Banner
আলাপচারিতা-(২) : মুসলিম সমাজে বিপ্লবের সমস্যা — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ January 11, 2024, 12:00 AM, Hits: 655

(এক)

ধর্ম মাত্রই অন্ধবিশ্বাস নির্ভর। সুতরাং যু্ক্তি-প্রমাণ নির্ভরতা তথা বিজ্ঞান মনস্কতা ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না। এর ফলে উন্নত ও আধুনিক শিল্পনির্ভর সমাজ নির্মাণের পথে ধর্ম তথা ধর্মীয় চেতনা বিরাট বাধা অর্পণ করে। এই অবস্থায় যে সব দেশ বা সমাজ আধুনিক শিল্প-সভ্যতা নির্মাণের পথে স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দভাবে অগ্রগতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে পুরাতন ব্যবস্থার সাথে ছেদ ঘটাতে গিয়ে তাদের ধর্মের সঙ্গেও কম-বেশী ছেদ ঘটাতে হয়েছে।

তবে এটা লক্ষ্যণীয় যে, এইসব দেশের কোনটিই মুসলিম নয়। মূলত এগুলি সবই খ্রীষ্টান কিংবা বৌদ্ধ সমাজের পশ্চাদভূমি থেকে উঠে আসা দেশ। তার মানে ইসলাম ধর্ম এমনই এক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে যেখানে তার অধীনতায় থাকা সমাজের ভিতর থেকে স্বাধীনভাবে আধুনিক সভ্যতার শক্তি জন্ম নিতে পারে না। যার ফলে ইসলামী বা মুসলিম সমাজে আধুনিক সভ্যতার পথে যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তার প্রায় সম্পূর্ণটার জন্য প্রয়োজন হয়েছে ইউরোপের উন্নত অমুসলিম সমাজগুলির আধিপত্য তথা পরাধীনতার। মুসলিম পৃথিবীর জন্য এটা ছিল সাধারণভাবে উপনিবেশিক পরাধীনতার কাল। স্বাভাবিকভাবে বহিরাগত ও বিজাতীয় উপনিবেশিক শাসকরা মুসলিম সমাজের অগ্রগতির তুলনায় সেগুলির শোষণ ও লুণ্ঠনেই বেশী মনোযোগী ছিল। সুতরাং শাসক দেশগুলির তুলনায় পরাধীন মুসলিম দেশগুলি ছিল পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে তলিয়ে। বিদেশী শাসকদের প্রয়োজনে আধুনিক সভ্যতার পথে তাদের যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছিল সেটুকু ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও খণ্ডিত। অবশেষে এক সময় মুসলিম দেশগুলি একে একে স্বাধীনতা লাভ করেছে। কিন্তু মুসলিম দেশগুলি আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথে স্বচ্ছন্দভাবে এগিয়ে যেতে ব্যর্থ হচ্ছে। পরিণতিতে আজ অবধি সমগ্র মুসলিম পৃথিবী অমুসলিম উন্নত দেশগুলির বিশেষত তার সাবেক উপনিবেশিক দেশগুলির নানান ধরনের শোষণ, বঞ্চনা ও আধিপত্য মূলক ব্যবস্থার অধীনে রয়েছে। কারণটা সহজবোধ্য। মানুষের চেতনাকে পশ্চাৎপদতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখার সবচেয়ে বড় শক্তি হিসাবে ক্রিয়াশীল হয়ে রয়েছে ধর্ম — ইসলাম ধর্ম। প্রত্যক্ষ উপনিবেশিক শাসনের অবসান হলেও ইসলাম ধর্মের কারণে ইসলামী সমাজ তথা পৃথিবীর স্বচ্ছন্দ অগ্রগতি অসম্ভব হয়ে রয়েছে।

অন্য সকল ধর্ম থেকে অনেক ভিন্ন এবং প্রচণ্ড রকম অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক ধর্ম ইসলাম, যা সম্পর্কে আমাদের বিশেষভাবে সচেতন হওয়া অত্যাবশ্যক। আমি ইসলামের স্বরূপ ও ভূমিকা নিয়ে আমার বিভিন্ন রচনায় আলোচনার চেষ্টা করেছি। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা বুঝতে চেয়ে আমি কিছু কাজ করেছি। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে আমার লিখা তিনটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করতে পারি। যথা, (১) ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা (http://bangarashtra.net/article/852.html), (২) ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা (http://bangarashtra.net/article/1169.html),  এবং (৩) ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব (http://bangarashtra.net/article/1542.html)। এই তিনটিই ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ দেওয়া আছে।

ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে আধুনিক শিল্প সভ্যতামুখী আমূল পরিবর্তন বা লোকায়ত ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনেকের মনে যে সংশয় আছে সে প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হল সূচনায় ভিতর থেকেই এই শক্তিকে জন্ম নিতে হবে। সেটা হবে বলেও আমি মনে করি। সেটার লক্ষণও আমি অন্তত বাংলাদেশে দেখতে পাচ্ছি। সমস্যাটা সেখানে নয়। যুগ ও পরিস্থিতির চাপে এটুকু ঘটবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যে, ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তি মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে জন্ম নিতে পারলেও প্রয়োজনীয় সামাজিক সমর্থন বা শক্তি কতটা পাবে সেটা। ফলে সামাজিক দ্বন্দ্বের একটা পর্যায়ে তা মুসলিম সমাজের ব্যাপক অংশ দ্বারা সমর্থিত মুসলিম সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বকারী শক্তির আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে। ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এই ঘটনাই ঘটেছে। আমার ধারণা এই বাস্তবতা বুঝে মুসলিম সমাজ থেকে জন্মপ্রাপ্ত লোকায়ত বিপ্লবী শক্তিকে এমন কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে যাতে করে তা বাইরের অ-মুসলিম সমাজের সমর্থন ও অংশগ্রহণ লাভ করে।

ইসলামী সমাজে লোকায়ত তথা ধর্মমুক্ত ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমস্যা সম্পর্কে প্রথমেই যে কথা বলতে হয় তা হল এই যে, ইসলাম আর দশটা অসামরিক ও অরাজনৈতিক ধর্মের মতো ধর্ম নয়। বরং সামরিক আগ্রাসন ও রাষ্ট্র বিস্তারের মধ্য দিয়ে এর প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার। অধ্যাত্মবাদ ও অলৌকিকতার কথা বললেও ইসলামের মূল বা অন্তর্গত প্রেরণা খুবই বৈষয়িক ভোগ-লিপ্সা, বিশেষত হামলা ও যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে পরভূমি দখল, লুণ্ঠন ও অগণিত পরনারী অপহরণ ও ধর্ষণ। নারীত্ব ও মানবতার বিরুদ্ধে এটা এক ভয়ঙ্কর অপরাধের ধর্ম, যাকে আমরা যুদ্ধাপরাধের ধর্ম হিসাবেও চি্হ্নিত করতে পারি। এবং সেভাবে চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরী।

পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্ব এবং বিশেষ করে মার্কসবাদ আমাদের আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টির প্রসারে যেমন ভূমিকা রেখেছে তেমন ইসলামকে চিনবার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমাদেরকে পথভ্রষ্টও করেছে। বিশেষ করে কমিউনিস্ট রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে সে কথা বলতে পারি। পাকিস্তান কালে যখন আমি কমিউনিস্ট পার্টি বা তার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম তখন সেখানে ধর্ম সম্পর্কে সাধারণত এই ধারণাই দেওয়া হত যে, ধর্ম মাত্র ভুল বা ভ্রান্ত। এ কথা বলার মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে পাঠ ও আলোচনাকে সাধারণত নিরুৎসাহিত করা হত। এ কথাই বলা হত ধর্ম হচ্ছে শ্রেণী শাসন ও শোষণের হাতিয়ার, সুতরাং শ্রেণী শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেই ধর্ম বিলুপ্ত হবে। কাজেই ইসলামসহ যে কোনও ধর্ম নিয়ে আলাদাভাবে ভাববার প্রয়োজন কী? এমন কি প্রধানত নির্দিষ্ট ধর্মের মাধ্যমে বা সাহায্যে যে, নির্দিষ্ট সমাজ এবং এমনকি রাষ্ট্র গঠন হতে পারে এই ধরনের চিন্তা সেভাবে গুরুত্ব পেত না। কারণ মার্কসবাদের মতে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে প্রধান নিয়ামক হচ্ছে অর্থনীতি। সুতরাং মার্কসীয় বিচার পদ্ধতিতে সামাজিক বা রাষ্ট্রিক পরিবর্তন কিংবা গঠনের পিছনে প্রধান নিয়ামক হিসাবে অর্থনীতির নিয়ম সন্ধান করা হত। পরিণতিতে ধর্মের গুরুত্বের প্রশ্ন সাধারণত উপেক্ষিত হত। ফলে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নটিও সাধারণত উপেক্ষিত থাকত।

বিশেষত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সপক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে চেয়ে ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা বা বিতর্ককে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা হত। কারণ তাতে করে মার্কসবাদ বা কমিউনিস্ট রাজনীতির মর্মে অবস্থিত বস্তুবাদী বা নিরীশ্বরবাদী দার্শনিক ভাবনা সামনে চলে আসত। এটা ধর্মের প্রশ্নে চরম অসহিষ্ণু ও হিংস্রভাবে আক্রমণাত্মক মুসলিম সমাজে গণ-আন্দোলন ও গণ-রাজনীতি গড়ে তুলবার পথে বিঘ্ন ঘটাবে এই বিবেচনা থেকে মার্কসবাদের বস্তুবাদী দার্শনিক সারবস্তুকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে তার অর্থনৈতিক দিকটাকে প্রাধান্যে রেখে মার্কসবাদী তথা কমিউনিস্ট রাজনীতিকে এগিয়ে নিবার চেষ্টা করা হত।

তবে এ প্রসঙ্গে বলা উচিত হবে যে, পাকিস্তান কালে কমিউনিস্ট পার্টি ও রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট রাজনীতি প্রচার করা সম্ভব না হলেও সমাজতন্ত্রের সপক্ষে প্রচার বন্ধ করা সম্ভব হয় নাই। বিশেষ করে ছাত্র ও শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের অগ্রসর অংশের ভিতর ব্যাপক পাঠাভ্যাস ও বিতর্কের প্রভাবে মার্কসবাদ ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। ষাটের দশকে এসে মার্কসবাদ ও বিশেষত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ প্রজন্ম এক পরাক্রান্ত শক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করে। তবে তারা বাস্তবে হয়ে পড়ে নেতৃত্বহীন। কারণ তৎকালে গোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টি ও তার নেতৃত্ব ছিল অনেক বেশী সাবধানী। ভারতীয় উপমহাদেশে এবং আরও বিশেষত পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বাংলায় তাদের ব্যর্থতার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তারা অতি সতর্কভাবে ও ধীর গতিতে পদক্ষেপের পক্ষপাতী ছিলেন। এই অবস্থায় ষাটের দশকে এ দেশের রাজনীতি এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়। এর ফলে ঐ কালে বামপন্থী রাজনীতি ও সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে যে সকল সমস্যা সৃষ্টি হয় তা নিয়ে আলাদাভাবে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন আছে, যা নিয়ে আমি ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’(http://bangarashtra.net/article/922.html), ‘মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্ক : ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ প্রসঙ্গে ডঃ লেনিন আজাদ ও শামসুজ্জোহা মানিকের পত্রালাপ (http://bangarashtra.net/article/413.html)’ সহ বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধে আলোচনা করেছি।

(দুই)

ইসলামী সমাজে উগ্রতা ও গোঁড়ামির জন্য সাধারণত মোল্লা-মৌলবীদেরকে দায়ী করা হয়। এ হল যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো ব্যাপার। মুসলিম সমাজের মূল নিয়ন্ত্রক মোল্লা শ্রেণী নয়। ইসলামের বিধিবিধান প্রচার ও নিয়মিত ধর্মচর্চার দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ায় মুসলিম সমাজে এরা নিঃসন্দেহে প্রচুর প্রভাব রাখে। কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বা নেতৃত্ব সেভাবে এদের হাতে থাকে না। এরা ইসলামের বার্তাপ্রচারক মাত্র। সমাজ ও রাষ্ট্রের শাসন বা কর্তৃত্বকারী শ্রেণী হল ঐতিহাসিকভাবে সামরিক শ্রেণী তথা সেনাবাহিনী। পাশ্চাত্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর এই অবস্থা বদলে গেছে। বর্তমান যুগে মুসলিম সমাজে এটা সাধারণভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে প্রভাবান্বিত সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিক এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়। এদেরকে আমরা সাধারণভাবে সমাজের উচ্চবর্গ ও মধ্যবিত্ত বলতে পারি। নিজেদের মুসলিম পরিচয় রক্ষা করেই এরা সাধারণত পাশ্চাত্য অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। আধুনিক যুগে এরাই সমাজের নেতৃত্বকারী শ্রেণী গঠন করে। আধুনিক শিক্ষা তথা পাশ্চাত্য শিক্ষা বঞ্চিত মোল্লারা এদের অধস্তন শ্রেণী হিসাবে সমাজে টিকে থাকে। অর্থাৎ উচ্চবর্গ কিংবা মধ্যবিত্তের অধীনে এবং তাদের সহযোগী হিসাবে মোল্লারা সমাজে ভূমিকা পালন করে। মোল্লারা সমাজে যে ভূমিকাই পালন করুক তারা সাধারণভাবে কোথাওই শাসকের ভূমিকায় থাকে না। আফগানিস্তান এ ক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রম, যা একটা বিশেষ ঐতিহাসিক ও সামাজিক পটভূমি থেকে উদ্ভূত। আফগানিস্তান দিয়ে সাধারণ মুসলিম সমাজকে বুঝতে চাইলে নিদারুণ ভুল করা হবে। অথচ এই ভুল অনেকেই করেন।

এটা বুঝলে এত বিভ্রান্তি থাকে না যে, মুসলিম সমাজ গঠনের মূল শক্তি নিহিত আগ্রাসী যুদ্ধ ও হানাদার সেনাবাহিনীর মধ্যে। সুতরাং আর সব শ্রেণী ও গোষ্ঠী এই যুদ্ধ ও তার বাহিনীর অধীনস্থ কিংবা সহযোগী বা শাখা-প্রশাখা মাত্র। সুতরাং মোল্লারাও তাই।

আমি পূর্ব পাকিস্তানে বড় হয়েছি। অতঃপর পূর্ব পাকিস্তানকে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার পর বিগত বায়ান্ন বৎসর ধরে আমি বাংলাদেশ ও তার সমাজকে দেখে আসছি। এর ভাঙ্গা-গড়া, এই সমাজের মধ্য থেকে বিশাল হিন্দু জনসংখ্যার উচ্ছেদ সাধন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর উর্দূভাষীদের উচ্ছেদ সাধন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের উপর সন্ত্রাস পরিচালনা এসব অনেক কিছু আমি দেখেছি। বিশেষত ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ থেকে এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের আজকের বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ।

অবশ্যই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি এই সমাজ গঠনের একটি প্রধান উপাদান। কিন্তু এই সমাজ গঠনের অন্যতম উপাদান এবং কখনও প্রধানতম উপাদান হিসাবে যদি ধর্ম তথা ইসলাম ধর্মকে দেখা না হয় তাহলে প্রকৃতপক্ষে এই সমাজ ও রাষ্ট্রের গঠনপ্রক্রিয়ার কিছুই বুঝা যাবে না। ফলে এই সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যার স্বরূপ উপলব্ধি এবং সমস্যার মীমাংসার পথও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়া বুঝবার জন্য আমাদেরকে শুধু ১৯৭১-কে বুঝলে হবে না, সেই সঙ্গে অবশ্যই বুঝতে হবে ১৯৪৭-এর বাংলা ও ভারত ভাগকে, যার মর্মে আবার আছে ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে আরব মুসলিম হানাদার বাহিনী কর্তৃক সিন্ধু আক্রমণ ও বিজয় এবং বিশেষত আনুমানিক ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে তুর্কী মুসলিম হানাদার ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী কর্তৃক বাংলা জয়। তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত জ্ঞানগৃহ নালন্দা ধ্বংসকারী ও তার হাজার হাজার নিরস্ত্র ছাত্র, শিক্ষক ও বৌদ্ধ ভিক্ষু হত্যাকারী বখতিয়ার খলজী যে আজকের বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের আদি-পিতা এটা না বুঝলে বাংলা ও বিশেষ করে বাংলাদেশের বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ গঠনের মূল চরিত্র-বৈশিষ্ট্যকেই আমরা বুঝতে পারব না। এর সঙ্গে অবশ্য ইসলাম ধর্মকেও বুঝতে হবে। বখতিয়ার খলজীসহ সকল ইসলামী হানাদারদের জ্ঞান বিধ্বংসী, গণ-হত্যা ও নারী-ধর্ষণ মূলক কর্মকাণ্ডের মূলে ক্রিয়াশীল মতাদর্শ হিসাবে ইসলামের মতাদর্শিক ভূমিকাটা বুঝা অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মগুলির নির্দিষ্ট ভূমিকা বুঝায় অক্ষম বহু সেকিউলার বা লোকবাদী এই জায়গাটাকেই সাধারণত বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। তারা মনে করেন সব ধর্মই ভুল, সুতরাং আলাদাভাবে ধর্মগুলির ভূমিকা বুঝবার প্রয়োজন কীসের? উপমহাদেশে কমিউনিস্টরা সম্ভবত এই প্রশ্নে সবচেয়ে বেশী মতিচ্ছন্নতায় ভুগেন। সুতরাং ধর্ম হিসাবে হিন্দু কিংবা ইসলাম তাদের কাছে সবই সমান। বরং মানুষের ‘সমতার’(!) ধর্ম হিসাবে তাদের অনেকে যেমন ইসলামকে দেখতে পান তেমন বর্ণজাতিভেদ-ভিত্তিক হিন্দু ধর্মের তুলনায় ইসলাম তাদের অনেকের নিকট উন্নততর ধর্ম। ইসলামের ভিতর তাদের অনেকে দরিদ্রদের শ্রেণী সংগ্রাম, এমনকি বিপ্লবও দেখতে পান!*

--------------------------------------

* ইসলামের স্বরূপ ও সমস্যাগুলি নিয়ে আমার বিস্তারিত আলোচনার জন্য আগ্রহী পাঠক ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’ (http://bangarashtra.net/article/852.html), ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’ (http://bangarashtra.net/article/1169.html),  এবং ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’ (http://bangarashtra.net/article/1542.html) ইত্যাদি রচনাগুলি পাঠ করতে পারেন। বর্তমান রচনাটিকে সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে ইসলাম বিষয়ে বিশদ আলোচনা এখানে করছি না।

-----------------------------------------  

যাইহোক, আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি বাংলাদেশে বিশেষত মুসলিম সমাজ ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহ গঠনে ইসলাম কীভাবে ভূমিকা পালন করেছে সেটা মনোযোগ দিয়ে দেখার ও বুঝার চেষ্টা করেছি। ১৯৪৭ সাল থেকে ধরলেও আজ অবধি বিপুল সংখ্যক হিন্দু এ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ’৪৭-এর দেশভাগের আগে এ দেশের মুসলিমদের কী ছিল? শিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসা, জমি-জায়গা প্রায় সবই ছিল হিন্দুদের হাতে। কারণ উপর তলার অতি সংখ্যাল্প বহিরাগত মুসলিম শাসকরা ছাড়া আর প্রায় সব জায়গায় সভ্য সমাজ নির্মাতা হিসাবে হিন্দুরা ছিল বিপুলভাবে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকারী। ব্রিটিশ শাসনকালে এসে অতীব সংখ্যালঘু মুসলিম, যাদের অধিকাংশই আবার ছিল চরে চরে ভাসমান ও ঘনঘন নদীভাঙ্গনের দরুণ অস্থিতিশীল ও অর্ধযাযাবর জীবন যাপনকারী, তারা তাদের জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধি ঘটিয়ে হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যার ভারসাম্যকে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে বদলে ফেলল। মুসলিম জনসংখ্যা কীভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে এ সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ ধারণা পেতে চাইলে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যাওয়া যেতে পারে। ২৫/৩০ বছর বয়সেই এক একটা মুসলিম নারী ১০/১২ ‍কিংবা ১২/১৪টা বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। আজ থেকে তিন বা চারশ’ বছর আগে এগুলির মধ্যে ২/৩টা বাচ্চা হয়ত বাঁচত। ম্যালেরিয়া, কলেরা, ডায়রিয়া, টাইফয়েড, বসন্ত, কালাজ্বর ইত্যাদির প্রকোপে খুব কম সংখ্যক শিশুই বেশী সময় টিকত। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যা ও এসব রোগের প্রতিষেধক ওষুধের প্রচলনের ফলে মৃত্যুহার কমে যাওয়ায় মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। বাংলায় মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধি সম্পর্কে আমি বিভিন্ন জায়গায় কিছু আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতে আরও আলোচনা করার প্রযোজন অনুভব করি। তবে এখানে সে প্রসঙ্গ নয়।

(তিন)

আমার কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম মুসলিম সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে একটা প্রায় ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করে। পাহাড়ীদের সঙ্গে বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে আমার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এরা তখন সবাই বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ করত; ফলে বাম রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ীদের উপর শুরু হয় নারকীয় অত্যাচার। বিডিআর ও পুলিশের ছত্রছায়ায় সাধারণ মুসলিম বাঙ্গালীরা দল বেঁধে চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা নির্বিশেষে পাহাড়ী পল্লীগুলির নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। পল্লী ঘেরা্ও করে পাইকারী লুঠতরাজের সঙ্গে চালাত ইচ্ছামতো মারধর এবং সংঘবদ্ধ নারী-ধর্ষণ। নারী ধর্ষণে মুসলিমরা যে কতটা পারঙ্গম হতে পারে সেটা তো সহজেই অনুমান করা চলে। যে ধর্ম বিধর্মী ও বন্দী নারী ধর্ষণকে অনুমোদন দেয় সেই ধর্মের পুরুষরা নারীদের জন্য কত ভয়ঙ্কর হতে পারে তা অবশ্য সহজে অনুমেয়।

১৯৭২ সালে আমার পাহাড়ী বন্ধুরা সেইসব ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বলত। বলতে বলতে কেউ কেউ খুব আবেগাপ্লুত হত। বলা যায় শুধু উচ্চস্বরে কাঁদতে বাকী রাখত। সেসব বিবরণ শুনে আমারও খুব কষ্ট হত। আমার পাহাড়ী বন্ধুরা বাঙ্গালীদের এই আগ্রাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই ১৯৭২ সালেই, যেটা কার্যকর করতে তারা কিছু সময় নেয়। 

এ কথা বলা উচিত হবে যে, পাহাড়ীদের উপর এই নৃশংস হামলা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ সম্পর্কে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি শেখ মুজিবও সম্পূর্ণ জ্ঞাত ছিলে্ন। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন সাংসদ ও ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতি’র নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল শেখ মুজিবের নিকট তাদের উপর পরিচালিত নির্যাতন ও বৈষম্যের প্রতিকার চাইলে এবং পাহাড়ীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবী তুলে ধরলে তিনি উত্তরে বললেন, ‘তোরা সবাই বাঙ্গালী হয়ে যা।’ ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির লাঞ্ছিত-বঞ্চিত  জাতি ও জনসমষ্টির প্রতি কী নিদারুণ অমর্যাদা ও তাচ্ছিল্য সূচক উক্তি ছিল এটা!  

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অবশ্য আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও আছে। ’৯০-এর দশকের শেষ দিকে কম-বেশী বছর কাল আমি আমার পাহাড়ী বন্ধুদের আশ্রয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ছিলাম। সেখানে তাদের একটা উন্নয়ন সংগঠনে আমি সংশ্লিষ্ট হয়েছিলাম। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের শান্তিচুক্তি হবার পর তথন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ক্ষমতায় আমার বন্ধুরা থাকায় আমার সেখানে থাকবার সুযোগ হয়।

যাইহোক, পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃষ্টান্ত আমার সামনে ইসলামীকরণের চিরায়ত গতিধারাকে উপস্থিত করে। প্রথম পর্যায়ে নিম্নশ্রেণীর বা ইতর শ্রেণীর আমজনতা সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কোনও পল্লী বা বসতির নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষদের উপর। এই পর্যায়টা পাইকারী লুণ্ঠন, হত্যা এবং গণ-ধর্ষণের। এই পর্যায়টাকে নিরীক্ষণ করলে ইসলামের আগ্রাসনের প্রাথমিক রূপটাকে অনেকটা ধারণা করা যায়। এর পরের পর্যায়ে আসবে ইসলামের বিজয়কে সংহতকরণের পর্যায়। এটা মূলত মডারেট মুসলিমদের পর্যায়। তখন ইসলামী দখলদারি মোটামুটি সম্পন্ন হওয়ায় সমাজের ধীর ইসলামীকরণ চলবে, যার মধ্যে থাকবে প্রলোভন, চাপ ইত্যাদি নানানভাবে ইসলামে ধর্মান্তরকরণ। যারা ধর্মান্তরিত হবে তাদের মধ্য থেকেও একটা অংশ নূতন মুসলিম সমাজের নেতৃত্বকারী শ্রেণীর অঙ্গীভূত হবে। তবে আধুনিক যুগের প্রভাবে এই নেতৃত্ব গঠনে ইংরাজী শিক্ষার একটা বিশেষ ভূমিকা থাকবে।

বাংলাদেশে মুসলিম মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী গঠনের প্রথম পর্যায়ে ভিন্নধর্মাবলম্বীদের সম্পদ ও সম্পত্তি জবরদখলের ইতিহাসকে যদি গুরুত্ব সহকারে বুঝতে না চাওয়া হয় তবে মুসলিম সমাজ ও তার নেতৃত্বকারী তথা শাসক শ্রেণী গঠনের আদি সত্যটাই অনাবিষ্কৃত রয়ে যাবে। বস্তুত এই সত্যের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মুসলিম সমাজে ভিতর থেকে পরিবর্তনের সমস্যার উৎস।

(চার)

শুধুমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস বা পরিচয়ের ভিন্নতার কারণে যদি ভিন্ন সমাজের মানুষদেরকে আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন এবং তাদের নারীদের ধর্ষণ ও অপহরণ করাকে অপরাধ কিংবা পাপ হিসাবে গণ্য করা হয় তবে প্রতিটি মুসলিম সমাজ গঠনের মর্মে রয়েছে এই পাপ। এবং এই পাপ কেন্দ্রীভূত হয় তার নেতৃত্ব তথা শাসক শ্রেণীর মধ্যে।

মুসলিম সমাজে আমূল পরিবর্তন কিংবা বিপ্লবের সমস্যাটা তার এই আদি পাপে নিহিত। এই আদি পাপকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে না পারলে এই সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর অন্তত ভিতর থেকে কীভাবে সম্ভব? অমুসলিম পৃথিবীর দেশে দেশে বিপ্লব ও সামাজিক প্রগতি ঘটবার এতকাল পরেও আজ অবধি মুসলিম পৃথিবীর মৌলিক সামাজিক কাঠামোর অপরিবর্তনীয়তার মূলে রয়েছে তার সৃষ্টির মূলে নিহিত এই ঐতিহাসিক অপরাধ বা পাপ।

সব সমাজেরই ভিতর থেকে পরিবর্তন ঘটলে সেটার সূচনাতে কম অথবা বেশী ভূমিকা রাখে সমাজের নেতৃত্বকারী বা শাসক শ্রেণীর একাংশের পথ পরিবর্তনের তাড়না বা তাগিদ। প্রচলিত পথে সমাজের অগ্রগমন যখন থেমে যায় এবং পথ পরিবর্তনের জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি হয় তখন সমাজকে নূতন পথে নেওয়ার জন্য উপর তলা তথা উচ্চবর্গ বা Elite শ্রেণী থেকে যত ক্ষুদ্র সংখ্যায় হোক একদল লোক পথপরিবর্তনের ডাক নিয়ে সমাজের নীচ তলার আমজনতার কাছে যায়। তখন সমাজে বিদ্রোহ বা বিপ্লব ঘটতে পারে। বিশেষ করে রাষ্ট্রবিপ্লবের জন্য এই প্রক্রিয়া অপরিহার্য। রাষ্ট্রবিপ্লব এমনই উন্নত স্তরের সামাজিক বিজ্ঞানের ব্যাপার যে, রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিষয়ে অনভিজ্ঞ আমজনতার পক্ষে তার নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা সম্ভব হয় না। তারা বড় জোর সমর্থকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। নীচতলা থেকে আগত কর্মী হয়েও যারা বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটা তারা তখনই করতে পারে যথন তারা অভিজ্ঞ নেতাদের সঙ্গে থেকে উচ্চতর রাজনীতির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ পায়। সভ্যতার আর সব পেশার মতো বিপ্লবী রাজনীতিতেও এক ধরনের বিশেষায়িত (বিপ্লবী) রাজনীতির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অপরিহার্য।

যেভাবেই দেখা যাক বিপ্লবী পরিবর্তনের শক্তির আগমনটা সূচনায় ঘটতে হয় সমাজের উচ্চতর শ্রেণী বা উচ্চবর্গ থেকে। কমিউনিস্ট রাজনীতির পরিভাষা অনুযায়ী উচ্চবর্গ থেকে আগতদের শ্রেণীচ্যুতি ঘটাতে হয়। অর্থাৎ তারা তাদের আদি শ্রেণী থেকে বিচ্যুত হয়ে সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়। বাস্তবে যাই ঘটুক তত্ত্বগতভাবে অর্থনৈতিক শ্রেণী-বিপ্লবের নামে যেসব দেশে রাজনীতির চর্চা হয়েছে সেসব দেশ সাধারণভাবে কোনওটাই মুসলিম না হওয়ায় তাদের বিপ্লবের বাস্তব রূপ ভিন্ন হয়েছে। মুসলিম সমাজে এই বিপ্লব হবে অনেক ভিন্ন ধরনের যার চর্চা প্রকৃতপক্ষে আজ অবধি হয় নাই।

আমার বিবেচনায় মুসলিম সমাজের বিপ্লব মূলত ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব। আর্থাৎ এই বিপ্লব প্রধানত ইসলাম বিরোধী। এই বিপ্লবের অর্থনৈতিক দিকও থাকবে। কিন্তু এর ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকটাই হবে মুখ্য। এই মাত্র যে কথা বলেছি, এ ধরনের বিপ্লব মুসলিম সমাজে হয় নাই। কারণ এমন পূর্ণাঙ্গ সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা আর কোনও ধর্মই দেয় নাই। অবশ্য আধুনিক যুগের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এসে ইসলামও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার আদি বা মূল রূপে আর নাই। তবু সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার প্রবল প্রতাপ এখনও মুসলিম সমাজ জীবনে বিদ্যমান। এবং এ ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বড় কথা মুসলিম সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি হল বাহির থেকে আগ্রাসী মুসলিম শক্তির আক্রমণ এবং শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যাপক ধ্বংসসাধনের পরেও টিকে থাকা অবশিষ্ট অভ্যন্তরীণ সমাজের ইসলামে ধর্মান্তরকরণ। স্বাভাবিকভাবে এখানে সামাজিক বিপ্লবের দাবী হয়ে দাঁড়ায় এমন সর্বাত্মক বিপ্লব সাধন যার ফলে শুধু অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটবে না, উপরন্তু সমাজের ইসলামী পরিচয়ও নির্মূল হবে। এই বিপ্লব এভাবে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের উচ্ছেদ সাধনের বিপ্লবে পরিণত হবে। এই কারণে আমি মুসলিম সমাজের বিপ্লবকে বলেছি ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’। এই নামে আমার একটা বইও আছে, যেটার কথা ইতিপূর্বে বলেছি এবং যেটা ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ দেওয়া আছে। 

(পাঁচ)

এই বাস্তবতার তাৎপর্য বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, পৃথিবীর যে দেশগুলিতে আধুনিক যুগের সূচনা ঘটাতে গিয়ে ভিতর থেকে স্বাধীনভাবে বু্র্জোয়া কিংবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে সেগুলির কোনওটাই মুসলিম নয়, বরং প্রকৃত অর্থে সবই খ্রীষ্টান অথবা বৌদ্ধ সমাজ। আর এই দুই ধর্মই ইসলামের বিপরীত প্রকৃতি বিশিষ্ট। মূলত শান্তি ও অহিংসা এবং হৃদয়ের নিকট আবেদন নিয়ে এই ধর্ম দুইটির জন্ম ও বিকাশ। ইসলামের উত্থান ও বিকাশ তার বিপরীতে যুদ্ধ, লুণ্ঠন, হত্যা, নারী ধর্ষণ, দাসকরণ ও জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়ে। এই পার্থক্যের স্বরূপ উপলব্ধি করা ছাড়া ভিতর থেকে মুসলিম সমাজে বিপ্লব সংগঠন অসম্ভব হয়ে থাকবে।

মুসলিম সমাজ গঠনের মূল পদ্ধতিকে বুঝলে তার শাসক শ্রেণী গঠনের মূল পদ্ধতিকেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। ফলে এখনকার শাসক বা নেতৃত্বকারী শ্রেণী পাশ্চাত্য মানদণ্ড অনুযায়ী যত ভদ্র ও মার্জিত হোক তার জন্ম ও গঠনে মূল নিয়ামক হিসাবে রয়েছে ধর্মের আবরণে পরিচালিত অন্যায় আক্রমণ, হত্যা, ধর্ষণ, দাসকরণ ও নির্যাতন। অর্থাৎ এখনকার শাসক শ্রেণী যত দেশী ও ভদ্র রূপ ধারণ করুক এরা উত্তরাধিকার সূত্রে মর্মমূলে এমন বহিরাগত হানাদার যারা তাদের অধীনস্থ সমাজ গঠন করেছে পাইকারী হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ, দাসকরণ, নির্যাতন ও বলপ্রয়োগের সাহায্যে।

বিপ্লবের সমস্যাটাও এই জায়গায়। আমি আগেই বলেছি যে, বিপ্লবী চেতনার মূল শক্তিটা সূচনায় আসে উচ্চবর্গ তথা মোটা দাগে বললে শাসক শ্রেণী থেকে। অর্থাৎ এটা এক অর্থে শাসক শ্রেণীর বিভক্তি। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা লেনিন বিপ্লবের বিজয়ের শর্ত হিসাবে শুধু শ্রমিকদের সমর্থনের কথা বলেন নাই। তিনি এই সঙ্গে এ কথাও বলেছেন যে, পেটি বুর্জোয়া এবং এমনকি বুর্জোয়াদেরও কত বেশী অংশ সমর্থন করে তার উপর নির্ভর করে বিপ্লবের সাফল্য। অর্থাৎ কম্যুনিস্ট জ্ঞানতত্ত্ব থেকে বিচার করলেও বিপ্লব শুধু শ্রেণীগত বিষয় নয়, এটা সামাজিক বিষয়ও বটে। শুধু একটা শ্রেণীর উপর বিপ্লব নির্ভর করে না। শাসক শ্রেণীর একটা অতি ক্ষুদ্র ও শ্রেণীত্যাগী (শ্রেণীচ্যুত?) অংশ প্রথমে সমাজে বিপ্লবের ভাবনাটা নিয়ে আসে। তারপর সামাজিক প্রয়োজন থেকে এক সময় এটা সামাজিক চাহিদায় পরিণত হতে পারে।

মুসলিম সমাজে শাসক শ্রেণী হতে আগত শক্তি কর্তৃক ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব ঘটানোটা এইজন্য আরও কঠিন যে, এই বিপ্লব পাপের উপর প্রতিষ্ঠিত সমগ্র শাসক শ্রেণী এবং এমনকি সমাজেরও বিনাশ দাবী করে। ইসলাম না থাকলে শুধু তার বুর্জোয়া স্বরূপ শাসক শ্রেণী থাকে না তা-ই নয়, উপরন্তু প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিক শ্রেণী স্বরূপ মুমলিম পরিচয়ে পরিচিত জন-সমাজও থাকে না। মার্কসবাদী তত্ত্বে বুর্জোয়ারা প্রলেতারিয়েতের অংশ হয়ে তার সামাজিক পরিচয় বা সত্তাকে রক্ষা করতে পারে। এটা আংশিকভাবে তার আত্মপরিচয় বোধকে রক্ষা ও তৃপ্ত করতে পারে। কিন্তু ইসলামকে উচ্ছেদ করে জনগণই বা তার সামাজিক পরিচয়কে রক্ষা করবে কীভাবে, আর সমাজ-শাসকরাই বা কোন সামাজিক পরিচয়কে অবলম্বন করে নূতনভাবে বাঁচবে?

আগের কালে না হয় স্পেনে মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করে খ্রীষ্টানরা মুসলিমদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে খ্রীষ্টান করে এই সমস্যার একটা সমাধান দিয়েছিল। কিন্তু এখনকার যুগে আমরা কোন্ সমাধান দিব? প্রথম কথা ধর্মের কাল এটা নয়। দ্বিতীয়ত, আমরা করব ধর্ম-বিরোধী লোকায়ত বিপ্লব। সুতরাং এই প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে পেতে হবে।

এক কালে এর একটা উত্তর আমি কিছুটা হলেও পেতে চেয়েছিলাম ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে — আমাদের প্রেক্ষিতে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে, যেটাকে আমি আজ অবধি অনেকটা হলেও ধারণ করে চলেছি বাঙ্গালী জাতি-রাষ্ট্র ধারণা তথা বঙ্গরাষ্ট্র ধারণার মাধ্যমে। বৃহত্তর ভারত-রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাও বঙ্গরাষ্ট্র ভাবনার এক ধরনের সম্প্রসারণ।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অনারব জাতিগুলির জাতি পরিচয়কেও ইসলাম সাময়িকভাবে তার ধর্মীয় পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে। এটা ঠিক যে, আমাদের ক্ষেত্রে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ইসলামের আগ্রাসী চেতনাকে অনেকটা দুর্বল বা কিছুটা খর্ব করতে পারে। অন্তত পূর্ব বঙ্গ বা আজকের বাংলাদেশে আমরা এ ক্ষেত্রে একটা পর্যায় পর্যন্ত আসতে পেরেছি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এ ক্ষেত্রে আমার জন্য একটা রক্ষাব্যূহ হিসাবে অনেকটা কাজ করেছে। কিন্তু এর সীমাবদ্ধতা বুঝতে হবে। যে কথা বলেছি, বিভিন্ন জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধকেও একটা পর্যায়ের জন্য হলেও ইসলাম আত্মস্থ কিংবা ধারণ করতে পারে। ইসলামী বা মুসলিম পরিচয়ের অধীনে তাই বিভিন্ন জাতির অস্তিত্ব রয়েছে। ইসলাম তথা আরব চেতনার আধিপত্যের প্রতি আনুগত্য প্রদান করেই এটা জাতিগুলির এক ধরনের স্বায়ত্তশাসন।

এতে যেটা রক্ষা পায় সেটা হচ্ছে ইসলামী শাসক শ্রেণী ও সমাজ গঠনের মূলে যে আগ্রাসন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও হত্যা রয়েছে তার উত্তরাধিকারকে সগৌরবে রক্ষা করা। ফলে সমাজ বিপ্লবের চিন্তা নিয়ে উচ্চবর্গ থেকে যদি বা অতি ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠী বেরিয়ে আসে তবে তা যেমন ব্যাপক উচ্চবর্গের মধ্যে তেমন আমজনতার মধ্যেও সমর্থন পায় না। মার্কসবাদের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে ‍বুর্জোয়া শ্রেণী প্রলেতারিয়েতে পরিণত হলেও তা তার সামাজিক পরিচয় বা আইডেনটিটি হারায় না। সেখানে বৃহত্তর সামাজিক পরিচয় নিয়ে তা বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু ইসলামে সেই প্রলেতারিয়েত কোথায়?

মানুষ নিজে থেকে তার পরিচয় ধ্বংস করে সামাজিকভাবে বাঁচতে পারে না। ভারতবর্ষের মানুষ হিসাবে আমরা মানুষের এই মনস্তত্ত্বের সাথে খুব পরিচিত। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গতিধারায় গড়ে উঠা নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকার এই প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি শত শত বৎসরের ইসলামী আগ্রাসন, হত্যা, ধর্ষণ ও শাসনের মধ্যেও ভারতীয় সমাজকে হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে তার স্বতন্ত্র দেশজ তথা ভারতীয় পরিচয় নিয়ে টিকে থাকবার অদম্য শক্তি যুগিয়েছে। রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিক পরিচয় হারালেও ভারতবাসী তার বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জিত ধর্মীয় সামাজিক পরিচিতির মাধ্যমে তার আত্মপরিচয়কে রক্ষা করতে চেয়েছে। মানুষের মনের এই জায়গাকে না বুঝলে আমরা মানুষের জীবন ও সমাজের অনেক রহস্যেরই কূল-কিনারা পাব না।

ইসলাম থেকে মুক্তি মানে শুধু শাসক তথা বুর্জোয়ার জন্যই নয়, অধিকন্তু আমজনতা তথা প্রলেতারিয়েতের জন্যও এক অর্থে আত্মবিনাশ অর্থাৎ মুসলিম হিসাবে আত্মপরিচয় বিনাশ। এই আত্মবিনাশ সমাজ চেতনায় ভয়ঙ্কর শূন্যতা সৃষ্টি করে। হ্যাঁ, এর কিছুটা পূরণ হতে পারে জাতীয়তাবাদের মত লোকবাদী দর্শন দ্বারা, যার (জাতীয়তাবাদের) আবার জাতিগতভাবে বাস্তব সামাজিক ভিত্তি থাকে। কিন্তু ইসলাম-সৃষ্ট হিংস্র আক্রমণাত্মক বা আগ্রাসী. ধর্ষক ও লুঠেরা সামাজিক চেতনাকে নিষ্ক্রিয় কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কী করে? তখন ইসলামকে ছাড়লেও কিংবা গৌণ করলেও এই চেতনা সওয়ার হয় জাতীয়তাবাদের ঘাড়ের উপর। তখন এই জাতীয়তাবাদ পরিণত হতে পারে এক নৃশংস ও অমানবিক জাতীয়তাবাদে।

এটাই আমরা দেখেছি পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে মুসলিম বাঙ্গালী কর্তৃক ভারত থেকে আসা মুসলিম বিহারী নিধনযজ্ঞের মধ্যে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বিহারী নিধন ও উৎসাদন মোটামুটি সম্পূর্ণ হল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হল আদিবাসী জনজাতিগুলির উৎসাদন প্রক্রিয়া। সেখানে বাঙ্গালী বসতি স্থাপনকারী বা ‘সেটেলাররা’ অবাঙ্গালী পাহাড়ীদের উপর আক্রমণ ও নির্যাতন চালাচ্ছে প্রধানত বাঙ্গালী হিসাবে। মুসলিম রূপ ও পরিচয় থাকলেও সেখানে তাদের মুখ্য রূপ বা পরিচয় হল বাঙ্গালী। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী অবাঙ্গালী ও অমুসলিম জনজাতিসমূহের উচ্ছেদ দ্বারা সেখানে ঘটানো হচ্ছে মুসলিম বাঙ্গালী সমাজের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার। এর মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অভিবাসী বাঙ্গালী মুসলিমরা পাকিস্তান কালেও থাকা বিপুল সংখ্যাগুরু পাহাড়ীদের হটিয়ে দিয়ে সংখ্যাগুরুতে পরিণত হয়েছে।

পৃথিবীর বিশাল অমুসলিম ভূভাগের বহু সংখ্যক দেশে যেভাবে ভিতর থেকে বিপ্লবী রূপান্তর ঘটেছে ইসলামী সমাজে কি ভিতর থেকে সে ধরনের পরিবর্তনের কোনো শক্তিই নাই? তার মানে কি ইসলাম যেভাবে বাইরের শক্তির আগ্রাসনে এসেছে তাকে সেভাবেই সর্বত্র বাইরের শক্তির আগ্রাসনে বিতাড়িত করতে হবে? যদি তা হয় তবে তার ফল হবে ভয়ঙ্কর রক্তপাত ও অগণিত মানুষের প্রাণহানি।

আমি ধারণা করি মুসলিম সমাজ গঠনের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে এমন এক শক্তি যা হচ্ছে ইসলামের প্রলেতারিয়েত। এই শক্তি হল নারী। সমাজের অর্ধাংশ এই নারী হল ইসলামের প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণী। অর্থাৎ ইসলাম থেকে মুক্তি ঘটাতে জাগাতে হবে এই নারী শক্তিকে। কাজটা অবশ্য সূচিত করবে উপর তলা বা উচ্চবর্গ থেকে আগত একটা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী। ইসলাম থেকে মুক্ত এই লোকায়ত শক্তি অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে প্রধানত নারীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এক নবতর বিপ্লবের মাধ্যমে মানব জাতিকে ইসলামের দাসত্ব থেকে মুক্ত করবে।

সুতরাং এই বিপ্লব মূলত নারীবাদী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী যে কোনও সামাজিক বিপ্লব প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পাল্টা বলপ্রয়োগ ও রক্তপাত দাবী করে। বিশেষত ইসলামী সমাজের বিরুদ্ধে বিপ্লবে এই বলপ্রয়োগ ও রক্তপাতের প্রয়োজন আরও অনেক বেশী হতে পারে। এর জন্য যে সশস্ত্র শক্তির প্রয়োজন সেটা কি নারী হতে পারবে? বিচ্ছিন্নভাবে ২/৪ জন নারী অস্ত্রধারী যোদ্ধা হতে পারে। কিন্তু সামষ্টিকভাবে নারী সেটা পারবে না। কারণ যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সাহস, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা ও রক্তপাত নারীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বিরোধী। তার দেহ ও মন কোনটাই এ ধরনের প্রবৃত্তিকে অনুমোদন করে না। প্রকৃতি এভাবে মানুষকে গড়েছে। কিছু মানুষ (এ ক্ষেত্রে নারী) অল্প কিছু সংখ্যায় এবং অল্প কিছু সময়ের জন্য এর ব্যতিক্রম ঘটাতে পারে। কিন্তু এটা হবে খুব অস্বাভাবিক ঘটনা। ফলে তা দিয়ে ইতিহাসের গতিধারা নির্ধারিত হয় না।

যাইহোক, এখানে আমি নারী-পুরুষের ভিন্নতা ও ঐক্য বা সমতার বিষয়গুলি আলোচনা করে আমার এই আলোচনাকে বেশী দীর্ঘ করতে কিংবা ভিন্ন খাতে নিতে চাই না। আমি শুধু এখানে মুসলিম সমাজে বিপ্লবের নারীবাদী রূপের গুরুত্বকে তুলে ধরতে চাইছি। আমার কিছু কিছু লেখায় আমাদের সমাজ-বিপ্লবে নারীবাদী রূপের গুরুত্ব নিয়ে কিছু আলোচনার চেষ্টা করেছি। যেমন ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ নামক গ্রন্থে ‘নারীর মুক্তি কোন পথে’ নামক একটা অধ্যায় (দ্বাদশ) আছে সেখানে বিপ্লবের নারীবাদী বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে কিছু আলোচনা করেছি। (‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ‘রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থে’ ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ দেওয়া আছে। এর লিংক : http://bangarashtra.net/article/922.html)

সমাজের উপর তলা থেকে বিরাট সংখ্যায় ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবী শক্তি (যারা হবে সাধারণভাবে পুরুষ) আসবে না, সমাজের তলদেশ থেকেও বিরাট বিপ্লবী শক্তি উঠে আসবে না — এমন অবস্থায় ক্ষমতা দখল এবং সমাজ পরিবর্তন হবে কী করে? আর সব সমাজের মতো কিংবা তার চেয়েও বেশী ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবের প্রধান শর্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। ক্ষমতা কেন্দ্র দখলের পর ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সমাজ চেতনাকে ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবের অনুকূল করা ছাড়া কি এটা সম্ভব? এটা কয়েকজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি কর্তৃক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ব্যাপার না।

অর্থাৎ ভিতর ও উপর তলা থেকে উদ্ভূত হলেও এবং আমজনতার ভিতরে কিছু ভিত্তি সৃষ্টিতে সমর্থ হলেও ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবী রাজনীতির যে শক্তি উদ্ভূত হবে তাকে পেতে হবে বাইরের তথা অমুসলিম সমাজের সমর্থন এবং এমনকি তার অংশগ্রহণ। তার একটা দৃষ্টান্ত কিন্তু আংশিকভাবে হলেও আমাদের সামনে তৈরী হয়ে আছে। সেটা হল ’৭১। যুদ্ধের রাজনীতি যারাই গড়ুক কংগ্রেসী ভারতের সাহায্য নিয়ে যুদ্ধের নেতৃত্ব দখল করেছিল মুসলিম লীগের প্রকৃত উত্তরাধিকারী আওয়ামী লীগ। এরা মর্মমূলে ছিল বিপ্লব বিরোধী লুঠেরা ও প্রতিক্রিয়াশীল অর্থাৎ অত্যন্ত নিম্নচরিত্রের অধিকারী প্রতিবিপ্লবী। ভারতের সর্বাত্মক আশ্রয় ও সাহায্য নিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের যে উন্মত্ত লুঠতরাজ শুরু হয় তাতে করে তাদের নেতা স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বলতে বাধ্য হন, ‘যে দিকে তাকাই, সে দিকেই দেখি চাটার দল’ এবং ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’। তার এ ধরনের আরও খেদোক্তি আছে। বাস্তব হচ্ছে মুখে তিনি যাই বলুন এই দুর্বৃত্ত ও লুঠেরা শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণ করেন নাই বা করতে পারেন নাই। সেটা তার পারবার কথাও নয়। কেন পারবার কথা নয় সেটা যারা ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠনের ইতিহাস ভালোভাবে জানেন তারা বুঝবেন বলে ধারণা করি। কারণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হলে নীতিনিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের নিয়ে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন হবার পর ক্ষমতালোভী নীতিহীন, সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীদের দল হয়ে দাঁড়াল তখন রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী আওয়ামী লীগ। এইসব নীতিবিবর্জিত, লোভী ও অসৎ রাজনীতিকদের নেতা হলেন প্রথমে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার মৃত্যুর পরবর্তী কালে তার অনুগত ও বিশ্বস্ত সহকর্মী শেখ মুজিবুর রহমান।

প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ চরিত্রগতভাবে এমন একটা দল যার পক্ষে দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর কিছু করা সম্ভব নয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে তারা তাদের এই চরিত্রের প্রথম প্রকাশ ঘটিয়েছিল। মাকাল গাছে আম ফলতে পারে না। ফলে আওয়ামী লীগের হাতে পড়ে ১৯৭১ সালেও একটা সম্ভাব্য বিপ্লবের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু এটা ঠিক যে, একটা বৃহত্তর ও শক্তিধর ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিভক্তি ও বিপর্যয় ঘটেছিল। এটা ছিল ইতিহাসের পশ্চাৎযাত্রা নয়, বরং অগ্রযাত্রা। কারণ এটা শুধু উপমহাদেশ পরিসরে নয়, উপরন্তু বিশ্ব পরিসরেও ইসলামের শক্তিকে খর্ব করেছে এবং লোকায়ত বিপ্লবের পথকে প্রশস্ততর করেছে। বাংলাদেশে ইসলাম থেকে মুক্তির চেতনার যেটুকু অগ্রযাত্রা ঘটেছে সেটা মূলত ’৭১-এ বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের ফল, যার পিছনে আবার আছে ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের অভিঘাত।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার কারণ নাই। তাছাড়া ’৭১-এর অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতার একটা ছিল বাঙ্গালী জাতির মুক্তির যুদ্ধ বলা হলেও তা বাস্তবে পূর্ব বাংলার মুসলিম পরিচয়কে অস্বীকার ক’রে লোকবাদী বাঙ্গালীর সর্বজনীন চেতনাকে ধারণ করতে পারে নাই। এর ফলে এর মর্মে ছিল ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতির বিভক্তিকে রক্ষার মাধ্যমে পাকিস্তানের মুসলিম ধর্মসাম্প্রদায়িক চেতনার সংরক্ষণ। এতদসত্ত্বেও বিশেষ করে ’৭১-এর ছক বা প্যাটার্নটাকে মনে রাখতে এবং বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। আগামী যাত্রার পথরেখার অনেকটাই তার ভিতর থেকে পাওয়া যাবে। ফলে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ণয়ে সেই অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কাজে লাগবে।

(ছয়)

এখানে আমাদের সমাজের বিপ্লবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর রণনৈতিক (strategic) ও রণকোশলগত (tactical) বিষয়কে দৃষ্টির সামনে আনতে চেয়েছি। ফলে আজকের বাংলাদেশের মুসলিম সমাজে বিপ্লব সংগঠনের ক্ষেত্রে কিছু মৌল সমস্যার উপর এখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চেয়েছি। এর ফলে আমার এই আলোচনায় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায় হিন্দু সমাজে পরিবর্তন বা বিপ্লবের সমস্যার উপর আলোকপাত করার চেষ্টা অন্তত এখানে করি নাই বা করতে চাই নাই। তবে সে আলোচনার গুরুত্ব আছে। বিশেষত যে উপমহাদেশের আমরা অবিচ্ছেদ্য অংশ তার বিপুল সংখ্যাগুরুই হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ হওয়ায় প্রগতিমুখী যে কোনও পরিবর্তন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংক্রান্ত বিষয় চলে আসে। তবে যেহেতু হিন্দু ধর্ম অন্তত বাংলাদেশে বিপ্লবের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় এই মুহূর্তে বেশী গুরুত্ব বহন করে না সেহেতু হিন্দু ধর্ম ও সমাজের সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনাকে আমি অন্তত এই আলোচনায় আনতে চাই নাই। অবশ্য হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন রচনায় আমি আলোচনা করি নাই তা নয়। স্বাভাবিকভাবে তার সমালোচনাও করেছি। তবে যে কথা বললাম এখানে সে বিষয়ে আলোচনা করবার প্রয়োজন অনুভব করছি না।*

------------------------------------------

*  আমার বিভিন্ন রচনায় হিন্দু ধর্ম ও সমাজ এবং হিন্দু মানস সম্পর্কে আলোচনা করেছি। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাবে হিন্দু সমাজ ও মানসিকতায় যে সকল সমস্যা সৃষ্টি হয় সে সকল আলোচনায় সেগুলিকে যতটা সম্ভব চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছি। আগ্রহী পাঠকের জ্ঞাতার্থে সেগুলির মধ্য ধেকে নিম্নে কয়েকটি রচনার নাম উল্লেখ করছি।

(১) ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের উত্থান ও রাষ্ট্রশক্তির অবসান http://bangarashtra.net/article/1437.html

(২) হিন্দু সমাজ এবং একটি কেস-স্টাডি http://www.bangarashtra.net/article/1398.html

(৩) ধর্ম ও জাতপাতের সীমানা পেরিয়ে http://www.bangarashtra.net/article/1356.html

(৪) কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন http://www.bangarashtra.net/article/1387.html

-----------------------------------------

হিন্দু সমাজের দুর্বলতার একটা দিক হলো শত শত বৎসর ধরে পাশাপাশি বাস করা সত্ত্বেও ইসলাম ও মুসলমানকে বুঝতে না পারা। আসলে বুঝতে না পারাটা এসেছে বুঝতে না চাওয়া থেকে। হিন্দু চেতনার যে আত্মবদ্ধতা ও সঙ্কীর্ণতা তা থেকে কৌতূহল বা আগ্রহের এই অভাব। যাইহোক, ধারণাগত এই সীমাবদ্ধতা থেকে অনেকেই মনে করেন যে, ইসলামী সমাজের যত নষ্টের গোড়া সবই বুঝি মোল্লা সম্প্রদায়। মুসলিম সমাজের  অনেক উদার মুসলিমও তা মনে করে। কিন্তু ঘটনাটা মোটেই তা নয়। মোল্লা-মৌলবিীরা যতই প্রভাব রাখুক মুসলিম সমাজের মূল নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তারা হল সামরিক-বেসামরিক আমলা, ধনিক ও রাজনীতিকদের নিয়ে গঠিত শাসক শ্রেণী। মোল্লারা ভূমিকা পালন করে এদের সহযোগী ও প্রকৃতপক্ষে বশংবদ হিসাবে। আমি মুসলিম সমাজ গঠন ও নিয়ন্ত্রণে সমাজ-নেতা বা শাসক ও মোল্লাদের ভূমিকার তাৎপর্য নিয়ে ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’ গ্রন্থে (http://bangarashtra.net/article/1542.html) আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে তার ‘২। ইসলামে ধর্ম ও রাষ্ট্র’ এবং ‘৩। যুদ্ধ ও সহিংসতা নির্ভর সমাজ’ শিরোনামের অধ্যায় দু’টি গুরুত্বপূর্ণ।  

তবে মুসলিম সমাজের যতই সমস্যা থাকুক, এখন আমার ধারণা, ভারতবর্ষে বিপ্লবের সূচনা শক্তিটাকে আসতে হবে মুসলিম সমাজ থেকে। কারণ বিপ্লবের জন্য নেতেৃত্বের যে শক্তিমত্তা ও সাহস দরকার সেটা মুসলিম সমাজ থেকে উঠে আসা মানুষরা অনেক বেশী পরিমাণে আত্মস্থ করতে পারে তাদের সামাজিক বাস্তবতার কারণে। যদিও এতকাল মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবী শক্তির কার্যকর উত্থান একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে ছিল তথাপি যুগ পরিবর্তনের ফলে সেই অবস্থাটা এখন আর পূ্র্বের মতো করে থাকছে না। বিশেষ করে ইন্টারনেট ব্যবহার ও সেই সাথে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বপরিস্থিতি ইসলামের পতন ও বিলুপ্তিকে এখন অনিবার্য করছে। ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব কোনও একটা দেশে ঘটলে তা সুনামির শক্তি ও প্রচণ্ডতা নিয়ে আঘাত করবে সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে।*

------------------------

*  মুসলিম পৃথিবীর বিপ্লবের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য :

ইন্টারনেট এবং আসন্ন বিশ্ববিপ্লব : http://bangarashtra.net/article/1433.html

----------------------------

তবে আমার বিচারে মুসলিম পৃথিবীর দুর্বলতম গ্রন্থি এখন বাংলাদেশ। ফলে ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবের সূচনা ঘটবার সম্ভাবনা এখান থেকেই বেশী দেখি। সুতরাং বিপ্লবীদের উর্বর ক্ষেত্র এখন বাংলাদেশ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমাজ ও ধর্মের বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাগুলি নিয়ে এখন নূতন করে অনুসন্ধান হওয়া দরকার। ফলে ইসলামের উপর অনুসন্ধানও বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিবে। তাছাড়া উপমহাদেশে এমনিতেই ইসলামের প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে কোনও ধরনের বিপ্লব সম্পন্ন করা অসম্ভব। ফলে যারা উপমহাদেশে বিপ্লবের সমস্যা বুঝায় আগ্রহী হবেন তাদেরকে হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি ইসলামকেও বুঝতে হবে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ইসলামকে বুঝার গুরুত্বই সর্বাধিক।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ