Banner
আফগানিস্তান : যুদ্ধ-বন্দিনী ভারত-নারীর কন্যা-সন্তান — শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ July 27, 2023, 12:00 AM, Hits: 983

বিষয়সূচী :

১। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত

২। সিন্ধু সভ্যতা থেকে খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি

৩। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে  আধুনিক যুগ পর্যন্ত সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পটভূমি

৪। আফগানিস্তানে নারীর উপর আরোপিত অবরোধের ঐতিহাসিক-সামাজিকি ভিত্তি

 

১। অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত

তালিবান অধিকৃত আজকের আফগানিস্তান আর পশুপ্রায় অবস্থায় পতিত ও অবরুদ্ধ নারী যেন দুইটি সমার্থক শব্দ। বস্তুত আফগানিস্তানের কথা উঠলে প্রথমেই একটা জাতির অর্ধেক অংশ নারীকে সমাজ-জীবন থেকে বিতাড়িত ক’রে গৃহের অবরোধে ও পঙ্গু জীবনে ঠেলে দেওয়ার কথা মনে আসবে।

মনে প্রশ্ন জাগা উচিত যে, আজকের যুগে এটা কীভাবে সম্ভব? এটা ঠিক যে, ইসলাম ভয়ঙ্করভাবে নারী নিগ্রহী ধর্ম। সুতরাং ইসলাম যেখানে গেছে সেখানেই নারীর অবস্থার ক্রমিক অধোগতি হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ইউরোপের হাত ধরে আধুনিক সভ্যতার জয়যাত্রার মুখে একদিকে যেমন মুসলিম পৃথিবীর দেশে দেশে মুসলিম শক্তির পরাজয় ও পতন ঘটে চলেছে, অপর দিকে তেমন নারীর অবস্থারও ক্রমোন্নতি ঘটছে। এটা ঠিক যে, এই উন্নতিতে ছন্দপতন আছে, যেমন ইরান। ইরানে ১৯৭৯ খ্রীষ্টাব্দে শিয়া মোল্লাদের নেতৃত্বে ইসলামী অভ্যুত্থানের পর থেকে নারীর অবস্থার নিদারুণ অবনতি ঘটেছে। এতটা না হলেও কোথায়ও কোথায়ও সমাজে ইসলামের শক্তি বৃদ্ধির কারণে নারীর অবস্থার কম-বেশী অবনতি বিভিন্ন মুসলিম দেশে বিভিন্ন সময়ে কিছু করে ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু তারপরেও সামগ্রিকভাবে মুসলিম পৃথিবীর নারীরাও এখন পূর্বের তুলনায় অনেকটা স্বচ্ছন্দভাবে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ প্রসঙ্গে সৌদী আরবে নারীর অবরোধমুক্তির কথা উল্লেখ করা যায়। সৌদী আরব যেন মুসলিম পৃথিবীকে উল্টেপাল্টে দিতে চলেছে। এ ক্ষেত্রে সৌদী যুবরাজ ও প্রধান মন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বমূলক ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ঠিক এর বিপরীত পথে চলছে আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের ইতিহাস বলে এটা তার ভয়ঙ্কর অন্ধকার অতীতের দিকে যাত্রা। এই ভয়ঙ্কর অন্ধকার অতীতেই তার ইতিহাসের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে। তবে তার আগেও অনেক দূর অতীতে আছে ভিন্ন আর এক আফগানিস্তান — যার এক বৃহদাংশ ছিল আলোকোজ্জ্বল ও গৌরবময় সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত। আফগানিস্তানে সিন্ধু সভ্যতার বসতির কিছু চিহ্ন পাওয়া গেলেও তা দিয়ে বেশী কিছু ধারণা করা যায় না। তবে এটা বুঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার প্রান্তে এবং সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্য পথের মধ্যে অবস্থিত এই ভূ-ভাগ এক সময় সিন্ধু সভ্যতার ছায়ায় বিকশিত হয়েছিল। তবে সিন্ধু সভ্যতার মতো দূর অতীত নিয়ে বেশী কথা বলা না গেলেও পরবর্তী কালের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য ও ঐতিহাসিক দলিল থেকে অতীতের আফগানিস্তান সম্পর্কে অনেক তথ্যই পাওয়া যায়। এগুলির উপর নির্ভর করে আমরা আফগান সমাজ ও ইতিহাসের বিকাশধারা সম্পর্কে একটা মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা করতে পারি।

আফগানিস্তান সম্পর্কে যে কোনও আলোচনার সময় মনে রাখতে হবে যে, আফগানিস্তানের ভাগ্যের সঙ্গে ভারতবর্ষ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার মূলভূমির ভাগ্য গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে। কারণ ভূ-প্রাকৃতিক কারণে আফগানিস্তানকে ইরান ও মধ্য এশিয়ার বিশাল ভূভাগ থেকে ভারতে প্রবেশের দরজা বা দ্বার বলা চলে। ভারতের উত্তর ও উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালা সেদিক থেকে ভারতে প্রবেশকে প্রায় অসম্ভব করে রেখেছে। অন্যদিকে, ভারতের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ ভূভাগ সমুদ্র বেষ্টিত। পশ্চিমে অবস্থিত বালুচিস্তান এক মরুপ্রায় বৃহৎ অঞ্চল, যা যাতায়াতের জন্য বিরাট বাধা হয়ে থেকেছে। এই অবস্থায় অতীতে স্মরণাতীত কাল থেকে ভারত থেকে তার বাইরে বিপুল বাণিজ্য সম্ভার যাবার স্থলপথ যেমন ছিল আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে তেমন দূর দূরান্তের বণিকদের কাফেলাও স্থলপথে ভারতে আসত আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে।

এ হল ঐতিহাসিক বিচারে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিক। কিন্তু ঐতিহাসিক বিচারে তার আর একটা অতীব গুরুত্বের দিক আছে। সেটা হচ্ছে সামরিক। যুগ যুগ ধরে ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পদ বিদেশী আক্রমণকারীদেরকে এই উপমহাদেশ আক্রমণে প্রলুব্ধ করেছে। গ্রীক, ইরানীয়, শক, হুন, তুর্কী, মোঙ্গল, মোগল ইত্যাদি প্রায় সকল আক্রমণকারী বাহিনী মূলত আফগানিস্তান পার হয়ে ভারতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অর্থাৎ তাদের সবাইকে আসতে হয়েছে আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে। এর ব্যতিক্রম হল অষ্টম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের আরব আক্রমণকারীদের সিন্ধুজয়, আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজ বণিকদের বাংলাজয়। আরব আক্রমণকারীরা অভিযান চালিয়েছিল সমুদ্র পথে, ইংরেজ বণিকদের প্রবেশও ঘটেছিল সমুদ্র পথে। কিন্তু এ দু’টি সাধারণভাবে ব্যতিক্রম। এ ছাড়া উপমহাদেশে উল্লেখযোগ্য সকল আক্রমণকারীর বৃহদায়তন আক্রমণ অভিযানগুলি পরিচালিত হয়েছিল আফগানিস্তানের ভিতর দিয়ে।

সুতরাং মূল ভারতভূমিতে প্রবেশদ্বার হিসাবে আফগানিস্তান যেমন ভারতকে বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ ও সমৃদ্ধির সুযোগ এনে দিয়েছে তেমন বৈদেশিক হানাদারদের আক্রমণ অভিযানের মাধ্যমে ভারতবাসীকে অপরিমেয় দুঃখ, দুর্গতি, ধ্বংস ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে সাহায্যও করেছে। বিশেষত আজকের আফগানিস্তানকে বুঝতে হলে তার উপর দিয়ে ভারতভূমিতে স্মরণাতীত কাল ধরে আসা লুঠেরা ও হানাদারদের আক্রমণ অভিযানসমূহের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা পেতে হবে। অর্থাৎ আজকের আফগানিস্তান কিংবা তার নারীর এমন অকল্পনীয় দুর্গত অবস্থার উৎস সম্পর্কে ধারণা করতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

 

২। সিন্ধু সভ্যতা থেকে খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি

আলোচনার শুরুতে আমরা যে কথা বলেছি তার জের টেনে বলি, ভৌগোলিক অবস্থান ও রাজনৈতিক কারণে অনেক প্রাচীন কাল থেকে আফগানিস্তান বৈদেশিক আক্রমণাভিযানের শিকার হয়েছে। এখানে একে একে বহিরাক্রমণ ঘটেছিল পারসিক, গ্রীক, শক, হুন, আরব, তুর্কী, মোঙ্গল ও মোগল সম্রাট বাবরের বাহিনীর। এই অঞ্চল মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যোগাযোগের পথে থাকায় এখানকার মানুষ অসংখ্য বার বিদেশী হানাদারদের আক্রমণাভিযান, লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞের সহজ শিকার হয়েছে।

সিন্ধু সভ্যতার সময়ে (২৬০০ খ্রীঃপূ থেকে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত) আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল সিন্ধু সভ্যতার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে ছিল। এর পরের আফগানিস্তানের ইতিহাস অস্পষ্ট। বৌদ্ধ সাহিত্যে যে ষোলটি মহাজনপদের উল্লেখ আছে তার মধ্যে গান্ধার ও কম্বোজের নাম পাওয়া যায়। গান্ধার আজকের আফগানিস্তানের পূর্ব অংশ, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ পেশোয়ার জেলা ও উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের রাওয়ালপিণ্ডি নিয়ে গঠিত ছিল। প্রকৃতপক্ষে তা কাবুল উপত্যকা থেকে সিন্ধু নদীর পূর্বে তক্ষশিলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই রাজ্যের পশ্চিমের রাজধানী ছিল পুষ্কলাবতী।* এর ধ্বংসাবশেষ এখনও, কাবুল ও সোয়াত নদী যেখানে মিশেছে সেখান থেকে কিছু উপরে, পেশোয়ার থেকে ১৭ মাইল উত্তর-পূর্বে চরসদ্দায় (পারাং-এর কাছে) আছে। বুদ্ধের সময়ে তক্ষশীলা গান্ধার রাজ্যের রাজধানী ছিল ও পুষ্কলাবতী একটি প্রধান নগর ছিল। পারস্যের রাজা দারিউসের (প্রায় ৫২২-৪৮৬ খ্রীঃপূঃ) অধিকার ও আকামেনীয় সাম্রাজ্যের অধীন হবার পর পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজধানী পুষ্কলাবতী তার রাজনৈতিক গুরুত্ব হারায়।

----------------------------------------

* দেখুনঃ G.P. Singh, Republics, Kingdoms, Towns and Cities in Ancient India, D.K. Printworld (P) Ltd., New Delhi, 2003, pp. 118-119.

----------------------------------------

আরেকটি বৃহৎ জনপদ কাম্বোজের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, এর পশ্চিম সীমানা আফগানিস্তানের বল্খ-বাদাখশান এবং পামীর অঞ্চলে বা পূর্ব আফগানিস্তানের কাফিরিস্তানে, এবং পূর্ব সীমানার মধ্যে পড়েছে প্রাচীন রাজপুর বা আধুনিক রাজৌরির দক্ষিণ বা পুঞ্চের দক্ষিণ-পূর্বে।* এর রাজধানী ছিল দ্বারকা বা দারওয়াজ। তবে এটি গুজরাটের দ্বারকা নয়।

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২০।

----------------------------------------

এই সমস্ত বিবরণ থেকে ধারণা করা যায় যে, আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকে বুদ্ধের সময়েরও কিছু পরে পর্যন্ত বৃহত্তর ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অংশ ছিল।

প্রাচীনকালে বল্খ্ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল জুড়ে ‍ছিল ব্যাকট্রিয়া রাজ্য। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে আকামেনীয় সম্রাট প্রথম সাইরাস বা কুরু ব্যাকট্রিয়া অধিকার করেন। পরবর্তীকালে আকামেনীয় রাজা সাইরাস ২ এই অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পঞ্চম শতাব্দীতে আফগানিস্তান পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়। পারস্যের শাসক দারিউস (দারিউস ১) আফগানিস্তানে অভিযান সংগঠিত করেন। পরে দারিউস ১ বিভিন্ন প্রদেশ বা সত্রপির মাধ্যমে আকামেনীয় শাসন সুদৃঢ় করেন। এই প্রদেশগুলি হল আরিয়া (বর্তমান হেরাত অঞ্চলের অন্তর্গত), ব্যাক্ট্রিয়া (বা বল্খ), সত্তজিডিয়া (বর্তমান গজনী থেকে সিন্ধু নদী পর্যন্ত এলাকা),  আরাকোসিয়া (কান্দাহার), ও ড্রানজিয়ানা (সিসতান)। আফগানিস্তানের বর্তমান বল্খ্ হল প্রাচীন ব্যাকট্রা। ৩৩০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে গ্রীক রাজা আলেকজান্ডারের হাতে পরাজয়ের পূর্বে মকরান (বালুচিস্তান), গান্ধার ও সিন্ধু অঞ্চল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল।

আলেকজান্ডার পারস্যের আকামেনীয় সাম্রাজ্য উচ্ছেদ করেন এবং ৩২৭ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে তার ভারত ত্যাগের পূর্বে আফগান সত্রপির বেশীরভাগ অঞ্চল অধিকার করেন। আলেকজান্ডার ব্যাকট্রিয়া অধিকার করে ম্যাসিডোনীয় গ্রীকদের অধীনে আনেন। পরবর্তীকালে ব্যাকট্রিয়ার গ্রীক শাসকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে ব্যাকট্রীয় গ্রীকরা পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে। আফগানিস্তানের বড় এলাকা গ্রীক সেলুসিড রাজবংশের অধীনে বহুকাল পর্যন্ত ছিল। আফগানিস্তানে সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র যেমন, বল্খ, পুষ্কলাবতী, বাগরাম, প্রভৃতি অঞ্চল গ্রীক রাজাদের অধীন ছিল। এই সমস্ত বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির সাথে তৎকালীন ভারতের মথুরা, পাটলিপুত্র, বিদিশা, উজ্জয়িনী ও গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বন্দরের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। এছাড়া সেই সময় এই অঞ্চলের সাথে চীন, পশ্চিম এশিয়া ও মিসরের বাণিজ্য ছিল। খ্রীষ্টপূর্ব সময়ে ব্যাকট্রিয়ার তৈরী কাপড় মঙ্গোলিয়ায় পাওয়াতে আফগানিস্তানের সাথে বিভিন্ন অঞ্চলের দূর বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়।

গ্রীক ঐতিহাসিক আরিয়ান উল্লেখ করেছেন যে, কাবুল ও সিন্ধু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল প্রথমে অ্যাসিরিয়া, পরে কিছু কাল মিডিয়া ও পরে পারস্যের শাসনাধীনে ছিল।* স্পষ্টতই এই অঞ্চলটির অংশবিশেষ আধুনিক আফগানিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিল।

----------------------------------------

* দেখুনঃ John W. McCrindle, Ancient India as described by Megasthenês and Arrian, Munshiram Manaharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, Reprinted 2015, p. 183.

----------------------------------------

৩০৪ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে হিন্দুকুশ অঞ্চলের দক্ষিণ অংশ ভারতের মৌর্য শাসনাধীনে চলে যায়। সম্রাট অশোকের অধীন সাম্রাজ্য সমগ্র ভারতবর্ষ ও আফগানিস্তানের আমু দরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল্, যা তখন জম্বুদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।

খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে উত্তর থেকে শক ও পশ্চিম থেকে পার্থিয়ান বা পহ্লবদের ক্রমিক আক্রণাভিযান শুরু হয়। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকের দ্বিতীয় অংশে গ্রীক রাজাদের পরাজিত করে শক রাজা মউয়েস কাপিশ (হিন্দুকুশ পাহাড়ের দক্ষিণ-পূর্বে কাবুল-বাগরাম অঞ্চল), গান্ধার ও পশ্চিম পাঞ্জাব অধিকার করেন। ৮৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে পহ্লবরা কান্দাহার ও হেরাত অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। 

প্রাচীনকালে বুদ্ধের সময় থেকে আফগানিস্তান প্রধানত তিনটি ধারায় বৌদ্ধ ধর্মের সংস্পর্শে আসে। প্রথমটি সম্পর্কে জানা যায় যে, তপস্সু (Tapassu) বা ত্রপুষ (Trapussa) ও ভল্লিক নামে দুই জন বণিক বুদ্ধের কাছে এসে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে সর্বপ্রথম উপাসক হয়েছিলেন। এই কাহিনীর বিবরণ বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবর্গ ও অঙ্গুত্তর নিকায়-এ উল্লেখ আছে। এই কাহিনী খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাংও উল্লেখ করেছেন।* তিনি বলেছেন যে, ত্রপুষ ও ভল্লিক বুদ্ধের কাছ থেকে ফিরে আফগানিস্তানের বল্খ থেকে কিছু দূরে দু’টি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন, যা হিউয়েন সাং দেখেছিলেন। ভল্লিক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। ধ্বনিগত দিক বিবেচনা করলে ভল্লিক নামটি বল্খ্ থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে হয়।** এছাড়া শাক্য গোত্রের লোকজনও আফগানিস্তানে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে যায়। পরে বৌদ্ধ ধর্ম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় মহাসাংঘিকা সন্ন্যাসীদের মাধ্যমে এবং শেষে সম্রাট অশোকের সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা।*** বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যে মরুযাত্রীদলের সাথে ভ্রমণ করত তা অনেক পালি বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। এথেকে ধারণা করা যায় যে, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আফগানিস্তানে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছিল। উদ্যান অঞ্চলটি (আফগানিস্তানের জালালাবাদ অঞ্চল) সম্ভবত বল্খ ছাড়া আফগানিস্তানের প্রথম অঞ্চল যেখানে বৌদ্ধ ধর্ম ভিত্তি পায়। উদ্যান অঞ্চলের বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলি ফা-হিয়েন, সুং-উন ও হিউয়েন-সাং পরিদর্শন করেন এবং সেখানে পূজা দেন।**** History of Buddhism in Afghanistan গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক সি,এস, উপাসক গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালে আফগানিস্তানে যান ও সমগ্র দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সমগ্র আফগানিস্তানের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ জুড়ে পূর্বে জালালাবাদ থেকে উত্তর-পশ্চিমে বল্খ, এবং দক্ষিণে কান্দাহার পর্যন্ত বৌদ্ধ স্থাপনায় পরিপূর্ণ।***** দীর্ঘকাল তালেবানের শাসনাধীনে থাকার পর এই সমস্ত বৌদ্ধ স্থাপনা আজ আছে কীনা এবিষয়ে এখন আর নিশ্চিত হবার উপায় নাই।

----------------------------------------

* দেখুনঃ Samuel Beal, Buddhist Records of the Western World, Translated from the Chinese of Hiuen Tsiang (A.D. 629), Vol. I, Kegan Paul, Trench, Trübner & Co. Ltd., London, 1906, pp. 46-48.

** দেখুনঃ C.S. Upasak, History of Buddhism in Afghanistan, Published by Central Institute of Higher Tibetan Studies, Sarnath, Varanasi, 1990, p. 10.

*** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮।

**** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২-১৩।

***** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮।

----------------------------------------

ভারতবর্ষে গ্রীকদের পরে আফগানিস্তানের উপর দিয়ে যে যাযাবর আক্রমণকারীরা প্রবেশ করে তারা ছিল শক জনগোষ্ঠী। কুষাণ* যুগে কণিষ্ক (আনুমানিক খ্রীষ্টাব্দ ৭৮ থেকে ১৪৪) কুষাণ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন আমু দরিয়ার অপর পাড় থেকে গঙ্গা উপত্যকা পর্যন্ত। এছাড়াও তার নিয়ন্ত্রণে ছিল কাশগড়, ইয়ারখন্দ ও খোটানসহ চীনা তুর্কিস্তান। কণিষ্ক বৌদ্ধ ধর্মের বড় ধরনের সমর্থক হওয়ায় তার অধীনস্থ এলাকাসমূহে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। এই সময়ে বণিকদের পথ ধরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মধ্য এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রাচীন কালে ভারতে যেমন বৌদ্ধ শ্রমণ বা ভিক্ষু, পরিব্রাজক, বণিক ও শিল্পীরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পরিভ্রমণ করত তেমন আফগানিস্তানেও তাদের যাতায়াত ছিল বলে ধারণা করা যায়। ফলে প্রাচীনকালে আফগানিস্তানে কিছু বাণিজ্যকেন্দ্র ও সাথে বৌদ্ধ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছিল।

----------------------------------------

* ইউ-চি নামে একটি পশুচারী ও যাযাবর জাতিগোষ্ঠীর আদি বাসস্থান ছিল চীনা তুর্কিস্তানে। প্রাচীনকালে হিয়ুং-নু নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি তাদের চিরশত্রু ইউ-চি জাতিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। ইউ-চিরা বিতাড়িত হয়ে পশ্চিম দিকে এসে ব্যাকট্রিয়ান বা বাহ্লীক গ্রীকদের সেলুসিড সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে সেখানে বসবাস শুরু করে। এই সময়ে তারা পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়, যাদের একটি শাখার নাম ছিল কিউ-সুং। এই কিউ-সুং বা কুইশোয়াং থেকে কুষাণ নামটি এসেছে। কুষাণরা প্রথম খ্রীষ্টাব্দে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে।

----------------------------------------

সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, আফগানিস্তানের বল্খ ও বামিয়ান থেকে বাণিজ্য পথ উত্তর ভারত হয়ে গঙ্গা উপত্যকায় তাম্রলিপ্তির (তমলুক) সাথে সংযুক্ত ছিল এবং ওড়িশা ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন বৌদ্ধ বসতি ও বাণিজ্যকেন্দ্রসমূহের সাথে সংযুক্ত ছিল।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ Sunil Kumar Patnaik, Excavations at Aragarh (2014-16): An Early Historic Buddhist Site, (Notes and News), in, Purātattva, No. 46, 2016, p. 223.

----------------------------------------

কুষাণরা ছিল যাযাবর গোষ্ঠী যাদের চীনা উৎস থেকে ইউ-চি বলা হয়। তারা প্রথমে হিন্দুকুশ পর্বতের উত্তরাঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই প্রক্রিয়া চলেছিল। আমু দরিয়ার দক্ষিণ ও উত্তর উভয় অংশের ইউ-চিরা পাঁচটি ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল্। তারা ১৩৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে ব্যাকট্রীয় গ্রীকদের কাছ থেকে ব্যাকট্রিয়া অধিকার করে নেয়। তারা এরপর কাবুল অঞ্চল ও গান্ধার দখল করে ও তার পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে পার্থিয়ানদের আক্রমণ করে।

গান্ধার আজকের আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ও পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশ জুড়ে একটি  প্রাচীন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। এই গান্ধার অঞ্চলে গ্রীক, শক, পার্থিয়ান ও কুষাণ রাজাদের ধারাবাহিক পৃষ্টপোষকতায় অযুত সংখ্যাধিক বৌদ্ধ স্তূপ, মন্দির ও মঠ  তৈরী হয়েছিল। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং উল্লেখ করেছেন যে, কেবলমাত্র গান্ধার অঞ্চলেই এক হাজার মঠ (যার অর্ধেক ধ্বংসপ্রাপ্ত) ছিল। হিউয়েন সাং বলেন যে, শক রাজা মিহিরকুল গান্ধার অঞ্চলে ১৬০০ বৌদ্ধ নির্মাণ ধ্বংস করেন।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ Samuel Beal (Translated), Si-Yu-Ki: Buddhist Records of the Western World, Translated from the Chinese of Hiuen Tsiang (A.D. 629), Vol. I, p. 171.

----------------------------------------

আফগানিস্তানের আমু দরিয়া অঞ্চলের ইউ-চি শাসকরা খ্রীঃপূঃ ২য় শতাব্দীতে চীনা সম্রাটকে কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থ উপহার দিয়েছিল। এই অঞ্চলে এই সময়ে বৌদ্ধ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকার এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য।

রাজা কণিষ্কের অধীনে দ্বিতীয় খ্রীষ্টাব্দে কুষাণদের ক্ষমতা সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল যখন তার সাম্রাজ্য উত্তর-মধ্য ভারতের মথুরা থেকে ব্যাকট্রিয়া অতিক্রম করে মধ্য এশিয়ায় চীনের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। কুষাণদেরকে শিল্প ও সংস্কৃতির পৃষ্টপোষকতা করতে দেখা গেছে। ভারত, রোম ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য পণ্য বিনিময়ের জন্য সিল্ক রুটের একটি প্রধান শাখা আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। বল্খ ছিল সেখানকার বাণিজ্য পণ্য একটি বাণিজ্য বহর থেকে অপর বহরে স্থানান্তরের একটি স্থান। খ্রীষ্টীয় প্রথম শতকের দিকে ভারতীয় পরিব্রাজকরা এই পথ ধরেই চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করতে যেতেন। এছাড়া গান্ধার শিল্প এই সময়েই বিকাশ লাভ করেছিল।

কুষাণদের সময়ে আফগানিস্তানে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি দেখা গেছে। কাবুলের উত্তরে বাগরামে আলেকজান্দ্রিয়া, রোম, ভারত ও চীন থেকে আনা মূল্যবান নানা দ্রব্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও বল্খ-এর উত্তরে দেলবানজিন নামে একটি বড় কুষাণ নগর ও বল্খ-এর পশ্চিমে শেবারঘান নামে স্বর্ণ-ভাণ্ডার-পূর্ণ একটি বসতি আবিষ্কার করা হয়েছে।

কণিষ্কের পর কুষাণ রাজকুমারদের অধীনে বিভিন্ন প্রদেশ শাসিত হয়। কুষাণদের পৃষ্টপোষকতায় পূর্ব, মধ্য ও উত্তর আফগানিস্তানে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। ২৪১ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পারস্যের সাসানীয়রা বাগরামসহ আফগানিস্তানের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়।

৪০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে মধ্য এশিয়া থেকে যাযাবরদের গোষ্ঠী হেপথালাইটিসদের অধীনে একটি নূতন ঢেউ আফগানিস্তান অধিকার করে। সাসানীয় ও পশ্চিম তুর্কীদের জোটের কাছে তারা ৫৬৫ খ্রীষ্টাব্দের দিকে পরাজিত হয়। সাসানীয়রা মূলত অনাহিতা দেবীর পুরোহিত ছিল। তারা জরথুস্ত্র ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে, কিন্তু একই সাথে তারা বৌদ্ধ, হিন্দু ও অন্যন্য স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল ছিল। ৫ম থেকে ৭ম শতকে অনেক চীনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে পরিভ্রমণ করেন।

চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর দিকে বামিয়ানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দু’টি  বৌদ্ধ মূর্তি (১৭৫ ফুট বা ৫৩ মিটার ও ১২০ ফুট বা ৪০ মিটার উচ্চাতা বিশিষ্ট) পাহাড়ের গায়ে পাথর খোদাই করে তৈরী করা হয়েছিল, যেগুলিকে ২০০১ খ্রীষ্টাব্দে তালিবানের শাসনের সময়ে ধ্বংস করা হয়।

চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষে ভ্রমণ করেন (চতুর্থ খ্রীষ্টাব্দের শেষ থেকে পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দের শুরু পর্যন্ত)। তিনি লিখেছেন যে, যখন তিনি গান্ধারে আসেন তখন সেখানকার বেশীর ভাগ লোকজনকে হীনযান বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হিসাবে দেখেছেন। সেখানে একটি বৃহৎ বৌদ্ধ স্তূপ ছিল। এরপর তিনি পুষ্পপুরে আসেন। সেখানকার বৌদ্ধ স্তূপের সশ্রদ্ধ সৌন্দর্য ও মর্যাদাপূর্ণ মহনীয়তা তাকে মুগ্ধ করেছিল।* তিনি বলেন, যখন ইউ-চিরা এখানে আক্রমণাভিযান চালায় তখন এখানকার অধিবাসীরা বৌদ্ধ ছিল। তিনি যখন এখানে আসেন তখন সেখানে সাত শতেরও বেশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিল। এরপর তিনি পেশোয়ারের পশ্চিমে বর্তমান আফগানিস্তানের জালালাবাদ থেকে পাঁচ মাইল দক্ষিণে হে-লো শহরে (বর্তমান হিড্ডা) আসেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সেখানে বুদ্ধের মাথার খুলি একটি বিহারে স্থাপিত ছিল, যা সেখানকার রাজা চুরি থেকে রক্ষা করার জন্য পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানকার রাজা প্রতিদিন সকালে সেখানে নৈবেদ্য প্রদান করার পর পূজা সম্পন্ন করে রাজকার্যে মনোনিবেশ করতেন। বিভিন্ন দেশের রাজারা সেখানে নৈবেদ্যসহ সংবাদ বাহক পাঠাতেন। নগার একটি প্রাচীন রাজ্য ও একটি নগরের নাম, যা কাবুল নদীর দক্ষিণ তীরে ও জালালাবাদ থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এই নগরেও বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার থাকার কথা ফা-হিয়েন জানিয়েছেন।** এছাড়াও এর আশেপাশের অঞ্চলে বহুসংখ্যক বৌদ্ধ স্তূপ ও বিহার থাকার কথা তিনি জানান। এরপর দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে তিনি বরফাচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণী পার হয়ে একটি দেশে পৌঁছান যাকে তিনি রোহি বলেছেন, যা আফগানিস্তানের একটি স্থানের নাম। সেখানে মহাযান ও হীনযান এই উভয় মতের প্রায় তিন হাজারের মত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিল। তাদের অভিযাত্রী দল আরো দশ দিন দক্ষিণ দিকে যাত্রা করে বর্তমান পাকিস্তানের বান্নু অঞ্চলে প্রবেশ করে, যেখানেও হীনযান মতের তিন হাজারেরও বেশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিল ।***

----------------------------------------

* দেখুনঃ: James Legge (Translated & Annotated), A Record of Buddhistic Kingdoms: Being an Account by the Chinese Monk Fâ-Hien of His Travels in India and Ceylon (A.D. 399-414), Oxford at the Clarendon Press, 1886, pp. 31-34.

** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৮-৩৯।

*** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১।

----------------------------------------

হিউয়েন সাং খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে আফগানিস্তানের উত্তর অঞ্চলে প্রবেশ করেন। উত্তর থেকে আফগানিস্তানের বল্খ্ প্রদেশের খলম্-এ প্র্রবেশ করার পর তিনি সেখানে দশটি মঠ ও পাঁচ শত সন্ন্যাসী ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। ধারণা করা যায় যে, সেগুলি ছিল  বৌদ্ধ মঠ ও সেই সমস্ত সন্ন্যাসীরা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ছিল। এর পর তিনি বল্খ-এ যান। এর উত্তরে সীমানা ছিল আমু দরিয়া নদী। সেখানকার রাজধানীতে প্রায় ১০০ টি মঠ ও ৩০০০ সন্ন্যাসী ছিল, যারা সবাই বৌদ্ধ মতের ক্ষুদ্রযান (Little Vehicle) শাখায় অধ্যয়ন করত। নগরটির বাইরে একটি মঠ ছিল যাকে নবসংঘরাম বলা হত। এটি এই দেশের একজন পূর্বতন রাজা তৈরী করেছিলেন। সেখানে থাকা একটি বুদ্ধের মূর্তিকে রত্নের দ্বারা সজ্জিত করে দ্যুতিময় করা হয়েছিল। যে ঘরে এটি ছিল সেটিও মূল্যবান বস্তুরাজি দ্বারা সজ্জিত ছিল।* এই কারণে আশেপাশের রাজ্যের প্রধানরা প্রায়ই এই সমস্ত সম্পদের লোভে লুণ্ঠন করার জন্য হানা দিত। এইখানে হিউয়েন সাং তুর্কী গোষ্ঠীর অন্তর্গত ইউয়ে-হু খানের পুত্রের এখানকার মূল্যবান সম্পদ লুঠের উদ্দেশ্যে আক্রমণাভিযানের কথা উল্লেখ করেছেন। এই মঠের উত্তরে একটি স্তূপ ছিল যার উচ্চতা ছিল ২০০ ফুট। এছাড়া মঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি বিহার থাকার কথাও তিান বলেছেন, যা অনেক আগে তৈরী করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ১০০ জন পুরোহিত ছিল। এই রাজধানীটির উত্তর-পশ্চিমে একটি শহর ও তারও উত্তরে আরেকটি শহরের দু’টিতেই একটি করে স্তূপ ছিল, যা ৩০ ফুট উঁচু ছিল। এই শহর থেকে কিছু দূর পশ্চিমে আরেকটি শহরে প্রায় ২০ ফুট উঁচু একটি স্তূপ ছিল। এগুলি সবই প্রাচীন যুগে নির্মাণ করা হয়েছিল। এরপর হিউয়েন সাং উল্লেখ করেন যে, তারা বল্খ থেকে দক্ষিণে পারস্যের সীমানার কাছে কিয়ে-চি বা গাচি (বা গায) নামে একটি দেশে যান যেখানে ১০ টির মত মঠ ও ২০০ পুরোহিত ছিল। তারা সবাই সর্বাস্তিবাদের মত অনুসরণ করত, যা ক্ষুদ্রযানের একটি শাখা। সেখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বরফাচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণী পার হয়ে তারা আফগানিস্তানের বামিয়ান রাজ্যে প্রবেশ করেন।** এই সমস্ত অঞ্চলে তিনি দস্যুদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা পরিব্রাজকদের জিনিসপত্র লুণ্ঠন করে তাদের হত্যা করত। বামিয়ানে তিনি ১০টি মঠ ও ১০০০ পুরোহিত থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। এখানকার রাজধানীর উত্তর-পূর্বে একটি পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের পাথরের ভাস্কর্য ছিল, যার উচ্চতা ছিল ১৪০ বা ১৫০ ফুট। এর সোনালী রং চারিদিকে দ্যুতি ছড়াত ও এর মূল্যবান অলংকারসমূহের ঔজ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে যেত। এই জায়গার পূর্ব দিকে একটি মঠ ছিল। এই মঠের পূর্ব দিকে শাক্য বুদ্ধের একটি দাঁড়ানো মূর্তি ছিল যার উচ্চতা ছিল ১০০ ফুট। এই শহরের কিছু দূরে একটি মঠ ছিল যেখানে বুদ্ধের একটি শায়িত মূর্তি ছিল। এটি দৈর্ঘ্যে ১০০০ ফুটের মত। এই জায়গা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ২০০ লি-এর মত দূরত্বে, পূর্ব দিকে একটি বরফাচ্ছাদিত পর্বতশ্রেণী রেখে, যে জায়গায় তারা পৌঁছান সেখানে একটি সংঘারাম ছিল। সেখানে বুদ্ধের দাঁত ছিল বলে তিনি লেখেন। এখান থেকে পূর্ব দিকে যেয়ে তারা কপিশ দেশে পৌঁছান। এই অঞ্চলটির উত্তর সীমায় বরফাচ্ছাদিত পর্বত এবং তিন দিকে হিন্দু কুশ পর্বত। এখানকার রাজধানীতে সকল অঞ্চল থেকে আসা পণ্যদ্রব্য দেখতে পাওয়া যায়। হিউয়েন সাং এখানকার রাজা ক্ষত্রিয় ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, প্রতি বৎসর এখানকার রাজা আঠারো ফুট উঁচু একটি বুদ্ধ মূর্তি তৈরী করেন। এই দেশে একশর মত মঠ ছিল ও প্রায় ৬০০০-এর মত পুরোহিত ছিল। এখানকার স্তূপ ও সংঘারাম এত উঁচু ছিল যে, সব দিক থেকে সেগুলি দেখা যেত। হিউয়েন সাং এখানে দেবতাদের ১০ টি মন্দির (সম্ভবত হিন্দুদের) ও ১০০০-এর মত বিরুদ্ধ মতাবলম্বী (হিন্দুদের পুরোহিতদের সম্পর্কে বলা হয়েছে) ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, এখানে নগ্ন সন্ন্যাসী (সম্ভবত জৈন সন্ন্যাসী) ও অন্যরা ছিল যারা নিজেদের গায়ে ছাই দিয়ে আচ্ছাদিত করত। এছাড়া তিনি আরো কিছু মানুষজন সম্পর্কে বলেছেন, যারা মাথায় পরার জন্য হাড়ের মালা তৈরী করত।*** রাজধানীর পূর্বে একটি বৃহৎ সংঘারাম ছিল, যেখানে ৩০০-এর মত পুরোহিত (বৌদ্ধ) ছিল। এই রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমে একটি বড় নদীর দক্ষিণ তীরে (এই নদীটি কাবুল নদী হওয়া সম্ভব বলে অনুবাদক উল্লেখ করেছেন) একটি বৌদ্ধ মঠ থাকার কথা বলেছেন। এই মঠের দক্ষিণ-পূর্বে আরো একটি বৌদ্ধ মঠ ছিল। এই মঠের দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০০ ফুট উঁচু একটি বৌদ্ধ স্তূপ ছিল। এই শহরটির দক্ষিণ-পশ্চিমে পিলুসার নামে একটি পাহাড় আছে। কথিত আছে যে, এই পাহাড়ের আত্মা একটি হাতীর আকার নেয়। তাই এই পাহাড়ের নাম পিলুসার। এখানে ১০০ ফুট উচ্চতার একটি স্তূপ আছে, যা সম্রাট অশোক নির্মাণ করেছিলেন। পিলুসার স্তূপের উত্তরে একটি সংঘারাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

----------------------------------------

* দেখুনঃ Samuel Beal (Translated), Si-Yu-Ki: Buddhist Records of the Western World, pp. 43-44.

** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫-৪৯।

*** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯-৫৫।

----------------------------------------

উপরের আলোচনা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে, ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাং-এর সময়েও অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় চতুর্থ থেকে সপ্তম শতকেও আফগানিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল। যে কারণে সেখানে বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজারাও বৌদ্ধ ধর্মকে পৃষ্টপোষকতা করতেন। তবে কিছু মানুষ জরথুস্ত্র ও পূর্ব অঞ্চলের কিছু মানুষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল।

খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকে আফগানিস্তান হেফথালাইট ও সাসানীয়দের শাসনাধীনে ছিল। এই সময়ে আফগান ক্ষুদ্র রাজাদের শাসনের সময়ে হিন্দু ধর্মের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। হিন্দু রাজাদের শাহী পরিবার প্রধানত কাবুল ও গজনী অঞ্চলে শাসন করত। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এই সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু শাহী মন্দির ও গজনীতে একটি ঠাকুরঘর (Chapel) পাওয়া গেছে, যেখানে বৌদ্ধ ও হিন্দু উভয় ধর্মের ভাস্কর্যশিল্প ছিল।

 

৩। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সামাজিক-রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পটভূমি

এখানে আমরা আফগানিস্তানের ইসলামীকরণ ও সেই সাথে আফগানিস্তানের আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল ও ভারতবর্ষে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধজয়ের উপর আলোচনা করব। আজকের আফগানিস্তানের সমাজ ও নারীর বর্তমান অবস্থার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে সেখানকার ইসলামীকরণ ও ইসলামের বিজয়ী যুদ্ধগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। একথা মনে রাখা দরকার যে, ইসলাম পৃথিবীর যেখানেই গেছে সেখানেই যুদ্ধ জয়ের পর সেখানকার অধিবাসীদের সম্পদ লুণ্ঠন ও সেখানকার অধিবাসী স্বাধীন নারী ও পুরুষদের দাস হিসাবে বন্দী করে নিয়ে যেত। শাসকরা বা সেনানায়করা সাধারণ সৈনিকদের প্রায় ক্ষেত্রেই যুদ্ধে বিজিত জনপদে অবাধ লুণ্ঠনের জন্য ছেড়ে দিত। এরপর তাদের মধ্যে যুদ্ধে লুণ্ঠিত সম্পদের ও বন্দী নারী-পুরুষদের ধর্মীয় বিধান মতে একটি অংশ বন্টন করে দিত। সেই সমস্ত সৈনিকরা নিজ দেশে ফিরার পর এই সমস্ত দাস-দাসীদের স্থানীয় বাজারে বিক্রী করত। নির্দিষ্ট বেতন ছাড়াও এগুলি ছিল সৈনিকদের উপরি আয়। সুতরাং সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে ইসলামের জিহাদী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ থাকবে এমনটাই স্বাভাবিক। একই সাথে ভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের ফলে প্রাপ্ত নারী ধর্ষণেও যে তাদের বিশেষ উৎসাহ ও প্রেরণা কাজ করত তাতে কোনও সন্দেহ নাই। কারণ ভিন্ন জনগোষ্ঠীর বন্দী নারীদের ধর্ষণে সাধারণ সৈনিকদের কোনো ধর্মীয় ও আইনগত বাধা ছিল না। শুধুমাত্র সেই সমস্ত জনগোষ্ঠীর প্রধানদের স্ত্রী-কন্যা ও তাদের পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট নারীরা সাধারণত প্রধান শাসকের ভাগে পড়ত। আধুনিক যুগে ইসলামের নামে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে দেখা যায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক ১৯৭১ সালে পূর্ব বঙ্গে বাঙ্গালী নারীদের অবাধে ধর্ষণের মাধ্যমে। তাদের সেনাদের শেখানো হয়েছিল যে, বাঙ্গালী সহি বা খাঁটি মুসলমান নয়। ঐতিহাসিকরা উল্লেখ না করলেও নীচে বর্ণিত প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে যুদ্ধের যৌক্তিকতা ও প্রেরণা হিসাবে আমরা এই সাধারণ চিত্র কল্পনা করে নিতে পারব।

ইসলামী সেনাবাহিনীর আফগানিস্তান অঞ্চলে প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ৬৪২ খ্রীষ্টাব্দে সাসানীয়দের উপর বিজয় অর্জনের ফলে। কিন্তু তারা এই অঞ্চলকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। সেখানে বিদ্রোহ হয় ও যাদের তারা ধর্মান্তরিত করেছিল, মুসলমান সেনাবাহিনী চলে যাবার সাথে সাথে তারা তাদের পুরাতন বিশ্বাসে ফিরে যায়।

বসরার আরব গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে আমীর ৬৫২ খ্রীষ্টাব্দের দিকে হেরাত, বল্খ ও বাদগিস অধিকার করেছিলেন, কিন্তু তার অর্ধ শতাব্দী পরে আব্বাসীয় যুগে খোরাসান ও উত্তর আফগানিস্তানে আরব নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হয়। আরব মুসলমানরা আফগানিস্তানের হেরাত, মাইমানা ও বল্খ-এর কাছে সামরিক ছাউনি গড়ে তুলে ও বহু সংখ্যক বৌদ্ধ ও জরথুস্ত্র ধর্মের বসতি ধ্বংস করে। এই সময় এই সমস্ত অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ বিহারসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। এর পরেও আফগানিস্তানের ইসলামীকরণে বহু শতাব্দী লাগে ও তা প্রথম দিকে সমভূমির নগর কেন্দ্রগুলিতে সীমাবদ্ধ থাকে।* বৌদ্ধ, ইহুদী, খ্রীষ্টান, জরথুস্ত্র ও স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাস বিশেষত ঘুর, বাদগিস এবং হিন্দু কুশের পাহাড়ী অঞ্চলে টিকে ছিল।** কাবুল ও দক্ষিণ আফগানিস্তানে একাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গজনীর সুলতান মাহমুদের দ্বারা শেষ পর্যন্ত ইসলামীকরণ ঘটে। তিনি ঘুর আক্রমণ করেন ও সেখানকার অধিবাসীদের ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। তবে কাফিরিস্তানের কাফিররা তাদের প্রাচীন বহু-দেবতাবাদী ধর্ম ১৮৯০-এর দশক পর্যন্ত রক্ষা করেছিল।

----------------------------------------

* এই প্রসংগে নাইল গ্রীন তার সম্পাদিত Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban গ্রন্থের ভূমিকায় লেখেন, “However, conversion was not always directly related to conquest, and beyond the level of the political, bureaucratic, and religious elite, conversion was likely a slow, patchy process. Conversion was more rapid in urban (and lowland) than in rural (and highland) areas and was in many cases more likely a slower, multigenerational process of acculturation than a single moment of conversion. We know that Buddhism survived until the late tenth century, which would in turn suggest that popular Buddhist practices survived much later, while the region’s pre-Islamic religious heritage also included Zoroastrian, Indic, and other local cults that were the fruit of centuries of selective adoption from religious influences that ranged from India to Greece. Some communities, including wealthy Jewish and Hindu merchant groups, avoided conversion entirely to survive into recent times.”  দেখুনঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban, University of California Press, Oakland, 2017, pp. 3-4.

** দেখুনঃ Jonathan L. Lee, Afghanistan: A History from 1260 to the Present, Reaktion Books Ltd, London, 2018, p. 32.

----------------------------------------

সিন্ধুর প্রাচীন ইতিহাস চাচ্নামাহ্-য়* বলা হয়েছে যে, খলিফা আলীর শাসনকালে হিজরী ৪০ সালে (৬৬০ খ্রীষ্টাব্দে) সাগীর বিন দাউদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে হিন্দ ও সিন্ধে অভিযানের জন্য পাঠানো হয়। যেসমস্ত নগরীতে তারা গিয়েছিল সব জায়গাতেই তারা বিজয় লাভ করে। প্রচুর সংখ্যক দাস-দাসী ও বিপুল পরিমাণ লুটের মাল তারা হস্তগত করে।** পরবর্তী খলিফা মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানের সময়েও তিনি সিন্ধু জয়ের জন্য তার সেনাবাহিনী পাঠান, যারা প্রতিবারই প্রচুর লুটপাটের মালামাল ও ‍যুদ্ধলব্ধ দাস-দাসী নিয়ে যায়। যদিও তখনো পর্যন্ত কেউই মূল সিন্ধু রাজ্য দখল করতে পারে নাই। পরে খলিফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক হিন্দ ও সিন্ধের প্রশাসনিক ক্ষমতা হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে অর্পণ করেন। হাজ্জাজ তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহম্মদ বিন কাসিমকে হিন্দ অঞ্চলে প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ করেন। মুহম্মদ কাসিম সিন্ধু অঞ্চলে দেবল বন্দর অধিকার করেন ও সেখানকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জাঁকজমকপূর্ণ দেবমন্দিরে প্রবেশ করেন। চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন, যারা মন্দিরটির ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিল তারা দরজা বন্ধ করে দিতে চাইল। তারপর দ্বাররক্ষী দু’জনকে টেনেঁহিচড়ে বের করে এনে হত্যা করা হল। এখন আর প্রবেশের কোনো বাধাই রইল না। সেখানে সুরক্ষাপ্রাপ্ত সাতশত সুন্দরী রমণীকে আটক করা হল। তাদের গায়ে মহামূল্যবান গহনা ও মণিমুক্তা খচিত পরিধেয় বস্ত্র ছিল। একসঙ্গে চারজন যোদ্ধাকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল। কেউবা বলেন, চারশত যোদ্ধা অতর্কিতে হানা দিয়ে তাদের গহনাগুলি কেড়ে নিয়েছিল।*** দেবল বিজয়ের পর যুদ্ধলব্ধ দাস-দাসী ও মালামালের এক-পঞ্চমাংশ ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী আলাদা করে রাখতে এবং খলীফার রাজকোষে পাঠিয়ে দিতে মুহম্মদ কাসিম নির্দেশ দিলেন। এছাড়াও তিনি অন্যান্য আরো নগর ও শহর অধিকার করে লুঠতরাজ চালান ও সেই সমস্ত জায়গা থেকে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান ধন-সম্পদ ও নারী-পুরুষ দাস হিসাবে নিয়ে যান। চাচ্নামাহ্-র লেখক বলেন যে, সিন্ধু অঞ্চলে নিরুন নামে একটি স্থানের শাসনকর্তা ও জনগণের নেতা ছিলেন একজন সামানি (চাচ্নামাহ-য় বৌদ্ধ শ্রমণকে বা যাজক শ্রেণীর ব্যক্তিকে সামানি বলা হয়েছে)। মুহম্মদ কাসিম সেখানে বুদ্ধের মন্দিরের এলাকাটিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন।****

----------------------------------------

* চাচ্নামাহ্ গ্রন্থটির মূল ফারসি অনুবাদক ও সংকলক মুহম্মদ আলী বিন আবু বকর কুফির বর্ণনায় জানা যায় যে, চাচ্নামাহ্-র মূল গ্রন্থটি বিশুদ্ধ হিজাজী ভাষায় লিখিত হয়েছিল। গ্রন্থটিতে আরব ও সিরিয়াবাসী বীরদের বীরত্বগাঁথা বর্ণিত ছিল। গ্রন্থটির মূল আরবীর রচয়িতার নাম জানা যায় না।

** মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী (অনুদিত), চাচ্নামাহ্ঃ সিন্ধের প্রাচীন ইতিহাস, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪, পৃঃ ৯১-৯২।

*** প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৯-১২৪।

**** প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩২-১৩৪।

----------------------------------------

আমরা আগে বলেছি যে, মুসলমান সেনাবাহিনীর জন্য পরজাতির ‍উপর চাপিয়ে দেওয়া এই সমস্ত যুদ্ধের সবচেয়ে বড় বৈষয়িক প্রেরণা কাজ করত সমৃদ্ধ জনপদসমূহের লুটের মাল ও যুদ্ধলব্ধ পুরুষ ও নারী যাদেরকে দাস ও দাসীতে রূপান্তরিত করে নিজেদের দেশের বাজারে বিক্রী করে দেওয়া হত। এই সমস্তই করা হত আল্লাহর নামে। ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে রাজা দাহিরের বাহিনীকে মোকাবিলা করার সময মুহম্মদ কাসিম তার আরব সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশ্যে তাদেরকে অনুপ্রাণিত করবার জন্য বলেছিলেন, ”ওহে আরববাসীগণ, শত্রুরা দল বেঁধে প্রস্তুত হয়ে এসেছে আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। আপনাদেরও সর্বোচ্চ পরিমাণে সচেষ্ট হতে হবে, কারণ তারা তাদের সম্পদ, পরিবার, বাড়ীঘর, গৃহস্থালী ও সম্পত্তির জন্য ভয়ংকরভাবে লড়াই করবে। মহান আল্লাহর সহযোগিতায় তাদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হোন। দৈব সুরক্ষা ও দৈবের কৃপায় আমরা আশাকরি তাদেরকে আমাদের ধারালো ও শক্তিশালী তরবারির আহার্যে পরিণত করব এবং পরাজিত ও বশ্যতা স্বীকার করাতে সক্ষম হব। তখন পরিবার ও সম্পত্তি থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দিব ও প্রচুর যুদ্ধলব্ধ মালামাল নিশ্চিত করব। … … মনে রাখবেন, মহান ও মহিমাময় আল্লাহ্ ধার্মিকদের জীবনে সুখী পরিসমাপ্তি ঘটান। সবসময় আল্লাহর পবিত্র কোরআনের থেকে বারংবার আবৃত্তি করবেন এবং বলবেন, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু।” *

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৩।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন, ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধুর রাওয়ার দুর্গ মুহম্মদ কাসিমের বাহিনীর দখলে চলে যাবার পর সেখানে যে সমস্ত ধনসম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র যা কিছু ছিল সবই বিজয়ীদের হস্তগত হয়। শুধুমাত্র রাজা দাহিরের পুত্র জয়সিয়া চলে যাবার সময় কিছু ধনসম্পদ সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলি ছাড়া অবশিষ্ট সম্পদ ও লুটের মালামাল মুহম্মদ কাসিমের সামনে হাজির করা হল। গণনা করার পর দেখা গেল যে বন্দী দাস-দাসীর সংখ্যা ষাট হাজারের কাছাকাছি, এদের মধ্যে রাজপরিবারের ত্রিশ জন যুবতি ছিলেন। যুবতীদের মধ্যে হাস্নাহ্ নামে রাজা দাহিরের এক ভাইয়ের মেয়েও ছিলেন। মুহম্মদ কাসিম এদের সবাইকে হাজ্জায্ বিন ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বন্দিনী নারীদেরসহ দাহিরের মস্তক, লুটের ধন-সম্পদের এক পঞ্চমাংশ রাজকীয় কোষাগারে জমা দিবার জন্য পাঠানো হল। দাহিরের মস্তক, নারীগণ ও লুটের মালামাল হাজ্জাজের কাছে পৌঁছাল। তিনি তখনই ভূমিতে নতজানু হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদায় পড়লেন আর আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, “পৃথিবীর এই রাজ্যটির ক্ষমতা ও অন্যান্য ধনরাশির সাথে উন্মুক্ত এবং গুপ্ত বহু সম্পদরাশি আমার মুঠোর মধ্যে চলে এসেছে।”*

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩-২১৪।

----------------------------------------

অন্য একটি স্থানে এই যুদ্ধ জয়ের পরের বর্ণনা প্রসংগে চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন, ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গটির পতনের পর রাজা দাহিরের স্ত্রী রাণী লাডি ও রাজপুত্র মিলে শত্রুসৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলেন। তখন তারা আলর দুর্গে অবস্থান করছিলেন। মুহম্মদ কাসিমের সৈন্যবাহিনী দুর্গ আক্রমণ করলে রাণী লাডি সংকল্প করেছিলেন যে, যদি কোনো কারণে দুর্গের পতন হয় তাহলে তিনি অনুসারী ও সন্তানদের সহ জ্বলন্ত অগ্নিতে আত্মাহুতি দিবেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে দুর্গটি আরব সৈন্যদের দখলে চলে গেলে তারা সকলে আরব সৈন্যদের হাতে বন্দী হলেন। পরবর্তীতে মুহম্মদ কাসিমের সামনে সমস্ত লুণ্ঠিত মালামাল ও সকল বন্দীদেরকে হাজির করা হল। তিনি সকল সৈন্যদেরকে আদেশ দিলেন যে দুর্গের ভিতর থেকে বন্দী করা দাহিরপত্নী লাডি ও দাহিরের অন্য একজন পত্নীর গর্ভজাত দুজন কুমারী কন্যাকে তার সামনে উপস্থিত করা হোক। তার আদেশ অনুসারে সেই নারীদের তার সামনে উপস্থিত করা হল এবং একজন পরিচারকের দায়িত্বে তাদেরকে অন্য বন্দীদের থেকে আলাদা করে বসতে দেওয়া হল। রাজকোষের জন্য এক-পঞ্চমাংশ লুটের মালামাল ও বন্দী দাসদের নির্বাচন করা হল। নির্বাচিত এই দাসদের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় কুড়ি হাজারের মত। অবশিষ্টদের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেওয়া হল।* চাচ্নামাহ্-র লেখক আরো লিখেছেন, মুহম্মদ কাসিম তখন কারিগর, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের প্রতি তার ক্ষমাসুন্দর দরাজহস্ত প্রসারিত করেছিলেন। তাই বন্দীদের ভিতরে যারা কারিগর, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের শ্রেণীভুক্ত ছিল তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। তারপর তিনি জল্লাদখানায় এলেন এবং তার উপস্থিতিতেই সামরিক শ্রেণীর সকল যোদ্ধাকে শিরশ্ছেদ করতে নির্দেশ দিলেন। বলা হয় যে, এই উপলক্ষে ছয় হাজার লড়াকু যোদ্ধাকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। কেউ কেউ এই সংখ্যাটি প্রায় ষোল হাজার বলেন। অবশিষ্ট লোকদের ক্ষমা করা হয়েছিল।**

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৫-২২৬।

** প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৬।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন, মুহম্মদ কাসিম এরপর সকল প্রজার উপর আল্লাহর পবিত্র রাসুলের প্রণীত আইন অনুযায়ী কর ধার্য করলেন। যারা ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করল তারা দাসত্ব ও জিজিয়া কর থেকে মুক্ত হল এবং ক্ষতি সাধন থেকে বেঁচে গেল। যারা ইসলাম গ্রহণ করল না তাদেরকে জিজিয়া কর ধার্য করা হল। এরপরেও কিছু সংখ্যক লোক তাদের মাতৃভূমিতে থেকে যাওয়ার সংকল্প করল কিন্তু অন্যরা পূর্বপুরুষের ধর্ম আঁকড়ে ধরে রাখতে দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করল। তাদের ঘোড়াগুলিসহ গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পত্তিসমূহ তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হল।* চাচ্নামাহ্-র লেখক আরো লিখেছেন, মুহম্মদ কাসিম এরপর কারিগর ও বণিকদের গণনা করার আদেশ দিলেন। সাধারণ জনগণের মধ্য থেকে প্রায় এক হাজার লোককে তখন গণনা করে আলাদা করা হল। লুটের ফলে যেহেতেু তারা তাদের সম্পত্তি হারিয়েছে তাই মুহম্মদ কাসিম মাথাপিছু কর হিসাবে মাত্র ১২ দিরহাম ওজনের রৌপ্য নির্ধারণ করলেন। তারপর তিনি দলপতি ও গ্রামপ্রধানদের রাজস্ব আদায়ের জন্য নিযুক্ত করলেন। তিনি গ্রামবাসী ও নগরবাসী জনগণের রাজস্ব আদায় করার দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত করলেন।**

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৬-২২৮।

** প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৮।

----------------------------------------

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতীয় নারীদের নিজেদেরকে শত্রুর হাতে সমর্পিত না করে আত্মাহুতি দিতে দেখা যায়। চাচ্নামাহ-য় এরকম একটি বিবরণ আছে। মুহম্মদ কাসিমের সেনাবাহিনী যখন রাওয়ার দুর্গ ঘেরাও করে অনবরত আক্রমণ চালাতে লাগলেন, তখন রাণী বাঈ দুর্গের ভিতরে থাকা অন্য রাণীদের এক জায়গায় জড়ো করে তাদের উদ্ধেশ্যে মুহম্মদ কাসিমের সৈন্যবাহিনীর কাছ থেকে বিপদের কথা জানিয়ে আগুনে আত্মাহুতি দিবার আহবান জানালে সকল উপস্থিত নারীরা এক মত পোষণ করেন এবং তারা একটি বিশাল ঘরের মধ্যে দাহ্যবস্তু দিয়ে আগুন জ্বালালেন। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে নিজেরা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। মুহম্মদ কাসিম এরপর দুর্গ দখলে নিলেন। তিনি সেখানে থাকা ছয় হাজার লড়াকু সৈন্যকে হত্যা করলেন। তাদের অনুসারী ও পোষ্যদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদের কয়েদ করা হল।*

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১২-২১৩।

----------------------------------------

মুহম্মদ কাসিম এরপর সিন্ধু অঞ্চলের আশেপাশের অন্যান্য স্থানীয় শাসকদেরকে আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য চিঠি লিখলেন। ব্রাহ্মণাবাদের কাছে পৌঁছে তিনি বার্তাবাহকদের সেখানে পাঠিয়ে প্রস্তাব রাখলেন যে, হয় ইসলাম গ্রহণ করতে হবে নতুবা জিজিয়া কর দিতে হবে। এই দুই প্রস্তাবের কোনোটাই যদি তারা অনুসরণ না করে তাহলে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হল।*

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৮, ২১৯।

----------------------------------------

দীর্ঘ ৬ মাস অবরোধের পর ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গে বসবাসকারী নাগরিকরা পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততিসহ অনুকম্পা লাভের জন্য মুহম্মদ কাসিমের কাছে উপস্থিত হল ও ক্ষমা ভিক্ষা চাইল। চাচ্নামার লেখক লিখেছেন, উভয়পক্ষের সম্মতি অনুযায়ী দৃঢ় একটি চুক্তি সম্পাদিত হল এবং মুহম্মদ কাসিম তাদের ক্ষমা মঞ্জুর করলেন। লড়াইয়ে সমর্থ পুরুষদের সবাইকে শিরশ্ছেদ করা হল। তাদের অনুসারী ও আশ্রিতজনদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। যাদের বয়স ৩০ বৎসর বা তার চেয়ে কম ছিল তাদেরকে শিকলবন্দী করা হল। অসংখ্য লোককে হত্যা করা হল এবং অবশিষ্ট জনগণের উপর রাজস্ব নির্ধারণ করা হল।*

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ২২২-২২৩।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্-য় মুহম্মদ কাসিমের আরেকটি যুদ্ধের বিবরণ এখানে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন, মুহম্মদ কাসিম বিয়াস নদীর তীরে গোলকন্দহ্ নামে এক দুর্গে এসে পৌঁছালেন। আরব সৈন্যদের আগমনের সংবাদ পেয়ে দুর্গবেষ্টিত নগরীটির জনগণ যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হল। তখন অনেকগুলি যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং দুই পক্ষেই প্রচুর রক্তস্রোত বয়ে গেল। কিন্তু যখনই বিকালের নামাজের সময় উপস্থিত হত তখন আরব সৈন্যরা ‘আল্লাহু আকবর’ রণধ্বনিতে গর্জে উঠত এবং ডান ও বাম দিকে বিশাল আক্রমণ করে বসত। শত্রুরা তখন পালিয়ে যেত ও দুর্গের ভিতরে আশ্রয় নিত। তারপর তারা কেল্লাপ্রাচীরের শীর্ষদেশ থেকে তীরবর্ষণ শুরু করত এবং ফিঙ্গা থেকে পাথর ছুড়ে মারত। এভাবে প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে অবরোধ চলল। এক সময় রসদ সরবরাহের অভাবে তাদের সৈন্য শিবিরে দুর্ভিক্ষ শুরু হল। কারণ তাদের রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে গোলকন্দহ্-র শাসক রাতের আঁধারে পালিয়ে গেলেন। দুর্গের শাসকের প্রস্থানের পর নগরটির নিরীহ জনগণ ও সেই অঞ্চলের কারিগর ও বণিক শ্রেণীর লোকেরা আরবীয় সেনাপতিকে চিঠি লিখে জানালেন, “আমরা সকলেই শাসকের অধীন প্রজামাত্র। আমাদের শাসক এই মুহূর্তে পালিয়ে আছেন। আমাদের ক্ষমা করুন।” তখন মুহম্মদ কাসিম ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী ও কারিগরদের সকলের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করলেন এবং দুর্গে প্রবেশ করলেন। সামরিক শ্রেণীর চার হাজার লোককে তিনি তরবারির সাহায্যে হত্যা করলেন ও তাদের অনুসারী ও পরিবার-পরিজনদের বন্দী করলেন। এরপর তিনি রাভি নদীর দক্ষিণ তীরে সিক্কাহ্ ও মুলতান অভিমুখে অগ্রসর হলেন। সেখানকার দুর্গের সৈন্যদের সাথে আরব সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হল ও এক টানা সতের দিন যুদ্ধ চলল। এই যুদ্ধে মুহম্মদ কাসিমের কুড়ি জন প্রসিদ্ধ সহযোদ্ধা মারা যায় এবং সিরিয়া থেকে আগত বাহিনীর দুই শত পনের জন যোদ্ধা প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে তিনি নির্দেশ দিলেন যে, সমগ্র নগরীটিকে যেন লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়।*

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৭-২৫৯।

----------------------------------------

মুহম্মদ কাসিম এর পর যখন মুলতান এসে পৌঁছালেন তখন সেখানকার শাসকরা তার সাথে যুদ্ধ করার জন্য বেরিয়ে এলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। এইভাবে অবিরাম দুই মাস যুদ্ধ চলতে লাগল। সিন্ধুবাসীরা গুলতি, তীর ও পাথরের সাহায্যে প্রতিআক্রমণ করতে লাগল। নগরে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিল। সেখানকার শাসক বাছরা যখন দেখতে পেলেন তারা কারো কাছ থেকেই কোনোরকম সাহায্য পাবেন না, তখন তিনি কাশ্মীরের রাজার কাছে গিয়ে আশ্রয় চাইলেন। পরবর্তী দিন আরব সৈন্যরা আগের মতই অগ্রসর হল এবং যুদ্ধ শুরু করল। আরব সৈন্যরা কোনো মতেই দুর্গের দেওয়ালের কোথায়ও সুড়ঙ্গপথ বা ভূগর্ভস্থ রাস্তা তৈরী করতে পারছিল না। তারপর দুর্গের ভিতর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে অনুকম্পা চাইলে মুহম্মদ কাসিম তাকে ‍নিরাপত্তা দানের অঙ্গীকার করলেন। তখন লোকটি দুর্গের উত্তর দিকে অর্থাৎ নদীর তীরবর্তী একটি স্থান দেখিয়ে দিল। সেই স্থানটি থেকে সৈন্যরা গর্ত খোঁড়া শুরু করলে দুই-তিন দিনের মধ্যে দুর্গপ্রাচীরটি মুখ থুবড়ে পড়ল। এভাবে দুর্গটি দখল করা হল। সেখানে ছয় হাজার সামরিক যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছিল ও তাদের পরিবার-পরিজন, অনুসারীদেরকে যুদ্ধবন্দী করা হয়েছিল। সেখানে বণিক, কৃষিজীবী ও কারিগর শ্রেণীর লোকদের ক্ষমা করে দেওয়া হল। কিন্তু খলীফার কোষাগারে রাজস্ব পাঠানোর জন্য তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের হুকুম জারি হল। এছাড়াও যুদ্ধের সময় মুখোমুখী হয়ে অনবরত লড়ে যাবার জন্য ও সুড়ঙ্গপথ তৈরীর সময় বিশাল ঝুঁকি মোকাবিলা করার জন্য সৈন্যদের মধ্যে অকাতরে অর্থ বিলি করা হল। সেই সময় বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়।* চাচ্নামাহ্-র লেখক আরো বলেন যে, শহরের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত উভয় সম্প্রদায় থেকে মোট ওজনে ষাট হাজার দিরহাম রৌপ্য চাঁদা হিসাবে জোগাড় হল। সমস্তটিই আরব সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হল। প্রতিজন অশ্বারোহী যোদ্ধা অন্য কিছু বাদেও বিশেষ অংশ হিসাবে চারশত দিরহাম রৌপ্য পেয়েছিল। এরপর মুহম্মদ কাসিম তাদেরকে বললেন, “এবারে খলীফার রাজধানীর কোষাগারে পাঠানোর জন্য তোমরা রাজস্ব সংগ্রহ কর।” এই সমস্ত বিষয়ে কথাবার্তা চালানোর সময়ে সেখানে একজন ব্রাহ্মণ উপস্থিত হয়ে বললেন যে, যেহেতু দাহিরের রাজত্বের অবসান হয়েছে তাই এই মুহূর্তে মুলতানের প্রবীনতম লোকদের কাছ থেকে শোনা মূল্যবান কথা বলতে দ্বিধা করব না। সেটি হল সুপ্রাচীনকালে এই নগরীটিতে যশ্বীন নামে এক রাজা বাস করতেন। বংশানুক্রমিকভাবে তিনি কাশ্মীরের রাজার উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি জাতিগতভাবে একজন ব্রাহ্মণ ও উপাসক ছিলেন। তিনি একটি দেবমন্দির স্থাপন করে তার তলদেশে চল্লিশটি বড় বড় তামার ঘড়াভর্তি গুপ্তধন ভূগর্ভে মাটির নীচে ঢেকে দেন। সেই স্থানটির উপরিভাগে একটি দেবপ্রতিমা স্থাপন করেন, যা সম্পূর্ণরূপে স্বর্ণনির্মিত ছিল। এই কথা শুনার পর মুহম্মদ কাসিম তার প্রধান সহচরবৃন্দ ও ব্যক্তিগত পরিচারকবৃন্দ সাথে নিয়ে মন্দিরটিতে ঢুকলেন। তিনি সেখানে একটি স্বর্ণনির্মিত প্রতিমা দেখতে পেলেন। মূর্তিটির মুখমণ্ডলে লাল চুনি পাথরে নির্মিত দুটি চোখ ছিল। মূর্তিটি অবিকল জীবন্ত মানুষের মত দেখতে ছিল। মুহম্মদ কাসিম মূর্তিটিকে সেখান থেকে উঠিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। এটি ওজনে ২৩০ মন সোনার ছিল। তারপর মাটির তলায় লুকানো গুপ্তধন ভর্তি চল্লিশটি তামার ঘড়া উঠিয়ে এনে ওজন করা হল। সব মিলিয়ে ঘড়াগুলিতে ১৩২০ মন ওজনের সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সোনানির্মিত মূর্তির সাথে অন্যান্য সোনার ভাণ্ডার সরকারী কোষাগারে স্থানান্তরিত করা হল। এছাড়াও নগরীতে লুঠ করে আহরণ করা সকল মণি-মুক্তাসহ মুলতানের উন্মুক্ত ও সমাহিত সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে যাওয়া হল। যে দিন মন্দিরটি আবিষ্কৃত হয় ও ধনরত্নসমূহ জব্দ করা হয় সেই দিনই হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছ থেকে একটি চিঠি এসে পৌঁছায়। চিঠিতে হাজ্জাজ লিখেছেন, “হে আমার প্রাণপ্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র, তোমার নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানের শুরুতে আমি খলীফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের কাছে শপথ করে বলেছিলাম এবং নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম যে, অভিযানের প্রস্তুতি হিসাবে এবং আগামীতে খলীফার রাজকোষ থেকে যে পরিমাণ অর্থের ব্যয় হবে আমি তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ ফেরত দিব বা পরিশোধ করব। খলীফার রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কর্মকর্তাদের কাছে অনুসন্ধান করে আমি জানতে পেরেছি যে, এই অভিযান উপলক্ষে এ যাবত তোমাকে খরচ হিসাবে ষাট হাজার দিরহাম রৌপ্য পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে তুমি আজকের দিন পর্যন্ত যে পরিমাণ নগদ ও মালামাল পাঠিয়েছ, বহু মূল্যবান দ্রব্যাদিসহ যোগ করে দেখা গেছে তার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার দিরহাম ও অতিরিক্ত কুড়ি হাজার দিরহাম। এই সমস্ত কিছুই রাজকীয় কোষাগারে জমা  হয়েছে। এই মুহূর্তে যেখানেই তুমি স্থায়ী কোনো গ্রাম বা শহর বা বিখ্যাত কোনো নগর দেখতে পাবে অবশ্যই সেখানে মসজিদ ও ধর্ম প্রচারের মঞ্চ নির্মাণ করে দিবে। প্রতি সপ্তাহের জুম্মাবারে সেখানে অবশ্যই খুৎবা পাঠ করা হোক এবং মুদ্রাসমূহে খলীফার নাম খোদাই করা বাধ্যতামূলক হোক। … “**

----------------------------------------

*  প্রাগুক্ত, পুঃ ২৫৯-২৬০।

** প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬০-২৬২।

----------------------------------------

উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় বুঝা যায় যে, খ্রীষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী জুড়ে খলীফার রাজধানী বাগদাদে ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে যুদ্ধলব্ধ বিপুল সম্পদ ও দাস-দাসীর সমাবেশ ঘটতে থাকে। মুহম্মদ কাসিমসহ তার পূর্বে অন্য মুসলিম যোদ্ধাদের বর্তমান বালুচিস্তানের মকরান, সিন্ধু ও মুলতান অঞ্চলে ও আফগানিস্তানের আশেপাশের অঞ্চলের সকল ছোটখাট যুদ্ধ বিবেচনায় নিলে সব মিলিয়ে শুধু সেই সময়েই বেশ কয়েক লক্ষ মানুষকে দাস-দাসী হিসাবে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।  

আফগানিস্তানে খ্রীষ্টীয় ৯ম ও ১০ম শতাব্দীতে অনেক সংখ্যক স্থানীয় মুসলিম ধর্মের রাজবংশের উদ্ভব হতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে প্রথম দিককার রাজবংশ হল খোরাসানের তাহিরিদ, যাদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বল্খ্ ও হেরাত। তারা ৮২০ খ্রীষ্টাব্দে আব্বাসীয় খেলাফত থেকে বাস্তবে স্বাধীন হয়ে যায়। ৮৬৭-৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দের দিকে তাহিরিদদের পরে সিসতান থেকে সাফারিদ নামে স্থানীয় একটি রাজবংশ ক্ষমতায় আসে। উত্তরের স্থানীয় রাজারা দ্রুত শক্তিশালী সামানিদদের সামন্ত হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, যারা বোখারা থেকে শাসন করত। ৮৭২ থেকে ৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত বোখারা, সমরখন্দ ও বল্খ্ সামানিদদের শাসনের অধীনে সমৃদ্ধি ভোগ করেছিল।

খ্রীষ্টীয় ১০০০ সাল থেকে আফগানিস্তানের বেশীর ভাগ অঞ্চল মুসলিমদের অধীনে চলে গেলেও সেখানকার বৌদ্ধ স্থাপনাগুলি আরো কয়েক শতাব্দীকাল দাঁড়িয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেগুলি মুসলিম ধর্মীয় স্থানসমূহের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। বল্খ-এর পূর্বতন বৌদ্ধ অভিজাত পরিবারগুলি নূতন মুসলিম অভিজাত পরিবার গঠন করে। যেমন সবচেয়ে বিখ্যাত বার্মাকিড পরিবার বল্খ-এর মহা বিহারের মালিক (পারসিক উৎস থেকে যাকে নওবাহার বলা হত, যা সংস্কৃত নব বিহার থেকে এসেছিল)। ধর্মান্তরিত হয়ে বার্মাকিড পরিবার কেবলমাত্র বলখের আধেপাশের অঞ্চলে স্থানীয় মুসলিম অভিজাত হয়েছিল তাই নয়, তারা আব্বাসীয়দের রাজধানী বাগদাদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক পরিবার হয়ে উঠেছিল। সেখানে তারা সংস্কৃত গ্রন্থসমূহের আরবী অনুবাদ কাজে পৃষ্টপোষকতা প্রদান করে। এই সময়ে নামমাত্র ধর্মান্তরকরণ ঘটলেও ইসলাম-পূর্ব সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত ছিল।* বল্খ-এর বৌদ্ধ প্রথাসমূহের ইসলামী সমাজে প্রবেশ করার বিষয়ে লেখক ক্রিস্টোফার বেকউইথের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি মনে করেন, ল্যাটিন (বিশ্ববিদ্যালয়) কলেজের ধারণা সরাসরি ইসলামী মাদ্রাসা থেকে এসেছে, যার উৎস আবার মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ বিহার বা মঠ থেকে। মধ্য এশিয়ার প্রাথমিক আব্বাসীয় শতাব্দীগুলিতে পণ্ডিতদের প্রাধান্য থেকে এবং প্রথম মাদ্রাসা আফগান নগর বুস্টে নির্মাণ হবার ঘটনা থেকে বেকউইথ মনে করেন যে, শুধুমাত্র সেই সময়ে বৌদ্ধ পরিবার ও তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ টিকে থাকে নাই, সেই সাথে বৌদ্ধ চিন্তাপদ্ধতিও টিকে গিয়েছিল।** এই সময়ে আব্বাসীয় রাজধানী থেকে প্রচারিত ধর্মীয় শিক্ষা বৌদ্ধ ঐতিহ্যের সাথে বিজড়িত ছিল।

----------------------------------------

* দেখুনঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban, p. 5.

** ক্রিস্টোফার বেকউইথের লেখার উপর নাইল গ্রীনের আলোচনার জন্য দেখুনঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban, p. 5.

----------------------------------------

এই সমস্ত ঘটনা থেকে এটা মনে করার কারণ আছে যে, মুসলমানদের অধিকারে আফগানিস্তান চলে যাবার বেশ কয়েক শত বৎসর পর্যন্ত প্রাক-ইসলামিক প্রভাব কাটতে পারে নাই। ফলে আফগানিস্তানে সভ্যতার অনেকখানি প্রভাব ছিল। লেখক আন্দ্রে উইন্ক মনে করেন যে, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কী ও মোঙ্গল বিজয় পরবর্তী পশুপালক যাযাবরদের অভিগমনের সঙ্গে বর্তমান পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলসমূহে বৃহদায়তনে মুসলিম জনগোষ্ঠী দেখতে পাওয়ার সম্পর্ক আছে।* খ্রীষ্ঠীয় একাদশ শতাব্দীর সূচনা থেকে আরো কয়েক শত বৎসর আফগানিস্তানের ইতিহাসে যুদ্ধ আর যুদ্ধ-জয়ের ফলে লব্ধ বিপুল সম্পদের সমাবেশের বিবরণ যেমন দেখতে পাব তেমন এই সময় ধরে এই অঞ্চলে যুদ্ধ-লব্ধ বিপুল সংখ্যক দাস-দাসীর উপস্থিতিরও বিবরণ পাব। এর ফলে সমাজের ডেমোগ্রাফি বা জনমিতিতে বিপুল পরিবর্তন হয়ে থাকবে তেমন সমাজ-মনস্তত্ত্বেও পরিবর্তন হবে। এই বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।

----------------------------------------

* আন্দ্রে উইন্ক-এর বক্তব্য সম্পর্কে নাইল গ্রীনের আলোচনার জন্য দেখুনঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban, p. 5.

----------------------------------------

মধ্য যুগের আফগানিস্তান [সৌজন্যেঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam| From Conversion to the Taliban, 2017]

খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীর মাঝামাঝি আলপ্তগীন নামে একজন প্রাক্তন তুর্কী দাস গজনী দখল করে নেন। তার পরবর্তী ছিলেন আরেকজন প্রাক্তন দাস সবুক্তগীন, যিনি কাবুল ও সিন্ধু পর্যন্ত জয় করেন। তার পুত্র ছিলেন গজনীর মাহমুদ, যিনি ৯৯৮ খ্রীষ্টাব্দে ক্ষমতায় আসেন। মাহমুদ পাঞ্জাব ও মুলতান জয় করেন এবং ভারতের অভ্যন্তরে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করেন। এক সময়ের অখ্যাত শহর গজনী একটি জাঁকজমকপূর্ণ নগরে পরিণত হয়। তেমনিভাবে দ্বিতীয় রাজধানী বুস্টও (লস্কর গাহ্) সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। কাছাকাছি সময়ে খ্রীষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে বিখ্যাত পণ্ডিত আলবেরুনী উল্লেখ করেছেন যে, ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের পর্বতগুলিতে বিভিন্ন আফগান উপজাতি বাস করত। এরা সেই সময় প্রায় সিন্ধুদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ্ (অনূদিত), আলবেরুনীর ভারত-তত্ত্ব, Translation of Alberuni’s Kitab-fi-Tahkike Malil Hende Min Makalatun Mokbulatun fil-Akleao Marzulatun, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৮২, পৃঃ ১৬০।

----------------------------------------

যুদ্ধ ও লুঠতরাজের মাধ্যমে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকা গজনীর শাসকদের ভারতের বিপুল ধন-সম্পদের প্রতি লোভ ছিল। ভারতের ধন-সম্পদ ও দাস-দাসী পাওয়ার লোভে ১০০১ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনী থেকে পেশোয়ারের দিকে রওয়ানা হন। ঐতিহাসিক কাসিম ফিরিশতা বলেন যে, সেখানে লাহোরের রাজা জয়পালকে যুদ্ধে পরাজিত করে মাহমুদ প্রচুর ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেন। তিনি যে সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্য পান তার মধ্যে ১৬টি রত্ন খচিত কণ্ঠহার ছিল। সেকালের জহুরীরা এর মূল্য ১,৮০,০০ দিনার মূল্য ধার্য করেছিল।* এরপর ১০০৪ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ভারতে ভাটিয়া নামে একটি শহরে যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে ২৮০টি হাতী, বহু দাস-দাসী ও অন্যান্য দ্রব্য লুণ্ঠন করেন ও গজনী নিয়ে যান।

----------------------------------------

* দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, Bengali Translation of Ferista’s History of Muslim Conquest of India, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৭, পৃঃ ৩১।

----------------------------------------

১০০৮ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ নগর কোটে আক্রমণ করে মন্দিরের প্রতিমাগুলি ভেঙ্গে ফেলে মন্দিরকে ধূলিস্মাৎ করলেন। এর পর তার বাহিনী ভীম নামে একটি দুর্গে আক্রমণ করে তার আশেপাশে তালোয়ার ও আগুনের সাহায্যে ছারখার করে। কাসিম ফিরিশতা লিখেছেন যে, ভীমদুর্গে সঞ্চিত এত সোনা, রূপা, মূল্যবান পাথর ও মণিমুক্তা ছিল যে, পৃথিবীর কোনো রাজার ভাণ্ডারেই এত ছিল বলে মনে হয় না।

কিতাব-ই-ইয়ামিনি গ্রন্থের লেখক আল উতবি ৪০০ হিজরী সনে (১০০৯ খ্রীষ্টাব্দে) নযিন (Nazín) অভিযানের বিবরণে লিখেছেন যে, সেনাবাহিনী গজনীতে ফিরে আসার সময় অগুণিত সম্পদ ও দাস-দাসী নিয়ে আসে এবং দরিদ্র ও সাধারণরা প্রভূত সম্পদ ও দাস-দাসীর মালিক বনে যায়।*

----------------------------------------

* আল উতবি লিখেছেন, “And the army of Islám came to Ghazna with that boundless wealth, and those numberless sums of money, so that the forces of the foot soldiers of Islám were retarded in proceeding through India, and slaves fell in value to that extent, that the poor and humble became lords, and possessors of many slaves and goods beyond computation.” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, translated from the Persian version of the contemporary Arabic chronicle of Al Ụtbi by James Reynolds, printed for the Oriental Translation Fund of Great Britain and Ireland, London, Date: MDCCC.L.VIII (1858), p.  393.

----------------------------------------

সুলতান মাহমুদ ১০১১ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর নিকটবর্তী থানেশ্বর নামে একটি শহর ও তার যাত্রাপথে অবস্থিত অঞ্চলসমূহ বিজয়, ধ্বংস ও লুটপাট করেন। ফিরিশতা লিখেছেন যে, মাহমুদ থানেশ্বরের  মন্দিরের মূর্তিগুলি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেন ও  পদদলিত করবার জন্য জাগ সোমা নামে পরিচিত হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি মূর্তি গজনীতে পাঠিয়ে দেন। সেখানকার একটি মন্দিরে ৪৫০ মিসকাল ওজনের একটি পদ্মরাগমণি পাওয়া গিয়েছিল, যার সম্পর্কে হাজী মুহাম্মদ কান্দাহারীর বিবরণের উদ্ধৃতি ‍দিয়ে ফিরিশতা বলেন এটি যারা দেখেছে, তারা স্বীকার করেছিল যে এর মত আশ্চর্য বস্তু আর একটিও কোথাও আছে বলে কেউ শুনে নাই। কাসিম ফিরিশতা বলেন যে, এই সময় মুসলমান বাহিনী ভারত থেকে বহু ধন-সম্পদ ও দুই লক্ষ লোককে বন্দী করে রাজধানী গজনী নিয়ে যায়। এর ফলে রাজধানী গজনী একটা ভারতীয় নগরীতে পরিণত হয়েছিল। এমন কোনো সৈনিক থাকল না যারা অনেক দাস-দাসী ও সম্পদের মালিক হয় নাই।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৩।

----------------------------------------

উতবি লিখেছেন, মাওয়ারন্নাহার অঞ্চলের (আমু দরিয়া নদীর অপরপারে অবস্থিত অঞ্চলকে বলা হত) শাসনকর্তা হিসাবে তোগান-খানের সময়ে (৪০৩ হিজরী বা ১০১২ খ্রীষ্টাব্দের দিকে) চীনের সীমান্ত অঞ্চল থেকে এক বিশাল সেনাবাহিনী এক লক্ষ তাবু সহ আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করতে আসে। তারা ছিল মূর্তি পূজারী। তোগান-খান এক লক্ষ লোক সংগ্রহ করলেন এবং তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করেন ও প্রায় এক লক্ষ লোককে হত্যা করেন। তাদের প্রায় এক হাজার বন্দী, তাদের কম বয়স্কা নারী ও শিশু এবং অগুণতি ধন-সম্পদ ইসলামী বাহিনীর হাতে আসে।*

----------------------------------------

* ঐতিহাসিক আল উতবি লিখেছেন, “They cast to the ground upon the battle field, nearly 100,000 dead bodies of infidels, heads bade farewell to bodies, and souls were divided from forms. The vulture swords inflicted full pain upon the livers of unbelievers, and the hyenas and lions were gladdened by gleaning from that plain. Nearly one thousand captives, their damsels and children fell into the hands of the people of Islám, equal in beauty to the Moon, and in brightness excelling the all-diffused ray, and incalculable wealth and plunder besides, the residue of the army gnawed destruction and took to flight.” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, p.  434.

----------------------------------------

১০১৭ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ কনৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন। এখানকার একটি শহর জয় করে তিনি মিরাটের পথে রওয়ানা হন। সেখানে থেকে তিনি ২,৫০,০০০ রৌপ্য দিনার ও ৩০টি হাতি হস্তগত করেন। সেখান থেকে তিনি যমুনা নদীর তীরে মহাভন নামে এক দুর্গ জয় করে প্রভূত ধন সম্পদ ও অন্যান্য লুণ্ঠিত দ্রব্য পান। এরপর তিনি মথুরা নগরে প্রবেশ করে লুটপাট করেন ও সেখানকার মূর্তিগুলির কিছু ভেঙ্গে ফেললেন ও কিছু আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। এখানে তিনি বিপুল পরিমাণ সোনা ও রূপা পান। কারণ মূর্তিগুলি সোনা ও রূপার তৈরী ছিল। ফিরিশতা বলেন যে, মথুরার মন্দিরগুলিতে চারটি স্বর্ণনির্মিত মূর্তি ছিল, যাদের চোখ পদ্মরাগমণি দিয়ে গঠিত। ঐ মূর্তিগুলির মূল্য ছিল ৫০,০০০ দিনার। অন্য আর একটি মূর্তিতে ৪০০ মিসকাল ওজনের একটি নীলকান্ত মণি পাওয়া গিয়েছিল এবং মূর্তিটি গলিয়ে বিপুল পরিমাণ বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সোনার মূর্তিগুলি ছাড়াও সেখানে একশয়ের উপর রূপার মূর্তি ছিল, যেগুলি বহন করতে শতাধিক উট লেগেছিল।* মথুরায় সুলতান মাহমুদ শহরে ব্যাপক লুণ্ঠন ছাড়াও আগুন দিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন।

----------------------------------------

* দেখুনঃ কাসিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৮।

----------------------------------------

সুলতান মাহমুদ মথুরার মন্দিরগুলি লুণ্ঠন করার পর মুনয্ নামে একটি দুর্গাভিমুখে সৈন্য পরিচালনা করেন। সেখানে লুণ্ঠন পরিচালনা করার পর তিনি চাঁদ পালের দুর্গ অবরোধ করেন। সেখানে লুটপাট করার পর চন্দ্র রায় নামে এক রাজার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। ফিরিশতা বলেন যে, লুটের মাল ভারাক্রান্ত ও অসংখ্য বন্দী পরিবৃত হয়ে মাহমুদ গজনী ফিরে আসেন। গজনীতে তিনি তার লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে ছিল ২০,০০০,০০০ দারম্ সোনা ও রূপার পিণ্ড, ৫৩,০০০ যুদ্ধবন্দী ও ৩৫০টি হাতী।* এ প্রসঙ্গে উতবি লিখেছেন, সুলতান হিন্দ থেকে ফিরে আসার পর এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও মণি-রত্ন এবং এত বিপুল সংখ্যক দাস-দাসী নিয়ে আসেন যে, গজনীর সুরাপানের স্থান ও রাস্তা তাদের জন্য খুবই সংকীর্ণ বলে প্রতীয়মান হল। এছাড়া এই অঞ্চলের খাদ্য ও পানীয় তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই সময়ে খুরাসান, মাওয়ারন্নাহার ও ইরাকের মত দূর অঞ্চল থেকে বণিকদের বিভিন্ন গোত্র এত বেশী দাস-দাসী গজনীতে নিয়ে আসল যে, তাদের সংখ্যা মুক্ত মানুষদের সংখ্যা থেকে বেশী হল ও শ্বেত মুক্ত মানুষেরা তাদের সংখ্যাধিক্যে হারিয়ে গেল।**

----------------------------------------

* অনুবাদক লিখেছেন, দারমের মূল্য ৫ পেঃ ধরলে এই সংখ্যা ৪১৬,৬৬৬ পাউন্ড স্টারলিং-এর বেশী হবে না।  দেখুনঃ কাসিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৮-৫০।

** উতবির ভাষায়ঃ “When the Sultán returned from Hind in victory and light, with abundant wealth and no scanty amount of gems, and so many slaves that the drinking-places and streets and Ghazna were too narrow for them, and the eatables and victuals of the country sufficed not for them, and from the most distant parts tribes of merchants betook themselves to Ghazna, bringing so many slaves from Khurásán, and Mawarannahar, and Irák, that their number exceeded the free, and a white freeman was lost among them, …”, Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, p.  462-463.

----------------------------------------

এরপরে সুলতান মাহমুদ কাশ্মীরের পথে রওয়ানা হয়ে লোকোট দুর্গ ঘেরাও করেন। কিন্তু সেটি অজেয় মনে করে সেখান থেকে লাহোরে পৌঁছান। যখন লাহোর অধিকার করেন তখন বিনা বাধায় শহরে প্রবেশ করে সৈন্যদেরকে বেপরোয়াভাবে লুটপাটের জন্য ছেড়ে দেন। ফিরিশতা বলেন যে, এখানে এত ধন-সম্পদ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি সুলতানের হাতে পড়েছিল যে, তা পরিমাপ করা সাধ্যাতীত ছিল।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ কাসিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৫৩-৫৪।

----------------------------------------

বিশেষভাবে ভারতবর্ষের ধন সম্পদের প্রতি বিদেশী হানাদারদের এত প্রলুব্ধ নজর ছিল যে, ধারণা করা যায় এই বিপুল সম্পদের খবর নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে থাকবে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ফিরিশতার বর্ণিত বিবরণে। তিনি বলেন যে, ১০২৪ খ্রীষ্টাব্দে মাহমুদ যখন গুজরাটের দিউ দ্বীপের কাছে সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠনের জন্য গজনী থেকে যাত্রা করেন তখন তার সহযাত্রী হবার জন্য তুর্কীস্থান ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলি থেকে ৩০,০০০ যুবক যোগ দেয়। তারা সোমনাথ আক্রমণের উদ্দেশ্যে বিনা বেতনেই সুলতানের সেনাবাহিনীর সাথে গিয়েছিল।* ধারণা করা যায় যে, ভারতবর্ষের বিপুল সম্পদের ভাণ্ডার ও যুদ্ধলব্ধ নারীদের পাওয়ার জন্য তারা এতটা উৎসাহী হয়েছিল। ফিরিশতা লেখেন যে, গজনীর সুলতান এই মন্দিরে যে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও রত্ন পেয়েছিলেন জগতে কোনো রাজার ভাণ্ডারে তত ছিল না।

----------------------------------------

* দেখুনঃ কাসিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৫৬।

----------------------------------------

সুলতান মাসুদ গজনভী ১০৩৩ খ্রীষ্টাব্দে ভারত অভিযানে গিয়ে কাশ্মীরের পর্বতশ্রেণীর মধ্যে অবস্থিত একটি দুর্গ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দখল করতে সমর্থ হন। সেখানে তিনি সমস্ত লোককে নির্বিচারে হত্যা করেন। সেখানকার শিশু ও নারীদের যুদ্ধবন্দী হিসাবে নিয়ে যান।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ কাসিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৮৩।

----------------------------------------

কাশিম ফিরিশতা বলেন যে, সুলতান ইব্রাহিম-বিন-মসউদ গজনভী ভারতে এক সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন, এবং এমন সমস্ত স্থান অধিকার করেন যেখানে আগে কোনো মুসলমান বাহিনী প্রবেশ করে নাই। সময়টি ছিল ১০৭৯ খ্রীষ্টাব্দ। সুলতান ডেরা নামে একটি শহরের শহরবাসীদের আত্মসমর্পণ ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে আহবান জানান। শহরবাসীরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করলে কয়েক সপ্তাহ অবরোধের পর শহরটিতে হামলা করার ফলে উভয় পক্ষে বহু সংখ্যক লোক নিহত হবার পর মুসলমানরা শহর দখল করে। তারা এখান থেকে প্রচুর পরিমাণ ধন-রত্ন  লুন্ঠন করে ও এক লক্ষ লোককে বন্দী করে গজনী নিয়ে যায়।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ কাসিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১১১-১১২।

----------------------------------------

কিতাব-ই-ইয়ামিনি গ্রন্থের লেখক আল উতবী বলেন যে, গজনী এক সময় চারিপাশে সভ্য দেশ ও বিখ্যাত নগরসমূহের মধ্যে একটি হীনতর ও সংকীর্ণ অঞ্চল ছিল।* ধারণা করা যায় যে, ভারত থেকে বিপুল ধন সম্পদ লুণ্ঠন করে রাজধানী গজনীতে নিয়ে যাবার ফলেই পরবর্তীকালে গজনী একটি জাঁকজমকপূর্ণ ও সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়।

----------------------------------------

* গজনীতে সুলতান মাহমুদের একটি জামে মসজিদ নির্মাণ প্রসঙ্গে আল উতবি বলেন যে, “… … he ordered that they should make a choice of a site for the Jama Masjid of Ghazna, since they had constructed the old mosque in bygone times and for a smaller number of people, at a time when Ghazna was but a small territory, and was inferior amongst civilized lands and renowned cities.” Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini,), p.  463.

----------------------------------------

মাহমুদের উত্তরসূরীরা শাসন কাজ পরিচালনা করেছিল ১১৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। তবে তাদের ক্ষমতা ক্রমশ কমে যেতে থাকে। এই সময়ে মধ্য আফগানিস্তানের পাহাড়-ঘেরা অঞ্চল ঘুরের আলাউদ্দিন হুসাইন গজনী লুন্ঠন করেন ও শেষ গজনাভিডদের ভারতে বিতাড়িত করেন। আলাউদ্দীনের ভাতিজা মুইজ আল-দীন মুহাম্মদ, যিনি ঘুরের মুহাম্মদ হিসাবে পরিচিত, ১১৭৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম ভারত আক্রমণ করেন। ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর কুতুব উদ্দীন আইবক দিল্লীর সুলতান হন। ঘুরের মুহাম্মদের মৃত্যুর অল্পকাল পরে ঘুরী সাম্রাজ্যের পতন হয় ও আফগানিস্তান সুলতান আলাউদ্দীন মুহাম্মদ দ্বারা অধিকৃত হয়। তিনি খারেজম-শাহ নামে পরিচিত ছিলেন। তার শাসনাধীন অঞ্চল পূর্ব দিকে চীনা তুর্কীস্তান থেকে পশ্চিম দিকে ইরাকের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

১২১৯ খ্রীষ্টাব্দে চেংগিস খান আলাউদ্দীনের অধীনস্থ পূর্বাঞ্চলীয় অংশে আক্রমণ করেন। আলাউদ্দীনের পুত্র জালালউদ্দীন মিংবুরনু আফগান উচ্চভূমির অধিবাসীদের কাবুলের কাছে পারওয়ানে (আধুনিক জাবাল ওস সরাজ) সমাবেশ ঘটান ও যুদ্ধে মোঙ্গলদের ভয়ানক পরাজয় ঘটান। চেংগিস খান প্রতিশোধ হিসাবে বামিয়ানে অভিযান চালান। সেখানকার যুদ্ধে তার নাতি মারা গেলে তিনি এত ক্ষিপ্ত হন যে, যখন তিনি সেখানকার নগর দুর্গটি দখল করেন, তখন একজনও জীবন্ত প্রাণীকে বাঁচিয়ে না রাখার হুকুম দেন। বামিয়ান সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এরপর গজনীর দিকে অগ্রসর হয়ে চেংগিস জালাল উদ্দীনকে পরাজিত করেন।

চেংগিস খানের মৃত্যুর পর তার বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। আফগানিস্তানে স্থানীয় প্রধানরা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। অন্যরা মোঙ্গল প্রধানদের কর্তৃত্বের অধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিল। এই ধরনের রাজত্বের যুগ ১৪শ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলেছিল যখন তৈমুর লং দেশটির বৃহৎ অংশ দখল করে নেন।

তৈমুর লং-এর ভারত অভিমুখে যাত্রার সময়কার একটি বিবরণে ঐতিহাসিক শরাফুদ-দীন ইয়াযদী তার যাফর-নামা গ্রন্থে লিখেন, ৮০০ হিজরীর রজব মাসে (মার্চ ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দ) তৈমুরের বাহিনী ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করে। তিনি শুনেছিলেন যে, দিল্লী ও অন্যান্য জায়গায় ইসলাম পালন করা হলেও সাধারণভাবে দেশটি অবিশ্বাসী ও মূর্তি-পূজকদের দ্বারা দুষিত। সুতরাং তিনি ধর্মীয় যুদ্ধ বা জিহাদের উদ্দেশ্যে মুলতান ও দিল্লীর বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন। তাদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, মনে হচ্ছিল যেন গাছের অসংখ্য পাতা। ইন্দরাবে পৌঁছে তিনি জানতে পারলেন যে, কাটোর পাহাড়ে অবিশ্বাসীরা বাস করে। তারা সাধারণত নগ্ন চলাফেরা করে ও তাদের ভাষা অদ্ভূত, যা পারসিক, তুর্ক ও হিন্দী থেকে ভিন্ন। তিন দিনের অবিরাম যুদ্ধে তৈমুরের বাহিনী জয়লাভ করে। তৈমুর তাদের খবর পাঠালেন যে, তারা যদি আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয় তাহলে তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা পাবে ও তারা তাদের ভূমিতে থাকার অধিকার পাবে। কিন্তু রাতের বেলা তারা তৈমুরের একটি বাহিনীকে আক্রমণ করে বসে ও তাদের ১৫০ জনকে বন্দী করে হত্যা করে। ইয়ায্দী লিখেছেন, “তখন ইসলামের সমস্ত বাহিনী পর্বতের উপরে উঠে এবং সকল পুরুষদের তরবাবির সহায্যে হত্যা করে, ও নারী ও শিশুদের বন্দী করে নিয়ে যায়। যারা আল্লাহর আরাধনায় কখনো তাদের মস্তক অবনত করে নাই সেই সমস্ত অবিশ্বাসীদের মাথা দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় পিরামিড তৈরী করা হয়।”*

----------------------------------------

* দেখুনঃ H.M. Elliot and John Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. III, Trübner and Co., London, 1871, pp. 480-481.

----------------------------------------

এরপর তৈমুরের বাহিনী আরেকটি বড় ধরনের গণহত্যা ও লুণ্ঠন সংঘটিত করে ভাটনির নামে একটি নগরে। রাও দুল চাঁদ ছিলেন এর শাসক। এটি ছিল প্রধানত হিন্দুদের বসতি। এখানে ইয়াযদীর ভাষ্যমতে তৈমুরের বাহিনী “দশ হাজার অবিশ্বাসীকে হত্যা করেছিল, সেখানকার বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল, এবং সমস্ত জায়গা ধ্বংস করেছিল। কিছু ছাইয়ের ঢিবি ছাড়া কিছুরই অবশিষ্ট ছিল না। লুটেরাদের হাতে আসা সোনা ও রূপা, এবং ঘোড়া ও লুঠের সমস্ত ধরনের মালামাল তৈমুরের নির্দেশে সেনাবাহিনীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল।”*

----------------------------------------

* দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৮৮-৪৯১।

----------------------------------------

ভাটনির ধ্বংসের পরে পচন ধরা নিহতদের কারণে বাতাস দুষিত হওয়ায় তৈমুর তার বাহিনীতে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দেন। এর পর তার বাহিনী নানা শহর ও নগরে লুণ্ঠন ও হত্যা চালায়। তবে তৈমুরের বাহিনীর আসার সংবাদ পেয়ে প্রায় সব নগরের বাসিন্দারা দূর অঞ্চলে পালিয়ে যায়। এরপরেও তৈমুরের সৈন্যরা তাদের পশ্চাধাবন করে তাদের মালামাল লুণ্ঠন করে ও তাদের অনেককে হত্যা করে ও নারী ও শিশুদের বন্দী করে। ইয়াযদী লিখেছেন যে, এই সকল নগর বা শহরের লোকজন অবিশ্বাসী, গবর্*, অগ্নি উপাসক ও হিন্দু ছিল। এভাবে তৈমুরের বাহিনী এই সমস্ত স্থানে ব্যাপক গণহত্যা ও লুণ্ঠন চালায়। এক সময তৈমুর যমুনা নদী অতিক্রম করে লোনি দুর্গের দিকে অগ্রসর হন। ইয়াযদী বলেন, গবররা আগেই দুর্গের ভিতর অবস্থিত তাদের বাড়ী-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল ও তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পুড়িয়ে ফেলেছিল। ইয়াযদী এরকম কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন যেখানে হিন্দুরা স্ত্রী ও সন্তানদের আগুনে নিক্ষেপ করে নিজেরা শত্রুদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বুঝা যায় যে, মুসলমান হানাদারদের দ্বারা তাদের স্ত্রী-কন্যাদের ধর্ষণ ও অবমাননাকর দাসত্বের চেয়ে হিন্দুরা এইভাবেই জীবন উৎসর্গ করাকে শ্রেয়তর মনে করত। তৈমুর আদেশ দিলেন যেন, সেখানে অবস্থিত মুসলমানদের এক পাশে সরিয়ে ফেলা হয় ও বাকীদের, গবর ও অবিশ্বাসীদের, ইসলামের তরবারির নীচে চালিত করা হয়। এরপর সৈয়দরা (তারা মুহাম্মদের বংশধর বলে কথিত) ছাড়া সেখানে থাকা সকল অধিবাসীদের উপর লুণ্ঠন পরিচালনা করা হল ও দুর্গটি পুড়িয়ে এটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হল।**

----------------------------------------

* গবর্ অর্থ অবিশ্বাসী বা জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারী। তখন ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চলে প্রধানত হিন্দুরা বাস করত। জরথুস্ত্র ধর্মের কেউ বাস করত না। এখানে ইয়াযদী অমুসলমান নির্বিশেষে অবিশ্বাসী, গবর্, ইত্যাদি বলেছেন।

** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯১-৪৯৬।

----------------------------------------

এর কিছু দিন পরে লোনির কাছে হিন্দুদের উপর পরিচালিত গণহত্যার বর্ণনা ইয়াযদী দিয়েছেন। সেখানে শিবির ফেরার পর তৈমুরকে আমীর জাহান শাহ ও অন্যান্য আমীররা জানায় যে, সিন্ধু নদী অতিক্রম করার পর কম বা বেশী এক লক্ষ হিন্দু বন্দী করা হয়েছিল এবং এই সমস্ত হিন্দুদের তাঁবুতে রাখা আছে। মনে করা হচ্ছে যে, দিল্লীর সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের দিন তারা শত্রুর সাথে যোগ দিতে পারে। এই মতটির সমর্থন পাওয়া যায় যখন দিল্লীর সম্রাটের বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হলে তারা উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। তৈমুর এই বিষয়টিকে গ্রহণ করলেন এবং সকল হিন্দু বন্দীকে হত্যা করতে নির্দেশ দিলেন। আরো বললেন যে, যারা এই হুকুম প্রতিপালন করতে অবহেলা করবে তাদেরকে হত্যা করতে হবে এবং তাদের স্ত্রী, সন্তান ও সম্পত্তি তথ্য প্রদানকারীর সম্পত্তি হবে। এই হুকুমের ফলে ১,০০,০০০ হিন্দুকে তরবারির নীচে হত্যা করা হল। এরপর তিনি বন্দীদের স্ত্রী ও সন্তানদের ও গবাদিপশুগুলিকে পাহারা দিবার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন।*

----------------------------------------

* এই ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন ইয়াযদী। তিনি লিখেছেন, “On the same day Amír Jahán Shah and other amirs represented to Tímúr that from the time he crossed the Indus a hundred thousand Hindu prisoners, more or less, had been taken, and that these gabrs and idol-worshippers were kept in the camp. It was to be feared that in the day of battle with the forces of Delhí they might join the enemy. This opinion was confirmed by the joy which the prisoners had exhibited when Mallú Khán marched against the imperial forces at Jahán-numáí.   Tímúr considered the point, and deeming the advice of his officers to be wise, he gave orders for all the Hindu prisoners to be put to death. Every one who neglected to comply with this command was to be executed, and his wives, children, and goods were to become the property of the informer. In pursuance of this order 100,000 infidel Hindus were put to the sword. Mauláná Násiru-d dín, a most distinguished ecclesiastic, had fifteen Hindus in his train, and he who had never caused a sheep to be slaughtered was obliged to have these fifteen Hindus killed. Tímúr also issued an order that one man out of every ten should be left in camp to guard the wives and children of the prisoners, and the captured cattle.” দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৭।  

----------------------------------------

১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তৈমুর লং দিল্লী দখল করেন। দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ নিবার পর খাজাঞ্চীখানার কর্মকর্তাদের শহরে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য রবিউ-স সানি মাসের ১৬ তারিখে পাঠানো হল। বহু সহস্র সৈন্য খাদ্য শস্য ও চিনি আদায়ের আদেশ নিয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হল। কর্মকর্তাদের প্রতি একটি আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে, যে সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তৈমুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ও শহরে পলাতক অবস্থায় আছে তাদের প্রত্যেককে বন্দী করতে হবে। এই নির্দেশ পালনের জন্য সৈন্যদল সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সৈন্যরা মানুষের উপর পীড়ন শুরু করণ। নিজ স্ত্রী-কন্যার ধর্ষিত হওয়া সহ্য করতে না পেরে দিল্লী শহরের, সিরি, জাহান পানাহ্ ও পুরাতন দিল্লীর  হিন্দুরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয় ও সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে। হিন্দুরা তাদের নিজেদের জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয় ও তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে। এর ফলে সৈন্যরা লুটপাট ও ধ্বংসে আরো আগ্রহী হয়ে উঠে। সমস্ত শহরে লুণ্ঠন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কর্মকর্তারা অপেক্ষা করে। প্রায় ১৫০০০ মানুষ শুক্রবার সারা রাত লুণ্ঠন ও বাড়ী-ঘরে আগুন দিবার কাজে নিয়োজিত ছিল। অনেক স্থানে হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সকাল বেলায় যে সমস্ত সৈনিকরা বাইরে ছিল তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নগরের ভিতর প্রবেশ করল ও ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সুষ্টি করল। রবিবার দেখা গেল যে সমস্ত জায়গায় লুণ্ঠন করা করা হয়েছে এবং জাহান-পানাহ্ ও সিরির বহু প্রাসাদ ধ্বংস করা হয়েছে। ১৮ তারিখেও লুটতরাজ চলতে লাগল। দেখা গেল যে, প্রতিটি সৈনিক কুড়ি জনেরও বেশী মানুষকে দাস হিসাবে পেয়েছে এবং কেউ কেউ পঞ্চাশ বা এক শত পুরুষ, নারী ও শিশুকে দাস হিসাবে শহরের বাইরে নিয়ে গেছে। অন্যান্য দ্রব্য লুণ্ঠন ও কেড়ে নিবার পরিমাণ এত বেশী ছিল যে সেগুলি হিসাবের বাইরে ছিল। এগুলি হল মূল্যবান মণি-রত্ন, হীরা, সব ধরনের জিনিসপত্র ও কাপড়, সোনা ও রূপার পাত্র ও আধার, ও আলাই টংকা ও অন্যান্য মুদ্রা। যেসমস্ত নারীকে বন্দী করা হয়েছিল তাদের বেশীরভাগই হাত ও পায়ে সোনা বা রূপার হার ও আঙ্গুলে আংটি পরেছিল। ১৯ তারিখে অনেক হিন্দু যারা বড় মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল, মনে করা হল যে, তারা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তৈমুরের বাহিনী সেখানে গিয়ে তাদের হত্যা করে। হিন্দুদের কর্তিত মস্তকে উঁচু স্তম্ভ তৈরী করা হল। তাদের দেহ ক্ষুধার্থ প্রাণী ও পাখীদের খাদ্যে পরিণত হল। একই দিন সমগ্র পুরাতন দিল্লী লুণ্ঠন করা হল। সেখানকার যে সমস্ত অধিবাসী জীবন্ত রক্ষা পেয়েছিল তাদের বন্দী করা হল। সেখান থেকে বহু হাজার কারিগর ও যন্ত্রশিল্পীকে নগর থেকে বের করা হল ও তৈমুরের অধীনে নেওয়া হল। তাদেরকে বিভিন্ন রাজপুত্র, আমীর ও আগাদের মধ্যে বিতরণ করা হল। তৈমুর তার রাজধানী সমরখন্দে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি আদেশ দিলেন যে, এই ধর্মীয় কাজের জন্য যেন সকল পাথর-মিস্ত্রীকে সংরক্ষিত রাখা হয়।*

----------------------------------------

* দিল্লীতে তৈমুরের এই ভয়ংকর লুঠতরাজ, ধ্বংসকাণ্ড ও দাসকরণের বিবরণ ইয়াযদী ও ফিরিশতা দুই জনেই দিয়েছেন। দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫০১-৫০৪ এবং

কাসিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৩৯০-৩৯২।  

----------------------------------------

এরপর তৈমুর এক যুদ্ধে মীরাটের দুর্গ অধিকার করেন। সেখানকার হিন্দু সৈন্যদের হত্যা করা হয় ও তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হয়। এরপর দুর্গের দেওয়াল মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়। এরপর তৈমুর যমুনা নদীর উপরের অংশে তার বাম ভাগের সৈন্যবাহিনীকে হিন্দুদের অঞ্চলসমূহের উপর লুটতরাজ ও আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য পাঠিয়ে দেন। এরপর তৈমুর গঙ্গা নদী পার হয়ে ও পরে জম্মু সহ বিভিন্ন ভারতীয় অঞ্চল অধিকার করে লুণ্ঠন ও গণহত্যা পরিচালনা করেন। পরে তিনি সমরখন্দে প্রত্যাবর্তন করেন।    

তৈমুরের উত্তরসূরী তিমুরীদরা (১৪০৫ – ১৫০৭ খ্রীষ্টাব্দ) শিক্ষা ও শিল্পকলার বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল, যারা রাজধানী হেরাতে চমৎকার সমস্ত ভবন নির্মাণ করেছিল। তাদের শাসনাধীনে আফগানিস্তান শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।

তিমুরীদ শাসনামলে কিছু নারীকে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। তিমুরীদ শাসক শাহরুখের (শাসনকাল ১৪০৫-৪৭) স্ত্রী ও রাণী গওহর শাদ তার স্বামীর মৃত্যুর পর তার অল্প বয়স্ক নাতীকে তিমুরীদ শাসক হিসাবে অভিষিক্ত করার পর প্রায় এক দশক বাস্তবে শাসন করেছিলেন। তিনি দুইটি মসজিদ নির্মাণের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।* এছাড়াও এই সময়ে রাজপরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট নারীদের বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ্** ও সমাধিসৌধ নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা করার প্রমাণ পাওয়া যায়।***

----------------------------------------

* দেখুনঃ Nushin Arbabzadah, Women and Religious Patronage in the Timurid Empire, in, Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban, pp. 56, 57.

** সুফি ইসলামে প্রচলিত আবাসিক ভবন যা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যবহৃত হত।

*** প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৬-৭০।

----------------------------------------

১৬শ শতাব্দীর প্রথম দিকে তুর্কী উজবেকরা মুহাম্মদ শ্যাবানির অধীনে মধ্য এশিয়ার ক্ষমতায় আরোহণ করে, যিনি ১৫০৭ খ্রীষ্টাব্দে হেরাত দখল করেন। ১৫১০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে সাফাভিদ শাহ ইসমাইল ১ মার্ভে শ্যাবানিকে অবরোধ করেন এবং তাকে হত্যা করেন। চেংগিস খান ও তৈমুর লং-এর বংশধর বাবর ১৫০৪ খ্রীষ্টাব্দে কাবুলকে একটি স্বাধীন ও ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজধানী বানান। তিনি ১৫২২ খ্রীষ্টাব্দে কান্দাহার দখল করেন এবং ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে দিল্লীর দিকে যাত্রা করেন। তিনি ভারতের শেষ আফগান রাজা ইব্রাহীমকে পরাজিত করেন, যিনি ছিলেন শেষ আফগান লোদি বংশের রাজা। এভাবে তিনি ভারতে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। হিন্দু কুশ পর্বতের দক্ষিণ থেকে সমগ্র পূর্ব আফগানিস্তান মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে পরবর্তী ২০০ বৎসর আফগানিস্তান পর্যায়ক্রমে ভারতের মোগল ও ইরানের সাফাভিদদের অধীনে ছিল। মোগলরা কাবুল থেকে উত্তরে হিন্দু কুশ পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ পর্যন্ত এবং সাফাভিদরা হেরাত ও ফারাহ অধিকার করে ছিল। বহু কাল ধরে কান্দাহার ছিল বিতর্কমূলক এলাকা।

বিদেশীদের শাসন থেকে আফগানিস্তান স্বাধীন হবার অনেক চেষ্টা করেছিল। ১৭০৯ খ্রীষ্টাব্দে হোটাকি গিলযাই (Hotaki Ghilzay) গোত্রের নেতা মীর বাইস খান (Mir Vays Khan) কান্দাহারের পারসীয় গভর্নর গোরজিন খানের বিরুদ্ধে একটি সফল অভ্যুত্থান ঘটান। এভাবে প্রথম বিদেশী শাসন থেকে আফগানিস্তানের মুক্তির কাল শুরু হয়। মীর বাইস খান ১৭১৫ খ্রীষ্টাব্দে তার মৃত্যু পর্যন্ত কান্দাহার শাসন করেন।

১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে পারস্য থেকে নাদির শাহের সেনাবাহিনী কান্দাহারে পৌঁছায় ও শহরটি অবরোধ করে। দুই মাস অবরোধের পর সাইদাল খানের নেতৃত্বে গিলযাই দুর্গ আত্মসমর্পণ করে। হেরাতের সাদ্দোযাই সুলতানদের প্রতি সমর্থন দেওয়ায় সাইদাল খানের দুই চক্ষু উৎপাটন করা হয়। নাদির শাহের সেনাবাহিনীর হাতে ১৭৩৮ খ্রীষ্টাব্দে কান্দাহার নগরের পতন ঘটে। ক্ষমা চাওয়ায় শাহ হোসেন হোটাকি ক্ষমা পান কিন্তু হোটাকি গোত্রের মানুষদের গণহারে পারস্যের সবযাওয়ার ও অন্যান্য অঞ্চলে নির্বাসিত করেন। আবদালি গোত্রের মানুষদের নির্বাসন থেকে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয় ও বাড়ী, জমি ও চারণভূমি তাদের দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর নাদির শাহ গজনী ও কাবুল দখল করে নেন এবং ১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে মোগল রাজধানী দিল্লী দখল করেন। তার যুদ্ধ লব্ধ জিনিসের মধ্যে ছিল কোহিনুর নামে একটি বিখ্যাত হীরা ও ময়ূর সিংহাসন। দিল্লীতে তিনি সাধারণ গণহত্যার নির্দেশ দেন। ফলে সেখানে এক ভয়াবহ গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন সংঘটিত হয়, এবং দোকান ও ঘর-বাড়ী পুড়ানো হয়। যখন নাদির শাহ হত্যা ও ধ্বংসকাণ্ড বন্ধ করার নির্দেশ দেন তখন দেখা গেল যে,  ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ এর মত পুরুষ, নারী ও শিশু নিহত হযেছিল।* এই উন্মত্ত হিংস্রতার পর নাদির শাহ বিপুল সম্পদ হাতি ও উটের পিঠে নিজের দেশে নিতে থাকেন।** নাদির শাহ ভারতে বহু সংখ্যক ধ্বংসকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। তার সময়কার ঘটনাবলীর অনেক কিছুর সাক্ষী ঐতিহাসিক আনন্দ রাম মুখলিস লিখেছেন যে, ওয়াযিরাবাদ, ইমনাবাদ ও গুজরাটের মত নগরগুলি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হল। কোনো কিছুর প্রতিই ছাড় দেওয়া হল না, সব ধরনের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের হাতে বিনষ্ট হল, এবং নারীরা ধর্ষকদের শিকারে পরিণত হল।*** আততায়ীর হাতে নাদির শাহের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্যে নানা খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যায় ও আফগান সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে।

----------------------------------------

* দেখুনঃ Jonathan L. Lee, Afghanistan: A History from 1260 to the Present, Reaktion Books Ltd, London, 2018, pp. 94-95.

** ঐতিহাসিক রুস্তম আলী ১৭৪১-৪২ খ্রীষ্টাব্দের দিকে রচিত তারিখ-ই হিন্দী গ্রন্থে এই বিষয়ে যে বিবরণ দিয়েছেন তা এই রকম, “Afterwards, Nádir Sháh himself, with the Emperor of Hindústán, entered the fort of Delhí. It is said that he appointed a place on one side in the fort for the residence of Mahammad Sháh and his dependants, and on the other side he chose the Díwan-I Khás, or, as some say, the Garden of Hayát Bakhsh, for his own accommodation. He sent to the Emperor of Hindústán, as to a prisoner, some food and wine from his own table. One Friday, his own name was read in the khutba, but on the next he ordered Muhammad Sháh’s name to be read. It is related that one day a rumour spread in the city that Nádir Sháh had been slain in the fort. This produced a general confusion, and the people of the city destroyed five thousand men of his camp. On hearing of this, Nádir Sháh came of the fort, sat in the golden masjid which was built by Roshanu-d daula, and gave orders for a general massacre. For nine hours an indiscriminate of all and of every degree was committed. It is said that the number of those who were slain amounted to one hundred thousand. The losses and calamities of the people of Delhí were exceedingly great. … … … After this violence and cruelty, Nádir Sháh collected immense riches, which he began to send to his country laden on elephants and camels.” দেখুনঃ H.M. Elliot and John Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. VIII, 1877, p. 64.

একই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন ঐতিহাসিক আনন্দ রাম মুখলিস তার তাযকিরা গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, “On the morning of the 11th an order went forth from the Persian Emperor for the slaughter of the inhabitants. The result may be imagined; one moment seemed to have sufficed for universal destruction. The Chándni chank, the fruit market, the Daribah bázár, and the buildings around the Masjid- i Jáma’ were set fire to and reduced to ashes. The inhabitants, one and all, were slaughtered. Here and there some opposition was offered, but in most places people were butchered unresistingly. The Persians laid violent hands on everything and everybody; cloth, jewels, dishes of gold and silver, were acceptable spoil.

… …

… The massacre lasted half the day, when the Persian Emperor ordered Hájí Fúlád Khán, the kotwál, to proceed through the streets accompanied by a body of Persian nasakchís, and proclaim an order for the soldiers to desist from carnage. By degrees the violence of the flames subsided, but the bloodshed, the devastation, and the ruin of families were irreparable. For a long time the streets remained strown with corpses, as the walks of a garden with dead flowers and leaves. The town was reduced to ashes, and had the appearance of a plain consumed with fire. All the regal jewels and property and the contents of the treasury were seized by the Persian conqueror in the citadel.  He thus became possessed of treasure to the amount of sixty lacs of rupees and several thousand ashrafis; plate of gold to the value of one kror of rupees, and the jewels, many of which were unrivalled in beauty by any in the world, were valued at about fifty krors. The peacock throne alone, constructed at great pains in the reign of Sháh Jahán, had cost one kror of rupees. Elephants, horses, and precious stuffs, whatever pleased the conqueror’s eye, more indeed than can be enumerated, became his spoil. In short, the accumulated wealth of 384 years changed masters in a moment.” দেখুনঃ H.M. Elliot and John Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. VIII, pp. 88-89.

*** আনন্দ রাম মুখলিস রচিত তাযকিরা গ্রন্থের বিবরণ এই রকমঃ “On the 4th of Shawwál the Persian army crossed the Attock river on a bridge of boats. On the 8th the Emperor reached the left bank of the Chináb river, and on the 9th encamped close to the bridge of Sháh-daula.

But how to relate the ruin and desolation that overwhelmed this beautiful country! Wazírábád, Ímanábád, and Gujarát, towns which, for population, might almost be called cities, were levelled with the earth. Nothing was respected; property of all kinds became the spoil of the plunderer, and women the prey of the ravisher.” দেখুনঃ H.M. Elliot and John Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. VIII, p. 80.    

----------------------------------------

নাদির শাহের ৪০০০ আফগান দেহরক্ষীর সেনাপতি ছিলেন আহমদ খান আবদালী, যিনি এর পর কান্দাহারে ফিরে আসেন ও গোত্রীয় পরিষদে শাহ নির্বাচিত হন। তিনি দুর-ই দুরান খেতাবে নিজেকে ভূষিত করেন। অন্যান্য আফগান গোত্রীয় নেতাদের সমর্থন নিয়ে তিনি (আহমদ শাহ দুররানি) মেশেদ থেকে কাশ্মীর ও দিল্লী পর্যন্ত, অন্য দিকে আমু দরিয়া থেকে আরব সাগর পর্যন্ত আফগান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে আহমদ শাহ আবদালী মোগলদের পরাজিত করে লাহোর জয় করেন ও ব্যাপক লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেন। এই সময় তিনি হাজার-হাজার নারী ও শিশুদের বন্দী করে দাস করেন ও হাজার-হাজার পাঞ্জাবী পুরুষদের তার সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন।* এরপর আবদালী গুরুত্বপূর্ণ শহর সিরহিন্দ অধিকার করেন ও সেখানে ব্যাপক লুণ্ঠন পরিচালনা করেন। সেখানকার অধিকাংশ পুরুষ অধিবাসীদের এবং নারী ও শিশুদের দাস করা হয়। এখানে মোগল সেনাবাহিনীর সমস্ত সম্পদ তাদের হাতে চলে যায়। এখানে বহু সংখ্যক মুসলমান অধিবাসী থাকার পরেও আবদালরি বাহিনী এখানে লুণ্ঠন পরিচালনা করে।** তিন বৎসর পর আবদালীর বাহিনী দ্বিতীয়বার লাহোরে গণহত্যা চালায় ও লুণ্ঠন পরিচালনা করে। 

----------------------------------------

* দেখুনঃ Jonathan L. Lee, Afghanistan: A History from 1260 to the Present, p. 121.

** দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২১।

----------------------------------------

১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে আহমদ শাহ দিল্লীর গেটে এসে উপস্থিত হন। তিনি ইতিমধ্যে মোগল বাদশাহ আলমগীর ২-কে একটি তালিকা দেন যেখানে ২ কোটি রূপি প্রদান, সম্রাটের কন্যাকে বিবাহের সম্মতি, ও কাশ্মীর ও সিরহিন্দের উত্তরে সকল মোগল অঞ্চল হস্তান্তরের কথা উল্লেখ ছিল। যদি তার শর্ত পালন না করা হয় সেক্ষেত্রে তিনি দিল্লী লুণ্ঠনের হুমকি দেন। আলমগীর ২ আহমদ শাহের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করলে অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে আহমদ শাহ দিল্লী প্রবেশ করেন। তিনি আলমগীর ২-কে সিংহাসনে থাকার অনুমতি দিলেও মূল ক্ষমতা আহমদ শাহের হাতে থাকল। কিছুদিনের মধ্যেই আহমদ শাহ মোগলদের ধর্মীয় সহনশীলতার দীর্ঘ ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে ফেললেন ও অমুসলিমদের পাগড়ী ও অন্যান্য ইসলামিক পোশাক পরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। তিনি আদেশ দিলেন যে, হিন্দুরা কপালে একটি পৃথক চিহ্ণ ব্যবহার করবে। আহমদ শাহ তার সৈন্যদের বেতন দিবার জন্য মোগল রাজকোষ থেকে নিযুত পরিমাণ রূপি চাইলেন, কিন্তু মোগল রাজকোষ তখন শূন্য। তিনি পারিষদ, বণিক ও প্রতিটি গৃহ থেকে খাজনা আদায়ের উদ্যোগ নিলেন ও এর জন্য মানুষের উপর ভয়ংকর অত্যাচার করলেন। দিল্লীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তিনি এখন জাঠদের অঞ্চলের প্রতি মনোযোগ দিলেন, যেগুলি দিল্লীর দক্ষিণ ও পূর্বে ছিল্। তিনি ফরিদাবাদ দুর্গ আগুন ও তরবারির মুখে ধ্বংস করলেন।

আফগান সেনানায়ক সরদার জাহান খান বল্লভগড় ও এর আশেপাশের অঞ্চল লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে জাহান খান হিন্দুদের পবিত্র নগর মথুরা আক্রমণ করেন। এই নগরের অধিবাসীরা প্রধানত ছিল ধর্মীয় সাধু, ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও তীর্থযাত্রী, যারা যুদ্ধ করতে অপারগ ছিল। এর পরেও জাহান খানের সৈন্যরা সেখানকার সাধু, ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের উপর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করল ও তাদের মৃতদেহের মুখের ভিতর গরুর মাংসের টুকরা প্রবেশ করিয়ে মৃতদেহকে কলুষিত করল। নগরের মন্দিরগুলি পুড়ানো হল ও মূর্তিগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হল। হাজার-হাজার হিন্দু পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে শিরশ্ছেদ করা হল। এমন কি নগরের মুসলমান অধিবাসীরাও এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায় নাই। পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীর জল প্রবাহ এর পরের সাত দিন মানুষের রক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছিল।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৪-১২৫।

----------------------------------------

মথুরার গণহত্যার পর সরদার জাহান খানের হাতে হিন্দুদের নিকট আরেকটি পবিত্র স্থান বৃন্দাবনের একই পরিণতি হয়। এরপর জাহান খানের বাহিনী আগ্রার সৈন্য-সরবরাহের প্রধান একজন মুসলমান হবার পরেও আগ্রার উপরেও উন্মত্ত গণহত্যা ও লুটতরাজ চালায়। ইতিমধ্যে আহমদ শাহ আবদালী গোকুল নামে ভিন্ন ধরণের এক হিন্দু ধর্মীয় কেন্দ্রের দিকে অভিযান পরিচালনা করেন। গোকুল ছিল হিন্দুদের ভক্তি শাখার নাঙ্গা সাধুদের কেন্দ্র যারা সামরিক শৌর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেনাবাহিনী শহরের দিকে আসলে হাজার-হাজার নগ্ন, শরীরে ছাই মাখা সাধুরা নিজেদের জীবনের মায়া না করে আক্রমণকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলসরূপ আহমদ শাহ পরাজয় স্বীকার করেন ও গোকুল গণহত্যা ও লুটতরাজ থেকে রক্ষা পায়।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৫।

----------------------------------------

আহমদ শাহের ভারত অভিযানে এত লুণ্ঠিত মালামাল হয় যে, লুণ্ঠিত জিনিসপত্র নিবার জন্য ২৮,০০০ ভার-বহনকারী পশু যোগাড় করা হয়েছিল, যার মধ্যে শতাধিক হাতি ছিল। এমন কি অশ্বারোহী বাহিনী থেকে ঘোড়াও এই সমস্ত অভিযানে লুণ্ঠিত মালামাল নিবার কাজে ব্যবহার করা হয়। তার ফিরার পথে শিখদের অশ্বারোহী বাহিনী তার সেনাবাহিনীর পার্শ্বদেশে আক্রমণ করে। আহমদ শাহ সরদার জাহান খানকে শিখদের পবিত্র নগর কার্তারপুর আক্রমণ ও লুণ্ঠনের জন্য পাঠান। আফগান বাহিনী সেখানে মন্দির ও গুরুদুয়ার সমূহ অপবিত্র করে ও সেখানকার নাগরিকদের উপর হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে। এরপর তিনি আরেকটি বাহিনীকে শিখদের পবিত্র নগর অমৃতসর আক্রমণ করতে পাঠান যার পরিণতি একই রকম হয়।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৬।

----------------------------------------

১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে মারাঠারা আহমদ শাহের কাছে পরাজিত হলে আফগানরা হাজার-হাজার যুদ্ধ-বন্দীকে শিরশ্ছেদ করে, এমন কি যারা আত্মসমর্পণ করেছিল তাদেরও। মূল যুদ্ধের পরে পানিপথের দুর্গ লুণ্ঠনের সময় আহমদ শাহের বাহিনীর সৈন্যরা চৌদ্দ বছর বয়সের উপরে প্রতিটি পুরুষকে শিরশ্ছেদ করে এবং শহরের নারী ও শিশুদের দাস হিসাবে বন্দী করে। যখন আহমদ শাহ বিজয়ীর বেশে রক্ত-ভেজা রাস্তার উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নগরে প্রবেশ করলেন তিনি কোহিনুর হীরা দ্বারা অলংকৃত পোশাক পরেছিলেন।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৭-১২৮।

----------------------------------------

কান্দাহারে বিদ্রোহের খবর পাওয়াতে আহমদ শাহ সেনাবাহিনীকে নিয়ে পেশোয়ারে ফিরে যান এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য সেখান থেকে সেনাবাহিনীর একটি অংশকে বিদ্রোহ দমনের জন্য কান্দাহারে পাঠান। পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে যখন তার বাহিনী অতিক্রম করছিল শিখ অশ্বারোহী বাহিনী পুনরায় তাদের আক্রমণ করতে লাগল। ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে শিখ সেনাবাহিনী চাহার মহলে অবস্থিত আহমদ শাহের গভর্নরের একটি বাহিনীকে নির্মূল করে। কান্দাহার থেকে পাঠনো সাহায্যকারী বাহিনীকে তারা পরাজিত করে ও আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করে। এরপর শিখরা পাঞ্জাব অধিকার করে। মারাঠাদের পরাজিত করার কয়েক মাসের মধ্যেই এভাবে আহমদ শাহ আবদালী নূতন ও ভয়ংকর একটি শক্তি শিখদের কাছে পাঞ্জাবের অধিকাংশ হারান।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৮।

----------------------------------------

কান্দাহারের বিদ্রোহ দমনের পর আহমদ শাহ পাঞ্জাবে ফিরে আসেন। মালেরকোটলার গভর্নর আহমদ শাহকে জানান যে, শিখ সেনাবাহিনীর পরিবার ও সৈন্যদলের অসামরিক লোকজন নিকটে শিবির স্থাপন করেছে। আহমদ শাহের সৈন্যবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে ও আহমদ শাহ তাদের নির্দেশ দেন যেন সেখানে ভারতীয় পোষাক পরিধানকারী একজনও বাঁচতে না পারে। শিখ রক্ষীদের একটি ছোট দল অসামরিক অপ্রতিরোধী মানুষদের শিবিরকে ঘিরে রাখে ও লড়াই করে শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করে। দশ ঘন্টা পর আহমদ শাহ গণহত্যা বন্ধের আদেশ দেন। শিখ ঐতিহাসিকরা বলেন যে, এই গণহত্যায় প্রধানত নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও সৈন্যদলের অসামরিক লোকজন মিলিয়ে ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডকে শিখরা ওয়াড্ডা গলুঘরা (Wadda Ghalughara) বা বৃহৎ গণহত্যা নামে আজও স্মরণ করে।*

----------------------------------------

* দেখুনঃ পৃঃ ১২৮।

----------------------------------------

এরপর আহমদ শাহ শিখদের নববর্ষের অল্প কিছু পূর্বে অমৃতসরে আরেকটি গণহত্যা ঘটান। সেই সময় শিখদের স্বর্ণ মন্দির অপবিত্র করা হয় ও গরুর মৃতদেহ শিখদের পবিত্র হ্রদে নিক্ষেপ করা হয়। এরপর মন্দির ও গুরুদুয়ারের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে সেটি পূর্ণ করা হল। এই সমস্ত গণহত্যার পরেও শিখ সেনাবাহিনী পুনরুজ্জীবিত হয় এবং কিছু মাস পর আহমদ শাহ তার সেনাবাহিনী পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কাশ্মীরে সরিয়ে নিয়ে যান। এই সময় শিখরা সিরহিন্দ এবং জলন্ধর দুয়াবা এবং লাহোরের দূরবর্তী অঞ্চলসমূহে আক্রমণ পরিচালনা করে। ১৭৬২-র অক্টোবর মাসে আহমদ শাহ দেওয়ালী উৎসবের আগের দিন আবার অমৃতসর আক্রমণ করেন। কিন্তু এই সময় শিখরা যুদ্ধে জিতে যায়। এই সময়ে কান্দাহারে আবার বিদ্রোহের খবর পেলে তিনি তার বাহিনীকে সেখানে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। পাঞ্জাব পুনরায় শিখদের অধীনস্থ হয়। পরের বৎসর সরদার জাহান খান তার ছেড়ে যাওয়া এলাকা পুনর্দখল করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে গুরজানওয়ালায় জাহান খান ব্যাপক পরাজয় বরণ করেন। এরপর শিখরা মালেরকোটলা ও মরিনডায় লুণ্ঠন চালায়। পরের বৎসর জানুয়ারী মাসে সিরহিন্দের গভর্নর যইন খান, যাকে শিখরা ওয়াড্ডা গলুঘরা গণহত্যার জন্য দায়ী করেছিল, তাকে পরাজিত করে ও হত্যা করে। এরপর শিখরা সিরহিন্দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও এর লোকজনকে হত্যা করে ও বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয়। লাহোরকে একই ভাগ্য থেকে রক্ষা করার জন্য এর গভর্নর কর দিতে রাজী হন ও শিখ অধীনতা স্বীকার করেন। এরপর অজেয় বলে পরিচিত রোহতাস দুর্গ অবরোধ করলে তার পতন ঘটে। এরপর আরো ভয়ানক আঘাত আসে মুলতানের পতনের মধ্য দিয়ে। এমন কি শিখরা ডেরা ইসমাইল খান ও ডেরা গাজী খানের মত দূরাঞ্চলের শত্রু ঘাটিগুলি অধিকার করে।*

----------------------------------------

* প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৮-১২৯।

----------------------------------------

এই বিপর্যয়ের খবর শুনার পর আহমদ শাহ আবদালী রাগে জ্বলে উঠলেন ও কালাতের নাসির খানকে চিঠি লিখে তাকে এই অবিশ্বাসী গোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে ও তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করে দাসত্বের অধীনে নিতে এক জিহাদে যোগ দিতে বললেন। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে আহমদ শাহ পাঞ্জাবে ফিরে আসলেন। কিন্তু জিহাদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। লাহোরের বাইরে ওৎ পেতে থাকা শিখদের আক্রমণে তাদের অগ্রবর্তী সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও নাসির খান অল্পের জন্য রক্ষা পান। এরপর শিখরা জঙ্গলে পশ্চাদপসরণ করে। আহমদ শাহের সেনাবাহিনী তখন অমৃতসরে তৃতীয়বার লুণ্ঠন অভিযান চালায় ও সেখানকার মন্দিরকে অপবিত্র করে। এরপর শিখরা আফগান সেনাবাহিনীর পার্শ্বদেশে আক্রমণাভিযান চালিয়ে যায়্। আহমদ শাহ সিরহিন্দের দিকে বাহিনী চালনা করেন ও পথে যা কিছু ছিল তার বাহিনী সমস্ত লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে তার বাহিনী আরো অভিযান করতে অস্বীকার করে। তাদের বেতন বাকী পড়েছিল। এছাড়াও আহমদ শাহের বিরতিহীন অভিযান তার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টির সৃষ্টি করে। বিদ্রোহের ভয়ে আহমদ শাহ লাহোরে যাবার প্রস্তুতি নেন। লাহোরে পৌঁছে তার বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি তাদের বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে সিন্ধু নদীর দিকে যাত্রা করতে নির্দেশ দেন। ভুল জায়গায় চেনব নদী অতিক্রম করার সময় তার বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য জলে ডুবে বা নদীতে ভেসে গিয়ে মারা যায়। তার অবশিষ্ট বাহিনী সিন্ধু নদী অতিক্রম করলে শিখদের বাহিনী পুনরায় পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চল অধিকার করে। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিলে শিখ বাহিনী লাহোর অধিকার করে। ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বরে আহমদ শাহ উত্তর ভারতে শেষ অভিযান পরিচালনা করেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি লাহোর অধিকার করেন ও অমৃতসর অবরোধ করেন। আফগানদের পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে টেনে নিয়ে এসে শিখরা তাদের সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেয়। এরপর শিখদের স্তম্ভাকারে সজ্জিত সৈন্যদল আহমদ শাহের বাহিনীর পশ্চাদপসারণের পথ কেটে দিয়ে তাদের বাধ্য করে মুখোমুখি লড়াই করবার জন্য। সফলভাবে আফগান বাহিনীকে দুই ভাগে বিভক্ত করে শিখ সৈন্যরা সরদার জাহান খানকে আক্রমণ করে পরাজিত করে। তার বাহিনীর এই সমস্ত বিপর্যয় সত্বেও আহমদ শাহ দিল্লীর দিকে অগ্রসর হবার জন্য গোঁ ধরেন। কিন্তু তার পরাজয়ের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে একের পর এক প্রদেশ খাজনা দিতে, কর অথবা সৈন্য সরবরাহ করতে অস্বীকার করে। আরেকটি বিদ্রোহের আশংকায় দিল্লী যাবার সংকল্প ত্যাগ করে তিনি মুলতানে ফিরে যান।*

----------------------------------------

* প্রগুক্ত, পৃঃ ১২৯-১৩০।

---------------------------------------- 

আহমদ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র তিমুর শাহ ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু তিনি গোত্রীয় প্রধানদের কাছ থেকে নামমাত্র স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তার রাজত্বকালের বেশীরভাগ সময়েই তাকে তাদের বিদ্রোহ দমন করতে ব্যয় করতে হয়। এই বিরুদ্ধতার কারণে তাকে ১৭৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কান্দাহার থেকে রাজধানী স্থানান্তর করে কাবুলে নিতে হয়।      

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশক জুড়ে আফগানিস্তানের শাসক আবদ আল-রহমান (শাসনকাল ১৮৮০-১৯০১ খ্রীষ্টাব্দ) ইসলাম ধর্মকে আফগানিস্তানের মানুষের উপর নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। তিনি গোত্রীয় সমাজের উপর কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইসলামকে ব্যবহার করেন। এজন্য তিনি রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ব্যবহার করে ভিন্ন মতাবলম্বী সুফী ও ধর্ম-গুরুদের (ওলামা) উপর নিষ্ঠুরতা চালান।* ১৮৯০-এর দশক জুড়ে আবদ আল-রহমানের মধ্য ও উত্তর আফগানিস্তানের পার্বত্যময় উচ্চভূমিতে বসবাসরত হাজারা ও কাফির জনগোষ্ঠীর উপর পরিচালিত আক্রমণাভিযানের কথা বলা যায়। এই আক্রমণ অভিযানকে সুন্নি ইসলামের ফতওয়ার সাহায্যে জিহাদ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছিল। হাজারারা শিয়া ইসলাম ও কাফিররা তাদের নিজস্ব ধর্ম পালন করত। এই আক্রমণাভিযানে হাজারাদের নারী, পুরুষ ও শিশুদের তারা দাস করে এবং তাদের দাস ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রী করে দেয়। এই দাস-দাসী বিক্রীর উপর কর আরোপ করে কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল অর্থ আয় করে। এক দশক পরে বহু সহস্র হাজারা ব্রিটিশ শাসিত বালুচিস্তানের কোয়েটার আশেপাশে এবং ইরানের মাসহাদে নিরাপদে নির্বাসিত হয়। ১৯০৪ সালে আবদ আল-রহমানের উত্তরসূরী হাবিবুল্লাহ খান তাদেরকে নিজ ভূমিতে ফিরে আসার জন্য একটি দশ মাসের সময় সীমা বেঁধে দেন, এবং বলে দেন যে এর অন্যথা হলে তাদের ভূমি বাজয়াপ্ত হবে। এই পরিস্থিতিতে, যখন হাজারারা নির্বাসন থেকে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে আসে তখন দেখতে পায় যে, পশতুন সরকার তাদের অনেক জমিই পছন্দনীয় সুন্নি পশতুন গোত্রসমূহকে দান করে ফেলেছে।**

----------------------------------------

* এই বিষয়ে লেখক অ্যাস্টা ওলেসেনের বক্তব্যের উপর নাইল গ্রীনের আলোচনার জন্য দেখুনঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban, p. 15.

** প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫।

----------------------------------------

১৯শ শতাব্দী জুড়ে রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতীয় সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য ব্রিটেন আফগানিস্তানকে যুক্ত করার চেষ্টা করে। এর ফলে একাধিক ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮৩৮-৪২, ১৮৭৮-৮০ ও ১৯১৯-২১ সময়ে। তৃতীয় ব্রিটিশ-আফগান যুদ্ধে (১৯১৯-২১) ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হলে আফগানিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আফগানিস্তান বাকী পৃথিবী থেকে পিছনে পড়ে ছিল বলে আমীর আমানুল্লাহ খান সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেন। আমানুল্লাহ আফগানিস্তানকে আমীরাতের পরিবর্তে রাজতন্ত্রের অধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে নানা আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন ও লয়া জিরগা (Loya Jirga) নামে পরিচিত জাতীয় কা্উন্সিলের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন। তার নীতির বিরোধীরা ১৯২৮ ও ১৯২৯ খ্রীষ্টাব্দে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটায় ও তাকে দেশ ত্যাগ করতে হয়।

১৯৩৩ খ্রীষ্টাব্দে জহির শাহ রাজা হন। তিনি পরবর্তী ৪০ বৎসর শাসন করেন। ১৯৫৩ খ্রীষ্টাব্দে সোভিয়েত পন্থী জেনারেল মোহাম্মদ দাউদ খান প্রধানমন্ত্রী হন ও কমিউনিস্ট দেশগুলি থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা চান। তিনি বেশ কিছু সামাজিক সংস্কার শুরু করেন, যার মধ্যে ছিল নারীদের আরো বেশী সামাজিক উপস্থিতির অনুমোদন। ১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে দাউদের সংস্কারের ফলে নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ও কর্মী হিসাবে কর্মস্থলে প্রবেশের অনুমতি পায়। আফগান কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৫ খ্রীষ্টাব্দের দিকে গোপনীয়ভাবে গঠন করা হয়। এই গোষ্ঠীর প্রধান নেতারা ছিলেন বাবরাক কারমাল ও নূর মোহাম্মদ তারাকি। ১৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দে দাউদ খান একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেষ রাজা মোহাম্মদ জহির শাহকে উৎখাত করেন ও আফগানিস্তানের রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন। দাউদ খান একটি নূতন সংবিধান প্রস্তাব করেন যেখানে নারীদের অধিকার প্রদান ও আফগানিস্তানকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার বিষয় ছিল। ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দে কমিউনিস্ট পন্থী একটি সামরিক অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হন। নূর মোহাম্মদ তারাকি যিনি আফগান কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতা নেন। তারা ইসলামী নীতি, আফগান জাতিীয়তাবাদ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায় বিচারের ভিত্তির উপর নীতি নির্ধারণ করেন।  এতেও ইসলামপন্থীরা সন্তুষ্ট হয় নাই। রক্ষণশীল ইসলামী ও জাতিগত নেতারা সামাজিক পরিবর্তন প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে এবং দেশব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। ১৯৭৮ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে সোভিয়েত দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সরকারের বিরুদ্ধে মুজাহেদীন বাহিনীর গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত বাহিনী কমিউনিস্ট শাসকদের সহায়তার জন্য আফগানিস্তানে প্রবেশ করে। ১৯৮০ খ্রীষ্টাব্দের শুরুর দিকে মুজাহেদীন বিদ্রোহীরা ঐক্যবদ্ধ হয় ও আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে,  সোভিয়েত সেনাবাহিনী শহরগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখলেও গ্রামগুলির উপর আফগান মুজাহেদীনদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। মুজাহেদীনরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের অস্ত্র পাকিস্তানের মাধ্যমে পেতে থাকে। 

১৯৯৫ খ্রীষ্টাব্দের দিকে তালিবান (ছাত্রবৃন্দ) নামে পরিচিত ইসলামী মিলিশিয়াদের উত্থান ঘটে। খরা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি পেতে আফগানরা তাদের সমর্থন করে। তারা ছিল ইসলামী আইনের কঠোর প্রয়োগের পক্ষপাতী। তারা এজন্য নারীদের শিক্ষা ও চাকুরীর ক্ষেত্র সীমিত করে ফেলে। বাইরে চলাচলের জন্য নারীদের সম্পূর্ণ বোরখা আবৃত করার জন্য কঠোরতা ও একা কোনো নারীর বাইরে বের হবার প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

২০০১-এর দিকে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তালিবান বামিয়ানের বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলি ধ্বংস করতে থাকে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের প্রেক্ষিতে আমেরিকা আফগানিস্তানে প্রবেশ করে ও সেখানে তাদের পছন্দের সরকার বসায়। গত ২০২২ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাসে তালিবান আমেরিকার প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে।

তালিবান ক্ষমতা দখল করার পর আবার নারীদের উচ্চ শিক্ষা নিষিদ্ধ, বাইরে একাকী চলাচল সীমিতকরণ, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করছে। এই সবের প্রতিবাদে সেখানকার নারীরা রাস্তায় নেমেছিল। এখনো পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নাই। যদিও কিছু রাষ্ট্র তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছে ।

আধুনিক আফগানিস্তানের মানচিত্র [সৌজন্যেঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam| From Conversion to the Taliban, 2017]

 

৪। আফগানিস্তানে নারীর উপর আরোপিত অবরোধের ঐতিহাসিক-সামাজিকি ভিত্তি

উপরের আলোচনায় আমরা দেখতে পেয়েছি যে, আফগানিস্তানে বিশেষভাবে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব খ্রীষ্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত গভীরভাবে ছিল। এমন কি খ্রীষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর দিকে হুনদের অব্যাহত আক্রমণাভিযান ও ধ্বংসের পরেও সেখানকার শহরগুলিতে প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর লেখায়। সেখানে প্রধানত বৌদ্ধ, হিন্দু, জরথুস্ত্রসহ অন্যান্য ধর্মের প্রভাব ছিল মুসলিমদের আগমনের পরেও আরো প্রায় দুই শত বৎসর। আফগানিস্তানের প্রধানত সকল নগর মুসলিম শাসনের অধীনে আসে প্রায় ৯০০ খ্রীষ্টাব্দের দিকে।* এই সময়কে যদি আফগানিস্তানে মুসলিম শাসক ও তাদের সৈনিকদের দ্বারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অপর জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে ব্যাপকায়তনে লব্ধ দাস-দাসী রাখবার ও বেচা-কেনা করবার সূচনা ধরা যায় তাহলে এই চর্চা আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত কম বেশী চলেছিল এমনটা ধরে নেওয়া যায়।

----------------------------------------

* দেখুনঃ Nile Green (ed.), Afghanistan’s Islam: From Conversion to the Taliban, p. 3.

----------------------------------------

মুসলিম যুগে ভারত ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে যুদ্ধ-জয়ের ফলে কত সংখ্যক দাস-দাসী আফগানিস্তানে নেওয়া হয়েছিল তার কোনো পরিসংখ্যান নাই। তবে ভারতে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম হানাদার ও শাসকদের হাতে কত লোক মারা যায় তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক দলিল ও পরিবেশ-পরিস্থিতিগত প্রমাণের উপর ভিত্তি করে অধ্যাপক কে.এস. লাল দেখান যে, ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মুসলিম হানাদার ও শাসকদের হাতে ৬ থেকে ৮ কোটি লোক মারা যায়।* কম করে ধরলেও একই সময়ে সমসংখ্যক মানুষকে দাস-দাসী হিসাবে আরব, পারস্য, মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। এই সংখ্যার সাথে যুক্ত হবে অষ্টাদশ শতকে পারস্য থেকে আসা নাদির শাহ ও আফগানিস্তান থেকে আসা আহমদ শাহ আবদালীর ভারত আক্রমণাভিযান থেকে বন্দী করে নেওয়া নারী ও পুরুষ। ধারণা করা যায় যে, বন্দী মানুষদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক পথের কষ্টে, খাদ্যাভাবে, প্রচণ্ড ঠান্ডা, তুষারপাত, ইত্যাদি কারণে পথে মারা যায়।** আরব, পারস্য ও মধ্য এশিয়ার চেয়ে আফগানিস্তান থেকেই বেশীর ভাগ সময় ভারতবর্ষে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। এ ছাড়াও পথের নৈকট্য ও ভারতের প্রবেশ দ্বার হওয়ায় আফগানিস্তানেই বেশীরভাগ বন্দী ভারতীয় মানুষকে নেওয়া হয়ে থাকবে। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিলে, শুধু আফগা্নিস্তানেই মুসলিম হানাদারদের আক্রমণে এই সময় জুড়ে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ কোটি মানুষকে দাস-দাসী হিসাবে বন্দী করে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে হলেও আফগানিস্তানের জনসংখ্যার উপর এর প্রভাব কল্পনা করা যায়। এর সাথে ছিল ভারত থেকে লুট করে আনা বিপুল পরিমাণ সম্পদ।     

----------------------------------------

* দেখুনঃ এম,এ, খান (অনুবাদ), জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০, পৃঃ ২৭০।

** শুধু হিন্দুকুশ পর্বত এলাকায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও তুষারপাতে ভারত থেকে দাস হিসাবে আনা বহু সংখ্যক বালক ও বালিকাদের মৃত্যুর কথা ইবনে বতুতা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “Another reason for our halt was fear of snow. For upon this road there is a mountain called Hindūkūsh, which means ‘the slayer of the Indians’, because the slave-boys and girls who are brought from the land of India die there in large numbers as a result of the extreme cold and the great quantity of snow. [The passage of] it extends for a whole day’s march.” দেখুনঃ H.A.R. Gibb (ed.), The Travels of Ibn Battuta, A.D. 1325-1354, Volume III, Published by the Syndics of the Cambridge University Press, London, 1971, p. 586.

----------------------------------------

বিশেষত ভারতে যারা লুণ্ঠন করতে আসত তাদের আকর্ষণ শুধু ধন-সম্পদে সীমাবদ্ধ থাকত না। বরং তাদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হত ভারতীয় নারীরা। পুরুষ দাসদের তুলনায় মধ্য এশিয়া কিংবা তৎসংলগ্ন অঞ্চলের যাযাবরদের নিকট নারী বন্দীদের আকর্ষণ অনেক বেশী হত। কারণ অর্থনীতি বা উৎপাদনশীলতার নিম্ন মাত্রার কারণে দাসশ্রমের চাহিদা সেখানকার বাজারে যে অনেক কম হত সেটা সহজে বোধগম্য।* বরং নারীরা পুরুষ প্রভুদের সম্ভোগ ও গৃহশ্রমের চাহিদা পূরণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখত। স্বাভাবিকভাবে নারীর চাহিদা ও ফলত বাজার মূল্যও বেশী ছিল।

----------------------------------------

* যুদ্ধ নির্ভর সমাজ ছিল বলে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল ও চীনা সীমান্ত থেকে আনা শক্ত-সমর্থ তুর্কী পুরুষ দাসদের চাহিদা ও মূল্য ভারতীয় পুরুষ দাসদের তুলনায় যে বেশী ছিল তা বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানা যায়।

----------------------------------------

শক-হুন ইত্যাদি প্রাক-মুসলিম হানাদারদের আক্রমণ ও লুণ্ঠন অভিযানের ধারায় পরবর্তী মুসলিম অভিযানগুলিকে ফেলা গেলেও এগুলি ছিল গুণগতভাবে অনেক ভিন্ন। প্রাক-মুসলিম হানাদাররা ভারতে প্রবেশ কিংবা বসতি স্থাপনের পর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিচারে কম-বেশী ভারতীয় সমাজের অংশ হয়ে যেত। তারা সাধারণত বৌদ্ধ অথবা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করত। বিশেষত বৌদ্ধ ধর্মের মতো অহিংসা ও মানবিক সমতার চেতনা ভিত্তিক ধর্মের প্রভাব তাদেরকে যে অনেকাংশে প্রভাবিত করত তাতে সন্দেহের কারণ নাই। হিন্দু ধর্মও তাদের যাযাবর জীবন পরিত্যাগ পূর্বক স্থিতিশীল কৃষিনির্ভর জীবনে প্রবেশে সহায়ক ভূমিকা রাখত। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে এমন কথা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। বরং আরবের যাযাবর বেদুইন জীবন থেকে উঠে আসা জিহাদ তথা ধর্মযুদ্ধ ও হিংসা নির্ভর এই ধর্ম ভারতীয় কৃষি সমাজ ও সভ্যতায় অধোগতি ঘটাবার ক্ষেত্রে কম অথবা বেশী সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। ভারতের প্রবেশ দ্বার হওয়ায় আফগানিস্তানের পার্বত্য ও রুক্ষ ভূমিতে ইসলামের ভূমিকা হয়েছে আরও বেশী রকম সভ্যতা-ধ্বংসী।

বিশেষ করে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে নব উদ্যমে মুসলিম আক্রমণ অভিযান শুরুর পর থেকে ভারতের প্রবেশ-দ্বার আফগানিস্তান হয়েছে মধ্য এশিয়ার যাবতীয় হানাদারদের এক ধরনের ‘হল্টিং স্টেশন’। ভারত থেকে লুঠ করে ফিরবার পথে এখানেই তাদের অনেকে তাদের লুণ্ঠিত মালামাল ও দাস-দাসী বিশেষত দাসী তথা বন্দী নারীদের নিয়ে থেকে গেছে। হয়ত আফগানিস্তান হয়েছে তাদের এমন বাসস্থান যেখান থেকে তারা বা তাদের উত্তর-পুরুষরা ভারতে তাদের পরবর্তী লুণ্ঠন অভিযান করবে কিংবা এমন আর কোনও অভিযানকারী বাহিনীর সহযাত্রী হবে লুঠের মালের প্রত্যাশায়।

শেষ পর্যন্ত যেটা দাঁড়াচ্ছে সেটা হল আফগানিস্তানের জনসংখ্যার এক বৃহৎ অংশ গঠন করেছে বিশেষত ভারতের লুণ্ঠিত ও ধর্ষিত নারীদের গর্ভজাত এবং ধর্ষক পুরুষদের ঔরসজাত সন্তানরা। বিশেষ করে লুণ্ঠিত বা অপহৃত নারীদের দিয়ে একটা সমাজ গঠনের ফলাফল বুঝতে হবে। এই নারীদেরকে তাদের স্বজন-স্বদেশ থেকে জোর করে ধরে আনা হয়েছে। অনেকের রয়েছে স্বজনদের হত্যা ও প্রিয় বাসগৃহের অগ্নিদাহের স্মৃতি। তারপর আছে স্বজনদের খুনীদের হাতে ধর্ষিত হবার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।

সুতরাং এই নারীরা আফগান সমাজের জন্য সব সময় একটা হুমকিও সৃষ্টি করে রাখত। এদের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তাদের পুরুষ প্রভুদের নিশ্চিত হবার কারণ ছিল না। কাজেই আফগান পুরুষরা নারীর অবরোধে সর্বদা এত সতর্ক থেকেছে। আফগান মনস্তত্ত্বের এই দিক বুঝা উচিত বলে আমাদের মনে হয়। সুতরাং আফগানিস্তানে সর্বদা নারীর পর্দা বা অবরোধ নিয়ে এত কড়াকড়ি। এবং এটা হয়ে থেকেছে আফগান পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। যারাই আফগান নারীদের অবরোধ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে পদক্ষেপ করতে চেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মোল্লাদের নেতৃত্বে আফগান পুরুষরা তথা পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ ফুঁসে উঠছে এবং প্রয়োজন মনে করলে পুরাতন ব্যবস্থা রক্ষার জন্য অস্ত্র ধরেছে। সেটা বাদশাহ্ আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে হোক আর মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে হোক। এর জন্য তাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়েছে নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের অনুশাসন।

ইসলাম যেমন নারী লুণ্ঠন ও ধর্ষণের অনুকূলে ধর্মীয় বিধান দিয়েছে তেমন নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার অনুকূল বিধানও দিয়েছে। যুদ্ধ-বন্দী নারীকে দাসকরণ ও ধর্ষণের বিধান কুরআনে পাওয়া যায়। যেমন বলা হচ্ছে, ‘যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুত দাসীগণ ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না’ (২৩:৫-৬); ‘ইহার পর, তোমার জন্য কোন নারী বৈধ নহে এবং তোমার স্ত্রীদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নহে যদিও উহাদের সৌন্দর্য তোমাকে মুগ্ধ করে। তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নহে’ (৩৩:৫২); ‘এবং যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, তাহাদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না’ (৭০:২৯-৩০)। এই অধিকারভুক্ত দাসীরা হল যুদ্ধে লুণ্ঠিত অথবা ক্রয়কৃত। মুহাম্মদের কথা, কাজ ও সম্মতিকে হাদীস বলা হয়। এইগুলি হাদীসগুলিও ইসলামের বিধান হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের ফলে লুণ্ঠন ও দাসকরণ যে ইসলামে বৈধ তার সপক্ষে একটি হাদিস এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

‘আবু তাওবা … সহল ইবন হানযালিয়্যা (রা) বর্ণনা করেছেন য, তাঁরা হুনায়নের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে সফরে ছিলেন। তখন দ্রুতগতিতে উট চালিয়ে সন্ধ্যাকালে মাগরিবের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এমন সময় একজন অশ্বারোহী সৈনিক এসে তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাদের নিকট হতে আলাদা হয়ে ঐ সকল পাহাড়ের উপর আরোহণ করে দেখতে পেলাম যে, হাওয়াযিন গোত্রের স্ত্রী-পুরুষ সকলেই তাদের উট, বকরী সবকিছু নিয়ে হুনায়নে একত্রিত হয়েছে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ঐ সকল বস্তু আল্লাহ্ চাহেত আগামীকাল মুসলিমদের গণীমতের সামগ্রীতে পরিণত হবে।’ (আবু দাউদ শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং- ২৪৯৩)

গণীমতের মাল অর্থ যুদ্ধে লুণ্ঠিত শত্রুপক্ষের নারী, পুরুষ, শিশু ও অন্যান্য সকল সামগ্রী। যুদ্ধে অর্জিত নারী, পুরুষ ও শিশুদের দাস-দাসী হিসাবে যুদ্ধের পর সৈনিকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হত। ভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা চালানো ও নারীদের বন্দী করা ও ধর্ষণ করা ইসলামে বৈধ। এমন দুইটি হাদীস নীচে দেওয়া হলঃ

‘মুহাম্মদ ইবন আর’আরা (র) ……… আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, কতিপয় লোক (বনী কুরায়যার ইয়াহূদীগণ) সা’দ ইবন মু’আয (রা)-কে সালিশ মেনে (দুর্গ থেকে) নেমে আসে (তিনি আহত ছিলেন) তাঁকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠানো হল। তিনি গাধায় সাওয়ার হয়ে আসলেন। যখন (যুদ্ধকালীন অস্থায়ী) মসজিদের নিকটে আসলেন, তখন নবী করীম (সা) বললেন, তোমাদের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি অথবা (বললেন) তোমাদের সরদার আসছেন তাঁর দিকে দাঁড়াও। তারপর তিনি বললেন, হে সা’দ! তারা (বনী কুরায়যার ইয়াহূদীগণ) তোমাকে সালিশ মেনে (দুর্গ থেকে) বেরিয়ে এসেছে। সা’দ (রা) বললেন, আমি তাদের সম্পর্কে এ ফায়সালা দিচ্ছি যে, তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হোক এবং শিশু ও মহিলাদেরকে বন্দী করে রাখা হোক। (তাঁর ফয়সালা শুনে) নবী করীম (সা) বললেন, তুমি আল্লাহ্ তা’আলার ফায়সালা অনুযায়ী ফায়সালা দিয়েছ অথবা (বলেছিলেন) তুমি বাদশাহ (আল্লাহর) ফায়সালা অনুযায়ী ফায়সালা করেছ।’ (বুখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং – ৩৫২৯)

‘ইসহাক (র) ………. আবূ সাঈদ  খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বনী মুসতালিক যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, মুসলিম মুজাহিদগণ যুদ্ধে কতিপয় বন্দিনী লাভ করলেন। এরপর তাঁরা এদেরকে ভোগ করতে চাইলেন। আবার তারা যেন গর্ভবতী হয়ে না পড়ে সে ইচ্ছাও পোষণ করছিলেন। তাই তারা নবী (সা)-কে আযল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। নবী (সা) বললেনঃ এতে তোমাদের কোন লাভ নেই। কারণ আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামত পর্যন্ত যত জীবন সৃষ্টি করবেন, তা সবই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। মুজাহিদ (র) কাযআ (র)-এর মধ্যস্থতায় আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা) বলেছেনঃ যত জীবন সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত করা হয়েছে, আল্লাহ্ তা’আলা অবশ্যই তা সৃষ্টি করবেন।’ (বুখারী শরীফ, দশম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং – ৬৭৯২)

বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হল জিহাদ। জিহাদে আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ সবই ইসলামের ধর্মীয় বিধানে বৈধ। অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম শত্রুকেও বিধর্মী ঘোষণা করে জিহাদ করা যায়। এই রকম এক দৃষ্টান্ত হচ্ছে তৈমুর লংয়ের ভারত আক্রমণ। তখন তুঘলক বংশের শেষ শাসক নাসিরুদ্দীন মাহমুদ দিল্লীর সিংহাসনে ছিলেন। তিনি ছিলেন মুসলিম। অথচ আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী সমরখন্দের শাসক তৈমুর লং তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করে ১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তার রাজ্য আক্রমণ করেন। ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, তৈমুর লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে হত্যা ও দিল্লীসহ ব্যাপক অঞ্চলে ধ্বংস ও লুণ্ঠন চালান। সমরখন্দে ফিরবার সময় তিনি তার সঙ্গে করে নিয়ে যান দুই থেকে আড়াই লক্ষ বন্দী ভারতীয়কে। এই বন্দীদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম সবই ছিল। যাদের হত্যা বা ধ্বংস করা হয়েছিল তাদের মধ্যেও হিন্দু ও মুসলিম সবই ছিল, যদিও আক্রান্ত অঞ্চল হিন্দু গরিষ্ঠ হওয়ায় তারাই হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অপহরণের প্রধান শিকার হয়েছিল।

যাইহোক, ভারত লুণ্ঠনকারীদের জন্য জিহাদের বিধান দ্বারা ইসলাম হয়েছিল মধ্য এশিয়ার মরুচারী-পশুচারী ও বর্বর যাযাবরদের নিকট অত্যন্ত সুবিধাজনক একটা মতাদর্শ। একইভাবে লুণ্ঠিত ও বন্দী নারীদের পুরুষ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্যও ইসলাম হল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটা মতাদর্শ।

ধর্ম হিসাবে ইসলাম সর্বত্র গেছে মূলত জিহাদের মাধ্যমে। সুতরাং ইসলাম প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়েছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কিংবা মতাবলম্বীদের উপর ধর্মের নামে মূলত আক্রমণ, যুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ, দাসকরণ ও ধ্বংস। সুতরাং ইসলাম যেখানে গেছে বা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নারীর অবরোধ, যাকে ভদ্র ভাষায় বলা হয় পর্দা। দীর্ঘ ঐতিহাসিক ও সামাজিক গতিধারায় আফগানিস্তানে এটাই এমন চরম ও হিংস্র রূপ নিয়েছে। সুতরাং বাইরে নারীর রূপ, এমনকি অবয়ব প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়েছে। বাইরে গেলে তাকে যেতে হবে বোরখায় সর্বাঙ্গ আবৃত করে। শুধু তাই নয়, সে একাও কোথায়ও যেতে পারবে না। ইসলামের বিধান অনুযায়ী বাইরে যেতে হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে নিকটতম পুরুষ আত্মীয়, যে তাকে পাহারা দিবে। আজকের পৃথিবীতেও এমন ইসলামী বিধান রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত হয়ে আর কোথায়ও না হোক আফগানিস্তানে আছে। সামাজিক কর্মক্ষেত্র থেকেও তাদেরকে বিতাড়ন করার কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষাও তাদের জন্য নিষিদ্ধ।

আজকের আফগানিস্তান যেন অগণিত লুণ্ঠিত ও অপহৃত নারীদের জন্য মধ্যযুগের পুনরুজ্জীবিত বন্দীশালা, যাদের ধরে আনা হয়েছে প্রধানত ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আর তাই লুণ্ঠনকারীদের কব্জায় তাদের ধরে রাখবার জন্য এতকাল পর আজকের যুগেও এতসব আয়োজন। যেন তারা পালাতে না পারে, বিদ্রোহ না করে, কিংবা অবিশ্বস্ত না হয়। প্রকৃতপক্ষে, আজকের আফগানিস্তানকে বুঝতে হলে আমাদের তার অতীত ইতিহাসের এক দীর্ঘ রক্তাক্ত ও বেদনাবহ অধ্যায়কে বুঝতে হবে। আর তখন আজকের যুগেও আফগান নারীদের উপর এমন সর্বাত্মক জিহাদ পরিচালনার তাৎপর্য ধরা পড়বে। দুর্গত আফগান নারীর বেদনাকে বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে যে, যুগ যুগ ধরে অগণিত লুণ্ঠিত ও ধর্ষিত ভারতীয় নারীর অশ্রুধারাই প্রবল জলস্রোতের মতো আজ অবধি প্রবাহিত হয়ে চলেছে আফগান সমাজ-ভূমির উপর দিয়ে। সেই জলস্রোতের প্রচণ্ড আঘাতে আফগান পুরুষতন্ত্র যাতে তছনছ হয়ে না যায় তার জন্য যেন ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে তালিবান নেতৃত্বে আফগান পুরুষতন্ত্রের এমন হিংস্র পুনরুত্থান।

____________

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ