Banner
ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা প্রসঙ্গে পত্র বিনিময় : শামসুজ্জোহা মানিক বনাম অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক বনাম অভিরূপ মুখোপাধ্যায়, আপডেটঃ August 7, 2023, 12:00 AM, Hits: 845

 

(ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা প্রসঙ্গে পশ্চিম বঙ্গ থেকে অভিরূপ মুখোপাধ্যায় (E-mail- avirup2000.official@gmail.com) শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চলের (E-mail- bangarashtra@gmail.com) নিকট পত্র পাঠালে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের সাথে শামসুজ্জোহা মানিকের যে কিছুসংখ্যক পত্র বিনিময় হয় গুরুত্ব বিবেচনা ক’রে পত্রলেখকদের সম্মতিক্রমে তার কিছু বাছাইকৃত পত্র কিংবা পত্রাংশ নিম্নে কাল-ক্রমানুসারে প্রকাশ করা হল।  — বঙ্গরাষ্ট্র, ৭ আগস্ট, ২০২৩)

 

Feb 13, 2023, 9:50 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

প্রথমে আপনাকে আমার ব্যক্তিগত ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাচ্ছি আপনার অনুসন্ধান এবং জিজ্ঞাসাপূর্ণ পত্রের জন্য। আমাদের দু’জনের যৌথ পত্র তৈরী করতে কিছু সময় লাগবে। মনে হল তার আগে আপনার পত্রের প্রেক্ষিতে আমার কিছু ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ করে আপনাকে একটা পত্র লিখি। আসলে ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুসন্ধানে লেখনীর মাধ্যমে আমার যাত্রা ১৯৯০ সাল থেকে যখন আমি ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ লিখি। এই রচনার পরেই আমার যাত্রার সঙ্গে শামসুল আলম চঞ্চল যোগ দেয়। ১৯৯৪ সালে তার ইংরাজীতে লিখা থিসিস-পেপার The Indus Civilization and the Aryans নিয়ে পৃথিবীর পণ্ডিত মহলে তার যোগাযোগ শুরু। আর এভাবে ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুসন্ধানে চঞ্চল এবং আমার যৌথ যাত্রার শুরু।

ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’-এর কথা থাক। ওটা তো একটা নূতন ধারণা নিয়ে নবযাত্রার সূচনা। তারপর ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আমাদের যৌথভাবে রচিত ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization এবং পরবর্তী সময়ে আমাদের যৌথভাবে রচিত এবং ২০০৩ সালে প্রকাশিত বাংলা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ নিয়ে আমাদের সবচেয়ে কম প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ থেকে এবং সবচেয়ে বেশী প্রত্যাশা ছিল পশ্চিম বঙ্গ থেকে। কিন্তু বাস্তবটা হয়েছে ভিন্ন। ১৯৯০ সালে লিখা ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ দূরে থাক পরবর্তী কোনও রচনার মূল্যায়নই পশ্চিম বঙ্গে পাই নাই। ১৯৯১ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত সময়ে তিনবার আমি নিজে পশ্চিম বঙ্গের পণ্ডিত মহলে ঘোরাঘুরি করে এতই তিক্ত হয়েছিলাম যে পশ্চিম বঙ্গ থেকে তেমন কোনও প্রত্যাশাই আর করি নাই। ফলে সেখানে দীর্ঘকাল ধরে আর যোগাযোগ রাখি নাই বলাই সঙ্গত। আমার লিখা ‘কেস-স্টাডি ঋদ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’ (লিংক: http://www.bangarashtra.net/article/1387.html) রচনায় আমার অনেক তিক্ত উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই সত্য যে, বাংলাদেশেই বরং আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় অনেক বেশী সাড়া পেয়েছি, যদিও প্রয়োজন অনুপাতে তেমন কিছু না। এবং যাত্রার শুরুর দিকে এক অর্থে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের তৎকালীন মহাসচিব ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের প্রবল উৎসাহপূর্ণ সমর্থন। সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ে বর্তমান পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিদের এই সমর্থনের মূল্য আমাদের কাছে অপরিমেয় হয়ে দেখা দিয়েছে।

পশ্চিম বঙ্গ থেকে যখন আপনার পত্র পেলাম তখন সেটা বিশেষত আমার জন্য নিয়ে এসেছিল বিস্ময়ের একটা অনুভূতি। সেখান থেকে আপনি প্রথম এবং একমাত্র মানুষ হিসাবে দেখা দিয়েছেন যিনি আমাদেরও আগ্রহের বিষয়গুলি নিয়ে এত গুরুত্ব দিয়ে ভাবছেন। সুতরাং আমরা যথেষ্ট আনন্দ পাই আপনার পত্রের উত্তর দিতে। অধ্যয়ন এবং মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে চিন্তার জগৎ সমৃদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বিতর্কেরও প্রভূত প্রয়োজন হয়। বিতর্কের মধ্য দিয়ে মতৈক্যে পৌঁছানোটাই যথাযথ পদ্ধতি।

আসলে অনেক কথা আমরা বলতে চাই। কিন্তু বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রধান দেশে থেকে অনেক সংযত এবং সতর্ক ভাবে লিখতে বা বলতে হয়। ‘সিন্ধৃ থেকে গঙ্গা’র ৩য় খণ্ডে উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতার গতিধারা সম্পর্কে অসঙ্কোচে কতটা বলতে পারব তা জানি না। বিশেষত বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের উত্থান ও ভূমিকা নিয়ে অনেক তিক্ত সত্য বলতে হবে। একই কথা আসবে বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের ভূমিকার প্রশ্নে। তবে হিন্দুরা সেভাবে মারমুখী নয়; বরং মতামতের প্রশ্নে এতই সর্বংসহা এবং নির্লিপ্ত যে ভিন্ন চিন্তা ও বক্তব্য কেউ বলতে যাচ্ছে সন্দেহ হলেই দুই কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কিছুই যাতে শুনতে না হয় তার বন্দোবস্ত করে রাখে। এটা হচ্ছে ভারত এবং হিন্দু সমাজের সমস্যা।

কিন্তু বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে আর এক ধরনের। মুসলিমরা হচ্ছে মারমুখী। এমনই মারমুখী যে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে কেউ আঘাত করছে মনে হলেই তার আর রক্ষা নাই! জ্ঞান চর্চা করতে গিয়ে এখানে অনেক দুর্ভোগ আমাকে ভুগতে হয়েছে এবং চঞ্চলকেও। এই সমাজে স্বাধীন ও নিঃশঙ্ক ভাবে জ্ঞান বা বুদ্ধির চর্চা হবে কী করে? এরপরেও বাংলাদেশে থেকে আমি যেটুকু লিখি তা প্রায় অকল্পনীয়।

যাইহোক, ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা’র ৩য় খণ্ডে ইতিহাসের যে সত্য তুলে ধরতে হবে তার অনেক কিছু বিশেষত বাঙ্গালী হিন্দু এবং মুসলিমের পছন্দ হবে না। তবে হিন্দুরা যেহেতু ‘সর্বংসহা’ এবং যা তাদের অপছন্দনীয় তার প্রতি ‘আমি শুনব না, আমি দেখব না; সুতরাং আমি কিছু বলব না, করবও না’ এই নীতিতে অবিচল থাকে সেহেতু তাদের নিয়ে ভাবনা নাই। তবে বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যাল্প, সুতরাং তাদের নিয়ে এখানে না ভাবলেও চলে। কিন্তু দেশটা বিপুল সংখ্যায় মুসলিম অধ্যুষিত। সুতরাং এখানে বইটার ৩য় খণ্ড লিখলেও প্রকাশ করতে পারব কিনা তা জানি না। বঙ্গরাষ্ট্রে ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’ প্রকাশ করতে পেরেছি। ওটা পড়লে বুঝবেন বাংলাদেশে থেকেও আমি কতটা সাহস করতে পেরেছি। কিন্তু ৩য় খণ্ড এখন লিখলেও সেটা এখন প্রকাশ করতে পারব কিনা তাতে সন্দেহ আছে। যাইহোক, আমাদের কাজটা এখন করে রাখতে চাই। কিছু অনুকূল পরিস্থিতি এসেছে মনে করলে প্রকাশ করব। তবে প্রকাশের তাড়না যেহেতু নাই সেহেতু কাজটা আগাবে ধীর গতিতে।

এই সময়টায় আপনার সঙ্গে পত্র বিনিময় আমাদের জন্য একটা ভিন্ন ধরনের আনন্দ বয়ে আনতে পারে। আসলে আমি খুব আনন্দ পাই পশ্চিম বঙ্গের বিশেষত হিন্দু সমাজের একজন চিন্তাশীল মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগ পাওয়ায়। পূর্ব বঙ্গে আমাদের মনোভূমি গঠনে কলকাতা এবং হিন্দু সমাজের যে বিরাট ভূমিকা রয়েছে সেটা আমি সব সময় সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করি। সেখান থেকে আমার প্রত্যাশা বেশী ছিল বলে ক্ষোভটাও বেশী।

তবে এটাও বুঝি যে, ১৯৪৭-এর বাংলা ভাগের ভয়ঙ্কর আঘাত হিন্দু সমাজকে সবদিক থেকে পঙ্গু করেছে। এ ধরনের আঘাত একটা জনগোষ্ঠীর জীবনে কত ভয়ঙ্কর ক্ষতির কারণ হতে পারে তা আজকের পশ্চিম বঙ্গকে এক সময়কার বঙ্গের সঙ্গে তুলনা করলে বুঝা যায়। তবে এর জন্য দায়ী আজকের বাঙ্গালীদের পূর্বপুরুষরা, যারা নওয়াবী আমলে মুসলিম শাসনের পতনকালে নিজেরা মহারাষ্ট্র এবং পাঞ্জাবের অমুসলিম যোদ্ধাদের পথ অনুসরণ না করে মীরজাফরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একদল বিদেশী মুসলিমের পরিবর্তে আরেক দল বিদেশী ইংরেজের নিকটা ক্ষমতা হস্তান্তরের ষড়যন্ত্রের অংশীদার হল।

আপাত দৃষ্টিতে ব্রিটিশ শাসনের অনেক সুফল হিন্দু বাঙ্গালী ভোগ করেছে। কিন্তু সেটা কয়দিন এবং কতটুকু? এবং ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল কত ভয়ানক হয়েছে হিন্দু বাঙ্গালীর জন্য! প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ বছরের বহিরাগত মুসলিম শাসনও হিন্দু বাঙ্গালীর এতটা ক্ষতি করতে পারে নাই যতটা ক্ষতি ব্রিটিশ শাসন করেছে। নওয়াবী শাসন অবসান এবং ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার সময়টায় বঙ্গের জনসংখ্যা ছিল তিন কোটি। আমার নিজের অনুমান সমগ্র বঙ্গে তখন মুসলিম জনসংখ্যা ছিল কুড়ি লক্ষ থেকে ত্রিশ লক্ষের মধ্যে। ব্রিটিশ বা ইংরেজরা ১৭৫৭ সালে ক্ষমতা দখলের প্রায় বারো বছর পরই ১৭৬৯-’৭০ খ্রীষ্টাব্দে এক মহাদুর্ভিক্ষ (বাংলা ’৭৬-এর মন্বন্তর) সৃষ্টি ক’রে তৎকালীন বঙ্গের তিন কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটিকেই হত্যা করে। এই ধ্বংসকাণ্ডে কিন্তু সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিপুলভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় হিন্দু জনগোষ্ঠী। ঐতিহাসিকদের বিবরণ অনুযায়ী বঙ্গের কুটীর শিল্পীদের অর্ধেকই এই দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবররণ করে। কুটীরশিল্পীদের প্রায় সবাই ছিল হিন্দু। ব্রিটিশ শাসকদের আরও কিছু ভূমিকা হিন্দু সমাজের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়। হিন্দুরা কিন্তু ১৮৭২ সালের লোকগণনার হিসাব অনুযায়ীও বঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মসম্প্রদায় এবং মুসলিমরা সংখ্যালঘিষ্ঠ ছিল। ১৭৫৭-তে বঙ্গে যে মুসলিমদের অনুমেয় সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ লক্ষ ছিল তারা এই ২০২৩-এর ২৬৬ বছর সময়ের মধ্যে কীভাবে দুই বঙ্গে ২০-২১ কোটি জনসংখ্যায় পরিণত হল এবং কীভাবে মুসলিম সমাজের বিকাশ হল, কীভাবে তারা প্রাধান্যে এল এগুলির অনুসন্ধান এক চমকপ্রদ কাজ হতে পারে। তার পরিবর্তে যা হচ্ছে তার প্রায় সবই কিছু সস্তা এবং মুখরোচক সাহিত্য রচনা। ইতিহাস পাঠ এইজন্য এত গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। সেখান থেকে আমরা যে জানি শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু দিকনির্দেশও পাই, আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও নির্ধারণ করতে পারি।

বাংলা ও বাঙ্গালীর বিষয়ে আমি কিছু কাজ করি নাই তা নয়। যেমন ‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’, ‘বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান’ ইত্যাদি গ্রন্থে আমার কিছু জিজ্ঞাসা এবং চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে। তবে সেগুলি যথেষ্ট যেমন নয় তেমন সেগুলি তেমন কোনও অনুসন্ধিৎসা জাগিয়েছে সে কথাও বলব না। তবু বাংলাদেশে কিছু আলোচনা লেখায় না হলেও মৌখিকভাবে হয়েছে। শুধু ভারত-ইতিহাসের সমস্যা বুঝাটা আমার জন্য যথেষ্ট নয়, বঙ্গ বা বাংলার ইতিহাসের সমস্যা বুঝাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বরং আমি মনে করি বাংলাকে গভীরে গিয়ে বুঝতে চাইলে বৃহৎ ভারতকে বুঝার চেষ্টা করতে শিখব। আর তখন দেখব কীভাবে বৃহত্তর ভারতের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে বাংলা ও বাঙ্গালী জড়িয়ে আছে। এ হল খণ্ড থেকে সমগ্রে পৌঁছাবার পদ্ধতি। চেষ্টা করব ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা’র ৩য় খণ্ডেও আমার অনুসন্ধান ও উপলব্ধিকে চঞ্চলের অভিজ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে প্রকাশ করতে।

তবে তৃতীয় খণ্ড রচনায় বিশেষত বাংলা ও বাঙ্গালী জাতি প্রসঙ্গে আমাদের অনেক বক্তব্য আসবে আমার নিজ অভিজ্ঞতার পেক্ষাপট থেকে। আমার বয়স এখন ৮১। সুতরাং মাঠ পর্যায়ে এই দীর্ঘ জীবনে বহুকিছু অনুসন্ধান করবার কিংবা দেখবার সুযোগ পেয়েছি। যেসব পুস্তকে পড়েছি সেগুলির অনেক ভ্রান্তি মাঠ পর্যায়ের সাক্ষ্য থেকে নিশ্চিত হয়েছি। এবং আমার অনেক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ সিদ্ধান্তের সমর্থনে কোনও লিখিত বক্তব্য পাই নাই। আসলে বুদ্ধিবৃত্তি বা চিন্তার জগতে বাঙ্গালী হিসাবে আমরা গর্ব করলেও আমাদের চিন্তার দৈন্য যে কতটা গভীর তা আমি আমার জীবনব্যাপী অনুসন্ধান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুভব করেছি। আমি পশ্চিম বঙ্গে কিছু অনুসন্ধান চালালেও সেটা তেমন গভীর নয়। কিন্তু পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশের সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র নিয়ে আমার বেশ কিছু অনুসন্ধানমূলক কাজ আছে। সবচেয়ে বড় কথা এ দেশের গ্রাম ও শহর জীবনের অনেক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হবার সুযোগ আমি পেয়েছি। পাকিস্তান কালে কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে গভীর গ্রামাঞ্চলে প্রায় ছয় বছর কাটিয়েছিলাম। তখন আমি কম্যুনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম। সেটা ছিল দীর্ঘ মতবিরোধ ও জিজ্ঞাসা বা সংশয়পূর্ণ একটা অধ্যায়। বাংলাদেশ হবার কয়েক মাস পর অর্থাৎ ১৯৭২-এর এপ্রিল-মের দিকে এই সম্পর্কের অবসান ঘটাই। এরপর একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে পুনরায় দুই দফায় গভীর পল্লীতে চার বছর কাল অতিবাহিত করি। এই সময় আমি নূতন করে গ্রাম, কৃষক, রাষ্ট্রের ভূমিকা, হিন্দু-মুসলিম মন-মানসিকতার সমস্যা ইত্যাদিকে ভিন্নভাবে বা নূতনভাবে দেখতে ও বুঝতে চেষ্টা করেছি। তখন আমি জাতীয় পর্যায়ের কোনও বৃহৎ সংগঠন ও আন্দোলনের কেউ নই, বরং একজন ব্যক্তি মাত্র। এই সব অভিজ্ঞতার সঙ্গে আছে আমার অধ্যয়ন। শুধু যে বাঙ্গালী জাতি আমার পর্যবেক্ষণ কিংবা অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু হয়েছিল তা নয়। আমি নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে নিজ উদ্যোগে বছর কাল গারো জনজাতির উপরও মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক কাজ তথা গবেষণা পরিচালনা করেছিলাম। ঐ একই দশকের একেবারে শেষ দিকে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে বৎসর কাল আমার পাহাড়ী বন্ধুদের আশ্রয়ে থেকে কাজ করি। এখানে বলে রাখা উচিত যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির নেতাদের অনেকে আমার ছাত্র জীবনের বন্ধু। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর আমার তাদের আতিথেয়তা লাভের সুযোগ ঘটে। তখন তাদের হাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ। এবং এখনও।

যাইহোক, নিজের কথা এই জন্য বললাম যাতে আমি যখন আমার দেশ সম্পর্কে কথা বলব সেটার পটভূমি বুঝতে আপনার সুবিধা হয়। বাংলা ও বাঙ্গালী সম্পর্কে আমাদের অনেক মূল্যায়নের ভিত্তি হবে আমার নিজ জীবনের বাস্তব ও চাক্ষুস অভিজ্ঞতা। বাংলার বাইরের জায়গা বা মানুষ কিংবা অতীত সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমার দলিলপত্রের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নাই্। কিন্তু বাংলা সম্পর্কে এ কথা সর্বদা প্রযোজ্য নয়। বরং আমার নিজ অভজ্ঞতা দিয়েই অনেক লিখিত বিষয় বা মূল্যায়নকে প্রশ্নবিদ্ধ, এমনকি প্রত্যাখ্যান করতে পারি। আসলে আমার নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি বাংলার ইতিহাসের অনেক ভুল পাঠ আমাদেরকে দেওয়া হয় এবং অনেক বিষয় সম্পর্কে আমাদের নিদারুণ রকম ভ্রান্ত ধারণা আছে। এই ভ্রান্তি শুধু আর্যতত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলার সমাজ ও ইতিহাসের বহুকিছুর মূল্যায়নেও এই ভ্রান্তি রয়েছে। বাঙ্গালীর দাসত্বপরায়ণ মানসিকতা, সংকীর্ণতা, চিন্তার ভীরুতা এগুলি এর জন্য কম দায়ী নয়।

গারো এবং চাকমা-মারমাদের উপর কিছু কাজ করতে গিয়ে আমি বুঝেছি বাঙ্গালী জাতি কতখানি কূপমণ্ডুক এবং সংকীর্ণ। আমরা নিজেদেরকে বুঝতে পারি না, অন্যদেরকেও। আমরা ‘বাড়ীর পাশে আরশি নগরে’ যে ‘পড়শি বসত করে’ তার খবর রাখি না। এ খবর কয়জন রাখে যে মোগল আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা রাজাদের রাজভাষা ছিল বাংলা। যেমন বাংলা ত্রিপুরারও রাজভাষা ছিল। অর্থাৎ এই দুই রাজ্যের রাজকীয় কাজকর্ম পরিচালিত হত বাংলা ভাষায়। সেই আদিবাংলা কাল পরিক্রমায় কলকাতায় গিয়ে আজকের বাংলা ভাষার রূপ নিয়েছে।

অথরিটি হিসাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত লেখক বা পণ্ডিতদের বক্তব্যের বাইরে বক্তব্য দিলে কী বিপদ হয় তার একটা উদাহরণ দিয়ে এখনকার মত আমার ব্যক্তিগত পত্রের বক্তব্য শেষ করতে চেষ্টা করব। এটা ১৯৮৪ সালে কলকাতার ঘটনা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায় (তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন ছিলেন) তার বাসায় আমার সম্মানে একটা পরিচিতি এবং আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে পূর্ব বঙ্গের মুসলিম সমাজের বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছিলাম, যা অন্য একজন বয়স্ক অধ্যাপকের পছন্দ হচ্ছিল না। তিনি আমাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি যেসব কথা বললেন তা কোন বইয়ে আছে?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘আমি কোনো বইয়ে এ কথা পড়ি নাই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বলছি। আমি নিজে দেখেছি।’ তখন তিনি বললেন, ‘আপনি দেখেছেন বললে তো হবে না। কোন বইতে এ কথা আছে তা তো বলতে হবে।’

এবার বুঝুন আমার অবস্থা! আমি যা বলছিলাম তা নিজেও কোথায়ও পড়ি নাই। যা দেখেছিলাম সে কথাই বলছিলাম। আমাকে উদ্ধার করলেন জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘এখানে আমরা অ্যাকাডেমিক আলোচনা করছি না। উনি ওনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। সেটা ওনাকে বলতে দিন।’ অধ্যাপক থামলেন। কিন্তু সন্তুষ্ট হলেন না। কিছুক্ষণ পর উঠে চলে গেলেন। জানি না জয়ন্তানুজ বাবু বেঁচে আছেন কিনা। বয়সের কারণে এখন পর্যন্ত তার বেঁচে থাকবার কথা নয়।

অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেট থাকলেও আমি অ্যাকাডেমিক প্রতিষ্ঠানের পণ্ডিত নই। তবে বাস্তব জীবন থেকে আমি বহুকিছু শিখেছি। বিশেষত মাঠ পর্যায়ের মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা আমাকে বিরাটভাবে শিক্ষিত এবং সমৃদ্ধ করেছে। সুতরাং ১৯৮৯-এর শেষ দিকে আমি যখন প্রণালীবদ্ধভাবে ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করি তখন তার ১ম সূক্ত পড়েই আমি নিশ্চিত হই যে, এটা যাযাবর পশুপালক দূরের কথা এমনকি গ্রাম্য কৃষক বা ঐ পর্যায়ের অশিক্ষিত এমনকি অর্ধশিক্ষিত কোনও মানুষেরও রচনা নয়। আসলে উন্নত সিন্ধু সভ্যতার সুশিক্ষিত ঋষিদের রচনা হিসাবে ঋগ্বেদকে বুঝতে আমার এতটুকু সময় লাগে নাই, সমস্যাও হয় নাই। বরং তখন আমি ঋগ্বেদ রচয়িতাদের পরিচয় বুঝার ক্ষেত্রে ‘পণ্ডিতদের’ বুদ্ধির ঘাটতি দেখে হতভম্ব বোধ করছিলাম। বস্তুত প্রথম মন্ত্র থেকে শেষ মন্ত্র পর্যন্ত আমি ঋগ্বেদকে সিন্ধু সভ্যতার পটভূমিতে স্থাপন করে পাঠ করেছিলাম। আসলে মানুষ সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করেছে। তার সাথে আমি যুক্ত করতে চেষ্টা করেছি আমার অধ্যয়নকে। একদিকে অধ্যয়ন, অপর দিকে উপর তলা থেকে একেবারে নীচ তলার সাধারণ মানুষ নিয়ে আমার কর্ম এবং সংগ্রাম মুখর জীবন — এই দুই মিলিয়ে আমি।

বক্তব্যের পিছনে যে ব্যক্তি থাকে তাকে বুঝতে পারলে তার বক্তব্যের সারবত্তা বা বক্তব্য বুঝতেও অনেক সময় সুবিধা হয়। কথার পিছনের মানুষকে চিনলে বা জানলে তার কথা অনেক বেশী জীবন্ত ও মূর্ত হতে পারে। সেই কারণে নিজের কথা বলা। বিশেষত প্রতীকীভাবে বললে বলতে ইচ্ছা করে আপনি যেন জাগ্রত পশ্চিম বঙ্গের দূত আমাদের কাছে। সুতরাং আপনি একটা ভিন্ন গুরুত্ব বহন করেন আমাদের দুইজন বিশেষত আমার কাছে। কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা দীর্ঘ পত্র দিলাম আপনাকে। তবে এর একটা কপি যাবে চঞ্চলেরও কাছে।

আশা করছি অল্প দিনের ব্যবধানে আমরা দুইজন আপনার পত্রের উত্তর দিতে সক্ষম হব। আপনার জন্য শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় নিই।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

 

Feb 16, 2023, 3:26 PM

ধন্যবাদ মানিকবাবু, আমায় ব্যক্তিগত পত্রটি লেখার জন্য।

আর্যতত্ত্বের সমস্যা নিয়ে আপনাদের গবেষণা প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পণ্ডিতমহলের নিষ্ক্রিয়তা সম্বন্ধে জেনেছি 'বঙ্গরাষ্ট্র'-এ লেখা আপনার কিছু নিবন্ধ থেকে। দিল্লিতেও চঞ্চলবাবু গিয়েছিলেন এবং সেখানকার নামকরা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকরাও উন্নাসিক আচরণ কিছুটা দেখিয়েছিলেন বলে আপনারা বলেছেন। কিছু কিছু ঘটনা আপানাদের নিবন্ধ থেকেই জানতে পেরেছি। মাত্র কুড়ি বছর আগেও কী বিপুল পরিমাণে কূপমণ্ডূকতা ছিল আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের মধ্যে। আজও এই সংকীর্ণতা নেই তা নয়, তবে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট কোনো মতবাদের ছাপ না-থাকায় মুক্তচিন্তার অবস্থা কিছুটা হলেও তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলব, লকডাউনের সময়টার আশেপাশে ইন্টারনেটে যেটুকু খোঁজাপাতি করেছি, তাতে করে বুঝেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার বিশেষরকম চর্চা হচ্ছে কিছু গ্রুপের মধ্যে, সেটা সংঘ-রাজনীতির অংশ হিসেবেই হোক বা স্বাধীন গবেষণা হিসেবেই হোক। আপনাদের বক্তব্য এদের বক্তব্য থেকে যথেষ্ট আলাদা।

পুঁথিগত বিদ্যায় কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থাকা পণ্ডিতদের কথা বলতে গিয়ে জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলোচনাসভার কথা মনে পড়ল। প্রায় দেড় দশক হল উনি আর আমাদের মধ্যে নেই বলেই জানি আমি। ভালো লাগল, উনি আপনার পরিচিত মানুষ জেনে।

আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ ও সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত গবেষণায় সাড়া না-পাওয়ার কিছু কথা যেমন আগে থেকেই জানি, তেমনই চট্টগ্রাম এলাকায় বা গারো, চাকমা প্রভৃতি পাহাড়ি জাতিগুলির অভিজ্ঞতার কথাও জানলাম। ব্যক্তিগতভাবে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা আমার নেই বললেই চলে। আবার এটুকু আমি বুঝি যে, পুঁথিগত তথ্যের মধ্যে ইচ্ছাকৃত অনেক বিকৃতি থাকে। আমরা যারা অধ্যয়ন মারফৎ গবেষণা চালাতে চাই, তারা বিপথগামীও হতে পারি ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে। সে-ক্ষেত্রে মাটির কাছাকাছি আপনার অভিজ্ঞতার ঘটনাগুলি আমার কাছে খুবই আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয় হবে। উক্ত পত্রে অল্পবিস্তর ইঙ্গিত দিয়েছেন সে-ব্যাপারে। 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ডে আপনার সেই অভিজ্ঞতা আর চঞ্চলবাবুর মতামত একসাথে পড়ে দেখব।

বাংলাদেশের মুসলমান সমাজের অসহিষ্ণু স্বভাব নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও অনেক কথা শুনি। আমি নিজে বাংলাদেশ যাইনি, তবে অদূর ভবিষ্যতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আর এই দুই বাংলাকে আলাদা করে দেখতে মোটেই ভালো লাগে না আমার। ধর্ম যখন অধ্যাত্মিক তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে রাজনৈতিক মতবাদে দাঁড়িয়ে যায়, তখন বাংলাভাগের মতো বেদনাদায়ক পরিণতির মাটিও তৈরি হয়ে যায়। এমন অবস্থায় নিরপেক্ষ গবেষণা চালানো, বিশেষ করে হিন্দু বা মুসলমান সমাজের দুর্বলতা নিয়ে যখন আলোচনা করবেন, পাল্টা আক্রোশ ধেয়ে আসার আশঙ্কা থেকেই যায়। 'ইসলাম বিতর্ক' প্রকাশ নিয়ে আপনাদের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া থেকে ২০২০ সাল অবধিও আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে আপনাদের। ফলে 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ড অবধি হার্ড কপি আকারে প্রকাশ করার সুযোগ হয়তো থাকবে না। সফট কপি প্রকাশ করেন যেমন 'বঙ্গরাষ্ট্র'-এ, সেরকম প্রকাশ করাও যেতে পারে। এখন দুই বাংলার ধর্মসম্প্রদায়ের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে অভিজ্ঞতার কথা প্রকাশ করতে গেলেও বিপত্তি হতে পারে। সে-ক্ষেত্রে যেমনটা বললেন আগের পত্রে, অনুকূল অবস্থা বুঝে রচনাটি প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে। এর মাঝের সময়টায় তৃতীয় খণ্ডটির পরিমার্জনা, সংযোজন ইত্যাদি করার অবকাশও পাবেন। অন্তত লেখার কাজটা সময়মতো সুষ্ঠুভাবে শেষ হোক, এটাই চাইব।

'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ড নিয়ে আমার আগ্রহের বিশেষ কারণও আছে। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের চিন্তাভাবনা কীভাবে গড়ে উঠেছে, সংক্ষেপে তা বলব। গত কয়েকটি বছর ধরে আমি মহাভারত থেকে বেদ-পুরাণ, মূলত ধর্মীয় দর্শন নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি। ভারতের সংস্কৃত ধর্মীয় সাহিত্য সম্পর্কে অধ্যাত্মিক মূল্যায়নই বেশি পেয়েছি আমি। এ ছাড়া ছোটো বয়সে আমি বেড়ে উঠেছি অনেকটা বামপন্থী আবহে। ফলে বস্তুনিষ্ঠ উপায়ে ভাবতে শিখেছি। একদিকে নিজের যুক্তিবাদী মন, অন্যদিকে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধর্মাশ্রিত বর্ণনা– এই দুইয়ের মাঝে টানাপোড়েনে ছিলাম আমি দীর্ঘদিন। আমি একটা ভিত্তি চাইছিলাম, যার ওপর দাঁড়িয়ে ভারতের ধর্মগ্রন্থগুলোকেও ইতিহাসের পটভূমিতে ফেলে ব্যাখ্যা করা যাবে। প্রত্নতথ্যের ওপর আমার আপনাদের মতো জ্ঞান নেই। সুতরাং আমি ভারতীয় দর্শন বিভিন্ন ধারার মধ্যে থেকে ঝাপসাভাবে প্রাচীন ইতিহাসটাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি যথেষ্ট। পত্র মারফৎ যেসব প্রশ্ন করি, সেগুলো আমার ওই উপলব্ধির ফল। কিন্তু আমার একটা বাস্তব ভিত্তির প্রয়োজন ছিল। এমনকি উপনিষদের দর্শন নিজের মতো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এটাও বুঝেছিলাম যে, উপনিষদের ব্যক্তিভিত্তিক দর্শন কোনো উন্নত নাগরিক পটভূমি থেকেই আসবে। আর উপনিষদ বা বেদের যুগের সাথে জুড়ে আছে সিন্ধুভূমির প্রাচীন নগরায়ণের ইতিহাস। পরে এ বিষয়ে আরও নতুন জিনিস ভেবেছি আমি। আর এটাও খুব ভালো বুঝতে পেরেছি যে, আদি উপনিষদগুলি এই গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষরাই লিখেছিল। অথর্ববেদের মন্ত্র থেকে কপিলের সাংখ্য ও আদি উপনিষদ সবই এই পূর্ব ভারতের তথা বঙ্গভূমির মানুষদের দ্বারা রচিত বলে আমার মত। প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে অতুল সুর এককালে বলেছিলেন যে, প্রাচীন পৃথিবীতে তাম্রবাণিজ্যের প্রচলন পূর্ব ভারতের জঙ্গলমহল থেকেই শুরু হয়েছিল। এমনকি আক্কাদীয় অ্যাসিরীয়দের (অসুর > অ্যাসিরীয়?) তাম্রপ্রিয়তার কথা প্রত্নসমীক্ষাতেই পাওয়া যায়। ঝাড়খণ্ড এলাকার অসুর জনজাতির মধ্যেও সেখানকার তামার খনিতে কাজ করার মিথ চালু আছে বলে পড়েছি। কাছেই তমলুক, তাম্রলিপ্ত বন্দরের এলাকা। সিন্ধু যুগে কোনোভাবে বাংলার বন্দর এলাকা থেকে তামার বণিক যাওয়া-আসা করত কিনা, সে বিষয়ে বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ যথেষ্ট উদাসীন। ঋগ্বেদের একটি ঋকে গঙ্গা থেকে শুরু করে শেষে সিন্ধু নামের উল্লেখ আছে। ওই ঋকের ঋষি কি বাংলা থেকে কোনোভাবে সিন্ধু এলাকায় যাওয়ার কথা বলতে চেয়েছেন? বেদ থেকে সিন্ধু সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা থেকে গাঙ্গেয় সভ্যতার বিভিন্ন রহস্যের মুখোমুখি হই আমি এভাবেই। ফলে বুঝতেই পারছেন, প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষার অধিক জ্ঞান না-থাকলেও ভারতের মূলধারার দর্শনের আলোচনা থেকেই আমি ইতিহাসটাকে নিজের মতো করে ধরতে পারছি। 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ড তাই আমার কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এতে বঙ্গভূমির ইতিহাসকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দেখানোর চেষ্টা হয়তো করবেন আপনারা। কয়েকটি জায়গায় আমারও সংশয় আছে। সেগুলো নিরসন হবে আশা করি।

এসব ভাবনার মাঝে বৈদিক গোষ্ঠী ও তাদের বেদ-সংকলনের ভূমিকাটা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি। বেদ পশুপালকদের রচনা বলে এমন গলাবাজি হয়েছে একসময়, আমার আর নতুন করে কিছু মাথায় আসেনি। তখন হঠাৎ আপনাদের 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা' বইটা পাই পিডিএফ আকারে। পরে 'বঙ্গরাষ্ট্র' সাইটও খুঁজে পাই। আপনারা বাঁধভাঙার ঘটনার সাথে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলোকে এত চমৎকারভাবে মেলাতে পেরেছেন যে, আর্য আক্রমণের অনুমাননির্ভর ধারণা তাতে খণ্ডিত হতে বাধ্য। নদী, বাঁধ আর কৃষিকাজের সাথে সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক বিদ্রোহীদের পারস্পরিক সম্পর্ক এখন আমার কাছে অনেক পরিষ্কার। এর আগেও আর্য আক্রমণ নস্যাৎ করতে দেখেছি এ দেশের সংঘ-রাজনীতির লোকদের। কিন্তু সেই আলোচনা ছিল শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো গোঁজামিল-দেওয়া ধর্মীয় আলোচনা। আপনারা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ওপর ঋগ্বেদের ঘটনাক্রমকে আধারিত করেছেন। ফলে সিন্ধু আর গাঙ্গেয় সভ্যতার মাঝের আবছা ইতিহাস পরিষ্কারভাবে ধরা দিয়েছে আমার কাছে অনেকটা।

বাংলার ইতিহাস খুব বেশি করে উঃ-পঃ আর দঃ ভারতের সাথে জুড়ে আছে বলে অনুমান করি আমি। মূলত সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে আলোচনা শুরু হলেও বাংলার আলোচনায় আসতে পারি ভবিষ্যতে। এই প্রসঙ্গে পার্বত্য জাতিগুলির সমাজের গঠন যে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটা বলেছেন গারো জাতির ওপর নিবন্ধগুলিতে। এভাবে পূর্ব ভারতের ইতিহাসচর্চায় যে বিক্ষিপ্ত প্রবণতা রয়েছে, 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ডে তা একটা সমগ্র রূপ পাবে বলে আশা রাখি।

আর অন্য পত্রটির উত্তর আপনারা ধীরেসুস্থে দিতে পারেন। আমার কোনো তাড়া নেই।

এই পত্রটি আপনাকেই লিখছি আমি ব্যক্তিগতভাবে। তবু প্রাসঙ্গিক মনে হলে চঞ্চলবাবুকে মেইলটি ফরোয়ার্ড করতে পারেন। আমি কীভাবে চিন্তা করতে শিখেছি, অল্প পরিসরে বললাম সেটা। আমাদের ভাবনার মধ্যে এই ব্যক্তিগত বোঝাপড়া থাকলে ভবিষ্যতে আলোচনা চালানো আরও সুবিধাজনক হবে হয়তো।

আপনাদের জন্য শুভ কামনা রইল। আগামী পত্রে আবার ফিরে আসব।

ইতি – অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Feb 19, 2023, 3:59 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আপনার ব্যক্তিগত উত্তর পেয়ে অনেক ভালো লাগল। আসলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু বোঝাপড়া বা জানাশুনা হলে সংলাপে অনেক সুবিধা হয়। এই কারণে ব্যক্তিগত কিছু পটভূমি জানা বা জানানো ভালো। তাতে আলোচনাটা অনেক বেশী মূর্ত ও অর্থবহ হতে পারে। ফলে আমার অতীত জীবন সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে চেয়েছি। আসলে মানুষের ব্যক্তিজীবন বা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা আমি প্রথম বুঝেছি ১৮৮৯ এবং বিশেষত ১৯৯০ সালে যখন আমি ঋগ্বেদ পাঠ করি। আমি জানতাম ভারতবর্ষে ‘আর্য’ নামধারী বহিরাক্রমণকারী পশুচারী যাযাবরদের রচনা ঋগ্বেদ। এর বাইরে আর কোনও মত আছে তা জানতাম না। হ্যাঁ, তার বাইরে আর একটা মত জানতাম। সেটা হচ্ছে ডি ডি কোসাম্বির মত। An Introducion to the Study of Indian History-তে তিনি এই মত ব্যক্ত করেছিলেন যে, বহিরাগত যাযাবর আক্রমণকারী আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার পণ্ডিতদের একটা অংশকে বন্দী করে তাদেরকে বাধ্য করে নিজেদের বৈদিক ভাষায় ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহ রচনা করতে। অর্থাৎ ঋগ্বেদ হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার বন্দী ঋষিদের রচনা! ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বের কর্তাভজা ভারতীয় পণ্ডিতের জ্ঞান-বুদ্ধির বহর দেখুন! বন্দী ঋষিদের রচনার উদ্ভট কল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করতে অবশ্য আমার ১ম মণ্ডলের আরও কিছু সংখ্যক মন্ত্র পড়তে হয়েছিল। কিন্তু আমি মন্ত্রগুলির ভিতর থেকে সুউন্নত সিন্ধু সভ্যতার ভিতর থেকে উঠে আসা স্বাধীন ও শিক্ষিত মানুষদের স্বতঃস্ফূ্র্ত ও উদাত্ত কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলাম। এবং সেটা ছিল আমার স্তম্ভিত হবার পালা। সকল বেদ-পণ্ডিত ও ব্যাখ্যাদাতার ভ্রান্তি অনুভব করে আমার হতভম্ব হবার পালা। তখনও জানতাম না আর্যতত্ত্বে আর কোনও ভিন্নমত আছে, যেমন বিবেকানন্দের মতো হিন্দু পণ্ডিতের ভিন্ন মতের কথা পরে জেনেছিলাম।

যাইহোক, ঋগ্বেদ পাঠ আমাকে দিয়েছে অপরেমেয় আত্মবিশ্বাস, আমার বোধ-বুদ্ধির উপর আস্থা। এর উৎস কিন্তু শুধু আমার অধ্যয়ন বা পড়াশুনা নয়, উপরন্তু মানুষের জীবন-ঘনিষ্ঠতা, অগণিত মানুষের সুখ-দুঃখ এবং কর্ম ও সংগ্রামের সাথী হবার অভিজ্ঞতা।

এর জন্য আমি সবচেয়ে বেশী ঋণী আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রতি যার প্রধান উৎস আবার ছিল এক সময় মার্কসবাদ বা কমিউনিস্ট মতাদর্শ। অথচ আশ্চর্য হবার মত ব্যাপার এই যে, অষ্টম শ্রেণী থেকে আমি মার্কসবাদ বা কম্যুনিজমে শর্তসাপেক্ষে কিছু আস্থাশীল হলেও আমি যখন অনার্সের ছাত্র হই তখনই সাম্যবাদ বা কম্যুনিজমকে কল্পস্বর্গ বা ইউটোপিয়া মনে করতাম। মনে করতাম এমন দ্বন্দ্বহীন মানবসমাজ একটা অবাস্তব কল্পনা। ফলে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের লক্ষ্যটাকেই ভ্রান্ত মনে করতাম। তারপরেও আমার কাছে বিকল্প আদর্শ যেমন ছিল না তেমন নিজেরও বিকল্প নির্মাণের জন্য যোগ্যতা ছিল না। বিশেষত কম্যুনিস্ট রাজনীতির নিকট আমি অপরিমেয়ভাবে ঋণী আমার যুক্তিবাদী এবং লোকবাদী বা ধর্মবিরোধী চেতনার বিকাশের জন্য। সেই দিক থেকে বললে বলা যায় মার্কসবাদ আমাকে নিয়েছে লোকায়ত দর্শনের পথে।

১৯৫৭ সালে আমি যখন ক্লাস এইটের ছাত্র তখন থেকেই আমি ধর্ম এবং বিশেষ করে ইসলাম বিরোধী। এ থেকেই আমি হই ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান-বিরোধী। তা থেকে আসে পাকিস্তানের ইসলামী রাজনীতি উৎখাতের চিন্তা থেকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ তথা বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। এ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় আমার লেখা আছে। আসলে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও তার চেতনার বিকাশে আমার একটা ভূমিকা ছিল।

কিন্তু আমার জীবনের একটা বৃহত্তর মিশন ছিল এবং আছে। সুতরাং কোনও ক্ষুদ্র গণ্ডীতে আমি আবদ্ধ হয়ে আমার লক্ষ্যচ্যুত হতে চাই নাই। সুতরাং কর্মক্ষেত্র বা এলাকা পরিবর্তন করতেও আমার দ্বিধা হয় নাই। যখনই মনে হয়েছে এটা আমার সত্য অনুসন্ধানের জন্য প্রযোজনীয় জীবন-ধারার জন্য ক্ষতিকর তখন সেটা পরিত্যাগ করে সরে গেছি। সুতরাং জাতীয় সংসদ নির্বাচন করবার কিংবা মন্ত্রী হবার অথবা নেতা হবার হাতছানি আমাকে কখনই আকৃষ্ট করতে পারে নাই।

আমি যেটা পেরেছি সেটা আর কেউ পারে নাই কেন সেটা বলতে পারি না। তবে এটা ভয়ঙ্কর এবং প্রচণ্ড লড়াইয়ের এক অনিশ্চিত জীবন। এই লড়াইয়ে খুব কম মানুষই টিকতে পারে। তবে আমার প্রজন্মের যারা আমার মত কিছু ভিন্ন মত নিয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত সংগ্রাম করেছিল এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কাজও করেছিল শেষ পর্যন্ত নানান বাধা তাদের যাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছে। তবু এ কথা বলব আমি পেয়েছিলাম এক বিস্ময়কর প্রজন্মকে। আর সেখানে আসে সকল দোষ-ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মুসলিম বাঙ্গালী সমাজের অবিশ্বাস্য উত্থান কাহিনী। প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের গতিতে এর উত্থান, হয়ত এর রূপান্তর অথবা ধ্বংসও হবে ঝড়ের গতিতে এবং সেটা হয়ত অত্যাসন্ন।

মনে রাখবেন আমাদের পিতাদের প্রজন্ম মূলত এক প্রজন্মে ইংরাজী তথা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ধর্মীয় রাজনীতির চর্চা করেছে। আর সামগ্রিক সমাজের তুলনায় ক্ষুদ্র হলেও অত্যন্ত গতিশীল এবং নির্ধারক আমরা কিছু সংখ্যক তরুণ ধর্মকে প্রত্যাখ্যান ক’রে একটা লোকায়ত দর্শন নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের পিতাদের স্বপ্নের পাকিস্তান ভাঙ্গার রাজনীতি গড়লাম এবং সেটা আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে। এবং সেটা পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকেই। আমি নিজে ১৯৫৭ সালে উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় ধর্মদ্রোহী এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তান-দ্রোহী। দশম শ্রেণীতে যখন পড়ি তখন আমি কালীদাসের ‘মেঘদূত’, ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত এবং মনোরঞ্জন রায়ের ‘দর্শনের ইতিবৃত্ত’ পাঠ করা এক কিশোর। আইএ বা ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হবার কিছুদিনের ভিতর আমি দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ পড়ে শেষ করেছি। না, এটা কিন্তু আমার একার অধ্যয়নের বর্ণনা নয়। আমার প্রজন্মের এমন আরও কিছুসংখ্যক বই পড়ুয়া মানুষ ছিল, যারা গোগ্রাসে বই-পত্র গিলত বলা যায়। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার হল আমার পূর্ববর্তী প্রজন্মের প্রায় সবাই গ্রামের চাষাভূষা বা জোতদার পটভূমির এবং যাদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠেরই শিক্ষা বা লেখাপড়া ছিল না। দর্শনগত বিচারে আমাদের প্রজন্ম এক পিতৃদ্রোহী প্রজন্ম। এটা কিন্তু ইতিহাসের এক বিস্ময়। আপনাদের সমাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতাকে ঠিক বুঝা যাবে না। আমাদের প্রজন্ম এক প্রবল এবং পরাক্রান্ত প্রজন্ম। তা না হলে সাম্যবাদী সমাজ বা কমিউনিজমে অবিশ্বাস অর্থাৎ কমিউনিস্ট বিপ্লবে অবিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আমি কৃষকদের নিয়ে বিপ্লব করতে সেই ১৯৬৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ অসমাপ্ত রেখে গ্রামে চলে যেতে পারি! এই পাঠ আমি পরবর্তী সময়ে সমাপ্ত করি। এটা ঠিক যে, কৃষক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা হিসাবে চীন এবং ভিয়েৎনামের অভিজ্ঞতা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু কোনও কিছুতে আমি অন্ধ হই নাই। ভক্তি থাকলেও অন্ধ ভক্তি আমার কোনও কিছুতে ছিল না, আর নাইও।

এই রকম সমাজ এবং তার ভিতরকার এক বিস্ময়কর প্রজন্মের ভিতর থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি। তাই শুধু বই পড়ার পরিমাণ বা সংখ্যা দিয়ে আমাকে বুঝা যাবে না। ঐ প্রজন্মের উত্থান প্রক্রিয়া দিয়েও আমাকে বুঝতে হবে।

তবে ব্যক্তি হিসাবে আমি এখন পর্যন্ত টিকে থাকলেও প্রজন্মটা ধ্বংস হয়েছে। সেটা বহু কারণেই এবং বহুভাবেই। তবু আমাদের এখানকার অবস্থা পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় একদিক থেকে অনেক ভালো বলে মনে হয। তা না হলে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে আমি শামসুল আলম চঞ্চলকে পেলাম কী করে? আমার অস্থির ও অনিশ্চিত জীবনে পাঠের অনেক ঘাটতি আছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা সেভাবে না থাকলেও তার আছে বিপুল অধ্যয়ন। সেটা আমার চেয়েও অনেক বেশী। এবং তার জীবন সিস্টেমেটিক হওয়ায় সেই অধ্যয়ন বা পাঠকে সে সংরক্ষণ করেছে বই-পত্রের মাধ্যমে অথবা নোট ক’রে। আমার বই-পত্রের প্রায় সব সঞ্চয়, যদি কিছু করেছিলাম, সবই গেছে উইয়ের পেটে, বন্যার জলে। অবশেষ যেটুকু ছিল সেটুকুও নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ, সম্ভবত মণ দরে বিক্রী করতে চেয়ে। কিংবা হয়ত আওয়ামী লীগ সরকারেরই নির্দেশ ছিল এভাবে লুটপাট করার। সুতরাং আমার প্রায় সব সঞ্চয় রয়েছে আমার মাথার ভিতরে, যা আমি পড়েছি, যা আমি দেখেছি। ফলে বইয়ের সূত্র ধরে লেখা ইদানীং আমার অনেক কম। এখন বই-পত্রের সূত্র উল্লেখপূর্বক অ্যাকাডেমিক বা গবেষণাধর্মী যে কাজ করি তার প্রায় সবই চঞ্চলের সঙ্গে।

একা আর কতদিন পড়তে এবং লিখতে পারব তা বলতে পারি না। বয়সের ভার এখন বেশী অনুভব করি। চোখেরও বেশ সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে সব মিলিয়ে আমার আর লেখাপড়া করার সেই সামর্থ্য নাই। এই জন্য মাঝে মাঝে অস্থির বোধ করি। নিজের অধ্যয়ন ও অভিজ্ঞতার ফসল মানুষের হাতে তুলে দিয়ে যেতে প্রবল ইচ্ছা জাগে।

কিন্তু এটা বুঝি যে, আমার সব চাওয়া নির্ভর করছে রাজনীতির উপর, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর, নূতন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের উপর। রাজনীতি যে নিখাদ ও বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আমি মর্মে মর্মে অনুভব করেছি ঋগ্বেদের সত্য প্রকাশ ও প্রচার করতে গিয়ে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে, জ্ঞানী বা জ্ঞানসাধকরা সত্যান্বেষী হয়। সুতরাং আমি বা আমরা দুইজন যখন এত বড় অথচ সহজবোধ্য একটা সত্যকে বলছি তখন সবাই না হোক সাধারণভাবে পণ্ডিতরা এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিবে। ক্রমে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে, প্রতিটি সামাজিক সত্য প্রতিষ্ঠার পিছনে থাকতে হয় রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন। ঐতিহাসিক সত্যও রাজনৈতিক শক্তির স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে মিথ্যা হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে এবং একই রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজনে ইতিহাসের মিথ্যা বয়ান তৈরী হতে পারে, মিথ্যা হলেও যাকে সবাই মিলে সত্য বলে চালাবে অথবা সত্য বলে মেনে নিবে।

সমাজ ও ইতিহাসের সত্যান্বেষী অনুসন্ধানের শক্তি ভারতেও এখন পর্যন্ত খুব দুর্বল বলেই মনে হয়। অন্তত এখান থেকে যা বুঝি। এর জন্য সবচেয়ে দায়ী ব্রিটিশ সামাজ্যবাদের ধারাবাহিকতা হিসাবে যে রাষ্ট্র স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেটার অস্তিত্ব। অর্থাৎ আজকের ভারত-রাষ্ট্রকে আরও নির্দিষ্টভাবে বললে বিটিশ উপনিবেশবাদের ধারাবাহিকতা বলি, যার মধ্যে আছে তার পূর্ববর্তী ইসলামী সাম্রাজ্যবাদেরও ধারাবাহিকতা। বাংলাদেশ একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এলেও এই ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটাতে পারে নাই। কেন পারে নাই সেসব নিয়ে আমি আমার বিভিন্ন রচনায় আলোচনা করেছি। পাকিস্তানও এই ধারার বাইরে নয়।

তবে আমার ধারণা প্র্রকৃত স্বাধীন ভারত জন্ম না নিলেও তার সূত্রপাত হয়েছে ভারতে বিজেপি-এর উত্থান দিয়ে। বিজেপি-এর মূল উপাদান হিন্দু ধর্ম মনে হতে পারে। কিন্তু সেটা আপাত সত্য। মর্মে যেটা আছে সেটা হচ্ছে উপমহাদেশের জন-সমাজের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের রসে পুষ্ট ভারতীয়ত্বের একটা বোধ। এটা হাজার হাজার বছরের প্রজন্ম পরম্পরায় মাটির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য চেতনার বন্ধনে আবদ্ধ একটা বোধ। এই চেতনা বৌদ্ধ, জৈন, হিন্দু ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্মের আবরণ বা আধার সৃষ্টি করে তার ভিতরে  আশ্রয়   নিয়েছে। এর উৎসে পৌঁছাতে গেলে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় উপস্থিত  হব।

হিন্দু চেতনায় নাড়ীর টানের শক্তি কতটা প্রবল হতে পারে সেটা হয়ত একটা ঘটনার বর্ণনায় জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠবে। ঘটনাটা পাকিস্তান কালের। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ (অনার্স)-এর ছাত্র। যার কাছে শুনছিলাম তিনিও তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। যিনি বলছিলেন তিনি আমার এক বছরের সিনিয়র হলেও তার সঙ্গে আমার প্রচুর মত বিনিময় হত। তিনি প্রচণ্ড রকম অধ্যয়নশীল এবং মুক্ত চিন্তার মানুষ ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তিনি সচিব হিসাবে দীর্ঘদিন কর্মরত থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিছুদিন আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যাইহোক, তার বিবরণে আসি। তার জেলা ছিল কুমিল্লা। সেই জেলার সেই সময়কার একটা ঘটনার কথা বলে তিনি হিন্দু মনস্তত্ত্বের একটি গভীর দিককে আমার নিকট তুলে ধরেন। কুমিল্লা অঞ্চলের একটা হিন্দু পরিবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাচ্ছিল। সীমান্তের চেকপোস্টে কাস্টম্স কর্মকর্তারা হিন্দু গৃহস্থের টিনের বাক্স তল্লাশী করে কাগজে মোড়ানো একটা বড় মাটির ডেলা দেখতে পেল। মাটির ডেলা ভারতে নিয়ে যাচ্ছে কেন এ প্রশ্নের উত্তরে হিন্দু গৃহস্থ জানালেন এটা পিতৃপুরুষের ভিটার মাটি। দেশে তো আর কখনও ফেরা হবে না। তাই এই মাটিটুকু স্মৃতি হিসাবে নিয়ে যাচ্ছেন। এদিয়ে গৃহদেবতার মূর্তি বানিয়ে পূজা করবেন।

আমার বন্ধু প্রতিম সেই সিনিয়রের এই বিবরণ সেদিন যেমন মনকে নাড়া দিয়েছিল তেমন আজও যখন আমি এ কথা মনে করি তখন ভীষণ কষ্ট পাই। আসলে হিন্দু চেতনার যতই সমস্যা থাক, তার ভিতরের মাটির সঙ্গে আবদ্ধ কৃষকের এই অন্তরঙ্গ রূপকে আমাদের অনুধাবন করার চেষ্টা করা উচিত। অনেক সমস্যা সত্ত্বেও এটা লোভী, লুটেরা, নারী ধর্ষক এবং শিকড়হীন যাযাবর হানাদারদের ধর্ম নয়। কেউ-ই যেন সব ধর্ম সমান বা ধর্ম মাত্রই ভুল বলে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে হিন্দু ধর্মকে এক পাল্লায় মাপতে না যায়।

ইসলাম ধর্ম আমাদের মত অনারবদেরকে দেশদ্রোহী বানায়। কিন্তু হিন্দু ধর্ম তাকে অন্তত দেশপ্রেমের দিকে নিবার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। আমার ধারণা বিজেপির নেতৃত্বে ভারত এবং ভারতবাসীর যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা এক সময়ে ভারত ও ভারতবাসীকে নূতন দিকে যেতে অনুপ্রাণিত করবে। কাজটা বিজেপিকে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে হবার কারণ আমি দেখি না। কারণ এটা এমন এক আমূল বিপ্লবের কাজ যেটা শুধু বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাবে না, অধিকন্তু লোকায়ত চেতনার জাগরণ ও প্রতিষ্ঠা ঘটিয়ে ধর্মের শাসন থেকেও ভারতবর্ষকে মুক্ত করবে। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানকে যদি প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসন অবসান সূচনার প্রথম পর্যায় ধরা হয় তবে বিজেপি’র উত্থানকে আমি দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা হিসাবে বিবেচনা করব। ভারতবর্ষে উপনিবেশবাদের পূর্ণ অবসান কখন কীভাবে হবে তা আমি বলতে পারব না। তবে বাংলাদেশ নিয়ে শত হতাশার মধ্যেও আমি বাংলাদেশ নিয়ে কিছু আশা করি। কারণ উপমহাদেশে এখানে অর্ধশতাব্দীরও অধিক কাল পূর্বে এমন একটা বিপ্লবী প্রজন্মের উত্থান ঘটেছিল যারা ধর্মবিরোধী চেতনা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি গড়ে তুলেছিল। সেই প্রজন্মের একজন হিসাবে আমি গর্ব বোধ করি। আমার সাহস এবং যেটুকু সক্ষমতা আছে তার উৎস নিহিত রয়েছে সেই প্রজন্মের গঠন প্রক্রিয়ায়। আমার ধারণা উপমহাদেশের আগামী ইতিহাস নির্মাণে একটা পর্যায়ের জন্য হলেও এই বাংলার বাঙ্গালী একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

এটা ঠিক যে, বাঙ্গালীর যে জাগরণ ষাটের দশকে হয়েছিল তার সেই গঠন আর হুবহু আগের মত করে হবে না। তখন আমাদের চেতনায় আমাদের বিপ্লবের তিনটা পর্যায়ের কথা মনে হত। প্রথমত পূর্ব বঙ্গে বিপ্লব, অতঃপর দুই বঙ্গে বিপ্লব এবং বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণ; অবশেষে ভারতবর্ষব্যাপী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অখণ্ড সমাজতান্ত্রিক অথবা জন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে এসব আলোচনা হত না। তবে আমাদের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে এসব আলোচনা হত। অবশ্য পূর্ব বঙ্গের পর্যায় পার করে আমাদের চিন্তাকে বেশী দূর নেওয়ার সময় তখন ছিল না। আমাদের সামনে ধর্মীয় তথা ইসলামী পরিচয়ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানকে উচ্ছেদ করার প্রশ্নটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত আমার নিকট এটাই ছিল সবচেয়ে জরুরী বিষয়।

যাইহোক, এত কথা একবারে বলা সম্ভব নয়। তবে আজ এটুকু বলি যে, আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও  বোধ ক্রমে আমার মধ্যে মহাভারতীয় বোধকে শক্তিশালী করেছে, যার শুরু যখন আমি মার্কসবাদের প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস হারাই প্রায় তখন থেকে। কী বিস্ময়কর, তাই না? সদ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ইসলামী আবহে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বালক ও কিশোররা কীভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রভাবে ইসলাম ও পাকিস্তান বিরোধী হিসাবে বেড়ে উঠল এখন ভাবলে বিস্ময় বোধ করি। আমাদের কৈশোরে বাঙ্গালী চেতনার জাগরণে পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর বাঙ্গালী-বিরোধী বৈষম্যের ভূমিকা ছিল বৈকি, কিন্তু তার ভূমিকা অন্তত আমার মত কিশোরদের মধ্যে গে্ৗণ ছিল। ওটা ছিল আমার মত কিশোরদের কাল যখন তারা সপ্তম-অষ্টম শ্রেণী থেকেই বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ পেরিয়ে বিশ্বসাহিত্য পাঠে মনোনিবেশ করেছে। আমার সেই কালের কথা যখন স্মরণ করি তখন রোমাঞ্চিত হই।

১৯৫৯ সালে আমি যখন যশোর জিলা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন আমার এক সহপাঠী বন্ধু (পরবর্তী কালে কম্যুনিস্ট আন্দোলনের নেতা হয়েছিল।) পথ চলবার সময় কখনও উদাত্ত কণ্ঠে মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদ বধ বা আর কোনও কবিতা আবৃত্তি করত। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মনে হলে আজও সেই রোমাঞ্চ অনুভব করি। কিংবা যশোরের সেই কিশোরের কথা স্মরণ করি যে কোনও বই কারও কাছ থেকে নিয়ে পড়ে ভালো লাগলে ফেরৎ দেওয়ার আগে নোট বইতে পুরা বই হাতে নকল করে রেখে দিত। তার ঘরের এক কোণে এইসব নোটবইয়ের একটা স্তূপ জমে গিয়েছিল। জানি না সেখানে কয় ডজন হাতে লিখা বইয়ের স্তূপ জমেছিল। হয়ত তাকে স্বাভাবিক ছেলে বলা যাবে না। কিন্তু জ্ঞানের প্রতি তার এই উদগ্র আকর্ষণ কিংবা নিষ্ঠাকে খাটো করে দেখি কী করে?

সেই দশম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় কলেজ পর্যায়ের মাদ্রাসা পড়ুয়া আমার সিনিয়র এক ছাত্রের সঙ্গে আমি আল্লাহ্ যে নাই সেই সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তর্কে লিপ্ত হলাম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তর্ক করার পর দুপুরে খাবার জন্য তর্ক স্থগিত রেখে এক-দেড় মাইল দূরবর্তী আমাদের বাসায় এসে তাড়াতাড়ি স্নান করে ভাত খেয়েই আবার দৌড়। এভাবে দুই দিন তর্ক হল। কিন্তু আল্লাহ নাই এটা মানতে তার ভয়। ‘কম্যুনিজম ভালো জিনিস’ এটা সে মানতে রাজী হল। কিন্তু ‘আল্লাহ্ নাই এ কথা শুনলেই তো ভয় লাগে!’ ‘আচ্ছা, মানিক! আল্লাহ্ নাই, এ কথা না মানলেই কি চলে না?’ (উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে কথাগুলি তার।) আমার সাফ উত্তর, ‘না’। এবার বুঝুন অবস্থা! ওখানেই আমাদের তর্ক শেষ এবং আমি বিদায় নিলাম।

সেই আমাদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম। এমন প্রজন্ম একটা জাতির জীবনে বার বার আসে না। হ্যাঁ, আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল না। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের তো সেই অর্থে শিক্ষাও ছিল না। আমরা কী করে তাদের কাছ থেকে দিশা পাব? বরং তাদের ধর্মবিশ্বাস ও পশ্চাৎপদ চেতনার প্রতি বিরুদ্ধতা নিয়েই আমাদের বেড়ে উঠা। যে মার্কসবাদী তত্ত্ব বা আদর্শ নিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম তা ছিল এ সমাজ ও উপমহাদেশের অনুপযোগী এবং সেখানে গুরুতর কিছু ভ্রান্তিও ছিল। তবু সেই তত্ত্ব বা মার্কসবাদ এবং পুরাতন মার্কসবাদী নেতৃত্বকেও (যাদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু সমাজ থেকে আগত এবং গ্রেফতার এড়াতে আন্ডারগ্রাউন্ড) আমি পুরা দায়ী করি না। যাত্রা শুরুর জন্য একটা কিছু লাগে। সেই যাত্রার প্রেরণা সঞ্চারের জন্য মার্কসবাদ এবং পুরাতন নেতৃত্ব তাদের সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমাদের নিকট নমস্য। আসলে হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে আমাদের জাতি বা সমাজও বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সুভাষ বসু তো এমনিতেই ব্যর্থ হন নাই!

বৃহৎ আয়তনে একটা বিপ্লবী আন্দোলন এবং তার পরিণতিতে একাত্তরের মত একটা যুদ্ধের অপরিহার্যতা ছিল। সেটা হয়েছে। পৃথিবীর সকল দেশের প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হয়। বিপ্লবী কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের অযোগ্যতা, ভারত ও চীনের ভূমিকা ইত্যাদি কারণে ঐ বিপ্লব ব্যর্থ হলেও ঐ পথ ধরে পরবর্তী সফল বিপ্লব আসতে পারে। সেটা সব দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, ভিয়েতনাম — এর কোনও ব্যতিক্রম নাই। কোথায়ও ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা অনেক বেশীবার হতে পারে, কোথায়ও হয়ত সবটাই বৃথা যায়। তবে বিভিন্ন কারণে আমি বাংলাদেশের ব্যাপারে আশাবাদী। আমি অনুমান করি বাংলাদেশে একটা সফল জাগরণ ঘটলে সেটা পশ্চিম বঙ্গকে জাগাবে, আর পশ্চিম বঙ্গ জাগলে সেটা গোটা ভারতকেও জাগাবে। এবং জলোচ্ছ্বাসের মত এর ঢেউ আছড়ে পড়বে পাকিস্তানের উপর। সেখান থেকে হয়ত আফগানিস্তান এবং এমনকি ইরানের উপর।

অবশ্য মুসলিম ও হিন্দু সমাজে বিপ্লবের ধরন বা গতিধারার সামঞ্জস্য বা মিল সম্পর্কে আমি তেমন একটা নিশ্চিত নই। প্রবল গতি নিয়ে চলমান, যাকে প্রায় ধাবমান বলা যায়, এবং ভয়ঙ্কর হিংস্র, অসহিষ্ণু ও মারমুখী একটা সমাজে বিপ্লবের রূপ আর একটা প্রায় নিষ্ক্রিয়তাবাদী বা প্রায় স্থবির ও মূলত সহিষ্ণু সমাজে বিপ্লবের রূপ বা গতিধারা হুবহু এক রকম হতে পারে না। আমার বিবেচনায় প্রথম বৈশিষ্ট্য মুসলিম সমাজ সম্পর্কে এবং দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হিন্দু সমাজ সম্পর্কে অনেকখানি প্রযোজ্য। হিন্দুদের ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রমভিত্তিক কাঠামোবদ্ধতার চেতনাই সামাজিক প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বহু ধরনের বিশ্বাস ও প্রথা নিয়েও সহাবস্থান করতে হিন্দুর সমস্যা হয় না। কিন্তু ইসলামের ব্যাপারটা তা নয়। সেখানে বিশ্বাস বা ধারণায় ভিন্নতার কোনও জায়গাই নাই। এবং নারী এখানে পুরুষের ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছু না। এই সমাজে যেহেতু সহিষ্ণুতার কোনও জায়গা নাই সেহেতু গণতান্ত্রিক চর্চাও এখানে সমাজের গভীরে শিকড় মেলতে পারে না। সহজ ভাষায় উপমা দিয়ে হিন্দু ও মুসলিমের মূল সত্তাকে এভাবে বলা যায় একজন যেন উপজাতি তথা দলের সুকঠোর শৃঙ্খলায় আবদ্ধ যাযাবর আরব বেদুইন আর অপর জন উপজাতিসম বর্ণজাতির কঠোর শৃঙ্খলায় বংশপরম্পরায় আবদ্ধ কৃষক।

যাইহোক, এই আলোচনা বিস্তাারিতভাবে এখানে করা সম্ভব নয়। তবে এখানে এটুকু বলি যে, মুসলিম সমাজের মানুষ হিসাবে ইসলামকে মোকাবিলা করার প্রশ্নটাই আমার কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং খণ্ডে খণ্ডে মীমাংসার কর্মনীতি অনুযায়ী ইসলামের বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে একটা পর্যায়ের জন্য হলেও হিন্দুর জাগরণ আমার নিকট কাম্য। সংগ্রাম মানুষকে বদলায়। সেটা হিন্দুদের জন্যও প্রযোজ্য। হিন্দু সমাজের দিকে আমার প্রত্যাশার একটা দৃষ্টি থাকে। কারণ আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝি শুধু ভিতর থেকে ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির সাফল্য আসবে না। তবে ইসলামের বিপর্যয়ের কাল শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে আপাতদৃষ্টিতে ইসলামের শক্তি ভীতিসঞ্চারী। কিন্তু এর পিছনে আছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়া এবং ভূ-রাজনীতিরও ভূমিকা। তবে সে আলোচনার জায়গা এটা নয়।

পাকিস্তান কিন্তু ভেঙ্গে পড়তে যাচ্ছে। এটাকে একটা পথ দেখাতে হবে মাত্র। আমার ধারণা ঠিকভাবে প্রচার করতে পারলে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত বিপ্লবের চেতনা বাংলাদেশের মত পাকিস্তানের জনমনের উপর প্রবল প্রভাব ফেলবে। মুসলিম মনকে আমি মোটামুটি বুঝি। সিন্ধু সভ্যতার গৌরব গাথা ঠিকভাবে তুলে ধরলে শিক্ষিত মুসলিম মন কীভাবে অনুপ্রাণিত হয় সেটা আমি বাংলাদেশে বহুকাল ধরে দেখে আসছি। তখন তারা উপমহাদেশের মানুষ হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার সাথে একাত্ম বোধ করে। কারণ তারা গৌরবের অংশীদার হতে চায়।

আমি বহুকাল ধরে চিন্তা করেছি ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত পণ্ডিতরা আমাদের প্রতি সমর্থনদানে যেখানে এত কৃপণ থেকেছেন সেখানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মত পাকিস্তানের একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা হওয়ার পরেও মোহাম্মদ রফিক মোগল কী করে সেই ১৯৯৪ সালে অমন আবেগপূর্ণ এবং অকৃপণ ভাষায় আমাদেরকে পত্র দিলেন! তিনি তো জানতেন যে আমরা হিন্দুদের আদিগ্রন্থ ঋগ্বেদকে তুলে ধরছি সিন্ধু সভ্যতার একটা ধর্মীয় আন্দোলনের ফসল হিসাবে। এটা যে ভারতের হিন্দুদের পক্ষে যেতে পারে সেই ভয়ও তিনি করতে পারতেন। না, তিনি সেসবের পরোয়া করেন নাই। এ থেকে অনেক কিছু বুঝা যায়। হাড়ির ভাতের খবর জানবার জন্য কি সব ভাত টিপতে হয়?

আমার জীবন থেকে আমি শিখেছি যে, ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠার কাজটাও একটা রাজনীতি এবং উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে সেটা বিপ্লবী রাজনীতি। কারণ এই রাজনীতির প্রতিষ্ঠা উপমহাদেশ থেকে ধর্মের সাথে সাথে পাশ্চাত্যের আর্থ-সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যেরও অবসান ঘটাবে। সুতরাং আমার কাছে এখন আর ইতিহাসের সত্য সন্ধান কিংবা প্রতিষ্ঠার কাজকে অ-রাজনৈতিক ও শুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক মনে হয় না।

আপনি এই মুহূর্তে আমাদের নিকট পশ্চিম বঙ্গের দূত। সেই দিক বিবেচনা করে এত বিস্তারিত একটা পত্র আপনাকে দিলাম। এখন একটা বিষয়ে আপনি কি খোঁজ নিতে পারবেন? আমি অনেক দিন ধরে বৈদিক ভাষার উপর ভালো জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিকে খুঁজছি। আপনি যদি আমার লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনায় জেগে উঠুক উপমহাদেশ’ (http://www.bangarashtra.net/article/1504.html) পাঠ করেন তাহলে বুঝবেন কেন আমি তেমন কাউকে খুঁজছি। শুধু সংস্কৃত নয়, বৈদিক ভাষাও তাকে ভালোভাবে জানতে হবে। বাংলাদেশে তেমন কাউকে পাই নাই। জানি না পশ্চিম বঙ্গে তেমন কেউ আছেন কিনা। থাকবার কথা। তবে আপনার সন্ধানে থাকলে আমার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিলে বাধিত হব।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

আপনার ব্যক্তিগত পত্রের সব উত্তর হয়ত সেভাবে দেওয়া হয় নাই। উপনিষদ ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রের বিষয়ে পরবর্তী এক সময়ে কথা বলা যেতে পারে। বিশেষত হিন্দু ধর্মের বিকাশে পূর্ব ভারত এবং বিশেষত বঙ্গের ভূমিকার বিষয়ে আপনি যে প্রশ্ন তুলেছেন সে বিষয়েও আলোচনার চেষ্টা করা যায়। তবে এখনকার মত এখানেই থাক। পরবর্তী সময়ে আমি ব্যক্তিগত পত্রে সংক্ষিপ্তভাবে আমার এতদসংক্রান্ত যেটুকু ধারণা আছে সেটুকু বলতে চেষ্টা করব।

ইদানীং ইউটিউব, ফেসবুকে ইসলাম সংক্রান্ত বেশ কিছু আলোচনা হচ্ছে। এগুলি থেকে একটার লিংক আপনার জ্ঞাতার্থে দিচ্ছি। সময় পেলে শুনতে পারেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভয়াবহ পরিণতি। দরবেশ মোল্লা। The terrible fate of Muhammad bin Qasim https://www.youtube.com/watch?v=W-4OWc3DW1A-এ ধরনের প্রচুর ভিডিওর প্রয়োজন আমি খুব অনুভব করি। ভারতবর্ষের নবজাগরণের জন্য ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটনের প্রয়োজন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সত্যকে চাপা দিয়ে রাখবার অনেক চেষ্টা এতকাল হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে এখন নব উদ্যমে সত্যকে তুলে ধরার সুযোগ এসেছে। এটাকে কাজে লাগাতে হবে।

এখন আমি আপনার পত্রের যৌথ উত্তরদানে চঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হব। আপনার কল্যাণ কামনা করে এখনকার মত বিদায় নিই।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

 

Feb 23, 2023, 9:12 PM

প্রিয় মানিকবাবু,

আপনার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা শুনে খুব ভালো লাগল আমার। অল্পই বলেছেন, মেইল মারফৎ অল্প বলাই সম্ভব, তবুও আপনার জীবন যে অনেক বেশি ঘটনাবহুল, তা বুঝতেই পারছি। বিশেষ করে আপনার বয়স অনেকটাই হয়েছে। তার ওপর ষাটের দশকের মানুষ আপনি। বাংলার কৃষক আন্দোলনের সেই পুরোনো দিনে সততা, ভালোবাসা, নিষ্ঠার এক চমৎকার যুগ ছিল বলে শুনেছি। আমার বয়স তুলনায় অনেকটাই কম। তাই সেরকম একজন পুরোনো দিনের মানুষের অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনতে আমার ভালোই লেগেছে।

এটা একদমই ঠিক কথা বলেছেন যে, ষাটের সেই প্রজন্মের অবস্থা দিয়েই আপনার গড়ে-ওঠার বিষয়টাকে বুঝতে হবে। অন্য কোনোভাবে বোঝার চেষ্টাও আমি করিনি। আপনি সহজভাবে বলার পর বিষয়টা আরও সহজে বুঝলাম — কীভাবে আপনার পিতাদের প্রজন্মের থেকে আপনারা বিজ্ঞানমনস্কভাবে তৈরি হয়ে উঠছেন, পাকিস্তান আর্মির অত্যাচার কীভাবে নিজের মাটি আর ঐতিহ্যকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছে, যাকে নিছক সমাজতন্ত্রের ডিক্রি-ফলানো তত্ত্ব দিয়ে বোঝা যাবে না, এ সবই ভালো মতো বোঝাতে পেরেছেন আপনি। আরও নিশ্চিন্ত হলাম যে, এপার বাংলায়, মানে পশ্চিমবঙ্গে পাকিস্তান আমলের কথা মোটামুটি যেভাবে পড়ানো হয়, সেগুলোই বললেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। ওই ঘটনাটার কথাটা খারাপই লাগল, যেখানে এক হিন্দু পরিবার ভিটের মাটি এপারে নিয়ে আসছে গৃহদেবতার মূর্তি বানাবে বলে!

আর আপনি যে মার্কসীয় ভাবনার লোকায়ত, যুক্তিবাদী, জনমুখী ভাবধারাকে অল্প বয়সেই গ্রহণ করেছেন, সেটা ভেবে ভালো লাগছে আমার। কারণ পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকের পর থেকে বামপন্থী রাজনীতির বেশ কয়েকটা পর্যায় অতিবাহিত হয়। ফলে আমাদের এদিকে বিরোধী দলের সাধারণ ছেলেপুলেরা যুবক বয়সে আজও বাম-ঘরানায় কথা বলে। আপনি যখন সিন্ধু সভ্যতার ওপর চিন্তাভাবনা নিয়ে এখানে এসে উন্নাসিকতা দেখলেন, সেই সময়টা নব্বইয়ের দশক। তখন আমাদের সরকারি বামপন্থীরা সরকারি চাকরি 'উপহার' দিয়ে শিক্ষিত সমাজের নৈতিকতা, মেরুদণ্ডকে 'কিনে' নিয়েছিল। গৎবাঁধা চিন্তা যেটুকু ওপরমহল বলত, সেই নিরাপদ সীমার বাইরে কেউ বেরোত না। তাই বলে আজকের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিতমহল শান্তিতে আছে, সেটা ভাবা ভুল হবে। সংঘাতের অবস্থা না-থাকলে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় গতি আসে না। শিক্ষিত সমাজকে স্থানুর মতো এক জায়গায় কুয়োর ব্যাঙ করে বেঁধে রাখার চেষ্টা করেছিল গত বাম সরকার। তার থেকে আজকের তৃণমূলী জমানা ভালো এই অর্থে যে, প্রতিবাদ আর চিন্তার জগতে একটা আলোড়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছুটা। বিদ্যমান ব্যবস্থায় হতাশা আসলে তখনই বিকল্প খোঁজার তাগিদটা কাজ করে। সেই হিসেবে একটা কষ্টকর অবস্থা যেতে পারে এই রাজ্যে, কিন্তু এটা আখেরে ভালোই হবে বলে মনে হয়। অন্তত কষ্ট না-করলে কেষ্ট মেলে না। কিন্তু মার্কসবাদ সম্পর্কে আপনার সতর্ক মতামতটা প্রশংসার। পূর্ব ভারতের মতো বামপন্থী আন্দোলনের দীর্ঘকালীন ঘনঘটার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সম্ভবত যায়নি। অন্তত আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে বাচ্চাদের পড়ানো হয়, বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধটুকুই হয়েছে এটাই দেখেছি বেশিরভাগ জায়গায়। আপনি সেই পূর্ববঙ্গের ষাটের দশকের বাম ঐতিহ্যের কথা বলছেন দেখে অন্যরকম ভালো লাগা এল। প্রসঙ্গত, ২১ ফেব্রুয়ারি গেল। বরাক উপত্যকা থেকে অন্য এলাকার ভাষা শহিদদের নিয়ে চুপ করে থেকে, চাটগাঁ ইত্যাদি জায়গার স্বাধীনতার দাবি নিয়ে মুখে কুলুপ-আঁটা লোকেরা চারজন শহিদের আত্মত্যাগ নিয়ে কেঁদে ভাসাল হয়তো এইদিন। যাই হোক, আপনি আজকের বাংলাদেশেও সমান্তরাল ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাই আওয়ামী আর জামাতি ভাষ্যের বাইরে অন্যকিছু শোনার অবকাশ রইল আপনার কাছে। আপনার ছোটোখাটো দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা মাঝেমধ্যে শুনলে ভালো লাগবে আমার। আর আপনার বয়স হয়েছে যথেষ্ট। বললেন চোখেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আত্মকথার ধরনে কোনো রচনায় বিশেষ অভিজ্ঞতাগুলো লিখে গেলে পরবর্তী প্রজন্ম তথ্যের একটা ভাণ্ডার পাবে বলে আমার মনে হয়। 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ডে সেরকম কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন বলে জানিয়েছিলেন আগের পত্রে।

একটা বিষয় আমিও ভাবি। কতটা ঠিক জানি না। আপনি বলেছেন, ক্লাস এইট থেকে পাকিস্তান জমানার বিরোধী আপনি। তারপরই সামরিক শাসন জারি হয় পূর্ববঙ্গে। আর ইসলামের অনুসারীরা যে ব্যবহার করে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মানুষদের ওপর যে নির্যাতন তারা চালিয়েছিল, সেটার আপনি ন্যায্যভাবেই বিরোধী। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ সক্রিয় নই। বছর দুয়েক আগেও কিছু সমাজমাধ্যমে বাংলাদেশি মুসলমানদের মন্তব্য দেখতে পেতাম পোস্টের নীচে। খুব অল্প সংখ্যক শরীয়াপন্থী ছিল, যারা নম্র ভাষায় কথা শুরু করে নম্রভাবেই কথা শেষ করত। বেশিরভাগই নম্রভাবে শুরু করে তারপর হিন্দুধর্ম আর পৌত্তলিকতা এসব তত্ত্বকথার আলোচনা আর বিক্ষিপ্ত আক্রমণ করে কমেন্ট সেকশন ভরিয়ে দিত। আমি নিজে এই কুতর্কে অংশ নিইনি কখনও। তবে একজন পর্যবক্ষেক হিসেবে যা মনে হয়েছে আমার, আপনি যা বলেছেন, বাংলাদেশের তরুণ মুসলমান সমাজে 'শরীয়াস্থাপনার্থায়' উগ্রতার একটা ভয়াবহ রূপ দেখা যাচ্ছে। আফগানভূমিতে তালিবান ফিরে আসার পর বাংলাদেশের কিছু তরুণ আফগানিস্তানে তালিবানি প্রশিক্ষণ নিতে যেতে গিয়ে এয়ারপোর্টে আটক হবার খবর চোখে পড়েছিল আমার। যাই হোক, পূর্ববঙ্গের জাগরণ থেকে পশ্চিমবঙ্গের জাগরণ, সেখান থেকে উত্তর ভারত তথা পাকিস্তানে আন্দোলন ছড়িয়ে যাবার ভাবনায় গভীরতা আছে। কিন্তু সব জায়গায় জনমনস্তত্ত্ব একসাথে একসুতোয় বাঁধা পড়ছে না। যে প্রগতির কথা আপনি বললেন, সেটার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন আপনি? আমি তো অল্প নজরে প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি বিস্তর। আমাদের রাজ্যে মৌলবীতন্ত্র যেভাবে বৈধ সরকারের আড়ালে পোক্ত হচ্ছে দিনকে দিন, তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিক্রিয়া তুলনায় কম। আইনি ফ্যাসাদে ফেলে আর শিক্ষা কেলেঙ্কারি ফাঁস করে একটা সরকারকে কিছুদিন অকেজো করে রাখা যায়। জনমনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব না-পড়লে ওপর থেকে ঝামেলা তৈরি করেও সরকারের পায়ের মাটি সরানো যাবে না। এরকম তৃণমূল সরকার সীমান্তে অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটায় বলে শুনতে পাই। ভোটার লিস্টে প্রচুর অবৈধ নাগরিক ওপার থেকে আসছে বলেও শুনতে পাই। এগুলো গোপন কথা নেই আর। ফলে ইসলামী প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি আমরাও হয়তো হতে চলেছি শীঘ্রই। বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার প্রকাশের অবস্থা যদিও আমাদের অবস্থার তুলনায় অনেক খারাপ বলেই মনে হয়। তাই মুসলমান বাঙালি সমাজের উত্থান বিষয়ে আপনার দীর্ঘ জীবনের কিছু কাহিনি সংক্ষেপে বললে বা আপনার লেখা কিছু সেরকম বইয়ের রেফারেন্স দিলে খুশি হব। ইন্টারনেটে আপনার বেশ কিছু বইয়ের নাম দেখেছি, কিন্তু সবই আউট অফ স্টক দেখাচ্ছে। 'বঙ্গরাষ্ট্র'-এ কয়েকটা বইয়ের অনলাইন কপি দিয়েছেন দেখেছি। এর মধ্যে বাঙালি সমাজের সমস্যা নিয়েও বই আছে। আপনাদের বিতর্কিত বই 'ইসলাম বিতর্ক' কোনোভাবে জোগাড় করা সম্ভব? আমি বইটা কোথাও পাইনি। খোলা বাজারে খুঁজিনি। অনলাইনেও পাইনি।

আরেকটা কথায় আমিও একমত আপনার সাথে। ভারতীয় উপমহাদেশে যে-কটা স্বাধীন দেশ আজ গজিয়ে উঠেছে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি, এই সমস্ত দেশের সরকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই ধারাক্রমের পরিণতি। আমাদের যে পার্লামেন্ট চালু আছে গণতন্ত্রের নামে, সেটা ক্রমওয়েলের পার্লামেন্ট নকল করে বসানো। ভারতের সংবিধান আমার মুখস্থ নেই। তবে ইতিউতি পড়তে গিয়ে বিস্তর অব্যবস্থা, এমনকি মৌলিক অধিকারের মধ্যেও গোলমাল লক্ষ করেছি আমি। মোদি সাহেব মাঝেমধ্যে ভারত যে গণতন্ত্রের জননী– এটা বলেন টুকটাক বক্তৃতায়। করোনার প্রথম বছরে প্রচণ্ড উৎসাহ ছিল ভদ্রলোকের নিজের শখের 'আত্মনির্ভর ভারত'-এর পরিকল্পনা নিয়ে। তখন কিছু দামি মতামতও শুনতাম মোদির। সেখানে ভারতের গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস যে কয়েক হাজার বছরের, সেই গণতন্ত্র যে ওপর থেকে চাপানো সংসদভবনের গাজোয়ারি নয়, বরং সমাজের স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা, সেটা মোদি বুঝিয়ে দিতেন বক্তব্যে। এগুলোকে নিছকই রাজনৈতিক বক্তব্য লাগেনি তখন আমার। অন্তত এই কথাগুলো বলার পেছনে সংঘের তাত্ত্বিকদের স্বদেশি ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাটাও আমার নজর এড়ায়নি। সেই হিসেবে আজকের ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র তো বটেই, আগেকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বা ইসলামী শাসনের দীর্ঘ সময়– সবটাই ওপর থেকে চাপানো রাজত্বের কাল। এর আগেও টুকটাক বড়ো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশে। কিন্তু গুপ্ত বা তার আগের মৌর্য সাম্রাজ্য লৌকিক বিশ্বাস, সমাজের মূলগত গঠনে বিশেষ হাত দেয়নি। এই দেশের শেকড়ে সেই শক্তি আজও আছে, তাই সংবাদপত্র থেকে নানান সমাজমাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে নীতিহীনতা, নষ্টামির আমদানি করা হয় পশ্চিমের অনুকরণে, যাতে ভারতের প্রাচীন সমাজ তার প্রাণের শক্তি ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাহ্যিক চাকচিক্যকেই আধুনিকতা বলে মেনে নেয়। সফল পুরোপুরি হয়নি এই সমস্ত সংস্থার অধিকর্তারা আজও। তাই আমার মনে হয়েছে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, আমাদের মাটির খুব কাছাকাছি এমন লক্ষ-কোটি মানুষ আছে, যারা ভারতের সেই হাজার বছরের পুরোনো অথচ সবল লৌকিক গণতন্ত্র মেনে চলে তাদের দৈনন্দিন জীবনে। যত খারাপ অবস্থাতেই থাকুক, দেহাতি জীবনে ভালোবাসা বা মূল্যবোধের অভাব হয় না কখনও। আমার টাউনেও সেরকম প্রচুর মানুষ রাস্তাঘাটে-দোকানে-প্ল্যাটফর্মে ছোটো দোকানদারি চালায়। এদের দরদ আর ভালোবাসা দেখে নিজেকে এ দেশের মানুষ হিসেবে ভাবতে গর্ববোধ হয়। এদের অনেকেরই দেশের বাড়ি গ্রামে। দেশ বলতে এরা স্বায়ত্তশাসিত গ্রামকেই বোঝে। ফলে 'দেশ' বলতে যে একপেশে ধারণাটা চাপানো হয় আমাদের ওপর, সেটা ওপর থেকেই অনেক বেশি চাপানো। পক্ষান্তরে, পুনর্গঠনের শক্তি আমাদের মাটির মানুষদের মধ্যে আজও আছে। প্রযুক্তি বা বিজ্ঞানের সূত্র সেই লৌকিক যাপনে কোনোরকম বাধা আনবে না। তবে ধর্মের অলৌকিক মোড়কটা তখন ফেলে দিতে হতে পারে। কাজেই, লোকায়ত কাঠামোর শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে এখনও শেষ হয়ে যায়নি। এই হিসেবে আশা করা যায়, আস্থা রাখা যায় মানুষের বিবেক আর সুবুদ্ধির ওপর। কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে যে, আপনি নিজে সম্প্রদায়ের নিরিখে পূর্ববঙ্গের একজন মুসলমান হয়েও এই মহাভারতীয় বোধের অংশীদার হতে পেরেছেন। জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে সত্যের প্রতি আপনার নিষ্ঠাই এর প্রমাণ।

একটা বিষয়ে বলতে আমার খারাপ লাগছে, তবু রাখঢাক করব না। 'সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনায় জেগে উঠুক উপমহাদেশ' নিবন্ধটি আমার পড়া। এ প্রসঙ্গে আপনি বৈদিক ভাষায় বিশেষজ্ঞ কারোর খোঁজ থাকলে আপনার সাথে তার যোগাযোগ করিয়ে দিতে বলেছেন। আমি একেবারেই পরিচিত নই এখানকার সমাজে। বলা চলে গেরস্থ মানুষের মতন আমার জীবন। বৈদিক ভাষার ওপর কাউকে পেলে আমি নিজেই সেই ভাষা শিখতে চাইব। শেখার বয়স আমার পেরিয়ে যায়নি এখনও। কিন্তু এমন ব্যক্তি আছেন বলে আমার জানা নেই। পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতের অন্য জায়গায় অবশ্যই বৈদিক ভাষায় সুপণ্ডিত ব্যক্তি থাকবেন বলেই আমার মনে হয়। আমারই ইচ্ছা আছে আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে সংস্কৃত আর বৈদিক ভাষায় পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান অর্জন করার। সেটা গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়, আমারও সমস্যা হবে কোনোরকম গাইড ছাড়া এরকম একটা ভাষা শেখায়। ফলে আমার সেরকম পরিচিত বৈদিক ভাষাজ্ঞানী কেউ নেই। এই কথাটা আপনাকে বলতে আমার খারাপ লাগছে, কারণ ৮১ বছরের মানুষ হিসেবে জীবনের এই প্রান্তে এসে বৈদিক সাহিত্য নিয়ে প্রশ্নের উত্তর সরাসরি আপনি পাবেন না। আমি এই ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না জেনে অপরাধ মার্জনা করবেন আমার।

যাই হোক, আপনার আর চঞ্চলবাবুর যৌথ পত্র আমি পেয়েছি। সেটার উত্তর দেব শীঘ্রই। আপনারা সুস্থ থাকুন সকলে। আপনার পরিবারের কল্যাণ কামনা করে এখনকার মতো বিদায় নেব।

ইতি – অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Feb 25, 2023, 3:24 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

ক্লাস এইটে পড়ার সময় ধর্মবিশ্বাস হারাবার আগে পর্যন্ত পাকিস্তানী পরিচয় নিয়ে আমার কোনও সমস্যা ছিল না। নিজেকে একই সাথে মুসলিম এবং বাঙ্গালী ভাবতে সমস্যা হত না। গত চিঠিতেই আমি ইঙ্গিত দিয়েছি যে, তার আগে থেকেই আমি প্রচুর পড়তাম। যেমন সপ্তম কিংবা অষ্টম শ্রেণীতে থাকা অবস্থাতেই ‘পথের পাঁচালী’ পড়েছি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপরাজিত’ অষ্টম শ্রেণীতে উঠে পড়েছি। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এসব তো আছেই। যখন আমি নবম, দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বয়সের তুলনায় বিস্ময়কর রকম বিচরণ হয়েছে। অবশ্য আমার একার অবস্থা এমন ছিল না। আমার মত আরও কিছুসংখ্যক পাঠককে আমি পেয়েছিলাম সেকালে।

যাইহোক, ধর্মবিশ্বাস নিয়ে যে কথা বলতে চাচ্ছিলাম সে কথায় আসি। ধর্মবিশ্বাস যতদিন ছিল ততদিন পাকিস্তানী হিসাবে জাতীয় পরিচয় নিয়ে আমার মনে কোনও সঙ্কট ছিল না। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস হারাবার সাথে সাথে আমার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে একটা ভয়ঙ্কর ভুল মনে হল। সেটা ছিল আমার তীব্র মানসিক সঙ্কটের সময়। যদি ধর্মই ভুল হয় তবে ধর্মের ভিত্তিতে কেন বাংলা ও বাঙ্গালীকে ভাগ করা হল? এবং সেই সাথে ভারতভাগের অযৌক্তিকতাও দেখা দিল। তবে ভারতের প্রশ্নটা প্রথমে ছিল গৌণ বিষয়। বাংলা ও বাঙ্গালীর প্রশ্নটাই প্রবলভাবে আমার মধ্যে দেখা দিল। যেহেতু বাংলা ভাষা চেতনা আগে থেকেই শক্তিশালী ছিল সেহেতু ইসলামে বিশ্বাস দূর হবার সাথে সাথে আমার চেতনার জগতে এক বিরাট বিপ্লব ঘটে গেল। সেই সঙ্গে মার্কসবাদের প্রভাবে আমার ভিতরের মানবিকতা বোধও প্রবল হয়ে দেখা দিল। কারণ ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি আমাকে মার্কসবাদ বা কম্যুনিস্ট আদর্শের দিকে নিল। আর সেখান থেকে এল উদার মানবিকতা। ফলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে আস্থা অর্পণ করলেও ভিন্ন জাতি বিদ্বেষ আমার মনে কাজ করত না।

কিন্তু চিন্তা বা চেতনার এই রূপান্তর বা ট্রান্সফরমেশন দিয়ে শুধু আমাকে বুঝলে হবে না। এই ঘটনা আমার প্রজন্ম সম্পর্কেও কম আর বেশী প্রযোজ্য। আমরা যারা ধর্মবিশ্বাসমুক্ত বা লোকবাদী হতাম ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তারা পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে সহজেই বাঙ্গালীর রাষ্ট্র চিন্তার দিকে ঝুঁকতাম। এর আগের পত্রে যে কথা বলেছিলাম প্রথমে পূ্র্ব বঙ্গের স্বাধীনতা, তারপর দুই বঙ্গের পুনরেকত্রীকরণ এবং অখণ্ড সমাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতাম। অন্তত আমার মত যারা একটু বেশী অগ্রসর ছিল তাদের মনের ভিতর এমন একটা চিন্তা থাকত। তবে ভাষাগত কারণেই তখন ভারত দূরবর্তী কল্পনা হয়ে গিয়েছিল। ফলে তাৎক্ষণিক সমাধান হিসাবে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা এবং অতঃপর যুক্তবাংলা প্রতিষ্ঠার কথাই আমরা ভাবলাম। তবে বাস্তব বিবেচনা থেকে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার উপরই আমাদের সকল চিন্তা এবং প্রয়াসকে নিবদ্ধ করেছিলাম। খুব বিস্ময়কর মনে হলেও আমাদের তরুণ প্রজন্মের এই চিন্তার সঙ্গে পুরাতন প্রজন্মের কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদীদের চিন্তাকে মিলাতে গেলে ভুল হবে। দীর্ঘ কম্যুনিস্ট রাজনীতি চর্চার কারণে অসাম্প্রদায়িকতা থাকলেও তাদের মধ্যে তখন শ্রেণী সংগ্রামের বাইরে আর কোনও বোধ সেভাবে কাজ করত না।

আসলে আমরা ছিলাম স্বাধীন প্রজন্ম। এটা আমাদের বিশেষ কোনও কৃতিত্ব ছিল না। এই ঘটনা ঘটিয়েছিল ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন প্রবর্তন। সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর কম্যুনিস্টরা সাধারণভাবে হয় জেলে, নয় আন্ডারগ্রাউন্ডে। আমরা তখন কোনও পরিচালক এবং অভিভাবকহীন প্রজন্ম হিসাবে বেড়ে উঠছি, যারা অতি কষ্টে ও সাবধানে মার্কসীয় সাহিত্য যোগাড় করে পাঠ করছি এবং নিজেদের বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী তার সমালোচনা বা ‘ক্রিটিক’ও তৈরী করছি। যেমন ধরুন আমি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন এঙ্গেলসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’র উপর আলোচনা করতে গিয়ে আমি আমার সহপাঠী এক বন্ধু যে নিজেও বইটা পড়েছিল তাকে বলছিলাম যে, এঙ্গেলস যেভাবে সমাজের পর্যায় বিন্যাস করেছেন সেটা ইউরোপ সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু ভারত সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। যেমন ইউরোপের সমাজে দাস ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু জাতিভেদমূলক সমাজ ব্যবস্থা ছিল না। আবার ভারতে জাতিভেদমূলক ব্যবস্থা সমাজের একটা বিশেষ রূপ হলেও এটা ইউরোপে ছিল না।

আমার মনে আছে আমি যখন এই সমালোচনা দিচ্ছি তখন আমি কেবল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি। অবশ্য আমিও আমার প্রজন্মের ভিতরে অনেকটা একা এবং ব্যতিক্রম। যারা আমার মত চিন্তাশীল এবং বিচারশীল হয়ে মার্কসবাদ সম্পর্কে অন্ধ হতে পারত না তারা সাধারণত আমার মত রাজনীতিতে না গিয়ে বেসামরিক আমলাতন্ত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার নিরাপদ ও সুস্থির জীবনে চলে গিয়েছিল। যারা এরপরেও রাজনীতিতে যেত তারা সাধারণত পুরাতন কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের প্রভাবে ভিন্নভাবে চিন্তার ক্ষমতা হারাত। একটা পর্যায়ে আমাদের প্রজন্মও পুরাতন ধারার কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের প্রভাবেই কম-বেশী চলে যায়। সেটা ছিল আমার জন্য ভয়ঙ্কর একটা সময়। তারপর অবশ্য আমি আর খুব বেশী কাল কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে থাকি নাই। একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বঙ্গ স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমার নিকট এ দেশে কম্যুনিস্ট রাজনীতির সকল ইতিবাচক ভূমিকা নিঃশেষ হয়েছে মনে হলে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। আসলে পাকিস্তান কালে একটা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চাওয়া ছিল আমার সকল ধ্যান-জ্ঞানের কেন্দ্র। এ কাজে আমি সে কালের কম্যুনিস্ট রাজনীতি ও তার প্রবল শক্তিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।

একদিকে, ধর্মমুক্ত মানুষ হিসাবে মুসলিম সমাজে থেকে ইসলামের কদর্য রূপকে প্রতিমুহূর্তে অনুভব করা এবং সেই সঙ্গে আমার ইতিহাস পাঠ, অপর দিকে, হিন্দুদের উপর মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্রমিক নির্যাতন আমাকে ইসলাম এবং ফলত পাকিস্তানের জানী দুশমনে পরিণত করেছিল। সেই সময় কম্যুনিস্ট আন্দোলনের শক্তিকে ইসলাম ও পাকিস্তান উচ্ছেদের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।

পাকিস্তান উচ্ছেদের পর আমার মনে হল যার নেতৃত্বে যেভাবেই হোক আমার জীবনের একটা মিশন পূর্ণ হয়েছে। এখন আমার সবকিছুকে নূতন করে বুঝবার প্রয়োজন আছে। সবচেয়ে বড় কথা কম্যুনিস্ট রাজনীতির ভ্রান্তির উৎস এবং বিকল্প পথ সন্ধানও করতে চেয়েছিলাম। কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব আমার প্রতি যে বৈরী আচরণ করত এবং যেভাবে আমাকে দাবিয়ে রাখার উপর তাদের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করত তার জন্য আমার মনে ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমি এগুলিকে ব্যাক্তগতভাবে নিতাম না। আমার মনে হত লোকগুলির এ ধরনের আচরণের মূলে আছে মার্কসবাদী রাজনীতির অনুশীলন। অর্থাৎ লোকগুলির ব্যক্তিগত দোষ-ত্রুটি খুঁজে না বেড়িয়ে তাদের ভ্রান্ত আচরণের উৎস খুঁজতে চেয়ে যে মতবাদের চর্চা তাদেরকে এ জায়গায় নিয়েছে সেটাকেই আমি বুঝতে চেয়েছিলাম। আসলে এই লোকগুলির আদর্শনিষ্ঠা ও ত্যাগের মহিমাকে আমি কখনই, কোনও দিনই খাটো করে দেখি নাই।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

স্বাভাবকভাবে বাংলাদেশোত্তর পর্বে সত্যানুসন্ধানে আমার যাত্রা হয়েছে দীর্ঘ এবং খুব কষ্টসাধ্য। এটা আমাকে খুব একাও করেছে। বিশেষ করে যাদেরকে সাথে নিয়ে এক কালে আমি যাত্রা করেছিলাম তাদের থেকে বিচ্ছেদ আমাকে একা করেছে। আমার এই অনিশ্চিত পথের সঙ্গী হবার মত মানুষ আমি কয়জনকে পাব আর পেলেও কয়দিন পাব। আমার প্রজন্মের যে দুই-চারজনকে কিছু সময় আমার সাথে পেয়েছিলাম তারা যার যার পথ বের করে চলে গেছে।

যাইহোক, আমার প্রজন্মের গল্প এখন থাক। তবে আমার এবং আমার প্রজন্মের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের মানুষ ধর্মমুক্ত হলে তারা যে পরিচয় সঙ্কটে ভুগে তা থেকে মুক্তি পেতে তারা বিকল্প পরিচয় হিসাবে বাঙ্গালী জাতীয়তার আশ্রয় নেয়। এটা আবার তাদেরকে ভারতীয় পরিচয়-বোধের দিকে ঝুঁকতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। তবে মার্কসবাদ বা কম্যুনিজমের সেই প্রবল প্রভাবের কালটাতে আমাদের নেতৃত্ব সর্বহারা শ্রেণী চেতনার প্রাচীর তুলে যে কোনও ধরনের জাতি-পরিচয় বোধকে ঠেকাতে চাইত। তা সত্ত্বেও সব মিলিয়ে পাকিস্তানের কালটা ছিল ধর্ম এবং ফলত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের উত্থানের কাল।

তবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এক অর্থে বাঙ্গালী জাতির জীবনে অন্ধকার কালের সূচনা ঘটিয়েছে। পাকিস্তান কালে বাঙ্গালী চেতনা এবং সেই সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক (মার্কসবাদের প্রভাবে) চেতনার প্রভাবের ফলে ধর্মের দাপট অনেকাংশে ছিল ম্রিয়মান। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হয়। এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী আওয়ামী লীগ।

প্রকৃতপক্ষে আপাদমস্তক দুর্বৃত্তের দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের যত রকম দোষ বা ত্রুটি আছে তার সর্বোচ্চ কেন্দ্রীভবন ঘটেছে এই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। স্বার্থের প্রয়োজনে যে কোনও পর্যায়ের নীচতায় এরা নামতে পারে। মনে রাখবেন গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের নায়ক সোহরাওয়ার্দী ও তার শিষ্য এবং লাঠিয়াল শেখ মুজিব এই দলের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। মূল প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীকে তাড়িয়ে ১৯৫৭ সালে এরা দলের দখল নিয়েছিল। সেকিউলারিজম, ইসলাম সবই এদের কাছে মজুত থাকে। এরা হচ্ছে প্রতারক। মূল কাজ হচ্ছে লুঠ, চুরি, অর্থ পাচার, ধর্ষণ এবং প্রতারণা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এদের বীভৎস ও উন্মত্ত লুটতরাজ নিজ চোখে দেখেছি। হিন্দুদের উপর সবচেয়ে বেশী অত্যাচার, তাদের জমি-জমা দখল এদেশে এরাই সবচেয়ে বেশী করেছে।

আওয়ামী লীগ ঘরানার গবেষক আবুল বারাকাতের হিসাবে হিন্দুদের সম্পদ-সম্পত্তির ৭০ শতাংশই আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্নভাবে দখল করেছে। তবে এরা ভয়ঙ্কর ধূর্ত। প্রতারকরা ধূর্তই হয়।

যাইহোক, এক কথায় বললে এ দেশে মুসলিম লীগ রাজনীতির প্রকৃত উত্তরাধিকারী এদেরকে বলতে হয়। মুসলিম লীগের কাছ থেকে তারা রপ্ত করেছে কীভাবে অন্যের ফলানো ফসল দখল করতে হয়। যেমন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার যে আন্দোলন ব্রিটিশ আমলে হিন্দু সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল তাতে কোনও অংশ না রেখেই ব্রিটিশ শাসকদের নিকট থেকে এরা মুসলিমদের রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান আদায় করে নিয়েছিল। আসলে এরা হয়েছিল ইংরেজদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি বাস্তবায়নের চমৎকার হাতিয়ার। একইভাবে বামপন্থীদের গড়ে তুলা স্বাধীনতা আন্দোলনের ফসলকে এরা ১৯৭১ সালে আত্মসাৎ করেছে ভারতের সাহায্য নিয়ে। বামপন্থীদের অনেক ভুল ছিল। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের। আসলে এটা ছিল নেতৃত্বহীন একটা প্রজন্ম। সবচেয়ে বড় কথা ভারত সরকার এ দেশে একটা বিপ্লবী শক্তির উত্থান ও প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি নিতে পারত না। ভারতের দরকার ছিল এক পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দুই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। আসলে তখন পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীও পাকিস্তানের ভাঙ্গন চাচ্ছিল। কেন চাচ্ছিল সেই আলোচনা কখনও করার সুযোগ পেলে করব। 

সুতরাং পাকিস্তান ও ভারত উভয়ের প্রয়োজন এক বিন্দুতে মিলে যায়। মাঝখানে অপরিমেয় দুঃখ-দুর্ভোগ এবং লুণ্ঠন, বিতাড়ন, ধর্ষণ ও হত্যার প্রধান শিকার হল নিরীহ হিন্দু জনগণ। হ্যাঁ, এটাই নিয়ম, যারা অতিরিক্ত নিরীহ-নির্দোষ তারাই পৃথিবীতে বেশী মার খাবে।

যাইহোক, স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্রের নামে আওয়ামী লীগের উন্মত্ত লুঠ ও দুর্বৃত্তপনার ফলে জনমনে যে প্রতিক্রিয়া ঘটে তাতে করে বিশেষত ইসলাম এবং পাশ্চাত্যপন্থী পুঁজিবাদী রাজনীতির উত্থানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মুজিব হত্যা এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেনাপতি জিয়া এটার সুযোগ নেন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের সাথে সঙ্গত কারণে ভারতের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় ভারত-বিরোধিতার সঙ্গে হিন্দু-বিদ্বেষ এবং ইসলামী চেতনার নব উত্থানও ঘটল। আওয়ামী লীগ তো সবকিছুতেই থাকে। সুতরাং এটারও সুযোগ সে যেখান দিয়ে যেভাবে পারে নিল। এবং আজ অবধি নিচ্ছে।

আওয়ামী লীগকে বুঝতে হলে মুসলিম বাঙ্গালীর জন্ম ও উত্থান প্রক্রিয়াকে বুঝতে হবে। আর এটা বুঝতে হলে বঙ্গ বিশেষত পূর্ব বঙ্গের নদী ভাঙ্গন ও চর গঠনের ভূমি ও জনপদ গঠনের প্রকৃতিকে জানতে ও বুঝতে হবে। এ নিয়ে আমি ‘বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান’-এ কিছু আলোচনা করেছি। নদীর চর গঠনের মধ্য দিয়ে নূতন নূতন ভূমি তথা গ্রাম ও পল্লী গঠনের অনেক কিছু আমি দেখেছি। এভাবে পৃথিবীর আর কোথায়ও বসতি ভাঙ্গে এবং গড়ে না।

হয়ত এই গানের কলি কখনও শুনেছেন, ‘একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।’ হ্যাঁ, প্রায় পুরা পূর্ব বঙ্গই নদীর ভিতর থেকে উঠে আসা চর দিয়ে তৈরী। আমার ছেলেবেলায় রাজশাহীর পাশ দিয়ে প্রবাহমান পদ্মানদী দিয়ে স্টিমার চলতে দেখেছিলাম। অথচ সেই পদ্মা এখন শুষ্ক মওসুমে ক্ষীণস্রোতাএক নদী। পশ্চিম বঙ্গের ভূমি গঠন অনেক আগে সম্পন্ন হওয়ায় আপনাদের তেমন অভিজ্ঞতা নাই। কিন্তু এ বঙ্গে চোখ-কান খোলা রেখে একটু ঘোরাঘুরি করলেই ভূমির ভাঙ্গন ও গঠনের অনেক দৃশ্যই চোখে পড়বে। পঞ্চাশের দশকে যখন আমি স্কুলের ছাত্র তখন আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আয়তন পড়তাম ৫৪ হাজার বর্গমাইল। হয়ত সামান্য কিছু বেশী। সেই আয়তন এখন বাংলাদেশের হয়েছে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের কিছু বেশী। কীভাবে? দেশজয় ছাড়া আর কোথায়ও কি এভাবে দেশের আয়তন বৃদ্ধি পায়?

বাংলাদেশে পায় বিনাযুদ্ধে এবং সেটা নদীর কল্যাণে। নদীবাহিত পলি পড়ে চর বা দ্বীপ গঠনের মাধ্যমে সাগরগর্ভ ভরাট হয়ে বাংলাদেশের এই আয়তন বৃদ্ধি ঘটে চলেছে আজও। এই অস্থির ও ভাঙ্গন প্রবণ চরাঞ্চলের মানুষরাই প্রধানত মুসলিম হয়েছিল সেই মুসলিম শাসনকালে। আজকের মুসলিম বাঙ্গালীকে বুঝতে হলে চরের সেই মানুষদেরকেই সবচেয়ে বেশী বুঝতে হবে। এটা অনেক আলোচনা দাবী করে। এখন আমি সেদিকে যেতে চাই না। তবে গভীর চরাঞ্চলের মানুষদের বিশেষ করে কৃষকদেরকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। মানুষ ভালো-মন্দ মিশিয়ে। এরাও তা-ই। কিন্তু এদের বদলাতে বেশী সময় লাগে না। স্বার্থের প্রেরণায় এদের খুব বেশীর ভাগ মানুষ মুহূর্তে চোখ উল্টাতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলাতে হবে ইসলামের শিক্ষা ও প্রেরণাকে। তাহলেই বুঝবেন মুসলিম বাঙ্গালী অন্তর্জগতে কী? শিক্ষা-সংস্কৃতি মানুষকে বদলায়। সুতরাং সব মুসলিম বাঙ্গালী নিশ্চয় চরের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না। তাছাড়া সবাই নিশ্চয় চর থেকে উঠে আসা মুসলিম বাঙ্গালী নয়।

যাইহোক, এটা চমৎকার আলোচনার বিষয় হতে পারে। ‘বাংলাদেশের রাজনীতির সমাজতত্ত্ব’ লিখতে গিয়ে আমি অনেকটা লিখে উৎসাহ হারিয়ে ওটা অসমাপ্ত রেখেছি। প্রথমত ওটা প্রকাশ করার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছা করে নাই। তারপরে মনে হল এটা লিখে লাভ কী? অন্তত এখন পর্যন্ত ওটা লিখবার ইচ্ছা নাই। যদি কোনও দিন ইচ্ছা হয় তবে লিখব। অবশ্য বেশ কিছুটা ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা’র ৩য় অধ্যায়ে নিবার ইচ্ছা আছে। তবে সমস্যা হবে আমি আমার নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলব বলে সব কথার কেতাবী সূত্র উল্লেখ করতে পারব না। যাইহোক, মুসলিম বাঙ্গালী সম্পর্কে আপাতত শেষ কথা বলতে গিয়ে এটুকু বলি যে, এই মুসলিম সমাজের মূলধারার প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি হচ্ছে আওয়ামী লীগ। চরে চরে ভাসমান, এক চর থেকে অন্য চরে বিশৃঙ্খল ও অস্থায়ীভাবে বসতগাড়া চইরা বা চরুয়া মুসলিমদের দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ। অস্থির-অনিশ্চিত চরের মত অস্থির-অনিশ্চিত বাংলাদেশের পরিবর্তে তাই তারা তাদের সকল সম্পদ পাচার করছে ইউরোপ-আমেরিকার দেশে দেশে। ভারত হোক, চীন হোক, আমেরিকা হোক বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে এরা দেশে তাদের লুঠকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করবে। যখন বিপদ দেখবে তখন ভাঙ্গনকবলিত চরের মত দেরী না করে অনিশ্চিত-অনিরাপদ দেশকে পিছনে ফেলে দিয়ে তাদের বিদেশের ‘সেকেন্ড হোম’-এ পালাবে। অত্যন্ত স্মfর্ট একটা শ্রেণী এটা। নিজেদের নগদ স্বার্থ ছাড়া আর কোনও কিছুর প্রতি এদের অঙ্গীকার নাই। সুতরাং এদের কোনও শত্রু নাই, এদের কোনও বন্ধুও নাই। যে কেউ যে কোনও মুহূর্তে এদের শত্রু কিংবা বন্ধু হতে পারে। এদের সবটাই এতই তাৎক্ষণিক যে, পরমুহূর্তে ঠিক কী করবে সেটা এরা নিজেরাও বলতে পারে না। শুধু জনগোষ্ঠীটাকে বা জাতিটাকে নয়, চরে চরে ঘর বাঁধা মানুষগুলিকে দেখেছি এবং ঘনিষ্ঠভাবে বুঝতে চেয়েছি। আমি মাঝে মাঝে ভাবি কীভাবে এই সমাজের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ষাটের দশকের প্রজন্ম – অমন প্রবল ও পরাক্রান্ত এক প্রজন্ম, অমন ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ, সাহসী ও সত্যান্বেষী প্রজন্ম? নিশ্চয় চরের মানুষরাই এই জাতির সবটা নয়। আর চরেও কিছু ব্যতিক্রম থাকে। আর নূতন ইতিহাস তো গড়ে ব্যতিক্রমরাই, চিরকালই। সেটাও এক কালে দেখেছি তো! আর সেটাই আমাকে ভরসা যোগায়।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

আপনি একটা জায়গায় বলেছেন, ‘সংঘাতের অবস্থা না-থাকলে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় গতি আসে না।’ আপনার এ কথার সাথে সহমত পোষণ করে বলছি সংঘাতের অবস্থা না থাকলে কোনও ধরনের চিন্তাই আগায় না। সে ক্ষেত্রে সবকিছু স্থানু হয়ে থাকে। আমার ধারণা এখন বিশ্বপরিস্থিতিকে খুব দ্রুত বদলে দিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবের বাইরে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতও যেতে পারবে না। এই যুদ্ধের প্রভাবে যে ব্যাপক ভাঙ্গচুর এবং উলটপালট হবে তা অনেক নূতন চিন্তা নয়, অনেক নূতন শক্তিরও উত্থান ঘটাবে। বিশেষ করে ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগের এই গতির শক্তিকে বুঝতে হবে। এই গতির সঙ্গে তাল মিলাবার কিংবা তাকে মোকাবিলার সক্ষমতা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দূরের কথা এমনকি হিন্দু গরিষ্ঠ ভারতেরও বর্তমান কোনও নেতৃত্বের নাই। আমি মনে করি যে সঙ্কট দেখা দিচ্ছে তাকে মোকাবিলা করে দাঁড়াতে হলে উপমহাদেশকে যে আদর্শিক ভিত্তির উপর দাঁড়াতে হবে সেটার যোগান দিতে পারে একমাত্র সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত ও জনকল্যাণবাদী এবং গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার ও পুনরুজ্জীবনের কাজটাই আমরা বাংলাদেশ থেকে করছি বলে আমি মনে করি। আমি মনে করি আমাদের একটা নূতন জাতীয় পরিচয় অত্যাবশ্যক যেটা নিয়ে আমরা মর্যাদার সঙ্গে বিশ্বসভায় দাঁড়াতে পারি। এর জন্য পুরাতন ভারতের দিকে হাত বাড়ালেও আমরা যে পরিচয় নিয়ে দাঁড়াব সেটা হচ্ছে নূতন ভারত বা নবভারতের পরিচয়। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও কৈশোর থেকে বৃহৎ ভারতে পৌঁছাবার পথ খুঁজতাম। কিন্তু সে পথ খুঁজলেও পথটা আমার জানা ছিল না। সুতরাং একটা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসাবে আমি বাঙ্গালী জাতি-রাষ্ট্র গঠন পর্যন্ত আমার করণীয় নিয়ে আগাতে চেয়েছিলাম। মনে হত পরবর্তী সময়ে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পথ খুঁজে পাব।

আসলে ঐক্যবদ্ধ বা অভিন্ন জাতি গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ভাষা। এছাড়া বৃহত্তর জাতি গঠন করতে হলে হয় জবরদস্তি, নয় মার্কসবাদ বা কম্যুনিজমের মত রাজনৈতিক মতবাদ বা ইসলাম বা হিন্দুর মত কোনও একটা ধর্মের আশ্রয় নিতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কম্যুনিস্ট মতবাদের আশ্রয় নিয়ে বৃহত্তর রুশ জাতি গঠনে কতটা সফল হয়েছে সেটা বিচার্য বিষয়। তবে বৈষয়িক সাফল্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়া প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ এসে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙ্গেছে। আর ধর্মের সমস্যা সহজবোধ্য।

ইসলামের প্রসঙ্গ নাই বা আলোচনা করলাম এখানে। এটার মত পশ্চাৎপদতা, বর্বরতা, অমানবিকতা ও একনায়কী হিংস্রতার কোনও মতাদর্শ নিয়ে আজকের পৃথিবীতে দাঁড়াবার প্রশ্নই উঠে না। হিন্দু ধর্ম ইসলামের মত হিংস্র না হতে পারে। কিন্তু এই ধর্ম নিয়ে কোনও জাতি বা রাষ্ট্র আগাবে কীভাবে? এটা প্রায় স্থবির ও বহুধাবিভক্ত একটা সমাজসমষ্টি নির্মাণের ধর্ম। ফলে যুগ যুগান্তের চাপিয়ে দেওয়া সকল জঞ্জালের ভার বহন করে তা চলেছে আজ অবধি। শুধু বহু ভাষা নয়, উপরন্তু বহু অবিশ্বাস্য রকম স্ববিরোধকে ধারণ করেও তা চলতে পারে। আসলে হিন্দু ধর্ম নিয়ে সমাজ হয়ত খুঁড়িয়ে চলতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র চলতে পারে না। আজকের দিনে তো আরও নয়। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি এই অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের সুযোগ এনে দিচ্ছে। আমি বহুকাল ধরে খুঁজছিলাম নব মহাভারতীয় জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সেই মূল উপাদানকে যা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াকে এক অখণ্ড জাতিতে পরিণত করবে। অবশেষে বৈদিক ভাষার পুনরুজ্জীবনের মধ্যে আমি সেই উপাদানকে দেখতে পেয়েছি। যদি আজ থেকে চার হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার মত এত বৃহৎ ও উন্নত সভ্যতা এই ভাষাকে তার সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাষা করতে পারে তবে আমরা কেন পারব না? যুগের প্রয়োজনে ভাষায় কিছু সংযোজন, বিয়োজন হতে পারে বৈকি! সেটা সকল ভাষাতেই হয়। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের একটা যাত্রাবিন্দু চাই। সেই প্রয়োজন থেকে বৈদিক ভাষার কথা ভেবেছি। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু পৃথিবীর কোন্ নূতন কাজ সহজে হয়? উপমহাদেশে বিদ্যমান কোনও ভাষাকে সমগ্র উপমহাদেশবাসী গ্রহণ করবে না। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে সুকর্ণ জাভা দ্বীপের ভাষাকে বাদ দিয়ে খুব সামান্য সংখ্যক মানুষের ভাষা মালয়কে অবলম্বন করে ইন্দোনেশিয়ার নূতন জাতীয় ভাষা বাহাসা ইন্দোনেশিয়া গঠন করেন। অথচ জাভানীজ ভাষায় ইন্দোনেশিয়ার ৫০%-এর বেশী মানুষ কথা বলত। কিন্তু বৃহত্তর ইন্দোনেশিয়ার ঐক্যের কথা চিন্তা করে এক কালের রাজকীয় ভাষা মালয় যাতে মাত্র ৫% মানুষ কথা বলত সুকর্ণ তাকে ভিত্তি করে ইন্দোনেশিয়ার নূতন ভাষা গঠন করলেন। আমরা যারা বাংলাদেশের বাঙ্গালী তারা বুঝি ভাষা মানুষের জন্য কত স্পর্শকাতর হতে পারে। এই যেখানে বাস্তবতা সেখানে বিশাল উপমহাদেশে কি চাইলেই একটা ভাষা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? সম্ভব যদি কোনও নেতৃত্বের সেই ধরনের চেষ্টা, ধৈর্য এবং প্রজ্ঞা থাকে এবং সেই সঙ্গে থাকতে হবে সার্বিক পরিস্থিতির কিছু হলেও আনুকূল্য। আমার ধারণা পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলি ব্যাপক সঙ্কট   বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। ফলে বিদ্যমান নেতৃত্বও সর্বত্র ব্যর্থ হবে পুরাতন পথে এগিয়ে যেতে চেয়ে। এর মধ্যে মোদী এবং আদানি দুইজন দুইভাবে পাশ্চাত্যের দিক থেকে আঘাতের সম্মুখীন হয়েছেন। এটা শুরু মাত্র। সামনে আরও অনেক আঘাত আছে। কী হবে তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে আগামী দুই থেকে তিন বছর সময়ের মধ্যেই অনেক অভাবিত ঘটনা দেখবার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। ঘটনা যারা ঘটাবার তারা ঘটাবে। আমাদের কাজ হল চিন্তা বা ধারণা তৈরী করতে থাকা। যখন সময় আসে তখন মানুষ দিশা খুঁজতে গিয়ে চিন্তা বা ধারণার জগতের দিকে হাত বাড়ায়। তখন হয়ত আমার কিংবা আমাদের এইসব চিন্তা কাজে লাগবে, ফলে আমরাও কিছু করার সুযোগ পেতে পারি। আবার নাও পারি। কিন্তু তাই বলে কিছু না করার দলে যোগ দিব কেন?

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

আপনি গত পত্রে পূর্ব ভারত এবং বিশেষ করে বঙ্গভূমির সঙ্গে হিন্দু ধর্মের বিকাশের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে বলেছেন। আমার মনে হয় ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা’র ২য় খণ্ডে আমরা হিন্দু ধর্মের উত্থান প্রসঙ্গে যে আলোচনা করেছি সেখানে এ প্রসঙ্গ কিছুটা এসেছে। আমার ধারণা সিন্ধু পরবর্তী কালে গাঙ্গেয় অববাহিকাকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় নগরায়ন ও সভ্যতার  যে পর্যায় শুরু হয় সেখানে ধর্ম একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সমগ্র প্রক্রিয়ার কেন্দ্র ছিল বিশেষভাবে মগধ অঞ্চল। সুতরাং এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের উত্থান। বৌদ্ধ পরবর্তী কালে হিন্দু ধর্মও এখানে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। কীভাবে, কেন সেসব নিয়ে আরও অনুসন্ধান হওয়া দরকার। তবে এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, বৌদ্ধ পাল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র নদীভাঙ্গনপ্রবণ তথা চইরা পূর্ব বঙ্গ না হয়ে ছিল মগধ সন্নিকটবর্তী তুলনায় স্থিতিশীল বঙ্গীয় বরেন্দ্র ভূমি। পাল রাজবংশের রাজধানী গৌড় এই বরেন্দ্র ভূমিতে অবস্থিত ছিল। পালদের শাসনকালে বৃহৎ বঙ্গভূমির সাধারণ মানুষ যে বৌদ্ধ ছিল সেটা সহজবোধ্য। এটাও সহজবোধ্য যে, এই সামাজিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিল বৌদ্ধ পাল রাজবংশ। বৃহৎ বঙ্গের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যে পাল রাজত্বের শেষ দিকে ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দু হচ্ছিল সেটাও বোধগম্য। এর ফলে বৌদ্ধ পাল বংশের সামাজিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণতিতে হিন্দু সেন রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গে বৌদ্ধ থেকে হিন্দু ধর্মে সমাজের এই রূপান্তরের কারণ বা পটূভূমি আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে এ নিয়ে কাজ হওয়া উচিত বলে অনুভব করি। বঙ্গে কীভাবে ইসলাম প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করল এ নিয়ে অনেক গালগল্প আছে, যেগুলি আমার নিকট খুবই বিরক্তিকর এবং হাস্যকর। আসলে হিন্দু সেন শাসনে নির্যাতিত বৌদ্ধরা বখতিয়ার খলজীর বঙ্গজয়ের পর দলে দলে মুসলিম হয় নাই এবং হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতিভেদের যাঁতাকলে পিষ্ট নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও ইসলামের সাম্যের মন্ত্রে মোহিত হয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে নাই। বস্তুত মুসলিম শাসনের সাড়ে পাঁচশত বৎসর কালে বঙ্গের কৃষি ও কুটীর শিল্পনির্ভর কয়জন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাতেই আমার সন্দেহ আছে। আমার চোখ-কানের উপর যদি আমি নির্ভর করি তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারি বঙ্গের সভ্যতা বহির্ভূত চরাঞ্চলের মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাদের সংখ্যা প্রাক-ব্রিটিশ শাসনকালে সামান্য ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধিহারের দ্রুততার ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে এরা অতিদ্রুত সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাগরুতে পরিণত হয়। এ নিয়ে ‘বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান’, ‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’সহ বিভিন্ন গ্রন্থ এবং প্রবন্ধে আমি কিছু হলেও আলোচনা করেছি। তবে অ্যাকাডেমিক এবং নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা না করে আমার মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করি।

বঙ্গীয় গরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ মানে মূলত চর থেকে উঠে আসা মানুষ। নির্দিষ্ট ভূমির অবলম্বনহীন এই মানুষেরা কৃষিজীবী হলেও ভাসমান, এক এলাকা বা এক চর থেকে আর এক এলাকা বা চরে তাদের অস্থির, অনিশ্চিত আবাস। আশ্চর্যজনক মনে হলেও চর যেমন স্থায়ী নয়, এদের সমাজ ও ফলশ্রুতিতে এদের সামাজিক শৃঙ্খলাও তেমন স্থায়ী নয়, বরং খুব অস্থায়ী। চর যখন ভাঙ্গতে শুরু করে তখন নূতন কোন চরে কে বসত গাড়বে তার কোনও নিয়ম নাই। চরও তো এক সঙ্গে গড়ে না, ভাঙ্গেও না। ফলে নদীবিধৌত বঙ্গের বাঙ্গালী ভাসমান হলেও কোনও নির্দিষ্ট সামাজিক শৃঙ্খলায় আবদ্ধ নয়। ভ্রাম্যমান আরব বেদুইন বা যাযাবররাও কঠোর উপজাতীয় কিংবা গোত্রীয় তথা কঠোর সামাজিক শৃঙ্খলায় থাকতে অভ্যস্ত। কিন্তু চলমান তথা অস্থিতিশীল জীবনযাপনকারী এই চইরা মানুষ নির্দিষ্ট কোনও সামাজিক বন্ধনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদীভাবে পরিচিত হয় না। তার সবই সাময়িক, তাৎক্ষণিক। তার দীর্ঘমেয়াদী সমাজ শুধু তার পরিবার। এছাড়া এ পৃথিবীতে সে একা। এদের নিয়ে গঠিত মানুষদের সমাজ তাই বিচ্ছিন্ন মানুষদের নিয়ে গঠিত সমষ্টি মাত্র। এই চইরা বাঙ্গালীর ভূমিকার সঙ্গে আমি ইসলাম গ্রহণকারী আরব বেদুইনদের সভ্যতা ধ্বংসী ভূমিকার মিল খুঁজে পাই। আরব বেদুইনদের সাহায্য নিয়ে ইসলাম যেমন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ ভূভাগের সভ্যতাকে লণ্ডভণ্ড করেছিল ইংরেজ শাসকদের সহায়তা নিয়ে বঙ্গের মুসলিমরাও তেমন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজজীবনকে বহুলাংশে লণ্ডভণ্ড করেছে। আপনি জানেন কিনা জানি না আজকের পাকিস্তানের মুসলিমরাও কিন্তু সেভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল না। বরং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ কিছু প্রদেশে পাকিস্তান দাবীর প্রতি বিরোধিতাও ছিল। আমার এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। তবে সম্ভবত সিন্ধুতেও এই বিরোধিতা ছিল। ওয়ালী খানের ‘Facts are Facts’ পড়লে একটা স্পষ্ট ধারণা পাবেন।

যাইহোক, পাকিস্তান আন্দোলনের তাৎপর্য বুঝতে হলে বাঙ্গালী মুসলিমকে বুঝতে হবে। আর সেটা বুঝতে হলে তার সামাজিক উৎস সন্ধান করতে হবে। তখন এর প্রকৃত চরিত্র এবং সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে একটা ধারণা করা সম্ভব হতে পারে। তবে মানুষ তো পরিবর্তনশীল। সুতরাং বিচারের সময় খুব বেশী অনড় বা রক্ষণশীল হতে নাই। তবু উৎস ও বিকাশধারা বুঝলে অনেক কিছু বুঝা সহজ হয়। আমার কথা শেষ করে আনি। মুসলিম মনস্তত্ত্ব বুঝবার ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের বেশ দুর্বলতা আছে। ফলে এর প্রতিকারের বুদ্ধিও হিন্দুদের কাছ থেকে পাওয়া বেশ কঠিন। হিন্দু সমাজ মর্মগতভাবে বিপ্লব-বিরোধী। কারণ তা চিরস্থায়ীভাবে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে চলতে চায়। আসলে প্রগতিশীলতা অর্থে মুসলিম সমাজও বিপ্লবের পক্ষে নয়। বরং ভয়ঙ্কর রকম প্রগতি ও মানবিকতা বিরোধী একটা সমাজ এটা। কিন্তু এর উপরে জবরদস্তিমূলকভাবে চাপিয়ে দিতে পারলে এই সমাজ বহুকিছুকে মেনে নেয়। এখানে পাশ্চাত্যের মানবাধিকারের তত্ত্ব চলবে না। আগে মানুষ বানান, তারপর মানবাধিকারের শিক্ষা দিবেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত থাকলে এতদিনে তা মানুষ হত। কিন্তু মার্কিন এবং পাশ্চাত্য তা হতে দেয় নাই। সৌদী আরবে যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান যেসব সংস্কার করছেন তিনি কোন্ মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ফরমুলা মেনে চলছেন? আমার মনে হয় পাশ্চাত্য গণতন্ত্র পাশ্চাত্যের জন্য আজ যেমন হোক আমাদের জন্য তার প্রতি অন্ধ ও বিচার-বুদ্ধিহীন আনুগত্য আমাদের জন্য বিপর্যয় এবং ধ্বংস ডেকে আনবে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কালে আমি এক সময় (১৯৭৯ – ১৯৮৬) জাতীয় পর্যায়ে একটা এনজিও গড়ে তুলেছিলাম, যেটার নির্বাহী প্রধান হিসাবে আমি কাজ করেছিলাম। ওটাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একটা পর্যায়ে ওটাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তার আগে আমি ইউরোপ-আমেরিকার ডোনারদের মনস্তত্ত্বটা বুঝার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের মত দেশ ও সমাজগুলি থেকে তারা কী চায় সেটা আমি নিজে দেখে-শুনে-বুঝে এসেছি। তাতে আমি তাদেরকে দোষ দিব না। সবারই উচিত যার যার স্বার্থ দেখা। সেটা যদি না বুঝে কেউ বোকার মত আচরণ করে তবে দোষটা কাকে দিব?যাইহোক, বুঝতেই পারছেন মুসলিম সমাজ সম্পর্কে আমার ওষুধের ডোজটা একটু বেশী কড়া। মনে হয় আজকের মত এখানেই বিদায় নিতে পারি। ভালো থাকবেন, আনন্দে থাকবেন।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

 

Feb 26, 2023, 4:35 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

গত পত্র পাঠাবার পর পুনরায় পাঠ করতে গিয়ে মনে হল দুই জায়গায় লেখায় কিছু ত্রুটি আছে যা সংশোধন করা উচিত। অন্যদিকে, আপনার পত্রে উল্লিখিত কিছু প্রশ্ন বা বক্তব্য প্রসঙ্গে আমি কিছু বলি নাই। অথচ আমার দিক থেকে কিছু বলা উচিত ছিল ভেবে এই পত্র লিখা।

প্রথমে আমার পত্রের ত্রুটি সংশোধন করি। আমি আমার পত্রে বলেছিলাম, ‘যেমন ধরুন আমি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন এঙ্গেলসের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’র উপর আলোচনা করতে গিয়ে আমি আমার সহপাঠী এক বন্ধু যে নিজেও বইটা পড়েছিল তাকে বলছিলাম যে, এঙ্গেলস যেভাবে সমাজের পর্যায় বিন্যাস করেছেন সেটা ইউরোপ সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে, কিন্তু ভারত সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। যেমন ইউরোপের সমাজে দাস ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু জাতিভেদমূলক সমাজ ব্যবস্থা ছিল না। আবার ভারতে জাতিভেদমূলক ব্যবস্থা সমাজের একটা বিশেষ রূপ হলেও এটা ইউরোপে ছিল না।’ এই শেষ বাক্যটা এমন হবে, ‘আবার ভারতে জাতিভেদমূলক ব্যবস্থা থাকলেও এখানে ইউরোপের মত করে দাস ব্যবস্থা ছিল না।’

ব্যাখ্যা সহকারে আমার উপরোক্ত বক্তব্যকে দিতে গিয়ে আরও কথা বলতে হয়েছিল, যার সব এখন মনেও নাই এবং এখানে সেসব স্মৃতি থেকে নেওয়ার চেষ্টা করবারও প্রয়োজন নাই। আমার মূল বক্তব্য ছিল, এঙ্গেলস যেভাবে ইউরোপের সমাজ বিকাশের গতিধারা দিয়ে সমগ্র মানব সমাজের গতিধারার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন এটা সঠিক নয়। এক এক সমাজের বিকাশ ও গতিধারা এক এক রকম হতে পারে। এই আলোচনায় আমার সেই বয়সের জ্ঞান ও বুদ্ধি অনুযায়ী ইউরোপ ও ভারতের সমাজের গতিধারার মধ্যে একটা তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছিলাম।

আমি আমার পত্রের আর এক জায়গায় বলেছি, ‘আওয়ামী লীগ ঘরানার গবেষক আবুল বারাকাতের হিসাবে হিন্দুদের সম্পদ-সম্পত্তির ৭০ শতাংশই আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্নভাবে দখল করেছে।’ কথাটা হবে এমন : হিন্দুদের কাছ থেকে দখলকৃত সম্পত্তির ৭০ শতাংশই আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্নভাবে দখল করেছে। বাকী ৩০% বিএনপি, জামাত ইত্যাদি বিভিন্ন দলের লোকজন দখল করেছে।

যাইহোক, ভুল তথ্য এবং বক্তব্য সংশোধন করতে চাইলাম। আমি ধরে নিচ্ছি যে, আপনি আমার বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন। কাজেই আমি বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হবার চেষ্টা করি। তারপরেও ভুল হয়। বয়সের কারণে অনেক কথা লিখবার সময় চাপ নিতে পারি না। আর চোখের সমস্যা তো আছেই।

তাই বলে এ কথা মনে করবেন না যে আপনাকে লিখতে আমি কষ্ট বোধ করি। বরং খুব আনন্দ পাই আপনার পত্র পড়তে এবং লিখতে। আসলে এক সময় পশ্চিম বঙ্গ থেকে আমার অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু শুধু হতাশার সঞ্চয়ই বেড়েছিল। ১৯৯১ সালের কথা মনে আছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন অধ্যাপককে আমার ১৯৯০ সালে লিখা ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’র হাতে লিখা পাণ্ডুলিপির ফটোকপি পড়তে দিয়েছিলাম। বইটা ‘বঙ্গরাষ্ট্রেও’ দেওয়া আছে। ইসলামের সমালোচনামূলক এ বই পড়ে তিনি এত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন যে সেটা আমাকে খুব বিস্মিত করেছিল। এ ধরনের কোনও বই নিয়ে যাতে পশ্চিম বঙ্গে না যাই সে ব্যাপারে তিনি আমাকে রীতিমত হুমকিও দেন। অথচ অধ্যাপক নিজে হিন্দু সমাজের মানুষ। তবে কম্যুনিস্ট। বাংলাদেশেও আমি কম্যুনিস্ট, অকম্যুনিস্ট, হিন্দু, মুসলিম নির্বিশেষে অনেককে বইটা দীর্ঘকাল ধরে পড়তে দিয়েছিলাম। তারপর এটা ২০০৯ সালে প্রথমে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশ করি এবং সম্ভবত ঐ বছর অথবা পরের বছর ২০১০ সালের প্রথম দিকে বইটা ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ থেকে ছাপাই এবং বাজারজাত করি। আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে ‘ইসলাম বিতর্ক’-এর ছুতা ধরে ২০১৬-এর ফেব্রুয়ারীতে আঘাত করেছে। সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু সামনা-সামনি কেউ কখনও কলকাতার অধ্যাপকের মত আমাকে হুমকি দেয় নাই। বরং এখানে ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’র জন্য কারও কারও কাছ থেকে উচ্ছ্বসিত কিংবা আবেগ আপ্লুত সমর্থন পেয়েছিলাম সেই কালে। এটা ঠিক যে, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে, কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের মত বিরোধিতা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্যও এখানে পাই নাই। আচ্ছা, ঠিক আছে আমার রাজনীতি কিংবা সমাজ-চিন্তা কিংবা ধর্ম-চিন্তা না হয় ভালো লাগল না, কিন্তু ভারত-ইতিহাস কিংবা আর্যতত্ত্ব সম্পর্কে যে সব বক্তব্য প্রথমে এককভাবে এবং পরবর্তীতে যৌথভাবে দিয়েছিলাম সেগুলি নিয়ে পশ্চিম বঙ্গ থেকে ইতিবাচক কিছু আলোচনা-সমালোচনা প্রত্যাশা করাটা কিন্তু স্বাভাবিক ছিল।  

১৯৯০ সালে ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’ লিখি। তখনও টুইনটাওয়ার ধ্বংস হয় নাই। ফলে পাশ্চাত্য থেকে ইসলাম-সমালোচনার জন্য সেভাবে অনুমোদন ও সমর্থনের কালও শুরু হয় নাই। তবু বাংলাদেশের মত এত বৈরী মুসলিম সমাজেও যেটুকু অনুমোদন, উৎসাহ কিংবা সমর্থন পেয়েছি তার কিছুই প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম বঙ্গে পাই নাই। আমার ধারণা প্রথমত হিন্দু ধর্মই বাঙ্গালীর জাতির এমন সর্বনাশ করেছে। তা না হলে মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে বাংলা থেকে কেন জাগরণ ঘটে নাই পাঞ্জাব বা মহারাষ্ট্রের মত? সম্ভবত দ্বিতীয় দফার সর্বনাশটা করেছে মার্কসবাদ বা কম্যুনিজম। পশ্চিম বঙ্গে আমি মার্কসবাদ বা কম্যুনিস্ট আন্দোলনের কিছু ইতিবাচক দিক দেখলেও এর ক্ষতিকর দিকটাই অনেক বেশী প্রবল বলে মনে হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী সমাজকে চূড়ান্ত রকম বন্ধ্যাত্বে ডুবিয়ে দিয়েছে কম্যুনিস্ট মতাদর্শ ও রাজনীতি।

পশ্চিম বঙ্গে বাম রাজনীতির ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মতামতের সঙ্গে আমি একমত পোষণ করছি। আমার আরও ধারণা আজ তৃণমূলের নেতৃত্বে যে লুম্পেন ও ইতর সমাজ ও রাজনীতির উত্থান সেখানে ঘটেছে সেই সমাজ ও রাজনীতির ভিত্তিটাকে মজবুতভাবে গড়ে দিয়ে গেছে বামফ্রন্ট। যে গাছ বামফ্রন্ট লাগিয়ে দিয়ে এবং বড় করে দিয়ে গেছে সেই গাছের ফল খাচ্ছে এবং খাওয়াচ্ছে এখন তৃণমূল।

যাইহোক, কোনটাই চিরসত্য বা ধ্রুব নয়। সবই স্থান-কাল-পরিস্থিতি নির্ভর। আজ থেকে এগারো-বারো শ’ বছর আগেও বৌদ্ধ পাল রাজবংশের শাসনকালে এই বাঙ্গালীর পূর্বপুরুষরা বাংলাকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতব্যাপী বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। সুতরাং পশ্চিম বঙ্গও আবার তার গৌরবের দিন ফিরে পেতে পারে। এটা ঠিক যে, এখন পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গ থেকে আশাব্যঞ্জক তেমন কিছু হতে দেখি না। তবে আপনার পত্র পেয়ে অন্তত অনেক আনন্দ পেয়েছি। আপনার পত্র থেকে আপনার অধ্যয়ন, চিন্তা ও জিজ্ঞাসার গভীরতাকে অনুভব করি। আপনার কিছু কথা থেকে পশ্চিম বঙ্গের অবস্থাকেও বুঝতে চেষ্টা করি।

আপনি ভারতের গ্রাম সমাজের যে অন্তর্নিহিত শক্তির কথা বলেছেন সেটাকে আমি এখানে থেকে বুঝার চেষ্টা করি। তবে ভারতের সেইসব গ্রাম তো সেভাবে দেখবার সুযোগ পাই নাই। এ ক্ষেত্রে আমার ধারণা মূলত পাঠ বা অধ্যয়ন নির্ভর।

অবশ্য বাংলাদেশের গ্রাম আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। আমার গ্রাম্য জীবন দশ বছরের। হিন্দু পল্লীতে যেমন তাদের আশ্রয়ে থেকেছি, তেমন মুসলিম পল্লীর অভিজ্ঞতা আছে। তবে বাংলার গ্রাম সমাজ উত্তর, মধ্য কিংবা দক্ষিণ ভারতের মত অতটা ঐতিহ্য নির্ভর বলে আমার মনে হয় না। এর জন্য ইসলাম ধর্মের পাশাপাশি বাংলার নদীভাঙ্গনমূলক ভূপ্রকৃতি দায়ী বলে আমার ধারণা। তবে আমার গ্রামীণ জীবনে গ্রাম সমাজের স্বশাসনের ভগ্নাংশ একেবারে দেখি নাই তা নয়। কিন্তু সেটা দিয়ে সমাজের নিজস্ব শক্তির একটা রূপ পরিস্ফুট হলেও নগর ও রাষ্ট্রের তুলনায় তার শক্তি অনেক কম দেখেছি। বিশেষত ইসলাম-শাসিত তথা মুসলিম রাষ্ট্রের থানা-পুলিশ, আদালত এবং সেই সঙ্গে মুসলিম দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিনির্ভর রাষ্ট্রের হানাদার ভূমিকা সমাজের কোথায়ও শুভ শক্তির দাঁড়াবার জায়গাই রাখে না।

ভারতে আপনাদের অভিজ্ঞতা অনেকটা ভিন্ন। আপনি ভারতের গ্রামসমাজের যে নিজস্ব অন্তর্নিহিত শক্তির কথা বলেছেন সেটা যে সেখানে আছে সেটা আমারও মনে হয়। অন্ধ পাশ্চাত্য-প্রীতি এবং দাসত্বপরায়ণ উপনিবেশিক চেতনার বিরুদ্ধে বিকল্প ও স্বাধীন চেতনা নিয়ে জাগবার শক্তিও সেখানে আছে, যেমনটা আপনি বলেছেন। হিন্দুত্ববাদ বলি আর সংঘ কিংবা বিজেপি-এর রাজনীতি বলি আর এগুলির বিকল্প হিসাবে লোকায়ত রাজনীতির কথা বলি ভারতের নিজস্ব শক্তি নিয়ে জাগরণের জন্য সেখানে হাত বাড়ানো ছাড়া উপায় কী? চেতনার স্বাধীনতার যুদ্ধটাও একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধ করতে গেলে আগে তো নিজস্ব একটা ভূমি পেতে হবে যেখানে আমরা নিজ শক্তির সমাবেশ ঘটাব। আমি তো ষাটের দশক এবং একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি করা মানুষ। সুতরাং আমার সেই অভিজ্ঞতা থেকে নূতন কালের ভিন্ন ধরনের হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য যাত্রা শুরুর জন্য জায়গাটাকে আমি চিনতে পারি এবং সেখানে আমার মত করে আমিও দাঁড়াতে চাই। সেখানেই চিরস্থায়ী হবার জন্য নয়, বরং সেখান থেকে এগিয়ে যাবার জন্যই সেই জায়গাটাকে চিনতে এবং সেখানে অবস্থান নিতে হবে। আমাদের জন্য জায়গাটা হচ্ছে আমাদের হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মহিমান্বিত ঐতিহ্যের ধারা, যেটা সবচেয়ে বেশী আজও বেঁচে আছে ভারতের গ্রাম-সমাজের ভিতর। নগরগুলি তো সর্বপ্রকারে পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদ-অধিকৃত। এগুলিকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আউটপোস্টও বলা যায়। সুতরাং মূল জায়গায় আপনার সাথে সহমত পোষণ করি।

এখনকার মত এখানেই বিদায় নিই।

আপনার কল্যাণ কামনায়,

শামসুজ্জোহা মানিক

 

Mar 4, 2023,9:46 AM

প্রিয় মানিকবাবু

আপনার দীর্ঘ ব্যক্তিগত পত্রটি পেয়ে খুব ভালো লাগল। কয়েকটি নতুন ধারণাও তৈরি হল আপনার পূর্ববর্তী পত্র থেকে; কিছু ধারণার পরিবর্তনও হল বলা চলে। পর্যায়ক্রমে সে-কথায় আসব।

আগেই আপনি বলেছেন যে, ষাটের দশকের আপনাদের প্রজন্ম কমিউনিস্ট রাজনীতির পূর্বতন ঐতিহ্য থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির জন্যই হোক বা সমকালীন কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কারাগারবন্দি হবার দরুনই হোক, আপনার প্রজন্ম এমন একটা অবস্থায় গিয়ে পড়েছিল, যেখানে কিছু করতে হলে আত্মসক্রিয় হতেই হত তাদেরকে। অন্তত আপনার কথা থেকে সে-কথা ভালোই বুঝেছি।

পঞ্চাশের দশক অবধিও বাংলাভাগ, উদ্বাস্তুদের স্রোত, সরকারগুলোর নামমাত্র সহায়তার ঘূর্ণিপাকে কী অবস্থাই না ছিল ভিটেছাড়া মানুষগুলোর! আমার পাড়াটা এপার বাংলার লোকদের বসতি মূলত। কিন্তু পাশের পাড়া প্রফুল্লনগর অনেকটাই কলোনি। আমার পাড়ার আশপাশে বিস্তর কলোনি আছে। রেললাইনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে থাকি আমি। চার নম্বরের ওপারে বস্তির পর বস্তি। রেলের লাইন ধরে প্রচুর বস্তি ছিল। এ সবই পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের আবাসস্থল। ইদানীং প্রোমোটারেরা পয়সা ঢেলে আর 'বিশেষ অনুরোধ' করে সে-সব জমি দখল করে পেল্লায় ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। গোটা দশ- পনের বছর কাঁচা টাকা প্রচুর বেড়েছে উড়ো প্রোমোটারদের। এই ব্যবস্থা শেষের দশ-পনের বছরের বাম জমানাই করে দিয়েছিল। আপনি ঠিকই বলেছেন: বাম রাজনীতির গোছানো গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাচ্ছে আর খাওয়াচ্ছে আজকের স্যাটার্নের দল। প্রবাদই আছে আমার টাউনের নামে: চালাও পানসি বেলঘরিয়া। এরকম নিরিবিলি টাউনে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর কাছের মানুষের বাড়ি থেকে কুড়ি কোটি টাকা পাওয়া থেকে শুরু; তারপর সব জায়গাতেই প্রচুর অচল টাকা পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টা আমাদের কাছে ও হাস্যকর। অনেকের আক্ষেপ: পাশের বাড়িতেই যদি এত টাকা আছে জানতাম, কবেই দোকানদারি ছেড়ে ডাকাতি ধরে ফেলতাম! দেখুন, টাকা দেখে চোখ কীভাবে ছানাবড়া হয়ে যায় এখন লোকের। এই অর্থগৃধ্ন মানসিকতা তৈরি হয়েছে নব্বই দশকের সোভিয়েত-পরবর্তী 'মুক্ত হাওয়া'র ফলশ্রুতিতে। আমি আমার ছোট্টো টাউনের কথাটুকু বললাম। তবে লেবার ক্লাসের সমাজে কাঁচা টাকার এই হঠাৎ আমদানি তৃণমূল জমানায় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এই প্রোমোটারি চক্র, অবৈধ কারবারির চক্র প্রায় পুরো উত্তর কলকাতা-লাগোয়া এলাকা জুড়ে ছেয়ে আছে। আমাদের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এতটা গভীরে হয়তো হাত দেবে না নিজেদেরই নিরাপত্তার কথা ভেবে। শুনছি, দুবাই এখন অতীত; সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডকে ঘিরে বড়োসড়ো অর্থপাচারের র‍্যাকেট তৈরি হয়েছে, যার সাথে আমাদের মহামান্য বঙ্গবিভূষণ সরকারের মন্ত্রীদের আর্থিক লেনদেনের যোগ রয়েছে বিস্তর। কিন্তু একটু নীচের সমাজে দেখুন, অভাব-কষ্ট বলতে যা বোঝায়, তাকে হাবিজাবি সরকারি ভাতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। আবার অতি সাধারণ ঘরের ছেলেপুলেদের টোটো চালানো থেকে দোকানপাট, এককথায় ছোটো উদ্যোগের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে বর্তমান সরকারের। বণ্টনে বিস্তর অব্যবস্থা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিপুল দুর্নীতি সত্ত্বেও সরকারের প্রধানের 'সদিচ্ছা' দেখে সাধারণ সমাজ যথেষ্ট আপ্লুত। ফলে একদম হেটো কথায় বলতে গেলে, 'খেটে-খাওয়া' সমাজকে 'মানবিক সাহায্য' দিয়ে যতটা সম্ভব হাতে রাখার চেষ্টা রয়েছে বর্তমান রাজ্য সরকারের। এই জন্যেই কেন্দ্ৰীয় সরকার ওপর থেকে তদন্ত চালালেও, সরকারি প্রতিষ্ঠান অকেজো হওয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষিত সমাজ প্রতিরোধ করলেও একেবারে লেবার ক্লাস বলতে যা বোঝায়, তাদের খুব বেশি হেলদোল নেই। তবে হ্যাঁ, এই নীচু সমাজটা বেঁকে বসলেই বিপদ সরকারের। তাই আপনার কথা অবশ্যই ঠিক যে, তৃণমূলের পৃষ্ঠপোষকতায় খাটুয়া সমাজ থেকে একটা বিপুল লুম্পেন বাহিনী তৈরি হয়েছে, যার ওপর শিক্ষিত সমাজের নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণটা আছে উড়ো মাফিয়াদের, যারা নিজেরাও এক অর্থে লুম্পেন। গত বাম জমানায় সরকারের কাছে বিক্রীত শিক্ষিত সমাজ এই লেবার ক্লাসকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। আজ তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের হাতের বাইরে এই সমাজ চলে গেছে। ফলে রাজ্যের শিক্ষা দুর্নীতি বা কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে পশ্চিম ভারতে কৃষকদের যে আন্দোলনই হোক, প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী আন্দোলন এখন এলিট, পয়সাওয়ালা লোকদের নিয়ে মচ্ছব করছে মূলত। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাম-কংগ্রেসি রাজনীতির শহুরে বাবুতন্ত্র একবারেই শেষ বলা চলে উত্তর ভারতে। মধ্য ভারতের রাজনীতিতে বিহারকে ঘিরে কিছুটাহলেও স্থানীয় এলিট রাজনীতি টিকে আছে এখনও। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ ভারতের রাজনীতিতে, যেখানে জনজীবন আপাতভাবে কিছুটা শান্তশিষ্ট মনে হলেও সমাজের 'গণতান্ত্রিক মুখ' তথা ঔপনিবেশিক নগরায়ণের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তার জায়গা করে নিচ্ছে খোলাখুলি টাকার হাওলাদার, বড়ো সংস্থা, ফিনান্সের ক্রমবর্ধমান শক্তি। রাজ্য তৃণমূল সেখানে কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের পশ্চিমি কর্পোরেট নীতির সমান্তরালে স্বাধীন কারিগরদের সমাজ গড়ে তোলার নামে রাজনৈতিক ভোটের স্থিতাবস্থা বজায় রেখে বিদেশে সম্পদ লুঠের কারবারি চালিয়ে যেতে চায়। গান্ধীজির পঞ্চায়েতি রাজনীতি এতটাও নিকৃষ্ট ছিল না সেই বিচারে ।

এই গেল পারিপার্শ্বিক অবস্থা। আমাদের এখানে বিকল্পভাবে বামপন্থী রাজনীতি সত্তরের দশকে ছাত্র-যুবদের নকশাল রাজনীতির মধ্যে দেখা গেছিল, যারা মূলত কৃষকের জমির অধিকারকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা করার দাবি তুলেছিল সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু চিনা কমিউনিস্ট নেতৃত্বের 'গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা'র জায়গায় 'শহর দিয়েই গ্রাম ঘিরে ফেলা'র অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে জানা আছে আমার। আমি ওই প্রজন্মের নই, তাই আমার অনেক অভিজ্ঞতাই পুঁথিগত। কিন্তু চলাফেরা যতটুকু করি আশপাশে, মানুষের কাজের জগৎ, কথা বলার ধরন থেকে পথেঘাটেই ইতিহাসের অনেক উপাদান খুঁজে পাই আমি। ফলে সবসময় তত্ত্ব পড়ে কেতাবি ব্যাখ্যা দেবার দরকার পড়ে না। আপনি বলেছেন যে, চরের বাঙালিদের অভিজ্ঞতা থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করার ক্ষেত্রে কেতাবি সূত্রের উল্লেখ সবসময় করতে পারবেন না। সে-ক্ষেত্রে বলব, একটা তত্ত্বের বইও লেখা হয় তথ্য বিশ্লেষণ করেই। আর সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয় আশপাশের জনজীবন থেকেই। সমাজতত্ত্ব গণিতের মতো অতটাও যান্ত্রিক নয় যে, বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও সেটা নির্মাণ করা যাবে। বরং অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির বিরাট ভূমিকা আছে সেখানে। পুঁথিবাগীশদের বোঝার কথা নয় সেটা। আপনার প্রজন্ম সেই সংঘর্ষ, ঘুমপাড়ানি তত্ত্বের জাল ছিঁড়ে ষাটের রাজনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী ভাবতে চেয়েছিল বলে মনে হয় আপনার কথা থেকে। তাই বইয়ের মতবাদ থেকে ষাটের দশকের পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট প্রজন্মকে বোঝা উচিত হবে না। আর তা-ই যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন আপনি, তার বিবরণ লিখে যাওয়াটা আপনার দায়িত্ব উত্তর প্রজন্মের কাছে।

☆ ☆ ☆

প্রসঙ্গত এঙ্গেলসের 'পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি'র কথা বলেছেন। আপনার প্রজন্মের প্রথাবিরোধী মেধাশক্তি অনুযান করতে পারি, কারণ ম্যাট্রিকের ছাত্র হয়েই আপনি এই গ্রন্থের একটা সমালোচনা তৈরি করেছেন! আমি কলেজ লেভেলের শেষের দিকে এই বইটি পড়ি। সমালোচনা এখন আমার আছে একরকম। এই প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব কিছু মত দেব এঙ্গেলসের এই অসাধারণ কাজটি সম্পর্কে।

এই বইটি এঙ্গেলস লেখেন মার্কসের মৃত্যুর এক বছর পরেই তড়িঘড়ি করে। কারণটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমরা মার্কসবাদের চর্চা যারা করেছি, তারা জানি যে, সমাজতন্ত্রের পরিণতিতে কমিউনিস্ট সমাজে রাষ্ট্র লোপ পাবার কথা বলা হয়েছে। এঙ্গেলসের এই বইটি সেই রাষ্ট্রবিলোপের তত্ত্বে প্রথম স্মরণীয় সিলমোহর। এখানেই আসল মজা। লেনিনও পরবর্তীতে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব'-এ রাষ্ট্র লোপ পাবার এঙ্গেলসীয় ভাষ্যকে নানা কায়দায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কিন্তু আমি পড়াশোনা করে জানতে পেরেছি যে, এঙ্গেলস বা লেনিন উভয়েই কিছুটা ছলনা করেছেন মার্কসের মতামতের সাথে। আর সবটাই হয়েছে মার্কস মারা যাবার পর। শেষ বয়সের মার্কসের অনেকটাই অনালোচিত লেখাপত্র দেখে আমি পরিষ্কার বুঝেছি যে, কমিউনিস্ট সমাজেও রাষ্ট্র থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছেন তিনি। এঙ্গেলস বা লেনিন ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রবিলোপের পক্ষে ছিলেন। তাই বলে নিজেদের ব্যক্তিগত মতামতকে মার্কসের ঘাড় দিয়ে চালিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?

কথাটা পাড়লাম এই কারণে যে, আপনারা সিন্ধু সভ্যতায় যে লোকায়ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, সেটা কি সবসময়ই লেনিনের কথা অনুযায়ী 'শ্রেণিশোষণের যন্ত্র' ছিল? যদি তা-ই হত, তাহলে সিন্ধু জনতার মতো স্বাধীন গণতন্ত্রী সমাজের ওপর থেকে কিছু চাপাতে গেলে হিতে বিপরীতই হত বরং। প্রত্নতথ্য কিন্তু সেরকম সাক্ষ্য দেয় না। ফলে কার্ল মার্কস নামক গবেষকটিকে নিয়ে মার্কসীয় রাজনীতির বাইরে নিয়ে গিয়ে চর্চা হওয়া প্রয়োজন। আমার আরও অনেক নিজস্ব মত আছে মার্কসীয় তত্ত্বের জগৎ নিয়ে।এটা গেল উপরিতলের রাষ্ট্র সম্পর্কে 'পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি'র সীমাবদ্ধতার কথা। এবার বলব সমাজতলের বিকাশ সম্পর্কে উক্ত গ্রন্থটির কিছু সীমাবদ্ধতার কথা।

এঙ্গেলস বলেছেন যে, আরণ্যক সমাজ থেকে জমি বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে কৃষিসভ্যতা ও নগরায়ণ, বাণিজ্যপীড়িত সমাজ জন্ম নিয়েছে। একক তত্ত্বের আধারে সমাজের ঘটনাবলিকে তত্ত্বায়িত করতে গিয়ে এঙ্গেলসও বলতে পারেননি ঠিক কীভাবে রাষ্ট্র তৈরি হল। 'এমন একটা বিন্দুতে' উপজাতীয় সমাজ পৌঁছে গেছিল, যেখানে নাকি আর আদিম সাম্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না; সেই সমাজ বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ভেঙে গেল এবং তার স্থলবর্তী হল রাষ্ট্র নামের একটি সামাজিক সংগঠন এরকম মন্তব্য আছে বইটিতে। মর্গান তাঁর মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় এমন কোনো কথা সরলীকৃত করে বলেননি। পরিবারের গঠনতন্ত্র নিয়ে তাঁর কাজ ছিল মূলত। কিন্তু এঙ্গেলস মর্গানের 'আদিম সমাজ'-এর রিভিউ করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে গোঁজামিল দিচ্ছেন নিজের রাষ্ট্রবিরোধী নৈরাজ্যকে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে।

এ ক্ষেত্রে আমার ধারণায় বদল এনেছে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য। যে আদিবাসী সমাজ দেখি আমরা, তাদের সমাজেও কঠোর সামাজিক নিয়ম দেখি। যেন এই প্রথাগুলি তাদের সমাজের আইনি ব্যবস্থা। সিন্ধু সভ্যতার আগেও আদিবাসী সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল বলে তো শুনিনি কখনও। বরং বিদায়ী সিন্ধু সভ্যতার আঞ্চলিকতার পর্যায়ে কৃষিবর্জিত বহু মানুষ আরণ্যক জীবনে ফিরে গেছিল বলে আমার মনে হয়েছে। এই হিসেবে আদিবাসী সমাজ ভেঙে রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার এঙ্গেলসীয় ধারণার ত্রুটি ধরা যাবে না বলে আমার মনে হয়। আদিবাসী জগতের সাথে বিদায়ী সিন্ধু সভ্যতাকে সম্পর্কিত না করলে ঝাড়খণ্ডের অসুর জাতির সাথে অসুর-উপাসক পার্সিদের সম্পর্কের বিষয়েও সঠিকভাবে আলোকপাত করা যাবে না হয়তো। বাংলাতেও বোধহয় আগত সিন্ধুবাসীরা দীর্ঘদিন কৃষিবর্জিত অবস্থাতেই ছিল। নাহলে পঞ্চনদের গম চাষ বাদ দিয়ে এখানে এতটা ধানের চাষের প্রচলন ঘটল কীভাবে? পূর্ব ভারতে ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রধান খাদ্য। আগত সিন্ধুবাসীরা যদি বঙ্গদেশে দীর্ঘদিন কৃষিচ্যুত হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের জীবনযাপনে কিছু দ্ৰাবিড় বা মোঙ্গলীয় প্রভাব মিশে থাকা সম্ভব। একেই আমাদের মুখের গঠনে দ্রাবিড় মোঙ্গলীয় ছাপ পরিষ্কার, আবার আমাদের প্রধান খাবার হিসেবে ভাতেরব্যবহার এই দুই জাতির থেকে গ্রহণ করে থাকতে পারি আমরা। বাংলার খাদ্য- সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

আপনার থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটো নতুন কথা জানলাম। নীচে বলব সেগুলি।

প্রথমত, আওয়ামী লিগ সম্পর্কে আমাদের জানানো হয় এটি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, অমুক তমুক ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি তার জায়গায় বলছেন আওয়ামী লিগের লুঠপাট, হিন্দু জনতাকে ব্যাপক হারে ভিটেছাড়া করার কথা। এইসব তথ্য এদিকে মিডিয়াগুলো আসতে দেয় না বলে শুনি। আপনি পূর্ববঙ্গের মানুষ। আপনিও এই একই কথা বলছেন দেখে বিষয়টা বুঝলাম ভালোভাবে।

দ্বিতীয় একটা চমৎকার জিনিস জানলাম আপনার আগের পত্র থেকে। অস্থায়ী চরের ওপর অস্থিতিশীল জনজীবন সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন আপনি। নির্দিষ্ট জমির সাথে বাঁধা না পড়ে চরের ভাঙন-নির্মাণের ওপর একটা জনগোষ্ঠী বেঁচে থাকলে তাদের মধ্যে যাযাবরসুলভ প্রবণতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে আরও। আপনার ওই অংশটুকু পড়ার পর যাযাবর জাতির সমাজের গঠন নিয়ে কিছুটা ভাবছি আপাতত। এ বিষয়ে কিছুটা পড়াশোনাও দরকার আমার আপাতত। তবে আমার ইচ্ছে রইল পূর্ববঙ্গের নদীতে চরা পড়ায় যে এলাকা গজিয়ে ওঠে, তার ওপর ভ্রাম্যমাণ জনসমাজকে কাছ থেকে দেখার। চইরা বাঙালির জীবনযাপন থেকে বাঙালি মুসলমানের প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি অভিনব আমার কাছে। আপনার সেইসব লেখা আমি পড়িনি এখনও উপলব্ধির ঘাটতির দরুন। ভবিষ্যতে পড়ব যে-কটা বই পাব। ধারণাটা পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন।

'আনন্দবাজার পত্রিকা' নামে একটি নামী পত্রিকা বেরোয় এদিকে। আমার অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন ছিল: পশ্চিমবঙ্গে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, অথচ এখানে মুসলমান সংখ্যায় কম। আবার পূর্ববঙ্গে সেন রাজারা পালিয়ে গেছিল, তবু সেখানে মুসলমান সংখ্যায় বেশি। তাহলে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে ধর্মান্তরিত হবার সম্পর্কটা সেভাবে নেই, অন্তত অ্যাকাডেমিক সার্কেলে যেভাবে পড়ানো হয়। 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় এই বিষয়ে একটা সম্পাদকীয় পাতার নিবন্ধ দেখেছিলাম ক-মাস আগে। পেলে আপনাকে পাঠাব। নিবন্ধটিতে মুসলিম শাসক কর্তৃক পূর্ববঙ্গের কৃষি অর্থনীতিকে সমর্থন ও কব্জা করার মধ্য দিয়ে সেখানে ইসলাম-সমর্থক জনতা তৈরি হয়েছিল বলে লেখা ছিল।

সমকালীন বিশ্ব-পরিস্থিতির কথা এসেছিল আপনার গত পত্রে। ইউক্রেন যুদ্ধ যে বর্তমান বিশ্ব-রাজনীতির পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, সেটা আমিও মনে করি। বিশেষ করে পেট্রোডলার কারেন্সির ব্যাপক সংকটের সাথে এই যুদ্ধের হারজিতের বিষয়টা সরাসরি যুক্ত বলে আমার মনে হয়। পাকিস্তানের মুদ্রার হার একেবারেই তলানিতে। চিন নিজের সিল্করুটে কোনোরকম রাজনৈতিক শজারু চায় না দেখছি; আগাছা মুড়িয়ে পথ মসৃণ করা তার নীতি। সম্প্রসারণ আর সাম্রাজ্যের আকাঙ্ক্ষার ওপর বিশ্বের মোড়লদের নৈতিকতা দাঁড়িয়ে আছে। এর ঠিক বিপরীতে থাকবে সিন্ধু সভ্যতার জনকল্যাণমূলক সমাজনীতি। রাষ্ট্রনীতিও এর বাইরে নয়। এই মহাসভ্যতার গৌরবে যাতে উপমহাদেশ ছেয়ে না-যায়, সেই জন্যেই হয়তো সিন্ধু সভ্যতার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না। আবার পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যায় মহেঞ্জোদড়োর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনগুলিকে এই অবহেলা করাটা হয়তো পৃথিবীর সাম্রাজ্যের ধ্বজাধারীদের পরিকল্পিত কাজ, যাতে আমাদের নজর ওই দিকে না-যায়!

আপাতত এখানেই শেষ করব। বয়সজনিত কারণে আপনার চোখের সমস্যার কথাটা বিবেচনায় রেখেই বলছি আপনি অল্প লিখেও জানাতে পারেন নিজের মত। লেখায় অবশ্য আবেগ প্রকাশের দিকটাও বিবেচনায় রাখছি আমি। স্মৃতি থেকে আহরণ করে এনে সে-সব অতীতের কথা লেখা আপনার কাছে যথেষ্ট শ্রমসাধ্য বিষয় এই বয়সে। সুস্থ থাকবেন আপনি। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করে আজকের মতো বিদায় নেব আমি। ধন্যবাদ।

ইতি  – অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Mar 7, 2023, 8:13 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আপনার গত ৪ মার্চ ২০২৩ তারিখের পত্র পড়তে গিয়ে, পশ্চিম বঙ্গে যাওয়া পূর্ব বঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুদের যে সামান্য দুর্দশার বিবরণটুকু দিয়েছিলেন, সেটুকুই মনকে ব্যথিত করার জন্য যথেষ্ট। আমি এই ভয়ঙ্কর চিত্র ১৯৭১ এবং ১৯৮৪ সালে পশ্চিম বঙ্গে যাবার পর দেখেছি। ভার আগে দেখলেও আমার মনে নাই। কারণ তখন আমি নেহাত ষষ্ঠ শ্রেণীর বালক। আমার নানীর জন্মস্থান বীরভূম জিলার রাজনগর। আমার নানার সঙ্গে বিবাহ সূত্রে তিনি এ বঙ্গের মানুষ হয়েছেন। কিন্তু তার ভাই-বোন এবং কিংবা তাদের সন্তানরা কেউ এ বঙ্গে বসত করে নাই। যাইহোক, আমার মা এবং আমার নিজেরও জন্ম রাজনগরে। রাজনগরে একাধিকবার গেলেও আমার সে ধরনের স্মৃতিকাতরতা বা নস্টালজিয়া থাকবার কারণ নাই। তবে আমার মা এবং বিশেষত আমার নানীর স্মৃতিকাতরতা আমি দেখেছি এবং অনুভব করেছি। মাতৃভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করায় আমার নানী কোনও দিন পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে পারেন নাই।

যাইহোক, আমার নিজের পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকেও আমি বুঝেছি জন্মভূমির টান কত প্রবল বা গভীর হতে পারে একটা মানুষ কিংবা জনগোষ্ঠীর জীবনে। সেই সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গে উদ্বান্ত হিন্দুদের জীবনের যে ভয়ঙ্কর দুর্দশার চিত্র স্বচক্ষে দেখেছি তার স্মৃতি আমাকে সর্বদা কষ্ট দিয়েছে এবং এখনও দেয়। মানবেতিহাসের একটা উল্লেখযোগ্য ট্র্যাজেডি রচিত হয়েছে ১৯৪৭-এর বাংলা ভাগে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের এই তিক্ত ফল আজও বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়কে ভোগ করতে হচ্ছে। এদেশ ত্যাগের স্লোভ আজও অব্যাহত রয়েছে। স্বদেশ-স্বভূমি চ্যুতি এবং উদ্বাস্তু জীবনের অনন্ত বেদনার এক গাথা রচনা করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক তার 'মেঘে ঢাকা তারা'য়। হয়ত দেখেছিলেন। আজও যখন ঐ চলচ্চিত্রের কথা মনে হয় তখন মনটা গভীর বেদনায় ভরে উঠে।

পূর্ব বঙ্গের উদ্বাস্তুদের প্রতি দিল্লীর উদাসীনতার কথা মনে করে আমি চিরকালই মনে ক্ষোভ ঘোষণ করেছি। আসলে হিন্দুদেরও চরিত্রের অনেক সমস্যা আছে। এত বেশী নিরাসক্ত, নির্লিপ্ত, আত্মকেন্দ্রিক এবং সঙ্কীর্ণ যারা হয় তাদের কপালে এমন দুর্গতি জুটাই স্বাভাবিক। হিন্দুদের নিয়ে আমার জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় নানানভাবে কাটিয়েছি। তাদের অনেক গুণ আছে বা ছিল, কিন্তু তাদের যে দোষগুলির বর্ণনা দিলাম এগুলির কারণে তাদের সব গুণ বিফলে গেছে।

যাইহোক, ক্ষোভের কথা থাক। আজকের পশ্চিম বঙ্গে যে লুম্পেন চরিত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে তা কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালীর মধ্যে এক সময় সেভাবে ছিল না। পাকিস্তান কালে ত্যাগ, সততা, নিষ্ঠার মহিমা নিযে হিন্দু সমাজ আমাদের সামনে উজ্জ্বল ছিল। আজ সময়ের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সে কালের কম্যুনিস্টদের অনেক সমালোচনা আমরা করতে পারি। কিন্তু মুসলিম বাঙ্গালী সমাজের মত এত নিকৃষ্ট একটা জনগোষ্ঠীর সামনে প্রধানত হিন্দু সমাজ থেকে আগত কম্যুনিস্টরা ছিল সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগ ও সংগ্রামের মূর্ত রূপ। এছাড়া হিন্দু সমাজের শিক্ষক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের অনেক গুণের প্রশংসা আমরা আমাদের ছেলেবেলায় আমাদের গুরুজনদের কারও কারও কাছ থেকে শুনতাম। শুধু সাহিত্য পাঠ বা ব্যাপক অধ্যয়ন নয়, ঐ মানুষগুলি সম্পর্কে আমাদের বিশেষত আমার অভিজ্ঞতাও আমার মনোভূমি নির্মাণে অনেকখানি ভূমিকা রেখেছে। জানেনই তো যে, অষ্টম শ্রেণী থেকেই আমি ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত। ফলে মুসলিম সমাজের তুলনায় অনেক বেশী গুণের অধিকারী হিন্দুদের দৃষ্টান্ত আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। কাজেই এ দেশে হিন্দুদের উপর মুসলিমদের সকল নিপীড়ন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর ঘৃণা ও আক্রোশ সেই বালক বা কিশোর বয়স থেকে আমার মনে ক্রমবর্ধমানভাবে সঞ্চিত হয়েছে।

যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গে হিন্দু বাঙ্গালীর এই অধঃপতন আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। আমি দীর্ঘকাল ধরে বুঝতে চেয়েছি কেন এমন হয়েছে? আসলে পূর্ব বঙ্গের এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ছিন্নমূল জীবনে মানবেতর জীবন যাপনের অভিজ্ঞতা তাদের আত্মমর্যাদা বোধ এবং সেই সঙ্গে নীতি-নৈতিকতা বোধকেও ধ্বংস করেছে। ফলে তারা পরিণত হয়েছে লুম্পেনে। আমার অনুমান পশ্চিম বঙ্গে যে জনসংখ্যা আছে তার কমপক্ষে অর্ধেকই পূর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মানুষ। সংখ্যাটা বিশাল।

সম্ভবত প্রধানত এই জনসংখ্যার উপর নির্ভর করেই পশ্চিম বঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় গিয়েছিল। এক সময় ধারণা করেছিলাম পশ্চিম বঙ্গের জন্য বামফ্রন্ট এক যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে পারে বিভিন্ন কর্মসূচী বিশেষত ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে।

পশ্চিম বঙ্গের ভূমি সংস্কারের উপর আমার নিজেরও কিছু পর্যবেক্ষণ ছিল। আমি বাংলাদেশের সরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস (Bangladesh Institute of Development Studies) - এর একটা প্রকল্পে কিছুকাল চাকুরী করেছিলাম। সেই সময় পশ্চিম বঙ্গে ভূমি প্রশাসন এবং ভূমি সংস্কারের কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা সংগ্রহের জন্য ১৯৯১ সালে বিআইডিএস থেকে আমরা দুইজন গবেষক পশ্চিম বঙ্গ ভ্রমণ করি। আমরা পশ্চিম বঙ্গ সরকারের সহায়তায় অনুসন্ধান পরিচালনার সুযোগ লাভ করি। আমার সঙ্গী গবেষক কাজ শেষ করে চলে এলেও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আমি আরও কিছু বাড়তি সময় থেকে যাই। মাসাধিক কাল আমি ছিলাম। আমাদের যৌথ এবং আমার একক অনুসন্ধানের সময়টায় আমি পশ্চিম বঙ্গে মন্ত্রী থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের কৃষক পর্যন্ত বহু সংখ্যক মানুষের সঙ্গে কথা বলি। সরকারী সহায়তা থাকায় অল্প সময়ে পশ্চিম বঙ্গের কয়েকটি জেলার গ্রামাঞ্চলে ভ্রমণ করা সম্ভব হয়।

সেই সময় মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান থেকে আমি বেশ উৎসাহিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশে ফিরে আমি যেসব প্রতিবেদন তৈরী করি সেগুলি এখানেও যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। একটা ছিল আমাদের দুইজনের যৌথ প্রতিবেদন। আর বাকী লেখা আমার ব্যক্তিগত। যাইহোক, একাধিক সংবাদপত্রে আমার লেখা বেরিয়েছিল।

পশ্চিম বঙ্গের ভূমি সংস্কার সম্পর্কে আমার উচ্ছ্বাস বা প্রত্যাশার একটা বড় কারণ ছিল এই ধারণা যে, এর ফলে পশ্চিম বঙ্গে শিল্পায়নের পথে অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। এটা হচ্ছে রাশিয়া, চীনের অভিজ্ঞতা থেকে অর্জিত আশাবাদ। পরে ক্রমে বুঝেছি যে, পশ্চিম বঙ্গে ভূমি সংস্কার করে বামফ্রন্ট বরং পশ্চিম বঙ্গের আরও ক্ষতি করেছে। কারণ তাদের এই কাজের ফলে পশ্চিম বঙ্গে ভূমিভিত্তিক যেটুকু বিত্তবান শ্রেণী ছিল সেটুকুকেও শেষ করে দিয়েছে; অথচ বামফ্রন্ট শিল্পোদ্যোক্তা শ্রেণীও গড়তে চায় নাই বা পারে নাই তাদের ব্যক্তিমালিকানার প্রতি ঘৃণা বা বিরূপতা থেকে। মাঝখানে পশ্চিম বঙ্গ হারিয়েছে তার কৃষিভিত্তিক সমৃদ্ধ শ্রেণীর অবশেষটুকুকেও। অসংখ্য ছোট ছোট জোতে কৃষিশক্তির বিভাজন কৃষির শক্তিকেও ধ্বংস করেছে। না হয়েছে কৃষকদের সম্মিলিত বৃহৎ খামার, না হয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় হোক আর ব্যক্তি মালিকানায় হোক শিল্পোদ্যোগে পুঁজির প্রবাহ। শেষ পর্যন্ত ছোট ছোট জোভের কৃষকরাও জমি বিক্রী করে অথবা উৎপাদক- শক্তি হিসাবে গুরুত্ব হারিয়ে সর্বহারা শ্রেণীর সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি করেছে। বাস্তবে আগে থেকে অস্তিত্বমান লুম্পেন শ্রেণীকে আয়তনে ও শক্তিতে বিরাট করে দিয়ে গেছে বামফ্রন্ট। কম্যুনিস্টরা নিজেরা চরিত্রগতভাবে লুশেন নয়। ফলে স্বাভাবিক নিয়মে প্রকৃত লুম্পেনরা সর্বস্তরে এবার লুম্পেন শাসন কায়েম করেছে পশ্চিম বঙ্গে। মমতা এবং তৃণমূল হচ্ছে লুম্পেন শ্রেণীর প্রকৃত প্রতিনিধি।

আসলে নিজ সমাজের বাস্তবতা না বুঝে আর এক সমাজের অভিজ্ঞতাকে যান্ত্রিকভাবে এবং একই সঙ্গে খণ্ডিতভাবে প্রয়োগের পরিণতি এমনই হয়। সমগ্র ভারত হচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের তৈরী করে দেওয়া একটা রাষ্ট্র। তার একটা প্রদেশে আর এক দেশের বিপ্লব পরবর্তী অভিজ্ঞতার খণ্ডিত প্রয়োগ এমন সর্বনাশই ডেকে আনে।

অবশ্য এটা পশ্চিম বঙ্গের আজকের পরিণতি সম্পর্কে আমার বুঝ। আপনারা তো সেখানে বাস করেন। সুতরাং আর কোনও ব্যাখ্যা থাকতে পারে কিনা সে সম্পর্কে আপনারা আরও ভালো বলতে পারবেন।

যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গের এই দশা আমাকে যথেষ্ট হতাশ করেছে। কারণ আমি এটা বুঝি যে, বাংলাদেশে এক অর্থে বিপ্লব করা কিংবা কোনও বিপ্লবী শক্তির পক্ষে ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু সেই শক্তির সামাজিক ভিত্তি এখানে অর্থাৎ মুসলিম সমাজের ভিতরে সেভাবে নাই। বিশেষ করে ইসলামের সঙ্গে তার চৈরা চরিত্রের সম্মিলন এখানে ভয়ানক বাধা। সুতরাং আমার কল্পনায় সর্বদা বিশেষত পশ্চিম বঙ্গ কাজ করে। অথচ বাস্তব হচ্ছে এই যে, পশ্চিম বঙ্গেও সেই সামাজিক ভিত্তি নাই ।

সামাজিক ভিত্তি না থাকলে শুধু ধারণা বা চিন্তা তথা তত্ত্ব দিয়ে কিছু হয় না। মুহাম্মদ তার জন্মস্থান মক্কা নগরে সেই সামাজিক ভিত্তি পান নাই বলে সেখানে ইসলাম নিয়ে দাঁড়াতে পারেন নাই। এর জন্য তাকে যেতে হয়েছিল মদীনার মত পশ্চাৎপদ এলাকায়, যেখানে গিয়ে তিনি পেয়েছিলেন যুদ্ধ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ প্রবণ বেদুইনদের আবেষ্টন বা সামাজিক ভিত্তি।

যাইহোক, পশ্চিম বঙ্গে কখন কী হবে তা জানি না। স্বাভাবিক, সুস্থ ও উৎপাদনশীল অর্থনীতি সেখানে কখন আবার গড়ে উঠবে তা জানি না। তবে চরিত্রগত বা মর্মগতভাবে হিন্দু সমাজ অনেক বেশী উৎপাদনশীলতামুখী। ফলে সেখানে পুনর্জাগরণ ঘটতে পারে। আর এখানে ঘটতে পারে যখন-তখন একটা স্ফুরণ বা বিস্ফোরণ, এখানকার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। এখন দেখা যাক কখন কোনটা ঘটে।

তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনা সংযোগে দ্রুত উলটপালট ঘটা সম্ভব। একদিকে অস্থির জনচরিত্র, আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, দুষ্কৃতি ও সন্ত্রাস, অপর দিকে ভারত ও বিভিন্ন পরাশক্তির টানাপোড়েন এ দেশে কখন কী ঘটাবে তা বলা যায় না। কিন্তু যে পরিবর্তন ঘটুক অস্থির-অনিশ্চিত এবং unpredictable জনচরিত্রের উপর নির্ভর ক'রে ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন ঘটানো যাবে কী করে? ক্ষমতা এবং সুযোগ হাতে পেলে এ সমাজের বেশীর ভাগ মানুষ কী করে সেটা আমার খুব ভালো রকম জানা আছে। সুতরাং এর একটা সমাধান হিসাবে ভারত থেকে এ দেশের ভূমি সন্তান অমুসলিমদের প্রত্যাবর্তনের কর্মসূচীর কথা বলেছি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে। আসলে আমার উদ্দেশ্য বিশেষত সকল অমুসলিম বাঙ্গালীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের সামাজিক রূপান্তর ঘটানো। এ প্রসঙ্গে আমার একটা নিবন্ধই আছে বঙ্গরাষ্ট্রে এই শিরোনামে 'ভূমি সন্তানদের প্রত্যাবর্তন : বাংলাদেশে বাঙ্গালী জাতির সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনের প্রধান শর্ত' (http://bangarashtra.net/article/1498.html)। লিংকে গিয়ে দেখতে পারেন। কী হবে তা তো জানি না। তবে আমার যে কাজ সেটা করে চলেছি। মার্কসবাদ সম্পর্কে আমার কিছু সমালোচনামূলক রচনা বা গ্রন্থ আছে। তার মধ্যে আপনি দুইটি পড়তে পারেন - 'মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ' (http://bangarashtra.net/article/395.html ) এবং 'মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্ক'(http://bangarashtra.net/article/413.html) আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন' বন্ধ করে দেওয়ার ফলে বই দুইটার কোনটাই এখন বাজারে পাওয়া যায় না। তবে 'বঙ্গরাষ্ট্রে' দেওয়া আছে। তার লিংক দিলাম। সময় করে দেখতে পারেন।

আমার অধিকাংশ লেখাই বঙ্গরাষ্ট্রে দেওয়া আছে। সুতরাং সাইটে ঢুকে একটু কষ্ট করে খোঁজ করলে সেগুলি পাবেন। তবে লেখার সংখ্যা তো খুব অল্প নয়। সুতরাং শিরোনাম দেখে কিছু লেখায় চোখ বুলাতে পারেন।

ঠিক জীবনী আকারে না হলেও আমার অভিজ্ঞভাজাত অনেক উপলব্ধিকে আমি এভাবে বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় অনেক ঝুঁকি নিয়েও লিখেছি। বঙ্গরাষ্ট্র হয়ত পশ্চিম বঙ্গ বা ভারতের বাঙ্গালীরা সেভাবে পড়ে না। পড়লে সেটা আমি বুঝি নাই। যদিও এক সময় কোন জায়গা থেকে কতটা হিট হয় সেটা জানবার ব্যবস্থা ছিল। তখনও পশ্চিম বঙ্গ কিংবা কলকাতা থেকে তুলনায় অনেক কম হিট হত দেখতাম। আর সাড়া তো কিছুই পেতাম না। বাংলাদেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেক হিট হত। অনুমান করতাম প্রবাসী বাংলাদেশীদের হিট সেগুলি। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মস্কো এবং রাশিয়া থেকেও কিছু হিট নিয়মিতভাবে হত। জানি না সেখান থেকে কারা দেখত। হয়ত আমাদের ইংরাজী লেখার জন্য সেসব হিট ছিল।

যাইহোক, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে সরকার আঘাত করায় বঙ্গরাষ্ট্র অনেক দিন বন্ধ ছিল। চালু করলেও অনেক কিছুই আর আগের মত নাই। আমি আগে অনেক কিছু চেক করতে পারলেও সেই ব্যবস্থা এখন নাই। এসব ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যয়ও করতে হয়। নিজ ব্যক্তিগত সামর্থ্যে কোনও ক্রমে ‘বঙ্গরাষ্ট্র’কে টিকিয়ে রাখছি। এখানে কিছু সংখ্যক লেখক পাই যারা সাহস করে বঙ্গরাষ্ট্রে লেখা দেন। বাংলাদেশে যে আমাদের একটা পাঠক গোষ্ঠী আছে সেটা যেমন বুঝি তেমন লেখা নিয়ে কিছু মতবিনিময়ও হয়। কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমরা বিস্ময়কর সাড়া পেয়েছি। আমার নিজের লেখার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। আমি মার্কসবাদের উপর ক্রিটিক হিসাবে ১৯৮৯ সালে 'মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ' লিখলে ঐ সময়ই এটা বাংলাদেশের প্রয়াত বিখ্যাত সাহিত্যিক আহমদ ছফা কর্তৃক সম্পাদিত সাপ্তাহিক পত্রিকা 'উত্তরণ'-এ সেটা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এরপর এটা প্রয়াত গবেষক ডঃ লেনিন আজাদ তার প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ‘প্রাচ্যবিদ্যা প্রকাশনী' থেকে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। পরবর্তী কালে আমি এটা ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন' থেকে প্রকাশ করি।

'মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ' ছিল সবমিলিয়ে মার্কসবাদের নির্মোহ সমালোচনা। সুতরাং এ বই প্রকাশের ফলে অনেক কমিউনিস্টিই আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কমিউনিজমের প্রতি অন্ধ অনুরাগ থাকা সত্ত্বেও ডঃ আজাদ আমার বইটা প্রকাশ করেছিলেন। ফলে তিনি তার মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট মহলে তীব্র নিন্দার সম্মুখীন হন। কিন্তু তার মনে হয়েছিল সকল বিপ্লবকামীর বইটা পড়া উচিত। আমার দুঃখ লাগে এ কথা ভেবে যে, আমার স্নেহভাজন পণ্ডিত মানুষটি অনেক বছর আগে তুলনায় খুব অল্প বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

লেনিন আজাদের চিন্তার স্ববিরোধ এবং দুর্বলতার অনেক সমালোচনা আমার আছে। কিন্তু তার এই উন্মুক্ত ও জিজ্ঞাসু মনের মাহাত্ম্যকে আমি অস্বীকার করব কেমন করে? এ বঙ্গে আমি এমন আরও মানুষ দেখেছি যাদের সমতুল্য কোনও মানুষই আমি পশ্চিম বঙ্গে দেখি নাই।

এ বঙ্গের অস্থির-অনিশ্চিত মানুষদের নিয়েও আমার বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা আছে। এক দিক থেকে দেখলে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা' প্রকাশের পরের অভিজ্ঞতা আমার জন্য অনেক সময় হয়েছিল হতভম্বকর। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে, বলতে গেলে একটু সমর্থন বা মূল্যায়নের আশায় পশ্চিম বঙ্গে ছুটে গেছি। ১৯৯১ থেকে এই ছুটা শুরু। '৯০-তে লিখা 'ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান' নিয়ে এই যাত্রা শুরু। বারবার ফিরে এসেছি খালি হাতে। সঙ্গে কিছু তিক্ততাও নিয়ে। অথচ প্রকাশিত না হলেও ঐ পাণ্ডুলিপিরও এখানে কিছু সমাদর পেয়েছিলাম। এরপর ২০০৩-এর জানুয়ারী মাসে 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা'র যে সমাদর এখানে পেয়েছিলাম সেটার কথা যখন মনে হয় তখন আমি আমার দ্বারা নিদারুণভাবে সমালোচিত এই সমাজের প্রতিও কখনও কৃতজ্ঞতা অনুভব করি।

একটা বিস্ময়কর ঘটনার কথা জানাই। 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা' প্রকাশের কিছুদিন পরের কথা। তখন বিএনপি ক্ষমতাসীন। '৭৫ পরবর্তী কালে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে বামধারা থেকে অনেকে তাতে যোগ দেয়। আমি এর বিরোধী ছিলাম। কিন্তু অভিন্ন ধারা বিশেষ করে প্রকাশ্য সংগঠন ন্যাপ থেকে অনেকে বিএনপিতে যোগ দেওয়ায় বিভিন্ন সময়ে কারও কারও সাথে দেখা হত। তাদের একজন ছিলেন আমাদের পার্টির এক সময়কার তরুণ বিপ্লবী কর্মী। আমার অনেক বয়োকনিষ্ঠ। তিনি এক সময় গোপন কম্যুনিস্ট পার্টির সশস্ত্র যোদ্ধাও ছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পর তিনি পার্টি ছেড়ে দেন। বিএনপির মধ্যে সাবেক বাম যারা সততার জন্য প্রশংসিত ছিলেন তাদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। আমার সঙ্গে কখনও সময় কাটাতে তিনি পছন্দ করতেন। তখন তিনি ক্ষমতাসীন বিএনপির প্রতিমন্ত্রী। আমার প্রকাশনের অফিসে তিনি মাঝে মাঝে সরকারী গাড়িতে করে আসতেন। সম্ভবত ২০০৩-এরই ঘটনা। কারণ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা' নিয়ে তখন ঢাকার পাঠক মহলে উচ্ছ্বাস চলছিল। তিনি নিজেও অবশ্য বইটা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এবং তার মতামতকে আমি গুরুত্বও দিতাম, কারণ তিনি ছিলেন অধ্যয়নশীল মানুষ। তখন তিনি বইটার একটা প্রকাশনা উৎসব কিংবা একটা সেমিনার করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে সেখানে বিএনপির আরও ২/১ জন মন্ত্রী যেমন বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব এবং মন্ত্রী মান্নান ভূঁইয়াও থাকবেন। ভদ্রলোক অনেক আগে প্রয়াত হয়েছেন। তিনি আমার এক বছরের সিনিয়র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমরা এক হলে থাকতাম এবং এক ছাত্র সংগঠন করতাম। তার বিষয় ছিল ইতিহাস। কিন্তু আমি সে প্রস্তাবে কর্ণপাত করি নাই।

আমি বহুকাল চিন্তা করেছি প্রস্তাবটা গ্রহণ করলে কি ভুল হত, নাকি ঠিক হত! আসলে আমি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে নিজের নামকে সংশ্লিষ্ট করতে চাই নাই। এরপর হয়ত আমার উপর নানানভাবে চাপ আসত বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য। তা না হলে হয়ত তিক্ততা বাড়ত। আসলে আমার সত্তাকে রক্ষার জন্য আমি খুব সতর্ক থাকবার চেষ্টা করেছি।

আবার মাঝে মাঝে চিন্তা করি 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা'র বক্তব্য যদি বিএনপি সরকার নিত তাতে আমার কী ক্ষতি হত? বরং আমাদের চিন্তাটা যাদের হাত দিয়েই হোক পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করত। আমরা হয়ত আড়ালে চলে যেতাম। কারণ রাষ্ট্রের শক্তি আমি বুঝি। রাষ্ট্রের শক্তির কারণে বক্তব্যটা প্রতিষ্ঠা পাবার পথে অনেক এগিয়ে যেতে পারত। হয়ত তখন মার্কিন নিবাসী প্রত্নতত্ববিদ ডঃ রফিক মোগলকেও বাংলাদেশ সরকার আনতে পারত। এখানে প্রতিষ্ঠানগুলি যেভাবে আমাদেরকে উপেক্ষা করেছে তখন সেখানকার পণ্ডিতরাই বরং এই বক্তব্যের প্রবক্তা হয়ে মাঠে নামত। যেহেতু বিএনপি আমাদেরকে পেত না তার দলে সেহেতু শেষ পর্যন্ত এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় আমাদের বহিষ্কার ছিল অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়। অবশ্য যদি শেষ পর্যন্ত সেমিনারটা হত তবে হয়ত ভাই হত। যাইহোক, যা হয় নাই, ভা নিয়ে এখন আর গবেষণা করে লাভ নাই।

বলা যায় আমার এই সামগ্রিক কর্মধারার বাইরেই ক্রমশ চলে গেছে পশ্চিম বঙ্গ বা ভারতের বাঙ্গালীদের অবস্থান। ক্বচিৎ কদাচিৎ ২/১ টা লেখা পাঠানো আর তা প্রকাশের মধ্যে এক দীর্ঘ সময় আমাদের সম্পর্ক সীমাবদ্ধ ছিল। সেটাও ক্রমশ ক্ষয়ে গিয়েছিল। এমন একটা সময়ে আপনার পত্রপ্রাপ্তি।

সামগ্রিকভাবে বললে বলতে হয় আপনি আমাদের সামনে একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছেন। পশ্চিম বঙ্গ না হোক, বিশেষত ভারতের অবাঙ্গালী কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে আমাদের পত্রের মাধ্যমে মতবিনিময় হয়েছে। কিন্তু আপনার সঙ্গে মতবিনিময়ের গুরুত্ব আমাদের কাছে ভিন্ন রকম হয়ে দেখা দিয়েছে। আপনার প্রশ্ন এবং মতামত আমাদেরকে বহুকিছু নূতনভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে। গ্রাম-নগর ইত্যাদির পার্থক্য বা সম্পর্ক নিয়ে আপনার প্রশ্নগুলির যথাযথ উত্তর পেতে আমাদের অনেক কিছু নূতন করে বুঝতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা আপনার এই সিরিয়াসনেস আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। আমরা অনুভব করেছি আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবার মত বাঙ্গালী তবে আছেন একজন ওপার বাংলায়! কখনও কখনও আপনার একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চঞ্চল আর আমি স্কাইপের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘন্টা কথা বলেছি। সত্যান্বেষীরা খুব সিরিয়াস মানুষ হয়। সুতরাং আমরা দুইজনও খুব সিরিয়াস মানুষ। আর তাই আপনার এক একটা পত্র আমাদের সামনে শুধু নূতন নূতন চ্যালেঞ্জ নয়, উপরক্ত আনন্দের সম্ভারও নিয়ে আসে। আসলে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের জন্য এ ধরনের 'ডিসকোর্স' লাগে। আপনি খাদ্য ও নৃতাত্বিক বিষয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, মতও দিয়েছেন। গম ও ধানের প্রসঙ্গে বলেছেন যে, সিন্ধুর অভিবাসীরা পূর্ব ভারত কিংবা বঙ্গে দীর্ঘকাল কৃষিবর্জিত হয়ে থাকতে পারে। তা না হলে এখানে গম থেকে ধান চাষে তারা গেল কী করে?

সিন্ধু সভ্যতায় গম ও যবের পাশাপাশি ধানেরও উৎপাদন হত। এ বিষয়টা আমরা সিন্ধু থেকে গঙ্গায় উল্লেখ করেছি। ১ম খণ্ডের ১ম অধ্যাযেও আমরা ধান চাষের বিষয় উল্লেখ করেছি। এই অধ্যায়ের ওয়েবসাইটের ২৫ নং পাতায় 'কৃষি' শিরোনামের পরিচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘হরপ্পান পর্যায়ে রুটির গম, যব, তিল, জোয়ার, মটরশুটি, তরমুজ, খেজুর, সর্যের বিভিন্ন প্রজাতি, ধান, ভুট্টা, এবং ভুলা চাষ হত।' আরও জায়গায় সিন্ধু সভ্যতায় অন্যতম খাদ্য হিসাবে চাল বা ধানের কথা আমরা বলেছি। আপনি হয়ত ভুলে গেছেন বা খেয়াল করেন নাই। এত কিছু মনে রাখাও অবশ্য কঠিন।

যাইহোক, ধান বা চালের প্রসঙ্গে আমি বলব, শুধু সিন্ধু সভ্যতাকে আমাদের সেই কালের ভারতবর্ষের একমাত্র প্রাচীন কৃষিভূমি ভাবাটা ভুল হতে পারে। ভারতবর্ষের আরও বিভিন্ন স্থানে কৃষি জানা জনগোষ্ঠী থাকতে পারে। তবে তারা সভ্যতা গঠনের পর্যায়ে যেতে পারে নাই। হাজার হাজার বছর ধরে এসব মানুষ বিভিন্ন স্থানের জলবায়ুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিভিন্ন প্রকারের শস্য উৎপাদন করা শিখতে পারে।

এখানে আমার জানা একটা বিহারী পরিবারের কথা বলতে পারি। বিহারে থাকা অবস্থায় তারা তিন বেলা গমের আটার রুটি খেত। কিন্তু বাংলায় আসবার পরে হজমের সমস্যা হওয়ায় তারা শুধু সকালে নাস্তা হিসাবে রুটি আর দুপুর ও রাতে ভাত খেতে অভ্যস্ত হয়। এই একই কারণে পূর্ব বঙ্গে আগত বিহারীরাও ভেতো বাঙ্গালীতে পরিণত হয। অর্থাৎ জলবায়ুর কারণেও মানুষের খাদ্যাভ্যাস বদলাতে পারে। আজকের অনেকাংশে শুষ্ক বাংলা নয়, বরং জলা-জঙ্গলময় ও ভ্যাপসা গরম সেই প্রাচীন বঙ্গভূমির কথাও চিন্তা করতে হবে।

এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই আজকের মত বিদায় নিবার আগে। আপনি ভগবান সিং-এর The Vedic Harappans পড়েছেন কিনা জানি না। এটা ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত। একটা ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলনের ফসল হিসাবে ঋগ্বেদকে ধরতে না পারলেও সামগ্রিক বিচারে গ্রন্থটিকে আমি ‘মাস্টারপিস’ হিসাবে বিবেচনা করি। ঋগ্বেদের ভাষাতাত্বিক বিচার থেকে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তার সম্পর্ক স্থাপনে তিনি অসাধারণ ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন। সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশে ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে তার ধারণার সঙ্গে আমাদের ধারণা অনেকাংশে মিলে যায়। তার ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞান মানব সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার সম্পর্কে আমাদের অনুমানকে অনেক শক্তি যুগিয়েছে।

যাইহোক, মানুষ এবং সামাজিক গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে আমার যে ধারণা হয়েছে তা থেকে আমার মনে হয়েছে মানব প্রজাতি যেখানে থেকেই আসুক মানব সভ্যতার জন্মস্থান ভারতভূমি। তারও অনেক আগে বহু লক্ষ বৎসর কাল পূর্বে যে এখানে আদি মানুষদের হাতিয়ার পাওয়া গেছে সে সম্পর্কে আমাদের উল্লেখ সম্ভবত আপনি ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র ১ম খণ্ডে পড়েছেন। ৭০ বা ৮০ হাজার বছর কিংবা একলক্ষ বছর আগে একদল মানুষ আফ্রিকা থেকে বের হতে পারে। তবে তারও অনেক লক্ষ বছর আগে থেকে মানুষ দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করত।

এটা এখন প্রত্নতাষিকভাবে প্রমাণিত। তবে সভ্যতার উন্মেষ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত আমার ধারণা অনুমান নির্ভর। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দুইটি পৌরাণিক সাহিত্য আমার অনুমানকে প্রাথমিক ভিত্তি যুগিয়েছে। একটি রামায়ণ, অপরটি মহাভারত। আপনি ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা' পড়েছেন। সুতরাং এই দুই সাহিত্য সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন আপনি জানেন। রামায়ণ থেকে আমরা লাঙ্গল চাষ-নির্ভর কৃষির উদ্ভবের ঘটনা ও সময়কে বুঝতে চেয়েছি। সময় সম্পর্কে আমাদের অনুমান বলেছি যে, আজ থেকে ১৭ বা ১৮ হাজার বছর আগে কোনও এক সময়। তখন হিম যুগ বা বরফ যুগ তার চূড়ান্ত সীমায়। এরপর তার ক্ষয় শুরু। আমাদের মনে হয়েছে এটা এ ধরনের যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটবার উপযুক্ত সময়।

আর মহাভারতকে বলেছি প্রাক-নগর ও প্রাক-রাষ্ট্র থেকে নগর ও রাষ্ট্র গঠনে উত্তরণকালে একটা সংঘাতের অভিঘাতকে ধারণ করে গড়ে উঠা একটা মহাকাব্য। আমার অনুমান ঘটনাটা বর্তমান সিন্ধু বা হরপ্পান সভ্যতা গঠনের অনেক পূর্ববর্তী কালের। সম্ভবত ক্যাম্বে উপসাগরের গর্ভে নিমজ্জিত নগরকে কেন্দ্র করে যে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলে আমি অনুমান করি সেই সভ্যতার ঊষাকালের কোনও যুগান্তকারী সংঘাতের বীজ-কাহিনীকে অবলম্বন করে এই মহাকাব্য গড়ে উঠেছে পরবর্তীকালে।

তবে এখন পর্যন্ত এটা আমার ব্যক্তিগত অনুমান যেটার সপক্ষে আমি কোনও প্রত্নতাত্বিক সাক্ষ্য বা প্রমাণ দিতে পারব না। ফলে মহাভারত নিয়ে এ ধরনের কোনও আলোচনাও আমরা করি না। তবে আমার কথা যদি বলেন তবে আমি বলব, মানব জাতির সভ্যতার সূতিকাগার বা জন্মভূমি হচ্ছে ভারভবর্ষ। এখানে এটা স্মরণাতীত কাল ধরে একটু একটু করে বিকশিত হয়েছে। এবং সেটা হয়েছে প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে এবং জনসমাজের অনেকটাই স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে। হয়ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এখানে মানুষ তাদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সভ্যতার একটা ভিত্তি গড়ে তুলেছে অনেকটাই পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে। বাধ্যতা যেটা ছিল সেটা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ভূ-প্রাকৃতিক; মানবিক নয়। যখন প্রাকৃতিক কারণে মানুষ পথ পরিবর্তন করেছে তখন সেটা হয়েছে নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ মতবিনিময়, অভিজ্ঞতার বিনিময়ের মাধ্যমে। এটাই মনে হয় যে, এ ক্ষেত্রে হিম যুগ বা Ice Age-এর একটা নির্ধারক ভূমিকা ছিল, যেমনটা ভগবান সিং বলেছেন। হিম যুগের চাপে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগের মানুষ ভারতবর্ষের বিষুব রেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। এখানে এসে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বিভিন্ন উপজাতি, গোত্র, ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিভক্ত মানুষরা পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতির নীতির ভিত্তিতে বাস করতে বাধ্য হয়েছিল। ভগবান সিং-এর এই বিশ্লেষণ বা পর্যবেক্ষণ আমার কাছে অসাধারণ এবং অথণ্ডনীয় মনে হয়েছে। তার এই পর্যবেক্ষণ থেকে ভারতবর্ষের সমাজের বহু বৈশিষ্ট্যের উৎস খুঁজে পাওয়া সহজ হয়।

আসলে হিম যুগের মধ্যে লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার ইতিহাসের অনেক রহস্যময়তার উৎস। যাইহোক, আমি মনে করি, ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতা হাজার হাজার বছর ধরে মূলত ভিতর থেকে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে। সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের একটা পর্যায়ে পৌঁছে যখন সমাজ আটকে গেছে তখন অধিকতর অগ্রগমনের শক্তি আঘাত করে যখন বাধা ভাঙ্গতে গেছে তখন ঘটেছে যুদ্ধ বা সংঘাত। এখানকার সমাজ বিকাশের নিয়ম অনুযায়ী অন্য সমাজের তুলনায় অনেক তুচ্ছ হলেও এখানকার জনমানসে সেগুলিই প্রলয়ঙ্করী রূপ নিয়ে দেখা দেয়। রামায়ণ, মহাভারতের মত তখন সেসব সংঘাতের কাহিনী মানুষকে যুগ যুগ ধরে অভিভূত করে রাখে।

তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ বিকাশধারার ঐতিহ্যের প্রচণ্ড শক্তির ফলে ভারতবর্ষে ভিতর থেকে কখনই মিসর, মেসোপটেমিয়া এবং চীনের মত নির্দয় ও সহিংস ধারায় সভ্যতা গড়ে উঠে নাই। এক কলিঙ্গ যুদ্ধের অনুতাপ থেকে সম্রাট অশোক তার মত-পথ সবই পরিবর্তন ক'রে চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হয়েছেন।

মানুষ এবং সমাজতত্ব সম্পর্কে আমার যেটুকু জ্ঞান জন্মেছে তা থেকে আমি এ কথা বলতে পারি যে, বেশী রকম সহিংস সমাজ বা তার আবেষ্টন থেকে কোনও নূতন উপাদান বিকাশ লাভ করতে পারে না। সুতরাং এমন আদিম সমাজ থেকেও সভ্যতা জন্ম নিতে পারে না। কারণ তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হবে। কাজেই আমার ধারণা ভারতবর্ষের বাইরে যে সভ্যভাগুলি আমরা দেখি কোনো না কোনো ভাবে সেগুলির প্রত্যেকটির উৎস ভারতবর্ষ। অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে ভারত থেকে সভ্যতার অধিকারী তথা সভ্যতা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের অধিকারী জনগোষ্ঠীসমূহ মিসর, মেসোপটেমিয়া কিংবা চীনে গিয়ে সভ্যতা গড়েছে। বৈরী পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে তাদেরকে হিংসা এবং বলপ্রয়োগের আশ্রয় নিতে হয়েছে। ভারতে যেখানে অযুত অযুত বছর কালের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সভ্যতার পথে তাদের সুস্থির যাত্রা হয়েছিল অভিগমনের ফলে সেই যাত্রায় আকস্মিক ছেদ ঘটেছে। নূতন ভূমিতে তাদের শত্রুদেরকে সহিংসভাবে মোকাবিলা করতে হয়েছে, সভ্যতা গড়তে প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি পেতে হয়েছে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। এবং ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে সভ্যতা নির্মাণের জন্য তাদের পক্ষে নূতন করে হাজার হাজার বছর পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না, জ্ঞান ও প্রযুক্তি জানা থাকায় সেই অপেক্ষার প্রয়োজনও ছিল না। সুতরাং ভারতের বাইরে সর্বত্র সভ্যতা নির্মাণে এত নির্দয়তা ও রক্তাক্ততা।

আসলে যে পরিস্থিতিতে ভারতে মূলত শান্তিপূর্ণভাবে সভ্যতা নির্মাণ করা সম্ভব ছিল সেই পরিস্থিতি ভারতের বাইরে আর কোথায়ও সেভাবে না থাকায় অন্য সবখানেই সভ্যতার গতিধারায় এত সহিংসতা এবং বলপ্রয়োগ। বুঝা যায় অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের মানুষ মানুষকে সেভাবে দমন ও শাসন না করে প্রকৃতিকে দমন ও শাসন করার যে পথ উদ্ভাবন করেছিল সেটাই তাকে নদীশাসনের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতা গড়বার পথে নিয়ে গিয়েছিল। চিরকাল এক পথে বা এক ভাবে চলা যায় না। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে পথ চলতে গিয়ে ভারতবর্ষকে অপরিমেয় দুঃখও পেতে হয়েছে। তবে সেটা এখানে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

তবে এ প্রসঙ্গ শেষ করার আগে আমি এটুকু বলি যে, প্রাক-মুসলিম যুগ পর্যন্ত মানব সভ্যতায় ভারতবর্ষের ভূমিকা যা হয়ে থেকেছে তাকে রূপকাকারে বললে বলা যায় গুরুগৃহের ভূমিকা। হ্যাঁ, ভারতবর্ষ যেন হাজার হাজার বছর ধরে হয়ে থেকেছে মানব সভ্যতার গুরুগৃহ। তা ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সচরাচর যায় নাই। বরং সমস্ত পৃথিবীকে দিয়েছে সভ্যতা থেকে অর্জিত জ্ঞান। এ জ্ঞান নিয়ে গিয়ে কেউ গড়েছে রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য, কেউ গড়েছে ধর্ম, কেউ বা এখান থেকে নিয়ে গেছে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার চর্চা।

ভারতবর্ষের সবশেষ বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বঙ্গভূমি সংলগ্ন নালন্দা। সুতরাং এটাও ছিল গুরুগৃহ। অনেক বড় মাপের গুরুগৃহ, যেখানে দেশ-বিদেশের হাজার হাজার ছাত্র আসত বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যাশিক্ষার জন্য। মুসলিম হানাদার বক্তিয়ার খলজী এটাকে ধ্বংস করে। মুসলিম হানাদারদের আগ্রাসনের পর ভারতবর্ষে উল্লেখ করার মত আর কোনও গুরুগৃহ অবশিষ্ট না থাকলেও সমগ্র ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে ক্ষুদ্র আয়তনে ছড়িয়ে ছিল লক্ষ লক্ষ গুরুগৃহ। শুধু গ্রামীণ সমাজের নয়, অধিকক্ত সমগ্র ভারতীয় জন-সমাজেরও স্বশাসনের ব্যবস্থা হিসাবে পঞ্চায়েতের মত সেগুলিও শেষাবধি টিকে ছিল স্বমহিমায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা গ্রামীণ এবং সেই সঙ্গে সমগ্র ভারতীয় জন-সমাজকেও লণ্ডভণ্ড করার পাশাপাশি এই গুরুগৃহগুলিকেও ধ্বংস করল তাদের কর্মনীতি দ্বারা। কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ঘটে গেছে এক মহাজাতির জীবনে এ কথা ভাবতেও কষ্ট হয়।

অনেকটা সময় নিলাম আপনার। আসলে আপনার মতামত এবং প্রশ্ন অনেক কিছু ভাবতে অনুপ্রাণিত করে। আর তাতেই আমাদের আনন্দ। এই আনন্দ সবাই দিতে পারে না। সুতরাং তার জন্যও আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই মনের ভিতর থেকে।

এখন আমাদের যৌথ পত্র রচনায় মন দিব। শুভ কামনা জানিয়ে বিদাই নিই।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

 

Mar 7, 2023, 10:08 PM

প্রিয় মানিকবাবু

আপনার দীর্ঘ ব্যক্তিগত পত্রটি পেয়ে খুব ভালো লাগল। কয়েকটি নতুন ধারণাও তৈরি হল আপনার পূর্ববর্তী পত্র থেকে; কিছু ধারণার পরিবর্তনও হল বলা চলে। পর্যায়ক্রমে সে-কথায় আসব।

আগেই আপনি বলেছেন যে, ষাটের দশকের আপনাদের প্রজন্ম কমিউনিস্ট রাজনীতির পূর্বতন ঐতিহ্য থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল। আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির জন্যই হোক বা সমকালীন কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কারাগারবন্দি হবার দরুনই হোক, আপনার প্রজন্ম এমন একটা অবস্থায় গিয়ে পড়েছিল, যেখানে কিছু করতে হলে আত্মসক্রিয় হতেই হত তাদেরকে। অন্তত আপনার কথা থেকে সে-কথা ভালোই বুঝেছি।

পঞ্চাশের দশক অবধিও বাংলাভাগ, উদ্বাস্তুদের স্রোত, সরকারগুলোর নামমাত্র সহায়তার ঘূর্ণিপাকে কী অবস্থাই না ছিল ভিটেছাড়া মানুষগুলোর! আমার পাড়াটা এপার বাংলার লোকদের বসতি মূলত। কিন্তু পাশের পাড়া প্রফুল্লনগর অনেকটাই কলোনি। আমার পাড়ার আশপাশে বিস্তর কলোনি আছে। রেললাইনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে থাকি আমি। চার নম্বরের ওপারে বস্তির পর বস্তি। রেলের লাইন ধরে প্রচুর বস্তি ছিল। এ সবই পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের আবাসস্থল। ইদানীং প্রোমোটারেরা পয়সা ঢেলে আর 'বিশেষ অনুরোধ' করে সে-সব জমি দখল করে পেল্লায় ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। গোটা দশ- পনের বছর কাঁচা টাকা প্রচুর বেড়েছে উড়ো প্রোমোটারদের। এই ব্যবস্থা শেষের দশ-পনের বছরের বাম জমানাই করে দিয়েছিল। আপনি ঠিকই বলেছেন: বাম রাজনীতির গোছানো গাছ থেকে আপেল পেড়ে খাচ্ছে আর খাওয়াচ্ছে আজকের স্যাটার্নের দল। প্রবাদই আছে আমার টাউনের নামে: চালাও পানসি বেলঘরিয়া। এরকম নিরিবিলি টাউনে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর কাছের মানুষের বাড়ি থেকে কুড়ি কোটি টাকা পাওয়া থেকে শুরু; তারপর সব জায়গাতেই প্রচুর অচল টাকা পাওয়া যাচ্ছে। বিষয়টা আমাদের কাছেও হাস্যকর। অনেকের আক্ষেপ: পাশের বাড়িতেই যদি এত টাকা আছে জানতাম, কবেই দোকানদারি ছেড়ে ডাকাতি ধরে ফেলতাম! দেখুন, টাকা দেখে চোখ কীভাবে ছানাবড়া হয়ে যায় এখন লোকের। এই অর্থগৃধ্ন মানসিকতা তৈরি হয়েছে নব্বই দশকের সোভিয়েত-পরবর্তী 'মুক্ত হাওয়া'র ফলশ্রুতিতে। আমি আমার ছোট্টো টাউনের কথাটুকু বললাম। তবে লেবার ক্লাসের সমাজে কাঁচা টাকার এই হঠাৎ আমদানি তৃণমূল জমানায় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এই প্রোমোটারি চক্র, অবৈধ কারবারির চক্র প্রায় পুরো উত্তর কলকাতা-লাগোয়া এলাকা জুড়ে ছেয়ে আছে। আমাদের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এতটা গভীরে হয়তো হাত দেবে না নিজেদেরই নিরাপত্তার কথা ভেবে। শুনছি, দুবাই এখন অতীত; সিঙ্গাপুর থেকে থাইল্যান্ডকে ঘিরে বড়োসড়ো অর্থপাচারের র‍্যাকেট তৈরি হয়েছে, যার সাথে আমাদের মহামান্য বঙ্গবিভূষণ সরকারের মন্ত্রীদের আর্থিক লেনদেনের যোগ রয়েছে বিস্তর। কিন্তু একটু নীচের সমাজে দেখুন, অভাব-কষ্ট বলতে যা বোঝায়, তাকে হাবিজাবি সরকারি ভাতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। আবার অতি সাধারণ ঘরের ছেলেপুলেদের টোটো চালানো থেকে দোকানপাট, এককথায় ছোটো উদ্যোগের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে বর্তমান সরকারের। বণ্টনে বিস্তর অব্যবস্থা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিপুল দুর্নীতি সত্ত্বেও সরকারের প্রধানের 'সদিচ্ছা' দেখে সাধারণ সমাজ যথেষ্ট আপ্লুত। ফলে একদম হেটো কথায় বলতে গেলে, 'খেটে-খাওয়া' সমাজকে 'মানবিক সাহায্য' দিয়ে যতটা সম্ভব হাতে রাখার চেষ্টা রয়েছে বর্তমান রাজ্য সরকারের। এই জন্যেই কেন্দ্রীয় সরকার ওপর থেকে তদন্ত চালালেও, সরকারি প্রতিষ্ঠান অকেজো হওয়ার বিরুদ্ধে শিক্ষিত সমাজ প্রতিরোধ করলেও একেবারে লেবার ক্লাস বলতে যা বোঝায়, তাদের খুব বেশি হেলদোল নেই। তবে হ্যাঁ, এই নীচু সমাজটা বেঁকে বসলেই বিপদ সরকারের। তাই আপনার কথা অবশ্যই ঠিক যে, তৃণমূলের পৃষ্ঠপোষকতায় খাটুয়া সমাজ থেকে একটা বিপুল লুম্পেন বাহিনী তৈরি হয়েছে, যার ওপর শিক্ষিত সমাজের নিয়ন্ত্রণ নেই, নিয়ন্ত্রণটা আছে উড়ো মাফিয়াদের, যারা নিজেরাও এক অর্থে লুম্পেন। গত বাম জমানায় সরকারের কাছে বিক্রীত শিক্ষিত সমাজ এই লেবার ক্লাসকে মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করত। আজ তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের হাতের বাইরে এই সমাজ চলে গেছে। ফলে রাজ্যের শিক্ষা দুর্নীতি বা কেন্দ্রীয় কৃষি আইনের বিরুদ্ধে পশ্চিম ভারতে কৃষকদের যে আন্দোলনই হোক, প্রাতিষ্ঠানিক বামপন্থী আন্দোলন এখন এলিট, পয়সাওয়ালা লোকদের নিয়ে মচ্ছব করছে মূলত। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাম-কংগ্রেসি রাজনীতির শহুরে বাবুতন্ত্র একবারেই শেষ বলা চলে উত্তর ভারতে। মধ্য ভারতের রাজনীতিতে বিহারকে ঘিরে কিছুটা হলেও স্থানীয় এলিট রাজনীতি টিকে আছে এখনও। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ ভারতের রাজনীতিতে, যেখানে জনজীবন আপাতভাবে কিছুটা শান্তশিষ্ট মনে হলেও সমাজের 'গণতান্ত্রিক মুখ' তথা ঔপনিবেশিক নগরায়ণের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তার জায়গা করে নিচ্ছে খোলাখুলি টাকার হাওলাদার, বড়ো সংস্থা, ফিনান্সের ক্রমবর্ধমান শক্তি। রাজ্য তৃণমূল সেখানে কেন্দ্রের এনডিএ সরকারের পশ্চিমি কর্পোরেট নীতির সমান্তরালে স্বাধীন কারিগরদের সমাজ গড়ে তোলার নামে রাজনৈতিক ভোটের স্থিতাবস্থা বজায় রেখে বিদেশে সম্পদ লুঠের কারবারি চালিয়ে যেতে চায়। গান্ধীজির পঞ্চায়েতি রাজনীতি এতটাও নিকৃষ্ট ছিল না সেই বিচারে।

এই গেল পারিপার্শ্বিক অবস্থা। আমাদের এখানে বিকল্পভাবে বামপন্থী রাজনীতি সত্তরের দশকে ছাত্র-যুবদের নকশাল রাজনীতির মধ্যে দেখা গেছিল, যারা মূলত কৃষকের জমির অধিকারকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা করার দাবি তুলেছিল সশস্ত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু চিনা কমিউনিস্ট নেতৃত্বের 'গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা'র জায়গায় 'শহর দিয়েই গ্রাম ঘিরে ফেলা'র অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে জানা আছে আমার। আমি ওই প্রজন্মের নই, তাই আমার অনেক অভিজ্ঞতাই পুঁথিগত। কিন্তু চলাফেরা যতটুকু করি আশপাশে, মানুষের কাজের জগৎ, কথা বলার ধরন থেকে পথেঘাটেই ইতিহাসের অনেক উপাদান খুঁজে পাই আমি। ফলে সবসময় তত্ত্ব পড়ে কেতাবি ব্যাখ্যা দেবার দরকার পড়ে না। আপনি বলেছেন যে, চরের বাঙালিদের অভিজ্ঞতা থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সমাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করার ক্ষেত্রে কেতাবি সূত্রের উল্লেখ সবসময় করতে পারবেন না। সে-ক্ষেত্রে বলব, একটা তত্ত্বের বইও লেখা হয় তথ্য বিশ্লেষণ করেই। আর সেই তথ্য সংগ্রহ করা হয় আশপাশের জনজীবন থেকেই। সমাজতত্ত্ব গণিতের মতো অতটাও যান্ত্রিক নয় যে, বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলেও সেটা নির্মাণ করা যাবে। বরং অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির বিরাট ভূমিকা আছে সেখানে। পুঁথিবাগীশদের বোঝার কথা নয় সেটা। আপনার প্রজন্ম সেই সংঘর্ষ, ঘুমপাড়ানি তত্ত্বের জাল ছিঁড়ে ষাটের রাজনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী ভাবতে চেয়েছিল বলে মনে হয় আপনার কথা থেকে। তাই বইয়ের মতবাদ থেকে ষাটের দশকের পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট প্রজন্মকে বোঝা উচিত হবে না। আর তা-ই যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন আপনি, তার বিবরণ লিখে যাওয়াটা আপনার দায়িত্ব উত্তর প্রজন্মের কাছে। প্রসঙ্গত এঙ্গেলসের 'পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি'র কথা বলেছেন। আপনার প্রজন্মের প্রথাবিরোধী মেধাশক্তি অনুমান করতে পারি, কারণ ম্যাট্রিকের ছাত্র হয়েই আপনি এই গ্রন্থের একটা সমালোচনা তৈরি করেছেন! আমি কলেজ লেভেলের শেষের দিকে এই বইটি পড়ি। সমালোচনা এখন আমার আছে একরকম। এই প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব কিছু মত দেব এঙ্গেলসের এই অসাধারণ কাজটি সম্পর্কে।

এই বইটি এঙ্গেলস লেখেন মার্কসের মৃত্যুর এক বছর পরেই তড়িঘড়ি করে। কারণটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমরা মার্কসবাদের চর্চা যারা করেছি, তারা জানি যে, সমাজতন্ত্রের পরিণতিতে কমিউনিস্ট সমাজে রাষ্ট্র লোপ পাবার কথা বলা হয়েছে। এঙ্গেলসের এই বইটি সেই রাষ্ট্রবিলোপের তত্ত্বে প্রথম স্মরণীয় সিলমোহর। এখানেই আসল মজা। লেনিনও পরবর্তীতে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব'-এ রাষ্ট্র লোপ পাবার এঙ্গেলসীয় ভাষ্যকে নানা কায়দায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। কিন্তু আমি পড়াশোনা করে জানতে পেরেছি যে, এঙ্গেলস বা লেনিন উভয়েই কিছুটা ছলনা করেছেন মার্কসের মতামতের সাথে। আর সবটাই হয়েছে মার্কস মারা যাবার পর। শেষ বয়সের মার্কসের অনেকটাই অনালোচিত লেখাপত্র দেখে আমি পরিষ্কার বুঝেছি যে, কমিউনিস্ট সমাজেও রাষ্ট্র থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছেন তিনি। এঙ্গেলস বা লেনিন ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রবিলোপের পক্ষে ছিলেন। তাই বলে নিজেদের ব্যক্তিগত মতামতকে মার্কসের ঘাড় দিয়ে চালিয়ে দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত?

কথাটা পাড়লাম এই কারণে যে, আপনারা সিন্ধু সভ্যতায় যে লোকায়ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, সেটা কি সবসময়ই লেনিনের কথা অনুযায়ী 'শ্রেণিশোষণের যন্ত্র' ছিল? যদি তা-ই হত, তাহলে সিন্ধু জনতার মতো স্বাধীন গণতন্ত্রী সমাজের ওপর থেকে কিছু চাপাতে গেলে হিতে বিপরীতই হত বরং। প্রত্নতথ্য কিন্তু সেরকম সাক্ষ্য দেয় না। ফলে কার্ল মার্কস নামক গবেষকটিকে নিয়ে মার্কসীয় রাজনীতির বাইরে নিয়ে গিয়ে চর্চা হওয়া প্রয়োজন। আমার আরও অনেক নিজস্ব মত আছে মার্কসীয় তত্ত্বের জগৎ নিয়ে। এটা গেল উপরিতলের রাষ্ট্র সম্পর্কে 'পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি'র সীমাবদ্ধতার কথা। এবার বলব সমাজতলের বিকাশ সম্পর্কে উক্ত গ্রন্থটির কিছু সীমাবদ্ধতার কথা।

এঙ্গেলস বলেছেন যে, আরণ্যক সমাজ থেকে জমি বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে কৃষিসভ্যতা ও নগরায়ণ, বাণিজ্যপীড়িত সমাজ জন্ম নিয়েছে। একক তত্ত্বের আধারে সমাজের ঘটনাবলিকে তত্ত্বায়িত করতে গিয়ে এঙ্গেলসও বলতে পারেননি ঠিক কীভাবে রাষ্ট্র তৈরি হল। 'এমন একটা বিন্দুতে উপজাতীয় সমাজ পৌঁছে গেছিল, যেখানে নাকি আর আদিম সাম্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না; সেই সমাজ বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ভেঙে গেল এবং তার স্থলবর্তী হল রাষ্ট্র নামের একটি সামাজিক সংগঠন- এরকম মন্তব্য আছে বইটিতে। মর্গান তাঁর মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় এমন কোনো কথা সরলীকৃত করে বলেননি। পরিবারের গঠনতন্ত্র নিয়ে তাঁর কাজ ছিল মূলত। কিন্তু এঙ্গেলস মর্গানের 'আদিম সমাজ'-এর রিভিউ করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে গোঁজামিল দিচ্ছেন নিজের রাষ্ট্রবিরোধী নৈরাজ্যকে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে।

এ ক্ষেত্রে আমার ধারণায় বদল এনেছে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য। যে আদিবাসী সমাজ দেখি আমরা, তাদের সমাজেও কঠোর সামাজিক নিয়ম দেখি। যেন এই প্রথাগুলি তাদের সমাজের আইনি ব্যবস্থা। সিন্ধু সভ্যতার আগেও আদিবাসী সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল বলে তো শুনিনি কখনও। বরং বিদায়ী সিন্ধু সভ্যতার আঞ্চলিকতার পর্যায়ে কৃষিবর্জিত বহু মানুষ আরণ্যক জীবনে ফিরে গেছিল বলে আমার মনে হয়েছে। এই হিসেবে আদিবাসী সমাজ ভেঙে রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার এঙ্গেলসীয় ধারণার ত্রুটি ধরা যাবে না বলে আমার মনে হয়। আদিবাসী জগতের সাথে বিদায়ী সিন্ধু সভ্যতাকে সম্পর্কিত না- করলে ঝাড়খণ্ডের অসুর জাতির সাথে অসুর-উপাসক পার্সিদের সম্পর্কের বিষয়েও সঠিকভাবে আলোকপাত করা যাবে না হয়তো। বাংলাতেও বোধহয় আগত সিন্ধুবাসীরা দীর্ঘদিন কৃষিবর্জিত অবস্থাতেই ছিল। নাহলে পঞ্চনদের গম চাষ বাদ দিয়ে এখানে এতটা ধানের চাষের প্রচলন ঘটল কীভাবে? পূর্ব ভারতে ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রধান খাদ্য। আগত সিন্ধুবাসীরা যদি বঙ্গদেশে দীর্ঘদিন কৃষিচ্যুত হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের জীবনযাপনে কিছু দ্ৰাবিড় বা মোঙ্গলীয় প্রভাব মিশে থাকা সম্ভব। একেই আমাদের মুখের গঠনে দ্রাবিড়- মোঙ্গলীয় ছাপ পরিষ্কার, আবার আমাদের প্রধান খাবার হিসেবে ভাতের ব্যবহার এই দুই জাতির থেকে গ্রহণ করে থাকতে পারি আমরা। বাংলার খাদ্য- সংস্কৃতির প্রাচীন ঐতিহ্য সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।

আপনার থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটো নতুন কথা জানলাম। নীচে বলব সেগুলি।

প্রথমত, আওয়ামী লিগ সম্পর্কে আমাদের জানানো হয় এটি যুক্তিযুদ্ধের সংগঠন, অমুক তমুক ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনি তার জায়গায় বলছেন আওয়ামী লিগের লুঠপাট, হিন্দু জনতাকে ব্যাপক হারে ভিটেছাড়া করার কথা। এইসব তথ্য এদিকে মিডিয়াগুলো আসতে দেয় না বলে শুনি। আপনি পূর্ববঙ্গের মানুষ। আপনিও এই একই কথা বলছেন দেখে বিষয়টা বুঝলাম ভালোভাবে।

দ্বিতীয় একটা চমৎকার জিনিস জানলাম আপনার আগের পত্র থেকে। অস্থায়ী চরের ওপর অস্থিতিশীল জনজীবন সম্পর্কে কিছু কথা বলেছেন আপনি। নির্দিষ্ট জমির সাথে বাঁধা না পড়ে চরের ভাঙন-নির্মাণের ওপর একটা জনগোষ্ঠী বেঁচে থাকলে তাদের মধ্যে যাযাবরসুলভ প্রবণতা পরিষ্কার হয়ে ওঠে আরও। আপনার ওই অংশটুকু পড়ার পর যাযাবর জাতির সমাজের গঠন নিয়ে কিছুটা ভাবছি আপাতত। এ বিষয়ে কিছুটা পড়াশোনাও দরকার আমার আপাতত। তবে আমার ইচ্ছে রইল পূর্ববঙ্গের নদীতে চরা পড়ায় যে এলাকা গজিয়ে ওঠে, তার ওপর ভ্রাম্যমাণ জনসমাজকে কাছ থেকে দেখার। চইরা বাঙালির জীবনযাপন থেকে বাঙালি মুসলমানের প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি অভিনব আমার কাছে। আপনার সেইসব লেখা আমি পড়িনি এখনও উপলব্ধির ঘাটতির দরুন। ভবিষ্যতে পড়ব যে-কটা বই পাব। ধারণাটা পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন।

'আনন্দবাজার পত্রিকা' নামে একটি নামী পত্রিকা বেরোয় এদিকে। আমার অনেকদিন ধরেই প্রশ্ন ছিল: পশ্চিমবঙ্গে সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, অথচ এখানে মুসলমান সংখ্যায় কম। আবার পূর্ববঙ্গে সেন রাজারা পালিয়ে গেছিল, তবু সেখানে মুসলমান সংখ্যায় বেশি। তাহলে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার সাথে ধর্মান্তরিত হবার সম্পর্কটা সেভাবে নেই, অন্তত অ্যাকাডেমিক সার্কেলে যেভাবে পড়ানো হয়। 'আনন্দবাজার পত্রিকা'য় এই বিষয়ে একটা সম্পাদকীয় পাতার নিবন্ধ দেখেছিলাম ক-মাস আগে। পেলে আপনাকে পাঠাব। নিবন্ধটিতে মুসলিম শাসক কর্তৃক পূর্ববঙ্গের কৃষি অর্থনীতিকে সমর্থন ও কব্জা করার মধ্য দিয়ে সেখানে ইসলাম-সমর্থক জনতা তৈরি হয়েছিল বলে লেখা ছিল।

সমকালীন বিশ্ব-পরিস্থিতির কথা এসেছিল আপনার গত পত্রে। ইউক্রেন যুদ্ধ যে বর্তমান বিশ্ব-রাজনীতির পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, সেটা আমিও মনে করি। বিশেষ করে পেট্রোডলার কারেন্সির ব্যাপক সংকটের সাথে এই যুদ্ধের হারজিতের বিষয়টা সরাসরি যুক্ত বলে আমার মনে হয়। পাকিস্তানের মুদ্রার হার একেবারেই তলানিতে। চিন নিজের সিল্করুটে কোনোরকম রাজনৈতিক শজারু চায় না দেখছি; আগাছা মুড়িয়ে পথ মসৃণ করা তার নীতি। সম্প্রসারণ আর সাম্রাজ্যের আকাঙ্ক্ষার ওপর বিশ্বের মোড়লদের নৈতিকতা দাঁড়িয়ে আছে। এর ঠিক বিপরীতে থাকবে সিন্ধু সভ্যতার জনকল্যাণমূলক সমাজনীতি। রাষ্ট্রনীতিও এর বাইরে নয়। এই মহাসভ্যতার গৌরবে যাতে উপমহাদেশ ছেয়ে না যায়, সেই জন্যেই হয়তো সিন্ধু সভ্যতার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য আমাদের কাছে পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না। আবার পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যায় মহেঞ্জোদড়োর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনগুলিকে এই অবহেলা করাটা হয়তো পৃথিবীর সাম্রাজ্যের ধ্বজাধারীদের পরিকল্পিত কাজ, যাতে আমাদের নজর ওই দিকে না-যায়!

আপাতত এখানেই শেষ করব। বয়সজনিত কারণে আপনার চোখের সমস্যার কথাটা বিবেচনায় রেখেই বলছি আপনি অল্প লিখেও জানাতে পারেন নিজের মত। লেখায় অবশ্য আবেগ প্রকাশের দিকটাও বিবেচনায় রাখছি আমি। স্মৃতি থেকে আহরণ করে এনে সে-সব অতীতের কথা লেখা আপনার কাছে যথেষ্ট শ্রমসাধ্য বিষয় এই বয়সে। সুস্থ থাকবেন আপনি। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করে আজকের মতো বিদায় নেব আমি। ধন্যবাদ।

ইতি – অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Mar 8, 2023, 9:34 PM

পুনশ্চ :

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আপনার ৪ মার্চে পাঠানো পত্রটাতে পুনরায় চোখ বুলাতে গিয়ে মনে হল পূর্ব বঙ্গে ইসলামীকরণের বিষয়টা আপনার কাছে পরিষ্কার করতে পারি নাই। আমি শুধু এটুকু বলেছি যে, চরাঞ্চলের অস্থিতিশীল জীবনের মানুষরাই প্রধানত ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কৃষিজীবী হলেও এরা মূলত সভ্যতা বহির্ভূত জীবন যাপন করত। কিন্তু প্রধানত এরা কেন ইসলাম গ্রহণ করেছিল সেটা স্পষ্ট করি নাই বলে মনে হল। এখন সেটা বলি।

অস্থির ও অনিশ্চিত জীবনের জন্য এরা খুব দুর্বল মনের হয়। এ থেকে আসে অতিরিক্ত ভাগ্য-নির্ভরতা এবং অলৌকিক শক্তির কৃপা কামনা। কিন্তু এটা একটা দিক মাত্র। অপর দিক হল বস্তুগত। যারা বাস্তব জীবনে শক্তিমান তারা তাদের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের দুর্বলতা পূরণ করতে চায়। সুতরাং যারা বিজয়ী এবং শাসক হয় এরা তাদের অনুগত হয়ে বাঁচতে চায়। মুসলিম হানাদাররা পূর্ব বঙ্গ জয়ের পর জনগোষ্ঠীর এই অংশই মূলত দ্রুত মুসলিম হয়েছিল। এই ধর্মান্তরকরণে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল বিজেতা মুসলিম যোদ্ধাদের আগে বা পিছে আসা পীর, সূফী ইত্যাদি নামে পরিচিত বিভিন্ন ধর্মপ্রচারক। মজার ব্যাপার হল এইসব তথাকথিত শান্তিপূর্ণ সূফীদের অনেকে ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা, যারা যে কোনও ছুতায় অস্ত্র নিয়ে হত্যাকাণ্ড ও যু্দ্ধে লিপ্ত হত। সিলেটের শাহ্ জালাল, খুলনার খান জাহান আলী কিংবা দিনাজপুরের চেহেল গাজী বা চল্লিশ গাজী এমন কয়টি জিহাদী ইসলাম প্রচারক।

এত প্রচেষ্টার পরও কিন্তু সুদীর্ঘ কাল পূর্ব বঙ্গেও মুসলিমরা সংখ্যালঘু ছিল। মুসলিম সংখ্যাবৃদ্ধির যেসব বয়ান পড়ি তাতে আমি আজকাল আর বিরক্ত হই না, বরং কৌতুক অনুভব করি। পূর্ব বঙ্গের চইরা মানুষদের বুঝলেই এত গবেষণা করতে হত না। সোজা কথা তারা বিজয়ী বীরদের ধর্ম বা আদর্শ গ্রহণ করেছিল। এই লোকগুলির সংখ্যাও ছিল যৎসামান্য। আমার অনুমানের কথা আপনাকে আগের এক পত্রে বলেছিলাম। নওয়াবী আমালের শেষ পর্যায়ে বাংলার মোট জনসংখ্যা তিন কোটির মধ্যে আমার অনুমান বহিরাগত এবং দেশী ধর্মান্তরিতদের মিলিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল কুড়ি লক্ষ থেকে ত্রিশ লক্ষের মধ্যে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কল্যাণে এরা সমগ্র বাংলায় ছেয়ে গেছে।

আমি এর আগের এক পত্রে বলেছিলাম ছিয়াত্তরের মন্বন্তর হিন্দু জনসংখ্যার উপর মারাত্মক আঘাত হানে। আমার অনুমান, যে এক কোটি মানুষ তাতে মৃত্যুবরণ করেছিল বলা হয় তাদের প্রায় সবই হিন্দু ছিল। এছাড়া পরবর্তী কালে ভূ-প্রকৃতিকে বিবেচনায় না নিয়ে যেভাবে রেললাইন প্রতিষ্ঠা করা হয় তাতে পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গে ভয়ঙ্কর দীর্ঘস্থায়ী ম্যালেরিয়ার ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এদের খুব গরিষ্ঠ অংশ ছিল হিন্দু। চরাঞ্চলের মানুষরা তথা মুসলিমরা এইসব বিপর্যয় থেকে অনেকাংশে রক্ষা পায়। এরপর আসে ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্তের প্রতিষেধক। ফলে এবার শুরু হল মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিস্ফোরণ। প্রতিটি দম্পতি যদি ১০/১২ টা করে বাচ্চা পয়দা করে আর সেগুলির মধ্যে ওষুধের কল্যাণে ৮/১০ টা বাচ্চা যদি বেঁচে থাকে তাহলে ১ শত বৎসরে ২০/৩০ লক্ষ মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে কী পরিমাণ হতে পারে একটু চিন্তা করুন। নওয়াবী কাল গেছে প্রায় পৌনে তিনশ’ বছর আগে। এই সময়টাকে এখন বিবেচনা করে দেখুন! অশিক্ষিত ও নিম্নবর্গের মুসলিমদের জন্মহার সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে কিনা জানি না। তবে চইরা মানুষ সম্পর্কে যে নাই সেটা বুঝি। আসলে কোনো কোনো বিবাহিত নারী আগের দিনে ১৪/১৫ পর্যন্ত সন্তান জন্ম দিত, যাদের মধ্যে হয়ত ২ বা ৩টা টিকত। অবশ্য আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যা প্রবর্তনের পর অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আগের মত মৃত্যু হার না থাকায় কোনও কোনও নারী বা দম্পতি অত সন্তান নিতে চায় না। তবে এই প্রবণতা খুব সাম্প্রতিক। গভীর গ্রামাঞ্চলে আমি দেখতাম মুসলিমরা কী পরিমাণে সন্তান জন্ম দেয়।

‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’ গ্রন্থের প্রথম দিকে মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধির উপর বিস্তারিত না হলেও কিছু আলোকপাত করেছি। আমার সেই সময় থেকে চিন্তায় আরও অগ্রগতি হয়েছে। তবু মূল বক্তব্য সেখানে পাবেন।

আসলে বাংলার ইসলামীকরণের মধ্যে অর্থনীতি খুঁজে লাভ নাই। কোনও অর্থনীতি থেকে বাঙ্গালীরা মুসলিম হয় নাই। এর পিছনে যেটা কাজ করেছে সেটা হচ্ছে শক্তিমান ও বিজয়ীর অনুগত ও অংশ হতে চাওয়ার মনস্তত্ত্ব। সোজা কথায় এটাই একটা রাজনীতি। মুসলিম হানাদাররা বাংলা জয় করতে না পারলে বাংলায় ইসলাম প্রবেশ করতে পারত না।

পূর্ব বঙ্গের প্রায় পুরাটাই তো অস্থিতিশীল ভূমি। তবু তুলনায় কিছু স্থিতিশীল চর এবং গ্রামাঞ্চলের হিন্দুরা কিন্তু সেভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাই। বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক সামাজিক বিভাজন এ ক্ষেত্রে সমাজকে যে নিজস্ব রক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে ইসলামকে প্রতিহত করায় তার ভূমিকাকেও আমাদের চেনা দরকার। উত্তর কিংবা দক্ষিণ ভারতের মত দৃঢ়বদ্ধ না হলেও বাংলায় বর্ণজাতি ভিত্তিক সমাজ বিন্যাসের এই ইতিবাচক দিকটাকে আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার বলে মনে হয়। বর্ণজাতিভেদমূলক সমাজ বিন্যাসের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে পঞ্চায়েত শুধু গ্রামীণ সমাজকে নয়, উপরন্তু সমগ্র ভারতীয় জন-সমাজকেও বিস্ময়কর শক্তি দিয়েছিল। সম্ভব হলে পরবর্তী কোনও সময়ে এ বিষয়ে আলোচনা করব।

আমার মনে হয় আপাতত এটুকুই যথেষ্ট হবে আপনার ভাবনার খোরাক যোগাবার জন্য।

ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

 

Mar 29, 2023,  6:21 PM

প্রিয় মানিকবাবু

গত ৭ মার্চের পত্রের প্রথম অংশে আপনি উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে বলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে বাম জমানার কৃষি সংস্কার নিয়েও নিজের মত দিয়েছেন। আমি আপনার সাথে একমত। আমি আরেকটু বক্তব্য যোগ করব এতে।

বড়ো আকারের জমিকে ছোটো ছোটো জোতে ভেঙে দিলে কতটা অভাব- অনটনে মানুষ পড়তে পারে, বাধ্য হয়ে মানুষ 'প্রলেতারিয়েত হয়, সে তো আমাদের খুব পরিচিত ঘটনা আজকের দিনে। সরকারি ট্যাক্সের টাকা মাইনে আকারে না-পেলে 'বাবু'রা আন্দোলন করে, অথচ গ্রামের অজস্র মানুষ প্রতি বছর মাইল মাইল দূরে শহরে কাজ করতে আসে ভিটেমাটি ছেড়ে, সেই দাবি নিয়ে আন্দোলন করার কথা কেউ বলেছে কখনও? আমার টাউনের গোটা শ্রমিক সমাজটাই এভাবে বাইরে থেকে আসা কৃষক বা আশপাশের এলাকার স্বাধীন কারিগর সমাজ, স্বাভাবিক গ্রামীণ বৃত্তি থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার জন্য তারা 'আন্দোলন' করে না।

অতিরিক্ত অভাবে থাকলে মানুষ আন্দোলন করে না, কাজের খোঁজ' করে প্রথমত। আর রইল পড়ে বর্গা আইন, সে ক্ষেত্রেও বলব পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট আসলেই কেরালায় শ্রমিক সাপ্লাইয়ের চক্র চালিয়েছিল বলে আমার ব্যক্তিগত মত। একটি চাষি পরিবারের জমির পরিমাণ বেঁধে দিলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে জমির পরিমাণ কম পড়ে যায়। তখন উদ্বৃত্ত কৃষি জনতা বাইরে কাজ করতে যাবে স্বাভাবিক। বাইরে কেউ চাষের কাজ করতে যাবে না, কারণ কৃষিকাজ আজও বংশপরম্পরার অর্থনীতি। তুলনায় শিল্প উৎপাদনের কাজ নির্বাচনভিত্তিক। সমস্যা এখানেই। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের যা হাল হয়েছিল, তাতে করে ওই চাষি পরিবারের বাড়তি সদস্যরা রাজ্যের মধ্যে কাজ পেত না বিশেষ। রাস্তার ধারে খুচরো কারবারিও যা হয়েছিল সেই জমানায়, তৃণমূলী আমলে তার চেয়ে ঢের ক্ষুদে কারবারি গজিয়ে উঠেছে পথেঘাটে। অগত্যা অনেক চাষি পরিবারই আছে, যাদের বাড়তি সদস্য বাইরে, বিশেষ করে কেরালায় কাজ করতে গিয়েছে কমিউনিস্ট নেটওয়ার্ক-এর সুবাদে। আমি নিজে কমিউনিস্ট মতবাদকে সমর্থনের মধ্য দিয়েই চিন্তাভাবনা শুরু করেছি। ফলে বাস করে কোটেশনের মধ্যে কমিউনিস্ট শব্দটাকে রাখলাম।

আপনি আগের পত্রটি পাঠানোর আগের কটা দিন বঙ্গরাষ্ট্র-এ আপনার কিছু বই দেখছিলাম। ঘটনাচক্রে আপনিও বলেছেন গ্রন্থগুলি দেখতে। মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ইতিহাসের বাইরে আপনার ব্যাখ্যান পড়ছিলাম। বিষয়টা আমার কাছে অভিনব। ঠিকই বলেছেন, সরাসরি দিনলিপির ধরনে লিখলে সেটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে অনেক জায়গায়। তার চেয়ে বিশ্লেষণ-সমেত বর্ণনার ধারণক্ষমতা বেশি হয়ে থাকে। বাঙালি মধ্যবিত্তের উত্থান বা ষাটের দশকের প্রজন্মকে নিয়ে কিছু মূল্যায়নেও চোখ বোলাচ্ছিলাম। আমি প্রতিটি রচনাই পড়ব, শুধু শিরোনাম বা বিষয়ে চোখ বুলিয়ে চলে যাব না। সেটা সময়সাপেক্ষ।

ভগবান সিংয়ের উক্ত গ্রন্থটি আমি পড়িনি, আপনার অন্য নিবন্ধের সুত্রেই জেনেছি তাঁর রচনার কথা। এও পড়েছিলাম যে, ভগবান সিংয়ের সাথে সম্ভবত চঞ্চলবাবুরই কিঞ্চিৎ মতপার্থক্য হয়েছিল আপনাদের বক্তব্য অনুযায়ী। আমি পড়ব ভগবানবাবুর বইটি। ভাষাতত্ত্বে আমার নিজেরও কিছুটা দখল প্রয়োজন। বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার অস্তিম পর্যায়ে দ্রাবিড়ভাষীদের কোনো ভূমিকা ছিল কিনা, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে হবে।

আপনি প্রথম দিকের একটি পত্রে তামিলনাড়ুর সমুদ্রের গভীরে কোনো ধ্বংসাবশেষের কথা বলেছিলেন। এ বিষয়ে বিশেষ জানি না আমি। কোনো তথ্যসূত্র বা আপনি সংক্ষেপে বলে দিতে পারবেন বিষয়টা সম্পর্কে? ইন্টারনেটের সাধারণ কোনো লিঙ্ক দিলেও চলবে।

☆ ☆ ☆

অভিবাসী সিন্ধু জনতার খাদ্য বিষয়ে মন্তব্য করেছিলাম আগের পরে। আপনি ঠিকই বলেছেন যে, সিন্ধু উপত্যকায় ধানের চাষও হত। এই তথ্যটা ওই মুহূর্তে খেয়াল করিনি। আসলেই আমার বক্তব্যটা আরেকটু অন্যরকম ছিল। সেটা বলছি একটু বিস্তারে।

ধানের চাষ সিন্ধু সভ্যতায় হত এটা ঠিক। তবে সিন্ধু উপত্যকার 'মেইন ফুড' কী ছিল? এটা জানা নেই আমার। আমাদের মেইন ফুড মূলত ভাঙ বা ইউরোপীয়দের রুটি; তেমন সিন্ধুবাসীর মেইন ফুড কী ছিল?

সে-রকম সিন্ধু জনতা গঙ্গাপারে অভিবাসী হয়ে আসলে চালের ব্যবহার কী করে মেইন ফুড হয়ে উঠল, সে সম্বন্ধে ধারণা দিতে পারবেন?

ভারতের বা পৃথিবীর অন্য জায়গায় চাষবাস হয়ে থাকতেই পারে তখনকার যুগে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার সমকালে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষিকাজ হবার প্রমাণ পাওয়া যায় কি? যতদূর জানি, জঙ্গলপূর্ণ এলাকা ছিল তখন আমাদের এই বঙ্গদেশ। অনেক চরের এলাকা তখনও তৈরি হয়নি পলি সঞ্চিত হয়ে। তাহলে সিন্ধু জনতা এখানে এসে জঙ্গলের উচ্ছেদ করেছিল নিশ্চয়ই? সেই ইতিহাসও থাকবে নিশ্চয়ই।

প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষা থেকে বোঝা যাবে যে, আগত সিন্ধুবাসীরা কৃষিবর্জিত অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল কিনা। সেটা হয়ে থাকলে তবেই অন্য জাতির খাদ্যপ্রণালীর প্রভাব পড়া সম্ভব।

পরের একটি পুনশ্চ অংশে পূর্ববঙ্গের ইসলামীকরণ নিয়ে আপনি মতামত দিয়েছেন। চরের অস্থিতিশীল বাঙালির স্বরূপ নিয়ে আর সেভাবে কথা হতে দেখিনি। আপনার কাছ থেকে বিষয়টা বুঝছি ক্রমেই। বর্ণজাতির বিভাজন আর সমাজের পেশাগত ঐক্য (ডিভাইড অ্যান্ড ইউনাইটেড রুল?) কীভাবে ইসলামের অর্থনীতিকে বাংলার তথা ভারতের গ্রাম-সমাজের অভ্যন্তরে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল, সে সম্বন্ধে আপনার মত পরে বলতে পারেন। আপনি চরের বাঙালি দেখেছেন। সুতরাং আপনার মত আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

বর্ণভেদ আর গ্রামীণ বৃত্তির সম্পর্ক নিয়ে যৌথপত্রের উত্তরে আমার কিছু বক্তব্য জানাব শীঘ্রই। আপনার সাথে কথা বলে চিন্তার অনেক জড়তা কেটে যেতে সুবিধাও হয়েছে আমার। তার কিছু বিষয় আগামী পত্রে প্রশ্ন আকারে জিজ্ঞেস করব আপনাদের।

ভালো থাকবেন। সুস্থ থাকবেন। যৌথপত্রের উত্তরে আমি আবার ফিরে আসব।

ইতি – অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Apr 3, 2023, 4:54 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎ ⁎

পশ্চিম বঙ্গে ভূমি সংস্কারের ফলাফল সম্পর্কে আপনার বর্ণনা আমার কাছে অনেক জীবন্ত মনে হল। ঠিকই বলেছেন যে, জমি বা জোতকে ক্ষুদ্র আয়তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়ার ফলে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সঙ্কট বৃদ্ধি করতে বাধ্য, যদি ভূমি সংস্কারের পাশাপাশি শিল্পায়ন না হয় কিংবা বাড়তি কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা না যায়। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এক বিরাট উদ্বৃত্ত কর্মহীন জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিল, যারা লুম্পেন জনগোষ্ঠীর ভিত্তিকে প্রসারিত করেছিল। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে পূর্ব বঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দু উদ্বাস্তুদের অব্যাহত স্রোতকে। এটা তো আজও অব্যাহত আছে। ভারত ভাগ হিন্দু বাঙ্গালীর সর্বনাশ করেছে। পশ্চিম বঙ্গের ক্ষতিটা অনুভব করি, আর পূর্ব বঙ্গেরটা প্রত্যক্ষ করি।

অনেক দিন পর্যন্ত মনে করতাম যে, বাংলা ভাগ না হয়ে বরং ভারত ভাগ করে অখণ্ড বাংলা প্রতিষ্ঠা করলে হিন্দু বাঙ্গালীর এমন ক্ষতি হত না। কিন্তু বহুকাল ধরে ক্রমে বুঝেছি, তাতে বরং হিন্দু বাঙ্গালীর সর্বনাশের যেটুকু বাকী ছিল সেটুকুও সম্পন্ন হত। যে হিন্দু বাঙ্গালীরা নওয়াবী শাসনকালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও মুষ্টিমেয় বহিরাগত মুসলিম শাসনকে উচ্ছেদ ক'রে পাঞ্জাবের শিখ কিংবা মহারাষ্ট্রের হিন্দুদের মত দাঁড়াতে পারে নাই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত মুসলিম আগ্রাসন থেকে কীভাবে রক্ষা পেত? দুই বঙ্গের সকল সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসহ হিন্দু বাঙ্গালীকে আরও ভয়ঙ্কর পরিণতি ভোগ করতে হত। আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার শরণার্থী শিবিরগুলি হিন্দু বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের স্রোতে উপচে পড়ত। আজকের পাকিস্তানের দিকে তাকালেই সমগ্ৰ বাংলার হিন্দু বাঙ্গালীদের পরিণতি কিছুটা হলেও কল্পনা করা যায়।

আমি যখন আজকের পশ্চিম বঙ্গের জনমিতির দিকে দৃষ্টি দিই তখন শঙ্কিত হই। মালদহ, মুর্শিদাবাদসহ কয়েকটি জেলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত হয়েছে। আরও শঙ্কার বিষয় হল পশ্চিম বঙ্গে মুসলিম সংখ্যাবৃদ্ধি। ইতিমধ্যে পশ্চিম বঙ্গে মুসলিমরা জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ পার করেছে।

আমার ধারণা ভারতের জন্য এখন মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা ইসলাম গুরুতর সমস্যা হয়ে উঠছে। সমস্যা হচ্ছে হিন্দুরা সাধারণত এই বিপদটাকে বুঝতে পারে না। আসলে ঘাড়ের উপর না পড়লে বা না চাপলে হিন্দুরা কোনও কিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে চায় না। এটা হিন্দু চেতনার একটা সমস্যা। আমার এই মূল্যায়ন বহু অভিজ্ঞতালব্ধ। সুতরাং পশ্চিম বঙ্গ বা ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের বিপদের স্বরূপ উপলব্ধির জন্য হয়ত আরও বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।

তবে ভরসার কথা হল ইসলাম তথা ধর্মপরিচয়-ভিত্তিক মুসলিমদের পতনকাল শুরু হয়েছে। কিন্তু এত দীর্ঘকাল ধরে সুপ্রতিষ্ঠিত একটা শক্তি বা ব্যবস্থা কি এমনিতেই যাবে? যা এসেছে বলপ্রয়োগ এবং হিংস্রতার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে বললেই যাবে? যেতে বলা মাত্রই তার হাতমোজার আড়ালে লুকিয়ে রাখা বাঘনখ বের করে হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। যারা ইসলাম থেকে মানুষের মুক্তির পথ অন্বেষী তাদের প্রত্যেকেরই উচিত ইসলাম ও মুসলিমের মনস্তত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব বুঝার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। ইন্টারনেটের কল্যাণে আজকাল অবশ্য অনেক ইসলাম ত্যাগী এ কাজে নেমেছেন। তাদের ভূমিকা মহামূল্যবান। আমি সকল ধর্ম থেকে মানুষের মুক্তি চাইলেও ইসলাম সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন যে অনেক ভিন্ন সেটা আপনি জানেন। মুসলিমদেরকে বুঝাতে নিশ্চয় হবে, তবে শুধু মুখের কথায় যে তেমন একটা কাজ হবে না সেটা বুঝতে হবে। মুসলিমরা সবচেয়ে ভালো যেটা বুঝে সেটা হচ্ছে অ্যাকশন বা কাজ। সেই অ্যাকশন কখন কীভাবে হবে সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। আপনার পত্রের প্রসঙ্গ থেকে আমি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেছি। এখন আপনার পত্রের প্রসঙ্গে ফিরে আপনার কথাই উদ্ধৃত করি, 'অতিরিক্ত অভাবে থাকলে মানুষ আন্দোলন করে না, "কাজের খোঁজ করে প্রথমত।

এটা আমার মনের কথা। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা মনে আছে। তখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ ঘুরে বেড়াত। শত শত মৃত মানুষের লাশ দেখতাম রাস্তার দুই ধারে পড়ে থাকতে। সেই দৃশ্যের কথা মনে হলে এখনও খুব কষ্ট পাই। এই দুর্ভিক্ষে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ব্রিটিশরা তবু কিছু হিসাব রাখত এবং দিত। ব্রিটিশ শাসকদের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী পাকিস্তানী শাসকরাও এ ক্ষেত্রে কিছু সততা রাখত। কিন্তু মুসলিম বাঙ্গালীদের মধ্যে সততার কোনও বালাই নাই। সুতরাং এদের নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর '৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কথা বলে দিলেন। কোনও জরিপ নাই, খোঁজ-খবর নাই। আন্দাজি যা মুখে এল তা বলে দিলে হল? যুদ্ধে হয়ত ২ থেকে ৩ লক্ষ মানুষ মৃত্যু বরণ করেছিল। সেটারও তো হিসাব হতে হবে। না, সেসবের বালাই নাই। আসলে রাষ্ট্রটা প্রতিষ্ঠিত ফাঁকির মধ্য দিয়ে। এর ভিত্তিতেই আছে বিরাট ফাঁকি। দুঃখের সঙ্গে হলেও বলতে হয় এই মিথ্যার ভিত্তি রচনায় আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়েছিল কংগ্রেস সরকার নেতৃত্বাধীন ভারত রাষ্ট্র।

কিন্তু সে কথা বলে কে? দেশের ভিতরে থেকে হলেও আমি কিছু বলেছি। আর সে কারণেও আমার উপর সরকারের এত আক্রোশ। যাইহোক, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় বামপন্থীদের অনেকে বলত এ দেশে এবার বিপ্লব হবে। আমি উত্তরে বলতাম, কিছুই হবে না। মানুষ ভিক্ষা করবে, ভিক্ষার অভাবে না খেয়ে পথে পথে মরবে। কিন্তু বিপ্লব করবে না। পেটে একেবারে ভাত না থাকলে মানুষ বিপ্লব কেন, আন্দোলনও করে না। ওটার জন্যও মানুষের কিছু শক্তির প্রয়োজন হয়, যার জন্য প্রয়োজন খাবারের।

আপনার এই বক্তব্য পড়ার সময় আমার নিজের উপলব্ধির কথা মনে পড়ল এবং সেই সঙ্গে জেগে উঠল চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময়ের স্মৃতি, পথে পথে পড়ে থাকা অসংখ্য নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধের লাশের স্মৃতি। সেই সময় চলছিল মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সারাদেশব্যাপী উন্মত্ত লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ এবং হত্যার মহোৎসব। এগুলি মনে হলে আবেগ সংবরণ করা কঠিন হয়। মুজিবের হত্যায় এ দেশের মানুষের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস এমনিতেই ঘটে নাই। সেই উচ্ছ্বাসও আমি ঢাকায় থেকে স্বচক্ষে দেখেছি।

আমারও বিচারভিত্তিক চিন্তা শুরু হয়েছিল কম্যুনিস্ট মতবাদে বিশ্বাস স্থাপনের পর। অবশ্য তার আগে আমি ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করি। সেটা আমার দর্শনগত উত্তরণ। তারপর কম্যুনিস্ট মতবাদে আস্থা অর্পণের মধ্য দিয়ে জ্ঞানানুসন্ধানের জগতে আমার নবযাত্রার সূচনা হয়। অবশ্য দশম শ্রেণী থেকেই মার্কসবাদ কিংবা সমাজতন্ত্রের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ও সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করি। কিন্তু সেই বয়সে এসব নিয়ে বেশী ভাবলে আমি বিপ্লবী রাজনীতির পথে যাত্রা করতে পারতাম না। আমি ভাবতাম যে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি সঠিক পথ কিংবা আমার প্রশ্নসমূহের উত্তর পাব। কারণ বিদ্যমান সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্মের যাবতীয় অন্যায়ের প্রতি আমার ছিল প্রচণ্ড ঘৃণা। বুঝতাম যে বসে থেকে সমস্ত জীবন পার করলেও আমি আমার কাঙ্ক্ষিত পথের সন্ধান পাব না। এই সংগ্রামের পথটা আমার সামনে দেখাবার জন্য আমি আমার সকল সমালোচনা সত্ত্বেও কম্যুনিজম এবং কম্যুনিস্ট আন্দোলনের নিকট ঋণী। এই উত্তরাধিকার নিয়ে আমার অহঙ্কারের শেষ নাই। তার পরেও তার সমালোচনা আমি রেখেছি। কারণ আমাদের সমাজ ও জাতির জন্য প্রয়োজন উন্নততর, সঠিক এবং যুগোপযোগী মতবাদ বা আদর্শ। এটাকে তত্ত্বও বলতে পারেন।

প্রয়াত পণ্ডিত ভগবান সিংয়ের সঙ্গে আমাদের উভয়েরই একটা প্রশ্নে বিরোধ হয়েছিল। এ নিয়ে আমার একাধিক রচনায় সম্ভবত লিখেছি। তবে এ প্রসঙ্গে 'ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠ (http://www.bangarashtra.net/article/1456.html)-এ কিছু বিশদভাবে বলেছি। তার বক্তব্য ছিল সিন্ধু সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে ঋষিরা যে সকল মন্ত্র রচনা করেছিলেন সেগুলির সংকলন হচ্ছে ঋগ্বেদ। এর সঙ্গে নদীনিয়ন্ত্রণ বিরোধী আন্দোলনের সম্পর্ক তিনি দেখেন নাই। অর্থাৎ তিনি সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় ঋষিদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা দেখতে পেয়েছেন। এ নিয়ে তার সঙ্গে আমাদের পত্র বিনিময়ও হয়েছিল, যার দুইটি বঙ্গরাষ্ট্রে আছে। তার লিখা গ্রন্থ The Vedic Harappans এবং শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার লিখা The Aryans and the Indus Civilization ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই উভয় গ্রন্থে ঋগ্বেদের ঋষিদের ভূমিকার প্রশ্নে আমাদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য পরিস্ফুট হয়। যাইহোক, তার অভিযোগ ছিল যে, আমরা সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য বৈদিক আন্দোলনকে তথা ঋষিদেরকে দায়ী করেছি। তিনি সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠায় নদী নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাকে যেমন দেখেন নাই তেমন তার ব্যর্থতার ফলে যে সিন্ধু সভ্যতার পতন হয় সেটাও মনে করেন নাই। বরং মনে করেছেন যে, সুদীর্ঘকাল স্থায়ী খরা তথা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে জলাভাবে সিন্ধু সভ্যতার পতন হয়। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার পতনে ঋষিদের কোনও ধরনের ভূমিকা তিনি দেখেন নাই। যাইহোক, ঋষিদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটা হিন্দুত্ববাদী বক্তব্য। অথচ আমার জানা মতে তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী। যাইহোক, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে পত্র বিনিময় হয়। আপনি Library বিভাগের Correspondence-d (http://www.bangarashtra.net/article/index / 9 html) আসাদের উভয় পক্ষের প্রাসঙ্গিক পত্রালাপ পাবেন। তার একটা এবং আমার একটা পত্র দেওয়া আছে সেখানে।

বর্ণজাতি প্রথার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে খুবই সিরিয়াস গবেষণা হওয়া দরকার বলে মনে করি। সেই সঙ্গে ভারতীয় সমাজ বাস্তবতায় পঞ্চায়েত সম্পর্কেও অনুসন্ধান হওয়া দরকার। আমি কিন্তু অন্য আরও দেশের গ্রাম-সমাজেও পঞ্চায়েত জাতীয় প্রতিষ্ঠান দেখতে পেয়েছি। কিন্তু ভারতীয় সমাজে পঞ্চায়েতের ভূমিকা অনেক শক্তিশালী বলে মনে হয়। এক অর্থে রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিরোধী শক্তি; অথচ প্রধানত অহিংস। এই শক্তি যোগাবার প্রধান উৎস কি বর্ণজাতিভেদ প্রথা? বিষয়গুলি নিয়ে আরও অনেক কাজ হওয়া দরকার।

আজ এখানেই শেষ করি।

আপনার শুভেচ্ছা কামনায়,

শামসুজ্জোহা মানিক

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ