শোষণ, লুটতরাজ, চুরিচামারি আর নির্যাতন। তাদের ওপর ভর করেই জারি আছে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। তাদের উচ্ছেদ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ সম্ভব নয়। এই দেশীয় শাসক শ্রেণি উচ্ছেদের ধারায় এসব দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পারে। শুধু শোষণ-লুণ্ঠন ও নির্যাতনই নয়, এদের অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনা মানুষকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে। অফিস আদালত ও হাসপাতালের ঘুষ-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, প্রশ্নফাঁস, যানজট, লোডশেডিং এবং পরিবেশ ধ্বংসের নানা আয়োজন এক অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এদের হাতে শুধু মানুষই তার নিজ জায়গা থেকে উচ্ছেদ হচ্ছে না পাশাপাশি নদী, পাহাড়, বন, বাতাস, পানি, মাটি সবকিছুই দূষিত, দখল ও উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। উন্নত পুঁজিবাদী দেশেও এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেসব দেশে ব্যাপক শোষণ থাকলেও জনগণের অনেক মৌলিক চাহিদার দায় নিতে রাষ্ট্র অনেকটা সক্ষম হয়েছে। তাই বিপ্লবের দায় কম অনুভব করছে সেসব দেশের জনগণ, এমনকী মেহনতী জনগণও। ওইসব দেশের জনগণের মধ্যে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে সেখানকার শাসকশ্রেণি।

 

অপরদিকে, আমাদের মত দেশকে এক একটা নরক তৈরি করে রেখেছে দেশীয় শাসকেরা। মানবাধিকার, এনজিও ও ধর্মীয় জিগিরসহ নানা প্রেসক্রিপশন দিয়েও পরিস্থিতির কোনো উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। বিপ্লব ছাড়া এসব দেশের জনগণের সামনে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ খোলা নাই। পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে অনিবার্যভাবে বিপ্লবের ভরকেন্দ্র হল উপনিবেশের শৃঙ্খলমুক্ত এই স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশগুলো। পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে এসকল দেশে বিপ্লবের জন্য সময়ের দাবি হল ভিন্ন রণনীতি ও ভিন্ন রণকৌশল। প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদের যুগের রণনীতি-রণকৌশল দিয়ে এ যুগে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ উচ্ছেদ সম্ভব নয়। পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগের ভিন্ন রণনীতি ও ভিন্ন রণকৌশল নির্মাণের জন্য দরকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী পূনর্গঠন।

 

এই যুগ হল লেনিনোত্তর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী পূনর্গঠনের যুগ। লেনিনোত্তর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিচারমূলক পর্যালোচনা ও সারসংকলনের যুগ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র পতন থেকে শিক্ষা নেওয়ার যুগ। এই যুগ হল কমিউনিস্ট আন্দোলনের পূনরুত্থান ও পূনরুজ্জীবনের যুগ। লেনিনোত্তর রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভ্রান্ত রাজনৈতিক তত্ত্বগত লাইনকে বিচারমূলক পর্যালোচনা করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের রেনেসাঁ সৃষ্টির যুগ।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ