Banner
আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জাসদ-বাসদের রাজনীতি — ইমাম গাজ্জালী

লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ October 31, 2020, 12:00 AM, Hits: 2191

                    

নিউক্লিয়াস পর্ব

গত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল পূর্ব বাংলার উত্থানপর্ব, ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যার সূচনাবিন্দু এবং ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলন একটি মাইলস্টোন। শিক্ষা আন্দোলন একটি নতুন শক্তির উত্থান-বার্তা জাতিকে জানান দিয়েছিল। সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে তদানীন্তন পূর্ববাংলায় নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে একটি অপ্রতিরোধ্য তরুণ প্রজন্মের উত্থান ঘটে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই রাজনীতিতে যুক্ত হন স্কুলছাত্র আ ফ ম মাহবুবুল হক।

সেই তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই স্বাধিকারের রাজনীতি পরিণতির দিকে যাত্রা শুরু করে, তাদের মানসজমিনেই বপিত হয়েছিল ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ এবং ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাঙলার’ রাজনীতি। ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্র ইউনিয়ন মেননগ্রুপের জনসভায় ১১ দফা কর্মসূচি ভিত্তিক ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’র ঘোষণা দেওয়া হয়। আর অপরদিকে, ১৯৭০ সালের ২১ আগস্ট ছাত্রলীগে নিউক্লিয়াসপন্থী নেতা স্বপন কুমার চৌধুরীর ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’-এর প্রস্তাব সংগঠনের ৪৫ জনের মধ্যে ৩৬ জন সমর্থন করেন। ৯ জন সমর্থন করেননি। সে কথায় পরে আসছি।

ওই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে এই দুইটি অংশই ছিল সবচেয়ে অগ্রসর। তারাই পুরো ছাত্র সমাজের মধ্যে স্বাধীনতার ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। সেখানে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ রাজনীতির উন্মেষ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক। ছাত্রলীগের অন্যতম নিউক্লিয়াসপন্থি নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী ছিলেন ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ এর প্রস্তাবক। ছাত্রনেতা মাহবুবুল হক ছিলেন সেই ধারার অন্যতম বলিষ্ঠ প্রবক্তা ও ছায়াদায়ী বটবৃক্ষ। উল্লেখ্য, ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’-এর রাজনীতি সেই সময়ে অধিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসের এই কালপর্বে আ ফ ম মাহবুবুল হকের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের নিউক্লিয়াস, পরবর্তিতে সেই নিউক্লিয়াসের অন্যতম সদস্য ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক। বস্তুত এই নিউক্লিয়াসই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের (বুর্জোয়া প্রধান ধারার) অস্থি-মজ্জা-অন্তঃসার।

ওই সময়ের ছাত্রলীগে দুইটি ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল: ১. স্বাধিকারপন্থি ধারা ২. স্বাধীনতাপন্থি ধারা। নিউক্লিয়াসের নেতারাই ছাত্রলীগের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। তাদের নেতৃত্বেই স্বাধীনতাপন্থি ধারাটি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। নিউক্লিয়াসের প্রভাবেই ছাত্রলীগের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতারাও স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য হন। একই কথা কমবেশি শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রেও খাটে।

অপরদিকে, ছাত্রলীগের স্বাধিকারপন্থী ধারার সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপের ধারার সঙ্গে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। উভয়গ্রুপ ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে লেনিন-গামা প্যানেলে নির্বাচন করেছিলেন। এমনকি বাকশাল গঠনকালে একই সংগঠনে বিলীন হয়েছিলো। কিন্তু ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী বা নিউক্লিয়াসপন্থী ধারার সঙ্গে স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক পূর্ববাংলার (মেননগ্রুপের) কোনো অংশের বোঝাপড়া তৈরি হয়নি। তেমন সুযোগ আসলেও কাজে লাগানো হয়নি। বরং তারা সব সময় বিরোধাত্মক অবস্থানেই থেকেছে।

নিউক্লিয়াস ও শেখ মুজিবুর রহমান

ছাত্রলীগের আভ্যন্তরে চরিত্রে ও বৈশিষ্ট্যে আলাদা থাকলেও, নিউক্লিয়াস প্রভাবিত অংশটি ভ্রূণ আকারে হলেও আওয়ামী লীগের এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের বিপরীতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য অবস্থান বজায় রাখেননি। বরং নিউক্লিয়াসপন্থিরাই শেখ মুজিবুর রহমানের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বের ভাবমূর্তি বা কাল্ট গড়ে তুলেছেন। তারা শেখ মুজিবের মধ্যে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বা চে গুয়েভারার ছায়া দেখতে চেয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ছাত্রলীগে নেতৃত্ব এবং আদর্শগত বিরোধের জের ধরে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় নিউক্লিয়াসপন্থিদের। কারণ উভয়ের পথ ও আকাঙ্ক্ষায় ভিন্নতা ছিল।

স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তোলার পর্বে নিউক্লিয়াসপন্থিরা নিজেদের ইচ্ছামত সংগঠন গড়ে তোলার বাধাহীন সুযোগ পেয়েছিলেন। কারণ আন্দোলনে দুর্বৃত্ত শক্তির চেয়ে জনগণের শক্তির আবেদন বেশি অনুভূত হয়। তবে রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোতে জনগণের শক্তি ক্ষমতাবান দুর্বৃত্তদের কাছে সহনীয় হয় না। তাই শাসনকাঠামো থেকে নিউক্লিয়াসপন্থি তরুণদের আলাদা করতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সামান্যতম দেরীও করা হয়নি। ফলে আলাদা অবস্থান নিতে বাধ্য হন নিউক্লিয়াসপন্থিরা। আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব থেকে আলাদা অবস্থান নিতে বাধ্য হতে গিয়েই জাসদের জন্ম। এভাবেই নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক পরিণতি ও সাংগাঠনিক প্রকাশই হল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল — জাসদ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হাড়ে হাড়ে জাসদকে চিনেছে, কিন্তু জাসদ নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে চেনে নাই, তখন এবং এখন। 

নিউক্লিয়াসের অবদান : অবিভক্ত ছাত্রলীগে শুধু ‘স্বাধীনতার ভ্যানগার্ড’ই ছিলেন না, নিউক্লিয়াস অংশের নেতারা ছয় দফা অনুমোদন করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাদের বাধ্য করেছিলেন। ‘জয় বাংলা ‘ স্লোগান তাদেরই সৃষ্টি। জাতীয় সঙ্গীত তারাই নির্ধারণ করেছিল, জাতীয় পতাকাও এই অংশের নেতারাই ডিজাইন, তৈরি ও উত্তোলন করেছিলেন। ‘বাংলাদেশ’ নামটাও এদেরই পরিকল্পনা। স্বাধীনতার ইশতেহার এই অংশের নেতারাই পাঠ করেছিলেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা প্রায় উপনিবেশিক কায়দায় শোষিত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তনের মানুষকে এতকিছু অনন্য উপহার দিয়েছিলেন তারাই। ১৯৬৮ সালে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার মধ্যে ছয় দফা হুবহু সংযুক্তি এই নিউক্লিয়াসপন্থিদেরই প্রয়াশ।

জাসদ গঠনকালের সময় : সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে গঠিত হয় জাসদ। সদ্য মুক্তিযুদ্ধোত্তর দেশে সে সময়ে ছিল একটা ভিন্ন মেজাজ। নয় মাস যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছিল নতুন দেশ গড়ার স্বপ্ন। পাকিস্তানি রাষ্ট্র ও শাসকদের নিপীড়নের কারণেই শুধু নয়, সেই নতুন স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার কারণেও তারা স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আর সেই সঙ্গে ছিল অসম্ভব প্রভাব বিস্তারকারী এবং শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র রাশিয়া ও চীনের উপস্থিতি। বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার। ভিয়েতনামে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে, কিউবাতে বিপ্লব ঘটে গেছে, আলজেরিয়া স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, চীনে মাওসেতুংয়ের নেতৃত্বে চলছে সাংস্কৃতিক বিপ্লব। সব মিলে সময়টা ছিল প্রবল স্বপ্নজাগানিয়া যুগ। সেই সঙ্গে ছিল যুদ্ধ করা তারুণ্যের টগবগে সাহস। যে কোনো কিছু ভাঙতে কিংবা গড়তে যারা ছিল পুরোপুরি প্রস্তুত। সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বাভাবিক সময়ে এমন পরিস্থিতি দৃশ্যমান থাকে না।

অসমাপ্ত বিপ্লবের জের : স্বপ্নগর্ভ সময়ে যুদ্ধ শেষের স্বপ্নভঙ্গে বিগত যুদ্ধের আরেকটা অভিঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। অসমাপ্ত বিপ্লবের জের ধরে আরেকটি বিপ্লবের দাবি সমাজ দেহে তীব্রভাবে অনুভূত হতে থাকে, যাকে পথভ্রষ্ট করা যায় কিন্তু এড়ানো যায় না। প্রতিটি বিপ্লবের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটতে দেখা গেছে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তেমন একটি অনিবার্য অভিঘাত সংঘটিত হয়েছিল জাসদের নেতৃত্বে, জাসদ ওই বিপ্লবের ডাক এড়াতে পারেনি, তবে জাসদের হাতেই ওই বিপ্লব পথভ্রষ্ট হয়েছে। ওই বিপ্লবী কাজটাকে এগিয়ে নেবার মত আর কোনো বামপন্থী বা কমিউনিস্ট শক্তি সমাজে তখন ছিল অনুপস্থিত। কমিউনিস্টদের একাংশ গাঁটছড়া বেধেছিল তদানীন্তন সরকারের সঙ্গে, আরেকাংশ মুক্তিযুদ্ধে বিভ্রান্তিকর ভূমিকা ও বিভ্রান্তিকর তত্ত্বগত লাইন গ্রহণের কারণে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। আর ইতিবাচক অপরাপর যে সকল শক্তি ছিল, সেগুলোর পক্ষে সেই নেতৃত্বের ভার নেওয়ার মত শর্ত ও সঙ্গতি ছিল না। সুতরাং জাসদকেই নিতে হয় মুক্তিযুদ্ধ নাতিদীর্ঘ হওয়ার কারণে অসমাপ্ত থাকা সেই বিপ্লবের দায়।

এবার আসি অসমাপ্ত বিপ্লবের অভিঘাতের কথায়। উদাহরণ স্বরূপ, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ঘটনাতেই তার প্রমাণ মেলে। ১৯১৭ সালের রাশিয়াতে সংঘটিত ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয় বুর্জোয়াদের নানা ধারার কোয়ালিশন-সাময়িক সরকার। সেই সাময়িক সরকারে যোগ দেওয়ার প্রবণতা ছিল বলশেভিক পার্টির প্রত্যেক নেতার, শুধু বাধ সেধেছিলেন ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন। তিনি তখন বলশেভিক পার্টির নেতাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, ‘বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে যে শোষণ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছে, তা পূরণ করা সাময়িক সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি ওই সরকারের সঙ্গে থেকেও মেহনতিদের দাবি ও স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নয়। ‘আবর্জনাদের’ সঙ্গে নিয়ে ভাল কোনো কিছু করা যায় না। তাতে লেজে গোবরে হয়ে, হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দুর্বৃত্ত নেতৃত্বের অপকর্মের দায় নিতে হয়। সেটা আরো উদ্ভট, আরো বিশ্রি ব্যাপার হতে পারে। মানুষের সেই স্বপ্নপূরণ একমাত্র বলশেভিকদের নেতৃত্বেই সম্ভব। বরং কোয়ালিশন সরকারকে বলতে হবে, ‘ক্ষমতা তো পেয়েছো, এবার প্রতিশ্রুতিগুলো পালন কর।’

ওই সময় লেনিন লিখলেন ‘এপ্রিল থিসিস’, লিখলেন ‘দূরের চিঠি’। তিনি বলশেভিক নেতাদের দেখালেন আরেকটি আসন্ন অভিঘাতের ইঙ্গিত, বোঝালেন তার অনিবার্যতার কথা। বললেন, বিপ্লবের প্রথম পর্যায়টিই কেবল সম্পন্ন হয়েছে, যাতে ক্ষমতা গেছে বুর্জোয়াদের হাতে। বললেন, সাময়িক সরকারকে বিশ্বাস করা চলবে না। তিনি এই কর্তব্য হাজির করলেন যে, বুর্জোয়াদের ক্ষমতায় পাকা হয়ে বসার সুযোগ দেওয়া চলবে না। সর্বোপায়ে লড়তে হবে সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার জন্য, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে বিধ্বস্ত করতে হবে এবং তৈরি হতে হবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য। তখন সাময়িক সরকারে যোগ দেওয়ার বাসনা থেকে দলকে বিরত রাখলেন। এদিকে আলেকজান্ডার ফিদরোভিচ কেরেনস্কি সরকারের কাছে শোষিত জনতার মার খাওয়া আকাক্সক্ষাগুলো পরিণত হল ক্ষোভে, ক্ষোভ ক্রমেই ধুমায়িত হতে থাকল। আরেকটি বিস্ফোরণ পেকে উঠতে থাকল, মাত্র সাত মাসের মাথায় সংঘটিত হল মহান অক্টোবর বিপ্লব। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে উচ্ছেদ হল জার সরকার, তার সঙ্গে জমিদার, কুলাক। পরের বার (রাশিয়ার সনগণনা অনুয়াযী ২৫ অক্টোবর) উচ্ছেদ হল বুর্জোয়া শ্রেণিসহ জমিদার ও কুলাকদের স্বমূল। তখন সমাজটাকে খোল-নলচে পাল্টিয়ে ফেলার আয়োজন শুরু করা সম্ভব হল। লেনিন সাময়িক সরকারকে জেঁকে বসার সুযোগ দেননি। ‘যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুর্ণগঠনের জন্য সময় ও সুযোগ দিতে হবে, নিশ্চয়ই তারা ভাল কিছু একটা করতে পারে’- এমন মতে তিনি মোটেই বিশ্বাসী ছিলেন না। সময়ের কাজ আগে নয়, পিছে নয়, এক্কেবারে ঠিক সময়েই করতে হবে; মহামতি লেনিন তা বুঝতে পেরেছিলেন। একেই বলে নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি।

নিস্তরঙ্গ হল অসমাপ্ত বিপ্লব: বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একাত্তরের আপাত বিজয়ের আরেকটি অভিঘাত ছিল সময়ের দাবি, মুক্তিযুদ্ধের ভেতরের শক্তিরই অসমাপ্ত বিপ্লবের নেতৃত্ব দেওয়ার অথরিটি তৈরি হয়। লড়াইয়ের মূলধারার বাইরের কোনো শক্তির পক্ষে কি সেই দাবি পূরণ করা সম্ভব? ইতিহাস তা বলে না। সেটা কি সেই সময়ের কোনো দল বা নেতা বুঝতে পেরেছিলেন? আমাদের চোখে পড়েনি। সশস্ত্র যুদ্ধের ভেতরের আপসহীন শক্তি ছাড়া সেই দাবি কে পূরণ করতে পারে? সেই দাবি পূরণে নেতৃত্বের ন্যায্যতা কার হতে পারে? সেই দাবি পূরণে জাসদ ছাড়া আর কোনো শক্তি কি সমাজে উপস্থিত ছিল? থাকলে তারা এতবড় শক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারলেন না কেন? সময়ের সমান্তরালে জাসদের কি প্রস্তুতি ছিল? মুক্তিযুদ্ধে অসমাপ্ত থাকা সেই সমাজ বিপ্লবের কঠিন কর্তব্য সমাধানের জন্য নিউক্লিয়াস থেকে সেই প্রস্তুতি কতটুকু ছিল, তা কি যথেষ্ট ছিল? আওয়ামী লীগ ও স্বাধিকারপন্থি ছাত্রলীগের সঙ্গে নিউক্লিয়াসপন্থিদের আচরণে, স্বভাবে ও ¯স্লোগানে পার্থক্য ছিল, ভ্রূণ আকারে হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রামাণ্য (Documented) স্বতন্ত্র অবস্থান ছিল কি? এখানে শুধু প্রশ্নই রাখা হলো, উত্তর খুঁজবেন এ বিষয়ে আগ্রহীরা।

বাস্তবতা হলো, সেই সময়ে অসমাপ্ত বিপ্লবের দায় পড়েছিল জাসদের কাঁধেই। ষাটের দশকে জেগে ওঠা তারুণ্যের মূলধারা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছিল জাসদের খাতে। জাসদ হয়ে উঠেছিল সাহসীদের সংগঠন। এই কালপর্বে অমিত তেজ আর স্পর্ধিত সাহস নিয়ে ঝলছে উঠেছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক। তার সাহস তখন কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। এইপর্বে তিনি নিউক্লিয়াসপন্থিদের নেতৃত্বের কাতারে চলে আসেন। অনেকের মুখে এটাও শুনেছি যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তার মতো সাহসী ও আদর্শনিষ্ঠ ছাত্র নেতা প্রত্যক্ষ করেনি বাংলাদেশ।

লেনিন থেকে কতটুকু নিতে পারলেন সিরাজুল আলম খান : ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর এপ্রিলে যখন মস্কোতে আসলেন লেনিন, তিনি আন্দোলনকারীদের কাছে হাজির করেছিলেন ৮ দফা (এপ্রিল থিসিসের)। সেখানে তিনি এই কর্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন যে, সাময়িক সরকারকে সমর্থন নয়। বিপ্লবের প্রথম পর্বে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে বুর্জোয়াদের হাতে, এই পর্যায় অতিক্রম করে দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্বে, এই পর্বে ক্ষমতা অবশ্যই প্রলেতারিয়েত এবং কৃষকদের সবচেয়ে গরিব অংশগুলোর হাতে হস্তান্তরিত হবে। দাবি তুললেন, পুলিশ সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের বিলোপসাধন করতে হবে। সকল কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়া চাই, তারা সবাই হবেন যেকোন সময় অপসারণযোগ্য, তাদের কারও বেতন একজন দক্ষ শ্রমিকের গড় মজুরি অতিক্রম করতে পারবে না। দেশের সমস্ত ভূমির রাষ্ট্রীয়করণ, ভূমির বিলিব্যবস্থা স্থানীয় ক্ষেতমজুর এবং কৃষক সোভিয়েতগুলির হাতে হস্তান্তর করতে হবে। দেশের সকল নিয়ন্ত্রণ থাকবে শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতের হাতে।

লেনিন দেখালেন, ‘যতদিন এই সরকার বুর্জোয়াদের প্রভাবের কাছে বশ্যতাস্বীকার করছে ততদিন আমাদের কাজ হলো ধৈর্যসহকারে অবিচলিত চিত্তে এবং অধ্যবসায়ের সাথে তাদের কর্মকৌশলের ভ্রান্তিগুলোর ব্যাখ্যা তুলে ধরা, যে ব্যাখ্যা জণগণের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব প্রয়োজনগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। তাদের সমালোচনা আর ভুলভ্রান্তি উদঘাটনের কাজ চালিয়ে যাওয়া, শ্রমিক শ্রেণির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেওয়ার আবশ্যকতার কথার প্রচার, যাতে করে জনগণ তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের ভুলগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।’

অপরদিকে, সিরাজুল আলম খান উপস্থাপন করলেন ১৫ দফা, সেটা শাসকেরই হাতে। সেখানে পুলিশ বাহিনীর নামের বিলোপের কথা বললেন, উপনিবেশিক আমলের প্রশাসন বদলের কথা বললেন, প্রতিরক্ষা বাহিনী দিয়ে পিপলস আর্মি গঠনের কথা বললেন, তাদের দিয়ে কৃষক ব্রিগেড ও শ্রমিক ব্রিগেড গঠনের কথা তুললেন। দাবিতে তুললেন, সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত হবে ১:৭। সমবায় অর্থনীতির কথা বললেন। খসড়া দাবি তুললেন, কোনো দেশের অনুকরণ না করে নয়। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দল ও গ্রুপের প্রতিনিধিদের নিয়ে ‘সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করার। এসবই ইতিবাচক। কিন্তু এসব দাবি উপেক্ষিত হলে কী করবেন, তা আর বললেন না। তার জন্য প্রস্তুতও ছিলেন না। এখানে এপ্রিল থিসিসের দাবি এবং ১৫ দফা দাবির তুলনামূলক বিচারের জন্য তুলে ধরা হল।

এপ্রিল থিসিসের দাবি

১. লুভোব এন্ড কোং এর নতুন সরকারের পুঁজিবাদী চরিত্রের কারণে যুদ্ধটা এই সরকারের অধীনে রাশিয়ার দিক থেকে প্রশ্নাতীতভাবে লুটেরা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধই রয়ে গেছে, সেহেতু এই যুদ্ধের প্রতি আমাদের মনোভাবের দিক থেকে তথাকথিত ‘বৈপ্লবিক প্রতিরক্ষাপন্থা’-কে সামান্যতম ছাড় দেওয়া চলবে না। বৈপ্লবিক প্রতিরক্ষাপন্থা যথার্থই সমর্থনীয় এমন একটা বিপ্লবী যুদ্ধকে শ্রেণীসচেতন প্রলেতারিয়েত সমর্থন দিতে পারে কেবলমাত্র দুটো শর্তে: (ক) ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে প্রলেতারিয়েত এবং প্রলেতারিয়েতর সাথে মৈত্রীবদ্ধ কৃষকদের সবচেয়ে গরিব অংশগুলোর হাতে; (খ) কথায় নয় কাজে সমস্ত পররাজ্য দখল বর্জন করা হবে। (গ) সকল প্রকার পুঁজিবাদী স্বার্থের সাথে বাস্তবে পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদ ঘটান হবে।

ওই সব বৃহৎজন অংশ যারা বৈপ্লবিক প্রতিরক্ষাপন্থায় গণহারে বিশ্বাসী, যারা যুদ্ধটাকে পরদেশ দখলের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেন না, যারা যুদ্ধটাকে নিতান্তই একটা আবশ্যকতা হিসেবে গ্রহণ করেন, তারা বুর্জোয়াদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছেন ঘটনা এমন হলে, বিশেষ স্পষ্টতার সাথে, অধ্যবসায় আর ধৈর্য সহকারে তাদের কাছে তাদের ভুল ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, পুঁজি এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মধ্যে বিদ্যমান অবিচ্ছেদ্য সংযোগ সম্পর্কটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন, আর এটা প্রমাণ করা প্রয়োজন যে, পুঁজির উচ্ছেদ ব্যতিরেকে বলপ্রয়োগে চাপানো নয় এমন চরিত্রের যথার্থ শান্তি দিয়ে এই যুদ্ধের অবসান ঘটান অসম্ভব।

যেসব ফ্রন্টে যুদ্ধটা চলছে সেখানে সৈন্যদের মধ্যে এই অভিমতের সপক্ষে সবচেয়ে জোরাল এবং বহুবিস্তৃত প্রচার অভিধান সংগঠিত করতে হবে।

ভ্রাতৃত্ব স্থাপন।

২. রাশিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতির বিশেষত্ব হলো এই যে, প্রলেতারিয়েতের শ্রেণীচেতনা ও সংগঠন যথেষ্ঠ শক্তিশালী না থাকার কারণে বিপ্লবের প্রথম পর্বে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে বুর্জোয়াদের হাতে, এই পর্যায় অতিক্রম করে দেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্বে, এই পর্বে ক্ষমতা অবশ্যই প্রলেতারিয়েত এবং কৃষকদের সবচেয়ে গরিব অংশগুলোর হাতে হস্তান্তরিত হবে।

এই উত্তরণ বিশিষ্টতা পেয়েছে, একদিকে এটা সর্বোচ্চ আইন সম্মত স্বীকৃত অধিকার সমৃদ্ধ হয়েছে (পৃথিবীতে সকল বিবদমান যুদ্ধরত দেশের মধ্যে রাশিয়া আজ সবচেয়ে স্বাধীন); অন্যদিকে জনগণের উপর বলপ্রয়োগ এখন অনুপস্থিত, আর সবশেষে শান্তি এবং সমাজতন্ত্রের নিকৃষ্ট শত্রæ পুঁজিপতিদের সরকারের প্রতি তাদের প্রশ্নাতীত নির্বিচার আস্থা।

বিপুল সংখ্যক প্রলেতারীয় জনরাশি সবে রাজনৈতিক জীবনে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, যা অভূতপূর্বই বটে, এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি আমাদের কাছে দাবি করছে যে, তাদের মধ্যে পার্টি কাজের বিশেষ অবস্থার সাথে আমাদের নিজেদের মানিয়ে নিতে পারার মতো যথোপযুক্ত সামর্থ্যবান হতে হবে।

৩. সাময়িক সরকারের প্রতি কোন সমর্থন তো নয়ই; বরং এই সরকারের সকল প্রতিশ্রুতি, বিশেষ করে (পরদেশ) দখল সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি ডাহা মিথ্যা, সেসব স্পষ্ট করে দিতে হবে। এই সরকার, যা পুঁজিপতিদেরই সরকার, সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা থেকে নিজেকে নিবৃত করবে, এই মর্মে অসমর্থনীয় ও মোহ জন্মানো “দাবি”-র জায়গায় এটার স্বরূপ উদঘাটন করতে হবে।

৪. এই বাস্তব অবস্থাটা উপলব্ধি করতে হবে যে, শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির বেশির ভাগের মধ্যে আমাদের পার্টি সংখ্যালঘু, এখন অবধি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু, আর আমাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একটা জোট যেটার মধ্যে আছে সমস্ত পেটি-বুর্জোয়া সুবিধাবাদীরা, জনপ্রিয় সমাজতন্ত্রী এবং সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারি থেকে শুরু করে অরগানাইজিং কমিটি (চখেইজে, সেরেতেলি আরও সব), স্তেকলোভ, আরও অনেকে, যারা বুর্জোয়াদের প্রভাবের কাছে বশ্যতাস্বীকার করেছে এবং এই প্রভাবকে প্রলেতারিয়েতের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে।

জনগণকে এটা উপলব্ধি করাতে হবে যে, বর্তমান মুহুর্তে শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলিই হচ্ছে বিপ্লবী সরকারের একমাত্র সম্ভাব্য রূপ, সুতরাং যতদিন এই সরকার বুর্জোয়াদের প্রভাবের কাছে বশ্যতাস্বীকার করছে ততদিন আমাদের কাজ হলো ধৈর্যসহকারে অবিচলিত চিত্তে এবং অধ্যবসায়ের সাথে তাদের কর্মকৌশলের ভ্রান্তিগুলোর ব্যাখ্যা তুলে ধরা, যে ব্যাখ্যা জণগণের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব প্রয়োজনগুলোর জন্য বিশেষভাবে উপযোগী।

যতকাল আমরা সংখ্যালঘু হিসেবে রয়েছি আমরা তাদের সমালোচনা আর ভুলভ্রান্তি উদঘাটনের কাজ চালিয়ে যাব, একইসাথে শ্রমিক প্রতিনিধিদের হাতে সমগ্র রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেওয়ার আবশ্যকতার কথা আমরা প্রচার করব, যাতে করে জনগণ তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের ভুলগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।

৫. পার্লামেন্টারি প্রজাতন্ত্র নয় : শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলি থেকে পার্লামেন্টারি প্রজাতন্ত্রে ফিরে যাওয়া হবে একটা পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ-আমরা চাই সারা দেশে তৃণমুল থেকে উপর পর্যন্ত শ্রমিক, ক্ষেতমজুর আর কৃষক প্রতিনিধি সোভিয়েতগুলির প্রজাতন্ত্র।

পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্রের বিলোপসাধন।

সকল কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়া চাই, তারা সবাই হবেন যেকোন সময় অপসারণযোগ্য, তাদের কারও বেতন একজন দক্ষ শ্রমিকের গড় মজুরি অতিক্রম করতে পারবে না।

৬. ভূমিবিষয়ক কর্মসূচীতে গুরুত্বের ভরকেন্দ্রটা ক্ষেতমজুর প্রতিনিধি সোভিয়েতের হাতে তুলে দিতে হবে।

জমিদারদের সকল ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা প্রসঙ্গে।

দেশের সমস্ত ভূমির রাষ্ট্রীয়করণ সম্পন্ন করতে হবে, ভূমির বিলিব্যবস্থা স্থানীয় ক্ষেতমজুর এবং কৃষক সোভিয়েতগুলির হাতে হস্তান্তর করতে হবে। পৃথক পৃথক গরিব কৃষক প্রতিনিধিদের সোভিয়েত গুলির নিয়ন্ত্রণাধীনে এবং সরকারী খরচে প্রত্যেকটা বৃহৎ ভূসম্পত্তিতে একটা আদর্শ খামার স্থাপন করতে হবে (স্থানীয় আর অন্যান্য অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে এবং স্থানীয় সংস্থাগুলির সিদ্ধান্ত অনুসারে খামারের আকার ১০০ থেকে ৩০০ দেসিয়াতিনা হতে পারে।)

৭. অবিলম্বে দেশের সকল ব্যাংককে একত্র করে একটা একক জাতীয় ব্যাংক গঠন করতে হবে। যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতের হাতে।

৮. বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্র “প্রবর্তন করা”আমাদের আশু কাজ নয়, বরং এই মুহুর্তে সামাজিক উৎপাদন এবং এসব উৎপাদিত জিনিস বিলিবন্টনের কাজ শ্রমিক প্রতিনিধি সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।

অপরদিকে, সিরাজুল আলম খান উপস্থাপন করেছিলেন ১৫ দফার খসড়া। তার বয়ানে-

“সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে, ‘১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের কোনো এক সময় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ (বিএলএফ) এর সঙ্গে বন্ধবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমানের বৈঠক হয়। বঙ্গবন্ধু আমাদেও চারজনকে (সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ) দেশ পরিচালনার বিষয়ে একটি সুপারিশমালা দিতে বলেন। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আমি ১৫ দফা কর্মসূচির একটি খসড়া তাকে দেই। নতুন রাষ্ট্রটি কীভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, এ কর্মসূচিতে আমি তা উল্ল্যেখ করেছিলাম। প্রস্তুাবগুলো নিম্নরূপ :

১.   অসম্পূর্ণ সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনায় রাষ্ট্রীয় পূর্ণগঠনের বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত একটি ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দল ও গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত এ সরকারের প্রধান থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

২.   কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবে সশস্ত্র যুদ্ধের পরীক্ষিত নেতৃত্ব দ্বারা, যাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা ধারণ করেন।

৩.   বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বঙ্গবন্ধু থাকবেন সকল দলের ঊর্ধ্বে। প্রয়োজনবোধে তিনি রাজধানীর বাইওে অবস্থান করবেন। তাঁকে কেন্দ্র কওে বাঙ্গালী জাতির চেতনা বিকাশের ধারা প্রবাহিত হবে।

৪.   বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হবে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনার আলোকে, কোনো দেশের অনুকরণ নয়। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল দল ও গ্রুপের প্রতিনিধিদেও নিয়ে ‘সংবিধান প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হবে।

৫.   চিরাচরিত প্রথার সেনাবাহিনী গঠন না কওে স্বাধীনতার সংগ্রামের চেতনায় জাতীয় পর্যায়ের ‘রেভ্যূলেশনারী (বিপ্লবী) গার্ড বাহিনী’ গঠন করা হবে। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক, এফএফ এবং বিএলএফ-সহ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এ বাহিনী তৈরি করা হবে। এর সমান্তরাল অন্য কোনো বাহিনী থাকবে না।

৬.  রেভ্যূরেশনারী গার্ডেও মধ্যে থাকবেÑ (ক) বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী’, যা হবে ‘পিপলস আর্মি’। (খ) কৃষিকাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য রেভ্যূালেশনরী ‘কৃষক ব্রিগেড’। (গ) শিল্প এলাকার জন্য রেভ্যূলেশনারী        ‘লেবার ব্রিগেড’।

৭.   নির্যাতনকারী পুলিশ বাহিনীর বদলে পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে ‘আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী’ গঠন করা হবে। ‘পুলিশ’ নামটি ব্যবহার করা হবে না।

৮.  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত বন্ধ থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা-শিক্ষক-ছাত্রদেও নিয়ে ছোট ছোট স্কোয়াড তৈরি করে বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। এক বছরের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষকে স্বাক্ষরতার আওতায় আনতে হবে।

৯.   উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিক্ষার জন্য ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা হবে। উচ্চ শিক্ষার জন্য গৃহীত ব্যাংক ঋণ শিক্ষা শেষ কওে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়ে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।

১০.  ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আমলের ধারাবাহিকতায় জেলা-মহকুমা-থানায় প্রশাসনের কোনো ‘ক্যাডার’ বা ‘গোষ্ঠী’ কে জনপ্রশাসনের দায়িত্বে রাখা যাবে না।

১১.  সশস্ত্র যুদ্ধেও সময় যারা জেলা-মহকুমা-থানা পর্যায়ে ‘কমান্ডার’- এর দায়িত্ব পালন করেছেন, তারাই জনপ্রশাসনের দায়িত্বে থাকবেন।

১২.  জনপ্রশাসনে ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আদলে প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ এসব শ্রেণি বিন্যাস থাকবে না। কাজের ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের জন্য যে স্তর হয়, তা অবশ্যই থাকবে।

১৩.  সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতনের অনুপাত হবে ১:৭।

১৪.  ‘সমবায় ভিত্তিক অর্থনীতি’ চালু হবে। পরিত্যক্ত কারাখানা মুক্তিযোদ্ধ-শ্রমিক-কর্মচারীদেও ‘সমবায়ে’র মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ‘সমবায়’-এর জন্য ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।

১৫.  কেবল ভারত ও রাশিয়ার ওপর নির্ভর না করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্রæততম সময়ের মধ্যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের দল, সাহস ও স্পর্ধার দল : সে সময় জাসদ অপ্রতিরোধ্য ছিল, সংগঠনটি টগবগে যৌবনের প্রতীকে পরিণত হয়। দলে দলে ছাত্র-যুবকরা যোগ দেন সমাজবদলের ওই মশাল মিছিলে। ষাটের দশকের উত্তাল যৌবন প্রবাহিত হয় জাসদের খাতেই। জাসদ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দল। সংগঠনটি ধারণ করেছিল দুইজন সেক্টর কমান্ডার (কর্ণেল তাহের বীর উত্তম ও মেজর জলিল), দুইজন সাব সেক্টর কমান্ডার (মাহবুব রব সাদী ও মেজর জিয়াউদ্দিন)। বিএলএফ-মুজিববাহিনীতে সিরাজুল আলম খান আঞ্চলিক কমান্ডার, আ স ম আব্দুর রব, নুর আলম জিকু, মার্শাল মনি ডেপুটি কমান্ডার, কাজী আরেফ আহমেদ গোয়েন্দা প্রধান, শাহজাহান সিরাজ বিএলএফ-মুজিব বাহিনী ও মুজিব নগর সরকারের মধ্যে লিয়াজোর দায়িত্বে ছিলেন। আ ফ ম মাহবুবুল হক, হাসানুল হক ইনু শরীফ নুরুল আম্বিয়া, মাসুম আহমেদ রুমি দেরাদুনে প্রশিক্ষক ছিলেন। দলের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত নেতৃত্বের সকলেই রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। সারাদেশের প্রতিটি জেলা মহকুমা থানা এলাকায় যারা জাসদ করতেন, তারা সকলেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নেতৃত্ব পর্যায়ের মানুষ। সেই সময় জাসদ ছাত্রলীগের নেতৃত্বের সকলেই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নেতাদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। জাসদ ছাত্রলীগের ওই সময়ে প্রথম অমুক্তিযোদ্ধা ছাত্রনেতা ছিলেন তিনি। বদিউল আলম সহ চার পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র নেতাকে ডিঙ্গিয়ে জাসদ হাইকমান্ড তাকে নেতা বানায়। জাতীয় পর্যায়ে অসম্ভব প্রভাবশালী এবং শাসকশ্রেণির প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে জাসদ। উপমহাদেশের ইতিহাসে শাসকদের মুখোমুখি এমন স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য নিয়ে দাঁড়ানো, তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা, জাতীয় পর্যায়ে এমন প্রভাবশালী শক্তি বামপন্থিদের ভেতর থেকে এখন পর্যন্ত দানা বাঁধেনি।

রাষ্ট্রের নির্যাতন আমন্ত্রণ : এতৎসত্ত্বেও নানা দুর্বলতা, অদূরদর্শিতা, বিভ্রান্তি, স্বতঃস্ফুর্ততাবাদ, বিভক্তি ও ভাঙনসহ নানা সীমাবদ্ধতা বড় কোনো দায়িত্ব নেওয়ার উপযোগিতা থেকে সংগঠনটিকে সরিয়ে রাখে। শাসকদের নির্যাতন এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলের পরিবর্তে বালখিল্যতা ও হঠকারিতায় জাসদ নেতৃত্ব গায়ে পড়ে ভয়াবহ নির্যাতনের পরিণতি ডেকে এনেছে। ১৯৭৪ সালে ১৭ মার্চের ঘটনা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ওই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে গুলিবর্ষণ এবং হতাহতের ঘটনায় দলটিকে রাষ্ট্রের ভয়াবহ দমনপীড়নের মধ্যে ফেলে দেয়। ওই ঘটনার পরিণতিতে দলকে গোপনে নিয়ে যেতে বাধ্য হতে হয়। এসব কারণে জাসদ জনবিচ্ছিন্ন হতে থাকে। দলে নানামুখি সংকট তৈরি হয়। একই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লববিরোধী শক্তি এবং রাজনৈতিক হতাশা বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। রাষ্ট্রের পীড়নে পড়া লড়াকু জাসদের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাতে ভুল করেনি নি:শেষ হওয়ার পথে থাকা বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি (মুসলিম লীগ ও জামাত)। যে শক্তি ছিল জাসদ ও আওয়ামী লীগের কমন শত্রু। রাষ্ট্রের ও ক্ষমতাসীন দলের নিষ্ঠুর দমন পীড়ন থেকে রক্ষা পেতে সেই কমন শত্রুর ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয় জাসদে। আর আওয়ামী লীগ বিপদে পড়লে সেই শক্তিকে অপকর্মের সুযোগ দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের আবেগ অনুভূতির দোহাই দিয়ে মানুষের সমর্থন আদায় করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের দোহাই পেরে মানুষের সমর্থন দলটিকে ক্ষমতায় থাকার একটা বৈধতা তৈরি করে। সেই বৈধতাই আওয়ামী লীগের একমাত্র সম্বল। তাই আওয়ামী লীগ বিরোধী লড়াইয়ে অত সরল নয়। এসব কারণে ওই ক্ষয়িষ্ণু শক্তি রাজনীতিতে কিছুটা হলেও স্পেস পায়। এরই ফাঁক গলিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ওই শক্তি জাসদকে ‘ল্যাং মেরে’ ক্ষমতার খেলায় সফল হয়। দুই দশকের সামরিক শাসনকালে সেই শক্তি পাতাল থেকে তুলে আনে যাবতীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা। তারা এখন পত্র পল্লবে বিকশিত, শক্তি সামর্থে ষোলকলায় পরিপূর্ণ। পাতাল থেকে উঠে আসা প্রতিক্রিয়ার এই শক্তিকে বিবেচনা করে, তাকে নি:শেষ করার দায়িত্ব নিয়েই আওয়ামী লীগকে উচ্ছেদ করার রাজনীতি করতে হয়। তা না হলে বহু পথ পাড়ি দিয়ে যাত্রা বিন্দুতেই থাকতে হবে। আওয়ামী লীগ বিরোধী লড়াইয়ে অনেকে এখনো ধর্মীয় ফ্যসীবাদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন, যেটা বিপজ্জনক। সেই বিপদের ফাঁক গলিয়েই বিএনপি জামাত সামরিক শাসন ইত্যাদি। ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিলের যে ঘটনার জন্য জাসদকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হল, এতে যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হল, ওই ঘটনাটির ওপর যথেষ্ট আলো পড়েনি। ঝেড়ে কেশে কেউ মুখ খুলছে না। যতটুকু বক্তব্য এসেছে, সেখানে অনেক কিছুই অনুদ্ঘাটিত রয়েছে বলে আমাদের ধারণা। এর কোনো দলীয় মূল্যায়ন চোখে পড়েনি আমাদের। কারা এমন আত্মঘাতি কর্মসূচি দিয়ে একটা সম্ভবনার নির্মূল প্রক্রিয়া শুরু করল, সেটা চিহ্নিত করা দরকার ছিল। যারা ঘটিয়েছেন, অর্ধশতাব্দি পর ইতিহাসের কাছে তাদের দায় স্বীকার করা দরকার।

একই ভাবে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান হাত ছাড়া হওয়ার পর আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা হয়েছিল, যা খোদ সিরাজুল আলম খান জেনেছিলেন ঘটনার ৩০ বছর পর।

সিরাজুল আলম খান আরো জানাচ্ছেন, “২৩ নভেম্বর হঠাৎ করে আমার কাছে সংবাদ এলো, কোনো একটি সভা থেকে মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব ও কর্ণেল তাহেরকে গ্রেফতার করা হবে। ঐ দিনই এসএম হলের হাউজ টিউটরের বাসা থেকে তাঁদেরকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ইনুও গ্রেফতার হলো। এদের গ্রেফতারে আমি বিস্মিত হলাম। গ্রেফতার হবার মত এমন কোনো ঘটনা বা সিদ্ধান্ত তো হয়নি।”

সেখানে তিনি আরো জানাচ্ছেন, “ এ ঘটনার ৩০ বছর পর (২০০৫ সালে) আমি জানতে পারলাম, আমার অনুপস্থিতিতে, আমাকে না জানিয়ে বা আমার মতামত না নিয়ে, মাত্র কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, আবারও কয়েকদিনের মধ্যে ক্যান্টনমেন্টে অভ্যুত্থান ঘটানো হবে। সেই প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন কর্ণেল তাহের ও মেজর জলিল।”

“....আমার অনুপস্থিতিতে, আমাকে না জানিয়ে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই বিষয়টি আমি পরে শরীফ নুরুল আম্বিয়ার কাছ থেকেই জানতে পারি।”

সিরাজুল আলম খান আরো জানান,“বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলের জন্য যে সংগঠিতশক্তি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে সৈনিক ও অফিসারদের মধ্যে এবং বাইরে ছাত্র-যুব-শ্রমিকদের মধ্যে থাকা দরকার, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তা সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত হয়ে পড়েছিল।”

তাহলে দলের হাইকমান্ডকে না জানিয়ে, পরিস্থিতি পরিপক্ব হওয়ার আগেই আরেকটি সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টা, এতে হঠকারি প্রবণতা ও দলের শৃঙ্খলা সম্পর্কে আঁচ করা যায়। এসব ঘটনা দলকে রাষ্ট্রের ভয়াবহ নিপীড়নের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

এতদিন পরে হলেও এসব ঘটনার কারণ ও পেছনের দায়ী ব্যক্তি ও নেতাদের ব্যাপারে সঠিক বক্তব্য প্রকাশ করা দরকার। প্রয়োজনে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি তোলা উচিৎ।

নিপীড়িত শ্রেণির সমাবেশ ঘটেনি: জাসদে অন্যান্য নিপীড়িত শ্রেণির সমাবেশ ঘটেনি। ¯স্লোগানে আর কর্মসূচিতে থাকলেও আন্দোলনে এবং সংগঠনে শ্রমিক, গরীব কৃষক ও ক্ষেতমজুরের অংশগ্রহণ ও প্রভাব খুব কম ছিল। যে কারণে বিপর্যয়ে পরে ছাত্র যুবকরা সদলবলে দল ছেড়ে দিতে থাকেন। ফিরে যেতে থাকেন স্ব-শ্রেণিতে। তারা ক্যারিয়ার গড়ে তোলার দিকে ঝুঁকে পড়েন, দেশে কিংবা দেশের বাইরে। আর দল ছাড়ার ঘটনাকে আড়াল করার জন্য নেতাদের এক নাগাড়ে দোষারোপ করতে থাকেন। অন্যদিকে, শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে দলের ভিত্তি মজবুত হলে, তাদের অন্তত ক্যারিয়ার গড়ার জন্য দল ছাড়ার দরকার পড়ত না। কারণ তাদের স্বশ্রেণিই এই আন্দোলনের সমার্থক।

গতি বনাম গতিজড়তা : বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী, কার্যকর বল প্রয়োগ করলেই বস্তু গতিশীল হয়। বাধা না পেলে গতিশীল বস্তু একই গতিতে চলতেই থাকে, যাকে বলে গতিজড়তা। তবে মাধ্যাকর্ষণের টানে ও বাতাসের বাধায় কিছু দূর গিয়ে গতিজড়তার বস্তুটি থেমে যায়। যেমন একটি চলন্ত ট্রেন ইঞ্জিন বন্ধ করলেও, গতিজড়তার কারণে কিছু দূর এমনিই চলে। এজন্য কোনো বস্তুকে গতিশীল রাখতে বল প্রয়োগ বহাল রাখতে হয়। তা না হলে গতিজড়তার মধ্যে সে কিছুদূর গিয়ে এমনি এমনি থেমে যাবে। নিউক্লিয়াসপন্থীরা ছাত্রলীগে ‘স্বাধীনতার বল’ প্রয়োগ করে, সংগঠনে গতি দিয়েছিল। এসব গতি হল স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের নানামুখি কর্মকান্ড, গোপন-প্রকাশ্য নানামুখি আয়োজন ও কৌশল। স্বাধীনতার রাজনীতিতে গতি আনতে তারা পরিকল্পিতভাবে এসব কাজ করেছিল। অপরদিকে, যখন জাসদ গঠন করলেন, সেখানে তাদের সেই সুপরিকল্পিত পূর্ব নির্ধারিত কোনো আয়োজনই ছিল না। যেমনটি ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে। জাসদ গঠন ছিল পরিস্থিতির চাপে আর স্বাধীনতা ছিল সচেতন প্রয়াশে। স্বাধীনতা ছিল নিউক্লিয়াসপন্থীদের গতি, আর জাসদ হল তাদের গতিজড়তা। স্বাধীনতা নিউক্লিয়াসপন্থীদের প্রজেক্ট, আর জাসদ ও সমাজতন্ত্র তারই রেশ।

বাধ্য হয়ে স্বতন্ত্র : জাসদ কখনো শেখ মুজিবকে অতিক্রম করতে চায়নি, সে বয়ান সিরাজুল আলমের কাছ থেকেই জানা যায়। তিনি লিখেছেন, “১৯৭২ এর জানুয়ারিতে বিভক্তির পর সারাদেশে ছাত্রলীগের দুটি সংগঠন পরস্পর বিরোধী ও সংঘাতমূলক অবস্থানে চলে যায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে দুই গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষও ঘটতে থাকে। ১৯৭৩ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ঢাকসু) নির্বাচনে রবপন্থী ছাত্রলীগের আ ফ ম মাহবুবুল হকের নেতৃত্বাধীন প্যানেলের বিপুল ভোটে জয়লাভের সম্ভবনা দেখে হলে হলে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়। অভিযোগ করা সত্ত্বেও মুজিব ভাই এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিলেন না। এসময় শ্রমিকদের নিয়ে ‘লাল বাহিনী’ গঠন করে তাদের অত্যাচারের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হলো। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুটা শীতল হলেও তখনও পর্যন্ত আমাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমি তাকে নিরপেক্ষ থাকার জন্য অনুরোধ করি।”

দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে গেছে, দুই গ্রুপে সংঘাত চলছে। সদ্য স্বাধীন দেশে দুই গ্রুপের সংঘাত যে রক্তাক্ত হতে বাধ্য সেটা অনুমান করা কষ্টকর নয়। এমন অবস্থায় ডাকসু নির্বাচনে রবপন্থীদের ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হচ্ছে। লাল বাহিনী গঠন করে নির্যাতন করা হচ্ছে, এরপরেও সিরাজুল আলম খান শেখ মুজিবের কাছে গেছেন যৌথভাবে কৃষক সংগঠন গঠন করার জন্য। তিনি বলেছেন, “ আমি মুজিব ভাইকে বার বার কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য অনুরোধ করি। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সারাদেশে ‘কৃষক ব্রিগেড’ গড়ে তোলা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি কৃষক ব্রিগেড গড়তে তিনি রাজী ছিলেন। একদিন সংবাদপত্রে দেখলাম আবদুর রব সেরনিয়াবতকে প্রেসিডেন্ট করে কৃষক লীগ গঠন করা হয়ে গেছে। আমি মুজিব ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ‘এটা মণি করেছে’। আমি তাঁর কথাটি গ্রহণ করতে পারলাম না। মনে হল আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে।”

দেখুন জাসদ গঠন কীভাবে হয়েছে। যখন শেখ মুজিব তাদের গ্রহণ করছে না। বরং তিনি শেখ মণির দিকেই ঝুঁকেছেন। তখন সিরাজুল আলম খান বলছেন, “.. যে সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট হয়ে দেখা দিল, তা হলো আমাদের পক্ষের হাজার হাজার কর্মী সংগঠক কী করবে? আদর্শগত দিক থেকে মণি এবং আমি দুটি আলাদা স্রোতের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই মণি মুজিব ভাইয়ের দিকে থাকবে। অথবা বলা যায়, মুজিব ভাই মণির পক্ষে থাকবেন।”

আরো  বলেছেন, “আমাদের হাজার হাজার কর্মী সমর্থকরা কোথায় যাবে, তারা কি আওয়ামী লীগ করবে? তা তো সম্ভব নয়। তাহলে তাদের জন্য একটি রাজনৈতিক স্পেস (স্থান) সৃষ্টি করা খুবই জরুরি এবং সেটা হতে পারে একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন”। অর্থাৎ কল্পিত নয়, পরিস্থিতির চাপে পড়ে জাসদ গঠন।

জাসদ এবং শেখ মুজিব : শেখ মুজিবুর রহমানের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ বা আয়োজন যে জাসদের ছিল না, শুধু তাই নয়, এটা তাদের চিন্তাতেও ছিল না, স্বপ্নেও ছিল না, তখনও না, এখনো না। ১৯৭২ সালে রমনাগ্রীনে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের অপরাংশের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমানের যাওয়ার খবর শোনার আগ পর্যন্ত তার নামেই জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তার নেতৃত্বেই ‘সমাজতন্ত্র‘ও কায়েম করতে চেয়েছিলেন। জাসদের বর্তমানের সকল ধারার নেতৃত্বের মনোভাব এখনো সেখানেই পড়ে আছে। আর যারা সেটা মেনে নিতে পারেননি, তারা ক্ষোভে দু:খে বিএনপি-জামাতের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন, আর নেতারা ‘কাফফারা’ দিতে আওয়ামী লীগের কক্ষপথে ঘুরছেন। আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে কীভাবে সমর্থন করবেন; কিংবা কীভাবে এবং কেন বিরোধিতা করবেন সেই সম্পর্কের দ্বান্দ্বিকতা নিউক্লিয়াসপন্থিরা তখনো নির্ণয় করতে পারেননি। এখনো পারছেন না।  স্বাধীনতাত্তোর শেখ মুজিবের প্রতি জাসদ নেতৃত্ব এখনো মোহগ্রস্থ। এই মোহ বজায় রেখে, তাকে অতিক্রম করার পথ কৌশল বের করতে না পারলে, জাসদের রাজনীতি কখনোই দাঁড়াতে পারবে না।

অপরদিকে, বাহাত্তর-পঁচাত্তরে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে উৎখাত করার রাজনীতি যখন তুঙ্গে তখনোও সকল জাসদ নেতাদের অন্তরজুড়ে ছিল শেখ মুজিব। বাইরে তারা লড়ছেন, মরছেন ও মারছেন; তখনও মুজিব কাল্ট থেকে মোহমুক্ত হননি। তার প্রকাশ আরো পরে দৃশ্যমান হয়েছে। এখন সেটা আরো প্রকাশ্যে এসেছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের সম্পর্কের সমীকরণের ওপর আরো পর্যালোচনার দাবি রাখে। এখনো জাসদের লোকজন আওয়ামী লীগকে দিয়ে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার কাজ করে যাচ্ছেন।

কিন্তু হিসাবটি ভিন্ন, বাহাত্তর পঁচাত্তরের লড়াইয়ে জাসদ টিকে গেলে, মুক্তিযুদ্ধের মূলধারার অথরিটি থাকত জাসদের হাতে আর আওয়ামী লীগের পরিণতি হতো মুসলিম লীগের মত। কিন্তু অপরিণামদর্শিতার কারণে জাসদ নিজেই নিজেকে তিলে তিলে ধ্বংস করেছে, জাসদের এই আত্মহত্যাই আওয়ামী লীগের টিকে থাকার পথ সুগম করে দিয়েছে। যে সব শর্তের জন্য জাসদ টিকল না, সেই সব শর্ত থেকে এখনো মুক্ত নয় জাসদ, আর বাসদ নেতারা এসব থেকে দূরে থেকে, সকল ‘ঝামেলাপূর্ণ ঐতিহ্যকে’ প্রত্যাখ্যান করে নিজেরা পাকসাফ থাকছেন। কেউই জাসদ রাজনীতির গ্রহণযোগ্য সারসংকলন করেনি, যে যার মত একটা ধারণা নিয়ে আছেন মাত্র। যার মধ্যে আংশিক বা কিয়দংশ গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও থাকতে পারে।

সিরাজুল আলম খান প্রসঙ্গ:  আ ফ ম মাহবুবুল হক বলতেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার মুখপাত্র আর সিরাজুল আলম খান হলেন স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা।’ সিরাজুল আলম খান ছিলেন জাসদ রাজনীতির প্রাণপুরুষ। শেখ মুজিবকে গভীরভাবে ধারণ করার মত একমাত্র ব্যক্তিই ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তার ন্যায় শেখ মুজিবকে ধারণ করার মত দ্বিতীয় আর কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশে তখনও ছিল না এখনো নেই। কিন্তু সিরাজুল আলম খান কখনোই শেখ মুজিবের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেননি, করার কোনো সচেতন প্রয়াস ছিল না তাঁর। বাংলাদেশকে স্বাধীন করা (নাকি বিচ্ছিন্ন করা) তাঁর এজেন্ডায় থাকলেও যুদ্ধপূর্ব সময়ে সমাজতন্ত্র ছিল না কখনোই। স্বাধীনতা ছিল নিউক্লিয়াসপন্থীদের প্রজেক্ট, কিন্তু সমাজতন্ত্র ও জাসদ নিউক্লিয়াসপন্থীদের প্রজেক্ট নয়। সেটা পরিস্থিতির চাপে পড়ে। ১৯৭০ সালের ২১ আগস্ট রাতে রাজধানী ঢাকায় নিউ মার্কেটের উল্টো দিকে ৪২ নং বলাকা ভবনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভা চলছিল, ছাত্রলীগে সিরাজপন্থিদের মুখপাত্র স্বপন কুমার চৌধুরী এ সভায় ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’-এর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এ সভায়  উপস্থিত ৪৫ সদস্যের মধ্যে ৩৬ জন এ প্রস্তাব সমর্থন করেন। ৯ জন সমর্থন করেননি। ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এ প্রস্তাবের প্রবল বিরোধিতা করেন। সভার শৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি এ সভা মুলতবি করে দেন। তখন এ প্রস্তাব নিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের কাছে গেলে তিনি খুবই বিরক্ত হন এবং উষ্মা প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি ছাত্রলীগের তরুণ তুর্কিদের বিপ্লবী মনোভাবের পরিপন্থি তাৎক্ষণিক কিছু বলেননি। নেতাদের কাছে শোনা গেছে, শেখ মুজিবুর রহমান ওই প্রস্তাব উত্থাপনকারীকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের জন্য সিরাজুল আলম খানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সিরাজুল আলম খান সে নির্দেশ কার্যকর করার সময় পাননি। ততদিনে দেশে স্বাধীনতার উত্তাল ঢেউ আছড়ে পরেছে, প্লাবিত করেছে পূর্ববাঙলার পললভূমি।

একারণে জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ¯স্লোগানে যখন দেশবাসীর মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত হয়, দেশব্যাপী প্রবল জোয়ার তৈরি হয়। প্রাণ দেওয়া নেওয়ার সাহস নিয়ে শত শত যুবক ও মুক্তিযোদ্ধার সমাবেশ ঘটে জাসদে। অথচ সিরাজুল আলম খান জানেন না, এই তারুণ্যের শক্তিকে কীভাবে বিপ্লবের কাজে লাগাতে হবে? কী নির্দেশনা দেবেন তাদের? কোন পথে মুজিব সরকারকে দাঁড় করাতে হবে জনতার কাঠগড়ায়, ওই সরকারকে উচ্ছেদ করে, কেড়ে নিতে হবে শাসনদণ্ড ? তিনি নিজেকে বাংলাদেশের লেনিন ভাবলেন বটে, কিন্তু লেনিনের যেভাবে কেরনেস্কিকে ক্ষমতা থেকে হটালেন, সময় ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও লেনিনের সেই পথকে কিভাবে কাজে লাগতে হয়, সিরাজুল আলম খান তা পারলেন না কিংবা জানলেন না।

শুধু কি তাই? ছাত্র তরুণদের এই ক্ষোভকে তিনি ব্যক্তি শেখ মুজিব বিরোধীতায় আটকে রাখলেন। লড়াইটা জারি রাখলেন শেখ মুজিব বিরোধীতায়। তাঁর ওপর আগের যে প্রভাব ছিল, তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব যে শ্রেণির প্রতিনিধি, সেই শ্রেণির উচ্ছেদের লড়াইয়ে উত্তরণ ঘটালেন না। যেখানে সরকার পরিবর্তন হলেও শ্রেণির উচ্ছেদের লড়াই বিভ্রান্ত হয় না।

এই সীমাবদ্ধতা লুকানোর জন্য নিজের চারপাশে তিনি তৈরি করেন এক রহস্যের বার্তাবরণ। সেই রহস্যের মধ্যে লুকিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন তিনি। সকলের মধ্যে হয়ে উঠেন ‘রহস্য পুরুষ’। তাঁর রহস্যময়তা হল নিজের সীমাবদ্ধতা ঢাকার এক শৈল্পিক প্রয়াস। ‘রহস্য পুরুষ’ এই পরিচিতিকে কড়ায়-গণ্ডায় উপভোগ করেছেন তিনি। উল্লেখ্য, এই ‘রহস্য পুরুষের’ অভিধা তিনি যুদ্ধপূর্বকালে পাননি, কারণ তখন তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার, রহস্যের দরকার হয়নি। তিনি রহস্যমানবের আড়াল গ্রহণ করেন জাসদ গঠনপর্বে। কারণ সেটা ছিল সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হওয়ার সময়। এ পর্বে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল না। তখনই দরকার হয়ে পড়েছিল রহস্যের চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নেওয়ার। 

যে মানুষটি একটি দেশ গঠনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখলেন। যিনি ষাটের দশকে তরুণ প্রজন্মের (বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারার) উত্থানপর্বের মূল নায়ক। পরবর্তীতে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে আরেকটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের মূলব্যক্তিত্ব। যিনি দেশের ইতিহাসে দুই দুইটি বড় ঘটনার মূলব্যক্তি (মুক্তিযুদ্ধ ও জাসদ), এখন তিনি যাপন করছেন অতি সাধারণ জীবন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া ভার।

২০০৭ সালের ১৬ মার্চে প্রোব পত্রিকা তার বরাত দিয়ে লিখেছিল, ‘সিরাজুল আলম খান মনে করেন, বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র দেশের জন্য রাজনৈতিক সীমানা প্রাচীরের দরকার নাই। দরকার হলে বড় জোর স্বায়ত্তশাসন হলেই চলবে।’ তাহলে একাত্তরের যুদ্ধের দরকার কি ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই পত্রিকায় তিনি বলেন, ‘That was then, everything has certain limitations’ he explains, ‘the States were separated from each other. Now it is the age of technology. it is the age of globalization. It takes seconds for things to happen, for problems to be solved. And if basic requirements can be met. What is the point of political boundaries?

(সবকিছুরই সুনির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা থাকে, পাকিস্তান যখন দুই রাষ্ট্রে পরিণত হয়, সেই সময়েরও একটা সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু এখন তো সময় বদলে গেছে, যুগ চলছে অধুনিক প্রযুক্তির এবং বিশ্বায়নের। আমরা এখন দ্বিতীয় পর্বে প্রবেশ করেছি। এখন আমাদের সমস্যাগুলো কীভাবে এবং কত দ্রুত সমাধান হবে, সেইটাই বিবেচনা করতে হবে। যদি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নতুন কোনো কাঠামোতে আমাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়, তাহলে রাজনৈতিক সীমান্তের দরকারটা কী?)

এই হল জাসদের প্রাণপুরুষের পরবর্তি উপলব্ধি। এই বক্তব্যে স্বাধীনতার চেয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের বিষয়টিই প্রধান হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা ও বিচ্ছিন্নতা মোটেই এক কথা নয়।

জাসদ গঠন পর্ব : জাসদের প্রথম সভাপতি ছিলেন মেজর জলিল। তিনি রাজনীতির লোক নন। জাসদের সভাপতি হওয়ার কিছুদিন আগেও তিনি ভাসানী ন্যাপে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, নেতৃত্বের দরকষাকষিতে না মেলায় তার ন্যাপ করা হয়নি। জাসদে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কাঙ্ক্ষিত পদ পেয়ে যান। অপরদিকে, কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে জাসদ সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান ঘটাতে গিয়েছিল, কিন্তু সফলতা আসেনি। কর্নেল তাহেরও জাসদের মূল ধারার লোক না। তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজনে সর্বহারা পার্টির সভাপতি সিরাজ সিকদারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু সিরাজ শিকদারের সঙ্গে তার রাজনৈতিক ও রণকৌলশগত ঐকমত্য হয়নি। জাসদ বিনাশর্তে তাঁর সেনা-অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে গ্রহণ করেছিল। রাজনৈতিক লাইন এবং সাংগাঠনিক শক্তিভিত ও প্রস্তুতির কথা বিবেচনা না করে কিংবা অন্যান্য জরুরি রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা ব্যাতিরেকে, তাড়াহুড়া করে এভাবে অভ্যুত্থান করতে যাওয়া শুধু হঠকারিতাই নয়, এটা হল বালখিল্যতা আর স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতি নি:শর্ত আত্মসমর্পণ এবং দলকে নি:শেষ করতে রাষ্ট্রশক্তির হিংস্র দমন পীড়নের সামনে দলকে ঠেলে দেওয়া। দলের ওপর রাষ্ট্রের হিংস্র হামলাকে আমন্ত্রণ জানানো।

দলটির তাত্ত্বিকভিত্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক, রাষ্ট্রীয় চরিত্র পুঁজিবাদী। দেশিয় শাসকশ্রেণি উচ্ছেদের লড়াই প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির এই তাত্ত্বিক কাঠামো প্রথম ব্যাখ্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম আখলাকুর রহমান। ড. আখলাকুর রহমানের পাঠচক্রে এ নিয়ে জাসদে একটা ঐক্যমত আগেই ছিল। তার আগে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপনের ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু সেটা গুছিয়ে লেখার কাজটি করেননি জাসদের নেতারা। জাসদে তখন অনেক মেধাবী তরুণদের সম্মিলন ঘটেছিল। তথাপি একাজেও তারা নির্ভর করেছিলেন অন্যের ওপর। বিপ্লবের মৌলিক প্রশ্নে মিল ছিল ভারতের ‘সোসালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়ার (এসইউসিআই) সঙ্গে। জাসদ নেতারা দলের তাত্ত্বিক ভিত্তিও রচনার জন্য নির্ভর করেন মুক্তিযুদ্ধের পরে কলকাতা থেকে বাংলাদেশে আসা এসইউআই এর সংগঠক মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ওপর। শোনা যায়, তিনি ওই তত্ত্ব নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন, সেখানে গুরুত্ব পাননি।

এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে কমিউনিস্ট ঘারানার বিপ্লবের স্তর তাত্ত্বিক মূল্যায়ন হল জনগণতান্ত্রিক, বা জাতীয় গণতান্ত্রিক অথবা নয়া গণতান্ত্রিক। কেউ কেউ বলেন মেহনতী জনতার গণতন্ত্র। জাসদই প্রথমে বিপ্লবের স্তর সমাজতান্ত্রিক নির্ধারণ করে। এর আগে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তিন নেতা, হাসান আলী মোল্লা, আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমেদ ১৯৬৬/৬৭ সালের দিকে যৌথভাবে একটি বই লিখেছিলেন। খুব পরিশ্রম করে, নিজেদের বুঝের ওপর। বইটির শিরোনাম ছিল ‘জাতীয় অর্থনীতির চরিত্র ধনতন্ত্র’। শিরোনাম দেখেই বোঝা যায়, বইটিতে তারা তখনকার পাকিস্তানের অর্থনীতি যে পুঁজিবাদী, সেটা নানা তথ্য উপাত্ত ও তাত্তি¡ক বিশ্লেষণ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ওই সময় কমিউনিস্ট মহলে বইটি ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয়। কিন্তু প্রথাগত কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাবের কাছে টিকতে না পেরে, সেই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জায়গা থেকে লেখকেরা সরে আসেন এবং গ্রহণ করেন লেনিনোত্তর রাশিয়া ও চীনের ডেস্ক থেকে আসা সাবেকি তত্ত্ব। ডেস্ক তত্ত্বের কাছে মার খেল বুঝের ওপর দাঁড়ানো তত্ত্ব। ওই তিন লেখক তাদের সেই বুঝের তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে, ইতিহাস কোন দিকে যেত, সেটা এখন অনুমান করা আর সম্ভব না।

পরের হাতের তামাক খাওয়া : নিউক্লিয়াস নেতৃত্ব দল গড়ার জন্য মেজর জলিলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কর্নেল তাহেরের কথা মেনে সিপাহি জনতার অভ্যুত্থান করেছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্র ও বিপ্লবের স্তর নির্ধারণে মবিনুল হায়দার চৌধুরীর ওপর নির্ভর করেছিলেন জাসদ নেতারা। আবার ক্ষমতায় গেছেন (রব ও ইনু) শেখ হাসিনার হাত ধরে। অন্যের হাতে তামাক খাওয়া স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছে জাসদ নেতৃত্বের।

যে দলটি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অন্যের হাতে ছেড়ে দেয়, আর নিজেরা শুধু লড়াইয়ের ময়দানে যুঝতে থাকে এবং তাকেই প্রধান করণীয় মনে করে। এর মত বালখিল্যতা আর কি হতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সংগঠনটির নেতারা হাত মেলাতে গিয়েছিলেন মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে। অথচ কয়েক বছর আগেই ‘হো হো মাও মাও, ব্যাঙ খাও চীন যাও’ বলে ভাসানী আশ্রিত বামপন্থিদের উপহাস করতেন। আওয়ামী নির্যাতন থেকে বাঁচতে আবার সেই ঘারানার সঙ্গে একটা সাময়িক সখ্যও গড়ে তুলেছিলেন, ততদিনে ভাসানীর সঙ্গে চীনাপন্থি কমিউনিস্টদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। শেষ-জীবনের ভাসানী ঝুঁকে পড়েন ইসলামী ধারার রাজনীতির দিকে। কিন্তু ভাসানীপন্থার সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া এবং সম্পর্কের মিল-অমিল নির্ণয় না করেই, শুধু আওয়ামী বিরোধিতার জায়গা থেকে তার সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়েছিলেন জাসদ নেতারা।

বাহাত্তরের সংবিধান ও জাসদের রাজনীতি : বাহাত্তরের সংবিধানের একাদশ ভাগে অর্থাৎ একেবারে শেষ দিকে একটি প্রায় অনুল্লেখ্য অনুচ্ছেদ হলো ১৪৯। যাতে বলা হয়েছে-“এই সংবিধানের বিধানবলী সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকরিতা অব্যাহত থাকিবে, তবে অনুরূপ আইন এই সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হইতে পারিবে।”

‘প্রচলিত আইন’ অর্থ এই সংবিধান প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানায় বা তার অংশ বিশেষে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সক্রিয় থাকুক বা না থাকুক, এমন যে কোন আইন। অর্থাৎ সংবিধানটি গৃহীত হওয়ার পূর্বে যা ছিলো, সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরও তাই আছে- অর্থাৎ পাকিস্তানী আমলে যে সব আইন, বিধি-বিধান জারী ছিলো, যা ছিলো ব্রিটিশদের পরিত্যক্ত- তাই দাড়ি, কমা সমেত বাংলাদেশে জারী করা হলো। এত রক্ত এত যুদ্ধ এত আন্দোলনের পরেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী আমলের পচা গলা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকেই কার্বন কপি করে বাহাত্তরের সংবিধানে খাড়া করা হল।

এই সংবিধান প্রনয়ণের পর ১৯৭২ সালের ২৬ মে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে ছাত্রলীগের তিন নেতা আ.স.ম আবদুর রব (তৎকালীন ডাকসু ভিপি), শাহজাহান সিরাজ (তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ছাত্রলীগ) ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া দাবি জানান যে, দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে গণপরিষদ ও মন্ত্রিসভা বাতিল করা হোক এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠন করা হোক জাতীয় সরকার। পরবর্তীতে রব-সিরাজ আরো একটি প্রশ্ন তোলেন, প্রায় ৬০ জনের অধিক গণপরিষদ সদস্যের (যাদের মধ্যে ৫ জন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, ১০ জন ইতোমধ্যে মারা গেছেন এবং কেহ কেহ দুর্নীতির দায়ে ও মুক্তিযুদ্ধের সময় পদত্যাগের দায়ে বহিষ্কৃত, কেউ কেউ অনুপস্থিত ও পদত্যাগী) অবর্তমানে অর্থাৎ বাংলাদেশের এক কোটির বেশি লোকের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এছাড়া তাঁরা আরো প্রশ্ন তোলেন যে, জাতীয় পরিষদ সদস্যের শতকরা নব্বইজনই যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সম্প‚র্ণ সময়টুকু ভারতে নির্লিপ্ত জীবনযাপন করেছেন, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অধিকার সেইসব গণপরিষদ সদস্যের আদৌ আছে বলে দেশবাসী মনে করে না।

বিবৃতি দিয়ে, সংবাদ সম্মেলন করে, বিভিন্ন নিবন্ধে সহ নানাভাবে ওই সংবিধান প্রত্যাখ্যান করেন ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ ও দলের মুখপত্র হক কথা, লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অমল সেন, ন্যাপ (মোজাফফর) এর একমাত্র সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সভাপতি কমরেড সিরাজ সিকদার ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা ও নির্মল সেন।

এদিকে, সিরাজুল আলম খান জানাচ্ছেন, “আমরা এ সংবিধানকে ভারত-পাকিস্তান-ব্রিটেনের অনুকরণে রচিত সংবিধান বলে আখ্যায়িত করলাম। বস্তুত এটি ছিলও তাই। স্বাধীনতা সংগ্রামের আকাক্সক্ষার কোনো ধরণের প্রতিফলন এ সংবিধানে ছিল না। তা সত্ত্বেও এ আধা খেঁচড়া ও বিদেশি সংবিধানের অনুকরণে তৈরি দলিলকেই আমরা ‘ÔA bad constitution is better than no constitution’’( বাংলা প্রবাদে যেমন বলা হয় ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল’) হিসেবে গ্রহণ করি।”

তিনি আরো জানাচ্ছেন, “..পাকিস্তানের আদলেই পুনর্গঠিত হল বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রশাসন। আমরা অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম পাকিস্তানের রেখে যাওয়া পূর্ব পাকিস্তান সচিবালয় হলে বাংলাদেশ সচিবালয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র সচিব হলো বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের যে ওসি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের হাতে তুলে দিয়েছিল, সেই ওসি হলো স্বাধীন বাংলাদেশের ওসি। এমন করেই কেবল একটি ভূখন্ড, একটি জাতীয় পতাকা এবং একটি জাতীয় সঙ্গীতকে সম্বল করে পূর্ব পাকিস্তান নাম বদলে ‘বাংলাদেশ’ যাত্রা শুরু করলো। রাষ্ট্রের সর্বত্রই বহাল রয়ে গেলো ব্রিটিশ-পাকিস্তানি আইন কানুন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন কাঠামো ও শাসনব্যবস্থাই স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত হলো।”

অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে পুরানা পাকিস্তান রাষ্ট্রকেই স্বাধীন দেশে পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। রাজাকারের পুনর্বাসনের চেয়ে এটা হাজার গুণ বড় স্বাধীনতাবিরোধী পদক্ষেপ। এর বিরুদ্ধে ওই সময়ের জাসদ বিবৃতি দিয়ে বিরোধীতা করেই দায় সেরেছে। কিন্তু এলএফও’র অধীনে নির্বাচিতদের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও স্বাধীন দেশে নির্বাচিতদের দিয়ে স্বাধীন দেশের উপযোগী সংবিধান প্রণয়নের দাবিতে ধারাবাহিক লড়াই জারি রাখেনি। রাখলে সেই লড়াই হত সমাজবদলের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি। জাসদ সেই রাজনীতি গ্রহণের দূরদর্শিতা ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকেছে। একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান সভার নির্বাচনের দাবি উপক্ষিতেই থেকেছে। যে কর্মসূচি এখনো কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসার সুযোগ রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের দুই ধারা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের দুইটি ধারা। এক. বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারা দুই. কমিউনিস্ট ধারা। বুর্জোয়া ধারাই ছিল প্রভাবশালী ও প্রধান ধারা। আর কমিউনিস্ট ধারা ছিল দুর্বল, বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন এবং তত্ত্বগত জটিলতায় নিমজ্জিত, এ সত্ত্বেও কমিউনিস্ট ধারার অসংখ্য নেতাকর্মী অসম সাহস নিয়ে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছেন। বরিশালের পেয়ারা বাগানে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে বীরত্বপূর্ণ লড়াই; শিবপুরে কাজী জাফর আহমেদ, মান্নান ভূঁইয়া, হায়দার আকবর খান রণো, হায়দার আনোয়ার খান জুনো নেতৃত্বে সফল যুদ্ধ; মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ভূমিকা রেখেছেন দেবেন সিকদার আবুল বাশার প্রমুখ নেতারা। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে লড়াই হয়েছে পাবনা টাঙ্গাইল যশোর নোয়াখালীতে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতা কমরেড আহমদ হোসেনের নেতৃত্বে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘটনার মত অসংখ্য ঘটনা এখনো চাপা পড়ে আছে। দেশের সকল জায়গায় দলীয় পরিচয় অগ্রাহ্য করে লড়াই করেছেন বামপন্থী যুবকেরা।

এটা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ভিত্তিটাই নির্মান করেছিলেন, বুর্জোয়া ধারার মধ্যে সিরাজুল আলম খান এবং কমিউনিস্ট ধারার মধ্যে মওলানা ভাসানী অনুসারীদের প্রগতিশীলরা। বুর্জোয়া ধারার প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়।

বুর্জোয়া ধারার প্রগতিশীল অংশ নিউক্লিয়াসপন্থীরা জাসদ গঠন করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই গড়ে তোলে, অপরদিকে, সিরাজ সিকদরের নেতৃত্বে পূর্ব বাঙলার সর্বহারা পার্টিও একই সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। যুদ্ধোত্তর সময়ে এই দুই ধারার রাজনৈতিক সমীকরণ একই সমান্তরালে আসলে, সে সমীকরণ মেলানো হয়নি। এখনো অন্তত তাত্ত্বিকভাবে সেটা স্বীকার করার সুযোগ রয়েছে।

জাসদ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি বা গ্রুপ সমূহ : জাসদ সম্পর্কে সকল ধারার কমিউনিস্টরা একই ধরণের মত পোষণ করেন। এক্ষেত্রে চীনাপন্থী রুশপন্থীদের মত অভিন্ন।  তারা মনে করেন জাসদ হল র’ এর সৃষ্টি। কেউ কেউ মনে করেন সিআইএ এর ষড়যন্ত্রের ফসল। তারা মনে করেন, তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের সমান্তরালে ভারত রাষ্ট্র কর্তৃক নিউক্লিয়াস নেতাদের নিয়ে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার কারণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়তে যেন তাদের আওতার বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো স্বাধীন শক্তি গড়ে উঠতে না পারে। তাদের বয়ানে মনে হয়, তাজউদ্দীন আহমেদ প্রায় কমিউনিস্ট, ভুল করে আওয়ামী লীগে গেছেন। তারা শেখ মুজিবকে মোকাবিলা করতে গিয়ে তাজউদ্দীনের শরণ নেন। শুধু শেখ মুজিব নয়, জাসদকে মোকাবেলা করতে গিয়েও তাজউদ্দীনের একটা রাজনৈতিক বিবরণী বা ন্যারেটিভ তৈরি করতে চান। কিন্তু এটা বুঝতে পারেন না যে, শেখ মুজিব ছাড়া তাজউদ্দীনের কোনো স্বতন্ত্র অবস্থান নেই। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তিতে শাসনকাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন করায় নিউক্লিয়াসপন্থীরা স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে পারলেও, তাজউদ্দীন পারেননি। ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় সেটা প্রমাণিত। তিনি জাসদের ধারায় আসলে, আর কোনো সম্ভবনা তৈরি হত কিনা, কে জানে। আর সত্যটা হল, মুক্তিযুদ্ধের রেশ শেষ হতে না হতেই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ রচনা করেছিলেন মেজর জলিল। আর সেই জলিলকেই সভাপতি বানায় র’ এর তৈরি জাসদ (!)। কমিউনিস্টদের সকল গ্রুপই জাসদের উত্থানকে ’র এর প্রজেক্ট বলে চালাতে চান।

সেক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা গেছে কমরেড আইউব রেজা চৌধুরীকে। তিনি বলতেন, ‘জাসদের নেতৃত্বে যে এত বড় শক্তির উত্থান হল- সেটা কোনো ষড়যন্ত্রের ফল নয়। ষড়যন্ত্র করে কিছু লোক নিয়ে কানাকানি করা যায়। কিন্তু হাজার হাজার তরুণের প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার লড়াই সংঘটিত করা যায় না। এত বড় শক্তির উত্থানের পেছনে মূল কারণ খুঁজতে হবে তার রাজনীতির মধ্যে। সেই রাজনীতি না খুঁজে, ষড়যন্ত্র খুঁজলে হয়ত নিজেদের সীমাবদ্ধতা আড়াল করার চেষ্টা করা সম্ভব, কিন্তু প্রকৃত রাজনীতি বের করা সম্ভব নয়। আমরা চাই বা না চাই, যে কোনো বড় আন্দোলনে প্রভাবশালী শক্তিগুলো নাক গলাতে আসবেই। সেখানে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার চেষ্টা তারা করবেই। এমনকি সম্প্রতি গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলনেও প্রতিপক্ষরা ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজে। আন্দোলনে প্রভাবশালী শক্তির অস্তিত্ব থাকার কারণে একটা আন্দোলনকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দেওয়া যায় না। বরং আন্দোলনে ভুল প্রবণতা ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করেই বিপ্লবী শক্তির বিকাশ বাধামুক্ত করতে হয়। ষড়যন্ত্র দিয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ বস্তুর পরিবর্তনের মূল ভিত্তি থাকে তার ভেতরে, বাইরের তাপচাপ তাকে সহায়তা করতে পারে মাত্র। একারণে ডিমে তা দিলে বাচ্চা ফোটে, পাথরে নয়।’

অপরদিকে, শেখ মুজিব প্রশ্নে জাসদ বনাম চীনপন্থী, রুশপন্থী কমিউনিস্টদের পাশাপাশি মূল্যায়নে দেখা যাক। রুশপন্থীরা মনে করেন একাত্তরের যুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধোত্তর উভয় সময়েই শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রগতিশীল। উভয় সময়ে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে করেন চীনাপন্থীরা। অপরদিকে, ৭২-’৭৫ এ লড়াই চলাকালে জাসদের একটা ব্যাখ্যা ছিল। তারা বলতেন, যুদ্ধপূর্ব শেখ মুজিব প্রগতিশীল এবং যুদ্ধোত্তরকালে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েন। পরাধীন দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির সীমিত আকারে যে প্রগতিশীল ভূমিকা থাকতে পারে এবং ক্ষমতায় গিয়ে যে তারা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হয়, সেটা কিছুটা হলেও জাসদের মূল্যায়নেই বোঝা যায়।

জাসদের আভ্যন্তরে গোপন সেল, আতুর ঘরেই মৃত্যু : জাসদের একটা প্রবণতা হল, ‘লড়াইটাই আসল, নেতৃত্ব-তত্ত্ব রাজনীতিক লাইন ওসব নিয়ে চিন্তাভাবনার দরকার নাই। পথচলাই পথ তৈরি করে দেবে।’ এসব কথার আড়ালে নেতারা একটা সম্ভবনাকে স্বতঃস্ফূর্ততা, হঠকারিতা ও বালখিল্যতার কাছে বলি দেন। যে হঠকারিতা স্বতঃস্ফূর্ততা ও বালখিল্যতার বিপরীতে জাসদের মধ্যে একটি কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস ছিল, কিন্তু সেই প্রয়াস বেশি দিন টেকেনি। শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গঠনের জন্য দলটির মধ্যে সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি বা সিওসি নামে ১৩ সদস্যের একটি গোপন চক্র গঠন করা হয়েছিল, অনেকটা ১৯৬২-৬৩ সালের নিউক্লিয়াসের আদলে। জানা গেছে, সারাদেশ থেকে বেছে বেছে সত্তর আশি জনকে নিয়ে সিওসি গঠন করা হয়। পরবর্তিতে যারা বাসদ গঠন করেছিলেন, তাদের মধ্যে ওই গোপন চক্রের সদস্য ছিলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক ও আব্দুল্লাহ সরকার। বিকল্প সদস্য ছিলেন মবিনুল হায়দার চৌধুরী।

সিওসি থেকে প্রথমে ‘লাল ইশতেহার’ নামে পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। মাত্র ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর সেটা বন্ধ হয়ে যায় কোনরূপ জবাবদিহিতা ছাড়াই। তার পরিবর্তে ‘সাম্যবাদ’ নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সেটা বেশিদিন আলোর মুখ দেখেনি। কিছুদিন পরেই এসব প্রক্রিয়া ভেঙ্গে দেওয়া হয়। আরো পরে নানা ঘটনা পরম্পরায় একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে জাসদ ভেঙ্গে বাসদ গঠিত হয়। আ ফ ম মাহবুবুল হক বাসদ গঠনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম নেতা ছিলেন। তদানীন্তন নিউক্লিয়াসের সদস্যের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, এমন স্বতঃস্ফুর্ততা দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব-উপযোগী সাচ্চা কমিউনিস্ট পাটি গড়ে ওঠবে না। এরজন্য দরকার হবে সঠিক তাত্ত্বিক ভিত্তির আলোকে বাস্তবসম্মত রণনীতি ও রণকৌশল এবং সচেতন প্রয়াস। তাই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে হাত লাগাতে হবে। এজন্য বাসদ গঠনে আত্ম নিয়োগ করেন। কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের অধিকাংশই থেকে গেলেন জাসদে। বিপুলসংখ্যক সহকর্মীকে জাসদে রেখে অতি অল্প সংখ্যকদের নিয়ে বাসদ গঠনের ঝুঁকি নিলেন তিনি। বাসদ গঠনে যারা এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের অনেকের ভিন্ন ধারার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল। যেমন খালেকুজ্জামান ভুইয়া ছিলেন পুর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (দেবেন-বাশার) সঙ্গে এবং মবিনুল হায়দার চৌধুরী ছিলেন ভারতের এসইউসিআই দলে। আব্দুল্লাহ সরকার ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানা যায়।

কমিউনিস্ট পার্টি গঠন পর্ব : জাসদে যুক্ত হওয়া নিউক্লিয়াস সদস্যের মধ্যে নানা সীমাবদ্ধতা ও ভুলত্রুটি সহ একমাত্র আ ফ ম মাহবুবুল হকই কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে আত্ম নিয়োগ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। অনেকে বলেন, আ ফ ম মাহবুবুল হক যোগ না দিলে বাসদ কখনো দাঁড়াতে পারত না। জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের রাজনীতি গঠনপর্বে মাহবুবুল হকের যে উজ্জ্বলতা ছিল, জাসদ গঠন পর্বে সেটা আরো বেশি দ্যুতি ছড়িয়েছিল। বাসদ অধ্যায়টি আগের দুই পর্বের মত দ্যুতি ছড়ায়নি, বরং নিষ্প্রভ হয়েছে। আগের দুই অধ্যায় বড় বেশি আলোকিত মনে হলেও,  বাসদ গঠনপর্বটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই পর্বে তিনি জাতীয়তাবাদী ধারা থেকে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবাদে উন্নীত হয়েছিলেন।  তিনি জাসদের ‘ধর তক্তা মার পেঁরেক’ কর্মকান্ড থেকে মুক্ত হয়ে সমমনাদের নিয়ে একটি সাচ্চা বিপ্লবী পার্টি গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাসদেও ছিল নানা সীমাবদ্ধতা। জাসদ রাজনীতির যে সীমাবদ্ধতা ছিল, তা নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করা হয়নি বাসদ গঠন পর্বে। অর্থাৎ জাসদ রাজনীতির বিচারমূলক পর্যালোচনা ছাড়াই বাসদ গঠন পর্ব শুরু হয়। অপরদিকে, দেশের অপরাপর কমিউনিস্ট বামপন্থিদের সঙ্গে জাসদের অবৈরী ও বৈরী সম্পর্কগুলো কী, কোন-কোন  ক্ষেত্রে, সেগুলোর তাত্ত্বিক ও কৌশলগত দিকগুলো নির্ধারণ করা হয়নি। জাসদ রাজনীতির অগ্রগতি ও বিচ্যুতিগুলোও চিহ্নিত করা হয়নি। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের (হক ধারা ও মণি সিংহ ধারা) মোটা দাগের অগ্রগতি ও বিচ্যুতি গুলোও চিহ্নিত না করে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্গঠন সম্ভব না। বাসদ যখন নতুনভাবে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে গেল, তখন তার আগের দলেরই শুধু নয়, দেশে ক্রিয়াশীল কমিউনিস্ট আন্দোলনেরও একটি মোটাদাগের সারসংকলন সম্পর্কিত ধারণা দরকার। সমাজ বদলের লড়াইয়ের পথে আসন্ন সংকট সীমাবদ্ধতা কীভাবে মোকাবেলা করে দল গঠন করতে হবে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল না। এসব কষ্টসাধ্য কাজে এগুলেন না নেতৃত্ব। সে সব করণীয় বাদ দিয়ে প্রথমে শিবদাস ঘোষ জ্বরে ভুগলেন, সে অসুখ থেকে আপাত আরোগ্য লাভ করার পরে তারা চিরায়ত কমিউনিস্ট রাজনীতির ধারায় নিপতিত হলেন। বিশেষত আ ফ ম মাহবুবুল হক অংশের বাসদ আন্দোলন করলেন মণিসিংহ ধারার সঙ্গে আর সখ্যতা গড়লেন চীনাপন্থীদের সঙ্গে।

বাসদকে কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে গড়ে তোলার পথটা শুরু থেকেই ছিল কণ্টকিত। বড়ই তিক্ত। নানা বিভ্রান্তি, নানা জটিলতা, ভাঙ্গন আর অনুকরণ করার দোষে দুষ্ট। উছিলা ভিন্ন হলেও ভারতের এসইউসিআইয়ের তাত্ত্বিক নেতা শিবদাস ঘোষের লাইন কড়াকড়িভাবে অনুকরণ করা নিয়ে বাসদেও ভাঙ্গন দেখা দেয়। সেই ঘটনার ৩৩ বছর পর আবার সেই শিবদাস ঘোষকে অথরিটি মানা না-মানা নিয়ে বাসদে (খালেক) বিভাজন ঘটে। এখন যারা শিবদাসকে ছেড়ে দিলেন, সে সময় শিবদাসকে নিয়ে কেন বাসদ ভাঙলেন, এ কৈফিয়ত এখন কেউ না চাইলেও এ প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য জবাব ইতিহাসের কাছে তাদের দিতেই হবে। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসের কাছে এর জবাবদিহি করার দায় কখনো এড়ানো সম্ভব নয়। নিজের চোখ বন্ধ করে চলা মানেই আড়াল নয়। গোজামিল দিয়ে চলা মানে, সঙ্কট এড়িয়ে যাওয়া নয়।

ফের শিবদাস ঘোষ : ভারতের সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার বা এসইউসিআই এর তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন শিবদাস ঘোষ। একাত্তর সালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতীয় সরকারি নীতির পক্ষে ছিলেন। সেই জায়গা থেকে তিনি এবং তার দল বাংলাদেশকে সমর্থন করেছেন। কিন্তু কাশ্মীর কিংবা নাগাল্যান্ডের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকার করেননি। লেনিনীয় নীতির জায়গা থেকে সকল জাতির আত্ম নিয়ন্ত্রণের লড়াইকে সমর্থন করতে হয়। সমর্থন করতে হয় লড়াইরত কমিউনিস্টদের মাধ্যমে, আর কমিউনিস্টদের অবস্থান না থাকলে সেই লড়াইয়ের অগ্রসর অংশের মাধ্যমে।

সেই শিবদাস ঘোষের তত্ত্বের অন্ধ অনুকরণ করা নিয়ে জাসদ ভাঙলো, বাসদ ভাঙলো, ভাঙা বাসদ আবারো ভাঙলো! ফের ভাঙল। অনুকরণবাদ হল উপনিবেশিক শাসনের প্রভাব। সেই প্রভাব কমিউনিস্ট আন্দোলনেও প্রবল। উপনিবেশিক শাসনে পিষ্টরা সব সময় অনুকরণপ্রিয় হয়, তারা নিজেদের মত করে দাঁড়াতে পারে না। অপরের তত্ত্ব অবলম্বন করে দাঁড়ায়। নিজেদের দেশের সমাজ রূপান্তরের তত্ত্বও নিজেরা নির্মাণ করতে পারে না। জাসদ বাসদে শিবদাস ঘোষ সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের চমৎকারভাবে শিখিয়েছে। এই দুর্বলতা থেকে উত্তরণ ছাড়া, কমিউনিস্ট পার্টি তো দূরের কথা, গণতন্ত্র নির্মাণও সম্ভব নয়। এ কথা রুশপন্থি, চীনপন্থি, হোক্সাপন্থি, ট্রটস্কিপন্থি, গ্রামসীপন্থি, এডওয়ার্ড সাঈদপন্থি, আরএসপিপন্থি, এসইউসিআইপন্থি, পল সুইজিপন্থী, সিপিআইপন্থি ও সিএমপন্থিসহ সকলপন্থি রাজনীতির সঙ্গে খাটে।

জানা মতে, নিউক্লিয়াসের নেতৃত্ব কোনো পন্থার শরণ নেননি, জাসদও কোনো পন্থী রাজনীতি করে নাই, এসইউসিআইয়ের শরান্নপন্ন হওয়া জাসদের জন্য শুভ ফলদায়ক কিছু হয়নি।

সহস্রাব্দ ধরে বিদেশি বিভাষী শাসনে শোষণে নিজেদের রক্ত মাংসে গেঁথে যাওয়া উপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাব তথা চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়াটা আগে জরুরি।

বাসদ গঠন ও স্ববিরোধিতা নিয়ে যাত্রা : আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১০ দলীয় জোট করার জাসদীয় ঐক্যের তীব্র বিরোধিতা করে বেরিয়ে আসে বাসদ নেতারা, তারা শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘১৯৮০ সাল জাসদ হলো বাকশাল’। আওয়ামী তখন সদ্য বিরোধী দল। এর আগে, জিয়ার সঙ্গে জাতীয় সরকার গঠন নিয়ে জাসদে বিতর্ক ওঠে (ডিএনজি-এন্টি ডিএনজি)। একে বিরোধীতা করে বের হয়ে আসা নেতারা বাসদ গঠন করেন। অর্থাৎ তখনকার বুর্জোয়াদের ক্ষমতাসীন (জিয়া) ও ক্ষমতাবর্হিভূত (আ.লীগ) অংশের সঙ্গে ঐক্য না করার বিপ্লবী মনোভাব নিয়েই বাসদ গঠন। অথচ বছর না ঘুরতেই ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ওসমানীকে সমর্থন দেয় বাসদ। ওসমানীর মই মার্কায় আরো সমর্থন দেয় আরো দুইটি রাজনৈতিক দল, আওয়ামী বিরোধী সকল বুদ্ধিজীবী ও এনজিও লর্ড ( জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ)। এঘটনার দুই বছর পরেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৫ দল গঠন করে বাসদ। এই স্ববিরোধীতা নিয়েই যাত্রা শুরু করলেন বাসদ নেতারা।

বাসদ গঠন পর্বে সাময়িকভাবে সারাদেশের আগ্রহ তৈরি হয়েছিল দলটিকে ঘিরে। ডাকসু সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে এই দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা নির্বাচিত হয়েছিলেন। জাসদ থেকে বেরিয়ে আসার পর বাসদ আবার ভাঙ্গে ৭ নভেম্বর ১৯৮৩। কিন্তু ভাঙ্গনের পদধ্বনি আরো নয় মাস আগের। একই বছরের মধ্য  ফেরুয়ারিতে জিয়াউদ্দিন বাবলুর সঙ্গে ডাকসুর কিছু সদস্য এরশাদের দলে যোগ দেয়। শতভাগ ছাত্র সংগঠন নির্ভর দলটির অন্যতম খুঁটি স্থানচ্যুত হওয়ার দায় পড়ে আহবায়কের উপর। একটি অরাজনৈতিক প্রসঙ্গকে সামনে এনে, দলকে ভাঙ্গনের মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি সেই দায় থেকে বাঁচার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করেননি।

কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করার জন্য যে উপাদান দরকার, শুরুতেই তার ঘাটতি ছিল, সেই ঘাটতি চিহ্নিত করতে না পেরে একে একে যখন সকলেই দলত্যাগ করতে থাকলেন, নিষ্ক্রিয় হতে থাকলেন, তখন বিপ্লবী পার্টির ভ্রূণটিও আর অবশিষ্ট থাকল না। এক পর্যায়ে নিদারুনভাবে একা হয়ে গেলেন আ ফ ম মাহবুবুল হক।

বাসদ গঠন করা হল জাসদের রাজনীতি ‘ভুল’ ছিল বলে। এটাই বাজে কথা। বরং বলা উচিত ছিল দেশিয় শাসকশ্রেণি উচ্ছেদের যে সঠিক রাজনীতি নানা সীমাবদ্ধতাসহ জাসদ চর্চা করেছে, যে রাজনীতি করার কথা একটি কমিউনিস্ট পার্টির। সুতরাং একটি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে জাসদের রাজনীতিকেই আরো পুণর্গঠিত করে এগিয়ে নিতে হবে। এভাবে জাসদের রাজনীতিকে বিচারমূলক সমালোচনা করলে, তাকে আরো পরিশীলিতভাবে পুনর্গঠন করার সুযোগ থাকত। জাসদের রাজনীতিকে পুনর্গঠন না করে, আমদানি হলো শিবদাস ঘোষের তত্ত্ব, আবার সেই অনুকরণ। এছাড়াও গতানুগতিক ও একই চক্রাবৃত্তে ঘূর্ণায়মান কমিউনিস্ট আন্দোলনে গা ভাসিয়ে দেয় বাসদ। নানা সীমাবদ্ধতা সহ দেশিয় শাসকশ্রেণি উচ্ছেদের রাজনীতিই চর্চা করেছে যৌবনকালের জাসদ। সেখানে সীমাবদ্ধতা ছিল। ব্যক্তি শাসককে যে ভাবে মোকাবেলা করতে গেছে, সেখানে আড়ালে পড়ে গেছে শ্রেণি প্রশ্নটি। আরেকটি সীমাবদ্ধতা ছিল, দেশিয় শাসকশ্রেণি বিরোধী লড়াইয়ের অধীনস্থ করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইকে এড্রেস করতে না পারা। এই আলোচনার আরো বিস্তার করা যায়, তবে আপাতত এখানেই ইতি টানছি।

জাসদের রাজনীতির বিচারমূলক সমালোচনার কাজ এখনো বকেয়া আছে। অনুকরণের রাজনীতি না করেই জাসদের উত্থান, আবার পরবর্তিতে অনুকরণে অনুমোদন দিয়েই তার পতন।

প্রতিটি রাজনৈতিক ধারারই একটা তত্ত্ব থাকে, জাসদের ছিল। কিন্তু তার প্রকাশ ছিল, সে প্রকাশে সীমাবদ্ধতা ছিল, সেটার সবটুকুর লিখিত রূপ ছিল না, সেটা করার কষ্টও করতে চায়নি শুরুর সময়ের জাসদ নেতারা। এজন্য তারা নির্ভর করেছেন অন্যের ওপর। এই দুর্বলতা ও তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনার অপারগতা থেকেই এসেছে শিবদাস ঘোষের খয়রাতি তত্ত্বের যুক্তিহীন অনুকরণবাদ। বাসদ গঠনের পরে নেতাদের একাংশ সচেতনভাবেই শিবদাসকে অনুমোদন করেন। আর আ ফ ম মাহবুবুল হক যে অংশের নেতৃত্ব দিতেন, সেখানে সুযোগ ছিল দল গঠনে অন্ধ-অনুকরণের রাজনীতির বাইরে এসে একটি বিপ্লবী দলের তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে তোলার। দলে বেশকিছু পোড় খাওয়া লোক ছিলেন। কিন্তু ওই পোড় খাওয়া মেধাবীদের মধ্যে ছিল ক্যারিয়ার গড়ার প্রবল ব্যক্তিবাদ। তারা আর সমাজ বদলের কষ্টকর আন্দোলন-সংগ্রামে থাকেননি। নিজের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করেছেন দেশে ও বিদেশে। অপরদিকে, জাসদের এবং এই ভূখন্ডে ক্রিয়াশীল কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ সার সংকলন করার কষ্টকর কাজ না করেই চীনপন্থীদের সঙ্গে সখ্যতা রেখে বজায় রাখতে চেয়েছেন নিজের বিপ্লবী সত্তা।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে প্রভাবশালী ধারা সম্পর্কে কমরেড আইউব রেজা চৌধুরী বলেছেন, “বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অবস্থানের দিক থেকে দীর্ঘদিন যাবত দুটি প্রাধান্যমূলক ধারা ক্রিয়াশীল রয়েছে। একটি হল মণি সিংহ ধারা (মণি সিংহ-খোকা রায়-অনিল মুখার্জি-বারীন দত্ত)। অপরটি হল আব্দুল হক ধারা (আব্দুল হক-মোহাম্মদ তোয়াহা-সুখেন্দু দস্তিদার-অজয় ভট্টাচার্য)। বাংলাদেশে এ সময়ে মণি সিংহ ধারার প্রধান বৈশিষ্ট হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের (একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ) শ্রেণিসমন্বয়মূলক বা লেজুড়বৃত্তিমূলক মূল্যায়ন। বাংলাদেশের বুর্জোয়া পার্লামেন্ট ও বুর্জোয়া নির্বাচনের ভূমিকার অতি ইতিবাচক মূল্যায়ন। অপরদিকে বাংলাদেশে এসময়ে আব্দুল হক ধারার প্রধান বৈশিষ্ট হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের (একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ) যান্ত্রিক বা নেতিবাচক মূল্যায়ন। বাংলাদেশে বুর্জোয়া পার্লামেন্ট ও বুর্জোয়া নির্বাচনের ভূমিকার অতি নেতিবাচক মূল্যায়ন। বাঙলাদেশের পুঁজিবাদের বিকাশের ধারার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে অক্ষমতা।

বাঙলাদেশে রুশপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সুনির্দিষ্ট রূপ হল মণিসিংহ ধারা। বাঙলাদেশে চীনপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সুনির্দিষ্ট রূপ হল আব্দুল হক ধারা।

..... বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বেশির ভাগ অংশ এখনো হয় মণি সিংহ ধারা নতুবা আব্দুল হক ধারারই অর্ন্তভুক্ত।”

তিনি আরো বলেছেন, “চীনপন্থী রাজনীতি ছিল মূলত যান্ত্রিক ও হঠকারী। (কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিশীল উপাদনসহ)। অপর কথায় চীনপন্থী রাজনীতি ছিল মূলত বাম তরফের সংশোধনবাদী।” রুশপন্থী সম্পর্কে আরো বলেছেন, “..রুশপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতি ছিল মূলত: শ্রেণি সমন্বয়মূলক ও আপোষমূলক (সাধারণভাবে কিছু কিছু প্রগতিশীল উপাদান সহ)। অপরকথা রুশপন্থী রাজনীতি হল ডান তরফের সংশোধনবাদী। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন রুশপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে ভারতপন্থী রাজনীতি ছিল বিশেষভাবে সম্পর্কিত বা জড়িত।”

এখালে উল্লেখ করা দরকার যে, প্রবল প্রভাবশালী রাশিয়া ও চীনের উপস্থিতি সত্বেও জাসদ যাবতীয় পন্থী রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ছিল। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল সকল কমিউনিস্ট ধারাই জাসদকে প্রতিবিপ্লবী বলে অভিহিত করে কিংবা করতে চায়। 

আ ফ ম মাহবুবুল হক রাজনৈতিক জোট করেছেন রুশপন্থী ধারার রাজনীতিকদের সঙ্গে আর সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন চীনপন্থী ধারার রাজনীতিকদের সঙ্গে। তার অংশের বাসদ ১৫ দল, ৫ দল, বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও ১১ দল গঠন করেছেন মণিসিংহ ধারার বামপন্থীদের সঙ্গে। আর মাও সে তুং জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন, পেরুর মাওবাদী কমিউনিস্ট নেতা গুজম্যানের জীবন রক্ষা কমিটি, শহীদ বিপ্লবী দেশপ্রেমিক স্মৃতি রক্ষা কমিটি প্রভৃতি আয়োজনে বাসদ কাজ করেছে মাওবাদীদের সঙ্গে।

স্বপক্ষত্যাগী জাসদ-বাসদ : ১৯৮০ সালে ভাঙ্গনের পর জাসদ বাসদ উভয়ই স্বপক্ষ ত্যাগ করে তত্ত্বগত ক্ষেত্রে উদভ্রান্ত থেকেছে। জাসদ রাজনীতির সার সংকলন না করে বাসদ গেছে চিরায়ত কমিউনিস্ট ধারায় আর জাসদ গেছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ভাষ্য নির্মাণে। জাসদের সেই ভাষ্যগুলো ছিল, ১. পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর দেশ উল্টো পথে যাত্রা শুরু করেছে। ২. তখন থেকেই দেশ পাকিস্তানি ধারায় চলে যায়, তার আগে সেটা মুক্তিযুদ্ধ ধারায় ছিল। ৩. আমরা ভাইয়ে ভাইয়ে (জাসদ-আওয়ামী লীগ) মারামারি করে অন্যকে ক্ষমতায় আনার জায়গা করে দিয়েছি। নিজেদের মধ্যে সংঘাতের উদাহরণ হিসেবে কেউ কেউ মহাভারতের কৌরব আর পান্ডবদের মধ্যেকার কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের উদাহরণ টানতেন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তারা এসব কথা এক নাগারে বলে এসেছেন। এসব ন্যারেটিভ বা ভাষ্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার বৈধতা তৈরি করে দিয়েছে। বিনিময়ে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেয়েছে তারা। সেই অবস্থান থেকে সরে আসেনি জাসদ। কিন্তু সত্যটা হল এটাই যে, বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে পাকিস্তানের ও ব্রিটিশের ফেলে দেওয়া পচাগলা উপনিবেশিক রাষ্ট্রের পুনরুজ্জীবন ঘটানো হয়। এছাড়া পুরানা আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনকেও বহাল রাখা হয়। সেটাই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পদক্ষেপ, সেখান থেকেই দেশ পাকিস্তানি ভাব ধারায় চলে গেছে। আর   সংবিধান প্রণয়নকালে জাসদ শুধু বিবৃতি দিয়েই দায় সেরেছে, কার্যকর আন্দোলনে যায়নি। পরবর্তিতে সামরিক শাসকরা পাতাল থেকে তুলে আনার সুযোগ পেয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলতার যাবতীয় অন্ধকার, ধর্মীয় কূপমন্ডুকতার জঞ্জাল।

তত্ত্ব ও আন্দোলনে বিরোধ : বাসদ ৫ দল গঠন করে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তার আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল গঠনে ভূমিকা রেখেছে। সেখানে দুই নেত্রীকে আন্দোলনে এক করার আন্তরিক প্রয়াস ছিল। এরশাদ পতন আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দ্বি-দলীয় ধারা (আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এক ধারা, বিএনপির নেতৃত্বাধীন আরেক ধারা) ক্ষমতায় যাওয়ার শক্তি অর্জন করে। সামরিক জান্তা এরশাদ দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হওয়া বিএনপি ছিল বিপর্যয়ের মুখোমুখি। আর সে সময় আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল নিষ্ক্রিয়, দুর্বল, ভঙ্গুর, বিভক্ত ও হতাশাগ্রস্ত। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে সেখান থেকে এ ২টি দলের উত্তরণ ঘটে, তারা শক্তি সঞ্চয় করে। দ্বিদলীয় ধারা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার ভরকেন্দ্র এই দুটি দলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে শুরু করে। এই দ্বি দলীয় ধারার প্রতিষ্ঠায় জাসদ বাসদসহ সিপিবি ও পাঁচ দলের রাজনীতি দায়ী। সে সময় নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও  খালেদা জিয়াকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ১৫০/১৫০ তত্ত্ব দিয়েছিলেন সিপিবি নেতা মোহাম্মাদ ফরহাদ। ওই দুই দলকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল এদেশে বামপন্থিরাই। তারাই দ্বিদলীয় ধারার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে। বাসদও সামিল হয়েছিল সেই রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির সঙ্গে জোট বাধার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্মসূচিগত অর্থে নিজেদের স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখেনি বাসদ এর সকল অংশ। সেই জায়গাটির আত্মসমালোচনা ছাড়া দ্বিদলীয় ধারার বিরুদ্ধে বাম বিকল্পের  স্লোগান একটা ফাঁকা আওয়াজ। সেটা হাস্যকরও বটে। কিন্তু সেই আত্মসমালোচনা এখনো চোখে পড়েনি। জাসদ-বাসদ উভয়ই তার রাজনৈতিক কৌশল থেকে সরে গিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।

এরশাদ পতনের পরে এরাই বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করে। সেই একই মনোভাব, একই ধারার রাজনীতি একই চক্রাবৃত্তে ঘূর্ণায়মান। শেষে বাহাত্তরের সংবিধান পুণপ্রতিষ্ঠার দাবি নিয়ে দুই বাসদই ১১ দলে যুক্ত হয়, সেটা বাসদের রাজনীতির বিপরীত মেরুর রাজনীতি ছিল। এখানে বলা উচিত আ ফ ম মাহবুবুল হকের বাসদ বামফ্রন্টে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে ১১-দলে যুক্ত হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে বাসদের বক্তব্য ছিল-‘এতে দেশে বামশক্তি সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বে। এটা বিলুপবাদের পথ। বড় দুই বুর্জোয়া দলের বিপরীতে ব্যক্তি কেন্দ্রিক ছোট ছোট পেটিবুর্জোদের লেজুরবৃত্তি করা। আগের জোট রাজনীতির বিবেচনায় ১১ দলীয় জোট করা আরো অধপতন। ’

বাসদ গঠনের পর নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে জোটবদ্ধ থাকাই হয়েছে তাদের নিয়তি, এককভাবে পথ চলার নজির নেই বাসদের কোনো অংশেরই। এরশাদের শাসনামলে ১৫ দল এবং ৫ দলের রাজনীতি মূলত ওয়ার্কার্স পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যেভাবে মিলে, বাসদের রাজনৈতিক লাইনের সঙ্গে সেটা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। সেই কথাটি আরো জোরালোভাবে খাটে বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের রাজনীতির বেলায়, আরো বিশেষভাবে খাটে ১১ দলের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ বাসদ করেছে ওয়ার্কার্স পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি, নিজেরটা বাদ রেখে। সেখানে উভয় অংশই নিজেদের রাজনীতির প্রতি বিশ্বস্ত ছিল না।

বিপ্লব, দল ও জীবন : ‘দলই জীবন বিপ্লবই জীবন’ এই চেতনায় রাজনীতি করার ছবক দিতেন বাসদ নেতারা। কী যান্ত্রিকতার খপ্পরেই না পড়েছিলেন কর্মীরা! জীবনের প্রেম-প্রীতি, মায়া, ভালবাসা, শিল্পকলা, সুকুমারবৃত্তি, ভাল উপন্যাস সব কিছুই বলি দিতে হবে দলের কাছে। এসব বাদ দিয়ে সারাক্ষণ শুধু দল আর বিপ্লব বিপ্লব জপতে হবে। আসলে জীবন তো হল মহৎতম উপলব্ধি, জীবন তো অনেক বড়, যা নিজের সীমানা ভাঙতে ভাঙতে মহাকাশের মত বিশালতায় তার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দিতে চায়। জীবনকে বিকশিত ও সুন্দর করার ক্ষেত্রে পদে পদে নানাবিধ বাধা। সে বিবেচনায় এই সময়ে মহাজীবনের পথে বড় বাধা হল পুঁজিবাদ। মানুষ প্রকৃতি পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের চক্রক্রম বিনষ্ট করে দেয় পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদ। এই বাধা অপসারণের জন্যই চাই বিপ্লব, আর বিপ্লবের জন্যই গঠন করা দরকার দল ও তত্ত্ব। তাহলে জীবনের সুন্দরতম উপলব্ধির ক্ষেত্রে আর কোনো যান্ত্রিকতাই থাকে না। তখন বিষয়টি কত জীবন্ত হয়ে ওঠে।

দলে বিপর্যয় শুরু : এরশাদ পতন আন্দোলনকাল থেকেই ভেতরে ভেতরে বাসদ রাজনীতিতে ক্ষয় রোগ শুরু হয়। আন্দোলনের তেজোদ্বীপ্তে সেটা সামনে আসতে পারেনি, তাই উপলব্ধি করা যায়নি সেই ক্ষয়রোগ। এরশাদ পতন পরবর্তিকালে সেই ক্ষয়রোগ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। ধীরে ধীরে একে একে নেতারা দল ছাড়তে থাকেন, দেশ ছাড়তে থাকেন, নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েন অনেকে। কেউ কেউ দলের বিরুদ্ধে, দলের নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বিষোদগার করতে থাকেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকালে মাহমুদুর রহমান মান্না দল ভেঙ্গে জনতা মুক্তি গঠন করেন। বাসদ-ছাত্রলীগের তখনকার সাধারণ সম্পাদক, আগের কমিটির সভাপতি সাধারণ সম্পাদকসহ অনেকেই সেই নতুন দলে যোগ দেন। যারা সেই পরিস্থিতিতেও মাহবুবুল হকের সঙ্গে থাকেন, তারা বাস্তব পরিস্থিতি না বুঝেই নানা ধরণের সীমাবদ্ধতা নিয়েই প্রাণপণে দলটিকে একটি বিপ্লবী ধারায় নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকেন। যেন বুক দিয়ে পাহাড় ঠেলে, বুক ক্ষত বিক্ষত করতে থাকেন, ভেতরে রক্তক্ষরণ হলেও পাহাড় এক চুলও নড়াতে পারেন না তারা।

তারা যতই নিজেদের বুঝ-বিবেচনা অনুযায়ী দলের ভেতরের করণীয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করতে থাকেন। দলের তত্ত্ব বিনির্মাণের সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরার চেষ্টা করেন। কিন্তু সামান্য কর্মীর কথা কানে তোলার সময় ছিল না নেতাদের। কিংবা নেতারাই তখন সময়ের ফাঁদে অসহায় শিকার হয়ে আছেন, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছেন না। একে একে নেতাকর্মীরা দল ত্যাগ করতে থাকেন, দেশ ত্যাগ করতে ও নিষ্ক্রিয় হতে থাকেন, এভাবেই বাসদের বিপ্লবী তেজ নিঃশেষ হতে হতে একদম তলানিতে এসে ঠেকে।

বিপর্যস্ত দলে আন্তরিক কর্মী : একটা বামপন্থি বিপ্লবী দলের রাজনীতি ও সাংগঠনিক শক্তিতে বিপর্যয় হলে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হন সেই দলের সবচেয়ে আন্তরিক কর্মীরা। দল ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ে এসব আন্তরিক কর্মীদের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। না পরিবারে, না সমাজে। ইতোমধ্যে তাদের বয়স থেকে তারুণ্য বিদায় নেয়, শরীরে জরা নেমে আসে। স্বাভাবিক জীবনের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কারন, বিপ্লবী কর্মীরা লড়াই করেন বিদ্যমান শোষণমূলক ও পচা-গলা সমাজের বিরুদ্ধে, তাই বিদ্যমান ব্যক্তিমালিকানাভিত্তিক সমাজের মূলধারা থেকে বিপ্লবীদের বিচ্ছিন্নতা অনিবার্যভাবে ঘটে যায়। একারণে সমাজে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রকরা এসব কর্মী-সংগঠকদের বিশ্বাস করে না। আর এসব নেতাকর্মীদের যে চরিত্র বৈশিষ্ট গড়ে ওঠে, তা দিয়ে চাকুরি বাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্য চলে না। তাই দলের বিপর্যায়ে এসব কর্মীদের পরিণতি হয় খুবই করুণ, ভাষায় অপ্রকাশ্য। সমাজে প্রচলিত সম্পর্কের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। দল ছাড়া এরা দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্বলের ঔদ্ধত্য মানুষ পছন্দ করে না। বাসদ যখন নিষ্প্রভ হতে থাকে তখন দলে উপদলীয় চক্র গড়ে ওঠে। নেতারা কান কথা পছন্দ করতে থাকেন। দলে গ্রুপিং মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। নেতাদের মধ্যে স্ববিরোধ দেখা দেয়। কর্মী-সংগঠকরা বিভ্রান্ত হন, তাদের আদর্শনিষ্ঠা ধূলিসাৎ হয়ে যায়, দলের আদর্শের সঙ্গে বিরোধাত্মক সম্পর্ক গড়ার প্রবণতা তৈরি হয়। অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অনেক কমরেড মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। অনেকে পাগল হয়ে যান। অনেকের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা চলে আসে। এ অবস্থায় বামপন্থি দলের কর্ম-সংগঠকরা পালিয়ে বাঁচতে চান। দেশ ত্যাগ, দল ত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। পুরনো সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শের আধার নিজ-পরিবারে আত্মসমর্পণ করেন। এসব প্রবণতা বাসদেও লক্ষ্য করা গেছে। জানা মতে ক্ষয়িষ্ণু ও বিপর্যস্ত সকল দলেও একই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। এরই মধ্যে সম্ভবত ২০০২/০৩ সালের দিকে ১১ দলের শরীক দল ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলে তথা মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতোমধ্যে আ ফ ম মাহবুবুল হকের বাসদ ১১ দল থেকে সরে আসে এবং ৫ বাম দল গঠন করে।

জাসদীয় রাজনীতির পরিশীলিত রূপ : বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ হল সীমাবদ্ধতাসহ প্রগতিশীল লড়াই। মুক্তিযুদ্ধে আপাত বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক সীমাবদ্ধ দিক রয়েছে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকে ‘মহান’ হিসেবে বর্ণনা করা কিংবা ‘দুই কুকুরের লড়াই’ হিসেবে অভিহিত করা যায় না। পরাধীন বা প্রায় উপনিবেশিক দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার হিস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও  লোভনীয় পদ-পদবি নিয়ে বিদেশি-বিজাতীয় শাসকদের সঙ্গে স্থানীয় উঠতি বুর্জোয়াদের কখনো বৈরী কখনো অবৈরী দ্বন্দ্ব থাকে। সেকারণে তারা জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে সীমিত আকারে প্রগতিশীল ভূমিকা রাখে। কিন্তু স্বাধীন দেশে ওই বুর্জোয়া শ্রেণি রাষ্ট্রযন্ত্র হাতে পেয়ে লুটেরা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হয়। প্রকাশ পায় তাদের গণবিরোধী চরিত্র। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জওহর লাল নেহেরুর সরকার, পাকিস্তানে নবাবজাদা লিয়াকত আলি খানের সরকার এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের বেলায় এ বিশ্লেষণ সর্বাংশে মিলে যায়।  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী থেকে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়েছে। বর্তমান যুগ হল পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগ। পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে একটি স্বাধীন দেশের বুর্জোয়া শ্রেণিই হল সেই দেশের শ্রমিক, গরীব কৃষক এবং অর্থনীতির সূচকে নিচের দিকে গড়াতে থাকা ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের প্রধান শত্রু। তাই দেশীয় শাসক শ্রেণিকে উচ্ছেদের লড়াই হল প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম। তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর খনিজ সম্পদ ও সুন্দর বন রক্ষার লড়াই হল রাজনৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই এবং পরিবেশ রক্ষার সংগ্রাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন, নারীর ওপর নিগ্রহের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন হল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ হল মেহনতী জনগণের নিকৃষ্ট শত্রু। ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াইও অন্যতম মূল লড়াই। প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রামের অধীনস্থ করেই এসব সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। আর প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম হল দেশিয় শাসকশ্রেণির উচ্ছেদের লড়াই।

আগামীর বিপ্লবী আন্দোলন ও আ ফ ম মাহবুবুল হক : নানা ভুল-ক্রুটি ও অন্যান্য সীমাবদ্ধসহ ওপরে বর্ণিত রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা করেছিলেন মাহবুবুল হক। তার লড়াইয়ের বিচারমূলক পর্যালোচনা ছাড়া পরবর্তি বিপ্লবী আন্দোলন দাঁড়াবে না। এটা বাংলাদেশের যে কোনো বিপ্লবী ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেই খাটে। কাউকে দেবতা বানিয়ে, তাকে নিয়ে মিথ তৈরি করে সমাজ বদলের রাজনীতি গড়া যায় না। লেনিনীয় শিক্ষা হচ্ছে-ইতিহাস নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট করণীয় দাবি করে; সেই রাজনৈতিক কর্তব্য উপলব্ধি করতে পরাটাই মূল কাজ।

আ ফ ম মাহবুবুল হককে কেন প্রয়োজন: বাংলাদেশে বিপ্লবী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ধারণ করেন শুধু তাদের অনুসারিরা। সকল ধারার বিপ্লবীদের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোনো চরিত্র খুঁজে পাওয়া যায় না, যার ছবি ঘরে টানিয়ে রাখা যায়। সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ, জাসদ গঠন, বাসদ গঠন এবং পরে ১১ দল পরিত্যাগ করে ৫ বাম দল গঠনের মাধ্যমে আ ফ ম মাহবুবুল হক প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতির নেতৃত্বের অঙ্গনে তিনি অনেকের চেয়ে অগ্রসর। তিনি সফল হননি, তার অনেক সমালোচনা ও সীমাবদ্ধতা আছে। তার আরো বিচারমূলক পর্যালোচনা করা যায়, তার সমালোচনাও করা যায়। এই লেখাতেও কিছুটা করা হয়েছে। কিন্তু আ ফ ম মাহবুবুল হকের আপসহীনতা এবং রাজনীতির বাঁকে বাঁকে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রসর অবস্থান রয়েছে। যাকে সমালোচনাসহ ধারণ করা যায়। তাকে করতে পারেন মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসর ধারা (মাওলানা ভাসানীর ও সিরাজুল আলম খানের প্রগতিশীল অংশ) এবং দেশের নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্টরা। সমাজ বদলের নতুন সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আ ফ ম মাহবুবুল হক আমাদের সেই ঐক্যের জায়গা তৈরি করে দিতে পারেন। কারো মৃত্যু যদি জীবনের জন্য এমন বিস্তৃত জায়গা তৈরি করে দেয়, এমনটি যদি সত্যসত্যই ঘটে যায় এবং সেটা ঘটানো সম্ভব। তাহলে একই চক্রে ঘূর্ণায়মান শতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বৃত্তটি ভেঙ্গে ফেলার আরেকটি আয়োজন শুরু করা সম্ভব। যে স্বপ্ন দেখতে জানে না, সে অপরকে স্বপন দেখাতেও জানে না।

(লেখক :  কমিউনিস্ট ইউনিয়নের সমন্বয়ক এবং বাসদ-ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি।)

 

সহায়ক/তথ্যসূত্র :

(১) আহমেদ ফজলুর রহমান মুরাদ এর ফেসবুক থেকে।

(২) আমি সিরাজুল আলম খান, একটি রাজনৈতিক আলেখ্য, শামসুদ্দিন পেয়ারা, মওলা ব্রাদার্স।

(৩) দ্বিতীয় ধারার রাজনীতি, (‘আভ্যন্তরীণ পরাধীনতা’ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও শাসনব্যবস্থা সম্বলিত ১৪ দফা) সিরাজুল আলম খান।

(৪) এ সময়ের কমিউনিস্ট রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ও পর্যালোচনা, আইউব চৌধুরী। দীপ্র প্রকাশ।

(৫) রাষ্ট্রচিন্তা

(৬) সোভিয়েত সমাজের ইতিহাস, লোকায়ত্ত রূপরেখা, প্রগতি প্রকাশন মস্কো।

(৭) ঞযব চৎড়ন, পত্রিকায় সিরাজুল আলমের সঙ্গে আলাপচারিতা

(৮) ভি আই লেনিন, কালেক্টিভ ওয়ার্কস ২৪ খন্ড (এপ্রিল-জুন ১৯১৭), প্রগ্রেস পাবলিশার্স, মস্কো।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ