Banner
কাশ্মীর নিয়ে কিছু কথা — মো. শহীদুল্লাহ

লিখেছেনঃ মো. শহীদুল্লাহ, আপডেটঃ February 3, 2023, 12:00 AM, Hits: 963

কাশ্মীর নিয়ে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের রয়েছে শিহরণ জাগানিয়া স্মৃতি ও ভাবনা। হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম-উত্তর পাদভূমিতে প্রকৃতির নয়ন জোড়ানো শোভা ও সৌন্দর্য নিয়ে এই ভূখণ্ড অবস্থিত। এর স্নিদ্ধ ও শান্ত নীল আকাশ, ডাল হ্রদের ভুবন মোহিনী রূপ আর বরফ ঢাকা পর্বত শৃঙ্গে সূর্যালোকের তরঙ্গায়িত সোনালি নৃত্য ভ্রমণবিলাসী রসিকজনকে যুগ যুগ ধরে করে চলেছে মাতোয়ারা। টেনে নিয়েছে এই যাদু উপত্যকায়। এ জন্যই পর্যটকের চোখে কাশ্মীর হচ্ছে ভূস্বর্গ। যেখানে রয়েছে হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের বসবাস। কুটির শিল্প, কৃষি, পশুচারণ ও পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাশ্মীরের অর্থনীতি। মানব সভ্যতার আদি অনেক প্রত্নচিহ্ন ও ইতিহাসের সাক্ষ্য রয়েছে এই জনপদে। নির্মল বাযু, নানা জাতের ফুল ও ফল, দামী পশমি বস্ত্র এবং থরে থরে সাজানো দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য কাশ্মীরের রয়েছে জগতজোড়া সুখ্যাতি। অন্যদিকে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, জাতিগত নির্মূলীকরণ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের করুণ অতীত।

কাশ্মীর শব্দের অর্থ জলাভূমি। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় ‘কা’ শব্দের অর্থ পানি, এর সঙ্গে শীমির প্রত্যয় যুক্ত হয়ে কাশ্মীর শব্দের উৎপত্তি। শৈব পুরাণসমূহ এবং সনাতন ধর্মের অতি প্রাচীন(খ্রিস্টপূর্বে লেখা) গ্রন্থগুলোতে এ রকম বর্ণনা আছে। এছাড়া স্থানীয় লোককথা, শ্রুতি ও স্মৃতি-সাহিত্য থেকে জানা যায় — কাশ্মীর বলতে বোঝায় পানি থেকে উদ্ভূত ভূমি। কাশ্মীরী লোককাহিনীতে বলা হয়েছে বৈদিক যুগের মহর্ষি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতির চর্চাকারী কাশব্য মুনির নামানুসারে এই সুন্দর উপত্যকার নাম হয়েছে কাশ্মীর।                                                        

উইকিপিডিয়া থেকে কাশ্মীরের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানা যায় The greater region of Kashmir borders the Pakistani provinces of Khyber Pakhtunkhwa (formerly known as North-West Frontier Province) and Punjab in the west, the Wakhan Corridor of Afghanistan to the north, the disputed area of Aksai Chin (formerly part of Ladakh), the Chinese Autonomous regions of Xinjiang and Tibet in the east, and the Indian state of Himachal Pradesh to the south.  

প্রাগৈতিহাসিক কাশ্মীরে প্রথমে সনাতনী শৈব ধর্মের সমাজ ও শাসন ছিল, প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থে এই সময়কালকে খ্রিস্ট্রীয় পঞ্চম শতাব্দীরও আগের কাল পরিক্রমা বলে উল্ল্যেখ করা হয়েছে। এ ধর্মের মতানুসারে দেবতা শিব সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। কোনো কিছুর পরিবর্তন বা ধ্বংসও হয় একমাত্র তার ইচ্ছায়। মানবাত্মর মরণ ও পরজগতের সুখ-শান্তির বিধান তিনিই করেন। এই সমাজচিন্তা শত শত বছর চলার পর কাশ্মীরের সমাজে প্রভাব বিস্তার করে গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত অহিংসার ধর্ম। এই ধর্মের মূল কথা অহিংসা পরম ধর্ম, জীব হত্যা মাহা পাপ এবং আত্মার নির্বাণ লাভই মানব জন্মের একমাত্র লক্ষ্য। মানবাত্মার এই নির্বাণ যদি লাভ করা না য়ায়, তবেই বিরাট মুশকিল, কেননা মনুষ্য ও প্রাণি-যৌনির মাধ্যমে আত্মাকে বারবার ফিরে আসতে হবে এই পৃথিবীর মায়া জগতে এবং পাপ ও পংকিলতাপূর্ণ ভব-সংসারে। বলতে দ্বিধা  নেই, ওই সময়ের শ্রুতি, গীতি, স্তব-স্তুতি এবং দান-ধ্যান-ধর্ম সম্পর্কে বিস্তর কল্প-কাহিনী ও কাব্য গাথা রয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের পুরনো পুঁথি-পুস্তকে। মানবগোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক ইতিহাসে এসবের মূল্য আছে বৈকি, তবে ভারতবর্ষের প্রাচীন কালের ইতিহাস ও রাজনৈতিক সমাজ-সংগঠন বলতে আমরা যা বুঝি — তা কিন্তু শুরু হয়েছে প্রথম সহস্রাব্দ(১০০০ খ্রি.) থেকে। নবম শতাব্দীর শেষ দিকে কাশ্মীরে শৈবধর্মকে প্রায় হটিয়ে দিয়ে এর স্থান পূরণ করে বৌদ্ধধর্ম। কিন্তু ওই বৌদ্ধসভ্যতা কাশ্মীরের সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য-সংহতি তিন শত বছরের বেশি ধরে রাখতে পারেনি। তখন কাশ্মীরের উপর বাড়তে থাকে মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের আক্রমণ। এমনি এক পরিস্থিতিতে ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম নৃ-পতি শাহ মীর কাশ্মীর দখল করেন। তিনি কাশ্মীরে শাহ মীর রাজবংশের শাসন প্রবর্তন করেন।

মোঘল শাসকরা ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে কাশ্মীর বিজয় করেন। এরপর থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাশ্মীর ছিল মোঘল সাম্রাজ্যভুক্ত। এরপর ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কাশ্মীর উপত্যকা ছিল আফগান দুররানি রাজবংশের শাসনে। তারপর শিখ সমরনায়ক রণজিৎ সিং কাশ্মীর দখল করেন। ১৮৩৯ সালে রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যুর পর, সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে তার দুই পুত্র খড়গ সিংহ ও শের সিংহের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই পটভূমিতে অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে (১৮৪৯ খ্রি.) রঞ্জিৎ সিং প্রতিষ্ঠিত শিখ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ঐ বছরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৭৫ লাখ নানকশাহী রূপির (তৎকালীন শিখ মুদ্রা) বিনিময়ে কাশ্মীর উপত্যকা এবং বালটিস্তান, কারগিল ও লেহ, এই তিন এলাকা সমন্বয়ে গঠিত লাদাখ অঞ্চলকে দেশীয় রাজ্য হিসেবে মহারাজা গোলাব সিংয়ের কাছে বিক্রি করে দেয়। এই গোলাব সিং ডোগরা হচ্ছেন কাশ্মীরের ডোগরা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। এরপর তিনি আগে থেকেই তার শাসনে থাকা জম্মু অঞ্চলের সঙ্গে কাশ্মীর ও লাদাখকে একত্র করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য গঠন করেন। গিলগিট ও পামির মালভূমির কিয়দংশ এই দেশীয় রাজ্যের (প্রিন্সলি স্টেট) সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে এর আয়তন আরো বৃদ্ধি পায়।

ডোগরা বংশের সেনাপতিরা গিলগিট এলাকা ও পামির মালভূমির অনেক ভূখণ্ড দখল করে তাদের এই রাজ্য সম্প্রসারিত করেছিলেন। তবে এই রাজ্যের ৬৮ ভাগ প্রজা ছিল মুসলমান। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোলাপ সিং সবসময়ই সতর্ক ছিলেন তার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রজাদের নিয়ে। তিনি তার মুসলিম প্রজাদেরকে সুনজরে দেখতেন না। চাকরি, ব্যবসা, দান ও রাজকীয় অনুগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি হিন্দুদের প্রধান্য দিতেন। সেনাবাহিনীর অফিসার পদে কোনো মুসলিম যুবককে নিয়োগ দেওয়া হতো না। তার পুত্র মহারাজা রণবীর সিং কাশ্মীরকে সম্পূর্ণ হিন্দুরাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তিনি একটি রাজকীয় দফতর স্থাপন করেছিলেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার এবং এ ধর্মটিকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য। তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল তার রাজ্যের শাসনক্ষমতা যেন হিন্দু ব্যতীত অন্য কারো হাতে না যায়। রণবীর সিংয়ের পুত্র প্রতাপ সিংয়ের শাসন ও মন-মানসিকতাও ছিল মুসলিমবিরোধী। তার ভাইপো মহারাজা হরি সিং সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৯২৫ সালে। তিনি ছিলেন মুসলিম প্রজাদের ওপর নিপীড়নকারী ও উগ্রহিন্দুত্ববাদী। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের(আরএসএস) নেতা এবং হিন্দু ধর্মের গুরুদের সঙ্গে তার ছিল সুসম্পর্ক। তিনি তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই আরএসএস কাশ্মীরী পণ্ডিতদের প্রবীন নেতা প্রেমনাথ ডোগরাকে প্রধান করে কাশ্মীর ও জম্মুতে প্রজা পরিষদ নামের হিন্দুত্ববাদী ও সামন্ত প্রথার পক্ষে গণসংগঠন গড়ে তুলে। এ সংগঠন কাশ্মীরকে নিশর্তভাবে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেছিল। পাশাপাশি এ সংগঠনটি কাশ্মীরের রাজনৈতিক পার্টি অল জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্স-এর নেতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ শেখের গণমুখী ভূমিসংস্কার (পূর্বপাকিস্তানে এ কে ফজলুল হকের দ্বারা জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের মত) নীতির বিরোধিতা করে এবং মহারাজা হরি সিংয়ের পক্ষ নেয়। এ সংগঠনের নেতাদের ভয় ছিল আবদুল্লাহর ভূমিসংস্কার নীতি যদি সফল হয় তা হলে ডোগরা ও পণ্ডিত সম্প্রদায়ের ভূস্বামীরা জমি ও তালুকদারি হারাবেন, সমাজে তাদের ক্ষমতা ধসে পড়বে। এ সময় কাশ্মীর ও জম্মু রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান তরুণ মহারাজা হরি সিং ডোগরা প্রজা পরিষদের পক্ষ নেন। এ কারণে তাকে ক্ষমতা চ্যুত করার হুমকি দিয়েছিলেন মুসলিম কনফারেন্সের নেতা আবদুল্লাহ, এই পটভূমিতে আরএসএসের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন জম্মু প্রজা পরিষদ মহারাজা হরি সিংয়ের পক্ষ নেয়। এ সব কারণে আরএসএস এবং ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত শ্যামা প্রসাদ মুখার্জির ভরতীয় জনসংঘের আত্মিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে কাশ্মীরের সঙ্গে। ১৯৫৩ সালে জম্মু প্রজাপরিষদ কাশ্মীর রাজ্যকে ভারতভুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য কাশ্মীর সরকারের অনুপ্রবেশ আইন অমান্য করে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি এ রাজ্যে প্রবেশ করে গ্রেফতার হন। ১৯৫৩ সালে শ্রীনগর কারাগারে বন্দি অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষনিঃশ্বাস  ত্যাগ করেন। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় মহারাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের হিন্দু মহাসভায় যোগদানের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৯ সালে তিনি এ সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। উল্লেখ্য, বাঙালি এই নেতা কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষাবিদ স্যার আশুতোষ মুখার্জির পুত্র। ১৯৪৭ সালে ভারত ইংরেজের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন কংগ্রেস সভাপতি কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ বংশের পণ্ডিত ও ব্যারিস্টার জওহরলাল নেহেরু। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি এই মন্ত্রিসভার শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জন সংঘের প্রতিষ্ঠাতা এবং উগ্র সাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন। ব্রিটিশ শাসিত বঙ্গপ্রদেশ ভাগ করার  ক্ষেত্রে একদিকে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলিম লীগ এবং অন্যদিকে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভার বেপরোয়া ভমিকা ছিল।

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ শাসক, ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ ভাগ করে পাকিস্তান ও  ইন্ডিয়া নামের দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই দেশ ভাগের সময় ভারতে ৫৬২টি করদরাজ্য(প্রিন্সলি স্টেট ছিল)। এ সব রাজ্যভুক্ত ভূখণ্ডের আয়তন ছিল গোটা ভারতবর্ষের আয়তনের ২৪ শতাংশ। এগুলোকে তৎকালে রাজা বা মহারাজা শাসিত স্বাধীন রাজ্য বলে অভিহিত করা হতো। ভুললে চলবে না দেশীয় এই রাজা-মহারাজারা ছিলেন সমাজের আধুনিক সংস্কারের বিপক্ষে। তারা ছিলেন বর্ণ প্রথা নির্ভর ব্রহ্মণ্যবাদের লালন-পালনকারী এবং ভয়ংকর প্রজা নিপীড়ক। ’৪৭-এ দেশভাগের সময় এই করদরাজ্যগুলোর ব্যাপারে নীতি ছিল- করদরাজ্যের রাজা কিংবা মহারাজা ইচ্ছে করলে নবসৃষ্ট পাকিস্তানে বা ভারত রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। অন্যদিকে তারা ইচ্ছে করলে স্বাধীন থাকতে পারবেন। তাই কাশ্মীরের রাজা হরি সিং গভর্নর জেনালের লর্ড মাউন্টবেটেনের কাছে অভিমত ব্যক্ত করেন যে তিনি স্বাধীন থাকবেন, তার রাজ্য ভারত বা পাকিস্তানে যুক্ত হবে না। সে অনুযায়ী তিনি কাশ্মীরের সীমান্ত-স্থিতি বাজায় রাখার জন্য পাকিস্তান ও ভারতের সরকারকে চুক্তি স্বাক্ষরের আহবান জানান। পাকিস্তান সঙ্গেসঙ্গেই এ চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু ভারত আলোচনার কথা বলে সেই চুক্তির বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। পরে তা আর সই করেনি ভারত। এরমধ্যেই কাশ্মীর ও জম্মুতে  দেশভাগজনিত সম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পরে। কাশ্মীরী মুসলমানদের সিংহভাগ পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন থামানোর জন্য হরি সিংয়ের সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের(আরএসএস) সশস্ত্রবাহিনী মুসলিমদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। তখন জম্মু ও কাশ্মীরে কত মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক তথ্য উদ্ধার করা এখন আর সর্বাংশে সম্ভব না। তবে সে সময়ের সরকারি বিবৃতি এবং পত্রপত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায় এ সংখ্যা বিশ হাজার থেকে ২ লাখের বেশি। অন্য দিকে কাশ্মীরের যে অংশ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং  যুদ্ধবাজ পশতুন (পড়ুন পাঠান) সশস্ত্র বাহিনীর দখলে চলে যায় সেখানে    (রাজউরি ও মীরপুর এলাকায়) ৫০ হাজার শিখ ও হিন্দুকে হত্যা করা হয়। এই যে পাকিস্তানপন্থি ও ভারতপন্থি সশস্ত্র শক্তি- এরা উভয়পক্ষই নারী অপহরণ ও গণহারে ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান হরি সিংকে চাপ দেয় পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার জন্য। তখন পাকিস্তানের মদদপুষ্ট পশতুন সশস্ত্র মুজাহিদ বাহিনী কাশ্মীরের পশ্চিম এলাকা আক্রমণ করে। পাঠান গোত্রপতিদের লালিত-পালিত লুটেরা বাহিনীও কাশ্মীরে ঢুকে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ,নারীনিগ্রহ এবং খুন-খারাবি চালিয়ে জম্মুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ অবস্থায় হরি সিং তার জীবন রক্ষার জন্য দিল্লিতে আশ্রয় নেন এবং নিজ রাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের শর্তে ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭। তখন ভারতের গভর্নর জেনারেল মাউন্টবেটেন বিমানে করে কাশ্মীরে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে হরি সিংয়ের রাজ্য রক্ষা করেন। তবে কাশ্মীর থেকে বহিরাগত আক্রমণকারীদের হটানোর জন্য সেনা অভিযানের আদেশে লর্ড মাউন্টবেটেন বলেন, ‘আপাতত কাশ্মীরে শান্তি স্থাপন এবং আক্রমণকারীদের মোকাবিলার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে কাশ্মীরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। কাশ্মীরের যে অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে আছে সেটি আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালটিস্তান এলাকা নিয়ে গঠিত। এ অঞ্চলটির আয়তন ৮৫ হাজার ৭৯৩ বর্গকিলোমিটার। ভারতভুক্ত জম্মু-কাশ্মীরের আয়তন ২ লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বর্গকিলোমিটার। কাশ্মীর রাজ্যের লাদাখ অঞ্চলের কিয়দংশ চীন দখল করে নেয় ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে। যে ভূমিটুকুর আয়তন ১৫ হাজার বর্গমিলোমিটির, নাম আকসাই চীন,  ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে এই এলাকাটুকু দেখতে মুরগির গলার আকৃতির। চীনের দখলে থাকা আফগানিস্তানের এই অঞ্চলকে কূটনৈতিক ভাষায় চিকেন-নেক বলা হয়। ১৯৬২ সালে একটি সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান গিলগিট ও বালটিস্তানের ৫ হাজার ১৮০ বর্গকিলোমিটার ভূখণ্ড চীনকে দিয়ে দেয়। এ এলাকাটি এখন চীনের শিনজিয়ান প্রদেশের উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত এলাকাভুক্ত।

কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ বাধে ১৯৪৭ সালে। যা চলে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে এই যুদ্ধের বিরতি ঘটে ১৯৪৮ সালে। উভয় দেশই যুদ্ধবিরতি রেখা মেনে নিয়ে কাশ্মীর থেকে সেনা সরিয়ে নেয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের সৈনিকরা জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকা দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এই যুদ্ধ থামানোর জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই দুই দেশের ওপরই অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। শেষে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার তাসখন্দে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। 

শিমলা চুক্তি : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানের শাসন-শোষণ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এ যুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং ভারতের সেনাবাহিনী মিলে মিত্রবাহিনী গঠন করে পাকিন্তানকে পরাজিত করেছিল। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার  সৈনিক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে আত্মসমপর্ণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এই বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবন্দির নিরাপত্তা এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের  পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই এ বন্দিদের ভারতের হাতে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৭২ সালের ২ জুলাই ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শিমলায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি বলে পাকিস্তানের বন্দি সৈনিক ও কর্মকর্তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালি  পেশাজীবী,  সরকারি- বেসকাররি চাকরিজীবী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা লোকজন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ওই চুক্তিতে কাশ্মীর সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে উভয় দেশই কাশ্মীরে ‘নতুন নিয়ন্ত্রণ রেখা’ মেনে নেয়। যা এখন দুই কাশ্মীরের (পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর ও ভারত শাসিত কাশ্মীর) মধ্যে লাইন অব কন্ট্রোল(এলওসি) নামে অভিহিত। তা ছাড়া শিমলা চুক্তি অনুযায়ী কাশ্মীর সমস্যা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে একান্তই দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে পরিণত হয়। এতদসংক্রান্ত কোনো বিরোধ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার জন্য দুই পক্ষই অঙ্গীকার বদ্ধ। এ বিষয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ বা অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই।

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহর মধ্যে কাশ্মীর অ্যাকর্ড নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তিতে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের ৩৭০ ধারা বজায় রেখেই ভারতের আইনসভাকে (লোকসভা) জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য সম্পর্কে আইন প্রণয়নের আরো ক্ষমতা দেওয়া হয়। যার সারকথা হচ্ছে — কাশ্মীরে যদি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যাতে ভারতের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার, ভূখণ্ডের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি এবং কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার কর্মকাণ্ড মাথাচাড়া দেয়, তাহলে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের ব্যাপারে নতুন আইন, আদেশ ও পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার রাখে।

দুই কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে বর্তমানে তিন ধরণের মত আছে। ১. কাশ্মীর- কাশ্মীরীদের, স্বাধীন কাশ্মীর চাই। এই মতের লোক এখন খুব কম। জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক জোট হুররিয়াত কনফারেন্সের নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানি ২০২১ সালে ৯২ বছর বয়সে মারা গেছেন। সম্প্রতি ভারতের জাতীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে হুরিয়াত কনফারেন্সের কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা (এনআইএ)। ওদিকে অসুস্থ অবস্থায় কারাগারে আছেন জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা ইয়াসিন মালিক। কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের সংগ্রাম এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কাশ্মীরের এ ধরনের খণ্ড-জাতীয়তাবাদী ও ধর্মকেন্দ্রিক উগ্র ও সশস্ত্র সংগ্রামের আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ২. পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চাই। এই মতের মানুষরা প্রধানত মুসলিম, শতকরা হারে খুব সামান্য। ৩. ভারতের সঙ্গে থাকাই ভালো, কেননা বিশ্বায়িত মুক্তরাজার অর্থনীতির এ যুগে, কাশ্মীরে উৎপাদিত পশমিবস্ত্র ও সেখানকার পর্যটন শিল্প বৃহৎ ভারতের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এ মতের মানুষরা সাধারণত উদারবাদী হিন্দু, কমিউনিস্ট এবং ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ;  কাশ্মীরের লোকসংখ্যার নিরীখে এই মতের মানুষ এখন শতকরা হারে অনেক বেশি। কিন্তু সমস্যা হলো- ভারত ও পাকিস্তানের উগ্রজাতীয়তাবাদী শাসকরা। তারা কাশ্মীরীদের জনমতের তেমন গুরুত্ব দেন না। এখনকার ভারত সরকার পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরের(!) দাবি জোর গলায় প্রচার করছে, অন্যদিকে ভারত শাসিত কাশ্মীরের পুরোটাই চায় পাকিস্তান। এই রাজনৈতিক দাবির সীমারেখার মধ্যে থাকতে রাজি নন পাকিস্তানের জঙ্গি-পছন্দ শাসক ও রাজনীতিকরা। তারা অস্ত্র, অর্থ ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে কাশ্মীরে ইসলামি জঙ্গি ও জিহাদিদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এই ভূস্বর্গকে ভূনরকে পরিণত করেছিল। এই পরিস্থিতিতে (৪ আগস্ট, ২০১৯) ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচ ৩৭০ ও ৩৫-ক ধারা বাতিল করেছিল। এরপর মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে দুই ভাগ করেছে। একটি  জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য। অন্যটি লাদাখ রাজ্য। এ দুই রাজ্যেই আপাতত দুই জন লেফটেনেন্ট গভর্নরের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি রয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে হাজার হাজার সেনা। তবে ৩৭০ ধারা রদ-আইনে বলা হয় সুবিধামত সময়ে জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকার গঠন করা হবে। 

আমি মনে করি ৩৭০ এবং ৩৫-ক ধারার কারণে কাশ্মীরের সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বুর্জোয়া বিকাশ আটকে ছিল। ওখানে সামন্ত যুগের মানবতাবিরোধী আইন ও প্রথা টিকে ছিল। যেমন, প্রজা-নিপীড়ক ও মুসলিম বিদ্বেষী হরি সিং এবং তার পূর্বসূরি ডোগরা রাজারা কাশ্মীরে গরু জবাই বন্ধ করে আইন করেছিলেন। তাদের প্রণীত মধ্যযুগীয় বর্বর আইনে আছে- ‘কোনো কাশ্মীরী নারী রাজ্যের বাইরের কাউকে বিয়ে করলে তিনি পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। হিন্দু-মুসলিমের বিবাহ নিষিদ্ধ এবং কোনো হিন্দু প্রজা ধর্মান্তরিত হতে পারবে না। ভারতের অন্য স্থানের কোনো ভারতীয় কাশ্মীরে জমি কিনতে পারবে না, স্থায়ী সম্পদ অর্জন করতে পারবে না। ভারতের অন্য অংশের কেউ কাশ্মীরে স্থায়ীভাবে বসবাস ও চাকরি করতে পারবে না।’ এরবাইরে  মৌলবাদী হিন্দুদের জাতপাতের ভুজঙ্গ-ফণা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিষাক্ত নিঃশ্বাস তো কাশ্মীর উপত্যকায় গোড়া থেকেই ছিল, এখনো আছে। এসব কী! এগুলো তো জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ পরিপন্থি। অন্যদিকে মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকার খর্বকারী আইন ও প্রথা। ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের পর স্বাধীনতা (ব্যক্তির সার্বিক মুক্তি) সাম্য ও সামাজিক সহমর্মিতার নীতি-ই যেখানে মানবসমাজের এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় এবং যুক্তিগ্রাহ্য রাষ্ট্রনীতি হিসেবে স্বীকৃত সেখানে ডোগরা রাজাদের পশ্চাৎপদ আইন ও প্রথাগুলো কী এখনো চলতে দেওয়া উচিত? আমি পরিষ্কারভাবে মনে করি ভারতের সংবিধানে কাশ্মীর বিষয়ক ৩৭০ ধারা ছিল ভারতভূমির ওই অংশে বুর্জোয়া বিকাশের অন্তরায় এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজ গড়ে ওঠার পথে কঠিন বাধা। নরেন্দ্র মোদির সরকার এই বাধা দূর করে সময়ের গুরু দায়িত্ব পালন করেছে। ভারত এর সুফল পাবে অদূর ভবিষ্যতে। তখন ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে উপকৃত হবেন কাশ্মীরের মানুষ। তারা ধীরে ধীরে ধর্মভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার কুহেলিকা থেকে মুক্ত হয়ে মানবিক সমাজ গড়তে পারবেন।

৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর ভারতীয় সমাজের মূলধারার জীবন, আইন ও সংস্কৃতিতে সমন্বিত হয়েছে, অন্য দিকে ভারতীয় সমাজ শুধুই কি ভারতীয়? মোটেই না। এখনকার ভারতীয় সমাজ নিঃসন্দেহে বিশ্বসমাজের অংশ ও শরীক। সেকারণে এখন কাশ্মীরের মানুষ ক্রমশ পরিচিত হবেন উন্নত ও আধুনিক বিশ্বসমাজের সঙ্গে। অন্যদিকে আশঙ্কা কমেছে এই সুন্দর উপত্যকাটি তালেবান, আইএস ও পাকিস্তানের মদদপুষ্ট জঙ্গীদের অভয়ারণ্য হওয়া থেকে। ৩৭০ ধারা বাতিল নিয়ে আজ যারা ইসলামি জোশে সোচ্চার, তারা কাশ্মীরে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের দ্বারা হিন্দু পণ্ডিত ও অন্য সংখ্যালঘুদের হত্যা ও বিতাড়নের সময় তো কথা বলেননি। ভেবেছেন কাশ্মীর তো মুসলমানদের দখলে আসছে, কী মজা! ভুললে চলবে না, একটা ধর্মীয় চরমপন্থা আরেকটা আরো খারাপ এবং বিপজ্জনক চরমপন্থাকে ডেকে আনে। কাশ্মীরেও তাই হয়েছে। পাকিস্তানের মদদপুষ্ট ইসলামি জঙ্গিবাদ ঠেকাতে এসেছে গেরুয়া ফ্যাসিবাদ। ভার্সাই চুক্তির ফলসরূপ জার্মানিতে যেমন উত্থান হয়েছিল নাৎসিবাদী নেতা অ্যাডলফ হিটলারের। ঠিক তেমনি ওয়াহাবি মোল্লাদের জঙ্গি-জিহাদি ও রাজনৈতিক ইসলামের জবাব দিতে ভারতবর্ষে গড়ে ওঠেছে উগ্র ও ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্ববাদ। এই ধর্মীয় স্বৈরতন্ত্র সংখ্যালঘুর সাংস্কৃতিক অধিকার স্বীকার করে না। পাত্তা দেয় না সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমবিকাশকে। সমাজকে টেনে নিতে চায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের অদ্ভূত সব লোকশ্রুতি ও ঐন্দ্রজালিক মনোভাবনার দিকে। ভারতে এখন সেই চেষ্টা চোখে পড়ার মত। আরেকটা কথা, যারা প্রগতিশীল, বামপন্থি এবং কমিউনিস্ট, তারা ফিলিস্তিনের শরিয়াপন্থি  জঙ্গি দল হামাস এবং কাশ্মীরের ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের সমর্থন করে থাকেন। কিন্তু কোন যুক্তিতে? এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পাইনি। আমরা জানি কাশ্মীরে ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের মদদপুষ্ট নামধারী ইসলামপন্থিদের জঙ্গি-উত্থানের পর জম্মু অঞ্চল থেকে লক্ষাধিক কাশ্মীরী পণ্ডিতকে তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। তাদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাদেরকে অস্ত্রের মুখে তাদের জন্মভূমি থেকে উৎখাত করা হয়েছে।  তখন ফারুক আবদুল্লাহ, মেহবুবা মুফতি কিংবা কোনো মুসলিম দেশ বা ইসলাম-দরদী পার্টি কি বিবেকের তাড়নায় বলেছে- কাশ্মীরের পণ্ডিত তথা হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর অন্যায় হচ্ছে? কাশ্মীরী পণ্ডিতদের ওপর ওই জুলুম ও নিপীড়নের প্রতিবাদ কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট ও বামরা শক্তভাবে করেননি। করেছে বিজেপি এবং এই পার্টির ভ্রাতৃপ্রতীম হিন্দুত্ববাদী গণসংগঠনগুলো। তাই দেশের হিন্দুজনতা এই দলের পক্ষেই তো যাবে। তাছাড়া বিজেপির রয়েছে দেশকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনায় সুসংহত করার অর্থনৈতিক ও ধর্ম-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি এবং সে অনুযায়ী বিশাল কর্মকাণ্ড। তবে আমি বলতে  মোটেই দ্বিধাবোধ করবো না যে,  বিজেপি ও এর শরীকদলগুলো হিন্দু উগ্রবাদী এবং চরম ডানপন্থি। এ ধরনের পার্টি ও সংগঠন সেক্যুলার গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশ ও উন্নয়ন চায় না। সেকারণে এই রাজনৈতিক চরিত্রের পার্টি বা জোটের শাসন অনিবার্যভাবে দেশের দলিত জনগোষ্ঠী এবং অন্য ধর্মীয় ও নৃ-তাত্ত্বিক সংঘ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যায়। সে কারণে কাশ্মীরেও বিজেপির শাসন ওখানকার সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিপক্ষে গেছে এবং আরো যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলনের জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাব আছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ও ভারত শাসিত কাশ্মীরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের। কিন্তু ভারত ও পাকিস্তান এই গণভোটের কথা বার বার এড়িয়ে গেছে। এই উভয় রাষ্ট্রই চায় কাশ্মীর ইস্যুর সামরিক সমাধান। একারণে এই কাশ্মীরকে নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দুই বার যুদ্ধ হয়েছে। বার বার হয়েছে সীমান্ত সংঘর্ষ। এতে  কাশ্মীরের মাটি রঞ্জিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিমের রক্তে। কিন্তু ভূস্বর্গতুল্য কাশ্মীরে শান্তির পায়রা বাসা বাঁধছে না। এর কারণ বহুবিধ। তবে প্রধান কারণ হচ্ছে ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রচিন্তা। যে সর্বনাশা চিন্তা একই সামাজিক ও সমআর্থিক স্তরের মানুষকেও সমানাধিকার, শোষণ মুক্তি, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিকযুক্তি ও বিজ্ঞানমনস্কতার আলোকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় না। কাশ্মীরের হিন্দু মুসলিমের বেলায়ও হয়েছে তাই। সে কারণে বললে বাড়তি বলা হবে না যে ভারত শাসিত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের জবরদখলকৃত কাশ্মীরে সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা আসতে আরো কয়েক যুগ সময় লাগবে। তবে পাকিস্তানের শাসকরা শিমলা চুক্তি বার বার লংঘন করেছে। তারা ভারতে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশে সহায়তা করে কাশ্মিরে রক্ত ঝরিয়েছে। কাশ্মীরী হিন্দুদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়েছে। কারগিল যুদ্ধ বাধিয়েছে। মধ্যযুগীয় তুরস্কের ধর্মকেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক উসমানীয় সাম্রাজ্যের নব-সংস্করণ হচ্ছে বর্তমানের পাকিস্তান রাষ্ট্র। এই ইমলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের দুধ-কলায় পুষ্ট হয়ে ইসলামি জঙ্গিরা ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কাশ্মীর ইস্যুতে সুপ্রতিবেশী সুলভ আচরণ করেনি। এতে পাকিস্তানের খুব যে মঙ্গল হয়েছে তা নয়। দেশটি এখন প্রায় দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ‘অপরের চালে ঢিল ছুঁড়লে নিজের বাড়ির চালে পাথর পড়ে’ পাকিস্তানের হয়েছে এখন এই দশা। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ও সামরিক অর্থে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে পাকিস্তানের।

লেখক : সাংবাদিক, সাবেক ছাত্রনেতা 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ