Banner
আলমগীর হুসেনের ‘ইসলাম ও মার্ক্সবাদ : আত্মার আত্মীয়?’ এবং তার ‘জীবন দর্শন’ -- আজাহারুল ইসলাম

লিখেছেনঃ আজাহারুল ইসলাম, আপডেটঃ March 5, 2012, 2:59 AM, Hits: 4601

পহেলা অক্টোবর ২০১১ তারিখে বঙ্গরাষ্ট্র ওয়েব সাইটে প্রকাশিত জনাব আলমগীর হুসেনের ‘ইসলাম ও মার্ক্সবাদ : আত্মার আত্মীয়?’ শিরোনামের নিবন্ধটা পড়লাম। তিনি ইসলাম ও মার্ক্সবাদকে একই কাতারে ফেলে চিহ্নিত করেছেন বা ট্রেড মার্ক করে দিয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে তার মত ব্যাপক পড়াশুনা ও গবেষণা করা পণ্ডিত ব্যক্তি ভাববাদী ও বস্তুবাদী দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির দর্শনকে কীভাবে এক করে ফেললেন? তিনি লিখেছেন ‘কেবলমাত্র ঈশ্বর ও পরকালে বিশ্বাসের মত কিছু গৌণ বিষয় বাদ দিলে মার্ক্সবাদ ও ইসলাম একাকার হয়ে যায়।’ তিনি ইসলাম ও মার্ক্সবাদী আন্দোলনে মৌলিক মিল পেয়েছেন! তবে ‘কিছু বিষয়ে আপাত দৃষ্টিতে পার্থক্য দেখা যেতে পারে।’ অর্থাৎ ‘আপাত দৃষ্টিতে’ কিছু পার্থক্য থাকলেও আসলে বা ‘মৌলিকভাবে কোন পার্থক্যই’ তিনি খুঁজে পান নাই। তিনি পার্থক্য শুধু পেয়েছেন, ‘যেমন মুহাম্মদের আন্দোলনে প্রলেতারিয়েত ছিল তারা, যারা তার ধর্ম ও নেতৃত্ব গ্রহণ করত; বাকী সবাই ছিল শোষক, নির্যাতক এবং হত্যা ও লুটপাটের লক্ষ্য। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে যদিও সব গরীব দুঃখী মানুষই প্রলেতারিয়েত, বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিন্তু মুহাম্মদের মতই ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর মার্ক্সবাদী আন্দোলনে ও প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ ও চীন হয়ে কম্বোডিয়া, উত্তর কোরিয়া পর্যন্ত কমিউনিস্টরা কোটি কোটি ( ৮.৫ থেকে ১০-০ কোটি) মানুষ হত্যা করেছে।’ এর আগের প্যারাতেই বলেছেন, ‘নিপীড়িত জনতাকে খাওয়ানো ও সশস্ত্র বিপ্লব-এ দু’টো বিষয়েই ইসলাম ও মার্ক্সবাদী আন্দোলন একই কাতারে পড়ে ....’ তার আগের প্যারাতে লিখেছেন; ‘সশস্ত্র বিপ্লবের প্রশ্নে মুহম্মদের ইসলামী আন্দোলনও কমিউনিস্টদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন একই সারিতে পড়েছে।’ এবং তার দাবী মতে এত অল্প সময়ে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা ইতিহাসে বিরল।

অর্থাৎ আলমগীর হুসেনের মতে আপাত দৃষ্টিতে পার্থক্যটাও শেষ পর্যন্ত পার্থক্য থাকে নাই অর্থাৎ পুরোটাই মিলে গেছে মুহাম্মদের সঙ্গে বা ইসলাম ধর্মের সঙ্গে। তা হলে তো আলমগীর হুসেনের মাপকাঠি অনুসারে মার্ক্সকে মুহাম্মদের শিষ্যও বলা যেতে পারে! বা হয়তো মুহাম্মদের খলীফাও কেউ বলে ফেলতে পারে। বোধ হয় এর পরবর্তীতে এ জাতীয় চিন্তার অনুসারীদের কাছ থেকে এরকম কোন মূল্যায়ন বা মন্তব্য হলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

আলমগীর হুসেন তার লেখায় মুহাম্মদের সঙ্গে মার্ক্স বা মার্ক্সবাদীদের আপাত দৃষ্টিতে পার্থক্য’-টাও খণ্ডন করেছেন ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ ও মানুষ হত্যার জন্য। উভয়েই অস্ত্রের ব্যবহার করেছেন শত্র“কে পরাজিত করার জন্য। তার এই সশস্ত্র বিপ্লব বিরোধী বোধের জন্য স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন আসে। এই অস্ত্রের ব্যবহার বা সশস্ত্র বিপ্লব কি সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য? শুধু কি মুহাম্মদ এবং মার্ক্সবাদীরাই অস্ত্রের ব্যবহার করেছে? নাকি মার্ক্সবাদীরা বাদে অন্য কোন সমাজ বিপ্লবীরাও করেছে? যদি করে থাকে তা হলে নিশ্চয় তারাও পরিত্যাজ্য বা নিন্দাযোগ্য নয় কি? নাকি কেউ কেউ নন্দিত হবে? তার লেখায় আর কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দেখা যায় না। এ লেখায় স্পষ্ট কিছু না থাকলেও অন্যত্র স্পষ্টভাবে সমাজ বিপ্লবের সমর্থন করে প্রশংসাসূচক বক্তব্য দিয়েছেন। নিম্নে সে আলোচনা করব।

তিনি উদারবাদীতে নিজের উত্থানের বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু উদারবাদের সংজ্ঞা এখানে দেন নাই। গত ১৬ই ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ ওয়েব সাইটের উদ্যোগে আহূত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসাবে আলমগীর হুসেন মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন, যার নাম ছিল ‘জীবন দর্শন’ সেখানে তিনি ঐ পঠিত প্রবন্ধের ১৩ নং পৃষ্ঠায় ‘উদারবাদী আন্তর্জাতিকতা অনুচ্ছেদে লিখেছেন, ‘১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে সফল বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে প্রথম উদারবাদী সংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে সংবিধানের অংশ ছিল মানবাধিকার ঘোষণা। এবং পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের দেশগুলো একে একে ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী গণতন্ত্র গ্রহণ করলে সে দেশগুলোও ফ্রান্সের সংবিধান প্রায় অপরিবর্তিত রূপে গ্রহণ করে। এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সংবিধানের মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ সালে প্রায় অপরিবর্তিত রূপে জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র হিসাবে গৃহীত হয়।’ এই বিপ্লবের রূপ বা কর্মকাণ্ড নিয়ে কোন বর্ণনা দেন নাই। শুধু এর ফলাফলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। এ বিপ্লবকে সমর্থন না দিয়ে উপায় নাই। এই বিপ্লব না হলে ইউরোপ আজকের ইউরোপ হয়ে উঠত না। আর এ বিপ্লব এড়াবারও কোন পথ ছিল না। অর্থাৎ সমাজ বিবর্তনে এটার অনিবার্যতা ছিল। এবং গোটা ইউরোপ এই বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হয় সে কথা আলমগীরের লেখাতেই আছে। অর্থাৎ ‘পাশ্চাত্যের দেশগুলো একে একে গ্রহণ করল,’ এবং ‘ফ্রান্সের সংবিধান প্রায় অপরিবর্তিত রূপে গ্রহণ করে।’ শুধু তাই নয় জাতিসংঘও ১৯৪৮ সালে প্রায় অপরিবর্তিত রূপে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র হিসাবে তা গ্রহণ করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে ফরাসী বিপ্লব হচ্ছে ইউরোপ বা পাশ্চাত্যের অর্থাৎ গোটা পশ্চিমা উন্নত বিশ্বের ক্রম বিকাশের এক দিক নির্দেশক বিপ্লবী কাণ্ড। কিন্তু এই কর্মকাণ্ডের রূপ কি ছিল? অতি সাধারণ পাঠকও জানেন যে সে রূপ ছিল ভয়ঙ্কর নির্মম! পুরাতন শাসক বা ফরাসী সম্রাটকে এবং তার পরিবার-পরিজন, বন্ধুমণ্ডলী, সেনাপতিমণ্ডলীসহ তার পক্ষাবলম্বী সবাইকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তার প্রাসাদ, বাস্তিল দুর্গ ভেঙ্গে ধূলিসাৎ করা হয়। প্রাচীন প্রচলিত আইন, প্রাচীন অধিকার বোধ, রীতিনীতি উচ্ছেদ করা হয়। বিপ্লবী শক্তি নতুন আইন, রীতিনীতি চালু করে। পুরাতন নীতি বোধ বাতিল করে নতুন ন্যায় নীতি চালু করে। সামন্ত ভূ-স্বামীদের সমস্ত জমি-জমা বাজেয়াপ্ত করে ভূমিদাস কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়। জমিদারী প্রথা বাতিল করে বিপ্লবী নেতা বা কর্মীরা নিজেরা ভাগাভাগি করে ভোগ করে নাই। সমাজে উৎপাদন বাড়াবার জন্যে কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়।

এর সঙ্গে ইসলামের নবীর যুদ্ধ ও যুদ্ধলুণ্ঠিত সামগ্রী নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে অনুৎপাদনশীল ভোগ ও বন্দীদের দাস-দাসী বানাবার ব্যবস্থাকে মিলানো যায় না। ইসলামে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। ছিল না সম্পদ উৎপাদনের চিন্তা। শুধু সম্পদ লুণ্ঠনের চিন্তা ছিল। সেই পশ্চাদমুখী, ভাববাদী ও অমানবিক চিন্তার বিপরীতে ফরাসী বিপ্লবোত্তর কৃষকদের মাঝে ভূমি মালিকানা প্রদান করে উৎপাদন বাড়াবার ব্যবস্থা এবং কৃষক-শ্রমিকসহ সমস্ত জনগণের সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণরূপে অগ্রগামী, বস্তুবাদী বা জাগতিক এবং মানবিক চিন্তার ফসল। তেমনি মার্ক্সবাদীদের দ্বারা মিলকারখানা ও সম্পত্তির সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠার পর পরিকল্পিত ভাবে উৎপাদন বাড়াবার ব্যবস্থা তথা সম্পদ বাড়াবার সর্বতোমুখী প্রচেষ্টা আর যা-ই হোক ইসলামী লুণ্ঠন নীতিমালার সঙ্গে এক মানদণ্ডে বিচারের বিষয় নয়। বিপ্লবী শক্তি কর্তৃক পূর্বতন মালিকানা উচ্ছেদের ব্যবস্থা হলেই যদি তা ইসলামী দখলের সঙ্গে এক হত তবে ফরাসী বিপ্লবের পূর্বতন মালিকদের উচ্ছেদও তো একই ভাবে ইসলামী দখলের সঙ্গে তুলনীয় হত। সে ক্ষেত্রে ফরাসী বিপ্লবে সামন্তদের মালিকানা উচ্ছেদ ও সম্পত্তি বণ্টনও তো বেআইনী ও অনৈতিক হয়ে পড়ে এবং তা ইসলামী দখলের সঙ্গে সমার্থক হয়ে যায়। তাহলে এককভাবে মার্ক্সবাদী বিপ্লবের মালিকানা দখলের প্রক্রিয়াকে ইসলামী দখলের সঙ্গে এক করে ফেলা কেন?

নিছক উদারবাদের কথা অনুসারে তো মানুষের অধিকার জোর পূর্বক হরণ করা অন্যায়। তা হলে ফরাসী বিপ্লবও তো অন্যায় বা অবৈধ হয়ে যায়? মানবতাবাদের দৃষ্টিতেও কি এই নৃশংস হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিদহন ও অন্যান্য পন্থায় সম্পদ ধ্বংস অন্যায় নয়? তা হলেও এখন তাকে সবাই সফল বিপ্লব বলছে কেন? আলমগীরও বলছেন সফল বিপ্লব। তার বিচারের একই মানদণ্ড অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবস্থা উচ্ছেদের লক্ষ্যে পরিচালিত আব্রাহাম লিংকনের যুদ্ধও কি পরিত্যাজ্য ও নিন্দনীয় হয় না? কিংবা আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা জর্জ ওয়াশিংটনও কি রক্তপাতের জন্য নিন্দনীয় হন না। কিন্তু আলমগীর কি তাতে রাজী হবেন?


নতুন ভাবনা, নতুন মূল্যায়ন ও নতুন বিশ্বদৃষ্টিতে বিজ্ঞান মনস্ক চেতনায় জগৎকে গড়ার অভিপ্রায়ে এবং সে সমাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের মানকেও ক্রমান্বয়ে আরও উন্নত করার আকাক্সক্ষাতেই সমাজের অধিকাংশ মানুষ মিলিতভাবে যুগে যুগে এ ধরনের বিপ্লব করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। কারণ পূর্বের শাসন, আইন সবই যখন অতি মুষ্টিমেয় এক শ্রেণীর অনুকূলে যায়, অধিকাংশ মানুষের চরম দুরবস্থার কারণ হয়, এবং অধিকাংশ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে দেয় তখন সমাজ বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে।

ফরাসী বিপ্লবের কর্মকাণ্ডের ফলশ্র“তিতে ইউরোপের সর্বত্র সমাজ পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কোথায়ও বিপ্লবী সংস্কারের মাধ্যমে কোথায়ও ধীর সংস্কারের মাধ্যমে এই পরিবর্তন ঘটে। ইংল্যাণ্ডে ফরাসী বিপ্লবেরও প্রায় ১৩০ বছর আগে ক্রমওয়েলের বিপ্লব সাধিত হয়। সেখানে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর পুনরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও বিপ্লবের প্রভাব সমাজে রয়ে গিয়েছিল। যার কিছু প্রভাব পরবর্তী সংস্কার আন্দোলনে পড়েছে।

ইউরোপের যুগান্তকারী ফরাসী বিপ্লব হয়েছিল দার্শনিক ভলতেয়ার ও রুশোর দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে, বিশেষ করে দার্শনিক রুশোর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। গোটা ইউরোপ জুড়েই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পরিমাণে সমাজ পরিবর্তন শুরু হয়। সেই সাথে ক্রমান্বয়ে শুরু হয় শিল্প বিপ্লব। শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একদিকে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক বুর্জোয়া শিল্পপতি, বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণীর বিকাশ ঘটে। অন্যদিকে বিশাল সংখ্যায় সম্পূর্ণ বিত্তহীন শিল্প শ্রমিক বা প্রলেতারিয়েতের সৃষ্টি হয়। সংখ্যার আয়তনে শ্রমিক শ্রেণী বিপুল। তাদের শ্রম ছাড়া শিল্প অচল বটে, কিন্তু তাদের জীবনের মান চরম দুর্দশাগ্রস্ত, অসহায় পশু তুল্য। আধুনিক উৎপাদনের এই পরস্পর বিরোধী দু’টি শ্রেণী তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে মুখোমুখী দাঁড়িয়ে যায়। ইউরোপব্যাপী শ্রমিক-মালিকের দ্বন্দ্ব স্থায়ী রূপ নেয়। আর এই পটভূমিতে কার্ল মার্ক্স তার নিজস্ব চিন্তা বা দর্শন নিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর পাশে দাঁড়ান।

তিনি কাণ্ট ও বিশেষ করে হেগেলের দ্বন্দ্ববাদকে অনুসরণ করে সমাজের সর্বত্র দ্বন্দ্ববাদের রূপকে পরিজ্ঞাত করেন। হেগেলের দর্শনের দ্বন্দ্ববাদের ভাববাদী দিকটি ত্যাগ করে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বা রূপটা গ্রহণ করেন। এভাবে তিনি গোটা ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।

 

তিনি ব্যাপক গবেষণা করে উদাহরণ ও পর্যলোচনার মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব নির্মাণ করেন। বুর্জোয়া বা ধনিক শ্রেণী কখনই মার্ক্সের উদ্বৃত্ত্ব মূল্যতত্ত্ব স্বীকার করে নাই। বুর্জোয়া বা ধনিক শ্রেণীর সমর্থক দার্শনিকগণ নিজেদেরকে উদারবাদী হিসাবে অভিহিত করেন এবং শ্রমিক শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশার কারণ হিসাবে তাদের অকর্মণ্যতা বা অযোগ্যতাকেই একতরফাভাবে দায়ী করেন। তারা একদিকে মেধা, যোগ্যতা ও কর্মশক্তিকেই ব্যক্তি উন্নয়নের একমাত্র পথ হিসাবে বিবেচনা করেন। ফলে সুযোগ, পরিবেশ এবং বুর্জোয়াদের বিভিন্ন নীতি বর্হিভূত কার্যকলাপসহ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শোষণকে মোটেই স্বীকার করেন না। এমনকি সামাজিক কোন দায়বদ্ধতার কথাও তারা স্বীকার করেন না। তাদের মতানুসারে যেহেতু মানুষ আত্মস্বার্থবাদী, তাই মানুষ আত্মস্বার্থের জন্যই কোন কাজে উদ্যোগী হয়, সম্পদ সৃষ্টি করে; সুতরাং এই আত্ম উদ্যোগে কোনরূপ হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয় বলে তারা মনে করে। উদারবাদে রাষ্ট্রকে দহবপবংংধৎু বারষ’ তথা ‘অবাঞ্ছিত প্রয়োজনীয়তা’ হিসাবে দেখা হয়। নিয়ন্ত্রণ মুক্ত অবাধ প্রতিযোগিতার নামই উদারবাদী রাষ্ট্র। অবশ্য অলৌকিক শক্তির বা ধর্মীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণ মুক্তির কথাও তারা বলে থাকেন।

আলমগীর পূর্ব উল্লেখিত আলোচনা সভায় পঠিত ‘জীবন দর্শন’ নিবন্ধে ৮ম পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, “মার্ক্সবাদের মত উদারবাদ নিখুঁত নয়। উদারবাদী তত্ত্বের মূলে রয়েছে অব্যাহত পরিবর্তনশীলতার স্পন্দন। এবং আমার ব্যক্তিগত বিচারে উদারবাদ হতে পারে অনেকাংশে মানবতাবাদের ভিত্তি। অথবা উদারবাদ ও মার্ক্সবাদের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হতে পারে একটি সুসংহত মানবতাবাদী জীবন দর্শন।”

তার এই উদ্ধৃতির সাথে ‘মার্ক্সবাদ ও ইসলামঃ আত্মার আত্মীয়’ নিবন্ধে মাকর্সবাদ সম্পর্কে করা তার মন্তব্যসমূহের ভিন্নতা লক্ষণীয়। সেখানে তিনি মার্ক্সবাদ ও ইসলামের সম্পর্ক মূলত এক ও অভিন্ন হিসাবে দেখিয়েছেন।

আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি চান পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক বিশ্বের কাংক্সিক্ষত উদারবাদী নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি উদ্যোগকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে। আবার তার আলোচনা সভায় পঠিত প্রবন্ধের উদ্বৃতি থেকে মনে হয়েছে তিনি মার্ক্সবাদ ও উদারবাদ মিলিয়ে এক মানবতাবাদী সমাজ চান। আসলে তিনি কি চান আর একটু ভেবে তা সুস্পষ্ট করবেন বলে আশা করি।

নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি পুঁজি সমাজে যে কি অনিয়ম ও বর্বরতা সৃষ্টি করতে পারে তার উদাহরণ সারা পৃথিবী জুড়ে বিদ্যমান। উন্নত বিশ্ব বা উন্নয়নশীল বিশ্বের দিকে তাকালেও তার রূপ চোখে পড়ে। বুর্জোয়া উৎপাদকেরা বিভিন্ন কৌশলে কোন নীতি বোধকে তোয়াক্কা না করে শুধু মুনাফার জন্যে নানা অবৈধ কাজ করে। মুনাফার বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগের জন্যই সমাজ এবং রাজনীতিতে তারা অর্থের জোরে প্রভাব বিস্তার করে। টাকার জোরে নির্বাচনে তারা নিজেরাও সরাসরি নির্বাচিত হয়, অথবা প্রভাবিত দল বা ব্যক্তিবর্গকে নির্বাচিত করে আনে। এমনি নানা ভাবে রাষ্ট্র পর্যায়ে ধনিক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঘুষের বা উপঢৌকনের মাধ্যমে কাজের প্রথা, পার্সেনটেজ বা ভাগাভাগির পথ তো আছেই। ধনিক শ্রেণীর পরিচালিত রাষ্ট্রগুলোর নিজেদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা প্রতিযোগিতা চলে। এক পর্যায়ে দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পর্বে সে দ্বন্দ্ব যুদ্ধেও রূপ নিয়ে থাকে। এভাবেই ছোটখাটো অসংখ্য দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের পর বিংশ শতকেই ইউরোপের বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বড় যুদ্ধ বেধে যায়, যাকে সবাই বিশ্ব যুদ্ধ বলে। বাজারহীন শিল্পোন্নত বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাজার বা উপনিবেশের মালিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর যুদ্ধ বাধে। এবং ক্রমান্বয়ে বিশ্বব্যাপী তা বিস্তার লাভ করে। কোন মার্ক্সবাদী রাষ্ট্র কিন্তু এ যুদ্ধ শুরু করে নাই। যদিও শেষ পর্যন্ত তাদের উপর আক্রমণ আসে এবং তারাও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

এই দু’টি বিশ্ব যুদ্ধে ইউরোপসহ সারা বিশ্বের কত লোক মারা গিয়েছিল? এবং এখনও পর্যন্ত ইরাক, আফগানিস্থানসহ মধ্য প্রাচ্যের নানা দেশেই যুদ্ধে মানুষ মরছে। সংখ্যার হিসাবে সেটা কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রগুলোর মানুষ হত্যার চেয়ে কি কম? কাজেই শুধু একদিকের হিসাবটা দেখলেই চলবে না। অবশ্য মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রগুলোর মানুষ হত্যার যে হিসাব তিনি দিয়েছেন সেটা কতটা নির্ভরযোগ্য সে প্রশ্নও করা যায়। তবু সে প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায় এসব যুদ্ধই কিন্তু বুর্জোয়া উদারবাদী বা ধনবাদী রাষ্ট্রের দ্বারাই সৃষ্ট।

যুদ্ধের কথা গেল, এবার বুর্জোয়া শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের আর একটা ব্যবসার কথা না বললেই নয়। শুধু ব্যক্তি স্বার্থের জন্যে যখন সম্পদ তৈরী ও তা বিপণন, তখন পপি থেকে অত্যাধুনিক প্রক্রিয়ায় নানা রকম অত্যাধুনিক নেশার দ্রব্য তৈরী এবং তা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়ে সম্পদ আহরণ তাদের চোখে আর দোষের কী? বুর্জোয়া বা উদারবাদী দর্শনের এ জাতীয় নিদর্শন সারা পৃথিবী ব্যাপী পরিব্যাপ্ত! আধুনিক গবেষণায় তৈরী আর একটি পণ্য ‘ইয়াবা’-র ছোবল শহর-বন্দর ছড়িয়ে এখন গ্রামগঞ্জের পথে-প্রান্তরে বিস্তার লাভ করেছে; একথা বাংলাদেশে বসবাসকারী যে কোন ব্যক্তি চোখ-কান একটু খোলা রাখলেই বুঝতে পারেন। এটা দেশের যুব সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পোঁছে দিচ্ছে। বুর্জোয়া শ্রেণীর এ জাতীয় ব্যবসার পক্ষে কি মন্তব্য করা উচিত? সমাজে যদি কোন নিয়ন্ত্রণ একেবারে না থাকে, তাহলে সে সমাজের পরিণতি এভাবেই বইতে হয়। আরও ভয়ঙ্করভাবেও বটে!

আবার ইসলামের স্বর্গরাজ্য বেহেশতে মানুষের সব চাহিদা মনে মনে চাহিবা মাত্র আপনা-আপনি পূরণ হয়ে যাবার মত ব্যবস্থায় আমোদ-প্রমোদ, মদ বা নেশার দ্রব্য এবং অঢেল হুর-গেলেমান বা যৌন সঙ্গীর সঙ্গে যৌন কর্মের তুলনা করে মার্ক্সের কাক্সিক্ষত সাম্যবাদী সমাজের উপর দোষ চাপানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ইসলামের পরজাগতিক স্বর্র্গরাজ্য ও মার্ক্সবাদের ইহজাগতিক স্বর্গরাজ্যের মাঝে মৌলিক মিল বিদ্যমান, যদিও তা সুস্পষ্ট উল্লেখ না হয়ে থাকতে পারে।’ ‘সুস্পষ্ট কোন উল্লেখ নাই’ তিনিই বলছেন; অথচ তিনি তা প্রমাণের জন্য উদগ্রীব। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের অভাব ও শ্রমসময় কমাবার মাধ্যমে মানুষের জীবনকে সহজ ও আরামপ্রদ করার আকাক্সক্ষাকে তিনি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মার্ক্সের আকাক্সক্ষা, ‘ সে সমাজে উৎপাদন ব্যবস্থা হবে সর্বোচ্চ, সম্ভব হলে পরিপূর্ণভাবে যন্ত্রায়িত।’ মানুষকে তার ব্যক্তিগত ও মননশীল উন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনের পথকে আলমগীর বেহেস্তবাসী মানুষের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যেখানে ‘মানুষের একমাত্র কাজ হবে আমোদ-প্রমোদ ও অবারিত যৌন কর্মে লিপ্ত হওয়া।’ তিনি বস্তুবাদী উৎপাদনশীল বাস্তব জগৎ আর সুখ কল্পনার স্বপ্নরাজ্য এক করে ফেলেছেন। মার্ক্সের সাম্যবাদী সমাজের চিত্রতো বহু দূরের স্বপ্ন। মার্ক্সবাদী সাম্যবাদের এক কাল্পনিক যৌন ভোগের চিত্র অনুমান করেছেন আলমগীর নিজের বিচারে বা কল্পনায়। যদিও মার্ক্স এরকম কোন বর্ণনা কোথাও দেন নাই তাও তিনি স্বীকার করেছেন। কিন্তু বর্তমানে তার সমর্থিত উদারবাদী তথা ধনবাদী বুর্জোয়া সমাজের ধনিকদের যৌন সম্ভোগের চিত্র কিছু পরিমাণে হলেও কি তিনি দেখতে পান? তাদের যৌনতার কোন খোঁজ-খবর কি কিছু রাখেন? দয়া করে একটু খোঁজ-খবর করুন। তারপর না হয় এ সম্পর্কে তিনি বলবেন। সমাজের সাধারণ মানুষ কিন্তু কিছু খোঁজ খবর রাখে। বর্তমান যুগের বুর্জোয়া সমাজের যৌন সম্ভোগের নেশা, নেশার এবং যৌনতার ব্যবসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছু খোঁজ রাখেন। অতীতেও ধনিক সম্প্রদায়ের যৌনতার নেশা এবং নেশার ব্যবসার কমতি ছিল না।


আমার মনে হয়েছে আলমগীর হুসেন সমাজে বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশে ব্যক্তি উদ্যোগকেই একমাত্র গুরুত্ব দেন। এই ব্যক্তি উদ্যোগের স্বাধীনতাকেই তিনি অর্থনৈতিক উন্নতির একমাত্র চাবিকাঠি মনে করেন। তার কোন কুফল আছে কি নাই, তা নিয়ে তিনি মনে হয় ভাবেন না। নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি উদ্যোগের কুফল নিয়ে সাদামাটা ভাবে দু একটি কথা উপরে আলোচনা করেছি। সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় তথা সমাজতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যেও যে ব্যক্তি উদ্যোগের দ্বার উম্মোচন করা যায়, প্রতিষ্ঠিত মার্ক্সবাদী বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের কেউ কেউ তা কার্যকর করেছে। যেমন প্রথমে চীন ও পরবর্তীতে ভিয়েৎনাম ব্যক্তি উদ্যেগকে ব্যাপকভাবে সুযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণও বহাল রেখেছে। এবং রাষ্ট্রীয় পুঁজিও পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছে। ফলে ব্যক্তি মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যার ফলে জাতীয় উন্নয়নে যেমন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকছে তেমন আবার তুলনামূলকভাবে দুর্নীতি ও নৈতিকতাহীন স্বেচ্ছাচারিতার লাগাম সহজে টেনে ধরে হ্রাস করা যাচ্ছে। আর উন্নয়নের গতি? তার প্রমাণ তো আমরা দেখছি। মাত্র কয়েক দশকের মধ্যে অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে চীন বিশ্বের দুই নম্বর শীর্ষ স্থানের অধিকারী। এমনকি বিশ্ব মিডিয়ার ভাষ্য অনুসারে আগামী এক বা দেড় দশকে চীন নাকি এক নম্বর অর্থনৈতিক শীর্ষ শক্তিতে পরিণত হবে। ভিয়েৎনামের উন্নয়নের গতিও চমকপ্রদ। তা হলে, নিয়ন্ত্রণ থাকলেই উন্নয়ন ব্যাহত হবে, গতি ধীরে হয়ে যাবে বলে যারা ভাবেন, তাদের চিন্তায় যে কিছু ভুল আছে, তা প্রমাণ হয়ে যায়।

বস্তুত বিশ্ব অর্থনীতিকে জনকল্যাণমুখী অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে হলে একচেটিয়া পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া উপায় নাই। নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিপুঁজির বিকাশ মানে নিয়ন্ত্রণহীন দৈত্যের হাতে সমাজের সকল মানুষকে বলির পাঁঠা হিসাবে ছেড়ে দেওয়া। যা কখনই মানব সমাজে মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। তাই সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মার্ক্সবাদের অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষা যাই থাক বাস্তবে মার্ক্সবাদ এই ধরনের একটি জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিয়ে গেছে। আর এভাবে তা মানব সমাজের অগ্রগতি সাধনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত ইসলাম যেখানে উৎপাদন বিমুখ যুদ্ধ ও লুণ্ঠন, বিধর্মী নারী ধর্ষণ, নারী নিগ্রহ ও অবরোধ, পশ্চাৎপদতা এবং মানুষের দাসত্বমূলক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠিত উৎপাদনশীলতা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য সমাধিকার ও মর্যাদা ও আধুনিক জীবন ভাবনার ভিত্তির উপর। এই বাস্তবতায় মার্ক্সবাদকে কোন অবস্থাতেই ইসলামের মত একটি পশ্চাৎপদ চেতনাধারী ধর্মের সঙ্গে একাকার করে দেখাটা ঠিক নয়। কোনভাবেই উৎপাদনধ্বংসী লুটেরা যুদ্ধ এবং অন্ধ ও অলৌকিকতাবাদী ধর্মযুদ্ধের সঙ্গে আধুনিক যুগচেতনা সমুদ্ভূত মার্ক্সবাদী বা কমিউনিস্ট বিপ্লবকে সমমাপে তুলনা করা সম্ভব নয়। যেমন রক্তপাত থাকাতেই কীভাবে ফরাসী বিপ্লবকে কিংবা আব্রাহাম লিংকনের নেতৃত্বে পরিচালিত আমেরিকার দাসত্ব বিরোধী গৃহযুদ্ধকে ইসলাম বা জিহাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা সম্ভব?

কয়েক লক্ষ বছরের জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে মানুষ আজকের মানব সমাজে উন্নীত হয়েছে। সামগ্রিক মানব সমাজের কল্যাণে পরিকল্পিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান, আইন, নিয়ম ও অর্থনৈতিক নিয়ম প্রয়োজন। অর্থাৎ সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জন্যই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। সেটা ব্যক্তিগত পুঁজি ও মালিকানার ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েও হতে পারে। হয়তো সেটাকে উন্নততর গণতন্ত্রের এক রূপ বলা হবে। সেটা হুবহু মার্ক্সের কল্পিত সমাজতন্ত্র না হতে পারে। কিন্তু এই ধরনের একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের প্রেরণা সঞ্চারী বা উদ্দীপক ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। মানুষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিখে। মার্ক্সবাদের অনেক সীমাবদ্ধতা বা ত্র“টি আছে যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। তবে সেটা ভিন্ন আরেক আলোচনার বিষয়। এই আলোচনা প্রসঙ্গে আমি এটুকু বলে এখানে শেষ করতে চাই যে মার্ক্সবাদ মানুষকে উন্নততর সমাজ নির্মাণে যে প্রেরণা এবং অমূল্য অভিজ্ঞতা দান করেছে তার মূল্য ফেলনা নয়। মার্ক্সবাদের সমালোচনা বা বিচারের সময় আমাদের এই দিকটি ভুলে যাওয়া উচিত নয় বলে আমি মনে করি। অন্যদিকে মার্ক্সবাদের সীমাবদ্ধতা বা ত্র“টি আলোচনা করতে গিয়ে আমরা যদি পাশ্চাত্যের বিদ্যমান উদারবাদকেই আমাদের সকল সমস্যার সমাধান বলে নির্বিচারে গ্রহণ করি তাহলেও আমরা ভুল করব বলে আমি মনে করি। আমাদের সমাজের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আমাদের পথ আমাদেরকেই স্বাধীনভাবে ও সৃজনশীলভাবে নির্ধারণ করতে পারতে হবে।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ