Banner
ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন : ফিরে দেখা — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ April 22, 2020, 12:00 AM, Hits: 1643

প্রথম অধ্যায়

সংক্ষিপ্ত এই আলোচনার শুরুতে এ কথা বলা উচিত হবে যে, ষাটের দশকে যে প্রজন্ম তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশ পূর্ব বাংলা কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের বুকে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি গড়েছিল সেই প্রজন্মের একজন হিসাবে এটা অনেকটা আমারও আত্মকথন।

এই আলোচনায় প্রথমে এটাও স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, পাকিস্তান কালে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য যে কোনও ধরনের স্বায়ত্তশাসনের রাজনীতি আর পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালীর জন্য জাতি পরিচয় ভিত্তিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই রাজনীতি। প্রথমটি হল পাকিস্তানের কাঠামোভুক্ত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবীভিত্তিক রাজনীতি। এর মর্মে আছে শুধু বাঙ্গালী মুসলমানের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা নয়, অধিকন্তু মুসলমান হিসাবে তার পাকিস্তান পরিচয় রক্ষারও আকাঙ্ক্ষা, সেই সঙ্গে সংখ্যাধিক্যের জোরে সমগ্র পাকিস্তানের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠারও সংগুপ্ত ইচ্ছা।

আর দ্বিতীয়টি হল পাকিস্তানের শুধু রাজনৈতিক কাঠামো নয়, অধিকন্তু পাকিস্তানের ধর্মীয় পরিচয়কে বাতিল করে ভাষাভিত্তিক জাতি পরিচয়কে ভিত্তি করে পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালীর জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। এই দ্বিতীয় রাজনীতির মর্মে আছে শুধু পাকিস্তানকে অস্বীকার নয়, অধিকন্তু পাকিস্তানের ইসলামী তথা মুসলিম পরিচয় ভিত্তিক রাষ্টতত্ত্ব বা রাষ্ট্রচিন্তাকেও প্রত্যাখ্যান। এটা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্ম তথা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান হয়ে দাাঁড়ায়।

রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্মকে প্রত্যাখ্যানের পিছনে যে বিষয়টি নির্ধারক হিসাবে কাজ করেছিল সেটি যে ছিল প্রকৃতপক্ষে ধর্মবিশ্বাসকেই প্রত্যাখ্যান সেই ঘটনাকেই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারতে হবে। আর তখন আমাদেরকে সেকালে এই ধরনের চিন্তার উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক বিস্ময়কর সত্যের সম্মুখীন হতে হয়।

আর সেই সত্যটি সে যুগে এ দেশে যে ঘটনার মধ্যে নিহিত ছিল সেটি শুধু বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা নয়, বরং সেই সঙ্গে সেকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রসারমাণ কম্যুনিস্ট আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের মতাদর্শ হিসাবে মার্কসবাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। মার্কসবাদ দর্শনগতভাবে বস্তুবাদে বিশ্বাসী, ফলে যে কোনও ধরনের ভাববাদ কিংবা অলৌকিক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস বিরোধী। আর তার ফলে মার্কসবাদ ভাববাদী দর্শন থেকে উদ্ভূত অলোকবাদী ধর্মবিশ্বাস-বিরোধীও হতে বাধ্য। এটা সে কালে ছাত্র-যুবদের মধ্যে যারা মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করত তাদেরকে সহজেই মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট করত। আবার যারা রাজনৈতিক কারণে মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হত তারাও ক্রমে তার প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস বিরোধী কিংবা ধর্মের প্রশ্নে সংশয়বাদী অথবা উদারবাদী হত।   

সে কালে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান কম্যুনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব এ দেশে পঞ্চাশের দশক হতেই অনুভূত হতে থাকে। ষাটের দশকে এসে এটি প্রবল রূপ নেয়। বিশেষত ষাটের দশকের ছাত্র সমাজের অগ্রণী এবং রাজনীতি সচেতন অংশ ব্যাপকভাবে মার্কসবাদী আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়। পরিণামে তাদের মধ্যে ধর্মমুক্ত বা ধর্মবিরোধী চিন্তা-চেতনার প্রসার ঘটতে থাকে, যেটাকে আমরা লোকবাদী বা জাগতিক চিন্তা-চেতনা বলতে পারি। তৎকালীন বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের এক বা দুই প্রজন্মে শিক্ষিত ও নাগরিক জীবনে উঠে আসা এই ছাত্র এবং তরুণদের মধ্যে লোকবাদী চেতনার বিস্তার ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

কারণ কেবল তার অল্প কিছুকাল পূর্ব থেকে কৃষিজীবী বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ আধুনিক শিক্ষার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেছে। ফলে তাদের সন্তানেরা আধুনিক শিক্ষালাভের প্রয়োজনে নদীবিধৌত ও নদীভাঙ্গনপ্রবণ এ দেশের অস্থিতিশীল ও পশ্চাৎপদ গ্রাম ও চরাঞ্চলের জীবনের পটভূমিকে পিছনে ফেলে এই প্রথম আধুনিক ও স্থিতিশীল নাগরিক জীবনে আসতে শুরু করেছে। এদের গ্রামীণ পিতা-পিতামহদের দৃষ্টিতে আধুনিক শিক্ষালাভের মাধ্যমে এরা তৈরী হচ্ছিল ভবিষ্যতের নেতা এবং শাসক-প্রশাসক হিসাবে। সেই আগামী কালের কাঙ্ক্ষিত কিংবা কল্পিত নেতা এবং শাসক-প্রশাসকদের একটা উল্লেখযোগ্য এবং এক অর্থে সবচেয়ে মেধাবী অংশ যখন কম্যুনিস্ট হতে থাকল তখন তার সামগ্রিক প্রভাব সমাজ জীবনে কতখানি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।

এই ছাত্র-তরুণরা তাদের পিতা-পিতামহদের ধর্মবিশ্বাস বিরোধী হিসাবে বেড়ে উঠল। এই বাস্তবতা তাদেরকে সহজেই পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক তথা ইসলামী পরিচয়ের বাইরে একটা বিকল্প এবং ধর্মমুক্ত পরিচয় খুঁজতে বাধ্য করল। এই পরিচয় তাদেরকে ধর্মবিশ্বাস ভিত্তিক পাকিস্তানী জাতি পরিচয়ের বিপরীতে বাঙ্গালী জাতি পরিচয়ের জায়গায় নিয়ে গেল। অবশ্যই এর পিছনে ভাষা আন্দোলন এবং পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর জাতিগত বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙ্গালী মুসলিমের ক্ষোভের ভূমিকাও ছিল। কিন্তু সেটা পাকিস্তানের ভিতর বড় জোর বাঙ্গালী মুসলিমদের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারত। সেটা ধর্মীয় পরিচয়মুক্ত বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তাকে জন্ম দিবে কেন? আর এখানেই আসে বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ এবং সেই সঙ্গে সে কালে কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী রাজনীতির প্রভাবের ভূমিকা। একদিকে, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতি-পরিচয়ের জাগরণ, অপর দিকে, নিরীশ্বরবাদী কিংবা ধর্মবিশ্বাস-মুক্ত দর্শন ও মার্কসবাদী রাজনীতির প্রভাব সম্মিলিত হয়ে সেকালে ধর্ম-পরিচয় মুক্ত বাঙ্গালী জাতি চেতনার বিকাশকে অনিবার্য করেছিল।  

প্রকৃতপক্ষে ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগ ছিল তরুণ প্রজন্মের চেতনার উত্তরণের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ঘটনা। কথাটা সবার জন্য প্রযোজ্য না হতে পারে। কিন্তু ঐ প্রজন্মের অগ্রণী অংশের মধ্যে ধর্মমুক্ত চেতনার বিস্তার ছিল একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অবশ্য ঘটনাটা যদি ‍শুধু বুদ্ধিচর্চার জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকত তবে কী হত? তাতে হয়ত তারা গণ-আন্দোলন বিচ্ছিন্ন বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকত। কিন্তু তা হয় নাই। একদিকে যেমন ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে তারা সেকালে তাদের নিকট ধর্মমুক্ত দর্শন হিসাবে পরিচিত মার্কসবাদে আস্থা অর্পণ করেছিল, অপর দিকে তেমন এই দর্শনভিত্তিক রাজনীতির প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিল।

বিশেষত পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যমূলক বিশ্বব্যবস্থার অংশ হিসাবে বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং ধর্মের অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সে কালে এই প্রজন্মের অগ্রণী অংশের নিকট মার্কসবাদ একমাত্র আদর্শ হিসাবে উপস্থিত হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিক থেকে শুরু করে ষাটের দশকের পুরাটা কাল জুড়ে আমার প্রজন্মের এক বড় কিংবা নির্ধারক অংশের ক্ষেত্রে এই ইতিহাস কম আর বেশী প্রযোজ্য। বিশেষত ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত আইয়ুবের সামরিক ও আধাসামরিক শাসনের অধীনে দশ বৎসরাধিক কালের বেশীর ভাগটাই ছিল এই প্রজন্মের উত্থানের শ্রেষ্ঠ সময়। এদের সবাই হয়ত মুক্ত বু্দ্ধিচর্চার পরিণতিতে ধর্মবিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্বক লোকবাদী হয়ে তার পর একই সঙ্গে লোকবাদী এবং সমাজ বিপ্লবের একমাত্র পরিচিত আদর্শ হিসাবে মার্কসবাদ গ্রহণ করত না, বরং হয়ত উল্টাটা হত। অর্থাৎ আগে হয়ত মার্কসবাদকে গ্রহণ করত তারপর তার প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত হত। অবশ্য একটা অংশ রয়ে যেত ধর্মের প্রশ্নে সংশয়বাদী কিংবা ধর্মের প্রশ্নে হত উদার মতাবলম্বী। যেটাই হোক, সে যুগে বিশেষত বিগত শতাব্দীর ষাটের দশক ছিল ধর্মমুক্ত চেতনার প্রভাবে এ দেশে লোকবাদী বাঙ্গালী চেতনার জাগরণের এক মাহেন্দ্র ক্ষণ।

সুতরাং এটাই সত্য যে, এ দেশে এই মাহেন্দ্র ক্ষণের জন্মে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল মার্কসবাদ কিংবা কম্যুনিস্ট আদর্শ। এর ফলে লোকবাদ কিংবা মুক্তচিন্তার চর্চা কিশোর ও তরুণদের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশকে সমাজ-পরিবর্তনের সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কহীন বুদ্ধিচর্চায় সীমাবদ্ধ না রেখে টেনে নিতে পেরেছিল ব্যাপক জনগণ সম্পর্কিত বিভিন্নমুখী আন্দোলনের কর্মকাণ্ডে। এই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, সে কালে কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলেও ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের মাধ্যমে তা জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখত। এ ছাড়া ছিল ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকসহ বিভিন্ন ধরনের গণ-সংগঠন যেগুলির মাধ্যমে কম্যুনিস্ট পার্টি গোপন থাকলেও প্রকাশ্যে তার সক্রিয় ভূমিকা রাখত। বিশেষত সে কালে ন্যাপ এবং গোপন কম্যুনিস্ট পার্টি দ্বারা প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ সারা দেশব্যাপী একটি প্রবল গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাদের প্রভাবে মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্র দ্বারা জনগণেরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রভাবিত হয়েছিল। এভাবে এই প্রজন্ম সে কালে শুধু নিজেরা ধর্মমুক্ত হয় নাই, বরং বাঙ্গালী জাতির সামনেও একটি আধুনিক, শিল্পোন্নত এবং ধর্মমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন উপস্থিত করেছিল। এই চেতনার গতিধারায় পাকিস্তান কালের শেষ পর্যায়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতি সামনে উঠে আসে।

অবশ্য রাজনৈতিক আন্দোলনের একটা পর্যায় পর্যন্ত পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবী সমগ্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সেটা স্বাভাবিকও ছিল। কারণ জনচেতনা পাকিস্তান ভাঙ্গার রাজনীতি গ্রহণের জন্য অনেক দিন পর্যন্ত প্রস্তুত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ তারিখের মধ্যরাতে পাক সেনার আক্রমণ অভিযান শুরুর পূর্ব পর্যন্ত সাধারণ জনমত পাকিস্তান ভাঙ্গার পক্ষে ছিল না। সেই অবস্থায় তরুণ প্রজন্মের চিন্তায় যে লক্ষ্যই থাকুক জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে থাকবার প্রয়োজনে তাদেরকে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দাবীকেই সামনে তুলে ধরতে হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার দাবী ধীর গতিতে হলেও বেগবান হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকে স্বাধীন পূর্ব বাংলার ধ্বনি ক্রমে জোরদার হয়ে উঠতে থাকে। প্রথমে স্বায়ত্তশাসন এবং তারপর স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম তাদের রাজনীতির প্রসার ঘটায়। স্বাভাবিকভাবে এই রাজনীতির মর্মে ছিল সেই কালের বাস্তবতায় মার্কসবাদ।

এটা ঠিক যে, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ক্রমে মার্কসবাদ এবং সেই সঙ্গে কম্যুনিস্ট আন্দোলন বা রাজনীতিরও অনেক ভ্রান্তি এবং সীমাবদ্ধতা ধরা পড়েছে। বিশেষত আমি এটা বুঝেছি যে, মুসলিম সমাজের সমস্যা বুঝবার ক্ষেত্রে মার্কসবাদী শ্রেণীতত্ত্ব এবং বিশ্লেষণ ছিল এক বিরাট ভুল এবং সর্বোপরি নিদারুণ এবং আত্মঘাতী ভুল ছিল শ্রমজীবী নির্ভর গণ-বিপ্লবের চিন্তা। কিন্তু সেটাও তো আমাদেরকে একটা প্রয়োগ-পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বুঝতে হত। যে সমাজে আধুনিক কালে যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে সবই হয়েছে অমুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্রের অধীনতায় অথবা চাপে এবং আজ অবধি নিজেদের উদ্যোগে সমাজ বিপ্লব হয় নাই সেই সমাজের বিপ্লবের সঠিক তত্ত্ব কি মাঠ পর্যায়ের বিপ্লবী অনুশীলন বা চর্চা ছাড়া বেরিয়ে আসে?

আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথ প্রদর্শক আধুনিক ইউরোপ। সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণের ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় আবদ্ধ আমাদের মত দেশগুলির বিপ্লবের জন্য আধুনিক ইউরোপ থেকে আসা একটি তত্ত্বকে অবলম্বন করা ছাড়া আমরা কীভাবে পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক শাসন-শোষণের ধারাবাহিকতায় থাকা আমাদের দেশকে মুক্ত করার পথে নিতে পারতাম? অন্যদিকে, ইসলামের মত এক ভয়ঙ্কর দাসত্বমূলক ধর্মের শৃঙ্খল থেকে সমাজ চেতনাকে মুক্ত করে যুক্তি ও লোকবাদের পথে নেওয়ার জন্য সে কালে আমরা আর কোন্ আদর্শকে আমাদের সামনে পেতে পারতাম? সুতরাং নিজস্ব উদ্যোগে সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা নিতে চাইলে সে কালের বাস্তবতায় মার্কসবাদের বিকল্প আর কিছু আমাদের সামনে ছিল না। বিপ্লবের নিজস্ব সঠিক তত্ত্ব গড়তে চাইলেই তো গড়া যায় না। বিশেষত মুসলিম পৃথিবীতে সফল সমাজ-বিপ্লবের কোনও অভিজ্ঞতাই আমাদের সামনে সেদিন যেমন ছিল না আজও তেমন নাই। যে কথা একটু আগেই বলেছি তার পুনরুক্তি করে বলি আজ অবধি কোনও মুসলিম সমাজকে নিজস্ব উদ্যোগ ও নেতৃত্বে ইসলাম ধর্ম থেকে মুক্ত করে একটা লোকবাদী ও যুক্তিবাদী সমাজে পরিণত করা যায় নাই। আমাদের মত বহু সুসলিম দেশে বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সেটা সম্ভব হয় নাই। সমস্যাটা শুধু মার্কসবাদের নয়। এটা ইউরোপ থেকে আবির্ভূত সকল জ্ঞানতত্ত্বেরও। কারণ ইসলামের সমাজ ইউরোপের সমাজ থেকে ভিন্ন। ফলে তার সমস্যাও ইউরোপের সমাজের সমস্যা থেকে ভিন্ন।

ইউরোপের পটভূমিতে আছে খ্রীষ্টধর্ম। খ্রীষ্টধর্ম বহু বিষয়েই ইসলাম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ ছাড়া ইউরোপের অনেক ঐতিহাসিক ও সামাজিক বাস্তবতা মুসলিম পৃথিবীর বাস্তবতা থেকে ভিন্ন। ফলে ইউরোপের বহু তত্ত্বই মুসলিম সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়। এখানে আমি বিস্তারিত আলোচনা করব না। তবে এক কথায় বলব যে মুসলিম সমাজের মূল সমস্যা ইসলামে নিহিত। এখানে আধুনিক, সভ্য এবং গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা ধর্ম, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইসলাম ধর্ম। ফলে ইসলাম থেকে মানুষ এবং সমাজকে মুক্ত করাই সমাজ বিপ্লবের সামনে সবচেয়ে বড় করণীয়। সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী ব্যবস্থা থেকে মুক্তির বিপ্লব ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবের সঙ্গে শুধু সংযুক্ত নয়, উপরন্তু তার উপর নির্ভরশীল।

এ কথা বুঝতে হবে যে, যে কোনও মুসলিম সমাজে বিপ্লব সম্পন্ন করতে হলে ইসলামকে বুঝাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম সাধারণ মুসলিমকে এমনইভাবে ধর্মান্ধ এবং ধর্মীয় প্রশ্নে আক্রমণাত্মক করে যে এতকাল ইসলাম সংক্রান্ত কোনও ধরনের নির্মোহ আলোচনাই মুসলিম সমাজে থেকে করা যেত না। সুতরাং ধর্মীয় প্রশ্নে একটা সহনশীল ও উদার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বড় জোর মার্কসবাদী দর্শনের মত দর্শন বা রাজনীতির আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারত। কিন্তু মার্কসবাদ ধর্মবিশ্বাস মুক্ত হওয়ায় সেটা নিয়ে অগ্রসর হতে গিয়েও ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আফগানিস্তানের মত অনেক দেশে লক্ষ লক্ষ শুধু নয়, অধিকন্তু মিলিয়ন মিলিয়ন কম্যুনিস্টকে প্রাণ দিতে হয়েছে এবং কম্যুনিস্ট পার্টিগুলির সদস্যদের সঙ্গে নানানভাবে সম্পৃক্ত আরও বিপুলতর সংখ্যক মানুষকে অপরিমেয় মূল্য দিতে হয়েছে। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে কম্যুনিস্ট নিধনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের ভূমিকা। পাশ্চাত্য এ ক্ষেত্রে ইসলামের সহায়ক হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিল এতকাল।

কারণ মুসলিম পৃথিবীতে পাশ্চাত্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা রক্ষায় ইসলামই ছিল পাশ্চাত্যের জন্য সবচাইতে সহায়ক ভাবাদর্শ। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পরবর্তী বিশ্ব-পরিস্থিতিতে একদিকে পাশ্চাত্যে অভিবাসী মুসলিমদের দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি, অপরদিকে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান জিহাদী কর্মকাণ্ডের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্য আর পূর্বের মত ইসলামের পৃষ্ঠপোষক ভূমিকায় থাকতে পারছে না। এটা ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবে মুসলিম বিশ্বের সামনে নূতন সুযোগ উপস্থিত করেছে।

অন্যদিকে ইসলামের অভূতপূর্ব এবং ভয়ঙ্কর শত্রু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে ইন্টারনেট বা আন্তর্জাল। ইসলাম সম্পর্কে যে যুক্তিনির্ভর আলোচনা-সমালোচনা এতকাল মুসলিম সমাজে অকল্পনীয় ছিল সেটা এখন আর কোনও বিশেষ ঘটনাই হয়ে থাকছে না। ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে যে কোনও মানুষের পক্ষেই এখন ইসলাম সম্পর্কিত যে কোনও ধরনের আলোচনাই পড়া বা শুনা সম্ভব। এভাবে চৌদ্দশত বৎসর ধরে মুসলিম সমাজে যে ধর্মের ক্ষতিকর দিকগুলি সম্পর্কে সাধারণের পক্ষে কোনও কিছু জানাই সম্ভব ছিল না এখন আর কোনও ভয় দিয়েই সেগুলিকে আড়াল করা সম্ভব না।   

 

দ্বিতীয় অধ্যায়

যে আলোচনায় ছিলাম সেই আলোচনায় ফিরে বলি, পাকিস্তান কালে এ দেশে লোকবাদী তথা ধর্মমুক্ত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশের মূল উৎস হিসাবে কাজ করেছিল লোকবাদী তথা ধর্মমুক্ত রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে মার্কসবাদ। কিন্তু এটা শুধু তত্ত্বগত বা বিশুদ্ধ দর্শনের বিষয় ছিল না। সে কালে এই দর্শনের বস্তুগত শক্তিভিত্তি হিসাবে কাজ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনসহ আরও বহু কম্যুনিস্ট দেশ এবং বিশেষত সোভিয়েতের প্রভাবে সারাবিশ্বে দ্রুত প্রসারমান কম্যুনিস্ট আন্দোলন। ফলে একদিকে পাশ্চাত্য নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্যের মোকাবিলায় আমাদের মত দেশগুলির জন্য যেমন একদিকে ছিল একটা বিরাট প্রেরণার উৎস হিসাবে এইসব দেশ এবং বিশ্ব কম্যুনিস্ট আন্দোলন, অপর দিকে তেমন ইসলাম ধর্মের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী রূপের বিপরীতে আদর্শিক ও রাজনৈতিক প্রেরণা স্বরূপ ছিল মার্কসবাদ।

অবশ্য অনেক কম্যুনিস্ট যে ইসলামের সমস্যাকে সঠিকভাবে ধরতে পারত তা না। আসলে তারা সাধারণভাবে ধর্মের সমস্যাই বুঝতে পারত না। তারা মনে করত যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলেই ধর্মের সমস্যার সমাধান হবে। ফলে এমনিতেই একটা লোকবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। এটা হল ইউরোপীয় অভিজ্ঞতা দিয়ে মুসলিম সমাজকে বুঝবার চেষ্টার ফল। কিংবা এটা ছিল মার্কসবাদের অর্থনীতি-নির্ভর যান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রভাব। যেটাই হোক, সে কালে এ ছাড়া কম্যুনিস্টদের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব ছিল না। কারণ বিশ্বপরিস্থিতি মুসলিম সমাজে সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে ছিল না। এর জন্য পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইসলামের এক ধরনের ঐক্য যেটা ছিল সেটার অবসান যেমন দরকার ছিল তেমন ঘরে ঘরে এবং জনে জনে ইসলামের সত্য পৌঁছাবার জন্য ইন্টারনেট উদ্ভাবনেরও প্রয়োজন ছিল।

এটা বুঝা অত্যাবশ্যক যে, যে সমাজগুলি সমাজবিপ্লবের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগীয় ব্যবস্থা থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে ক্ষুদ্র দেশ আলবেনিয়া বাদে ইউরোপ ও এশিয়ার সেই সকল দেশেরই পটভূমিতে ছিল খ্রীষ্ট অথবা বৌদ্ধ ধর্ম। কিন্তু এই দুই ধর্মের উত্থান সম্পূর্ণ রূপে শান্তিপূর্ণ রূপে এবং এগুলি বিকাশ লাভ করেছিল রাষ্ট্র থেকে স্বতন্ত্রভাবে। কিন্তু ইসলামের উত্থান, বিকাশ ও বিস্তার মূলত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি হাতে নিয়ে। ইসলাম একই সঙ্গে রাজনৈতিক-সামরিক ধর্ম। অথচ জন্ম ও বিকাশ প্রক্রিয়ার দিক থেকে খ্রীষ্টান কিংবা বৌদ্ধ ধর্ম মূলত অরাজনৈতিক ও অসামরিক। শুধু তা-ই নয়, ইসলামের অনেক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ খ্রীষ্টীয় অথবা বৌদ্ধ রীতিনীতি ও মূল্যবোধ থেকে ভিন্ন। সুতরাং খ্রীষ্টান কিংবা বৌদ্ধ সমাজে অনুসৃত বিপ্লবী কর্মপদ্ধতির অন্ধ অনুশীলন মুসলিম সমাজে ব্যর্থতা ডেকে এনেছে। ইসলামের বিকাশ প্রক্রিয়া সাধারণ মুসলিমদেরকে ধর্মের প্রশ্নে ভয়ঙ্কর রকম উগ্র ও আক্রমণাত্মক যে করে শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু তাদের শাসক শ্রেণী কিংবা উচ্চবর্গের প্রতি অন্ধ অনুগত করে। সুতরাং একদিকে মোল্লা অপরদিকে উচ্চবর্গ এই উভয় শ্রেণী এবং অপর দিকে এই উভয় শ্রেণী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত জনগণের ব্যাপক গরিষ্ঠ অংশের বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে কম্যুনিস্টদের সাফল্য লাভের জায়গা থাকে না।  

ইসলামী সমাজে কম্যুনিস্ট রাজনীতির ব্যর্থতার একটা খুব বড় কারণ শুধু মার্কসবাদের ধর্ম সংক্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে জনগণের বিরূপতা নয়, অধিকন্তু সমাজ বিপ্লবের প্রধান বাহিনী হিসাবে শ্রমিক এবং শ্রমজীবী জনগণ সম্পর্কে ধারণাও। ইসলামী সমাজে উপর তলায় তথা উচ্চবর্গের মধ্যে পাশ্চাত্য প্রভাব এবং শিক্ষার কারণে তবু কিছু আধুনিক যুগোপযোগী তথা প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার আশ্রয়-প্রশ্রয় সম্ভব। কিন্তু নীচ তলার আমজনতা ধর্মের প্রভাবে ভয়ঙ্করভাবে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। মোল্লারা কুরআন-হাদীসসহ বিভিন্ন ইসলামী শাস্ত্র থেকে অবিরাম তাদের মনোজগৎকে নির্মাণ করে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা সৎ এবং অকপট হলে স্বীকার করবেন যে ইসলামী শিক্ষা ও অনুশাসনের সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার মূল্যবোধসমূহের দ্বন্দ্ব ও বিরোধ কতটা প্রবল। এই অবস্থায় উপর তলার সমাজ ও রাষ্ট্র শাসকরা পাশ্চাত্যের অধীনস্থতায় থেকে ধর্মের প্রশ্নে কিছু আপোস করে চললেও আমজনতার মানসলোকে আদি ইসলামের হাতছানি থাকে অনেক প্রবল হয়ে, যার শিক্ষা তারা অনবরত পায় মোল্লাদের নিকট থেকে। অথচ কম্যুনিস্টরা এই আমজনতা কিংবা শ্রমজীবী মানুষকেই বিপ্লবের মূল বাহিনী হিসাবে কল্পনা করে। ফলে তারা শ্রমিক এবং শ্রমজীবীদের উপর নির্ভর ক’রে তাদের বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করে। আসলে এ হল মন ও মননে যারা বিপ্লবের শত্রু তাদেরকে শুধু বিপ্লবের মিত্র নয়, বরং বিপ্লবের মূল বাহিনী হিসাবে কল্পনা করা। এ হল এক নিদারুণ আত্মঘাতী কর্মনীতি, যা এসেছে ইউরোপীয় শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত মার্কসবাদের নিকট থেকে। এ হল খ্রীষ্টীয় পটভূমি থেকে আগত ইউরোপের শ্রমিক আর মুসলিম সমাজের শ্রমিককে একই পাল্লায় মাপবার ফল। একজন হল ইউরোপের নারীর প্রতি মর্যাদাশীল ও উৎপাদনশীল মানসের প্রতিনিধিত্বকারী, আর একজন ‘মালে গণীমতের’ ঐতিহ্যে লালিত নারী-ধর্ষক ও লুণ্ঠনজীবী আরব বেদুইন মানসের প্রতিনিধিত্বকারী। প্রথমে না বুঝা যেতে পারে। কিন্তু বহু অভিজ্ঞতায়ও এটা না বুঝাটা নিদারুণ বুদ্ধিহীনতার পরিচায়ক। আসলে কম্যুনিস্ট হলেও তারা যে সমাজ থেকে উঠে আসে তারা যে সাধারণভাবে সেই সমাজের বুদ্ধিবৃত্তি বা চেতনার স্তর থেকে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারে না সেটাই শেষ পর্যন্ত এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

যাইহোক, এ কথা আজ নিশ্চিত করে বলা যায়, ঐ কালটাতে এ দেশে কম্যুনিস্ট আন্দোলন ও বিপ্লব প্রচেষ্টার সাফল্যের কোনও কারণ ছিল না। এর জন্য শুধু পাশ্চাত্য, কিংবা ভারতকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের বাস্তবতাই এ ধরনের আন্দোলন ও প্রয়াসের সাফল্যের পক্ষে ছিল না। তবু একটা ধর্মমুক্ত আদর্শ বা চেতনা নিয়ে বাঙ্গালীর একটা জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে ভাবনা ষাটের দশকে বিকশিত হয়েছিল যার পরিণতিতে সম্ভব হয়েছিল ১৯৭১-এ জাতি হিসাবে বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটা যুদ্ধ সেটার সর্বাধিক কৃতিত্ব বিশেষভাবে দিতে হবে কম্যুনিস্ট রাজনীতির সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার প্রভাবে গড়ে উঠা এ দেশের ষাটের দশকের বিপ্লবী ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মকে।

তবে মার্কসবাদ ও কম্যুনিস্ট রাজনীতির ছায়ায় বেড়ে উঠলেও সনাতন কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের ছিল বিরাট ব্যবধান ও দ্বন্দ্বও। এরা পুরাতন ধারার নেতৃত্বের মত শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব, শ্রেণী সংগ্রাম ইত্যাদি মার্কসীয় কেতাবী ধারণার চেয়ে মার্কসবাদের ভিতরে থাকা বস্তুবাদী দার্শনিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারণা দ্বারা অনেক বেশী অনুপ্রাণিত হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের বাস্তবতায় তারা এই বস্তুবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে কাজে লাগিয়ে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে প্রথম পর্যায় ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা। এর পরবর্তী পর্যায় হিসাবে তরুণ প্রজন্মের অনেকের মনে সুপ্ত ছিল পশ্চিম বঙ্গকে নিয়ে কোনও এক সময় বাঙ্গালী জাতির ঐক্যবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কল্পনা। ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭-এর বঙ্গের বিভক্তিকে অস্বীকারের পরিণতিতে এটা ছিল যৌক্তিক চিন্তা। স্বাভাবিকভাবে সেটা যে সর্বদা উচ্চারিত হত তা নয়। তখনও লিখিত আলোচনায় বিষয়টি আসবার কথা নয়। তবে এই রকম একটা ভাবনা কিছু সংখ্যক তরুণের মধ্যে ছিল, যা নিয়ে আমার প্রজন্মের খুব ঘনিষ্ঠ মহলে কখনও আমরা আলোচনা করতাম। তবে পুনরায় বলি বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক বাংলা কিংবা কোনও না কোনও রূপে ঐক্যবদ্ধ ও সমাজতান্ত্রিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মত বিষয়গুলির সে কালে আমাদের ভাবনায় সেভাবে গুরুত্ব পাবার কারণ ছিল না। আমরা শুধু বুঝতাম আমাদের আশু লক্ষ্য পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব বাংলায় বিপ্লব সম্পন্ন করা, যার মধ্য দিয়ে একটি লোকবাদী এবং জন-গণতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটা হলে তা হবে প্রথমে পশ্চিম বঙ্গে এবং তারপর সমগ্র ভারতবর্ষ ব্যাপী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে যাত্রাবিন্দু স্বরূপ। সেই সঙ্গে আমাদের প্রজন্মের মনে ছিল বিশ্বমানবতার মুক্তির লক্ষ্যে বিশ্ববিপ্লবেরও স্বপ্ন। সুতরাং কোনও অর্থেই সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী তারা ছিল না। আসলে সে কালে বিস্ময়কর অনেক ভাবনা ছিল তরুণ প্রজন্মের ভিতরে। আজ যখন সে কালের উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কিশোর ও তরুণদের মধ্যকার বহুমুখী পাঠ, কল্পনা, আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়গুলি নিয়ে ভাবি তখন বুঝি যে, সেটা ছিল এক পরাক্রান্ত প্রজন্ম।

যাইহোক, এটা বুঝতে হবে যে, সে কালের তরুণ প্রজন্ম মূলত ধর্ম-বিরোধিতার জায়গা থেকে পাকিস্তান বিরোধী হয়েছিল। বাঙ্গালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর বৈষম্য স্বায়ত্তশাসনের জন্য যে রাজনীতির বিকাশ ঘটিয়েছিল সেটাকে তারা ঢাল বা আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে জনমনে ছড়িয়ে দিয়েছিল। এই জায়গায় তাদের বিরোধ ছিল আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের রাজনীতির সঙ্গে। এমনকি তাদের বিরোধ ছিল তারা যে ন্যাপের ছত্রছায়ায় ছিল সেই ন্যাপের স্বায়ত্তশাসনের রাজনীতির সঙ্গেও। ফলে তাদের বিরোধ ছিল যে গোপন কম্যুনিস্ট পার্টি ন্যাপকে নিয়ন্ত্রণ করত সেই কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গেও।

আসলে দ্বন্দ্ব ছিল নিজেদের মার্কসবাদী তত্ত্বের ভিতরকার শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের ধারণার সঙ্গেও। তাদের ধারণা অনুযায়ী বাঙ্গালীর জাতীয় বিপ্লব প্রধান করণীয় হওয়ায় তারা মার্কসবাদের অনুসারীও প্রকৃত অর্থে ছিল না। বরং তারা এ দেশের বুর্জোয়া বা সম্পত্তিবানদের একাংশকেও তাদের বিপ্লবের মিত্র হিসাবে বিবেচনা করত। ব্যক্তিমালিকানার সপক্ষে তাদের চিন্তাধারার সঙ্গে পুরাতন কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের পার্থক্য ছিল স্পষ্ট। তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্যের জায়গা ছিল বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন। পুরাতন নেতৃত্ব বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে কোনও ধারণাকে উগ্র জাতীয়তাবাদ বলে উড়িয়ে দিতে চাইত। জাতীয়তাবাদ ছিল সনাতন নেতৃত্বের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের বিরোধের সবচেয়ে বড় জায়গা। বস্তুত সে কালে সাধারণভাবে কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের দৃষ্টিতে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম ছিল পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী। ফলে নেতৃত্বের নিকট এরা কম্যুনিস্টই ছিল না।

যাইহোক, পুরাতন নেতৃত্বের সঙ্গে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের দ্বন্দ্বের এমনই এক ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সময়ে ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ছয় দফা দাবী উপস্থিত করেন। শেখ মুজিব যখন ছয় দফা দিয়েছিলেন তখন তার মধ্যে ছিল পাকিস্তানের ইসলামী রাজনীতির সুস্পষ্ট প্রেরণা। এর মধ্যে ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভাবপ্রেরণার সুস্পষ্ট ঘোষণা। এর সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলিমের স্বার্থ রক্ষার চিন্তা থাকতে পারে। কিন্তু তার সঙ্গে বাঙ্গালীর স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র গঠনের কোনও সম্পর্ক ছিল না। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব যে পাকিস্তানের ইসলামী তথা মুসলিম রাষ্ট্র চেতনার বিরুদ্ধে ছিলেন না, বরং তিনি যে ছিলেন পাকিস্তানের আদর্শিক ও বস্তুগত কাঠামো রক্ষার পক্ষপাতী তার প্রমাণ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালী জনগণের উপর আক্রমণ অভিযান শুরু করলে তিনি দিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে তার কাছে ধরা দিলেন। এভাবে তিনি বাঙ্গালী মুসলিমের পাকিস্তান ভিত্তিক রাষ্ট্রচিন্তা থেকে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্রচিন্তায় নিজের উত্তরণ ঘটাতে ব্যর্থ হলেন।

স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে এগিয়ে নিবার ক্ষেত্রে ন্যাপ নেতৃত্বেরও ব্যর্থতাকে আমাদের আজ পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। এই নেতৃত্বের বিশেষত পুরাতন কম্যুনিস্ট অংশ পাকিস্তান ভাঙ্গার বিরোধী ছিল। মনে রাখতে হবে এরাই সেকালে ন্যাপ নেতা মওলানা ভাসানীকে ঘিরে রেখেছিল। আর এরা কেউ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে ছিল না। সেটা মস্কো-পিকিং সব ধারাই। সুতরাং এই নেতৃত্বের সঙ্গে তীব্র বিরোধ ছিল তরুণ প্রজন্মের। এই বিরোধের পরিণতিতে তরুণ প্রজন্ম অনেকাংশে নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে, অনেক সময় নিজেরা বিভক্তও হয়। তবু তারা তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলে। মনে রাখতে হবে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীনতার আন্দোলন রাস্তার স্লোগানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। সেকালে ‘মেনন গ্রুপ’ হিসাবে পরিচিত বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের’ পক্ষ থেকে ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকার পল্টন ময়দানে ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ১১ দফা কর্মসূচী’ ঘোষণা করা হল। অর্থাৎ তরুণ প্রজন্ম স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্মসূচী দেওয়ার কাজটাও সম্পন্ন করল। স্বাধীনতার রাজনীতির সপক্ষে মাঠ ও রাস্তার স্লোগানের বাইরে এটা ছিল ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের প্রথম আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য ঘোষণা। এবার জাতির সামনে স্বাধীনতার একটা ঘোষণা থাকল। এর এক বছর পরই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ ও দমন অভিযান শুরু হলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূর্ব বাংলার জনগণের সশস্ত্র প্রতিরোধ ও জাতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হল।   

পাকিস্তানের দমন অভিযানের মোকাবিলায় পূর্ব বাংলার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হলে সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব ভারতের সাহায্যে খুব সহজেই আওয়ামী লীগ দখল করল। শেখ ‍মুজিব পাক সেনার নিকট ধরা দিলেও ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে আওয়ামী লীগ তার নামেই নয় মাস যুদ্ধ পরিচালনা করল। এভাবে পাকিস্তান কাঠামোকে রক্ষার রাজনীতির প্রকাশ হিসাবে ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়ী হলেও সেই নির্বাচনের ফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাষ্টক্ষমতায় যেতে পারল না। বরং তাকে যেতে হল পাকিস্তানের ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়। 

আর এখানেই ষাটের দশকের বিপ্লবী বা বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের সাফল্য। তাদের মনে পুরাতন কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের শ্রেণীতত্ত্বের যান্ত্রিক অনুশীলনের পরিবর্তে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে তাড়না ছিল সেটাই ঘটনাধারায় পূর্ব বাংলার জাতীয় আন্দোলনের মূল অভিমুখে পরিণত হল। প্রকৃতপক্ষে তরুণ প্রজন্ম দ্বারা দ্রুত প্রসারণমান পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের চাপে ইয়াহিয়া-মুজিবের মধ্যে আপোসের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হল। একটা যুদ্ধ অনিবার্য হল। আর এই যুদ্ধের আদর্শিক ভিত্তি যোগালো বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম কর্তৃক সংগঠিত পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতির ধর্মমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি।

কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা বুঝতে গিয়ে এটা বুঝতে হবে যে, তাদের ভাবনায় রাষ্ট্রচিন্তা প্রবল হতে পারত না তাত্ত্বিক এবং সমাজ বাস্তবতারও কারণে। বলা যায় তারা একটা সামগ্রিক অনুকূল বিশ্বপরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করতে চাইত। ততকাল তারা নিজেদের শক্তিকে নিয়োজিত ও রক্ষা করতে চাইত বিভিন্ন ছোটখাটো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমাজ চেতনাকে যতটা সম্ভব এগিয়ে নিতে চেয়ে। ফলে তাদের মাথায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা ছিল না বলাই সঙ্গত; আর যদি একান্ত থেকেই থাকত তবে সেটাকে বলা যায় বহু দূরবর্তী কালের ভাবনা। বস্তুত, মার্কসীয় তত্বের অন্ধ অনুশীলনের বাইরে তারা চিন্তা করতে পারত না। অর্থাৎ কেতাবী বিদ্যা আর সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের মত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেনাজানা ছকের বাইরে যাবার চিন্তা তারা করত না। ফলে নিজ সমাজের বাস্তবতা থেকে শিখে তত্ত্ব বা বিপ্লবী ধারণা নির্মাণের কল্পনাই তারা করতে পারত না।

তবে ধীরগতিতে সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র বিপ্লবের জন্য একটা অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টির বাইরে কোনও চিন্তা সেকালের নেতৃত্বের মধ্যে না থাকলেও তরুণরা অত ধৈর্যশীল ছিল না। ফলে তারা চাইত রাষ্ট্র ও সমাজ বিপ্লবের জন্য ঝুঁকি নিতে। বরং রাষ্ট্রবিপ্লবের তাড়না ছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবল। কারণ তাদের আশু লক্ষ্য ছিল নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সমাজ বিপ্লবের চিন্তাটা তাদের মাথায় কাজ করত, যেটাকে বলা যায় নেতৃত্বের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী চিন্তা। এই চিন্তা থেকে তাদের মধ্যে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের নেতাদের নিকট থেকে তারা নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালনের আশা করত। যাইহোক, এই আলোচনা এ দেশের তৎকালীন বামপন্থী রাজনীতির একটা গুরুতর সমস্যার দিককে আলোচনায় নিয়ে আসবে। কিন্তু সেই আলোচনার জায়গা এটা নয়। এক কথায় বললে বলা যায়, এ দেশের সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সে কালে কম্যুনিস্ট রাজনীতির যত ইতিবাচক ভূমিকা থাকুক দেশ ও কালের বাস্তবতার সামগ্রিক বিচারে তার অনুপযোগিতার কারণে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাও বাস্তবে রূপ লাভ করে নাই।

আসলে আধুনিক সভ্যতা ও যুগোপযোগী যে ধরনের সমাজ বিপ্লবের কল্পনা আমরা করি সে ধরনের বিপ্লবের কোনও বাস্তবতাই সে কালে আমাদের জন্য ছিল না। অর্থাৎ যে কোনও বিচারেই ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্ম তার সময়ের চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে গিয়েছিল। ফলে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ও অনেকাংশে একা হয়ে শক্তি হিসাবে ধ্বংসপ্রাপ্তও হয়েছিল।

আজ যখন নির্মোহভাবে সে কালের বামপন্থী আন্দোলনের অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা করি তখন এটা বুঝি যে, আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের জন্য যে ধরনের সামাজিক চেতনার বিকাশ দরকার ছিল ইসলাম তার জন্য এমনই এক বাধা যে, কোনও মুসলিম সমাজের ভিতর থেকেই এই কারণে কোনও স্বাধীন উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয় নাই। এর জন্য সাধারণভাবে প্রয়োজন হয়েছে পাশ্চাত্যের অধীনতা অথবা হস্তক্ষেপের। মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ায় আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথে যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে সেটাও অমুসলিম রাশিয়ার আধিপত্য এবং বিপ্লবের ফল। আসলে ইসলাম আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক। এই অবস্থায় ইসলাম বহির্ভূত শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথে ইসলামী সমাজের অগ্রগতি এক দীর্ঘ সময় একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে থেকেছে।

সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের উত্থান পরবর্তী কালে তার প্রভাবে বিশ্বপরিস্থিতে পরিবর্তনের ফলে পাশ্চাত্য আধিপত্য ও প্রভাব সঞ্জাত ইতিপূর্বেকার পরিবর্তনগুলি মুসলিম সমাজে ভিতর থেকে আরও কিছু অগ্রগতির পথ খুলে দিলেও শেষ পর্যন্ত সেগুলি বাহিরের হস্তক্ষেপে অথবা অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে একটা পর্যায়ের পর মুখ থুবড়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইসলামের প্রভাব অনেক ক্ষেত্রে গৌণ এমনকি বর্জন করতে পারলেও এইসব দেশের কোনটিতেই ইসলামের প্রভাব ও আধিপত্য থেকে সমাজকে মুক্ত করার পথে পদক্ষেপ দেওয়া যায় নাই। এর কিছু দৃষ্টান্ত হিসাবে তুরস্ক, মিসর, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ইত্যাদি দেশের নাম বলা যায়। ফলে ঘটেছে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতেও ধর্মের কম-বেশী প্রত্যাবর্তন এবং পরিণতিতে সমাজের পশ্চাদযাত্রা। ইতিমধ্যে পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপে এবং সেই সঙ্গে গৃহযুদ্ধে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসলামের পথ ধরে তুরস্কের পশ্চাদযাত্রা যে তার জন্য করুণ পরিণতি বয়ে আনবে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

যাইহোক, ইসলামী সমাজসমূহের স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ অগ্রগতিকে প্রতিহত করার জন্য এতকাল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ ইসলাম ধর্মকে তাদের জন্য সবচেয়ে সহায়ক শক্তি হিসাবে বিবেচনা করে তাদের কর্মনীতি অনুসরণ করত। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন পরবর্তী কালে, বিশেষত ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংস পরবর্তী কাল থেকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য কর্তৃক ইসলাম-তোষণ ও পোষণ নীতিতে কিছু করে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এর একটা কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে ইসলামী বিশ্বে কম্যুনিস্ট বিপ্লবের বিস্তারের সম্ভাবনার অবসান হল। ইসলামের বিরুদ্ধ ভাবাদর্শ হিসাবে ইসলামী সমাজগুলিতে মার্কসবাদের যেটুকু আবেদন ছিল সেটুকুরও অবসান হল।

ইসলামের সামনে প্রবল ও বিপজ্জনক প্রতিদ্বন্দ্বী বা শত্রু হিসাবে উদ্ভূত মার্কসবাদ ও কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ক্ষয় বা অবসান এবার ইসলামের সামনে পাশ্চাত্যকে প্রধান কিংবা প্রায় একক শত্রু হিসাবে উপস্থিত করল। বস্তুত ইসলামী জগতে প্রত্যক্ষ পাশ্চাত্য আধিপত্য অবসানের পর থেকে একটা দীর্ঘ সময় পাশ্চাত্য এবং ইসলামের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এমন এক তৃতীয় পক্ষ যা অন্তত ভাবাদর্শিকভাবে পাশ্চাত্য ও ইসলাম তথা ইসলামী বিশ্ব এই উভয়েরই শত্রু। অতীতে পাশ্চাত্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে কখনও কখনও মিসর, ইরাকের মত কোন কোন মুসলিম রাষ্ট্র সোভিয়েতের সঙ্গে মিত্রতা বা ঘনিষ্ঠতা করলেও দেশের ভিতরে কম্যুনিস্টদের দমনে সাধারণত কেউ কার্পণ্য করে নাই।

সেই কালের অবসান হয়েছে। এখন ইসলামের প্রধান শত্রু রূপে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য আবির্ভূত হয়েছে। উভয়ের মধ্যকার সংঘাত এখন ক্রমবর্ধমান। ফলে এখন আর নূতন করে ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করবার অবস্থায় পাশ্চাত্য নাই। এটি ইসলামী পৃথিবীর ভিতর থেকে ইসলাম থেকে মুক্তির আন্দোলনের পথে এক বিরাট বাধার অপসারণ ঘটিয়েছে।

তবে যে ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে নবজাগরণ অনিবার্য করে তুলছে সেটি হচ্ছে ইন্টারনেট বা আন্তর্জালের উদ্ভাবন ও প্রসার। এতকাল ইসলামী সমাজে বাস করে ইসলাম সংক্রান্ত কোনও প্রকার নির্মোহ আলোচনা কিংবা সমালোচনা ছিল মৃত্যুকে প্রায় ডেকে আনার শামিল। ইসলাম সংক্রান্ত কোনও ধরনের সমালোচনাকে মুসলিমরা সহ্য করতে অভ্যস্ত নয়। ঐতিহাসিকভাবেই এবং তাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ীও ইসলামের যে কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনার জবাব তারা দৈহিক আক্রমণ এবং হত্যা দ্বারা দিতে অভ্যস্ত। সুতরাং ইসলাম সংক্রান্ত কোনও মুক্ত আলোচনা এবং বিতর্কের জায়গা মুসলিম সমাজে নাই। এই রকম সামাজিক মনোভাব যে কোনও সমাজকে বন্ধ্যা এবং মস্তিষ্কশূন্য করতে বাধ্য। সুতরাং তলোয়ারের যুগের অবসানের ফলে যখন থেকে বুদ্ধিবৃত্তির প্রাধান্যের যুগ শুরু হয়েছে তখন থেকে মুসলিমদের নিয়তি হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিতে উন্নত পাশ্চাত্যের অমুসলিমদের অধীনস্থ হওয়া এবং তাদের দাসত্ব করে যাওয়া। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী মুসলিমদের জন্য আল্লাহর বান্দাত্ব বা দাসত্ব এখন মার্কিন নেতৃ্ত্বাধীন পাশ্চাত্যের বান্দাত্ব বা দাসত্বে পরিণত হয়েছে। 

কিন্তু ইন্টারনেট এই রকম মস্তিষ্কশূন্য ঈমানদার মুসলিমদেরকেও এখন ইসলাম সংক্রান্ত যাবতীয় সত্য শুনতে বাধ্য করছে। ইসলামী সমাজ ও রাষ্টের ভিতর থেকে হত্যার ভয় এবং রাষ্ট্রের জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে না হয় প্রতিবাদী কণ্ঠকে রোধ করা গেল। কিন্তু পাশ্চাত্যে বাস করে যে সব ইসলাম বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ লিখিতভাবেই হোক আর মৌখিকভাবেই হোক ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার করছেন তাদেরকে আটকানো যাবে কোন ছোরা-ছুরি-বন্দুক আর আইনের ভয় দেখিয়ে? আসলে মুমিন মুসলিমরা ইন্টারনেটের শক্তির সামনে একেবারে অসহায় হয়ে পড়েছে।

এভাবে ইন্টারনেটের কল্যাণে মুসলিম পৃথিবীতে ভাবজগতে নবতর বিপ্লব অপ্রতিহত হয়ে উঠছে। আর ভাবজগতে বিপ্লবের হাত ধরেই তো আসে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিপ্লব। সুতরাং ইন্টারনেটের সম্প্রসারণের এই কালে বিশ্বব্যাপী ইসলাম থেকে মুক্তির এক প্রচণ্ড ও বিশাল সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিপ্লবের কালে আমরা পদার্পণ করতে যে যাচ্ছি সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

এই রকম এক পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আজ আমাদের সামনে অর্ধশতাব্দী পূর্বকালের পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন নূতন তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। বস্তুত নির্মোহভাবে বিচার করলে আজ এ কথা স্পষ্ট হয় যে, ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীন পূর্ব বাংলার আন্দোলনের অভিঘাতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হলেও সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব যেমন তাদের হাতে যায় নাই তেমন এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলার বুকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হলেও এই রাষ্ট্র মোটেই স্বাধীন পূর্ব বাংলার ভাবপ্রেরণা এবং রাজনীতিকে ধারণ করে না। এটা ঠিক যে, ষাটের দশকের স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতির ভাবপ্রেরণাকে স্বাধীনতার পর নূতন শাসকদের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব হয় নাই। সুতরাং সকল ত্রুটি নিয়ে রচিত হওয়া সত্ত্বেও ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র এই চার মূলনীতিকে স্থান দেওয়া হয়েছিল। তবে এর সঙ্গে নূতন শাসকদের বাস্তব কর্মনীতি ও আদর্শের কোনও সম্পর্কই ছিল না; বরং তাদের সকল কর্মকাণ্ডের অভিমুখ যে ছিল পূর্ব বাংলাকে বাংলাদেশ নাম দিয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান হিসাবে পুনর্গঠন করা সময়ে সেটা প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশ মোটেই বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র হয় নাই, বরং এটা হয়েছে বাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়ের রাষ্ট্র, সুতরাং খণ্ডিত পাকিস্তান মাত্র। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর বাঙ্গালীত্বের সাময়িক আবেগ ও উচ্ছ্বাস কেটে যেতে বাঙ্গালী মুসলিমদের সময় লাগে নাই। শাসক ও শাসিত নির্বিশেষে বাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়ের গরিষ্ঠ অংশ তাদের ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানী চেতনার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে যে যাত্রা শুরু করে সেই যাত্রা যেখানে নিবার সেখানেই তাদেরকে আজ নিয়েছে।

এই চেতনার পরিণতিতে আজ বাংলাদেশ ঘুষ-দুর্নীতি-লুণ্ঠন-ধর্ষণ ও খুনের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন অগণিত অসহায় ও দুর্বল নারী, শিশু ও পুরুষের যে আর্তনাদ বাংলাদেশের বুকের উপর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মত আছড়ে পড়ছে তার আঘাতে অবিরত ভেঙ্গে খানখান হয়ে পড়ছে উন্নয়নের গল্পের কথামালা। কোনও গল্পের ব্যানার আর পোস্টার দিয়েই দেশের প্রকৃত অধঃপাতের চিত্রকে আর ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং আজ দেশকে পথ পরিবর্তন করতে হবে। এর জন্য প্রথম এবং সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল ইতিহাসের পুনর্বিচার। যে ইতিহাস আমাদেরকে সাড়ম্বরে জানানো হয় সেটার মধ্যে ফাঁক ও ফাঁকি কতখানি সেই ইতিহাসটা বের করে আনতে না পারলে আজকের এমন পরিণতির কারণটাকেও যে ধরতে পারা সম্ভব না সেটা বুঝতে হবে। কাজটা কঠিন এবং অনেকের নিকট অনাকাঙ্ক্ষিতও মনে হবে। কিন্তু কাউকে না কাউকে কাজটা করতে তো হবে।

আর সেখানে্ আসে বিশেষত ষাটের দশকে বিকশিত বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতির পুনর্মূল্যায়নেরও প্রশ্ন। এটা ঠিক যে, এর উদ্দেশ্য ষাটের দশকের রাজনীতির জায়গায়ও ফেরা নয়। সেটা সম্ভব নয়, সেই চেষ্টা উচিতও নয়। তবে সেই কালের একটা পুনর্বিচার জরুরী। এটা নূতন পথের যাত্রার জন্যই জরুরী। প্রায় অর্ধশতাব্দী কাল যে পথ ধরে এ দেশ আজ অবধি এসেছে তার ভয়াবহ পরিণতি তো আমাদের দেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। এ নিয়ে আর কতকাল ফাঁকা ও ফাঁপা গৌরব কীর্তন চলবে?

বিকল্প বা নূতন পথে যাত্রা শুরু আজ সময়ের দাবী। কিন্তু নূতন পথ বললেই তো হল না। তার জন্যও একটা অতীত লাগে। সেই অতীত থাকতে আমরা কেন শূন্যে হাতড়াব? সুতরাং শিক্ষালাভের জন্য, নূতন পথের দিশার জন্যই আজ আমাদেরকে নূতন করে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের উদ্যোগে গড়ে তোলা স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও আন্দোলনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

সেই প্রজন্ম তার আদর্শ নিয়ে সেভাবে আর বেঁচেও নাই। নেতৃত্বের সামনের সারিতে যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই পথভ্রষ্ট, লাভ ও লোভে আত্মসমর্পণকারী অথবা আত্মবিক্রয়কারী। অনেকে মৃতও। বাকীরা ছত্রভঙ্গ অথবা রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে অপসারিত। ফলে সেই প্রজন্মকে সেই অর্থে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম আজও বেঁচে আছে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি — পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতি গড়ে তুলতে পারার অনন্যসাধারণ ইতিহাসের মাধ্যমে। সুতরাং সেদিকে আমাদের নূতন করে দৃষ্টি দিতে হবে। তবে দৃষ্টিটা হতে হবে নির্মোহ; যাতে করে সেই আন্দোলনের ভিতরকার ইতিবাচক ও নেতিবাচক, সবল ও দুর্বল দিকগুলির নির্মোহ বিচারের মাধ্যমে আমরা নূতন পথে যাত্রার পাথেয় খুঁজে পাই। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে আজ আমার এই কথাটুকু বলা। 

আগস্ট, ২০১৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ