Banner
ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মের উত্থান ও রাষ্ট্রশক্তির অবসান — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ August 3, 2019, 12:00 AM, Hits: 1328

 

খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ শতকের দিকে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর এক থেকে দেড় হাজার বছরের অনেকটা সময় আমাদের জন্য ইতিহাস যেন ঘুমিয়ে ছিল। প্রত্নতত্ত্ব থেকে এই সময় সম্পর্কে সামান্য ধারণা পাওয়া যায়। ভারতীয় উপমহাদেশে নগর সভ্যতার জন্য সেটা ছিল এক বিরাট পশ্চাদপসরণের সময়। সেটা ছিল সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকা অঞ্চল থেকে প্রায় সমগ্র টিকে যাওয়া জনগোষ্ঠীর জন্য নিকট ও দূরের বিভিন্ন দেশে অভিগমন, পুনর্সংগঠন এবং পুনর্বাসনের সময়। বিশেষত কৃষিকে অবলম্বন করে গাঙ্গেয় উপত্যকায় পুনরায় নূতন করে নগর সভ্যতার আয়োজন যে এই সময়ে চলছিল সেটা অনুমান করা যায়। তবে সেটা সিন্ধু সভ্যতার বাস্তবতা এবং ভাবপ্রেরণা দুই দিক থেকেই অনেক ভিন্ন ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি এবং ঋগ্বেদ থেকে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় বাঁধ ও জলকপাটযুক্ত যে ধরনের নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করতে পারি তা আর কখনও ফিরে আসে নাই। অন্যদিকে, সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে আমরা যে ধরনের উন্নত, ব্যবহারিক, মূলত শান্তিনির্ভর, তুলনামূলকভাবে সমতানির্ভর এবং গণতান্ত্রিক নাগরিক সমাজের চিত্র দেখতে পাই সে ধরনের নাগরিক সমাজও আর পরবর্তী ভারতবর্ষে দেখতে পাওয়া যায় না।

সিন্ধু সভ্যতার পরবর্তী কালে গাঙ্গেয় অববাহিকায় প্রথমে কৃষি এবং অতঃপর নগর সমাজের উত্থানের পিছনে পুরোহিত শ্রেণীর ভূমিকা যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমরা সেই অনুমান করতে পারি। কারণ পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে গাঙ্গেয় অববাহিকায় যে সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সেখানে ধর্মের ভূমিকাকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখতে পাই। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, সমাজ গঠনে আমরা পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণদেরকে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ রূপে দেখতে পাই। এই ব্রাহ্মণরা সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে একটি ধর্মসংস্কার আন্দোলন এবং তার পরিণতিতে একটি গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে উদ্ভূত বৈদিক পুরোহিত শ্রেণীর উত্তরাধিকারী হলেও কালক্রমে তারা বহু মৌলিক বিষয়েই বৈদিক পুরোহিত শ্রেণী থেকে অনেক ভিন্ন হল। ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে গাঙ্গেয় অববাহিকায় বৈদিক ধর্ম এবং সমাজে বিরাট পরিবর্তন আনা হল।

প্রথমত, বৈদিক ধর্মে মূর্তিপূজা না থাকলেও ব্রাহ্মণরা মূর্তিপূজাকে তাদের ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে নিল। শুধু তা-ই নয়, বৈদিক দেবতাদের পরিবর্তে তারা বিভিন্ন অবৈদিক দেব-দেবীকে তাদের প্রধান দেব-দেবীতে পরিণত করল। দ্বিতীয়ত, তারা বর্ণজাতিভেদের ভিত্তিতে সমাজকে আনুষ্ঠানিকভাবে চার ভাগে বিভক্ত করল, যথা, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। এই ভাগের ভিত্তি হল পবিত্রতা ও অপবিত্রতার ধারণার ভিত্তিতে বর্ণজাতিসমূহের অপরিবর্তনীয় স্তরবিন্যাস এবং সেই সঙ্গে কর্ম বা পেশার সঙ্গে অপরিবর্তনীয়ভাবে কুলগত তথা বংশ ও গোষ্ঠীগত সংশ্লিষ্টতা। অর্থাৎ শুধু যে নির্দিষ্ট বর্ণজাতির জন্য পবিত্রতার ধারণা ভিত্তিক মর্যাদা নির্দিষ্ট হল তা-ই নয়, কর্ম বা পেশাও নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয় হল। ব্রাহ্মণ হল সবচেয়ে পবিত্র বর্ণজাতি এবং ধর্মচর্চার একচেটিয়া অধিকারী। পবিত্রতা ও মর্যাদার স্তরবিন্যাসে তার নীচে অবস্থিত বর্ণজাতি হল ক্ষত্রিয়; তাদের দায়িত্ব হল যুদ্ধ এবং রাষ্ট্র শাসন করা। তার নীচে জায়গা দেওয়া হল বৈশ্য বর্ণজাতিকে। তারা মূলত বণিক এবং কৃষিজীবী। তবে শূদ্র বর্ণজাতিতে ফেলা হল সাধারণ কৃষক এবং কামার-কুমার-ছুতার-তাঁতী-ধাতুশিল্পী ইত্যাদি কারিগর শ্রেণীর মানুষসহ সকল শ্রমজীবী জনগণকে। তত্ত্বগতভাবে তথা ধর্মীয় বিধানে তাদের কাজ হল উচ্চতর বর্ণজাতিসমূহের মানুষদের সেবা করা। অর্থাৎ শূদ্র হল সামাজিক সেবাদাস, যাদের কুলগত বা বর্ণজাতিগত পেশা এবং মর্যাদা পরিবর্তন হল নিষিদ্ধ। এভাবে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে ক্রমশ বর্ণজাতিভেদের এক অচলায়তনে বৃহত্তর সমাজকে আবদ্ধ করা হল। অথচ বৈদিক ধর্মে বর্ণজাতিভেদ প্রথা ছিল না। অবশ্য ব্রাহ্মণরা তত্ত্বগতভাবে সমাজকে চার বর্ণজাতিতে ভাগ করলেও বাস্তবে তারা পবিত্রতা-অপবিত্রতার ধারণা এবং বংশপরম্পরায় অপরিবর্তনীয় পেশা বা কর্মের ভিত্তিতে অগণিত বর্ণজাতিতে বিভক্ত একটা সমাজকে প্রতিষ্ঠা করল।

এটাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই চার বর্ণের বাইরেও আর একদল মানুষ থাকল যারা অস্পৃশ্য হিসাবে চিহ্নিত হল। চতুর্বর্ণের বাইরে এরা হল প্রকৃতপক্ষে পঞ্চম বর্ণ। এদের শুধু স্পর্শ নয়, এমনকি ছায়া পর্যন্ত অপবিত্র ছিল। বর্তমানে এরা দলিত হিসাবে পরিচিত। বুঝা যায় আদিম সমাজের যে সব উপজাতি বা গোত্র খাদ্য বা আশ্রয়ের প্রয়োজনে বা আশায় সভ্য সমাজে আগমন করতে চাইত তাদের একাংশকে সমাজের প্রান্ত সীমায় অস্পৃশ্য বা সর্বাধিক ঘৃণ্য হিসাবে জায়গা দেওয়া হত। এরা শুধু যে অস্পৃশ্য তা-ই নয়, এরা বাসও করত প্রকৃতপক্ষে শহর ও গ্রামের সীমানার বাইরে। রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া, বিশেষত শহর থেকে দূরে মানুষের দেহবর্জ্য বা মল নিক্ষেপ করা, পশুর মৃতদেহ দূরে নিয়ে ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা, গবাদি পশুর ছাল ছাড়ানো কিংবা তা দিয়ে জুতা তৈরী এবং জুতা মেরামত করা — এই ধরনের সমাজ কর্তৃক নিকৃষ্ট বিবেচিত কতকগুলি কাজ এদের জন্য নির্দিষ্ট করা হল। ২০১১-এর আদমশুমারির হিসাবে ভারতে দলিতদের সংখ্যা কুড়ি কোটি ধরা হলেও এদের প্রকৃত সংখ্যা প্রায় ত্রিশ কোটি। কারণ আদমশুমারিতে মুসলিম এবং খ্রীষ্টান দলিতদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় নাই। তাদের সংখ্যা দশ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে। দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত হবার কারণে ইসলাম এবং খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করবার পরেও এরা বহুবিধ বঞ্চনা এবং নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। যাইহোক, সবমিলিয়ে ভারতে দলিতদের সংখ্যা ৩০ কোটিরও বেশী হতে পারে। কাজেই ভারতের মোট জনসংখ্যা ১২০ কোটি হলে তার একচতুর্থাংশই হচ্ছে দলিত। বাংলাদেশে দলিত সংখ্যা ৬৫ লক্ষের উপর।

এভাবে সিন্ধু সভ্যতার সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান ঘটানো হল। শুধু তাই নয়, বাস্তবে বৈদিক ধর্মেরও অবসান ঘটানো হল। তবে সবই করা হল বেদের অভ্রান্ততা ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং সেই সঙ্গে বৈদিক ঋষিদের উত্তরাধিকারী হিসাবে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের নামে। নূতন অবৈদিক ব্যবস্থায় বেদের মন্ত্রসমূহ পাঠ করেই অবৈদিক দেবতাদের পূজা করা হল। বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজায় এবং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে, যেমন বিবাহে, বেদের মন্ত্রপাঠ অপরিহার্য হয়ে রইল। এটা মজার বিষয় যে, বেদ থাকল, অথচ বৈদিক ধর্ম থাকল না। বর্ণজাতিভেদের উপর প্রতিষ্ঠিত এই নূতন ধর্মে বেদ হল ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার হাতিয়ার। এটা আমাদের নিকট এখন পরিচিত হিন্দু ধর্ম হিসাবে।

এই অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় যে, মূলত গাঙ্গেয় অববাহিকায় সরে এসে বৈদিক পুরোহিত শ্রেণী আদিম উপজাতিসমুহের উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতাকে মূলত রক্ষা করে তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে কৃষি সমাজের অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য যে সকল কৌশল নিয়েছিল তার ফল হচ্ছে হিন্দু ধর্মের উত্থান। এটা ঠিক যে সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে সিন্ধু সভ্যতার শান্তিনির্ভরতার ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় বৈদিক ধর্মের উত্থানের ফলে সমাজে সমরবাদের উত্থান ঘটেছিল। কিন্তু ভারতবর্ষের ভূ-প্রাকৃতিক বাস্তবতা যুদ্ধ ও বলপ্রযোগের মাধ্যমে বৃহত্তর সমাজ নির্মাণের উপযোগী ছিল না। এখানে রযেছে পলায়ন ও আশ্রয়ের জন্য চতুর্দিকে অরণ্য এবং পাহাড়-পর্বত। সুতরাং অন্যত্র সভ্যতা নির্মাণের জন্য বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধকে এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য উপজাতির মানুষদেরকে দাস বা বলপূর্বক অধীনস্থ করে তাদের শ্রমশক্তি নিঙ্ড়ানোর উপর যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব ছিল সেটা এখানে সেভাবে সম্ভব ছিল না। ফলে এখানে বৃহত্তর সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণে কৌশলই হয়েছে মুখ্য উপাদান। গাঙ্গেয় অববাহিকাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের উত্থানের পিছনে আমরা এই বাস্তবতার প্রতিফলন দেখি।

সুতরাং ব্রাহ্মণ শ্রেণী গাঙ্গেয় অববাহিকায় বসতি স্থাপনের পর ধীর গতিতে এবং প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে কৃষির প্রাথমিক পর্যায়ে অবস্থিত স্থানীয় বিভিন্ন সমাজ বা উপজাতি এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন আদিম উপজাতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন কৃষি সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মের বহু উপাদানকে নিজ সমাজের অন্তর্ভুক্ত করেছে এভাবে ব্যাখ্যা করলে হিন্দু সমাজের উত্থানকে বুঝতে সুবিধা হয়। সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণরা উপজাতীয় সমাজের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যকে নিজ সমাজের অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেটা হচ্ছে উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য বোধ। এভাবে আদিম খাদ্য সংগ্রাহক এবং পশু শিকারী উপজাতি বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ‘জাতি’ বা চলতি কথায় ‘জাত’ তথা বর্ণজাতিতে পরিণত হয়ে নিজ উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য রক্ষার উপায় দেখতে পায়। বেশীর ভাগ আদিম উপজাতির মানুষই হল অপবিত্র বর্ণজাতিতে পরিণত। এবং তাদের পেশা পরিবর্তনও হল ধর্মীয় বিধানে অপরিবর্তনীয় এবং নিষিদ্ধ। আদিম মানুষের মূঢ়তা, সরলতা ও অন্ধবিশ্বাস হল ব্রাহ্মণদের নূতন সমাজ নির্মাণের মূল হাতিয়ার। যেহেতু এই অঞ্চল সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল সেহেতু এটা যে খাদ্য সংগ্রাহক এবং পশু শিকারী উপজাতিসমূহের দ্বারা খুব বেশী পরিমাণে অধ্যুষিত ছিল সেটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয়।

বিভিন্ন আদিম খাদ্য সংগ্রাহক ও শিকারী যাযাবর উপজাতি যখন সহজে খাদ্যলাভ এবং স্থিতিশীল ও নিশ্চিত জীবনের আশায় কৃষিসমাজে প্রবেশ করেছে তখন ব্রাহ্মণরা তাদের উপজাতীয় অনেক বৈশিষ্ট্য, প্রথা এবং বিশ্বাসকে রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। আদিম উপজাতীয় সমাজে উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ খুবই নির্ধারক একটি উপাদান। বর্ণজাতিগত বিভাজনে সেই উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষিত হল। সুতরাং বর্ণজাতির কাঠামোতে আদিম উপজাতির আপত্তি থাকবার কারণ ছিল না। তবে সমাজ কাঠামোর নিম্ন স্তরে অবস্থানকে মেনে নিতে কখনও আপত্তি হলেও তার জন্য ছিল ধর্মের সান্ত্বনা। এর জন্য আত্মার ধারণাকে কেন্দ্র করে তৈরী করা হল জন্মান্তরবাদ এবং কর্মফলবাদের তত্ত্ব বা ধারণা। গতজন্মের পাপের ফলে এই জন্মে নিম্ন ও তুলনায় অপবিত্র বর্ণজাতিতে বা ‘জাতে’ জন্ম হলেও পুণ্যকর্মের ফলে আগামী জন্মে উচ্চ বর্ণেও জন্ম সম্ভব। ধর্মের এমন ব্যাখ্যা থাকতে আদিম মানুষকে মানানো অসম্ভব কী? এভাবে সমাজের পশ্চাৎপদ চিন্তা এবং আদিমতার সামাজিক ভিত্তির উপর ব্রাহ্মণরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যের সৌধ নির্মাণ করল।

হিন্দু সমাজ নির্মাণকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় যে, অন্যত্র প্রায় সকল বৃহত্তর সমাজ নির্মাণে যুদ্ধাস্ত্র যেখানে প্রধান হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে সেখানে হিন্দু সমাজ নির্মাণে প্রধান হাতিয়ার হয়েছে কৌশল। শুনতে রূঢ় হলেও বলতে হবে এই কৌশলের মূল কথা হল প্রতারণা তথা মিথ্যাচার, ধাপ্পা। ধর্মের নামে অলৌকিক ও অদৃশ্য বিভিন্ন দেবতা বা শক্তির নামে ব্রাহ্মণরা অবলীলাক্রমে বিভিন্ন গালগল্প তৈরী করে আদিম মানুষদের প্রভাবিত করে তাদেরকে নূতন ধর্মীয় ব্যবস্থার অন্তুর্ভুক্ত করেছে। অন্যান্য সভ্যতায় বৃহত্তর সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনে সাধারণত অস্ত্রধারী সেনাবাহিনী বা সামরিক শক্তি যে ভূমিকা পালন করেছে এখানে ধর্ম তথা অন্ধবিশ্বাসের হাতিয়ার নিয়ে পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণ বর্ণজাতি বৃহ্ত্তর সমাজ গঠনে অনেকাংশে সেই ভূমিকা পালন করেছে। ব্রাহ্মণরা যুদ্ধ করে নাই। যুদ্ধ করলে তারা ব্রাহ্মণ থাকতে পারত না। কারণ অস্ত্র ধারণ ধর্মীয় বিধানেই তারা নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু ধর্মের মাধ্যমে সমাজ গঠন এবং নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা রাষ্ট্র পরিচালনার উপরেও তাদের প্রভাব এবং এমনকি আধিপত্য বজায় রাখত। ফলে ক্ষত্রিয় রাজাদের মন্ত্রী হিসাবে তাদের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে জনগণের নিকট ক্ষত্রিয় রাজাদের রাষ্ট্র শাসনের গ্রহণযোগ্যতা তথা বৈধতা লাভের পূর্বশর্ত। আর এই জনগণ ছিল কৃষি ভিত্তিক সভ্য সমাজের ভিতরে অবস্থিত মর্মগতভাবে আদিম উপজাতি সমাজের চেতনা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী।

এভাবে সিন্ধু সভ্যতার পতন-পরবর্তীকালে গাঙ্গেয় উপত্যকাকে কেন্দ্র করে নূতন সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণে আমরা যে দুই শক্তিকে প্রাধান্যে দেখতে পাই তারা হচ্ছে প্রথমত ব্রাহ্মণ এবং দ্বিতীয়ত আদিম উপজাতি যারা কৃষি সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুতরাং এভাবেও বলা যায় হিন্দু ধর্মের উত্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্ম এবং সেই সঙ্গে আদিম উপজাতিবাদের সমন্বিত উত্থান। কিংবা এভাবেও বলা যায়, হিন্দু ধর্ম হচ্ছে ব্রাহ্মণ এবং আদিম উপজাতির ঐক্যের ফসল। ফলে এখানে একই সঙ্গে আছে সভ্যতা এবং আদিম বন্যতার শুধু সহাবস্থান নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পর বিজড়ন।

হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বর্ণজাতিভেদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা। আর এই বর্ণজাতিভেদ সমাজকে স্থায়ীভাবে অজস্র ভাগে বিভক্ত করায় বৃহত্তর সমাজ হয় স্থবিরপ্রায় এবং অশক্ত বা দুর্বল। ফলে বাহিরের প্রবল শক্তির আক্রমণের মুখে প্রায়শ অধীনস্থ হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় এই সমাজে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা রক্ষায় বাহিরের শক্তির অনুপ্রবেশ এবং হস্তক্ষেপ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী থেকে এই বাস্তবতা দেখতে পাই। তবু আরও বেশ কিছু কাল ভারতবর্ষের প্রতিরোধের শক্তি কম-বেশী টিকে ছিল। কারণ তখনও হিন্দু ধর্ম নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। আরও অনেক কাল পর্যন্ত কিছুটা জোরালোভাবে টিকেছিল বৌদ্ধধর্ম। সেই সঙ্গে ছিল ব্রাহ্মণ ও বর্ণজাতিভেদ বিরোধী এবং সেই সঙ্গে নিরীশ্বরবাদী বিভিন্ন দার্শনিক এবং সামাজিক আন্দোলন। যেমন সাংখ্য, চার্বাক বা লোকায়ত ইত্যাদি। বুঝা যায় নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধধর্মসহ এই সকল আন্দোলন ছিল মূলত সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক ও আদর্শিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা।

বর্ণজাতিভেদের বিপরীতে ভারতীয় সমাজকে বৃহত্তর ঐক্যদানের শেষ উল্লেখ্য শান্তিপূর্ণ প্রচেষ্টা হিসাবে আমরা বৌদ্ধধর্মের কথা বলতে পারি। হাজার বছরেরও বেশী এক দীর্ঘ সময় বৌদ্ধ ধর্ম এবং ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা হিন্দু ধর্মের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু এই প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্ম হেরে যায়। এই হেরে যাওয়ায় হিন্দুদের দিক থেকে বলপ্রয়োগের তেমন কোনও ভূমিকা ছিল না। কারণ সেই ধরনের কোনও দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং এমনটাই মনে হয় যে, বৌদ্ধ সমাজ যখন কালক্রমে পার্শ্ববর্তী হিন্দু সমাজের প্রভাবে বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হল তখন তা হিন্দু সমাজ এবং ধর্মেরও অন্তর্ভুক্ত হল। এটা লক্ষ্যণীয় যে, বৌদ্ধধর্ম গ্রাম সমাজের তুলনায় নাগরিক সমাজে বেশী জনপ্রিয় ছিল।

এটা আমরা ধারণা করতে পারি, সিন্ধু সভ্যতার শান্তিনির্ভরতার ঐতিহ্য বৌদ্ধ ধর্ম ধারণ করেছে। সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের প্রায় দেড় হাজার বছর পর যেন সিন্ধু সভ্যতার শান্তিনির্ভরতার ভাবপ্রেরণা বৌদ্ধধর্মের অহিংসা নীতির মাধ্যমে নূতন করে বাঙ্ময় হয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধধর্ম আদিম উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতার চেতনা বিরোধী। তা বৃহত্তর ঐক্য এবং তুলনামূলকভাবে সমতার বন্ধনে সমাজকে ধরে রাখতে চায়। এভাবে তা বিভিন্ন উপজাতি ও জনগোষ্ঠীর মানুষদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে একটি বৃহত্তর সমাজে বিলীন করতে চায়। অনুমান করা যায় এটিও সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্য, যা বৌদ্ধধর্ম ধর্মীয় আবরণে হলেও তার ভিতরে ধারণ করেছে। এইখানে হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের যোজন যোজন দূরত্ব।

বলা যায় হিন্দু ধর্মের বিজয় ছিল আদিম উপজাতীয় এবং সেই সঙ্গে গ্রাম্য ভারতবর্ষের বিজয়। এই বিজয়ের সঙ্গে শুরু হল ভারতবর্ষের দীর্ঘ পরাধীনতার ইতিহাস। শক-হূন ইত্যাদি বহিরাক্রমণকারীদের উত্তরাধিকারী হিসাবে দেখা দিল মুসলিম আক্রমণকারীরা। মুসলিম আক্রমণকারীরা ছিল মূলত পুর্ববর্তী এই সকল যাযাবর এবং অর্ধযাযাবর আক্রমণকারীর ধর্মান্তরিত বংশধর। কিন্তু আরও অনেক সফল, আরও অনেক ধ্বংসাত্মক হল এই নব্য মুসলিম আক্রমণকারীদের অভিযান। ইসলাম পূর্ব বৌদ্ধ এবং হিন্দু রাজাদের শাসনাধীন ভারতবর্ষে যেটুকু সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ছিল সেসবের প্রায় সবই অতীতের বিস্মৃত অধ্যায়ে পরিণত হল। এর পূর্বেও যুদ্ধ ছিল। কিন্তু তার এমন ভয়াবহ রূপ বৈদেশিক আক্রমণের সময় ছাড়া ভারতবর্ষকে সাধারণত দেখতে হত না। প্রায় অব্যাহত যুদ্ধ, দাসত্বের ব্যাপক চর্চা, ধর্মের অজুহাতে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর উপর নির্বিচার আক্রমণ, ব্যাপক হারে নারী ধর্ষণ, বৃহদায়তনে লুণ্ঠন এসব বহিরাগত মুসলিম আক্রমণ ও শাসনের এক উল্লেখযোগ্য কাল জুড়ে ভারতবর্ষের জনগণকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে।

১১৯২ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ ঘোরী দিল্লী-আজমীরের রাজপুত রাজা পৃথ্বিরাজকে পরাজিত করে উত্তর ভারতে মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটান। মুসলিম শাসনামলে সুলতানী যুগ থেকে মোগল যুগ পর্যন্ত উপমহাদেশে যা কিছু বৃহৎ নির্মাণ হয়েছে তার প্রায় সবই সামরিক শাসকদের ভোগ-সম্ভোগের প্রয়োজনে। শাসকদের জন্য বিরাট বিরাট প্রাসাদ এবং কবর নির্মাণে বিপুল সম্পদ ব্যয় করা হয়েছে। জনগণের প্রয়োজন পূরণের বিবেচনা ছিল অধিকাংশ সময়ই খুব গৌণ একটি বিষয়। বহিরাগত হানাদারদের নিজেদের শাসন রক্ষার প্রয়োজনে যেটুকু করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিত প্রায় সময়ই তার বেশী কিছু করা হত না। আর ছিল বহিরাগত মুসলমানদের আগমনের অব্যাহত স্রোত, যারা যুদ্ধ জয় দ্বারা নূতন শাসক হত অথবা ভারতে আধিপত্যকারী মুসলিম শাসকদের সেনাবাহিনী অথবা বেসামরিক আমলাতন্ত্রে যোগ দিয়ে হত বিদ্যমান মুসলিম শাসক শ্রেণীর অংশ। দেশজ হতে কিংবা যে দেশে তারা বাস করছে তার জন্য মমতা বা আকর্ষণ জন্মাতে সময় লাগাটা ছিল স্বাভাবিক। ফলে লুণ্ঠনমূলক শাসন এবং তার আনুষঙ্গিক আচরণ এবং সংস্কৃতি অনুশীলন করা তাদের জন্য স্বাভাবিক ছিল। তবু তারা এ দেশে বাস করতে বাধ্য হত। ফলে এ দেশের সম্পদ আর যা-ই হোক যে ভূমি থেকে তারা আসত সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। ফলে সমস্ত অন্যায়-অনাচার এবং অত্যাচার সত্ত্বেও সেসবেরই একটা সীমাবদ্ধতা থাকা স্বাভাবিক ছিল এবং স্বাভাবিক নিয়মে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা ছিলও।

কিন্তু ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে এক নূতন হানাদার গোষ্ঠী বঙ্গ জয়ের মাধ্যমে ভারতভূমির দখল নিল। এরা হল ইংরেজ বা ব্রিটিশ। এরা এদের পূর্বসূরি মুসলিম হানাদারদের মত নিজ ভূমি পরিত্যাগ করে এ দেশে বসতি স্থাপন করল না। ফলে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করল এই উপমহাদেশ থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণে সম্পদ নিজেদের দেশ ইংল্যান্ড বা ব্রিটেনে নিয়ে যাবার উপর। এক অবিশ্বাস্য ধারাবাহিক লুণ্ঠন ও শোষণ এবং এই ধরনের লুণ্ঠন ও শোষণের উপযোগী শাসনের অধীনে প্রায় দুইশত বৎসর থাকল এই উপমহাদেশ। এই শাসনের প্রথম ধাক্কা সামলাতে হল বঙ্গকে। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিতে ১৭৭০ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গে যে মহাদুর্ভিক্ষ (বাংলা সনের হিসাবে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) হল তাতে ইংরেজদের হিসাব অনুযায়ীই বঙ্গের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মৃত্যুবরণ করে। তখন বঙ্গের জনসংখ্যা ছিল তিন কোটি। তার মধ্যে এক কোটি মানুষ প্রাণ হারায় ইংরেজদের সৃষ্টি এই দুর্ভিক্ষে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, বহিরাগত মুসলিম শাসন কিংবা আগ্রাসনের সমস্ত কাল জুড়ে একবারে একটি মাত্র গণহত্যায় এত বেশী সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর তথ্য আমরা পাই না। এদিক থেকে ব্যাপকায়তনে গণহত্যাকারী হিসাবে ব্রিটিশদেরকে অনন্যসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী বলা ছাড়া উপায় নাই।

যাইহোক, নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে এসবের জন্য বৈদিক ধর্মের উত্তরাধিকারী হিসাবে হিন্দু ধর্মের ভূমিকাকে দায়ী করা ছাড়া উপায় থাকে না। অসংখ্য বর্ণজাতি বা চলতি কথায় ‘জাতের’ ভিত্তিতে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে তা সমাজের ঐক্য এবং শক্তিকে খর্ব অথবা বিনষ্ট করে। এই ধর্ম অসম সম্পর্কের ভিত্তিতে অসংখ্য জাতের সমষ্টিস্বরূপ এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত করে যার মর্মে থাকে বিভাজন বা অনৈক্য। এই সমাজের ভিত্তিতে কিছু বিশ্বাস, অনুষ্ঠান এবং প্রথার অভিন্নতা বা ঐক্য থাকলেও এটাকে সমাজ না বলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন সমাজ সমষ্টি বলাই অধিকতর সমীচীন। সকলে ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে একটি বৃহত্তর সমাজ এবং কিছু অভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রতিটা ‘জাত’ বা বর্ণজাতি তথা গোষ্ঠী ভিন্ন। এমনকি ছোট ও বড়, পবিত্র ও অপবিত্র এমনভাবে চিহ্নিত ‘জাত’ বা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক শুধু যে নিষিদ্ধ তা-ই নয়, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে একত্র আহারও নিষিদ্ধ। যুগের প্রভাবে এবং যান্ত্রিক সভ্যতার গতিশীলতায় আহার-বিহারের সব বিধিনিষেধ সবার পক্ষে মানা সম্ভব না হলেও মনের ভিতরে সেসব বিধিনিষেধের প্রভাব রয়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা যে বিবাহ সম্পর্ক মানুষকে মানুষের সঙ্গে মিলাবার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করে সেখানে জাতের বিভাজন এই প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু করে রেখে সমাজকে কোনও সংহত সমাজই হতে দেয় না। যেখানে সমাজ গঠনই হয় না সেখানে রাষ্ট্র কিংবা জাতি গঠন হবে কী করে?

বস্তুত প্রতিটি জাত বা গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অজুহাত তুলে অনৈক্য রক্ষার উপরই এই সমাজে সবচেয়ে বেশী জোর দেওয়া হয়। অজস্র জাত এবং পাতের (আহার) বিভাজনে আবদ্ধ এই সমাজ প্রকৃতপক্ষে নিজেকে যে কোনও বৈদেশিক হামলা অথবা শাসনের সহজ শিকারে পরিণত করে। বস্তুত হিন্দু ধর্ম বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে দুর্লঙ্ঘ বাধা হয়ে থেকে রাষ্ট্র সাধনারও বিরোধী হয়ে দাঁড়ায়। এটা ঠিক না যে হিন্দু ধর্মের সংগঠক ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণী সমরবাদ বা যুদ্ধের বিরোধী। তবে তা বর্ণজাতিভেদমূলক ব্যবস্থার সাহায্যে যুদ্ধের শক্তি তথা সমরবাদকে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে সমাজকে বিভক্ত বা ছত্রভঙ্গ করে ফেলে। এই ছত্রভঙ্গ সমাজকে সহজেই পদানত করা যায় বলে বাইরের যে কোনও প্রবল শক্তি তাকে আক্রমণ করতে প্ররোচিত বা উৎসাহিত হতে পারে। অন্যদিকে, ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয় ছাড়া আর কোনও বর্ণের জন্য অস্ত্র ধারণ বা যুদ্ধ করা ধর্মত নিষিদ্ধ করে রাখে। এমন ব্যবস্থায় ক্ষত্রিয়ের বাইরে সমাজ প্রয়োজনেও অস্ত্র ধরবার অধিকার কিংবা শিক্ষা পায় না। আর এভাবে সামগ্রিকভাবে সমাজকে নিরস্ত্র ও যুদ্ধ বিমুখ করে হিন্দু ধর্ম রাষ্ট্র গঠন এবং রক্ষার বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে কাজ করে। সুতরাং হিন্দু ধর্মের উত্থান এবং নিরঙ্কুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতবর্ষের জন্য নিয়তি হয়েছে বৈদেশিক আগ্রাসন এবং শাসনের নিকট প্রায় অসহায় আত্মসমর্পণ। এটা ঠিক যে হিন্দু ধর্ম তার সমাজকে রক্ষা করতে পেরেছে বেশ কিছুটা পরিমাণে হলেও। তবে সেটা অপরিমেয় সামাজিক মূল্যের বিনিময়ে এবং রাষ্ট্র নির্মাণ বা রক্ষায় তার ব্যর্থতার বিনিময়ে। অথচ সিন্ধু সভ্যতার পতন কালে উদ্ভূত বৈদিক ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত আবেস্তান ধর্ম ভিন্ন অভিজ্ঞতা দান করে। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর এখান থেকে ইরানে অভিগমনের পর সেখানে তার আছে বৃহৎ রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্য গঠনের ইতিহাস। এটা ঠিক যে, শেষ পর্যন্ত ইসলামী আরবের আক্রমণ অভিযানের আঘাতে ইরানের সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে আবেস্তান ধর্মেরও পতন হয়েছে।

ইসলাম যেন হঠাৎ এক মহাপ্রলয়ের রূপ নিয়ে পৃথিবীর এক বিস্তীর্ণ ভূভাগের ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতাগুলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কোন্ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে প্রাচীন এবং ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতাগুলির জন্য এই রকম এক প্রলয়ঙ্করী ঘটনা পৃথিবীতে ঘটা সম্ভব হয়েছিল, তার ফলাফল কী ধরনের হয়েছিল সেটা ভিন্ন আলোচনা দাবী করে যা এই আলোচনার এখতিয়ার বহির্ভূত।

তবে এটা নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, শেষ পর্যন্ত খ্রীষ্টীয় ইউরোপ ইসলামের তরবারিকে প্রতিহত এবং পরাস্ত করে। এটাও নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত ভারতবর্ষ ইসলামের তরবারিকে মোকাবিলায় ব্যর্থ হলেও বৌদ্ধধর্ম অধ্যুষিত দেশগুলি ইসলামের অগ্রাভিযানকে মোকাবিলায় সাধারণত সমর্থ হয়েছে। ইসলাম সমুদ্র পথে আরব উপদ্বীপের তুলনায় নিকটবর্তী এবং ভারতের দক্ষিণে অবস্থিত বৌদ্ধ অধ্যুষিত দ্বীপ-রাষ্ট্র শ্রীলংকার দখল নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ শ্রীলংকা পার হয়ে আরও অনেক দূরবর্তী প্রধানত হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি অধ্যুষিত দ্বীপপুঞ্জ ইন্দোনেশিয়ার দখল নিতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু তা বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমার, থাইল্যান্ড কিংবা ইন্দোচীনের ভিযেৎনাম, কম্বোডিয়া, লাওসে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। একইভাবে তা প্রাচীন সভ্যতার অন্যতম লীলাভূমি চীনে প্রবেশ করতেও ব্যর্থ হয়েছে। এ কথা জানা যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে চীন যথেষ্ট পরিমাণে বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত দেশ ছিল। অর্থাৎ বুঝা যায় খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ এই দুই ধর্মের ভিতর এমন কিছু শক্তি আছে কিংবা এই দুই ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত সমাজগুলির ভিতর এমন কিছু শক্তি ছিল যা এইসব দেশকে ইসলামের আগ্রাসনকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল।

তবে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক সমতা এবং বৃহত্তর ঐক্য এবং শান্তিপ্রিয়তার ঐতিহ্য কিংবা ভাবপ্রেরণাকে তা ধর্মের আবরণে ধারণ করেছে। কিন্তু হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না। সিন্ধু সভ্যতা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে বৃহত্তর সমাজ নির্মাণের কিছু কলাকৌশল তা রপ্ত করে থাকলেও সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক সমতা এবং সংহতির চেতনা থেকে তার অবস্থান বহু দূরবর্তী। সুতরাং রাষ্ট্র সাধনারও তা পরিপন্থী, যে কথা একটু আগেই বলেছি। এবং একই সঙ্গে উন্নত নগর চেতনারও তা পরিপন্থী। প্রকৃতপক্ষে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক এবং পশ্চাৎপদ, ভাগ্যনির্ভর ও ধর্মাচ্ছন্ন গ্রাম সমাজে মানুষের চেতনাকে ধরে রাখবার উপযোগী ধর্ম হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। তাই হিন্দু চেতনা আধুনিক সভ্যতা বিরোধী। এদিক থেকে ইসলাম ধর্ম থেকে হিন্দু ধর্ম মোটেই দূরবর্তী নয়। তবে ইসলাম উন্নত সভ্যতা এবং মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিরোধী হলেও রাষ্ট্র নির্মাণ বিরোধী নয়। বরং ধর্মের নামে তা বৃহৎ ও এককেন্দ্রিক সামরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আরবীকৃত একীভূত সমাজ প্রতিষ্ঠাকে অগ্রাধিকার দেয়। তবে এই সমাজের মর্মে আছে বর্বর ও যাযাবর আরব বেদুইন চেতনা।

কিন্তু হিন্দু ধর্ম শুধু উন্নত সভ্য চেতনার পরিপন্থী নয়, বরং সেই সঙ্গে বর্ণজাতি ভিত্তিক সামাজিক বিভক্তি ও অসমতার পূজারী হয়ে তা বৃহত্তর সমাজ ও জাতি গঠনের পথে দুর্লঙ্ঘ বাধা অর্পণ করে। এভাবে তা শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনকে খর্ব করে। ফলশ্রুতিতে তা যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষকে বৈদেশিক আক্রমণ ও আগ্রাসনের সহজ শিকারে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। এটা স্পষ্ট যে, হিন্দু ধর্ম ভারতবর্ষের বিভিন্ন দেশ এবং জাতি সমূহের দীর্ঘ পরদাসত্বের কারণ হয়েছে। সুতরাং হিন্দু ধর্মের উত্থানের সঙ্গে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক শক্তির পতন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

এটা নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্ম যতদিন কম-বেশী প্রবল বা শক্তিশালী ছিল ভারতবর্ষ ততদিন উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বহিরাক্রমণগুলিকে প্রতিহত করায় সফল হয়েছিল। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে হর্ষবর্ধনের (জন্ম ৫৯০ খ্রীঃ – মুত্যু ৬৪৭ খ্রীঃ) শাসনকাল (৬০৭ খ্রীঃ - ৬৪৭ খ্রীঃ) ছিল গৌরবদীপ্ত। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তার মৃত্যুর পর প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত ব্যাপী বিস্তৃত তার বৃহৎ সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। আসলে বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষয় এবং হিন্দু ধর্মের বিকাশ এবং প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কাল শুরু হয়েছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারতে হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য বিস্তারের ফল পেতে বেশী দেরী হয় নাই। বাগদাদের উমাইয়া খলীফার শাসনকালে আরব মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধুর হিন্দু রাজা দাহিরকে পরাজিত ও হত্যা করেন। সিন্ধু এবং পাঞ্জাবের কিছু অঞ্চলে বেশ কিছু কাল আরব মুসলিম শাসন টিকেছিল। তবে ভারতবর্ষে মুসলিম অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে আরও সময় লাগে।

আরও কিছু কাল বৌদ্ধ ধর্ম যে যথেষ্ট শক্তি নিয়ে উত্তর ভারতে বিরাজমান ছিল সেটা বুঝা যায় বৌদ্ধ পাল সাম্রাজ্যের বিস্তার থেকে। বৃহৎ বঙ্গ বা বাংলাকে কেন্দ্র করে এক সময় তা উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং আসামসহ প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতে তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে। পাল রাজবংশের শাসন স্থায়ী হয়েছিল ৭৫০ খ্রীঃ থেকে ১১৭৪ খ্রীঃ পর্যন্ত মোটামুটি ৪২৪ বৎসর। তবে পাল রাজত্বের শেষ পর্যায়ে হিন্দু সেন রাজবংশের হাতে বাংলার রাষ্ট্র ক্ষমতা চলে যেতে থাকে। সেন রাজবংশের উত্থান একাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে ঘটতে থাকে। ক্রমে সেন রাজবংশ সমগ্র বাংলা থেকে পাল শাসনের অবসা্ন ঘটায়। সেন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সঙ্গে শুরু হয় বর্ণজাতি প্রথা এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কঠোর অনুশাসনসমূহ প্রতিষ্ঠার অভিযান। বুঝা যায় পাল রাজবংশের চূড়ান্ত পতনের পূর্বেই প্রজাসাধারণ হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বৌদ্ধদের হাত থেকে গোঁড়া হিন্দুদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনাকে এই সামাজিক বাস্তবতার রাজনৈতিক পরিণতি বলেই মনে হয়। এরপর মুসলিম বহিরাক্রমণকারীদের আর বেশী সময় লাগে নাই বঙ্গের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে। তুর্কী হানাদার বখতিয়ার খলজী আনুমানিক ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে রাজা লক্ষ্মণ সেনকে বিতাড়িত করে তার তৎকালীন রাজধানী নবদ্বীপ দখল করেন। তার সামান্য কিছু পূর্বে উত্তর ভারতে তুর্কী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বস্তুত ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষয় বা অবসান এবং পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাকে সহজেই বহিরাক্রমণকারীদের বিজয় এবং শাসন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত করা যায়। হিন্দু ধর্ম ও সমাজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বহিরাগতদের এই বিজয় এবং শাসনের প্রথম পর্যায়ের একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা জুড়ে ছিল প্রধানত তুর্কী ও মোগল বংশোদ্ভূত মুসলমান আক্রমণকারীরা, দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিল ব্রিটিশ আক্রমণকারীরা।

হিন্দু ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রাধান্য বিশিষ্ট আজকের ভারত-রাষ্ট্র যেটুকু অগ্রগতি অর্জন করেছে তা প্রকৃতপক্ষে সেখানকার জনগণ আধুনিক যুগ চেতনার প্রভাবে ধর্মের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদেরকে যতটুকু মুক্ত করতে পেরেছে তার ফল, এটা মোটেই হিন্দু ধর্মের প্রভাবের ফল কোনও অর্থেই নয়। বরং একটু খোলা মন নিয়ে দেখলেই বুঝা যাবে যে, সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উপর ধর্মের প্রভাব কিংবা নিয়ন্ত্রণ ভারতের অগ্রগতির পথে কত বড় বাধা অর্পণ করে রেখেছে। এটা ঠিক যে, যুগ ধারায় সবকিছুতেই কিছু না কিছু পরিবর্তন আসে। সুতরাং যুগের ধারায় হিন্দু ধর্মেও অতীত কালে স্থান ও কাল ভেদে যেমন অনেক পরিবর্তন এসেছিল তেমন বর্তমানেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সেসব পরিবর্তন হিন্দু ধর্মের মর্মবস্তুতে যেমন কোনও পরিবর্তন অতীতে ঘটাতে পারে নাই তেমন বর্তমানেও সেই ধরনের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়।

এমনিতেই আজকের আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে অলৌকিকতা নির্ভর যে কোনও ধর্মবিশ্বাস সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। তার উপর হিন্দু ধর্মের মত শুধু মধ্যযুগীয় নয়, উপরন্তু আদিম যুগীয় এবং সামাজিক অসাম্য ও বিভক্তির ধ্যান-ধারণা ভিত্তিক ধর্মবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে রেখে কোনও জনগোষ্ঠীর পক্ষেই তাদের সমাজকে যেমন সংহত রূপ দান করা সম্ভব নয় তেমন তাদের রাষ্ট্রকেও সংহত ও দৃঢ় ভিত্তি দান করার প্রশ্ন উঠে না।


রচনা – জুন-জুলাই, ২০১৮

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ