Banner
নবম অধ্যায় : শেখ মুজিবুর রহমান

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2013, 4:55 AM, Hits: 2558

এইবার মুজিব নামলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে শক্তি দেশে ছিল তার বিনাশ সাধনে। নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী তাজউদ্দিনকে প্রথমেই সরিয়ে দিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে পাকিস্তানের কাঠামোভুক্ত সেনা সদস্যদের দিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীকে রাখলেন। অথচ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান কতো বেশী তা কি তিনি জানতেন না? এটা ছিল সর্বজন বিদিত।

তবু পাঠকের অবগতির জন্য বাংলাদেশের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় লে: জেনারেল (অব:) জেএফআর জ্যাকব যিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চীফ অব স্টাফ তাঁর একটা বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে চাই। এটি শাহরিয়ার কবির কর্তৃক তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া। সাক্ষাৎকারটি ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত’ এই শিরোনামে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক জনকণ্ঠ-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। দৈনিক জনকণ্ঠের ৭ এপ্রিল, ১৯৯৬-এ প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে জ্যাকব বলছেন (শাহরিয়ার কবিরকে), ‘সম্ভবত আপনাদের ঐতিহাসিকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে এ সত্যটি নিশ্চয়ই বের করে নিয়ে এসেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে অসামরিক মুক্তি বাহিনী, নিয়মিত সেনাবাহিনী নয়।’

এই অসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা জীবনের সব রকম ঝুঁকি নিয়ে দলে দলে হাজারে হাজারে ঢুকেছিল দেশের গভীর অভ্যন্তরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য। অনেকের হাতে ছিল শুধু একটা হ্যান্ড গ্রেনেড। প্রবাসী লীগ সরকারের সেনাবাহিনী সদস্যদের মতো এরা বেতনভোগীও ছিল না। অথচ সেনাবাহিনী থেকে এদেরকেই বাদ দেওয়া হল। পাকিস্তানের নিকট রেখে যাওয়া ব্রিটিশ উননিবেশবাদীদের উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক কাঠামোটাকে এভাবেই রক্ষা করা হল এবং এই কাঠামোতে এসে জায়গা করে নিল পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা সদস্যরা। এই বুঝি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠা!

আমলাতান্ত্রিক সেনা কাঠামোর মতোই পাকিস্তানের ভাঙ্গাচোরা বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কাঠামোটাকেও খাড়া করা হল। সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের এক চমৎকার কীর্তি বটে! অন্যদিকে চলল লুটতরাজ আর দুর্নীতি। ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭-’৫৮ পর্যন্ত যে শিক্ষায় লীগ নেতারা তাঁদের অনুগামীদের তৈরী করেছিলেন সেই শিক্ষায় ব্রতী হয়ে তারা এবার নেমে পড়ল যে যেভাবে পারে সম্পদ আত্মসাতে। যাদের হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র নেই তারা এবার রাস্তায় নামল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাওয়া বন্দুক হাতে। যে যেখানে যেভাবে পারে বাড়ী, গাড়ী, অর্থ, জমি, অলঙ্কার এবং সব রকম সম্পদ আত্মসাৎ করে চলল। সকল লুণ্ঠনের কেন্দ্রীয় শক্তি হল আওয়ামী লীগ।

হয়তো এ সকল কথা অনেক লীগপন্থীর খারাপ লাগবে। তবু একটু স্মরণ করুন তো মুজিবের কথাগুলো ‘যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি চাটার দল’, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’

এই রকমই তো হবার কথা! কারণ আওয়ামী লীগকে তো তাঁর গুরু সোহরাওয়ার্দী এবং তিনি সেইভাবেই গড়ে তুলেছিলেন ১৯৫৬-’৫৭ থেকে। মাকাল গাছে আম হবে কি করে? অথচ দেশের সবাই কি চোর আর চাটার দল ছিল? ভাসানী? যাঁর গড়া আওয়ামী লীগ থেকে গুরু-শিষ্যে মিলে ১৯৫৭-তে তাড়িয়েছিলেন তাঁকে। বামপন্থীরা? তারাও কি চাটার দল, আর চোর ছিল?

বামপন্থীদের কথাটা বলা যাক। বামপন্থীরা কি কেউ মুক্তিযুদ্ধ করে নি? বাংলাদেশের ভিতরে থেকে যারা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তারা কি মুক্তিযোদ্ধা নয়? অতীতের ভ্রান্তি ভুলে কাজী জাফর এবং অন্যরাও কি পশ্চিম বাংলা থেকে দেশের ভিতরে জাতীয় যুদ্ধ গড়ে তোলেন নি? আবদুল মান্নান ভূঁইয়া কে ছিলেন? আবুল বাশাররাও কি ছিলেন না ঐ মুক্তিযুদ্ধে? তাদের সকলের অতীতটা কি চোর আর চাটার দলের মতো?

আর দেশের ভিতর যে হাজার হাজার বাম কর্মী ও যোদ্ধা ’৭১-এ যুদ্ধ করেছিল বিশেষত তরুণেরা এবং তাদের সঙ্গেকার কৃষক ও সাধারণ মানুষ, তারা কি সকলে অন্ধ পিকিংপন্থী বাম নেতাদের অনুসারী ছিল? তাদের কি মুজিব ডাক দিয়েছিলেন নূতন দেশ গঠনের জন্য? মস্কোপন্থীদেরকে সাইন বোর্ড নামিয়ে লীগে আসতে বলা যায়। কারণ ওরা ছিল লীগের লেজ বা অন্ধ অনুগামী মাত্র, যাদের লীগ কর্মীদের মতোও বন্দুক ধরার সাহসটুকু নেই। কিন্তু বাম শিবিরে এই যে হাজার হাজার বীর তরুণ যোদ্ধা ছিল তাদের ছিল মর্যাদাবোধ, একটা স্বাধীন চেতনা। তাদের অন্ধ অনুসারী হতে বললে হবে কেন? তাদের ডাক দিতে হত কর্মসূচীর ভিত্তিতে এবং সেই কর্মসূচীতে তাদের যথাযোগ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ ও মর্যাদা দানের ভিত্তিতে।

যখন স্বাধীন রাষ্ট্রে এই তরুণেরা নিজেদের কোনও স্থান পায় নি তখন তারা পুরাতন বাম নেতাদের গোঁয়ার্তুমি আর হঠকারিতার সহজ শিকার হয়েছে। এ এক দুর্ভাগা প্রজন্ম। তাদেরকে সবাই মেরেছে। মুজিব মেরেছেন, আবদুল হক মেরেছেন, আলাউদ্দিন-মতিন মেরেছেন, ইন্দিরা মেরেছেন এবং ইয়াহিয়া মেরেছেন।

এদের অবস্থাটা চিন্তা করলে আমার এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা মনে হয়। হাঁ, সবাই মিলে এদেরকেও মেরেছে। এদেরই রক্ত, অশ্রু আর অপমানের বিনিময়ে ফলানো ফসল সবাই সবচেয়ে বেশী ভোগ করেছে।

৭১-এর পাক হানাদার সেনাবাহিনীর আক্রমণ অভিযানের সময়কার বীভৎস অত্যাচারের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। সমস্ত বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ অভিযানের ভিতর তারা তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু করল এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে, যারা ছিল এ দেশের জনসংখ্যার মাত্র পনেরো শতাংশ। লক্ষ লক্ষ হিন্দু প্রাণ, সম্মান বাঁচাবার আশায় যে যেভাবে পারে দলে দলে সীমান্তের দিকে ছুটে চলেছে ভারত-রাষ্ট্রে আশ্রয় নেবার জন্য। বিশেষত পাক সেনাবাহিনীর প্রথম আক্রমণের মুখে যখন প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ল তখন পাক বাহিনীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হল হিন্দু। তখন সবাই তাদের শত্রু। চারদিকে শত্রু। এমন ঘটনাও তো জানি, যে হিন্দুটি ভাত খেতে বসেছে, প্রতিবেশী মুসলমান এসে তার ভাতের থালা লাথি মেরে দূরে নিক্ষেপ করে বলেছে, ‘এখনও তোরা আছিস? এখনও যাস নাই?’ তারপর তাদের একবস্ত্রে তাড়িয়ে দিয়েছে নিজ ভিটাবাড়ী থেকে।

হাঁ, এরাও বাঙ্গালী! এমন বাঙ্গালীর সেদিন অভাব হয় নি। যখন তারা দেখেছে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়েছে তখন তারা দলে দলে মুসলমান হয়ে গেছে, পাকিস্তানের সমর্থক হয়ে গেছে, হিন্দুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, বিহারী মারা বন্ধ করে এবার হিন্দু ধরা শুরু করেছে। লক্ষ লক্ষ নিযুত নিযুত হিন্দুর বাড়ী লুট হয়েছে। সবকিছু লুট হয়েছে। পথে পথে পাহারা দিয়ে লুটেরার দল। এমনও জানি পছন্দ হলে হিন্দু নারীদের জোর করে বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজনের দল থেকে কেড়ে নিয়ে সম্ভোগ করে হয়তো পরে ছেড়ে দিয়েছে। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। শুধু পথে নয়, গ্রামে, পাড়ায়। হিন্দু হওয়াটাই তখন বিপদের। মুসলমান তবু বাঁচতে পারে যদি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী না হয়, কমিউনিস্ট না হয়। অথবা তবু বাঁচা যেতে পারে। কারণ চারধারে আত্মীয়, বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী, এরা বাঁচাতে পারে। হিন্দুর কে আছে? অথবা মুসলমান শান্তি কমিটিতে যেতে পারে, রাজাকারও হতে পারে। হিন্দু যাবে কোথায়? পাক সেনাবাহিনী পথে পথে জিজ্ঞাসা করে বেড়াত ‘ইন্দু কেধার হ্যায়?’ হিন্দু হলে তার আর রক্ষা ছিল না। পুরুষের প্রাণ, নারীর সম্মান এবং শেষে প্রাণ ওসব সবই যেত পাক বাহিনীর হাতে, রাজাকারের হাতে। বাঙ্গালী মুসলমানদের এক বিরাট অংশই সেদিন এই হিন্দু নিধন যজ্ঞে শরীক হল। হিন্দুরা সবচেয়ে বেশী মূল্য দিল এ পারে। ওপারেও। মরল পঙ্গপালের মতো ওপারে ক্যাম্পে ক্যাম্পে। কত পরিবার নির্মূল হয়ে গেছে অসুখে! আমি তো নিজেই জানি এমন কৃষক পরিবারকে যার কেউ বেঁচে নেই। আমাদেরই কৃষক আন্দোলনের শরীক। স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্বপ্ন দেখা কৃষক দেখে নি স্বাধীনতা। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ-ই নয়। ঐ সময় দেশের ভিতরে হিন্দুদের লাঞ্ছনার অসংখ্য ঘটনা জানি। এমনও ঘটনার কথা জানি অনেক হিন্দু যুদ্ধের ভিতরে ভারতে যেতে পারে নি, হয়তো দূর কোনো গ্রামের ভিতর লুকিয়ে থেকেছে। সেখানে কখনও মুক্তি বাহিনীর যুবকেরাও হিন্দু নারীদের সম্ভোগের জন্য জোর করে টেনে নিয়ে গেছে।

হাঁ, এটাও ইতিহাস। মিথ্যার ঢাক-ঢোল-বাজনা বাজিয়ে সত্যের কণ্ঠটাকে আর কতকাল চেপে রাখা হবে? প্রতারণা, মিথ্যাচার দিয়ে কোন জাতি দাঁড়ায় না, দাঁড়াতে পারে না। তাই সত্যটাকেও আমাদের দেখতে হবে। শুধু আবেগ আর হুজুগে ভাসা নয়। কঠোর আত্মসমালোচনার প্রয়োজন আছে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দেশটাকে বসবাসযোগ্য করার জন্য, জাতিকে গৌরব দীপ্ত, মর্যাদাবান জাতিতে পরিণত করার জন্য আমাদের আজ আত্মানুসন্ধান করতে হবে। শুধু অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আর কতকাল পার পাওয়া যাবে? শুধু পাক বাহিনীর গাল-গল্প চালিয়ে আর কত কাল? আমাদের নিজেদের ভিতরের পাক বাহিনীর চেহারাটাকে দেখব না? নাকি অন্যকে দেখতে দিব না?

জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশকে, জাতিকে নূতনভাবে, আরও গভীরভাবে চিনেছি। তার সবলতার দিক, দুর্বলতার দিক। ওটা তো জাতি হিসাবে আমাদেরই। কলকাতায় গিয়ে বসে থাকি নি। বা শুধু সেখানে থেকে মুক্তিযুদ্ধের অংশীদার হই নি। সারা দেশ ঘুরেছি। মানুষের সুখ-দু:খ-বিপদ কাছে থেকে দেখেছি। সেসব আমারও ছিল। আমার প্রশ্ন, এ দেশে যারা শুধু হিন্দু হবার কারণে এই যে এতো দুর্ভোগ ভোগ করল তারা কি পেয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে? তারাও কি মুক্তিযোদ্ধা নয়? মুক্তিযোদ্ধা কি শুধু অস্ত্র হাতে নিলেই হয়? যে কৃষক এক বেলা যত্ন করে মুক্তিযোদ্ধাকে ভাত খাইয়েছে সেও কি মুক্তিযোদ্ধা নয়? এটা ঠিক যে, মুক্তিযোদ্ধার গুরুত্বের প্রভেদ আছে। সবার গুরুত্ব সমান নয়। তবু যারাই সেদিন স্বাধীনতা চেয়েছিল, স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছিল এবং তার জন্য মূল্য দিয়েছিল তারা কি সবাই মুক্তিযোদ্ধা নয়?

কিন্তু ৭০/৮০ লক্ষ বা তারও বেশী যে হিন্দু বাঙ্গালী ঘর-বাড়ী-সম্পদ সবকিছু হারিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল কিংবা এখানেও থেকে যারা সর্বহারা হয়েছিল তাদের পুনর্বাসনের জন্য সেদিন লীগ সরকার কি করেছিল? তারা কি বাঙ্গালী নয়, এ দেশের মানুষ নয়?

হাঁ, পাকিস্তান আন্দোলনের কালে হিন্দু জমিদার এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের একটা সংঘাত ছিল। কিন্তু পাকিস্তান হবার পর জমিদার আর উচ্চ বর্ণের হিন্দু কয়জন এ দেশে থেকেছিল? তারপর থেকে এ দেশে যারা থেকেছে তারা কি প্রায় সকলে নিম্নবর্ণের হিন্দু নয়? এমন কি তফসিলী হিন্দুরা তো ব্রিটিশ শাসনামলে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থনও দিয়েছিল। আর পাকিস্তান হবার পর সেই তফসিলী হিন্দুদের চব্বিশ বৎসর ধরে চমৎকার প্রতিদান দিয়েছে পাকিস্তানবাদীরা! স্বাধীন বাংলাদেশেও এই শূদ্র কৃষক আর নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দুর্ভোগটা সমান রইলএবং মুক্তিযুদ্ধের সময় মূল্যটা তারাই সবচেয়ে বেশী দিল।

মুজিব বললেন ত্রিশ লাখ বাঙ্গালীর মৃত্যুর কথা। কোনো দিন হিসাব করেছেন, গণনা করেছেন, খোঁজ নিয়েছেন কোথায় কয়জন মরেছে, কার কি ক্ষতি হয়েছে? আন্দাজি যা মনে এল বলে দিলেই হল! এই দায়িত্বহীনতা কোন্ চরিত্র থেকে আসে? এবং আজো এ দেশে এই দায়িত্বহীন হিসাব নিয়ে লাফালাফি করার লোকের অভাব নেই। তবু তিনি তো হিসাব ঘোষণা করেই খালাস! কখনও কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন সবচেয়ে বেশী মূল্য কারা দিয়েছে? হাঁ, তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিন্দুদের পুরস্কৃত করলেন পাকিস্তানী সাম্প্রদায়িকতাবাদী শাসকদের হিন্দু-পীড়নকারী শত্রু সম্পত্তি আইনটাকে অর্পিত সম্পত্তি আইন নামকরণ করে রেখে দিয়ে। এ দেশে এই হিন্দু-বিরোধী কর্মনীতি সকল সরকার গত পঁচিশ বৎসর ধরে চালিয়েছে। যত দিন গেছে মুসলমান না হবার অপরাধে হিন্দু বাঙ্গালীর উপর অত্যাচার তত বেড়েছে। জিয়া, এরশাদ, খালেদা হিন্দুদের উপর নির্যাতনকে ধারাবাহিকভাবে তীব্রতর করেছে। ফলে এ দেশের সন্তানেরা দলে দলে নিজ দেশ ছেড়ে চলে বাধ্য হয়েছে।

হাঁ, এই হিন্দুর মত ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের অবস্থাটা। ওদের কেউ নেই। কমিউনিস্ট নেতারা তাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে, কোণঠাসা করে, তাদেরকে ভুল পথে যেতে বাধ্য করে। যে যুদ্ধটা তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলল তাতে অংশ নিতে তারা দেয় না। একই কাজ আর এক দিক থেকে করে আওয়ামী লীগ, ভারত সরকার। তাদের ভূমিকার স্বীকৃতি দেবার কেউ নেই। বরং সবাই তাদের শত্রু। হিন্দু তবু হয়তো পশ্চিম বাংলায় গিয়ে একটা জায়গা খুঁজে নেবার চেষ্টা করতে পারেএরা যাবে কোথায়? এরা তো নকশাল! নকশাল হলেও নকশাল, না হলেও নকশাল। ১৯৭২-এ নকশাল দেখলেই গুলি করার হুকুম দিলেন মুজিব। এর মানেটা কি দাঁড়ায়? মনে আছে? ভাসানী বললেন, ‘নকশাল কি কারো গায়ে লেখা থাকে?’ যদি সেদিন ভাসানী ঐ হুংকার না দিতেন তবে মুজিবের হাতে আরো কত মানুষ সেদিন নিহত হত?

এ দেশে বাম নেতারা যে ভুলগুলো করেছিলেন, ৬ দফার বিরোধিতার নামে জাতীয় রাজনীতিকে পথভ্রষ্ট করেছিলেন তার জন্য অবশ্যই তাঁরা ধিক্কারযোগ্য। কিন্তু ৬ দফার নামে একই কাজ করার জন্য মুজিবও কি ধিক্কারযোগ্য নন? যদি শ্রেণী সংগ্রামটাই ধিক্কারযোগ্য হয় তবে ৬ দফা কেন হবে না? ৬ দফা শুধু মধ্যবিত্তের কর্মসূচী। ওটা শ্রমিকের নয়, কৃষকের নয়, নারীর নয়, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত জনগণের নয়।

জাতিকে বাদ দিয়ে যারা শুধু কৃষক-শ্রমিক দেখে তাদের সঙ্গে তাদের কি তফাৎ যারা শুধু মধ্যবিত্তকে জাতি বলে চালাতে চেয়ে তাকেই দেখে? দুই খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এ দেশে এক দিকে আওয়ামী লীগ, অপরদিকে পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো জাতিকে মেরেছে, জনগণকে মেরেছে এবং যে তরুণ প্রজন্ম জনগণকে নিয়ে একটা জাতি গঠন করতে চেয়েছিল তাদেরকে মেরেছে। আওয়ামী লীগের মারটা অনেক বেশী হয়েছে কারণ দিল্লীর সাহায্য পেয়েছিল।

তা না হলে হয়তো মারটা সমানে সমান হত জাতির জন্য, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের জন্য, যারা জনগণকে নিয়ে একটা নূতন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, এবং সেটা তারা হয়তো ফেরাতে পারত।

ওরা সবাই খণ্ডিত আর তাই ভ্রান্ত। এই ভ্রান্তির পিছনে যে উদ্দেশ্যই থাক, সেটা যত নীচ বা মহৎ হোক ফলটা খুব বেশী ভিন্ন নয়। অথচ এই দু’টো খণ্ডিত দিককে যদি এক করা যেত তবে জাতির চেহারাটা ভিন্ন হতে পারত। যারা এই কাজটা করতে চেয়েছিল এবং প্রকাশ্যে সাহস ভরে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের তেমন একটা কর্মসূচী দিয়েছিল সেই ছাত্র-যুব শক্তির কথাটা লীগ, মুজিবের মনে হল না। মনে হল না ভাসানীর কথাও যিনি নিজেও স্বাধীনতার কর্মসূচী ঘোষণা করেন ১৯৭০-এর ৩০ নভেম্বর।

হাঁ, জাতীয় রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্পষ্ট ঘোষণা যদি প্রকাশ্যে প্রথম এসে থাকে তবে সেটা ’৭০-এ ছাত্র-যুব শক্তি দ্বারাই প্রথম এসেছিল। এ দেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচী ওটাই। বাঙ্গালীর গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচী ওটাই। ওটা এসেছিল ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের পথ ধরে। ’৬৮-’৬৯-এর গণ অভ্যুথানকে ঐ কর্মসূচী নিয়ে গেছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। হয়তো কর্মসূচী ঘোষণার পদ্ধতিতে ভুল ছিল। শ্রেণী রাজনীতির উপর জোর দেবার কারণে কর্মসূচীও ছিল ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু তাতে কিছুই আসে যায় না। ঐ সময় আর কিছু না থাকায় ঐটারই দরকার ছিল। যেমন এক সময় আর কিছু না থাকায় দরকার ছিল ৬ দফারও।

৭২-এর সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসাবে ঘোষণা করা হল। সেকিউলারিজমের বাংলা অর্থ যে ধর্মনিরপেক্ষতা হয় না সে আলোচনা এখন করব না। তবে ধরে নেওয়া যাক সেকিউলারিজম অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষতা করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন এ দেশে চার মূল নীতির প্রকৃত শক্তি কে বা কারা? মুজিব যে ’৫৭-তে অমন একটা কাজ করলেন তারপর কারা এ দেশে জাতীয়তাবাদের পতাকাটা ধরে রেখেছিল? ঠিক আছে, তিনি না হয় ’৬৬-তে অতীতের ভুল বা অন্যায় যা-ই বলা যাক সংশোধন করলেন। কিন্তু সেকিউলার তিনি কতোটা ছিলেন? অথবা তাঁর চেয়ে বামপন্থীরা কি অনেক বেশী সেকিউলার ছিল না? তারাই কি এ দেশে দীর্ঘকাল ধরে সেকিউলার চেতনাটা গড়ছিল না? আর সমাজতন্ত্র? ওটার সমর্থক মুজিব কোন দিন ছিলেন? আর ভূমি সংস্কার সম্পূর্ণ না করা এবং আমলাতান্ত্রিক সেনা ও প্রশাসন গড়ে তুলে আমলাতান্ত্রিক স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার নাম বুঝি গণতন্ত্র?

আসলে মুজিব এই চারটি নীতির শক্তিই ধ্বংস করলেন বৎসরের পর বৎসর ধরে। যারা এগুলো গড়েছিল তাদেরকে ধ্বংস করলেন রক্ষী বাহিনী দিয়ে, সেনাবাহিনী দিয়ে, পুলিশ দিয়ে, প্রশাসন দিয়ে, আওয়ামী লীগ দিয়ে। যারা বৎসরের পর বৎসর ধরে জনগণের মধ্যে পড়ে থেকে এই চার নীতিকে জনগণের চেতনায় আনছিল তাদের ধ্বংস করা হল, ছত্রভঙ্গ করা হল। এমন কাজ বুঝি অন্যান্য দেশের বিপ্লবের নেতারা করেছিলেন? ক্যাস্ট্রো বুঝি এইভাবে সমাজতন্ত্র গড়েছিলেন কিউবায়?

না, তিনি একাই সব খাবেন। সব কৃতিত্ব তাঁর একার চাই। আর তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারা খাবে তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে। কাউকে তিনি ডাকলেন না। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল ভারত-রাষ্ট্রের ছায়ার নীচে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ভারত-রাষ্ট্রের ছায়া নিয়ে এল আওয়ামী লীগ। আর শেখ মুজিব এলেন পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের ছায়া নিয়ে। এবার তিনি ভারত-রাষ্ট্রের ছায়াকে ধরে রেখে দিল্লীকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে রেখে পাকিস্তানের পুরাতন সামাজিক-রাষ্ট্রিক বিন্যাসটাকে পুন:প্রতিষ্ঠার কাজ করলেন। কী চমৎকার এক জাতীয়তাবাদী, গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী আর সেকিউলার রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্বিন্যস্ত করা হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর চার মূল নীতির ঝাণ্ডা উঁচিয়ে!

হাঁ, জাতীয়তাবাদ বটে! এমন জাতীয়তাবাদ যা বাঙ্গালীকেও মারে, অবাঙ্গালীকেও মারেমারার একটা ছুতা পেলেই হল। সেটা নকশাল হতে পারে, বিহারী হতে পারে, জুম্ম বা পাহাড়ী হতে পারে, মুজিববাদ-বিরোধী হতে পারে, সুযোগ পেলে হিন্দুও হতে পারে, যে কোনো একটা হতে পারে।

আমার সেই সব বিহারীর কথা ভেবে আজো দু:খ হয় যারা ন্যাপ করত, শ্রমিক ফেডারেশন করত, ছাত্র ইউনিয়ন করত। বিহারীদের একটা বড় অংশ তখন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য আমাদের আন্দোলনে ছিল। বিহারীদের সংখ্যাগুরু তারা ছিল না। কিন্তু তারা সংখ্যায় একেবারে কমও ছিল না। হাঁ, বিহারী হয়েও তারা চেয়েছিল বাঙ্গালীর স্বাধীনতা। তারা চেয়েছিল বাঙ্গালীদের সঙ্গে মিলে মিশে এক স্বাধীন রাষ্ট্রে বাস করতে যেখানে শোষণ থাকবে না, জাতিগত নিপীড়ন থাকবে না, বাঙ্গালীর নামেই হবে সে দেশ তবু তারা তার গর্বিত বাসিন্দা হবে। তাদেরকেও কাতারে কাতারে হত্যা করা হয়েছে, তাদের নারীদের সম্ভ্রম নষ্ট করা হয়েছে, তাদের সহায়-সম্পদ লুট করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর সময়টাতেও এবং যুদ্ধের পরেও। কেন তাদের কি অপরাধ? বিহারী হলেই মারতে হবে এ কোন্ জাতীয়তাবাদ? এই বুঝি মুজিববাদ! যারা অপরাধ করেছে সেই জামাত-রাজাকারদের এ দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়, কিন্তু নিরপরাধ মানুষদের হত্যা ও ধ্বংস করা হয়। মিথ্যা আর ফাঁকির এই দেশে যুদ্ধের পর যত কঙ্কাল পাওয়া গেল সব বাঙ্গালী গণহত্যার চিহ্ন হল, কিন্তু যে অসংখ্য নিরপরাধ বিহারীকে হত্যা করা হল তাদের আর কঙ্কাল রইল না! কঙ্কালের গায়ে কি বাঙ্গালী, বিহারী লেখা থাকে? কাজেই দেখালেই হল! এটা দেখিয়ে আরও ফাঁকি দেওয়া যাবে। বিদেশীদের সহানুভূতি, আরও অর্থ আদায়ের যত ফন্দিফিকির! এ দেশে নির্দোষ নিরপরাধ বিহারীদের অতো বিশাল, বিপুল শোকের কথাটাও বলার কেউ রইল না। তাদের দু:খে দু:খ প্রকাশ করবে এমন সাহস কার?

বাংলাদেশ তো শুধু বাঙ্গালী জাতিসত্তার দেশ নয়। এখানে সংখ্যালঘু আরও বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষ বাস করে। তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাতে যোগও দিয়েছিল। আমার মনে আছে সাঁওতালরা তীর-ধনুক নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে গিয়েছিল। জানি আজকের যুদ্ধে তীর-ধনুক কোনো কাজের নয়। তবু কি তারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল না? তারা কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দেবার কারণে মূল্য দেয় নি? কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের কি দিয়েছে? সংখ্যালঘু কোন্ জাতিসত্তার কি অধিকার দেওয়া হয়েছে?

পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জাতিসত্তার জনগণ যারা আজ জুম্ম নামেও পরিচিত ষাটের দশকে তাদের ছাত্ররা সকলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং পরবর্তী কালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) করততারা সকলেই ছিল স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতির দৃঢ় সমর্থক। তাদের আশা ছিল যে, বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্রে তাদের একটা মর্যাদার জায়গা হবে, তারা স্বায়ত্তশাসন পাবে। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জুম্ম যুবকেরা তাতে যোগ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কোনো বামপন্থীকে যেমন যে সুযোগ দেওয়া হয় নি তেমন তাদেরকেও সে সুযোগ দিতে চাওয়া হয়নি। অবশ্য এর পরেও কয়েক জন জুম্ম যুবক সে সুযোগ করে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তাদের জাতিসত্তাগত মর্যাদা ও অধিকার অস্বীকার করা হল এবং তাদের উপর জোর করে বাঙ্গালী পরিচয় চাপাতে চাওয়া হল। জুম্ম জনগণের অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা যখন পার্বত্য চট্টগ্রামীবাসীর স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগত মর্যাদা এবং তাদের স্বায়ত্তশাসনের দাবী বিবেচনার জন্য মুজিবের কাছে আবেদন জানালেন তখন মুজিব তাদের বাঙ্গালী হতে বললেন এবং হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘লারমা, তুমি কি মনে করো! তোমরা আছ ৫/৬ লাখ। বেশী বাড়াবাড়ি করো না। চুপচাপ করে থাকো! বাড়াবাড়ি করলে তোমাদেরকে অস্ত্র দিয়ে মারবো না। (হাতের তুড়ি মেরে মেরে তিনি বলতে লাগলেন) প্রয়োজনে ১,২,৩,৪,৫-১০ লাখ বাঙ্গালী ঢুকিয়ে তোমাদের উৎখাত করব, ধ্বংস করব।’

মুজিবের আমল থেকে জুম্ম জনগণের উপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার শুরু হয় খালেদা জিয়া পর্যন্ত সকল সরকার সেটিকেই অব্যাহত রেখেছে। এই অত্যাচারের একটা তুলনা হতে পারে নয় মাস পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙ্গালী জাতির উপর যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তার সঙ্গে। তবে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জায়গাটা দখল করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।

এ দেশে প্রায় পঁচিশ বৎসর তাদের কথা বলারও প্রায় কেউ ছিল না। তাদের পুরুষেরা নিহত, নারীরা ধর্ষিত অথবা অপহৃত, তাদের ঘর-বাড়ী, জমি লুণ্ঠিত - এই হল এক নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পঁচিশ বৎসরের ইতিহাস।

এইভাবে যে জাতি হতে চেয়েছিল বাঙ্গালী জাতির বন্ধু, সহযাত্রী তাদেরকে বাধ্য করা হল হাতে অস্ত্র তুলে নিতে। যারা ছিল বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দৃঢ় সমর্থক তাদের কখন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে কখন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে এক নির্দয় দমন ও উৎসাদনের সামরিক যন্ত্র দ্বারা ছিন্নভিন্ন করে বাধ্য করা হল সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিতে।

এখনও যখন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কথা মনে পড়ে আমি গভীর বেদনা অনুভব করি। একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী এমন বিশাল হৃদয় ও চেতনার অধিকারী নেতার জন্ম দিতে পেরেছিল এ কথা যখন আমি ভাবি তখন ঐ জনগোষ্ঠীর প্রতিই আমার মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়। তিনি ছিলেন গণতান্ত্রিক বাঙ্গালীর অকৃত্রিম বন্ধু। মুজিবের সন্ত্রাসের সেই দিনগুলোর কথা মনে হয় যখন তিনি এত অত্যাচারের পরেও বলতেন বাঙ্গালী জাতির সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করার কথা। সকল অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। দীর্ঘ কাল তিনি ছিলেন যুদ্ধ বিরোধী এবং তিনি ছিলেন দিল্লী বিরোধী। হাঁ, ভারত-রাষ্ট্রের আধিপত্য বিরোধী তিনি ছিলেন।

আসলে তো তিনি আমাদের সেই প্রজন্মেরই মানুষ। সেই বিপ্লবী প্রজন্মের স্বাধীন চেতনাটা নিয়ে তিনিও বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁকে বেশী কাল কাছে পাই নি। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের ভিতর আমি বিশাল এক মানুষকে অনুভব করেছি আমার হৃদয়ের ভিতর। হয়তো তিনি জুম্ম জাতির ভাসানী। কিন্তু তাঁর ছিল আধুনিক শিক্ষা। তাঁর গুণে তিনি ছিলেন আরও অগ্রগামী; মার্জিত, নম্রকিন্তু ভাসানীর মতো এক অনম্র তেজ আর সহানুভূতি নিয়ে তিনি নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য দাঁড়াতে পারতেন। তাঁর জাতি ছিল অপরিমেয় নিগ্রহ, লাঞ্ছনা আর উৎসাদনের শিকার। সুতরাং তিনি তাদের জন্য দাঁড়ালেন।

দেওয়ালে যখন পিঠ ঠেকে গেল তখন তিনি রুখে দাঁড়ালেন, দাঁড়াতে বাধ্য হলেন। প্রায় ৮ কোটি মানুষের রাষ্ট্রের অধিপতিদের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন এক অতি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। শুরু হল এক অতি অসম যুদ্ধ। এইভাবে বাংলাদেশের শাসকেরা দিল্লী সরকার বিরোধী নেতাকে ঠেলে দিল দিল্লীর কাছে। আমার আজো প্রশ্ন আছে কে তাঁকে হত্যা করেছে? কাদের অতি নীচ চক্রান্তের শিকার ঐ স্বাধীনচেতা বিপ্লবী পুরুষ? কারা তাঁকে হত্যা করে একটা সংগ্রামী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন নেতৃত্বের শক্তিকে বিনষ্ট করতে চেয়েছিল?

এই হল মুজিবের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ! এই হল জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ! এই জাতীয়তাবাদের কথা উচ্চারণ করতেও ঘৃণা হয়। ধিক এমন জাতীয়তাবাদকে যা শুধু সংখ্যালঘু আর দুর্বল হবার কারণে এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীকে পাক হানাদার বাহিনীর মতোই নির্যাতন করে। নয় মাস নয় পঁচিশ বছর। আর প্রায় একুশ বছর আগে জুম্ম জাতি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। এবং একুশ বছর যুদ্ধ করে বাঙ্গালীকে শেখাচ্ছে কিভাবে জাতি হতে হয়।

আবদুল গাফফার চৌধুরী ফ্যাসিবাদের সবক দিয়েছেন । ওটা নাকি শুধু ইউরোপের! তা জার্মানী-ইটালীর ফ্যাসিবাদ মুজিব পাবেন কোথা থেকে? হিটলার-মুসোলিনির ঐ সাহস, তেজ, শক্তি তাঁর কোথায়? তাঁর যেমন সাহস, শক্তি, চরিত্র তেমনই তো তাঁর ফ্যাসিবাদ হবে! ঠিক আছে গাফফার চৌধুরীর একে ফ্যাসিবাদ বলতে যখন এতই আপত্তি তো এর একটা নাম দেওয়া যাক লুম্পেন ফ্যাসিবাদ। হাঁ, হিটলার-মুসোলিনির শেখানো ফ্যাসিবাদের অক্ষম, পঙ্গু, বিকৃত কিন্তু ধ্বংসাত্মক অনুকরণ এক লুম্পেন ও লুটেরা শ্রেণী কর্তৃক। আর এ লুম্পেন ফ্যাসিবাদেরই নাম দেওয়া হল এ দেশে মুজিববাদ।

আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা সব কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ আমার নেই। তবে মনে হয় আমার লেখার ভিতর দিয়ে তাঁর যুক্তি ও বক্তব্যগুলোর জবাব বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু বাকশাল সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তার একটা জবাব দিয়ে আমি তাঁর প্রসঙ্গ শেষ করব। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও যখন লক্ষ্য করলেন, পশ্চিমা গণতন্ত্রের ছিদ্রপথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জনসাধারণের অধিকারের উপর ক্রমাগত হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে তখন তিনি বাকশাল গঠনের মাধ্যমে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ফ্যাসিবাদী হলে, বিশ্ব ধনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের বরকন্দাজ হলে তাঁকে এমন নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হত না। শেখ মুজিবের বাকশাল প্রতিষ্ঠা হয়তো সময়োপযোগী ছিল না; কিংবা তার প্রতিষ্ঠা-পদ্ধতিও ত্রুটিমুক্ত ছিল না (তার জন্য প্রাণ দিয়ে তাঁকে চড়া দাম দিতে হয়েছে), কিন্তু তাঁর বাকশাল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ও বিতর্ক সৃষ্টি করা কোনো যুক্তিনিষ্ঠ রাজনীতিকের পক্ষে সম্ভব নয়। দীর্ঘকাল বামপন্থী রাজনীতি করার পরেও মেননের মধ্যে এই যুক্তিনিষ্ঠা ও বাস্তববাদিতার অভাব দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।’ (আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলাম, কাছে দূরে, ‘গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার, ফ্যাসিবাদ এবং সুবিধাবাদী বিশ্লেষণ’, ভোরের কাগজ, ঢাকা, ২২ আগস্ট ১৯৯৬)।

মুজিব বাকশাল কখন করলেন? ১৯৭২ থেকে সমাজতন্ত্রের নাম ব্যবহার করে ‘চাটার দল’ এবং ‘চোরের খনি’ নিয়ে তিনি গড়তে গেলেন পুঁজিবাদ এবং এই পুঁজিবাদ গড়ার জন্য তিনি সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের নামে যা করার করলেন। আসলে তিনি গড়লেন লুম্পেন পুঁজিবাদ, যার আপাদমস্তক লুটেরা ও ধ্বংসাত্মক। আর তাঁর গণতন্ত্র হল লুম্পেন ও ফ্যাসিবাদী গণতন্ত্র।

শেষে তাঁর চৈতন্যোদয় হল। ১৯৭৫-এর ২৫ জানুয়ারীতে তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করলেন সংসদের মাধ্যমে। এরপর হাত দিলেন বাকশাল প্রতিষ্ঠায়। তাঁর মনে হল সব তো খাওয়া হল এবার সমাজতন্ত্রটাও খাওয়া যাক! আসলে তিনি স্বাভাবিক বুদ্ধি বশেই বুঝেছিলেন যে, এই কয় বৎসর তিনি যে পথে এগিয়েছেন তাতে তাঁর ধ্বংস এখন অনিবার্য। এই ধ্বংসের হাত থেকে তিনি বাঁচতে চাইলেন। বাকশাল গঠনের পদ্ধতি নিয়ে আমি আলোচনা করব না। কারণ পৃথিবীর কোনো সমাজতান্ত্রিক বা জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবে ঐ রকম পদ্ধতিতে কোনো একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নি। মুজিবের গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, জাতীয়তাবাদ, সেকিউলারিজমের মতোই এটা হল এক উদ্ভট ও বিকৃত সমাজতন্ত্র। বলা যায় তিনি এতকাল ধরে যে লুম্পেন পুজিঁবাদ গড়লেন ওটা হল তার বিপরীত এক লুম্পেন সমাজতন্ত্র। তবু এর ভিতর ছিল একটা আকাঙ্ক্ষা, জন-গণতন্ত্রেরও এক ধরনের চেতনা। কিন্তু তিনি যে সমাজতন্ত্র বলা যাক জন-গণতন্ত্র বলা যাক সেটা গড়বেন কিভাবে? তিনি তো ইতিমধ্যে এর শক্তিগুলোকে ধ্বংস করেছেন, ছত্রভঙ্গ করেছেন, তাদেরকে নিজ শত্রুতে পরিণত করেছেন হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন দিয়ে। হাঁ, মুজিববাদী আর রক্ষী বাহিনীর সেইসব নির্যাতনের অনেক ঘটনা আমি জানি। ভয়ানক ক্ষোভ জেগে ওঠে যখন মনে হয় সেই সব নারীর কথা যাদের স্বামী, ভাই বা আর কেউ বামপন্থী হবার কারণে তাদেরকে মুজিবাদী অথবা রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করত, কাউকে দিনের পর দিন মুজিবাদী কিংবা রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্পে আটকে রেখে ঐ নিগ্রহের শিকার করত। আমার প্রশ্ন যদি কোনো পুরুষ ভুল রাজনীতি করে, এমন কি অপরাধ কিংবা গুরুতর অপরাধও করে তবে সেই অপরাধের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই এমন কি কিছুই যাদের জানাও নেই সেই নিরপরাধ, অসহায় নারীরা কেন এমন নিগ্রহের শিকার হবে? ইয়াহিয়াবাদেরই কি আরেক রূপ মুজিববাদ? এইসব অপরাধ, অন্যায়ের জন্য মুজিব কি কোনোদিন অনুতাপও প্রকাশ করেছিলেন?

তিনি বন্দী করে নিয়ে এসে সিরাজ শিকদারকে হত্যা করলেন। সিরাজ শিকদারের রাজনীতির পদ্ধতিতে ভুল ছিল। কিন্তু এ দেশে তাঁর কি কোনোই অবদান ছিল না? ভুল মানুষেরই হয়। সেই ভুল সংশোধনের সুযোগ কি তাকে দিয়েছিলেন? তাকে তিনি কোনো দিন ডেকেছিলেন? তিনি যেমন কাউকে চান নি তেমন সিরাজকেও চান নি। যে তরুণ ষাটের দশকে গোপনে হলেও প্রথম উচ্চারণ করল স্বাধীনতার বাণী তাকে এভাবে হত্যা করার কোন্ অধিকার মুজিবের ছিল? পাক বাহিনী ছাড়া যায়, রাজাকার ছাড়া যায়, জামাত ছাড়া যায়! সিরাজকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না! বিনা বিচারে বন্দীকে হত্যা করলেন তিনি।

হাঁ, সব শেষ করে তাঁর এখন মনে হল তিনি সমাজতন্ত্র গড়বেন। সমাজতন্ত্র যে গড়বেন তার শক্তিটা কোথায়? তার আগেই না তিনি সব শেষ করে দিয়েছেন! এ হল হিটলারের আত্মহত্যার পূর্বের, চূড়ান্ত পরাজয়ের কিছু পূর্বের দিনগুলোতে মানচিত্রে যুদ্ধ পরিকল্পনার নকশা আঁকার মতো। তখন তাঁর সব বাহিনী প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। নাৎসি বাহিনী কোনো রকমে বার্লিন রক্ষার জন্য মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ছে। চারদিক থেকে মিত্র শক্তির বাহিনীগুলো ধেয়ে আসছে বার্লিনের দিকে বার্লিনের পতন ঘটাবার জন্য। বোমা বর্ষণে রাজধানী বার্লিন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বার্লিন পতনের আর বেশী দিন নেই। হিটলার তখন মাটির নীচে বাঙ্কারে থেকে তাঁর পঙ্গুপ্রায় কম্পমান হাত দিয়ে মানচিত্রের উপর তাঁর নবতর যুদ্ধাভিযানের পরিকল্পনা তৈরী করতেন। রেখা এঁকে তাঁর অনুচরদের দেখাতেন কোন্ কোন্ ফন্সন্টে এবার তাঁর সৈন্যবাহিনী ধেয়ে যাবে, কোন্ জায়গায় বিদ্যুৎ গতিতে আঘাত করে শত্রু বাহিনী ধ্বংস করে কোন্ নগর, কোন্ দেশ এবার দখল করবে। এদিকে তাঁর সেনাবাহিনীই তখন প্রায় শেষ। প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।

ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, তবু নিধিরাম সর্দার! হিটলারের ঐ যুদ্ধাভিযান পরিকল্পনার মতো তখন মুজিবের সমাজতন্ত্রাভিযানের পরিকল্পনা। সমাজতন্ত্রের সমস্ত শক্তি নিজ হাতে নি:শেষ করে এখন তাঁর মনে হল এমন চমৎকার বস্তু আর হয় না!

তা, সমাজতন্ত্র যে গড়বেন কাকে নিয়ে গড়বেন? কর্মী বা ক্যাডার লাগে না? তাঁর দল তখন এক দঙ্গল লুটেরার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। হাঁ, আছে মস্কোপন্থী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, সংক্ষেপে সিপিবি। সমাজতন্ত্রের হাতিয়ার হবে সিপিবি? সমাজতন্ত্রটা কি জিনিস? শুধু জাতীয়করণ করলেই হল? প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্র আধুনিক যুগে বিপ্লবের একটা ধারণা। সহজভাবে বললে এটি হল একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সংগঠিত এমন এক সশস্ত্র বিপ্লব যার মাধ্যমে এই দল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে জনগণকে নিয়ে একটা নূতন রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংগঠিত করবে এবং এই নূতন রাষ্ট্র ব্যবস্থার সাহায্যে সংগঠিত করবে এমন এক অর্থনীতি যা কমিউনিজমের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ অভিমুখীও হতে পারে আবার অনেকাংশে একটি উদার ও উৎপাদনশীল বুর্জোয়া বা ব্যক্তি-পুঁজিবাদ অভিমুখীও হতে পারে। রাশিয়া প্রথম পথটা নিয়েছিল। আর চীনের পথ হয়েছে শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয়টি।

যে অর্থেই আমরা সমাজতন্ত্রকে নিই ওটা গড়া সিপিবি-এর কর্ম নয়। কারণ তা বিপ্লবই বোঝে না। সমাজতন্ত্রের কথা বললেই যদি সমাজতন্ত্রী কিংবা বিপ্লবী হওয়া যায় তাহলে পাখা থাকার দরুণ আরশোলাও পাখী হয়। আরশোলা যেমন পাখী, সিপিবি-ও তেমন সমাজতন্ত্রী কিংবা বিপ্লবী যা-ই বলা যাক তা-ই।

আসলে এই সিপিবি বা মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির বলয়ে গড়ে ওঠা বুদ্ধিজীবীরাই এ দেশে মুজিববাদের এবং আওয়ামী লীগের লুম্পেন রাজনীতির সবচেয়ে যোগ্য, দক্ষ প্রবক্তা বা দার্শনিক, যা-ই বলা যাক, হয়েছে। এরা হল সমাজের লুম্পেন গোষ্ঠীর সবচেয়ে মার্জিত, সবচেয়ে সংস্কৃত ও শিক্ষিত আর তাই সবচেয়ে ধূর্ত বুদ্ধিজীবী। এরা এ দেশে সেকিউলার ও দেশী সংস্কৃতি চর্চার নামে শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতি চেতনার আধুনিক রূপটির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিনিধি। এদের এতটুকু তেজ নেই, সাহস নেই; এদের উৎসর্গের, ত্যাগেরও প্রেরণা নেই। পশ্চাৎপদ জনগণের সঙ্গে সংযোগ নেই। সমাজ বিচ্ছিন্ন, জনগণ বিচ্ছিন্ন এরা বিদেশের যাবতীয় সংযোগ হাতে রেখে এ দেশে সব সময় নিজেদের প্রগতির পতাকাবাহী রূপে দেখিয়েছে। এরা গজদন্ত মিনারে বসে সেকিউলার ও দেশজ সংস্কৃতির যে রূপটা তৈরী করেছে তার অন্ত:সারশূন্যতা তাদের চরিত্রেও প্রতিফলিত। আর তাই তাদের প্রায় সবটা লোক দেখানো, মেকী। তারা ভাবে তারাই বুদ্ধির জগতে এ দেশের সবচেয়ে বড় উদ্ধারকর্তা। বঙ্গবন্ধু বলতে বলতে এদের মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। কিন্তু যেদিন এদের ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’ নিহত হন, এদের একটাকেও রাস্তায় নামতে বা ঘরের বাইরে দেখা যায় না। আসলে এই জাতির এক নিদারুণ সুযোগ সন্ধানী, নীতিহীন ও মেরুদণ্ডহীন লুম্পেন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী যে লুম্পেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে এরা হল তার যোগ্য সহচর, অনুচর, পারিষদ ও দার্শনিক। এ দেশের লুম্পেন বুদ্ধিজীবীদের এরাই হল শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, মাথা।

না, এদের অবদানও আমি অস্বীকার করি না। এই পশ্চাৎপদ বান্দা সমাজে একটা সেকিউলার সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তারে এদের অবদান বিরাট। কিন্তু এদের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কেও আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এরা যতটা দেয়, নেয় তার চেয়ে অনেক বেশী। যতটা ভাল করে, ক্ষতিটা করে তার চেয়ে বেশী। এবং এরা জনগণকে নিয়ে নূতন একটা বলবান, উন্নত, সেকিউলার ও মানবিক সংস্কৃতি গড়ার পরিবর্তে যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে তাও ওদের শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির মতোই নিবীর্য এবং সম্পূর্ণ উচ্চবর্গীয়। এবং এরা অনুদার, সঙ্কীর্ণ। আসলে মহৎ, উদার হতে পারে শক্তিমানেরা, সাহসীরা। সুতরাং এদের সংস্কৃতির মধ্যে মহত্ত্ব, উদারতা, সব কিছুকে সমালোচনামূলকভাবে দেখা এবং ভালমন্দ উভয় দিক বিচার করে মন্দটা বাদ দিয়ে ভালটা নেওয়ার শিক্ষা আসবে কি করে? এরা এ দেশে বান্দা সংস্কৃতির বর্বরতার উল্টা পিঠ মাত্র।

আর এমন এক মেরুদণ্ডহীন সংস্কৃতির মূল চালিকা শক্তি হল সিপিবি, যার মধ্যে নেই বিপ্লবের সাহস, আকাঙ্ক্ষা, চরিত্র। শুধু পরের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে যারা পথ চলতে চায় এবং নিজেদের পায়ে ভর দিয়ে চলার শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই তারা কিভাবে হবে মুজিবের সমাজতন্ত্র গড়ার সৈনিক? শুধু ত্যাগ, সততা ও আদর্শ নিষ্ঠা থাকলেই হবে? দেশে যুদ্ধের ভিতর দিয়ে যে বিরাট শক্তি মুক্ত হয়েছিল তাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ধ্বংসের পরিবর্তে সৃষ্টির শক্তিতে পরিণত করার ক্ষমতা এবং বিদ্যাটা তো যে পথ বা মতের হোক একমাত্র বামপন্থীদেরই হাতে ছিল। তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশকেও যদি মুজিব নিতেন বা নিতে পারতেন তাহলে এই শক্তিটাকে আয়ত্ত করার ক্ষমতাটাও পেতেন। কারণ সংখ্যাটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল গুণ বা ‘কোয়ালিটি’ঐ গুণের শক্তিটা নেতৃত্বে গেলে পরিমাণটাও তখন শক্তিতে পরিণত হতে পারে।

কিউবার মস্কোপন্থী মার্কসবাদীরা তো বিপ্লবী ছিল না। কিন্তু তাদের জনগণকে সংগঠিত করার, জনগণের মধ্যে কাজ করার যে দীর্ঘ ঐতিহ্য ও ক্ষমতাটা গড়ে উঠেছিল ক্যাস্ট্রো তাঁর নিজের সশস্ত্র বিপ্লবের অভিজ্ঞতা ও তেজসহ তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করে তাদের সেই ঐতিহ্য ও ক্ষমতাটাকেই আত্মস্থ করলেন। ফলে কিউবার বিপ্লব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মতো ব্যর্থ হয় নি। হাঁ, সিপিবি-এর রূপান্তর সম্ভব ছিল, যদি তা বামপন্থী বিপ্লবী শক্তির নেতৃত্বাধীন হত। কিন্তু মুজিব কি প্রকৃত বামদের সঙ্গে নিয়েছিলেন, যাদের সঙ্গে নিলে তিনি শুধু সিপিবি-কে নয়, দেশটাকেও বদলাতে পারতেন?

তিনি সমাজতন্ত্রী কোনোকালে ছিলেন না। বরং তার বৈরী ছিলেন। তিনি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক কোনোকালে ছিলেন না। বরং তার বিরোধী ছিলেন। তবু তিনি সমাজতন্ত্রী হলেন, মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হলেন! এটা কি প্রতারণা নয়?

মানুষের বিশ্বাসের, ধারণার পরিবর্তন হতে পারে। সেটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু তখন কি করণীয়? যে সৎ হয়, সে এই পরিবর্তনের শক্তিটাকে যারা গড়ে তোলে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, তাদেরকে সাথে টেনে নেয়, তাদেরকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিয়ে প্রকৃত ভূমিকাটা পালন করতে দেয়, আর এইভাবে নিজে আরও বড় হয়ে ওঠে। যে এটা করতে পারে সে আত্মস্থকারী হতে পারে, আত্মসাৎকারী নয়। মুজিব ছিলেন আত্মসাৎকারী। সবাই কষ্ট করবে, ঘাম আর রক্ত দিয়ে ফসল ফলাবে আর তিনি তাঁর একদল লুটেরা-লুম্পেন চ্যালাচামুণ্ডা নিয়ে আর একদল লুম্পেন বুদ্ধিজীবী নিয়ে সেগুলো সব একাই আত্মসাৎ করবেন। সব খাওয়ার একাই খাবেন; আর তাঁর চরিত্রহীন, লুম্পেন অনুসারীরা তাঁকে সামনে রেখে খেয়ে যাবে সব, গোটা দেশ, জাতির ভবিষ্যৎ। সবাইকে বঞ্চিত করে, সবার সব আহার কেড়ে নিয়ে একা খেতে গেলে পেট ফেটে যায়!

না, মুজিবের সাধ্য ছিল না সে যে বামই হোক তার কাছে যাবার কিংবা তাকে কাছে নেবার। কারণ সাধ্য ছিল না এ দেশে বাম ধারার অভিভাবক কিংবা নেতা ভাসানীর কাছে যাবার। যাবেন কোন মুখে? ১৯৫৭-এর আওয়ামী লীগ ভাঙ্গনের ইতিহাসটা যাঁদের জানা আছে তাঁরা সহজেই বুঝবেন কেন যাওয়া যায় না। ২১ দফার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী, আওয়ামী লীগের স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির অঙ্গীকার ভঙ্গকারী, ভাসানীর বিশ্বাসের অমর্যাদাকারী, জাতির চেতনা ও শক্তির প্রথম বিভক্তিকারী মুজিবের পক্ষে, সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য মুজিবের পক্ষে ভাসানীর কাছে যাবার মুখটা কোথায়? গেলেই তো তাঁকে প্রথমেই অতীতের ভুল স্বীকার করে নিতে, অনুতাপ করতে হবে। না, অমন প্রতারণা যে করে তার অনুতাপ থাকে না। আর তখন বিরাট ফাঁকির উপর দাঁড়িয়ে তাঁর বিরাট দম্ভ। ফাঁকির উপর দিয়েই যে ব্যক্তি সাফল্যের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে তো মনে করবেই যে, এভাবেই আরও আরও সফলতার যা কিছু আছে সব করায়ত্ত করে নিবে।

আসলে মুজিব ছিলেন লুম্পেন শ্রেণীর নেতা। এই শ্রেণীকে তার কথা দিয়ে চেনা যায় না। তার বৈশিষ্ট্য হল ভাল কথা বলা এবং মন্দ কাজ করা। সেই কারণে যারা ভাল কিছু করতে চায় তাদের দ্বারা তৈরী ভাল ধারণাটি যেটি সমাজে জনপ্রিয় হয় সেটিকে নিজের বলে চালায় আর যারা এটি গড়ে তোলে তাদেরকে ধ্বংস করে। হাঁ, লুম্পেন হল প্রতারক। যে ভাল কথা বলে, নীতিবাক্য আওড়ায়, কিন্তু যার নিজের জীবনে তার কোনোই প্রতিফলন ঘটে না। তবু বলব বাকশাল ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যে দীপ শিখাটি আওয়ামী লীগ নিভিয়েছিল তার প্রজ্বলনের শেষ অক্ষম প্রয়াস। যখন মুজিব বুঝলেন এভাবে চললে সব যাবে, দেশও যাবে ফলে তিনিও যাবেন তখন তাঁর চৈতন্যোদয় হল। সমাজতন্ত্র ও জন-গণতন্ত্রের ভাবমানসটি ধারণ করতে চাইলেন অক্ষম হাতে, ভুল পদ্ধতিতেও। বাকশাল গঠন পদ্ধতিও তার প্রমাণ, যেখানে তিনি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ গড়ে তোলার ব্যবস্থা না করেই তাদেরকে বাকশালে ঢোকালেন। এটি প্রকৃতপক্ষে নয় মাসের যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মতই একটি বিমূর্ত ধারণার প্রতিফলন, যেটি বাস্তবে একটি জগাখিচুড়ি বৈ আর কিছুই নয়। এটি হতে পারত মুজিবের লুম্পেন ফ্যাসিবাদেরও চূড়ান্ত রূপ। অবশ্য ফ্যাসিবাদও আর কতটা করবেন? তাঁর সব সাধ্য তখন ফুরিয়েছে। তখন হয়তো তাঁর ফেরার ইচ্ছা জেগেছিল। হাঁ, এটা তাঁর মতো জননেতার জন্য স্বাভাবিক। কারণ জননেতা খুব বড় হয়ে উঠলে তার মধ্যে দল বা শ্রেণীরও ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের নেতা হবার ঝোঁকও জাগে। খুব জনপ্রিয় জাতীয় নেতাদের নিয়ে সকল দল আর শ্রেণীর এই এক সমস্যা থেকে যায়। কিন্তু পূর্ব থেকে আয়োজন না রাখলে হঠাৎ কি সেটা পারা যায়? সৃষ্টি যার যেভাবে বিলয়ও তার সেভাবে। তিনি সেই নেতা হতে চাইলেন খুব দেরীতে। আর তখন তিনি হলেন এক অনিশ্চিত পথের পথিক সবার জন্যই। দল, শ্রেণী জাতি সবার কাছেই তাঁর প্রয়োজন ফুরালো। বাকশাল হত না কিছুই। ওটা শুধু শেষ বিভ্রান্ত প্রলাপ উচ্চারণ এক মরণোন্মুখ চেতনার।

বাকশাল হল। কিন্তু এতদিন ধরে লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে যে লুম্পেন শ্রেণীটি প্রবল হয়ে উঠেছে তা কেন তার লুণ্ঠনের পথ বন্ধ করে হঠাৎ সাধু-সন্ন্যাসী হবে? মুসলিম লীগ-আওয়ামী লীগের পথ ধরে যে শ্রেণীটি এখন এক পূর্ণাবয়ব লুম্পেন শ্রেণীতে পরিণত হয়েছে তা কেন আর মুজিবের অনিশ্চিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকার হতে যাবে? তাঁকে মারল তাঁর নিজের গড়া আওয়ামী লীগ, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র। আর তাই কোথায়ও কোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এল না।

আসলে মুজিব হয়েছিলেন আত্মদ্বন্দ্বের শিকার। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ চান নি। তিনি চেয়েছিলেন নিয়মতন্ত্রের পথ ধরে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন। আর হয়তো এই পথ ধরে স্বাধীনতা, যা প্রকৃতপক্ষে বিচ্ছিন্নতা মাত্র। সেখানে পাকিস্তানের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রাষ্ট্র, সমাজ ও ভাবাদর্শের কাঠামোটিকে তিনি সংরক্ষণ করতে পারতেন। কিন্তু ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথান এবং অত:পর এর পরিণতি স্বরূপ যুদ্ধ সব তছনছ করে দিল। পাকিস্তান থেকে ফিরে পাকিস্তানের পুরনো দিনগুলোকেই ফিরিয়ে আনতে চাইলেন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা ছাড়া তাঁর উপায় ছিল না। সুতরাং সমাজতন্ত্র থেকে সবই এল ঐ কথা হিসাবে। যখন দেখলেন সব যায় তখন তিনি ফিরতে চাইলেন। সেটা অসম্ভব ছিল। সুতরাং তিনি গেলেন। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের যে নেতৃত্ব তাঁকে সরিয়ে পাকিস্তানের পুনর্বিন্যস্ত কাঠামোটা পরিচালনা করতে চাইলে তারাও গেল দ্রুত গতিতে। অর্থাৎ মোশতাকেরও পতন হল। এবার এলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান।

মুজিব ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর তিন চতুর্থাংশ সময় পর্যন্ত পাকিস্তানের যে ভেঙ্গে পড়া কাঠামোটাকে মেরামত করে মোটামুটিভাবে দাঁড় করিয়েছিলেন সামরিক শাসক জিয়া সেটাকেই আরও মজবুত করলেন। মাঝখানে ছিল ক্ষণকালের একটা ছেদ চিহ্নের মতো বাকশাল। কিন্তু সেটা এতই ক্ষণকালের যে তার প্রভাব মুছে ফেলতে এতটুকু সময় লাগে নি।

আসলে এ দেশে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে শ্রেণীটি গড়ে উঠেছিল পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সেই শ্রেণীটিকে আরও বিকশিত করে এবং অবশেষে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারী করে। ’৭৫-এ আওয়ামী লীগের পতনের পর এই লুম্পেন বুর্জোয়া শ্রেণীর এক বৃহৎ অংশের প্রতীক হয়ে রইলেন মৃত মুজিব। বাকশাল করে মুজিব তাদেরকেও সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত করেছিলেন; একটা অনিশ্চয়তা বোধের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিলেন। মৃত মুজিব তাদের নিষ্কন্টক ও ভয়হীন করলেন, কিন্তু তাদের হাতে নিজ জীবন দিয়ে তুলে দিলেন মিথ্যা প্রচারের একটি রঙীন বেলুন যাকে দেখিয়ে এখন তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে নিজেদের অবস্থানটিকে নিশ্চিত করতে চেষ্টা করবে। মুজিব নিজে যে মিথ্যা ভাবমূর্তি তৈরী করে সারা জাতিকে প্রতারণা করেছিলেন তেমন নিজ জীবন দিয়ে হলেন আর এক দল প্রতারকের এক চমৎকার হাতিয়ার। তাঁর প্রাণদান, তাঁর নাম ভাঙ্গিয়ে এই লুম্পেন শক্তি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বাধীন লুম্পেন শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে রইল। লীগের রাজনীতিকে বিরাট পতনের পর টিকিয়ে রাখার জন্য একটা লাশের দরকার ছিল। লাশ তারা পেল। একটা নয়, অনেকগুলো।

আশা করি আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাকশাল আসলে কি বস্তু এবার সেটা পরিষ্কার হবে। হাঁ, এ দেশে সোহরাওয়ার্দী এবং অত:পর মুজিবের নেতৃত্বে যে শ্রেণীটি বিকশিত হয়ে এ পর্যন্ত এসেছে সেই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের একজন শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হলেন গাফফার চৌধুরী। প্রতিনিধি স্থানীয় বলে আমি তাঁর বক্তব্যের সূত্র ধরে লীগ ধারার রাজনীতির পর্যালোচনা করলাম।

অন্যদিকে, রাশেদ খান মেনন হলেন আবদুল হক-দেবেন শিকদার-আলাউদ্দিন আহমদ-আবদুল মতিন নেতৃত্বাধীন পিকিংপন্থী বাম ধারার সর্বশেষ প্রতিনিধি। এই উভয়ের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ এবং পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো এই উভয় ধারার সমগ্র দৃষ্টিভঙ্গীর নির্যাস যার উৎস আমরা খুঁজে পাব ষাটের দশকের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় দিনগুলোর ভিতর। বর্তমান কালে সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন লেখকের লেখাগুলোর মধ্যেও লীগ-পিকিংপন্থী বামের ঐতিহ্যিক দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব সত্যটা হল এই যে, এই উভয় ধারার আক্রমণ আর চক্রান্তের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছেন ভাসানী এবং সেই দশকের তরুণ প্রজন্ম, চূর্ণ হয়েছে ভাসানী এবং সেই প্রজন্মের স্বপ্ন।

বস্তুত ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৩-এর ২১ দফা, ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুথানের পথ ধরে ভাসানী এবং ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের নেতৃত্বে বাঙ্গালী জাতি ও তৎকালীন পূর্ব বাংলার সকল জাতিসত্তার জনগণের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের যে স্বাধীন শক্তি বিকশিত হয় সেই শক্তিটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই শক্তির কোনো ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব তখন ছিল না। ভাসানী ভারত-রাষ্ট্রে অবরুদ্ধ। সেখানে তাঁর কোনো স্বাধীন ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল না। বামপন্থী নেতারা যাঁরা ভারত-রাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন দিল্লী সরকারের প্রতিবন্ধকতার কারণে এবং সর্বোপরি তাঁদের অতীতের নানান ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতার কারণেও কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করার সুযোগ ছিল না। অন্যদিকে দেশের ভিতরে পুরাতন বাম নেতৃত্বের পথ ও পদ্ধতিকে অস্বীকার করে বিপ্লবী যুবশক্তি বিভিন্ন স্থানে নিজ উদ্যোগে স্বাধীনভাবে মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুলেছিল। লীগ দিল্লীর নিকট থেকে যে অফুরন্ত সুযোগ পেয়েছিল, এদের তার কিছুই ছিল না। তবু তাদের প্রচেষ্টা ছিল স্বাধীন। হাঁ, বিপ্লবী যুব শক্তির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সেদিন গড়ে উঠতে পারে নি চিন্তা-চেতনার অস্বচ্ছতা, বিশেষত সময়ের স্বল্পতা এবং প্রবল প্রতিকূলতার কারণে। তবু এইসব সংগ্রামের অভিমুখ ছিল সেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠনের দিকে। আমি মুক্তিযুদ্ধের এই প্রকৃত ধারাটিকে বলছি বাংলাকেন্দ্রিক এবং স্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের ধারা। অন্যদিকে ভারত-রাষ্ট্রের আশ্রয় ও নিয়ন্ত্রণে গড়ে তোলা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীভূত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরনির্ভর ধারাটিকে বলছি দিল্লীকেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধের ধারা। মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত হলেও এটিকে দিল্লীকেন্দ্রিক বাংলাদেশ যুদ্ধ বলাই অধিকতর সঙ্গত।

জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন ধারাটির তাৎপর্য আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। এই ধারাটি গড়ে উঠেছিল বামপন্থীদের নেতৃত্বে। এবং মনে রাখতে হবে তাদের যুদ্ধটি হঠাৎ ছিল না১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন যে ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ১১ দফা কর্মসূচী’ ঘোষণা করে সেটা ছিল এই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশ্য কর্মসূচী। এই কর্মসূচীর সপক্ষে বক্তৃতা দেন কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, মোস্তফা জামাল হায়দার, মাহবুব উল্লাহ। অর্থাৎ তখন এটি শুধু ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচী থাকে নি। এটি বামপন্থী জাতীয় বিপ্লবীদের একটি অভিন্ন কর্মসূচীতে পরিণত হয়। এই কর্মসূচীর পিছনের শক্তি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি।

জাতীয় যুদ্ধ শুরু হলে সমন্বয় কমিটি পুরোপুরিভাবে তাতে অংশ নেয় এবং কলকাতাকে কেন্দ্র করে কাজী জাফরের নেতৃত্বে এই সংগঠন তাতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাহবুব উল্লাহ জেলে থাকলেও আবুল বাশার এবং রাজশাহী জেল থেকে মুক্ত হয়ে দেবেন শিকদার পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরায় থেকে জাতীয় যুদ্ধে অংশ নেন।

এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে প্রদত্ত হলেও স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচী ছিল মূলত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক তৈরী। অথচ এই সংগঠন জাতীয় যুদ্ধে অংশ নিল না। অর্থাৎ এই সংগঠনের মূল নেতৃত্ব যে, স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রতি আদৌ আন্তরিক ছিল না এটা তার প্রমাণ। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন এই নেতৃত্বের স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য। সেটা হল এই রকম একটা কর্মসূচী ঘোষণা করা হলেও এর ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। আমি তো তখন পার্টির সদস্য এবং তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জেলায় পার্টি সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। কিন্তু এই কর্মসূচী প্রচারের জন্য আমাকেও কিছু বলা হয় নি। কর্মসূচীর কোন কপিও আমাকে দেওয়া হয়েছিল এমনটা মনে করতে পারি না। এটা ঠিক যে, এই কর্মসূচী যদি আজ পড়া যায় তবে এর অনেক সীমাবদ্ধতার দিক চোখে পড়বে। কারণ প্রকাশ্য জাতীয় আন্দোলনের কর্মসূচী না করে এটাকে কমিউনিস্ট পার্টির মূল কর্মসূচীর কাছাকাছি করা হয়েছিল। এই কর্মসূচী পড়লে তৎকালীন কমিউনিস্ট রাজনীতির নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের চিন্তা-চেতনার সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও এর ভিতর ছিল অনেক শক্তিশালী কর্মসূচী এবং ভবিষ্যৎ স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্রের একটি অবয়ব। এই রকম একটি কর্মসূচী আর কার ছিল? আওয়ামী লীগ তো জাতীয় যুদ্ধ শুরু করে কোন কর্মসূচী ছাড়াই।

যেভাবেই দেখা যাক বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের একটি কর্মসূচী ছিল। সেটা ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ঘোষিত হলেও এবং পরবর্তী কালে সেই ছাত্র ইউনিয়নের নাম পরিবর্তন ও বিভক্তি ঘটলেও। কারণ ব্যক্তিগুলি যেমন রয়ে গিয়েছিল তেমন রয়ে গিয়েছিল এই কর্মসূচীর পিছনের সংগঠনসমূহও।

যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরেও সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির অনেক কর্মী জাতীয় যুদ্ধ করেছিল। যেমন তৎকালীন রাজশাহী জেলার আত্রাই অঞ্চলে ওহিদুর রহমান, চট্টগ্রামে হাসান, পাবনায় টিপু বিশ্বাস ইত্যাদি। কিন্তু তাদের কোন সমন্বিত কেন্দ্র ছিল না। কারণ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে অস্বীকার করে। এবং নেতৃত্বের প্রভাবে টিপু বিশ্বাস যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে জাতীয় যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ান এবং শ্রেণী যুদ্ধের পথে চলে যান।

কিন্তু পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা থেকে বাঙ্গালী জাতির যে স্বাধীন মুক্তিযুদ্ধটি গড়ে উঠছিল তার একটি সমন্বিত রূপ গড়ে উঠছিল কলকাতাকে কেন্দ্র করে এবং জাফর-রনো-মেনন-দেবেন-বাশার প্রমুখের নেতৃত্বে। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ইত্যাদির সমন্বয়ে কলকাতায় গঠিত হয় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। এইভাবে জাতীয় যুদ্ধের বিকল্প ধারাটি গড়ে উঠছিল বামপন্থীদের নেতৃত্বে।

বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই যুদ্ধ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভর। ভারত রাষ্ট্র ও দিল্লী সরকারের বাধা ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করে তাকে অগ্রসর হতে হয়েছিল। সেখানে এই নেতৃত্ব পেয়েছিল মূলত পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার বাঙ্গালী জাতি ও জনগণের সমর্থন।

হাঁ, এই নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠছিল উভয় বাংলার বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সমন্বিত রূপটি। প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ যে, শুধু পাকিস্তানের দ্বি-জাতিতত্ত্বের নেতিকরণ ছিল তা-ই নয়, উপরন্তু এটা ছিল ভারতের একজাতিতত্ত্বেরও নেতিকরণ। পাকিস্তানের ধর্মীয় দ্বি-জাতিতত্ত্বকে অস্বীকার করলে কি থাকে? তা ঐক্যবদ্ধ ভারত-রাষ্ট্র নয়। বরং ঐক্যবদ্ধ বাংলা-রাষ্ট্র।

কারণ ভারত একটি জাতির ভূভাগ নয়। বরং তা বহু জাতির উপমহাদেশ। সুতরাং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ধারণার সঙ্গে ভারত-রাষ্ট্র গঠন সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ কথা ঠিক যে, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস­ঐতিহ্যে কিছু অভিন্নতা থাকায় ব্রিটিশ শাসনের অবসানে কনফেডারেশন জাতীয় রাষ্ট্রসংঘ বা জাতিসংঘ গঠন ছিল যৌক্তিক। কিন্তু তার পরিবর্তে একটি একক জাতি ও রাষ্ট্র কাঠামোয় ভারতবর্ষকে নিতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে অভিন্ন ঐতিহ্যের মধ্যকার ধর্মীয় উপাদান প্রবলতর হয়ে উঠতে পেরেছে, যা হয়েছে উপমহাদেশের প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বস্তুত ব্রিটিশ শাসন কালে ভারতের বহু জাতি সমন্বয়ে স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠন চিন্তার মধ্যে ছিল ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ঐক্যের অনুভূতি ও প্রেরণা। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল অখণ্ড ভারত-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেরণা, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায় হবে সংখ্যাগুরু। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায় সেখানে নিজেদের সংখ্যালঘু অবস্থানকে মেনে নিতে রাজী হয় নি বলে তারা পাকিস্তান দাবীকে সমর্থন করে। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান ছিল মুসলমান ভারত অর্থাৎ মুসলিম সংখ্যাগুরু অঞ্চল নিয়ে আর একটি ভারত-রাষ্ট্র, যেখানে মুসলিম প্রধান বহু জাতিসত্তা এক রাষ্ট্রে ঐক্যবদ্ধ হবে। এইভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা ১৯৪৭-এ ভারতবর্ষকে দুই সংখ্যাগুরু ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দিয়ে যায়। একটি হল হিন্দু ভারত, অপরটি মুসলিম ভারত। প্রথমটির নাম ভারত রইল, দ্বিতীয়টির নাম হল পাকিস্তান।

এমন এক প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য ছিল যুগান্তকারী। তা শুধু ব্রিটিশের সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের উত্তরাধিকারী বহুজাতিক মুসলমান সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভিত্তিকেই আঘাত করে নি, উপরন্তু বহুজাতিক হিন্দু সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র ভারতের ভিত্তিকেও হুমকির সম্মুখীন করেছিল। বিশেষ করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে উভয় বাংলায় বিশেষত পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার বিপ্লবীদের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যে স্বাধীন শক্তি বিকশিত হয়ে উঠছিল তা সমগ্র বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য ভবিষ্যতের এমন এক সমন্বিত বৃহত্তর সংগ্রামের ভিত্তি রচনা করছিল যা ছিল ভারত-রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করলে যেমন পাকিস্তান নাকচ হয় তেমন তা যৌক্তিক ও নীতিগতভাবে পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায়ও বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্ন উপস্থিত করে, যা ভারত-রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক বা দিল্লীকেন্দ্রিক কাঠামোকে নাকচ করে। প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ সমগ্র বাঙ্গালী জাতির সামনে পাকিস্তান ও ভারত-রাষ্ট্র উভয়ের বিপরীতে এক নূতন, বিকল্প রাষ্ট্রসত্তার যৌক্তিকতা উপস্থিত করেছিল।

সুতরাং আমি বলব পূর্ব বাংলার বিপ্লবী বাঙ্গালীরা পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় অবস্থান নিয়ে এবং সেখানকার বাঙ্গালী জনগণের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বাঙ্গালী জাতি ও জনগণের যে নিজস্ব ও স্বাধীন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ গড়ে তুলছিল সেটি ছিল বাংলা কেন্দ্রিক এবং স্বাধীন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। অপর দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ ছিল ভারত-রাষ্ট্র কেন্দ্রিক এবং দিল্লী সরকার নির্ভর মুক্তিযুদ্ধ। ভারত-রাষ্ট্র কেন্দ্রিক যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত দিল্লী সরকারের হাতে।

এটা ঠিক যে, সেদিন উভয় বাংলার সমগ্র বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সমন্বিত রূপটি স্পষ্ট অবয়ব নিয়ে আবির্ভূত হয় নি। এবং বামপন্থীদের তৎকালীন রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক বিভ্রান্তির কারণে এবং সর্বোপরি দিল্লী সরকারেরও হস্তক্ষেপ ও বাধার কারণে সেদিন তার সাফল্যের কারণ ছিল না। তবু ভারত-রাষ্ট্র ও দিল্লী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে উভয় বাংলার বাঙ্গালী জনগণের ঐক্য ও সমন্বয়ের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের যে স্বাধীন ধারাটি গড়ে উঠছিল তার মধ্য দিয়ে নির্মিত হচ্ছিল বাঙ্গালী জাতির ভবিষ্যৎ অগ্রগমনের রূপরেখাটি। নিশ্চয় সেটা ভারত সরকারের কাম্য ছিল না। সুতরাং তা চেয়েছিল যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় যুদ্ধের সমাপ্তি। পাকিস্তানেরও সেটার প্রয়োজন ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও তেমন একটা কামনা থাকাই স্বাভাবিক ছিল। কারণ জাতীয় যুদ্ধ যত দীর্ঘস্থায়ী হত বামপন্থী বা বিপ্লবী জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় যুদ্ধের স্বাধীন ধারাটির বিকশিত হয়ে ওঠার বাস্তবতা তত বেশী তৈরী হত। এই কারণে জাতীয় যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি ছিল এদের সবার প্রয়োজন। সুতরাং পাকিস্তান ও ভারত দ্রুত নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু ক’রে বাঙ্গালীর জাতীয় যুদ্ধকে নিজেদের দুই রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রীয় যুদ্ধে পরিণত করল, আর এইভাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ক্রমবিকাশকে রুদ্ধ করল পাকিস্তানের পরাজয় এবং ভারত রাষ্ট্রের বিজয়ের মাধ্যমে এবং এইভাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধেরও দ্রুত সমাপ্তির মাধ্যমে।

এবার আমি প্রশ্ন করব, আওয়ামী লীগ যে জাতীয় যুদ্ধ করল সেটাকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ না বলে শুধু মুক্তিযুদ্ধ বলার প্রতি তার এত ঝোঁক বা আগ্রহ কেন? এটা কার মুক্তিযুদ্ধ? এটা কি পূর্ব বাংলায় ইসলামী সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক মুক্তিযুদ্ধ, নাকি পূর্ব বাংলাকে ভারত-রাষ্ট্রের অঙ্গীভূত করার জন্য দিল্লীপন্থী মুক্তিযুদ্ধ? অথবা এটা পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙ্গালী জাতির মুক্তিযুদ্ধ?

হাঁ, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে শুধু মুক্তিযুদ্ধ বলার মধ্যে এক বিরাট ফাঁক ও ফাঁকি থেকে যাবার সম্ভাবনা আছে। এটা বুঝতে হবে যে, এই যুদ্ধ যেমন বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায়ের আর একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার শাসিত মুসলমান সম্প্রদায়ের যুদ্ধ ছিল না তেমন এটা পূর্ব বাংলায় একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়েরও যুদ্ধ ছিল না। কিংবা এটা পূর্ব বাংলাকে দিল্লীর অধীন প্রদেশ করার জন্য কোন দিল্লীপন্থী শক্তির যুদ্ধও ছিল না। এটা ছিল পাকিস্তানের ইসলামী ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির সেকিউলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। এই যুদ্ধ ছিল পূর্ব বাংলার ভূখণ্ডে বাঙ্গালীর প্রকৃত জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ। এটা বাঙ্গালী জাতির ঐতিহাসিক অভিযাত্রার প্রথম পর্যায় মাত্র। পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালীর সেকিউলার জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এটা অনিবার্যভাবে পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরায় বাঙ্গালী জনগণের সামনে দ্বিতীয় পর্যায়টি সম্পন্ন করার করণীয় এবং বাস্তবতা উপস্থিত করতে পারত।

না, সেটা হয় নি। প্রথমটাই সম্পূর্ণ হয় নি। কারণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে যুদ্ধ হল সেটা প্রকৃত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হয়ে ওঠে নি। তবু তার মধ্যেও ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মর্মবস্তু, যা দিল্লী সরকারের ভূমিকা এবং সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগেরও ভূমিকার কারণে যথাযথ রূপ নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে নি। আর এই কারণে হয়তো ’৭১-এর জাতীয় যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ না বলে শুধু মুক্তিযুদ্ধ বলে সত্যকে ধামাচাপা দেবার এমন প্রয়াস। আমার প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ কি দিল্লী সরকারের নির্দেশে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে শুধু মুক্তিযুদ্ধ বলার শিক্ষাটাকে ভারত-রাষ্ট্র থেকে নিয়ে এসেছিল?

কিন্তু আওয়ামী লীগের যুদ্ধটা ছিল কার? আমার ধারণা সেখানে তিনটি ভিন্ন ধারার সমাহার ঘটেছিল। বাঙ্গালী জাতির, মুসলিম সম্প্রদায়ের এবং দিল্লীপন্থী শক্তির। এই তিন ধারাই জড়াজড়ি করে ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ভিতর। যুদ্ধের পর শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন করে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধারাটিকে প্রাধান্যে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু তার পক্ষে স্পষ্ট হওয়া সম্ভব ছিল না। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কথা বলেই তাঁকে কৌশলে পাকিস্তান ও ইসলামের ধারাটিকে সংরক্ষণ ও প্রাধান্যে আনার কাজ চালাতে হয়েছিল। এর ফলে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগ শাসনকালে যে আত্মদ্বন্দ্ব দেখা দেয় তার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই মুজিবের কর্মকাণ্ডে। এই আত্মদ্বন্দ্বে মুজিবকে প্রাণ হারাতে হয়। অত:পর প্রথমে মোশতাক আহমদ এবং পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর ইসলামী সাম্প্রদায়িক ধারাটিকে বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের রাজনীতিতে স্পষ্টভাবে প্রাধান্যে নিয়ে আসেন এবং এইভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধারাটিকে রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অপসারণ করেন।

যাইহোক, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের ধারাটিকে আমি দিল্লীকেন্দ্রিক বা ভারত-রাষ্ট্র নির্ভর রূপে চিহ্নিত করতে চাই। এটা আমাদের এ দেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের অনেক দ্বন্দ্ব ও সঙ্কটকে বুঝতে সাহায্য করে। এই দিল্লীকেন্দ্রিক বাংলাদেশ যুদ্ধের ধারায় আবার দু’টি বিভাজন ঘটেছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর। একটি রাজনৈতিক, অপরটি সামরিক। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দিকটির প্রতিনিধিত্বকারী। রাজনীতির কারণে জনগণের উপর যেটুকু নির্ভরতা থাকে তা আওয়ামী লীগের পক্ষে পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আবরণটি সামনে রাখতে হয় জনগণকে সঙ্গে রাখার জন্য। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত এই রাজনৈতিক শক্তির নেতৃত্বেই লুম্পেন অর্থনীতি ও রাষ্ট্র কাঠামোটা গড়ে উঠল মুক্তিযুদ্ধের নামে, এবং এই নাম দিয়েই বিপ্লবী রাজনীতির সম্ভাবনা ও শক্তি বিনষ্ট করা হলে লুম্পেন শ্রেণীর প্রধান অংশের নিকট রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজন ফুরালো।

১৯৭৫ পরবর্তী কালে এই অংশ জিয়ার সামরিক নেতৃত্বের অধীনে থেকে রাজনীতির দুর্বলতার দিকটা ঝেড়ে ফেলল। জিয়াউর রহমান হলেন তাই লুম্পেন শ্রেণীর সামরিক নেতা। তবু যে কোনো কারণে হোক জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় তাঁর মধ্যে ছিল এক আত্মদ্বন্দ্ব। কারণ এই বিজড়নের ফলে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের কিছু প্রতীক তাঁকেও ব্যবহার করতে হত। এই আত্মদ্বন্দ্বে তাঁরও রক্তাক্ত পতন হয়েছে কয়েক বৎসর পর। এরপর এসেছেন সামরিক শাসক এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধে কোনো বিজড়ন না থাকায় তিনি ছিলেন আত্মদ্বন্দ্ব মুক্ত। এবং এ দেশের লুম্পেন শ্রেণীটি তাঁর নয় বৎসর শাসন কালেই পরিপূর্ণ রূপ লাভ করে। জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়াও তাঁর মৃত স্বামীর সামরিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারাটিকে বহন করে লুম্পেন রাজনীতিটিকে আরও এগিয়ে নিলেন মাত্র।

মুজিব থেকে খালেদা পর্যন্ত প্রায় ২৫ বৎসরের শাসন কালের অভিজ্ঞতাকে মনোযোগ দিয়ে বিচার করলে আমরা একটা বিষয় লক্ষ্য করে বিস্মিত হব যে, এ দেশে শাসনের চরিত্র যত বেশী রাজনৈতিক হয়েছে তত বেশী ব্যাপক-বিস্তৃত হয়েছে তার লুম্পেন, সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিপরায়ণ রূপটিও। মুজিবের রাজনৈতিক শাসন কাল ছিল ব্যাপক ও ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অরাজকতার কাল। জিয়ার সামরিক কিংবা রাজনৈতিক আবরণে সামরিক শাসনের কালটা ছিল অপেক্ষাকৃত স্থিতির কাল। বিএনপি গঠনের পর জিয়া তাঁর শাসনকে একটা রাজনৈতিক ও নির্বাচিত রূপ দিলেও ওটা ছিল সেনাবাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসন দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত দলীয় শাসন। এই সময়ে দুর্নীতি হলেও তা ছিল একটা সীমার মধ্যে। বিশেষত নীচ তলায় তা বেশী বিস্তৃত ও প্রবল হয় নি। এবং কেন্দ্রেও দুর্নীতির প্রকোপ এত তীব্র ছিল না জিয়ার সতর্কতার ফলে। জিয়ার মৃত্যুর পর বিএনপি-এর রাষ্ট্রপতি সাত্তার খুব স্বল্পকালীন একটা পর্যায় মাত্র এবং এই সময়েও মূলত জিয়ার শাসনামলের জেরটিই চলেছে।

বিএনপি-এর সাত্তার সরকারকে হটিয়ে দিয়ে ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৯০-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় টানা নয় বৎসর দেশ শাসন করেন। তাঁর শাসনও একটা স্থিতি দিয়েছিল, যদিও শেষ দিকে তা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এরশাদ জাতীয় পার্টি গঠন করে জিয়ার পদ্ধতিতে দেশ শাসন করেন। অর্থাৎ জাতীয় পার্টি ছিল সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক দল। আমরা এই ধরনের সামরিক শাসনকে আধা সামরিক শাসনও বলতে পারি। যাইহোক, এটা লক্ষণীয় যে, এরশাদের শাসনকালে দুর্নীতি হয়েছে জিয়ার সময়ের চেয়েও ব্যাপকভাবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুর্নীতি অনেকটাই সীমাবদ্ধ থেকেছে উপর তলায়। এবং সেটা নীচের দিকে অনেক দিন পর্যন্ত তুলনায় সংযত ছিল।

খালেদার প্রধান মন্ত্রীত্বে বিএনপি-এর পাঁচ বৎসরের শাসনকালে জিয়া এবং এরশাদের সময়ের তুলনায় দুর্নীতি ও সন্ত্রাস অনেক ব্যাপক ও তীব্রভাবে সর্বত্র ছড়িয়েছিল। তাঁর শাসনকালটি লুট ও সন্ত্রাস দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে। এবং লক্ষণীয় যে, এরশাদের শাসনকালের নয় বৎসর ক্ষমতার বাইরে থেকে গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি তার উপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে হারায় এবং সেই সঙ্গে পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী রাজনৈতিক চরিত্র ও গণ-রূপ লাভ করে।

অর্থাৎ এ দেশে যে দল যত বেশী রাজনৈতিক ও গণ-নির্ভর হয়েছে তার শাসনামলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা তত বেশী তীব্রতা ও ব্যাপকতা লাভ করেছে। এবং যে দল বা শাসন যত বেশী সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেছে এই দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা তত বেশী কেন্দ্রীভূত বা সীমাবদ্ধ থেকেছে, সেটা নীচের দিকে বা জনগণের মধ্যে তুলনায় কম বিস্তৃত হয়েছে।

সুতরাং এ দেশে প্রতিটি রাজনৈতিক শাসনকাল সামরিক শাসনকালের তুলনায় অধিকতর ব্যর্থ। সম্ভবত, এ দেশে আগামী দিনেও প্রচলিত ধারার সকল নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচনী রাজনীতির জন্য এই অনিবার্যতা অপেক্ষা করে আছে। অতীতে যে পরিণতি হয়েছে সম্ভবত আগামীতেও সেই পরিণতি হবে। সামরিক শাসনের তুলনায় রাজনৈতিক শাসনের ব্যর্থতার সম্ভাবনা বেশী।

এর কারণ অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখন এ বিষয়ে বিস্তৃত বিশ্লেষণের সুযোগ নেই তবু আমি এর পিছনে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কাজ করেছে সেদিকে একটা ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করব। আমার বিবেচনায় এ দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এই নিকৃষ্ট রূপের সবচেয়ে বড় কারণ উচ্চবিত্ত বা ধনী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লুম্পেন চরিত্র, এবং সেই সঙ্গে জনগণেরও। প্রকৃতপক্ষে জাতির ভিতর লুম্পেন চরিত্রের যে প্রাধান্য রয়েছে তা-ই দেশের গণ-রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশী প্রতিফলিত।

এই সত্যকে আমাদের দেশে স্বীকার করার অভ্যাস বা শিক্ষা যা-ই বলা যাক নেই। কিন্তু আমি বলতে চাই যে, আমাদের জাতি, জনগোষ্ঠীর ভিতরকার, বিশেষত তার নেতৃত্বকারী শক্তি উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের লুম্পেন চরিত্র এ দেশের রাজনীতিতে প্রতিফলিত। এ দেশে দীর্ঘ বিদেশী শাসনের কারণে এবং নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্যের কারণেও জনগণের ভিতর লুম্পেন চরিত্র গড়ে উঠেছে, যেটা তাদের নেতৃত্বকারী হিসাবে উচ্চ ও মধ্য বিত্তের মধ্যে সবচেয়ে বেশী প্রতিফলিত ও কেন্দ্রীভূত। অন্যদিকে শাসক বা নেতা তো নিজ আদলে সমাজ ও জনগণকে তৈরীও করে এবং অবস্থাটাকে রক্ষা করে। সুতরাং এই নেতৃত্বকারী শক্তিকেই সবচেয়ে বেশী দায়ী করা যায়। এরা জনগণের পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়া ও লুম্পেন বৈশিষ্ট্যগুলোকে দূর করার পরিবর্তে সেগুলোকে ব্যবহার করেই নিজেদের উন্নতির পথ ধরে এগিয়ে গেছে। এ দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা হল সহজ ও দ্রুত উন্নতির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। নিয়মতন্ত্র এই রাষ্ট্রক্ষমতায় আমলাদের সঙ্গে থেকে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে জনগণকে লুণ্ঠন করে বিত্তবান হবার পথ দিয়েছে। সুতরাং নিয়মতন্ত্রের রাজনীতি হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সহজে অর্থ-বিত্ত-সম্পদ উপার্জনের হাতিয়ার। ভোটের জন্য টাকা চাই, জনগণের পশ্চাৎপদতাকে ব্যবহার করা চাই, জনগণের সস্তা আবেগ, অন্ধত্ব ও সুবিধাবাদী মানসিকতাকে সুড়সুড়ি দেওয়া চাই। সুতরাং নির্বাচনকেন্দ্রিক নিয়মতন্ত্র এ দেশে কোনও আদর্শনিষ্ঠ রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করতে পারে না। সেনাবাহিনীর তবু একটা দৃঢ় শৃঙ্খলা থাকে। ফলে ক্ষমতায় গেলেই চট করে সেটা বিনষ্ট হয় না। অন্যদিকে শৃঙ্খলা থাকে বলে দুর্র্নীতিটাও সহজে অরাজক ও বিশৃঙ্খল হয় না। ফলে সেটা দ্রুত সমাজের ভারসাম্য ভেঙ্গে ফেলে না। প্রথমে ভোটেরও প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর এক সময় তাকেও যেতে হয় জনগণের সমর্থনের প্রয়োজনে জনগণের নেতৃত্বকারী শ্রেণী বা শক্তিগুলোর কাছে। ফলে উপরের কেন্দ্রীভূত দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে এবং সবশেষে সেটা এতই বিস্তৃত হয় যে, তারও পতন ঘটে জনরোষের ফলে। হাঁ, এ দেশে যে কোনো উপায়ে ব্যক্তিগত মালিকানায় সম্পদ উপার্জনের যে ‘মহান’ পুঁজিবাদী আদর্শ বিদ্যমান তাতে সকলেরই এই পরিণতি অনিবার্য। আসলে এটা আদর্শহীনতা ও নীতিহীনতারই নামান্তর। আর এই কারণে মুক্ত বাজার, অবাধ বাণিজ্য এসব নিয়ে যত শোরগোল তোলা যাক, বিদেশের টাকার বন্যায় যতবার দেশকে ডোবানো ও ভাসানো যাক, কোনো লাভ হয় না, বরং সমাজতলে যে বিপুল, ভয়ানক রোষ, ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিশৃঙ্খলার শক্তি জমা হতে থাকে তা বার বার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের অধিতলে পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু একই পথে একই প্রক্রিয়ায় যে-ই উঠে আসে তার প্রতিশ্রুতি যা-ই থাক, শুরুতে যে আকাঙ্ক্ষাই থাক সেও ঐ এক জিনিস হয়ে ওঠে সমাজতলের ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে যার পতন ঘটিয়ে সে ক্ষমতার আসনটি নিজে দখল করে।

এই এক দুষ্ট চক্রের হাত থেকে মুক্তির পথ ভোট সর্বস্ব রাজনীতিতে নেই। সামরিক শাসনেও নেই। সেই পথটা বিপ্লবের, সেই পথটা সমাজতন্ত্রের এবং গণতন্ত্রের; হয়তো আরও সঠিকভাবে বললে জনগণের গণতন্ত্রের। আসলে আমাদের এক নূতন আদর্শের দরকার, যা জনগণ এবং জাতিকে রূপান্তরিত করবে, নূতন এক আদর্শবান ও উন্নত জনগণ ও জাতিতে পরিবর্তিত করবে। এবং এই আদর্শটা বিপ্লবের। ভোট সর্বস্ব নিয়মতন্ত্রের নয়, স্বৈরাচারী সামরিক শাসনেরও নয়।

এই বিশ্লেষণে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে। যেহেতু নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক শাসন বেশী বিশৃঙ্খলাপূর্ণ এবং বেশী দুর্নীতিপরায়ণ সেহেতু কি সামরিক বা আধা-সামরিক শাসন রাজনৈতিক শাসনের চেয়ে বেশী ভাল? অর্থাৎ সামরিক শাসনকে কি মন্দের ভাল হিসাবে নেওয়া বা দেখা যায়? এই প্রশ্নের আমার স্পষ্ট উত্তর হল, না। না এবং না। সামরিক শাসন সবচেয়ে ধিকৃত রাজনৈতিক শাসনের চেয়েও নিকৃষ্ট। কারণ আমাদের দেশে অধ:পতিত রাজনৈতিক শাসনের যে রূপটি গড়ে উঠেছে তা ব্রিটিশ সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক শাসনাধীন নিয়মতন্ত্রের ধারাবাহিকতা মাত্র।

নিয়মতন্ত্রের মধ্যেও মধ্যবিত্ত এবং জনগণের একটা রাজনৈতিক শিক্ষা হয়। এর মধ্য দিয়ে জনগণ চেতনার বিচারে ক্রমে উন্নত হয়ে উঠতে পারে এবং ফলে বিপ্লবী হোক আর নিয়মতান্ত্রিক হোক মধ্যবিত্ত ও জনগণকে অবলম্বন করে একটা বিকল্প অথবা উন্নততর রাজনীতি দাঁড়াতে পারে। সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ সে সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে এবং সামরিক শাসনকে উপস্থিত করে একটা উন্নততর বিকল্প হিসাবে। অথচ তা পরবর্তী সময়ে আর একটি অধ:পতিত ও নিকৃষ্ট নিয়মতন্ত্রের পথ করে দেয় মাত্র। এ এক ভয়ঙ্কর অশুভ চক্র। এই অশুভ চক্র ভাঙ্গার একমাত্র পথ হল যে কোনো ধরনের আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপকে বিরোধিতা করা এবং রাজনীতিকে রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে দেওয়া।

সংগ্রামটা হবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে বিপ্লবী রাজনীতির, উন্নততর রাজনীতির। কিন্তু এই সংগ্রামে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পতন ঘটাতে চেয়ে সামরিক রাজনীতিকে তথা সামরিক হস্তক্ষেপকে কোনোক্রমেই সমর্থন দেওয়া কখনই কোনো প্রকৃত বিপ্লবী রাজনীতির কাজ নয়। বরং সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং যে কোনো আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রচলিত ব্যবস্থাধীন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির অবস্থান এবং এই নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভাঙ্গতে চাওয়া বিপ্লবী রাজনীতির অবস্থানটা একই সমতলে থাকা উচিত। অর্থাৎ নিয়মতন্ত্র ও বিপ্লব জনগণের ভিতর থেকে উঠে আসা দু’টি সমান্তরাল ধারা। নিয়মতন্ত্রের দুর্বলতা হল এই যে, যে আমলাতান্ত্রিক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে থেকে তা বিকশিত হয় সেটাকে ভাঙ্গতে চাইলেও তা সেটাকে ভাঙ্গতে পারে না। কিন্তু বিপ্লব সেটা পারে। বস্তুত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি আমাদের দেশে গণতন্ত্রের যে রূপটি গড়ে তুলেছে সেটি পঙ্গু ও সীমাবদ্ধ। কিন্তু তার একটা আর্তি বা আকাঙ্ক্ষা আছে এই পঙ্গুত্ব ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তির। বিপ্লবের কাজ এই মুক্তির আর্তি বা আকাঙ্ক্ষাকে ব্যবহার করে বিপ্লবের মাধ্যমে একটি প্রকৃত ও মুক্ত গণতন্ত্র গড়ে তোলা।

বস্তুত বিপ্লবী রাজনীতির উদ্ভব ও বিকাশ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি বা নিয়মতন্ত্রকে ধ্বংস করে ঘটে না। বরং নিয়মতন্ত্রকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেই বিপ্লবী রাজনীতির বিকাশ ঘটতে পারে। আমাদের দেশে বিপ্লবের একটা প্রধান সমস্যা হচ্ছে নিয়মতন্ত্রকে বিপ্লবের সহযোগী ও অধীনস্থ করার। এই অর্থে এটাকে ধ্বংস করার নয় বরং অধিকার ও রূপান্তরিত করার। বস্তুত নিয়মতন্ত্রের সঙ্গে বিপ্লবের একটি মৌল পার্থক্য হল মাত্রার। ক্ষেত্র বিশেষে নিয়মতন্ত্রও বিপ্লব কিংবা অনিয়মতন্ত্রকে ব্যবহার করে, কিন্তু তা করে সেটিকে অধীনস্থ এবং সমাজ-রাষ্ট্র বিপ্লবকে নস্যাৎ বা অকার্যকর করার জন্য। বিপ্লবও নিয়মতন্ত্রকে ব্যবহার করে, কিন্তু তা করে সেটিকে অধীনস্থ এবং সমাজ-রাষ্ট্র বিপ্লবকে জয়যুক্ত করার জন্য।

আর এই জায়গায় পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ’৬০-এর দশকে ভুলটা করেছিল। তারা আইয়ুবের চেয়ে মুজিবকে বড় শত্রু ভেবেছিল। মুজিবের অতীত যতই কলঙ্কিত হোক মুজিব ছিলেন সামরিক শাসনের পরিবর্তে রাজনৈতিক শাসনের শক্তি। হোক তার গণতন্ত্র সীমাবদ্ধ। হোক সেটা গণতন্ত্রের নামে মুৎসুদ্দি ও লুম্পেন মধ্যবিত্ত বা ধনিকের স্বৈরতন্ত্র। তবু মুৎসুদ্দি কিংবা লুম্পেন সামরিক স্বৈরতন্ত্রের তুলনায় সেটা অনেক বেশী প্রগতিশীল। মুজিবের পথে জনগণ ও জাতির মুক্তি সম্ভব ছিল না। কিন্তু তাঁর পথটা এই মুক্তির পথের সহায়ক হতে পারত যদি বামপন্থীরা তাঁর বিরোধিতায় কোমর বেঁধে না নেমে নিজেরা পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে বিকল্প জাতীয় কর্মসূচী নিয়ে এগোত। তাহলে মুজিবের এই নির্বাধ ও অপ্রতিহত উত্থান ও সম্ভব হত না, ফলে জাতিকে হয়তো এতটা মূল্য দিতে হত না।

এ দেশে বামপন্থীদের চিরকালীন মতিচ্ছন্নতার একটি প্রধান কিংবা কখনও প্রধানতম কারণ দর্শনগতভাবে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অন্তর্গত ঘৃণা, যা তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বহারার একনায়কত্বের ধারণা থেকে অর্জন করেছে। তাদের লক্ষ্যটা সর্বহারার একনায়কত্ব অর্থাৎ বাস্তবে কমিউনিস্ট পার্টির এককেন্দ্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে তারা দেখতে চায় দু’টো প্রতিপক্ষ। একপক্ষ হবে জারের মতো বা যে কোনো ধরনের সামরিক এবং একনায়কী শাসক, এবং অন্যপক্ষ একনায়কী কমিউনিস্ট বিপ্লবী। এই দুই পক্ষের লড়াই হবে। সেই লড়াইয়ে জিতবে একনায়কী কমিউনিস্ট বিপ্লবী।

নিয়মতন্ত্র ও নির্বাচন থাকায় তারা তাদের এই ফর্মুলা অনুযায়ী এগোতে পারে না। দুই পক্ষের মাঝখানে দেখতে পায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদেরকে, যেটা মুৎসুদ্দি হতে পারে আবার নিয়মতন্ত্রের সুযোগকে ব্যবহার করে বেড়ে ওঠা স্বাধীন বা জাতীয়ও হতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত একনায়কী স্বৈরতন্ত্রকে আক্রমণ করতে চেয়ে আগে আঘাত হানতে বাধ্য হয় এই মাঝখানের বাধাটাকে। হাঁ, যে কোনো ধরনের গণতন্ত্রী তার বিপ্লবের পথে প্রথম বাধা। এই বাধা না ডিঙ্গিয়ে সে শত্রুকে কার্যকরভাবে আঘাত করার উপায় দেখতে পায় না। এটা ঠিক যে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রীদেরকেও সে প্রথমে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়; বিশেষত যখন কমিউনিস্ট রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকে, যেমন পাকিস্তান আমলে ছিল; অথবা যখন স্বৈরতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শক্তির প্রচণ্ড আঘাত ও দমনের কারণে সে মাথা তোলার কোনো পথ পায় না। প্রবল স্বৈরশাসনের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তার জাতীয় বুর্জোয়া বা বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের আশ্রয় দরকার; এমন কি নিয়মতন্ত্রেরও। কিন্তু যতই শক্তি বাড়ে ততই তার প্রধান শত্রু হয়ে উঠতে থাকে এই প্রথম বা মাঝখানের বাধাটা। কারণ নিয়মতান্ত্রিক ও সীমাবদ্ধ গণতন্ত্র হোক আর স্বাধীন জাতীয় গণতন্ত্র হোক সবটাই তার আপন নেতৃত্বের ভূমিকার পথে বাধা। এটা না থাকলে সে প্রচলিত স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিরঙ্কুশ হয়। আর তাই তা প্রথম সুযোগে এটাকেই আগে ভেঙ্গে ফেলতে চায়।

এই কারণেও তা ভাসানীকে ভেঙ্গেছে, পঙ্গু করেছে। তাঁর প্রকৃত ভূমিকাটা ’৬০-এর দশকে আর পালন করতে দেয় নি। পঞ্চাশের দশকে ভাসানী পেরেছিলেন কারণ তখন কমিউনিস্টরা ছিল অতীব দুর্বল। ১৯৪৭-’৪৮-এর বিরাট ধ্বংসের আঘাতে তারা পঙ্গু। আর এই পরাজিত কমিউনিস্টদের বিপ্লবের সাধও মিটে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য। ষাটের দশকে এরা আওয়ামী লীগের প্রতি নি:শর্ত সমর্থন দানের রাজনীতি শুরু করে। কিন্তু ষাটের দশকে তরুণ প্রজন্মের উথানে একটা অংশের ভিতর পুরাতন বিপ্লবের ঝোঁকটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে কিংবা তরুণ প্রজন্মকে ব্যবহার করে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে এরা পিকিংপন্থী রাজনীতিকে আশ্রয় করে।

ভাসানী ছিলেন হাতের কাছে। তাই তাঁকে আটকে দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু মুজিব ছিলেন মুক্ত। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং কমিউনিস্ট বিরোধী। সুতরাং তাকে তারা দূর থেকে বিরোধিতা করে ঠেকিয়ে রাখতে চেয়েছিল। হয়তো এই নেতাদের ক্ষমতা দখল কিংবা বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা ছিল না। হয়তো তাদের সবটা ছিল প্রতারণা। কিন্তু তারা যে অমন হাজার হাজার সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কর্মীকে প্রতারণা করতে পারল সেটা কিন্তু মার্কসবাদের সর্বহারা একনায়কত্বের আবেদনটাকে ব্যবহার করেই।

কিন্তু ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের সমস্যাটা এই জায়গায় হয়েছিল যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পথ ধরে তারা মাও সে-তুং চিন্তাধারার নমে যে জায়গাতে এসে পৌঁছেছিল সেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে মাওবাদ। এখানে পুনরায় উল্লেখ করি ১৯৬৮-তে যে ছাত্র-তরুণেরা পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠন করে তারা কিন্তু তাদের ঘোষণাপত্রে মাও সে-তুং চিন্তাধারার পরিবর্তে শুধুমাত্র মাওবাদ শব্দটি ব্যবহার করে। তারা ছিল মাওবাদী। আসলে মাওবাদ ছিল ঐ বিপ্লবী প্রজন্মের মূল ভাবাদর্শ।

মাওবাদ কোন্ তাৎপর্য নিয়ে তাদের কাছে দেখা দিয়েছিল, যে কারণে তারা তার প্রতি এতটা আকৃষ্ট হয়েছিল? আসলে মাওবাদ মার্কসবাদী একনায়কত্বিক কাঠামোর ভিতর ধারণ করে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের ধারণার মাধ্যমে এক ধরনের বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ধারণা এবং সেই সঙ্গে কৃষকের বুর্জোয়া বিপ্লবের ধারণাটিকে। বস্তুত মাওবাদ নিজেকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে পৃথক করে নিয়েছে তার মর্মবস্তু স্বরূপ ‘শত ফুল ফুটতে দাও’-এর প্রেরণা উপস্থিত করে। অর্থাৎ মাওবাদের একটি মর্মবস্তু বুর্জোয়া গণতন্ত্র। হাঁ, মাওবাদ এক বিরাট আত্মদ্বন্দ্বেরও জন্ম দিয়েছে। কারণ ব্যক্তি-পুঁজিহীন একনায়কত্বের তথা নিরঙ্কুশ এককেন্দ্রের ভাবাদর্শিক কাঠামোর ভিতরে থাকায় তার সঙ্গে গণতন্ত্রের ভাবাদর্শিক কাঠামোর দ্বন্দ্বটা অমীমাংসেয়। মাও তার শিকার নিজেও হয়েছিলেন। তার শিকার হয়েছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লব। তার শিকার হয়েছিল এ দেশের তরুণ প্রজন্মও।

মাওবাদের ভিতরের ঐ গণতান্ত্রিক প্রেরণার কারণে তরুণ বিপ্লবীরা সাধারণভাবে অন্ধ পিকিংপন্থী হয় নি। আইয়ুবকে মিত্র ভাবে নি। মুজিবকে প্রধান শত্রু ভাবে নি। কিন্তু তবু তারা আত্মদ্বন্দ্বের শিকার ছিল। কারণ মার্কসবাদের বৃহত্তর কাঠামোর ভিতর মাওবাদের গণতন্ত্রের ভাবাদর্শিক কাঠামোটি রাখা। সুতরাং তারা এ দেশের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ধারায় গড়ে ওঠা নেতৃত্বের কাছেই ধরা দিয়েছিল যেমন ভাসানী ধরা দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্র ও বিপ্লব করতে চেয়ে, স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি গড়তে চেয়ে। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের আত্মদ্বন্দ্ব দূর হয় নি কখনই। এই আত্মদ্বন্দ্বের ফল হিসাবে এসেছে চারু মজুমদারের পথ। সেটা ছিল আত্মঘাতী। তবু এ ছিল এক অমীমাংসেয় আত্মদ্বন্দ্বের হাত থেকে মুক্তির অচেতন প্রয়াস। সবাই হয়তো অতটা অন্ধ ছিল না। কিংবা মার্কসবাদের মৌল বিষয়গুলি না জানার কারণেও সবাই অতটা অন্ধ ছিল না। একটা আনুগত্য ছিল কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রতি। ভাবত পথটা এখান থেকেই হয়তো বেরিয়ে আসবে।

মাওবাদের এই আত্মদ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির জন্য তখন দরকার ছিল একদিকে আত্মধ্বংস অপর দিকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। যারা চারু মজুমদারের পথকে অন্ধভাবে নিল তারা নিজেরা ধ্বংস হল, কিন্তু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সনাতন ধারায় গড়ে ওঠা শক্তিটাকেও ধ্বংস করল এবং সেই সাথে ধ্বংস করল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মর্যাদা। অন্যদিকে যাদের চেতনায় মাওবাদের গণ-বিপ্লব ও গণতন্ত্রের অবকাঠামোটি প্রবল ছিল তাদের জন্য প্রয়োজন ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আঘাতের। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ তাদের অন্তত কারো কারো চেতনার জগতে মার্কসবাদের কাঠামোটাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল। এইভাবে এ দেশে বিপ্লবী গণতন্ত্রের শক্তি সব দিক থেকে মুক্ত হল। কিন্তু এটা তখন শুধু একটা চেতনা, যার নেই সাংগঠনিক কাঠামো, সুনির্দিষ্ট মতবাদ বা ভাবাদর্শিক কাঠামো। তবু এ দেশের ভবিষ্যৎ বিপ্লবের পথটা গড়ে উঠতে পারে এই চেতনার ভিতর থেকে। সুতরাং এ দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সমগ্র বাম কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক বিরাট ধ্বংসের প্রয়োজন ছিল। হয়তো আওয়ামী লীগ ও মুজিবের কারণে ধ্বংসটা হয়েছে খুব বেশী যন্ত্রণাদায়ক। যেটা হতে পারত এক বিরাট শক্তির সহজতর রূপান্তর বা উত্তরণ সেটা হতে পারে নি লীগ ও মুজিবের ভূমিকার কারণে। তবু এই ধ্বংসের এক ভাল দিকও আছে। এ দেশে সমাজ পরিবর্তন ও বিপ্লবের পথে বাধা হয়ে ওঠা শক্তির অবসান হয়েছে।

বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা শেষ হয়েছিল। সুতরাং তা গেল। এই আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে বিকশিত ন্যাপের ভূমিকাও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ফুরিয়ে এল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর লীগ ও মুজিবের বিরুদ্ধে ভাসানীর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু তিনি দিল্লীর বিরোধিতা করতে গিয়ে ইসলামকে যেভাবে ব্যবহার করেন সেটা যত কৌশলগত হোক এর একটা ক্ষতির দিকও ছিল। সেই সময়ে তিনি ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আবেদন না রেখে যদি দিল্লী ও লীগ সরকার বিরোধিতায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতেন তাহলে হয়তো বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের প্রকৃত শক্তিটি ন্যাপে একটা জায়গা পেত। ফলে ন্যাপের ভিতর দিয়ে নূতন রাজনীতির ধারাটি ধীর গতিতে হলেও বিকশিত হবার সুযোগ হয়তো পেত। বস্তুত মুজিব আমলে তাঁর ঐ ভূমিকার ফলে আমার মতো কর্মীরা ন্যাপের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার আগ্রহ হারায়।

আমার বিবেচনায় ভাসানীর দ্বিতীয় বৃহৎ ভুল হল জিয়ার সামরিক শাসনকে যেভাবেই হোক সমর্থন দেওয়া। তিনি অপেক্ষা করতে পারতেন। বামপন্থীরা ছিল তাঁর ভিত্তি। মুজিব আমলে তারা ছিল ভয়ঙ্কর নিগ্রহের শিকার। সেটা যেভাবেই হোক ভাসানীকেও নিশ্চয় আহত করেছিল। তবু একটা রাজনৈতিক শাসনের পরিবর্তে একটা সামরিক শাসন কাম্য হতে পারে না। আর জিয়াও তো মুজিব বা লীগের সৃষ্টি। মুজিবের সুশৃঙ্খল সামরিক রূপ। এর ফলে রাজনৈতিক মুজিবের চেয়ে অনেক বেশী শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিয়মানুগ এবং স্থিতিশীল। কিন্তু তবু জিয়ার ভিতর থেকে কোনো সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে উঠতে পারে না। ভাসানী বরং লীগের পতন ও জিয়ার উথানের মধ্যে যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা পূরণের জন্য একটা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে পারতেন। তাঁর ঐ ভূমিকার ফলে পরবর্তী কালে মশিউর রহমান যাদুর মতো নীতিহীন লোক ন্যাপকে জিয়ার লেজুড় করতে পারল। ১৯৭৬-’৭৭ সালে আমি আরও কিছু নেতা-কর্মীসহ পুনরায় ন্যাপে যোগ দিই বা সক্রিয় হই। কিন্তু জিয়াকে যাদুর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ সমর্থন দিলে তার সংশ্রব আমরা কিছু সংখ্যক কর্মী চিরকালের মতো ত্যাগ করি।

জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-এর যে রাজনীতি দাঁড়াল সেটার প্রধান সাংগঠনিক ভিত্তিটা কিন্তু হল বামপন্থীরা। মুজিব তাদের রাজনীতিতে ভূমিকা পালনের সুযোগ না দিয়ে শুধু ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু জিয়া মুজিব ও লীগ বিরোধী রাজনীতি দাঁড় করাতে এদেরকে কাছে পেলেন। একদিকে জনগণের মনে লীগের পৌনে চার বৎসরের দু:শাসনের ভয়াল স্মৃতি, অন্যদিকে বাম কর্মীদের এক বিরাট অংশের আগমন জিয়ার সামরিক রাজনীতিকে এক দৃঢ় জমির উপর দাঁড় করালো। এইভাবে এ দেশে স্বাধীন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তিটারও অনেকটা হারিয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে ভাসানী কর্তৃক জিয়ার সামরিক শাসনের প্রতি সমর্থন প্রকাশের সঙ্গে এ দেশে নেতৃত্বকারী শক্তি হিসাবে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা ফুরালো। এরপর তিনি আর বেশী সময় বাঁচেন নি।

কিন্তু যখন আরও গভীরভাবে চিন্তা করি, পুনরায় চিন্তা করি তখন মনে হয় ভাসানী হয়তো তাঁর মতো করেই ঠিক। প্রথমত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে তিনি কোনোক্রমেই কারো দ্বারাই বিপন্ন হতে দিতে চান নি। তিনি জানতেন এবং বুঝতেন দিল্লী বাঙ্গালীর শত্রু। সুতরাং বাঙ্গালীর সেকিউলার রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র না হলেও তিনি হয়তো মনে করতেন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিতরেই তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা রয়েছে। এটা বিনষ্ট হলে সব বিনষ্ট হবে। তখন সেই মুহূর্তে, লীগ সরকারের পতনের পর ঐ মুহূর্তে তাঁর কাছে সম্ভবত স্থিতির প্রয়োজনটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, ভাসানীর তখন প্রয়োজন ছিল সারা বাংলাদেশে লীগ শাসনে, আক্রমণে বিনষ্ট, বিধ্বস্ত, ছত্রভঙ্গ, হতাশ, ক্ষীয়মান বামপন্থীদের পুনর্বাসন বা দম ফেলার জায়গার। বামপন্থীদের সবাই যে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের রাজনীতিতে গিয়েছিল তা নয়। অনেকেই ছিল জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে। এবং এক বিরাট অংশ ছিল ১৯৭১-এ ভারত-রাষ্ট্রের আশ্রিত। অনেকে ছিল দেশের ভিতরে দিশাহারা। এক বিরাট অংশ কখনই ন্যাপ পরিত্যাগ করে নি। যারা করেছিল তাদেরও এক বড় অংশ ন্যাপে ফিরে এসেছিল। ন্যাপ গোঁড়া কমিউনিস্ট বাদে সকল বামপন্থীর আশ্রয় শিবির হল।

ভাসানী হয়তো ভেবেছিলেন যদি এরা কখন জিয়ার সঙ্গে যায় যাক। না, তিনি যাওয়াটা দেখে যান নি। তার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তিনি ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক যাদু মিয়াকে তো চিনতেন। এই যাদু মিয়ার ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক হবার পিছনেও এক ইতিহাস আছে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৭০-এ আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাপ ত্যাগ না করেই স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগঠিত করার এবং তার নেতৃত্বে সংগ্রাম বা আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থাৎ তারা ন্যাপ ছেড়ে যাবে, কিন্তু সেটা থাকবে প্রকাশ্য মিত্র সংগঠন হিসাবে। প্রয়োজনে ফেরার রাস্তা খোলা রাখার উদ্দেশ্যও সম্ভবত এই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল। তখন তারা ঠিক করল যাদুকে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত করে যাবে। সেই সময় ছিল ন্যাপের জাতীয় সম্মেলন। যাইহোক, যাদু ছিলেন তাদের দৃষ্টিতে জাতীয় বুর্জোয়া। হায়রে, ভাসানী হলেন পেটি বুর্জোয়া, আর যাদু জাতীয় বুর্জোয়া! যাদুর ইতিহাস নিয়ে এখানে আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই। সেটা সবার জানা। তবে ভাসানী ছিলেন যাদুর বিরোধী। কিন্তু তাঁর উপায় কি? কমিউনিস্টরা তো তাঁকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে এবং ঘাড়ের উপর রেখে দিয়ে যাবে এক নিকৃষ্ট বাছাই। বাধ্য হয়ে মেনে নিলেন।

কিন্তু যে কথা বলছিলাম ভাসানীও হয়তো জানতেন শেষ পর্যন্ত তাঁর অবসন্ন বাহিনী জিয়ার আশ্রয় নিবে। যদিও নিজে দায়িত্বটা নেন নি। কিন্তু তাঁর না বোঝার কারণ ছিল না যে, জিয়াকে সমর্থনের কি পরিণতি হবে। এ দেশের বাম গণ-আন্দোলনের মূল ধারাটা সেনাবাহিনীর গর্ভে আশ্রয় নিবে।

হয়তো সেটাই তখন তিনি মেনে নিয়েছিলেন। আর একটা ধারার ভুলের দায় তো তাঁকেও টানতে হবে। হয়তো এই পথে তিনি এক অবসন্ন, ধ্বংসপ্রায়, বিপন্ন বাহিনীকে এবং সেই সঙ্গে তাঁর স্বপ্নকে ভবিষ্যতের জন্য রক্ষা করার একটা ব্যবস্থা চেয়েছিলেন। হয়তো মনে করেছিলেন এখান থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী ভবিষ্যৎ শক্তি নূতন ও প্রবল শক্তি নিয়ে আবার ফিরবে।

তাঁর মতো এই সমাজকে আর কয়জন চিনত? এটা না সেই দেশ যেখানে ১৯৫৭ সালে জাতির প্রতি সকল অঙ্গীকার বীর দর্পে ভঙ্গ ক’রে, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন ক’রে পুনরায় ১৯৬৬-তে রাজনীতিতে বীরের মতোই বুক ফুলিয়ে দাঁড়ানো যায়? আমার মনে আছে ১৯৬৭-তে ট্রেনে ১৯৫৬-’৫৭-এর মুজিবের ভূমিকার প্রসঙ্গে এক গ্রাম্য মধ্যবিত্তের মন্তব্য, ‘শেখ মুজিব চোর হোক আর যা-ই হোক, বাঙ্গালীর কথা তো বলে!’ হাঁ, এ দেশে চরিত্রের প্রয়োজন নেই। চুরি করে, লুট করে প্রবল শক্তি নিয়ে এসে আবার ভাল কথা সাজিয়ে বলতে পারলেই এ দেশে নেতা হওয়া যায়!

মুজিবের শক্তি ভিত্তিটা কি ছিল? ১৯৫৬-’৫৭তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির মাধ্যমে, লাইসেন্স-পারমিট বিতরণের মাধ্যমে যে এক অধিকতর শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী এ দেশে গড়ে তুলেছিল তারাই হল ষাটের দশকে জনমতেরও প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিমনে রাখতে হবে মুসলিম লীগ রাজনীতির আশ্রয়ে বিকশিত মধ্যবিত্তের প্রধান অংশই আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিয়ে আরও বিকশিত ও শক্তিশালী হয়।

ভাসানী যে ষাটের দশকে দাঁড়াবেন স্বাধীন ভূমিকা নিয়ে তার শক্তি কোথায়? মধ্যবিত্ত তার সঙ্গে কতটুকু? যারা ছিল তাদের অর্থ-বিত্ত কোথায়? শুধু ছাত্রদের নিয়ে তিনি এগোবেন? ছাত্রদের অর্থ-বিত্ত কোথায়? তারা না হয় মিছিল করল, গুলিতে প্রাণ দিল? কিন্তু সভা, বড় বড় জমায়েত, সংবাদপত্র এসব কোথা থেকে পাওয়া যাবে? সুতরাং তাঁর ভরসা হল একদল আদর্শবান মানসিক প্রতিবন্ধী। তবু ভাল, এরা আর যা-ই হোক চোর হবে না! কিন্তু ওভাবে কি রাজনীতি হয়? এ দেশে? যে দেশে আজও এই কম্পিউটার, টিভি আর ইন্টারনেটের যুগে ট্রেনে, বাসে, হাটে, বাজারে, রাস্তার মোড়ে ওষুধবেচারা ৬২ রোগ সারানোর ক্ষমতাসম্পন্ন একটা মাত্র মহৌষধ বিক্রি করতে পারে শুধু গলার জোরে সেই দেশের রাজনীতির মানটাই বা কি হবে? পথ চলতে প্রায়ই তো এমন অভিজ্ঞতা সকলের হয়। কোনো রোগই সারার কথা নয় ওসব ওষুধে। তবু শুধু অশিক্ষিত নয় লেখাপড়া জানা অনেক মানুষও ঐসব ওষুধ কিনে নেয়। ‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি’, রোগ না সারলে ঘাড় ধরে টাকা আদায় করে নেবার অধিকার প্রদান এইটুকু জোর গলায়, গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে বলতে পারলেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত বহুজনেরই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়। ঠকে। তবু কেনে। আবার ঠকে। তবু কেনে। কারণ অমন জোরে চীৎকার শুনলে সর্বরোগ হরণের মহৌষধ হারাবার ধৈর্যটা আর থাকে না!

তা, রাজনীতিতে গলার অমন জোর আনার জন্য বক্ষ-পিঞ্জর আর ঘাড়-গর্দানের আয়তনটাও তো তেমন হওয়া চাই। যত বড় সমাবেশ, মিছিল, সভা হবে, যত বেশী কর্মীরা ছুটাছুটি করবে তত না বক্ষ-পিঞ্জর, ঘাড়-গর্দানটাও অমন চীৎকার দেবার উপযোগী হবে! এগুলোর জন্য টাকা লাগে না?

হাঁ, এই সমাজকে ভাসানীর মত কেউ চেনে নি। তিনি সেসব কথা বলতেন। ঐ মুসলমান পীর বলতেন, ‘মুসলমান হিন্দুর মতো ২৭ বৎসর আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে পারে না। মুসলমানের অত ধৈর্য নাই।’ আর একটা গল্প একদিন তিনি বললেন মুসলমান সম্পর্কে। বগুড়ার পাঁচ বিবিতে। সম্ভবত ’৬৯-এ। আরও অনেকের সঙ্গে আমিও গল্পটা শুনেছিলাম। আশা করি মুসলমানরা আমার উপর অসন্তুষ্ট হবেন না। কারণ এটা আমার কথা নয়। মওলানা ভাসানীর। আর এটা আমি বলছি যারা তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলে তাদের কথার জবাব দেবার জন্য এবং সেই সঙ্গে ভাসানীর প্রকৃত ঐতিহাসিক ভূমিকার সঠিক মূল্যায়নের জন্য।

তিনি গল্প করলেন আল্লাহ কিভাবে মুসলমান বানিয়েছিলেন। গল্পটা এই রকম, আল্লাহ ফেরেশতাদের হুকুম দিলেন মানুষ বানাতে যাদের তিনি পৃথিবীতে পাঠাবেন। ফেরেশতারা সব মালমশলা যোগাড় করে মানুষ বানাতে শুরু করল। দুই চারজন মানুষ তো নয়! এখন মানুষ বানাতে বানাতে সব মগজ ফুরিয়ে গেল। ফেরেশতাদের সেদিকে খেয়াল ছিল না। তারা মানুষ বানাচ্ছে আর মগজহীন মাথা খুলি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে। হঠাৎ একজন ফেরেশতার খেয়াল হল, সর্বনাশ! মগজ তো দেওয়া হয় নি বহু মাথায়। এদিকে আরও বহু মানুষ তৈরী হয়ে এসেছে, খুলিসহ সব আছে, কিন্তু মগজ তো নেই!

ফেরেশতারা আল্লাহর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে তাঁকে ঘটনা জানাল। আল্লাহ সব শুনলেন। তারপর বললেন, ‘কোনো চিন্তা নেই। আর মগজেরও প্রয়োজন নেই। বাকীগুলোর মাথাও খুলি দিয়ে ঢেকে দাও।’ ফেরেশতারা বলল, ‘তা হলে মাথা যে খালি থাকবে!’ আল্লাহ বললেন, ‘তারও ব্যবস্থা আছে। খালি মাথা যত আছে সেগুলোকে আলাদাভাবে সব এক জায়গায় করে ওগুলোর মাথায় একটা করে গোল টুপি পরিয়ে দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিবে। ওরাই হবে আমার মুমিন বান্দা।’ অর্থাৎ মুসলমান।

মুসলমান সম্পর্কে ভাসানীর আর একটা মূল্যায়ন ছিল। তাঁর ভাষায় মুসলমান হল ইঁদুরের মতো। সামনে মাংসের একটা টুকরো ধরলেই হল। মুসলমান লাফ দিয়ে ওটা খেতে গিয়ে ফাঁদে পড়ে।

না, মুসলমান জনগণের প্রতি তার ঘৃণা ছিল না। বরং ছিল গভীর মমতা। তিনি বুঝতেন এই দেশের অজ্ঞ-মূর্খ-অন্ধ মুসলমান কৃষক, মেহনতী মানুষ কিভাবে লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, লুণ্ঠিত হয়। তিনি বুঝতেন এই মানুষদেরকে উন্নত করতে হবে। তিনি বুঝতেন এদের জন্য যোগ্য নেতা, যোগ্য শিক্ষক প্রয়োজন যাতে তারাও উন্নত মানুষ হিসাবে, উন্নত সমাজ ও জাতি হিসাবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। সেই যোগ্য নেতা বা শিক্ষক তিনি পান নি। তবু তিনি এই জনগোষ্ঠীর দুর্বলতা ব্যবহার করে ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানীতে বাড়ী বানানোর স্বপ্ন কোনোকালে দেখেন নি। দোষে-গুণে সমন্বিত এই জনগোষ্ঠী ছিল তাঁর সন্তান সম। তাদের উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্নের বীজটাই তাই হয়তো নূতন করে বুনে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেটা ছিল তাঁর নিজের আজীবন সাধনার বীজ।

তিনি জানতেন ন্যাপের বলয়ে থাকা বাম শক্তি এ দেশে আপোস না করে একার শক্তিতে কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এখন তার একটা অবলম্বন চাই, আশ্রয় বা সমর্থন চাই কোনো প্রবল শক্তির যা হবে লীগ-বিরোধী। এ দেশে সৎভাবে, নিষ্ঠার সঙ্গে, আপোসহীনতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে বললে ২/৪ জন মানুষ হয়তো কোনো রকমে টিকে থাকবে। কিন্তু যে প্রবল শক্তি ছাড়া সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্নটাই গড়ে ওঠে না সেই শক্তির জন্ম বা পুনর্জন্ম হবে কিভাবে?

যাদুর মতো লোকের হাতে নেতৃত্ব না থাকলে সামরিক শাসক জিয়া সবটা হয়তো ওভাবে গিলে ফেলতে পারতেন না। একটা সমন্বয় হতে পারত। কারণ তখন জিয়া বা সেনাবাহিনী ন্যাপের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় যেতে বাধ্য হত। সেটাকে তা নিজের পুনর্গঠন, পুনরুজ্জীবনের জন্য ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু সেসব হল না যাদুদের স্বার্থান্ধতা, ধৈর্যহীনতা এবং লুম্পেন চরিত্রের কারণে। তাঁরা বিনা শর্তে, সব ছেড়ে দিয়ে বাম আন্দোলনের বিরাট বাহিনীটাকে সেনা শিবিরে ঢুকিয়ে দিলেন।

এখন সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং ষড়যন্ত্রের ভিতরে থেকেও বিএনপি-তে যে বামপন্থীরা গেল তারা কিন্তু একটা চেতনার উত্তরাধিকার সাথে করে নিয়ে গেল। সেটা অবদমিত হতে পারে। কিন্তু ওটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর রাজনীতিতে যে ভূমিকা পালনের সুযোগ তাদেরকে এ দেশে আওয়ামী লীগ দেয় নি সেটার একটা সুযোগ তারা পেল। ধীরে ধীরে তাদের অনেক কিছুই কম-বেশী হল। ক্ষমতা হল, রাষ্ট্র চালাবার একটা বিদ্যা আয়ত্ত হল, সম্পদও অনেকের হল। সামাজিক সংযোগগুলো হাতে এল। আর এইভাবে তারা নিজেরা এবার একটা নূতন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ও বিস্তার ঘটালো। এদেরই একটা অংশ আরও অধ:পতিত হয়ে এরশাদের রাজনীতিতে গেল। সবাই যে সখ করে গেল তা নয়। পরিস্থিতির বৈরিতার মুখে বাধ্য হয়েও কেউ কেউ গেল।

হাঁ, এইসব কিছুকেই আমাদের হিসাবে নিতে হবে। এ দেশে পঁচিশ বছরের মধ্যে প্রায় ১৮/১৯ বছর কালের বামদের এক বিরাট অংশের ইতিহাস হল সামরিক-বেসামরিক আমলা শাসন এবং খালেদার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-এর সঙ্গে থেকে কোনো না কোনোভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে থাকার অথবা তাকে প্রভাবিত করার ইতিহাস। এর ফলে এরা এখন যেভাবেই হোক সমাজের এক প্রবল শক্তিতে পরিণত হল।

এ কথা ভুললে চলবে কেন আওয়ামী লীগ যখন এরশাদের সহযোগী হয়েছিল তখনও বিএনপি আপোসহীন থেকে এরশাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল। এ শক্তির উৎসটা কোথা থেকে সেদিন খালেদা পেয়েছিলেন? তা হল বিএনপি-এর ভিতরের বাম শক্তির অবশেষটুকু থেকে আর সবচেয়ে বেশী জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল থেকে। এই ছাত্র দলের মূল শক্তিটাই তো পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আসা শক্তি দিয়ে তৈরী।

খালেদা ১৯৯১-তে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাবার পূর্ব পর্যন্ত এই বাম ধারার শক্তির উপর দাঁড়িয়ে থেকে আপোসহীন রাজনীতিটা করতে পারলেন। এই যে এক বিশাল যুবশক্তি, এ দেশের ছাত্রদের বৃহত্তর অংশটা ছাত্র দলে থাকল সমস্তটা সময়, এর কারণ কি? এরশাদ শাসনামলের নয়টা বৎসর তো ক্ষমতাও ছিল না। তাহলে?

সেটা হল বাম ধারা থেকে আগত তরুণ প্রজন্মের অন্তর্গত জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক প্রেরণা যেটা দিল্লী বিরোধী এবং লীগ-বিরোধী ছিল। এটা ঠিক যে, বিএনপি-এর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ‘বিসমিল্লাহ’ এই প্রেরণাকে বিকৃত রূপ দিয়েছে। তবু মূল প্রেরণা ওটা। এ দেশের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি, হয়তো সেটা কাঁচামালের মতোই অপরিচ্ছন্ন, অপ্রক্রিয়াজাত, ছাত্র-তরুণেরা দলে দলে থাকল বিএনপি-এর ছাত্রছায়ায়।

এতদিন না হয় খালেদা তরুণ প্রজন্মের বিরাট অংশকে ক্ষমতার লোভ বা ভয় দেখিয়ে শান্ত করে রেখেছিলেন। তাদের জাতি গঠনের প্রত্যাশাকে প্রতারিত করেছিলেন। এখন খালেদা কিভাবে ঐ তরুণ শক্তিকে ধরে রাখবেন? তাঁর নেই ক্ষমতা, নেই আদর্শ। তাঁর ক্ষমতার পাঁচ বছরের ইতিহাস হল চুরি, সন্ত্রাস, লুট, দুর্নীতি আর প্রতারণার ইতিহাস। এখন তিনি কিভাবে এই বিপুল, বিশাল যুবশক্তিকে তাঁর নিয়ন্ত্রণে রাখবেন? এখন তাঁর ক্ষমতাও নেই, আদর্শও নেই। এবং তার সমস্ত ফাঁকি আর অযোগ্যতা ধরা পড়ে গেছে সকলের কাছে, সমস্ত জাতির কাছে। বিএনপি-এর রাজনীতি কোনো কালেই আদর্শ ভিত্তিক ছিল না। সেটা এ দেশে কার? আওয়ামী লীগের? আওয়ামী লীগ আদর্শের কথা বললেও তার প্রয়োগ কি তার নিজ জীবনে বা ইতিহাসে আছে? আদর্শ মানে কি শুধু বুলি, কথা? সবচেয়ে ভাল কথা তো সবচেয়ে বড় প্রতারকও বলতে পারে। প্রতারকের আসল মূলধন তো তার কথা এবং ভাবভঙ্গী, যা দিয়ে সে অন্যের বিশ্বাস অর্জন করতে পারে। আসলে কে কি বলল শুধু সেটা দেখলেই হয় না, কে কি করে বা করেছে সেটাও দেখতে হয়। আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুধু ক্ষমতার রাজনীতি, শুধু ভোটের রাজনীতি। এর জন্যই তার যা কিছু সংগ্রাম, জেল-জুলুম সবকিছু। কিন্তু কর্মী কি এভাবে তৈরী হয়? নিপীড়িত মানুষের কাছে, পশ্চাৎপদ মানুষের কাছে, শ্রমজীবী মানুষের কাছে যাওয়া, তাদেরকে সচেতন করা, সংগঠিত করা, তাদের নিয়ে আন্দোলন করা, তাদেরকে উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ ও নিয়োজিত করা এসব শিক্ষা কি আওয়ামী লীগের কর্মীরা জীবনে পেয়েছে? এই শিক্ষা ছাড়া ক্ষমতায় যাবার পর কি হয়? অতীতে কি হয়েছে? আগামীতেও কি হবে তা হাসিনা শিগগির দেখবেন

সুতরাং আওয়ামী লীগের রাজনীতি হল আদর্শ-বিযুক্ত রাজনীতি। বিএনপি-এরও ঠিক তাই। কিন্তু বিএনপি-এর ভিতর এমন একটা উপাদান আছে যা আওয়ামী লীগের নেই। সেটা হল আদর্শের ঐতিহ্যিক শক্তি। হাঁ, বামেরা যারা বিএনপি-তে গেছে তাদের অতীতের ত্যাগ, শ্রম, সংগ্রামের বিনিময়ে, অনেক রক্তের বিনিময়ে গড়া একটা আদর্শের উত্তরাধিকার নিয়ে সেখানে গেছে। আর এই কারণে এরশাদের পতনের পর জাতীয় পার্টি ছত্রখান হয়ে গেলেও বিএনপি যায় না।

তবে এবার যাবে। কারণ বিএনপি-এর কাছ থেকে জাতির সব প্রত্যাশা, এরশাদের ৯ বৎসরের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রায় লাগাতার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত সব প্রত্যাশা বিএনপি তার বিগত প্রায় ৫ বৎসরের শাসনামলে তছনছ করেছে। নয় বৎসরের অত বড়, অত দীর্ঘ এক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতির যে প্রত্যাশা জেগেছিল তারই ফলে বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল, কিন্তু বিনিময়ে কি দিয়েছে? সুতরাং ভাসানীর রাখা, বিপ্লবী প্রজন্মের রাখা যে চেতনার শক্তিটা বিএনপি-এর ভিতরে এতকাল ধরে লালিত ও পুষ্ট হয়েছে সেটা ভেঙ্গে বের হবে। এই শক্তির সামনে কারা থাকবে, কোন্ ব্যক্তি কি ধরনের ভূমিকা নিবে সেটা বিচার্য নয়। আমি শুধু শক্তির নিজস্ব গতিধারার নিয়মের কথাটা বলছি।

এই শক্তির অতীত আছে। সেখানে সে ফিরতে পারে। সেটা এক গৌরবময় প্রজন্ম ও যুগের গড়া, এক গৌরবময় প্রাচীন পুরুষের গড়া। যারা বাধ্য হয়ে বিএনপি-তে গিয়েছিল তাদের এক বড় অংশ ফিরতে পারে। কারণ তাদের ফেরার জায়গা আছে। আর হাঁ, এখনও চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ষাটের দশকের অনেক বিপ্লবী আছে। তারাও ফিরতে পারে। কারণ তাদের সকলেরই অতীত আছে। হয়তো অনেকের বর্তমানও আছে।

তবে সূচনার শক্তিটা আসতে হবে ষাটের দশকের প্রজন্ম থেকে। কারণ তারাই এ দেশে প্রকৃত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সৃষ্টিকারী। তাদের সংখ্যা কত, শক্তি কত সেটা কোনো বিচার্য বিষয় নয়। কারণ আয়তন ও অবয়বের শক্তি দিয়ে যদি সবকিছু নির্ধারিত হত তাহলে মানুষ হাতির পিঠে চাপত না বরং হাতিই মানুষের পিঠে চাপত। বস্তুত এ দেশে ষাটের দশকের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন ও স্বনির্ভর শক্তিটাকে বাদ দিলে আর সব মুক্তিযোদ্ধাই শূন্যে পরিণত হয়। নয় মাস প্রাণপণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও। আর এ কথা সমর বিজ্ঞানের কোন্ ছাত্র জানে না যে, ‘যুদ্ধ হল রাজনীতির সম্প্রসারণ।’ বিখ্যাত জার্মান সমর বিজ্ঞানী ক্লসউইৎস্ থেকে মাও পর্যন্ত অনেকেই কথাটা বলেছেন । তাঁদের পূর্বেও। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বাদ দিয়ে শুধু যুদ্ধটাকে নিয়ে টানাটানি করলেই বিরাট মুক্তিযোদ্ধা হওয়া গেল? তাহলে মোশতাক কি? জিয়া কি? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তাঁরা কি রকম ধারক, বাহক ছিলেন?

হাঁ, ষাটের দশকের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীন শক্তিটাই মূল সংখ্যা, ওটাকে বাদ দিলে আর সবই শূন্য। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি সব একত্র করলেও ঐ শূন্যের আয়তনটাই বাড়ে মাত্র। আসলে এতকাল শুধু কতগুলো শূন্য দিয়ে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের খেলা হয়েছে। তাতে সব ফলই শূন্য হয়। সংখ্যা বেরোবে কি করে? জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিই যে আর কারো ছিল না! ওটা কি হঠাৎ করে আসে? যেন জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিটা শুরু হল ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পরিণতিতে হঠাৎ ২৫ মার্চ রাতে পাক-বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে। অতই সহজ!

না, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি অত সহজে গড়ে ওঠে না। অত সহজে মুক্তিযুদ্ধ হলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয় না। তখন তারা সবাই ‘গণ্ডগোলের বছর’ হঠাৎ গণ্ডগোলে একটা পক্ষে অস্ত্র হাতে নিয়ে মারামারি করা লোকে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধ কি চর দখলের কাজিয়া যে হঠাৎ জেগে ওঠা চরের দখল নিতে দুই পক্ষ ঢাল-সড়কি-লাঠি নিয়ে মুখে হাত দিয়ে ‘আবা আবা’ ধ্বনি তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেই হল? হাঁ, চিরকাল তো এই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধটা নিজেরা করেছে তা হল ঐ চর দখলের কাজিয়া বা কাইজ্যা। ঐ চর গড়াও যায় না, ভাঙ্গাও যায় না। নদীই তা আপন নিয়মে গড়ে, ভাঙ্গে। ঐ চর নিয়েই ঘটত এই জনগোষ্ঠীর অতীতের সবচেয়ে বড় সামাজিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলো। প্রায় প্রতি বছরের ঘটনা ছিল সেটা। অবশ্য এখনও কিছু চরাঞ্চলে এই ঘটনা প্রতি বছরের। এখন কিছু সংখ্যক ‘মুক্তিযোদ্ধা’র ভাবসাব দেখে মনে হয় বাংলাদেশ যেন হঠাৎ জেগেছে চরের মত, আর ’৭১-এর কাজিয়াটা সেই চরের দখল নিতে! যেন মুক্তিযোদ্ধারা সব কাজিয়ার লাঠিয়াল! চর গড়ার ইতিহাসের প্রয়োজন নেই! এ দেশের রাজনীতিতে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত সংখ্যাটা হল ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম, যাদের পিতা সম ছিলেন ভাসানী। হাঁ, ঐ সংখ্যার পরে যত শূন্য যোগ করা যাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের শক্তি তত বাড়বে। আর তখনই সবাই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারী প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠতে পারবে। তখন আর কেউ-ই শূন্য রইবে না। সেটা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি যে-ই হোক না কেনযত লড়াইয়ের মাঠের মুক্তিযোদ্ধা আজো বেঁচে আছেন তাঁরা হোন না কেন। এবং এইভাবে সমস্ত জাতিও হয়ে উঠবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা।

অবশ্য এর মানে এই নয় যে, আমি বলতে চাইছি ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম থেকে আগতদের দিয়ে আগামী দিনের নেতৃত্বের প্রধান অংশ গঠিত হবে। না, সেটা হবে না। আমি এ কথা বলতে চাইছি যে, ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম থেকে আসতে হবে ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার শক্তি এবং ভাবপ্রেরণার শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে কিছু ব্যক্তিকে। একটা নূতন ধারার সূচনার জন্য এইটুকু প্রয়োজন। কিন্তু নূতন যুগের নেতৃত্ব গঠিত হবে প্রধানত নূতন শক্তিসমূহ ও তরুণ প্রজন্ম দ্বারা, যারা ঐ ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতাকে ধারণ করে নূতন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। আর এইভাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে তার পরিণতিতে নিয়ে যাবে।

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ