Banner
বাংলাদেশের দুর্বৃত্তায়ন -- শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ April 12, 2007, 6:00 PM, Hits: 4601

(প্রথম পর্ব)

অনেকের কথা শুনে মনে হয় দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি রক্ষা করে বাংলাদেশে একটি দুর্বৃত্তায়নমুক্ত রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, আর এভাবে সম্ভব দুর্বৃত্তায়নমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাও। সুতরাং অনেকেই এখন সংবাদপত্র ও টিভির মাধ্যমে অর্থনীতির দিকটাকে আলোচনায় কম এনে অথবা আদৌ না এনে রাজনীতি বিশুদ্ধকরণের নানান ধরনের ব্যবস্থাপত্র দিচ্ছেন। তার মধ্যে একটা ব্যবস্থাপত্র হচ্ছে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা এবং বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের অবসান ঘটানো এবং সম্ভব হলে এই দুই নেত্রীকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া তথা নির্বাসিত করা। এর সঙ্গে আছে পরিবারতন্ত্র উচ্ছেদ করার প্রতিজ্ঞাও।

মূল আলোচনায় যাওয়ার জন্য এই দুই নেত্রীর প্রসঙ্গ দিয়েই শুরু করি। এই দুই নেত্রীর কেউই কিন্তু নিজ দলের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য উন্মুখ ছিলেন না। বরং উভয় দলের নেতা-কর্মীরাই তাঁদের মূল নেতাদের মৃত্যু এবং দলের ক্ষমতাচ্যুতির পর দলের অখণ্ডতা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তাঁদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

কেন হয়েছিলেন তা ‘সুশীল সমাজের’ জন-বিচ্ছিন্ন ভদ্রলোকরা না বুঝতে পারেন, কিন্তু যাঁরা এইসব বৃহৎ দল করেন তাঁরা ঠিকই বুঝেন। বুঝেন বলে দলের বাঘা বাঘা নেতারাও মূল নেতার মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারের একজনকে ধরে এনে দলের প্রধান পদটিতে বসাবার জন্য দৌড়াদৌড়ি করেন। কারণ তাঁরা জানেন তা না হলে আর কাউকে কেউ মানবে না। কারণ মানবে না সাধারণ কর্মীরা এবং গাঁও-গেরামের মানুষরা এবং সেই সঙ্গে গাঁও-গেরাম থেকে এক বা দুই প্রজন্মে শহরে বসত-গাড়া মানুষরাও, যাদের শরীরে এখনও লেগে আছে গাঁও-গেরামের মাটির গন্ধ এবং ঈদ বা আর কোন বড় ছুটিতে এখনও যাদের অধিকাংশ গাঁও-গেরামে ফিরে গিয়ে শহরগুলোকে প্রায় জনশূন্য করে ফেলে। আর এরা না মানলে তাঁদের দলেরও পরিণতি হবে বাম দলগুলোর মত। ভোটারদের ভোটের আশাই যখন নেই তখন দল ছোট হল, না বড় হল তাতে কী যায় আসে? ফলে তখন দল ভেঙ্গে জন্ম নিবে অসংখ্য দল বা উপদল।

আসলে তেমন কোন আদর্শ বা নীতি-নৈতিকতা-নিয়ম নয়, বরং ব্যক্তি হচ্ছে আমাদের দেশে যে কোন গণ-ভিত্তিক এবং ব্যাপক জন-সমর্থিত রাজনৈতিক দলের উত্থান এবং রক্ষার মূল ভিত্তি। সেই ব্যক্তিকে পেতে হয় রাজকীয় মর্যাদা। কতিপয় অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের চাই একজন ‘আজা’ (রাজা)। ‘আজা’ যদি একান্ত না-ই জুটে তবে নিদেনপক্ষে চাই একজন ‘আনী’ (রাণী)। এই ‘আজা’ বা ‘আনী’কে ঘিরে গড়ে উঠে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল, গড়ে ওঠে তার অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব বা ক্ষমতা কাঠাম এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার ব্যবহার দ্বারা একটি সুবিধাভোগী শ্রেণী গঠনের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ভিত্তি। এই প্রক্রিয়ায় আদর্শ বলতে মোটা দাগে কিছু স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার ব্যাপার থাকে মাত্র। ঐটুকু মেনে গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত সুবিধা ও স্বার্থের প্রয়োজনে যা খুশী তা করা যায়। তাতে দল বা সমর্থক গোষ্ঠীর সমর্থনে তেমন কোন সমস্যা হয় না। যেহেতু ভোটাররা বেশীর ভাগ মুসলমান সেহেতু ইসলাম ধর্মের প্রতি আনুগত্যের অন্তত বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হবে। তারপর সেকিউলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রতি মৌখিক সমর্থন-অসমর্থনে অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ কিছু যায় আসে না।

আমাদের দেশে ধর্মের জায়গাটা সবচেয়ে বড় পরিচিতির জায়গা হয়ে আছে আজও। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টা ছিল এ ক্ষেত্রে ক্ষণকালের একটা যতি চিহ্নের মত। ঐ সময়টুকু ছাড়া সর্বদা প্রায় সকলেই ঐ জায়গা ছাড়া আর সব জায়গায় ছাড় দিতে প্রস্তুত। এই কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষে সেকিউলার রাজনীতির মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে খেলাফত মজলিশের সঙ্গে কয়েক মাস আগে ফতোয়াবাজীসহ ইসলামী আদর্শ বা রাজনীতির সপক্ষে চুক্তি করতে সমস্যা হয় না।

আবার প্রয়োজন ফুরাতে ঐ চুক্তি বাতিল করতেও তার সমস্যা হয় নি। কারণ তার ধর্ম রক্ষার জন্য ঐ চুক্তিরও প্রয়োজন নেই। ধর্ম তো তার আছেই। প্রয়োজনের জায়গায় সেটা আছে এবং থাকবে যেমন প্রয়োজনের জায়গায় তার আছে এবং থাকবে সেকিউলারিজম। সুতরাং প্রয়োজনে যে কোন চুক্তি তা যে কোন পক্ষের সঙ্গে করবে, আবার প্রয়োজন ফুরালে যে কোন চুক্তি তা ভাঙ্গবে। অবশ্য চুক্তি করারই বা তার দরকার কী? সবকিছুতেই তো তা আছে! যা বললে জন-সমর্থন ও ভোট পাওয়া যায় তা-ই তা বলবে। আসলে নীতি তার একটাই, বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা আদায় এবং স্বার্থ রক্ষা করা। তার জন্য যখন যা বলা এবং করা দরকার তখন সেটাই তা বলবে এবং করবে। তখন সেটাকে তার দলের নেতা, কর্মী এবং সমর্থক গোষ্ঠী সমর্থনও করবে। কারণ তাতে দলের সবারই কম-বেশী লাভ। নেতারা বড় ভাগ পেলেও, কর্মী এবং সমর্থকরাও তো তার ছিটেফোটা ভাগ পাবে। সবাই না পেলেও পরবর্তী সময়ে পাবার আশা করে দলের পিছনে থাকতে তো সমস্যা নেই। এভাবেই আওয়ামী লীগ শুধু নয়, বড় সব দল চলে।

১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রবেশের সুযোগ পাবার পর স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির দাবীর কী হাল করেছিলেন সে সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করতে চান না এখনকার বুদ্ধিজীবীরা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে এঁরা এখন সোচ্চার। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের সেই ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে তাঁরা এখন কথা বলেন না কেন? তাঁরা হয়ত বলবেন আমরা অতীত নিয়ে মাতামাতি করব কেন? তাহলে কী করতে হবে? অতীত ভুলে যেতে হবে। তাহলে আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি নিয়ে এঁদের অনেকের এত চেঁচামেচি কেন?

দেশের দুর্বৃত্তায়নের সমস্যা না বুঝলে তা দূর করা যাবে কীভাবে? সুতরাং সমাজ এবং তার ইতিহাস বিশ্লেষণ করা ছাড়া উপায় কী? কাজেই বর্তমান ছেড়ে আমাদের আর একটু অতীতে ফিরতে হবে।

১৯৫৪-তে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পিছনে সাধারণ বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সাধারণ মানুষও ছিল এই মধ্যবিত্তের সঙ্গে। এটা ছিল মুসলিম লীগ নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শাসক শ্রেণী এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত এখানকার মুসলিম আশরাফ বা অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জনগণের মহা ঐক্য। এই মহা ঐক্যে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলিম অভিজাত শ্রেণীরও সংখ্যালঘু অংশ ছিল। সোহরাওয়ার্দী তখন ছিলেন মূলত এই সংখ্যালঘু অভিজাত শ্রেণীর প্রতিনিধি।

এই মুসলিম অভিজাত শ্রেণী বাংলায় সাধারণভাবে বহিরাগত এবং জন-বিচ্ছিন্ন হলেও অনেক কাল পর্যন্ত এ দেশের মুসলিম সমাজ এদের পিছনেই সাধারণভাবে ছিল। মূলত এই শ্রেণীর রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসাবে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সমগ্র মুসলিম বাঙ্গালী সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই ঐক্য ভেঙ্গে পড়ে। সংখ্যাগুরু আশরাফদের নেতা ঢাকার নওয়াব পরিবারের খাজা নাজিম উদ্দীনের মত লোকদের পরিবর্তে সংখ্যালঘু আশরাফদের নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং নীচতলার কৃষক জনগোষ্ঠীর ভিতর থেকে উঠে আসা আম জনতার নেতা মওলানা ভাসানীর পিছনে মুসলমান বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমবেত হয়। অবশ্য প্রথম পর্যায়ে ভাসানীর গুরুত্ব বেশী ছিল। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন প্রধান নেতা এবং উদ্যোক্তা। ঐ সালে দল গঠন হলে তিনি তার সভাপতি নির্বাচিত হন।

কিন্তু ১৯৫৬-’৫৭ থেকে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। ঐ সময় সোহরাওয়ার্দী-মুজিব পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ মুজিব মন্ত্রী হবার পর এঁরাই আওয়ামী লীগ এবং তার অনুসারী মধ্যবিত্তের বৃহত্তর অংশের প্রধান নেতা হলেন। কারণ তখন তাঁদের হাতে ক্ষমতার মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত অর্জনের মূল চাবিকাঠি। সুতরাং তাঁদের সঙ্গে থাকলে নেতা, কর্মী, সমর্থক এবং নানানভাবে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিতরা অনেক ধরনের সুবিধা পেতে পারে। লাইসেন্স, পারমিট, ব্যবসার আরও নানান ধরনের সুযোগ, চাকুরী এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার জাত-উপজাত আরও বহু ধরনের সুযোগ-সুবিধা। সুতরাং নীতি বা আদর্শ তথা কর্মসূচী ও কর্মনীতির প্রতি অঙ্গীকার রাখা হল কি না হল তাতে কী যায় আসে! সোহরাওয়ার্দী যখন অঙ্গীকার ভঙ্গ করলেন তখন মুজিবসহ অনেকেই তাঁর সমর্থক হলেন।

তাহলে আসল ঘটনা কী দাঁড়াল? পাকিস্তানী তথা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর কাছ থেকে নিজেদের জন্য সুযোগ-সুবিধা আদায়ের জন্য তাঁদের কিছু জনপ্রিয় দাবী তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল। এই দাবী তোলার ফলে জনগণ তাঁদের পিছনে জমায়েত হবে। সেটা হবে তাঁদের শক্তি। সেই শক্তি নিয়ে তাঁরা ক্ষমতায় যাবেন। তারপর পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর সঙ্গে গোপন সমঝোতার ভিত্তিতে সেইসব দাবী জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করবেন।

সুতরাং কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে স্বায়ত্তশাসন দাবী প্রসঙ্গে বলা হল ৯৮% স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে, আবার কীসের স্বায়ত্তশাসন? আর স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি প্রতিষ্ঠার দাবীকে নাকচ করা হল সোহরাওয়ার্দীর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘০+০+০=০’ দ্বারা। অথচ পূর্ব বাংলার জন্য স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানের জন্য স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি প্রতিষ্ঠা ছিল আওয়ামী লীগের মূল দুইটি দাবী। এই দুই দাবীর প্রতি অবিচল ও অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকতে গিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাঁর নিজ দলেই টিকতে পারলেন না। সেখানে সংখ্যালঘু হয়ে তিনি বাধ্য হলেন তাঁর অনুসারী সৎ ও অঙ্গীকারাবদ্ধ নেতা-কর্মীদের নিয়ে স্বতন্ত্র দল হিসাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করতে।

বস্তুত সহজে ক্ষমতায় যাবার এবং সেখানে সহজে টিকে থাকার স্বার্থে সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর শিষ্য মুজিব পাকিস্তানী সামরিক-বেসামরিক আমলা, বৃহৎ ব্যবসায়ী এবং জমিদারদের নিকট পূর্ব বাংলা এবং পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দিলেন। উদ্দেশ্য একটাই, যে কোন ভাবে ক্ষমতায় থেকে যত দ্রুত সম্ভব অর্থ-বিত্ত সংগ্রহ দ্বারা নিজেদের অথবা নিজের দলের লোকদের শক্তি বৃদ্ধি করা। নীতি-আদর্শ-অঙ্গীকার ওসব কথার কথা! আসল কাজ নিজের স্বার্থ-সিদ্ধি।

কিন্তু এ ছিল নির্জলা বিশ্বাসঘাতকতা এবং নিকৃষ্ট দুর্নীতি। এ যদি দুর্নীতি না হয় তবে দুর্নীতি কোনটা? হাঁ, দুর্নীতির পথ ধরেই একটা শ্রেণীর উত্থান হয়েছে। আজকের উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং প্রতিষ্ঠিত শ্রেণীসমূহের উত্থান কীভাবে হয়েছে সেটা না বুঝলে আজকের দুর্বৃত্তায়ন ও লুণ্ঠনতন্ত্র কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটাও বোঝা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৬-’৫৭-তে ক্ষমতা হাতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী-মুজিব রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধ-অবৈধ ব্যবহার দ্বারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মূলত একটি সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু অর্থ ও বিত্তের অধিকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে তোলেন। বিশেষত কৃষক ও নিম্ন বা নিম্ন-মধ্য শ্রেণীর পটভূমি থেকে উঠে আসা একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী দ্রুত গড়ে উঠল এই সময়। এই শ্রেণীর সবাই যে দুর্নীতিগ্রস্ত কিংবা সবাই যে লীগের কর্মী বা অনুসারী ব্যাপারটা তা নয়। কিন্তু লীগ সংশ্লিষ্ট এই শ্রেণীর উত্থানটা দুর্নীতি নির্ভর বা অসৎ ও অনৈতিক। কারণ যে নীতি ও কর্মসূচীর প্রতি অঙ্গীকারের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের জন-সমর্থন লাভ, রাজনৈতিক উত্থান, ’৫৪-এর নির্বাচনে জয় লাভ এবং ক্ষমতায় যেতে পারা সেই নীতি ও কর্মসূচীকে জলাঞ্জলি দিল তা ক্ষমতার স্বার্থে। সুতরাং এই ক্ষমতার উদ্দেশ্য দেশ ও জন-কল্যাণ ছিল না, বরং ছিল শুধুমাত্র স্বার্থান্ধ দলীয় নেতা-কর্মী এবং সেই সঙ্গে অনুগত একটি শ্রেণীর কল্যাণ সাধন। এভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মর্মমূলে দুর্নীতি, প্রতারণা, মিথ্যা এবং নিকৃষ্টতা নিয়ে একটা শ্রেণীর উত্থান শুরু হল। এই শ্রেণীর উপর ভর করেই পরবর্তী কালে শেখ মুজিব ৬ দফা দিয়েছিলেন।

আজ এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ৬ দফাও ছিল ২১ দফার মত এই শ্রেণী ও তার দল আওয়ামী লীগের দর কষাকষি এবং সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার মাত্র। এবং একবার পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যেতে পারলে যে এর পরিণতিও ২১ দফার মতই হত সে কথাও বলা যায়। কেন তা হয় নি, কেন এবার শেখ মুজিব একই খেলা খেলতে পারেন নি তার উত্তর এই শ্রেণী ও তার দল আওয়ামী লীগে না খুঁজে খুঁজতে হবে ষাটের দশকে এ দেশের বামপন্থী রাজনীতির ভিতর। ষাটের দশকে বিশেষত বামপন্থী ছাত্রদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা দ্রুত বিকাশ লাভ করছিল, যার সূচনা ছিল প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের পূর্বেই এবং সেটা এই বামপন্থী ছাত্রদের মধ্যে।

শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করার পর বামপন্থী ছাত্রদের মধ্যকার বাঙ্গালীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা দ্রুত বিকাশ ও বিস্তার লাভের জন্য একটা নূতন সুযোগ লাভ করে। এভাবে স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সমান্তরালে স্বাধীনতার রাজনীতি দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে। এর প্রভাব বিশেষভাবে গিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ভিতর পশ্চিম পাকিস্তানী বিশেষত পাঞ্জাবীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত বাঙ্গালী অফিসার ও সৈনিকদের উপর।

এই রকম এক বাস্তবতায় মুজিবের পক্ষে ৬ দফার প্রশ্নে ছাড় দেওয়া তো দূরের কথা, এমন কি ৬ দফা নিয়েও রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব হয় নি। বরং ঘটনা ধারা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে গেছে। যুদ্ধে মুজিব নেতৃত্ব দেবার দায়িত্ব নেন নি, তবে আওয়ামী লীগ নিয়েছিল। ভারতের নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে হলেও তা যুদ্ধ করেছিল। এতে অবশ্য দুই দিক রক্ষার ব্যবস্থা ছিল। যুদ্ধে পাকিস্তান জিতলেও নির্বাচনের ফল রক্ষা করে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত মুজিব এবং লীগের সঙ্গে একটা বন্দোবস্তে যেতে বাধ্য হত। ফলে শেষমেশ একটা সমঝোতা হত উভয়ের মধ্যে এবং সেটা পাকিস্তানের কাঠামর ভিতরই হত। আর পাকিস্তান পরাজিত হলে যেটা হত সেটা হয়েছে।

অবশ্য পাকিস্তানী সেনার কাছে মুজিবের আত্মসমর্পণের ঘটনাকে মহীয়ান করার জন্য এই শ্রেণীর যুক্তির অভাব নেই। মুজিব নাকি বাঙ্গালী জাতিকে রক্ষা করার জন্য পাক-বাহিনীর কাছে স্বেচ্ছায় বন্দী হয়েছিলেন! তিনি ধরা না দিলে নাকি পাক-বাহিনী বাঙ্গালী জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিত অথবা অনেক বেশী লোক হত্যা করত! কারও কারও মতে পাক-বাহিনী তাঁকে হাতে না পেলে ঢাকা নগরকে ধ্বংস্তূপে পরিণত করত। মুজিব ধরা দেওয়ায় নাকি পাক-বাহিনীর রোষ কমেছিল, ফলে ধ্বংসযজ্ঞ স্তিমিত হয়েছিল! যেন পাক-বাহিনী এ দেশে ধ্বংস এবং হত্যা কম করেছিল!

তাহলে পাক-বাহিনীর হাতে ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর গল্প কেন করা? যেন ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু খুব কম মানুষের মৃত্যু! যেন এটা হত নয় মাসে কয়েক কোটি অথবা প্রায় পুরো সাত কোটিই! কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কথা যাঁরা বলেন তাঁরা কোন্‌ হিসাবের ভিত্তিতে এ কথা বলেন? পাকিস্তানের কারাগার অথবা কলকাতার নিরাপদ আশ্রয় থেকে এসে যাঁরা পাক-বাহিনীর হাতে ত্রিশ লক্ষ মানুষের মৃতুøর গল্প ফাঁদেন তাঁরা বাস্তবে কোনদিন সারা দেশব্যাপী একটা জরীপের প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেন নি। কত লোক মরেছে, কোথায় কীভাবে মরেছে, কারা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কারা স্বাধীনতার বিপক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে, সেসবের কোন জরীপ কি তারা কোন দিন করেছে, নাকি করার প্রয়োজন বোধ করেছে? এমন কি মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়েও বেশী দরকার ছিল দেশদ্রোহীদের তালিকা এবং কর্মকাণ্ডের তথ্য। কারণ স্বাধীন রাষ্ট্রে তাদের শাস্তির প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। না, সেসব কিছুই করা হল না। কারণ তাহলে যে অনেক দায়িত্ব এসে পড়বে! আসলে নিদারুণভাবে নির্বীর্য ও ভীরু-কাপুরুষ, সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, মিথ্যাচারী, ফাঁকিবাজ, প্রতারক ও ভণ্ড একটা শ্রেণীর জন্য তথ্য ও সত্যের বাস্তবতাকে ভয় পাওয়াই সঙ্গত। কারণ প্রতারণা ও ফাঁকি যার পুঁজি, আসল পুঁজির অভাব পূরণের জন্য তাকে মিথ্যার ফানুশ উড়াতে হয়। কাজেই সঠিক তথ্যের পথগুলোকে তাকে বন্ধ করে রাখতে হয়।

এই রকম এক শ্রেণীর পক্ষে মুজিবের আত্মসমর্পণের সপক্ষে এমন যুক্তি দেওয়া সম্ভব যে, দেশবাসীকে বাঁচাবার জন্য মুজিব স্বেচ্ছা-বন্দীত্ব বরণ করেছিলেন। নেতার কাপুরুষতা, দায়িত্বহীনতা, মিথ্যাচার এবং প্রতারণা ঢাকবার জন্য কী উদ্ভট এক যুক্তি! এই যুক্তি শুধু উদ্ভট এবং মিথ্যা নয়, এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক এক যুক্তি। কারণ বাংলাদেশ কখনও বহিঃশত্রু দ্বারা আক্রান্ত হোক এটা আমরা না চাইলেও যদি তেমন ঘটনা কখনও ঘটে তবে এই (কু)যুক্তিওয়ালাদের কথা মেনে এবং মুজিবের পথ অনুসরণ করে যুদ্ধজনিত লোকক্ষয় কমাবার বা এড়াবার জন্য আমাদের রাষ্ট্রের নেতৃত্বের কী করণীয় হবে?

বাংলার এক কবি বলেছেন, ‘মহাজ্ঞানী, মহাজন/যে পথে করে ভ্রমণ/ হয়েছেন চিরস্মরণীয়,/ সেই পথ লক্ষ্য করে/ স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে/ আমরাও হব বরণীয়।’ সুতরাং যে পথে ভ্রমণ করে শেখ মুজিব এদের নিকট চিরস্মরণীয় হয়েছেন আমাদের রাষ্ট্রের দিশারীদেরও কি সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে বরণীয় হবার কাজ করতে হবে না?

সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান মন্ত্রীকে দেশকে ফেলে দিয়ে সবার আগে শত্রু সেনার নিকট আত্মসমর্পণ করতে হবে না কি? অবশ্য তার আগে মন্ত্রীদেরকে যার যার পথ বেছে নিতে বলতে হবে। কিন্তু তিন সশস্ত্র বাহিনীর লোক ক্ষয় কমাবার জন্য তিন বাহিনী প্রধানদেরও কি কোন দায়িত্ব থাকবে না? হাঁ, তিন বাহিনীর প্রধানদেরকেও এই পথ অনুসরণ করে শত্রুর হাতে বন্দীত্ব বরণ করা উচিত হবে। আর যুদ্ধ? তার জন্য তো সশস্ত্র বাহিনীর সাধারণ অফিসার এবং সৈনিকরাই থাকল! অবশ্য যদি তারা যুদ্ধ করাটা একান্ত প্রয়োজন মনে করে তবে!

তবে লোক ক্ষয়ের কুযুক্তি বা উদ্ভট যুক্তি দিয়ে যে শ্রেণীটা মুজিবের আত্মসমর্পণকে সমর্থন করে তারা প্রকৃতপক্ষে কোন যুদ্ধই কোন কালে চায় নি। এরা স্বাধীনতাও চায় নি। তারা চেয়েছিল পাকিস্তানের কাঠামর ভিতরেই থাকতে। ৬ দফা ছিল তাদের কাছে ২১ দফার রকমফের মাত্র। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে উভয় কর্মসূচীর মধ্যে মিলও আশ্চর্য রকম। সুতরাং এবারও তার একই পরিণতি হতে পারত।

কিন্তু এ দেশে বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের উত্থান এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী সৈনিকদের ভিতর পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে ঘৃণার তীব্রতা এখানে পাকিস্তানের অস্তিত্বের কোন বাস্তবতা রাখে নি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের পূর্বে এবং পরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী অফিসার ও সৈনিক, বিশেষ করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ধ্বংস অনিবার্য করে তুলল।

ভারত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আত্মসাৎ করে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানকে ভাঙ্গার জন্য ভারতে পলাতক ও আশ্রয় গ্রহণকারী আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হল তার উপযুক্ত হাতিয়ার।

বস্তুত আওয়ামী লীগ শুধু একটা দল নয়, এক অর্থে এটা একটা শ্রেণীও, যা মর্মমূলে চরম সুবিধাবাদী, ন্যায়-নীতিহীন এবং প্রতারক। এটা ফাঁকিবাজ, অসৎ এবং লোভী বলে সর্বদা অন্যের শ্রমের ফল ও অবদান আত্মসাতের ফন্দি-ফিকির খোঁজে। এটা অন্যের সকল অবদান ও কৃতিত্ব অস্বীকার করে তাকে সম্পূর্ণরূপে নিজের বলে চালায়। লোভের কারণে এটা দেশদ্রোহিতা থেকে শুরু করে যে কোন নীচতায় নামতে পারে।

সুতরাং এটা চরিত্রে দুবৃêত্ত। কিন্তু এটা এমন দুর্বৃত্ত যার সাহস নেই। সুতরাং এটা স্বার্থের প্রয়োজনে অথবা বিপদ দেখলে খুব সহজে বহিঃশক্তির আশ্রয় নেয়, তার তাবেদার হয়। তবে সুযোগ সন্ধানী বলে সহজেই তা সুযোগ বুঝে প্রভু বদলাতে পারে। তাতে তার মুহূর্তও দেরী হয় না। এর কারণে দেশের ভিতর থেকে কোন স্বাধীন, দেশ প্রেমিক ও আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন শক্তির উত্থান দুরূহ হয়ে থাকে। কারণ বিদেশীরা এ দেশে তেমন কোন শক্তির উত্থান রোধে খুব সহজেই এর সাহায্য পায়। স্বাধীনভাবে থাকার যে দায়-দায়িত্ব তার চেয়ে বাইরের বৃহৎ ও পরাক্রান্ত দুর্বৃত্ত ও লুটেরাদের তাবেদার হয়ে থাকতে এবং প্রভুদের তুলনায় ছোটখাট দুর্বৃত্তপনা করে বাঁচতেই তা বেশী পছন্দ করে। কিন্তু বাইরের বৃহৎ লুণ্ঠনকারী শক্তিসমূহের মধ্যে তাদের বৃহত্তের কারণে যেটুকু বিবেচনা ও ঔদার্য থাকে এর সেটুকুও থাকে না। নীচু স্তরের নোংরা, নৃশংস ও অমানবিক কাজগুলো বিদেশী প্রভুরা এ সমাজে একে দিয়েই করায়। ফলে নিজ সমাজের দুর্বল ও অসহায় মানুষের উপর এর পীড়নের কোন সীমা-পরিসীমা থাকে না।

প্রকৃতপক্ষে এই শ্রেণী চরিত্রে দুর্বৃত্ত। তবে এটা এমন দুর্বৃত্ত যার নিজস্ব সাহস ও মর্যাদা বোধের অভাব এবং সুবিধাবাদের কারণে তা কথায় কথায় পায়ে পড়তে পারে। কিন্তু এটা হিংস্রতায় পরিপূর্ণ। যেহেতু এর সাহস নেই অথচ হিংস্র সেহেতু সুযোগ সৃষ্টির জন্য শ্রম ও চেষ্টা করে না, বরং সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র পিছন থেকে মাথায় লাঠির বাড়ি কিংবা বিষধর সাপের মত ছোবল মারতে পারে। ভীরু, কাপুরুষ অথচ লোভ, হিংস্রতা ও নিষ্ঠুরতায় পরিপূর্ণ একটা শ্রেণী এটা। ভাসানী এটার কথায় কথায় পায়ে পড়া দেখেছেন আবার ছোবল খেয়ে বিষজর্জরও হয়েছেন।

হাঁ, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা দ্বারা মুজিব যদি কারও পিতা হয়ে থাকেন তবে সেটা এই শ্রেণীর। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান এক দুর্বৃত্ত শ্রেণীর পিতার নাম। আজকের দেশ ব্যাপী দুর্বৃত্তায়ন, লুণ্ঠনতন্ত্র এবং দুর্নীতির এই ভয়াবহ রূপের জন্য সবচেয়ে বেশী যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তবে সেটা তাঁকেই করতে হবে। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ নিয়ে দুর্নীতি, অন্যায়, লুণ্ঠনের সূচনা হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই।

পাকিস্তান আমলে এই শ্রেণীর বিকাশ হলেও সেটা ছিল যথেষ্ট প্রাথমিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। লোভ, দুর্নীতি, আদর্শহীনতা তখনও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে না থাকায় কিংবা কখনও তা ব্যবহারের কিছু সুযোগ পাওয়া গেলেও মূল নিয়ন্ত্রণ হাতে না পাওয়ায় তার দুববৃêত্ত রূপ ছিল এখনকার তুলনায় অনেকটা সংযত। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র হাতে পাবার পর এই শ্রেণী স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। এখনও নিশ্চয় অনেকে ’৭২ থেকে শুরু করে মুজিবের শাসনের সেই দিনগুলো স্মরণ করতে পারবেন। কী উন্মত্ততায় লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, হত্যা এবং ধর্ষণ করে চলেছিল মুজিবের চ্যালা-চামুণ্ডারা। ১৯৭২-এর ২১ ফেব্রুয়ারীর মত মহান দিবসের ভোর ভোর সময়ে শহীদ মিনারে সমবেত যুবতী ও কিশোরীদের উপর দলে দলে মুজিববাদী যুবকদের সেই উন্মত্ত ধর্ষণ উৎসবের স্মৃতি কি এতই ফিকে হয়ে গেছে? সেইসব পাষণ্ডদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা মুজিব সরকার যে নেয় না সেটাই কি স্বাভাবিক না? হাঁ, এভাবেই মুজিবের ‘সোনার বাংলার সোনার ছেলেরা’ দেশের ভবিষ্যৎ হিসাবে তৈরী হচ্ছিল।

শেখ মুজিব এক দুবৃêত্ত শ্রেণীর পিতা, এক লুঠেরা বর্গী দলের নেতা। তিনি কয় টাকা আত্মসাৎ করেছিলেন সেটা কোনও বিচার্য বিষয় নয়। তিনি কোন শ্রেণীর জন্ম দিয়েছিলেন, কোন শ্রেণীকে কীভাবে লালন করেছিলেন সেভাবেই তার বিচার হবে।

শেখ মুজিব যদি এই দুর্বৃত্ত শ্রেণীর পিতা হন তবে আমরা সহজেই মুজিবের গুরু এবং মীর জাফরের যথাযথ উত্তরাধিকারী সোহরাওয়ার্দীকে চিনব এই দুবৃêত্ত শ্রেণীর পিতামহ রূপে।

শুরুরও শুরু থাকে। আর তাই এই শ্রেণীর এক পর্যায়ের আদিতে আমরা পাই মীর জাফরকে। নওয়াব সিরাজ উদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান কি শুধু একজন ব্যক্তি যিনি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের কাছে বাংলা-বিহারের নওয়াবী রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন? না, তিনি শুধু একটা ব্যক্তিই নন, তিনি একটা শ্রেণীও বটে, তিনি একটা শ্রেণীর শুধু প্রধান অংশের না, তিনি একটা শ্রেণীর বিপুলভাবে গরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধি, নেতা। তাই ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় নওয়াবের সেনাবাহিনীর প্রায় ৬৭ হাজার সৈন্যের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য তার অনুগত হয়ে লড়াই না করে দাঁড়িয়ে থেকে তামাশা দেখল। কারণ তারা পক্ষ নিয়েছিল ইংরেজদের। অর্থাৎ অঙ্কে হিসাব করলে নওয়াবী রাষ্ট্রের তিন চতুর্থাংশ তথা চার ভাগের তিন ভাগই চলে গিয়েছিল বিদেশী ভিন্নধর্মী ইংরেজদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতার হস্তান্তরের পক্ষে।

এর তাৎপর্য বুঝতে হবে। যে বহিরাগত মুসলিম শাসক শ্রেণী বাংলা শাসন করত তার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই স্বাধীন থাকতে চায় নি। রাষ্ট্রটা ছিল সামরিক এবং সেনাবাহিনী ছিল প্রধানতই মুসলমানদের নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্র সামরিক হওয়ায় সামরিক কর্মকর্তারাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করত রাষ্ট্রকে, যাদের অধিকাংশ ছিল মূলত বহিরাগত। কাজেই বুঝতে হবে বহিরাগত মুসলমান শাসক শ্রেণীই আর স্বাধীনভাবে থাকতে চায় নি।

হিন্দুরা ছিল শাসিত। তাদের একটা অংশ শাসন কার্যে বড় জোর বহিরাগত মুসলিম শাসকদের সহযোগী। সুতরাং উচ্চপদস্থ হিন্দুদের ক্ষেত্রে মীর জাফরের সহযোগী হবার ব্যাপারটা ছিল এক প্রভু থেকে আর এক প্রভুর অধীনে যাবার পক্ষে মত দেবার ব্যাপার। কিন্তু মুসলমান শাসক শ্রেণী কেন এমন সিদ্ধান্ত নিল?

সেটা আর এক আলোচনার বিষয়। কিন্তু একটা বিষয় আমরা এ থেকে স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি। সেটা হচ্ছে বাংলার বহিরাগত মুসলমান শাসক বা অভিজাত বর্গ শত শত বৎসর এ দেশে বসবাস করেও দেশটাকে কখনও আপন ভাবতে পারে নি, বরং ঘৃণা করেছে এবং এ দেশীয়দের তুলনায় তারা যে কোন বিদেশীর সাহচর্যে এমনকি শাসনেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছে। সুতরাং তারা যে শুধু তাদের নওয়াবকে প্রতারণামূলকভাবে ইংরেজদের হাতে তুলে দিয়েছিল তাই নয়, উপরন্তু সমগ্র ব্রিটিশ শাসন কালে বাংলার আশরাফ শ্রেণীর ভুমিকা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের আশরাফ শ্রেণীর তুলনায় ইংরেজদের প্রতি অনেক বেশী সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহের আঁচ এ বাংলায় প্রায় লাগেই নি। হাঁ, জন্ম দেশদ্রোহী, গণ-বিরোধী এবং বিদেশীদের নিকৃষ্ট চরিত্রের দালাল বাংলার মুসলিম অভিজাত শ্রেণীর খুব বড় অংশটাই। আধুনিক কালে এদেরই এক দক্ষ ও শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন সোওরাওয়ার্দী।

বাংলা ও বাঙ্গালীর দুর্ভাগ্য বাংলার জন-সমাজ থেকে উঠে আসা আদর্শনিষ্ঠ নেতা ভাসানীর অনুগত না থেকে জন-সমাজ থেকে উঠে আসা অপর এক নেতা মুজিব লাভে ও লোভে অনুসারী হলেন এমন এক নিকৃষ্ট শ্রেণীর নেতা সোহরাওয়ার্দীর। আর এভাবে উদীয়মান মধ্যবিত্তকে যেমন তিনি বিপথগামী করলেন তেমন এই মধ্যবিত্তের পিছনে ছিল যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা তাদের তিনি করলেন আশাহত, প্রতারিত এবং পথভ্রষ্টও।

সুতরাং বলতে হবে, সোহরাওয়ার্দীর অনেক গুণ, অনেক ক্ষমতা এবং দক্ষতা ! আধুনিক কালে এই জাতিকে প্রথম কার্যকরভাবে নীতিভ্রষ্টতা শিখিয়েছেন তিনি। তাঁর পথ ধরেই মুজিবের উত্থান। ঐ একই পথে জিয়া এগিয়েছেন।

সুতরাং ব্যক্তি জিয়া আর্থিক ক্ষেত্রে কী ছিলেন তা দিয়ে তাঁর বিচার হবে না। তিনি একটা দুর্বৃত্ত শ্রেণীকে কীভাবে হৃষ্টপুষ্ট করেছিলেন তা দিয়েই তাঁর বিচার হবে।

ক্ষমতার লোভে নীতি-নৈতিকতাহীনভাবে দল গঠন করলেন তিনি। তিনি মুসলিম লীগের অধঃপতিত, জাতিদ্রোহী লোকদেরকে তাঁর দলে এনে জড়ো করলেন। আওয়ামী লীগ শাসন কালে বিধ্বস্ত, বিপন্ন ন্যাপ ও বামপন্থীদের বিপন্ন অবস্থাকে তিনি পুরোপুরি কাজে লাগালেন তাঁদেরকে আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা বিচুøত করে নিজ দল গঠনের জন্য। জেল থেকে অপরাধীদের বের করলেন তিনি তাঁর দলের শক্তি বৃদ্ধির জন্য। অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা দু’হাতে ছিটিয়ে তিনি চরিত্র হনন করলেন ছাত্র ও যুবকদের। যুবকদের অর্থ দিয়ে বশীভূত করার জন্য করলেন সারা দেশে যুব কমপ্লেক্স। মুজিবও এত বুদ্ধিমান, এত কৌশলী ছিলেন না। মুজিব ছিলেন এমন একটা দলের নেতা যার সদস্যরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একেবারে অমার্জিত, ইতর এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উচ্ছৃঙ্খল-বিশৃঙ্খল বর্গীর দলের মত। এই দল লুণ্ঠন যতটা করবে তার চেয়ে অনেক বেশী ভাঙ্গবে, জ্বালাবে, ফেলবে, নষ্ট করবে। হাভাতে হঠাৎ প্রচুর খাবার পেলে যেমন করে এদের আচরণ অনেকটা তেমন।

কিন্তু সুচতুর জিয়া জাতির চরিত্র হননে অনেক বেশী দক্ষ কারিগর। নিজ ক্ষমতার স্বার্থে মানুষকে আদর্শভ্রষ্ট, ন্যায়-নীতি বোধচ্যুত করার মধ্যে যে ব্যক্তি চরম সার্থকতা খুঁজে পান সেই ব্যক্তি যে আসলে কতটা নির্বিবেক, বিকারগ্রস্ত এবং জাতির জন্য যে কতটা অশুভ হতে পারেন তার প্রমাণ চূড়ান্তভাবে পেয়েছে এই দেশ। যে আদর্শ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তারই ফসল তাঁর স্ত্রী, পুত্ররা, পরিবার এবং তাঁর দল বিএনপি। মাকাল গাছে মাকাল হবে না তো কি আম হবে?

(দ্বিতীয় পর্ব)

যাঁরা হাসিনা বা খালেদাকে দল থেকে বাদ দিয়ে বা নির্বাসনে পাঠিয়ে রাজনৈতিক দলের সংস্কারের কথা বলেন তাঁরা দলের অর্থনৈতিক-সামাজিক ভিত্তি তথা শ্রেণী ভিত্তিকে হিসাবে নেন বলে মনে হয় না। হাঁ, মূলত রাজনীতি দ্বারা এই শ্রেণী গঠিত হয়েছে। কারণ বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এবং রাষ্ট্র ক্ষমতার সাহায্যে এই দলের সমর্থক ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক এবং সেই সঙ্গে সামাজিক ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে। আর হাতে টাকা এলে অনেক কিছু হয়। জমি, বাড়ী, গাড়ী, ব্যবসা, কারখানা, কর্মচারী, সুবিধাভোগী, অনুগত ও কৃপা বা সুবিধা প্রার্থী লোকজন, প্রভাব-প্রতিপত্তি, ছেলেমেয়েদের ভাল জায়গায় লেখাপড়া ও তাদের বিদেশ গমন এবং ভাল বিবাহ থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছু হয় এই টাকার জোরে। রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতার গুণে এই টাকা। স্বাভাবিকভাবে আমাদের দেশে এর সঙ্গে নীতি-নৈতিকতার কোন সম্পর্ক নেই। থাকলে এভাবে রাতারাতি বিনাশ্রমে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ এমনকি বট গাছ হওয়া যায় না।

এই অর্থের ভিত্তি রাজনীতি ও রাষ্ট্র ক্ষমতা। কিন্তু একবার অর্থ হলে যে ভিত্তি গড়ে ওঠে সেটাই তখন রাজনীতিরও ভিত্তি হয়ে পড়ে। ফলে ক্ষমতায় থাকার বা আরোহণের শক্তিও সেটা হয়। দেশে বিপুল অর্থ-বিত্তের অধিকারী শ্রেণী গঠন হওয়ায় এখন আর অতীতের মত প্রায় খালি হাতে রাজনীতি করা যায় না। এখন সব কিছু ব্যয়বহুল। যোগাযোগ, প্রচার, কর্মীদের ভরণ-পোষণ বা আর্থিক প্রয়োজন সবকিছুর জন্য এখন প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এই অর্থ কারও না কারও হাতে আছে যা তারা ব্যয় করতে পারে। ফলে অর্থ যাদের কম তারা যত আদর্শনিষ্ঠ এবং যোগ্য হোক, ক্ষুদ্র পরিসরে তাদের যতই ভূমিকা থাকুক বৃহৎ পরিসরে বা জাতীয় পরিসরে রাজনীতিতে তাদের কোন অবস্থান রাখার উপায় থাকে না। অর্থের অভাব যাদের আছে এই অসম প্রতিযোগিতায় তাদের টেকার কোন উপায়ই নেই।

এ গেল একদিক। অন্যদিকে অনৈতিকভাবে বা দুর্নীতির মাধ্যমে একটা বিত্তবান এমনকি মধ্যবিত্তের এক বড় অংশ গড়ে উঠায় রাজনীতি হয়ে পড়েছে সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিগ্রস্ত তথা দুর্বৃত্তায়িত। অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তরা দুর্বৃত্তদেরকেই অর্থ দিয়ে, নানান রকম সহায়তা দিয়ে রাজনীতিতে নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করবে। বাস্তবে মূলত দুর্বৃত্তরা হচ্ছে এখন নেতা। এটা শুধু রাজনীতিতে নয়, বরং প্রায় সবখানে। কারণ যে কথা আগেও বলেছি এই শ্রেণীর উত্থান হয়েছে মূলত দুর্নীতি ও লুণ্ঠন তথা দুবৃêত্তায়নের মাধ্যমে। দুর্বৃত্তায়নের অংশ না হলে কার্যকর অর্থনৈতিক শক্তি হওয়া এই ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। ফলে অর্থের জোরে দুর্বৃত্তায়ন যে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে শেষ পর্যন্ত গ্রাস করবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই অবস্থাই আজ বাংলাদেশে বিরাজ করছে।

এ দেশে দুর্বৃত্ত শ্রেণীর দুইটি প্রধান দল, একটি আওয়ামী লীগ অপরটি বিএনপি। রাষ্ট্র ক্ষমতার ব্যবহার অথবা আরও সঠিকভাবে বললে অপব্যবহার দ্বারা এই উভয় দলেরই বিশাল কর্মী, সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। তারা সকলে যার যার দলের রাজনীতির সুবিধাভোগী। এই কারণে শেখ মুজিব নিহত এবং তার দল ক্ষমতাচ্যুত হলেও ধ্বংস প্রাপ্ত হয় না। বরং তার সামাজিক ভিত্তি বা শ্রেণীর জোরে একুশ বৎসর পরে হলেও ১৯৯৬-তে ক্ষমতায় ফিরে আসে এবং ২০০১-এ ক্ষমতা হারালেও পুনরায় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাবার স্বপ্ন দেখে।

এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে আমাদের উচ্চ ও মধ্যবিত্তের বিপুল গরিষ্ঠ অংশ প্রায় এক প্রজন্মেই এসেছে গ্রাম এবং কৃষক ভিত্তি থেকে। একটা সহজ উদাহরণ দিলে ঘটনাটা স্পষ্ট হবে। ১৯৭১-এর পূর্ব পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা ৪/৫ লক্ষ ছিল। ১৯৭২-এ সম্ভবত ৫ লক্ষ ছিল। সবাই নিশ্চয় মধ্যবিত্ত ছিল না। তাদের সংখ্যা অর্ধেকের কম থাকাই স্বাভাবিক। বাকী অর্ধেকের বেশীরভাগ ছিল দরিদ্র ও শ্রমজীবী, গৃহভৃত্য, পিয়ন জাতীয় নিম্ন শ্রেণীর কর্মচারী এবং বস্তিবাসী ইত্যাদি। এখন ঢাকার জনসংখ্যা ১ কোটি ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ। সুতরাং বলা যায় দেড় কোটির কাছাকাছি। ৩৫ বৎসরে নাগরিক সংখ্যার কী অবিশ্বাস্য বিস্তার! এর মধ্যে যদি ৪০/৫০ লক্ষ লোক মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হয় তাহলে বোঝা যাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বা সুবিধাভোগীর পরিমাণ কত বড় হতে পারে। তবে নিশ্চয় বিশেষত মধ্যবিত্তের সবাই এমনকি এক বৃহৎ অংশই যে প্রত্যক্ষভাবে কোন দলের সুবিধাভোগী এমনটা মনে করাও ঠিক নয়। কিন্তু যারা সুবিধাভোগী তাদের সামাজিক অবস্থান এবং ভূমিকা দিয়েই বিষয়টাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এবং বুঝতে চেষ্টা করতে হবে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের শক্তির বিষয়টাকে।

একবার দল দ্বারা এই সুবিধাভোগীদের শ্রেণী বা সামাজিক অবস্থান তৈরী হয়ে গেলে সেটা হয়ে পড়ে দলের এমন রক্ষাব্যূহ যা ভেদ করা না গেলে সেই দলকে আর ভাঙ্গা যায় না। উপরের তলায় কিছু ভাঙ্গন ঘটানো যেতে পারে। কিছু নেতাকে ভাগিয়ে নিয়ে নূতন দল গঠন করা যায়, কিংবা কিছু নেতা বেরিয়ে গিয়ে নূতন দল গঠন করতে পারে, কিন্তু তাতে দলের ভিত্তিকে নড়ানো যায় না। এটা শুধু লীগের অভিজ্ঞতার শিক্ষা নয়, বিএনপি-এরও অভিজ্ঞতার শিক্ষা।

লীগের মত স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়ার বিজড়ন এবং ১৯৭১-এর ২৭ মার্চের ঘোষণা জিয়াকে বিশেষ ভাবমূর্তি ও মর্যাদা দিয়েছিল। ১৯৭৫ পরবর্তী কালে সেনা প্রধান ও রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে এই ভাবমূর্তি ও মর্যাদা এবং রাষ্ট্র ক্ষমতাকে ব্যবহার করে তিনি বিএনপি গঠনের প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সমান্তরালে তাঁর দলেরও একটি শ্রেণী ভিত্তি গঠন করলেন। এরপর দেশে পুরাতন বা প্রতিষ্ঠিত ধারার বাইরে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের নূতন করে বিকাশের আর তেমন কোন সুযোগ ছিল না।

সুতরাং ১৯৮২-এর ২৪ মার্চ সেনা প্রধান এরশাদ জিয়ার উত্তরাধিকারী বেসামরিক রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিভিন্ন দল ছুটদের নিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করলেও নিজের আর তেমন কোন শ্রেণী ভিত্তি গঠন করতে পারেন নি। তাই তাঁর দল বর্তমানে ক্রম ক্ষয়প্রাপ্ত বা বিলীয়মান একটা দল, যার আর কোন ভবিষ্যৎ নেই।

আমার ধারণা লীগের গোটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে নিয়েও যদি নূতন দল গঠন করা যায় তবু সেটা দাঁড়াবে না। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতাদের সবাই মিলে একমত হয়ে যদি শেখ হাসিনাকে দল থেকে বহিষ্কার করে নেতৃত্ব দখল করে তবু শেখ হাসিনার পিছনেই থাকবে লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী ও সমর্থক। বাকীদের দলের অফিসে শেষ পর্যন্ত বাতি জ্বালাবার লোক পাওয়াও মুশকিল হবে। অর্থাৎ শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ হবে না। হাসিনা না থাকলে তার ছেলে জয় আসবে। জয় আসতে না চাইলে লীগের কর্মীরাই নিয়ে আসবে শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানাকে। রেহানাকেও পাওয়া না গেলে শেখ মুজিব পরিবার বা বংশের কাউকে ধরে নিয়ে আসবে নেতা বানাবার জন্য।

এই একই কথা প্রযোজ্য খালেদা জিয়া বা জিয়ার পরিবার সম্পর্কে। ওদের কাউকে বাদ দিয়ে বিএনপি হবে না। জোর করে করা যেতে পারে তবে সেটা টিকবে না। যারা অন্যত্র যাবে তারাও প্রায় সবাই নাক-কান মলে খালেদার কাছে বা খালেদা না থাকলে তার ছেলের কাছে ফিরে আসবে এবং বলবে যে ঘরের ছেলে হিসাবে তারা ঘরে ফিরে এসেছে।

আর দুর্নীতি? তার জন্য কিছু দিন অসুবিধা থাকলেও ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ বেশী দিন কোন কিছু মনে রাখে না। আর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট না হলে সেটা জানতেও চায় না। মনে রাখা তো দূরের কথা। এই কারণে ষাটের দশকে স্বাধীনতার রাজনীতি ও আন্দোলন যে বামপন্থীরা ছাড়া হওয়া অসম্ভব ছিল তাদের সে ভূমিকা নিয়ে কোন আলোচনাই প্রায় কেউ দেশে করে না।

হাঁ, এই জনগোষ্ঠী খুব সামান্যই মনে রাখে। আমার মনে আছে ১৯৬৭ সালে আমি যখন দিনাজপুর থেকে ট্রেনে ঢাকার দিকে আসছিলাম তখন এক ভদ্রলোকের কথা। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কোন এক গ্রামে তার বাড়ী। এখন সেটা মনে নেই। তার সঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের প্রসঙ্গ উঠতে তিনি যে কথা বললেন সেটা আমার আজও হুবহু মনে আছে, ‘শেখ মুজিব চোর হোক আর যা-ই হোক বাঙ্গালীর কথা তো বলে!’ ’৫৬-’৫৭-তে ভূমিকার কারণে তার ভাষায় মুজিব চোর। কিন্তু এখন তিনি ভাল। কারণ তিনি ৬ দফা দিয়েছেন।

বিএনপি-এরও তেমন কিছু করতে অসুবিধা হবে কি? এ দেশে ইস্যু তৈরী হতে কত সময় লাগে? সমস্যা আছে, সংকট আছে, বিদেশীদের লোভাতুর দৃষ্টি আছে। সুতরাং হিরো থেকে জিরো এবং পুনরায় জিরো থেকে হিরো হতে কত সময় লাগবে তা কে বলতে পারে?

কেউ যদি মনে করেন হাসিনা এবং খালেদাকে বাদ দিয়ে লীগ, বিএনপি-এর পুনগর্ঠন সম্ভব তবে বলতে হবে তারা এ দেশে উচ্চ শ্রেণী তথা নেতৃত্বকারী সামাজিক শ্রেণী গঠনের বাস্তবতাকে হিসাবে নেন না। বন্দুকের জোরে এদের বাদ দিয়ে কিছু লোক নিয়ে নূতন দল গঠন ক’রে কিংবা পুরাতন দল পুনর্গঠন ক’রে নির্বাচন করা যেতে পারে। কিন্তু গোটা বিষয়টা হবে একেবারে কৃত্রিম এবং ঠুনকো বা ভঙ্গুর। এতই ভঙ্গুর হবে সেই নির্বাচিত সরকার যে তার ভেঙ্গে পড়তে মোটেই সময় নিবে না। গ্রীন হাউজে চাষ করে কি আর দেশের চৌদ্দ-পনেরো কোটি মানুষের খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব? এ দেশের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কহীন ইউরোপীয় গণতন্ত্রের কল্পনাও গ্রীন হাউজ গণতন্ত্রের কল্পনা ছাড়া আর কিছু না।

এ দেশের মূল শাসক বা নেতৃত্বকারী শ্রেণীকে যদি আমরা একটি সামগ্রিক শ্রেণী হিসাবে ধরি তবে সেটা যে দুই প্রধান দলের অনুগত হয়ে আছে সেই দল দুইটির একটি আওয়ামী লীগ, অপরটি বিএনপি। এই দুই দল মানে তার মূল নেতা দুই ব্যক্তি। শেষ পর্যন্ত এই দুই ব্যক্তি একটি শ্রেণীরও প্রতীক।

এই শ্রেণীর পিছনেই মধ্যবিত্তসহ জনগণের ব্যাপক অংশ আছে। কারণ জনগণের জীবন- জীবিকা, মতামত এবং চিন্তা নিয়ন্ত্রণের যাবতীয় হাতিয়ার এদের হাতে। এদের হাতে অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ। সুতরাং প্রচার মাধ্যম এদের হাতে। সংগঠনের যত রকম রূপ আছে প্রায় সবই এদের হাতে।

এই শ্রেণী তার প্রয়োজনে তার দুই প্রধান রাজনৈতিক দল লীগ-বিএনপি-এর পিছনে থাকে বলে জনগণও সাধারণভাবে তাদের পিছনে যায়। বিশেষত ভোটের রাজনীতিতে সেটাই সাধারণ নিয়ম।

এটা ঠিক যে বিএনপি-এর দানবীয় দুর্নীতি ও লুণ্ঠন এবং নির্যাতন-সন্ত্রাসের ফলে এখন তার জন-সমর্থন সাংঘাতিক হ্রাস পেয়েছে। এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে তার ভরাডুবি হবে।

কিন্তু তাতে কী হবে? বিএনপি-এর শ্রেণী ভিত্তি যেটা ১৩/১৪ বৎসর সরাসরিভাবে ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরী হয়েছে সেটা যাবে কোথায়? সেই শ্রেণী ভিত্তিই শেষ পর্যন্ত বিএনপি-কে ফিরিয়ে আনবে। শুধু বিএনপি-কে নয় সেই সঙ্গে খালেদা জিয়া বা তার কোন একজন পুত্র বা পরিবারের আর কাউকে।

কিন্তু কেন পরিবারের একজন হতে হবে? আমার ধারণা এর দুইটা প্রধান কারণ। একটা হচ্ছে সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব যেখানে তারা একজন রাজা বা রাজার অভাবে রাণী খোঁজে। অর্থাৎ তার রাজতন্ত্র চাই এবং তাতে চাই একজন রাজা বা রাণী। এ কালে রাজা, রাজতন্ত্র না থাকতে পারে কিন্তু রাজকীয় মর্যাদা লাভকারী পরিবার ও পরিবারতন্ত্র তো থাকতে পারে! সুতরাং পশ্চাৎপদ ভোটারদের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে একজন রাজকীয় নেতার শাসন এবং তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের একজনের শাসন চমৎকার খাপ খায়।

কিন্তু এ না হয় আম জনতার মনস্তত্ত্ব, কিন্তু দলের মোটামুটি লেখাপড়া জানা নেতা-কর্মীদের সমস্যাটা কোথায়? একটা ব্যাপার তো আছেই, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটের বিবেচনা। কিন্তু আর একটা গুরুতর ব্যাপার আছে বলে আমার ধারণা। সেটা কী? সেটা হচ্ছে দুর্নীতি বা দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে দলের শ্রেণী ভিত্তি গঠন ও বর্ধন। যেহেতু নীতি-নৈতিকতা, নিয়ম এবং আদর্শ চর্চা দল গঠনের ভিত্তি নয়, বরং মুখে নিয়ম, নীতি-নৈতিকতার কথা বলা হলেও কাজে তার লঙ্ঘন, এবং দুর্নীতি, অনিয়ম, দুর্বৃত্তপনা এবং লুণ্ঠন হচ্ছে দলের নেতা-কর্মী এবং দল সংশ্লিষ্টদের প্রকৃতপক্ষে মূল লক্ষ্য, আদর্শ এবং কর্মসূচী সেহেতু মূল নেতার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য হচ্ছে দলের ঐক্য বা সংহতি রক্ষার মূল শর্ত।

নেতা হচ্ছে দলের ঐক্যের মূল সূত্র। সে না থাকলে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে তার পরিবারের একজন থাকবে। এ হল রামায়ণে বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ী রামের বনবাসের সময় তার অনুপস্থিতিতে তার খড়ম জোড়াকে সিংহাসনে রেখে তার ছোট ভাই ভরত কর্তৃক রাজ্য শাসন। খড়ম রাজ্য শাসন করে না। তবু সেটাকে সিংহাসনে রাখা হয় রামের স্মারক বা প্রতীক হিসাবে। লীগ, বিএনপি-এর ক্ষেত্রে হাসিনা, খালেদা মানবিক স্মারক বা প্রতীক। এদের লাগবেই। তা না হলে এই শ্রেণী নিজের ভিতরকার ঐক্য হারিয়ে ছিন্নভিন্ন হবে এবং যেহেতু তা দুর্বৃত্ত সেহেতু তার সদস্যরা পরস্পরকে আক্রমণ ও ধ্বংস করবে কিংবা তারা ধ্বংস হবে বাইরের বা ভিন্ন দলের শত্রুদের আক্রমণে। এছাড়া রাষ্ট্র ও আইনের প্রতি ভীতি তো আছেই। এ হল ডাকাত দলের শৃঙ্খলার মত যেখানে ন্যায়-নীতি থাকে না বলে ডাকাত সর্দারের প্রতি নিঃশর্ত বা অন্ধ আনুগত্য দল রক্ষার মূল শর্ত। অবশ্য সর্দারেরও দায়িত্ব থাকে তার দলের সদস্যদের স্বার্থ রক্ষার প্রতি কম-বেশী সজাগ থাকার। তা না হলে দল ছেড়ে ডাকাত সদস্যরা চলে যাবে বা পৃথক দল গঠন করবে কিংবা সর্দারকে হত্যা করবে।

ডাকাত দল প্রকাশ্যে থাকে না। সুতরাং তার সদস্যরা মানুষের ভীড়ে লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক দল প্রকাশ্য এবং তার নেতা-কর্মীরা সবার কাছে পরিচিত ও চিহ্নিত। সুতরাং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে শ্রেণী গঠন হওয়ায় এই শ্রেণীর সদস্যরা সর্বদা এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার বোধে ভোগে। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতায় থাকা এবং না থাকা উভয় অবস্থাতেই দলবদ্ধতা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম পূর্বশর্ত। কোন মহৎ ও উন্নত আদর্শের চর্চা না থাকায় স্বাভাবিকভাবে নেতা বা তার পরিবারের প্রতি আনুগত্য এই দলবদ্ধতা রক্ষার প্রধান পদ্ধতি হয়ে দেখা দেয়।

সুতরাং আমি বিদ্যমান অর্থনীতির কাঠামতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-এর বাইরে আর কোন রাজনৈতিক দলের কার্যকরভাবে উত্থানের সম্ভাবনা আপাতত দেখছি না।

(তৃতীয় পর্ব)

এতক্ষণ আমি যে দুর্বৃত্ত শ্রেণী সম্পর্কে আলোচনা করেছি তাদের লুণ্ঠন, দুর্নীতি এবং নির্যাতন জনমনে যে ঘৃণা এবং রোষ জন্ম দিয়েছে সেটিও কিন্তু অপর একটি বাস্তবতা। এই শ্রেণীর মধ্যকার প্রধান দুই নেতৃত্বকারী দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-এর মধ্যে সংঘাত এবং এই দুই দলের প্রতি জনগণের অনাস্থার ফলে ১১ জানুয়ারীতে জরুরী অবস্থার মাধ্যমে পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হয়েছে। এই পরিবর্তন কোন দিকে যাবে তা নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও হয় নি। তবে ৩৫ বৎসরের দুর্বৃত্তায়ন ও লুণ্ঠনতন্ত্রের অবসান ঘটবার একটা সম্ভাবনা যে উপস্থিত হয়েছে সে কথা বলা যায়।

কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে অনেক কিছু বলা যায় না। শুধু যে আমাদের জন-বৈশিষ্ট্য এবং রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির গতিধারার মধ্যে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন পরস্পর বিরোধী অথবা অসঙ্গতিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও উপাদান আমাদের দেশের গতিধারাকে অনিশ্চিত করে রেখেছে তা-ই নয়, উপরন্ত বিভিন্ন বহিঃশক্তি বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট চাহিদাও আমাদের দেশের ভবিষ্যৎকে অনেকাংশে অনিশ্চিত করেছে।

যে দুর্বৃত্ত শ্রেণীর বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে এতক্ষণ আমরা আলোচনা করেছি সেই শ্রেণীর গঠন ও বিকাশে ব্রিটেন এবং পরবর্তী কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা খুব নির্ধারক। ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাস সময়ে নির্ধারক ছিল ভারতের ভূমিকা। আধুনিক কালে রাজনীতিতে এই শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটে ব্রিটিশ শাসন কালের শেষ দিকে। ব্রিটিশ শাসকদের আশ্রয়পুষ্ট মুসলিম লীগ হয়েছিল তাদের প্রধান রাজনৈতিক মুখপাত্র। এখানে সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। শুধু এইটুকু বলা যথেষ্ট যে, এই শ্রেণীর জন্ম, বিকাশ এবং প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে থেকেছে এবং সেই সঙ্গে থেকেছে বহিঃশক্তির সঙ্গে আঁতাত। যখন তারা তাদের প্রয়োজনে কখনও সেকিউলারিজমের কথা বলেছে তখন সেটা হয়েছে কখনও ধর্মের একটা নমনীয় প্রকাশ এবং কখনও নেহায়েত কৌশল বা ভণ্ডামি। এই কৌশল আমরা বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে দেখেছি। এমনকি প্রয়োজনে কখনও বিএনপিও তেমন কৌশল করেছে এবং ধর্মের ব্যবহারকে সংযত করেছে।

এই শ্রেণী ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা ভাগ করেছে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা করেছে, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করেছে, তাদের ব্যাপক সংখ্যায় দেশ ছাড়া করেছে এবং তাদের সহায়-সম্পদ লুণ্ঠন করেছে যেমন করেছে স্বধর্মাবলম্বী দরিদ্র ও দুর্বলদেরকেও শোষণ ও লুণ্ঠন। শোষণ, লুণ্ঠন, নির্যাতনে কখনও জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, লোকবাদ ইত্যাদির নাম ব্যবহার করা হলেও তাদের মূল ভিত্তিটি কিন্তু ধর্ম। তাই তারা ধর্মকে ব্যবহারের প্রয়োজনে বার বার এখানে ফিরে। এর জন্য তারা সংবিধান থেকে প্রয়োজন বোধে সেকিউলারিজম বাদ দিয়ে সেখানে আল্লাহ্‌য় বিশ্বাস এবং বিসমিল্লাহ্‌ সংযুক্ত করেছে। এক সময় তারা ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মও ঘোষণা করেছে।

কিন্তু দেশটা আফগানিস্তান হয়েছে বা কখনও হবে এ কথা মনে করার কারণ নেই। এখানে ইসলামকে তার আদিরূপে প্রতিষ্ঠা করার কোন বাস্তবতা নেই। ওটা আজকের দিনে কোন দেশে সম্ভবও নয়। বড় জোর নামাজ-রোজার উপর জোর বাড়ানো, মেয়েদের কঠোরভাবে অবরোধের ভিতর রাখা এবং ভিন্ন ধর্ম ও উদারনৈতিক বা ভিন্ন চিন্তার বিরুদ্ধে অধিকতর আক্রমণাত্মক মনোভাব গ্রহণ এগুলো সম্ভব।

মূল ইসলামকে আর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কেন নয়, তার একটা ছোট উদাহরণ দিই। ইসলামে প্রাণীর চিত্র বা মূর্তি নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। হাদীসে এ সম্পর্কে বহুবার বিশেষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে এবং এ কথাও বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি প্রাণীর ছবি বা মূর্তি তৈরী করবে পরকালে তার সবচেয়ে কঠোর শাস্তি হবে। ফলে টিভি এবং সিনেমা থেকে শুরু করে বহু কিছুই বন্ধ করে দিতে হবে। এমনকি পাসপোর্ট করাও যাবে না। কারণ তাতে ছবি থাকে। ফলে মক্কায় হজ্জ্‌ করতে যাওয়াও সম্ভব হবে না। কারণ পাসপোর্ট ছাড়া সৌদি আরবে যাওয়াই সম্ভব নয়। মোট কথা ইসলামের অনেক মৌল বিধান পালন করতে গেলে সভ্যতাকে খারিজ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

সুতরাং ইসলামের বিধি-বিধান পুরো অনুশীলনের পাগলামি আজকের যুগে সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ করবে না, করেও না। এরপরেও আফগানিস্তানে তালেবানরা তেমন একটা কিছু করতে চেয়েছিল। জনগণের ধর্মান্ধতা ও পশ্চাৎপদতার মধ্য নিশ্চয় এর অনুকূল ক্ষেত্র ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও পূর্ববর্তী কালে রাজতন্ত্রের সময়েও আফগানিস্তান এমন ধর্মান্ধ ছিল না। অন্তত রাষ্ট্র শাসনে কিছু উদারনৈতিকতা ছিল। বাদশাহ্‌ আমানুল্লাহ্‌ বেশ কিছু আধুনিক সংস্কারের সূচনা করে গিয়েছিলেন, যার পথ ধরে আফগানিস্তান অনেকটা অগ্রসর হয়েছিল।

সুতরাং আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানের পটভূমি রচনায় বহিঃশক্তি বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ এবং পাকিস্তানের ভূমিকাকে দেখতে পারতে হবে। এ ক্ষেত্রে সেখানে কমিউনিস্টদের ভুলও নিশ্চয় এদেরকে সুযোগ করে দিয়েছিল। বিশেষত সোভিয়েত সেনার উপস্থিতি এই সুযোগকে বর্ধিত করেছিল।

বাংলাদেশেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের প্রয়োজন এখানে কোন উগ্র ইসলামী শক্তির উত্থানের পক্ষে যাবে না এমন কথা বলা যায় না। বাংলাদেশে তালেবানী মার্কা মোল্লাদের দ্বারা ক্ষমতা দখল সম্ভব বলে আমি মনে করি না। কিন্তু সামাজিক বাস্তবতা এবং বহিঃশক্তির প্রয়োজনের মধ্যে সম্মিলন ঘটলে ধর্মান্ধ সামাজিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে কোন উগ্র ধর্মীয় শক্তির উত্থান যে ঘটবে না তা কী করে বলা যায়? এমনকি এর জন্য নেতৃত্বের শক্তিকে প্রকৃত অর্থে ধর্মান্ধ বা ধর্মনিষ্ঠ হতে হবে তারই বা কী বাধ্যবাধকতা আছে?

পাকিস্তানে ভুট্টোকে সরিয়ে সেনা নায়ক জিয়াউল হকের নেতৃত্বে যে উগ্র ও মধ্যযুগীয় ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার জের পাকিস্তান আজও টেনে চলেছে। সামাজিক ভিত্তি থাকলে কীভাবে তথাকথিত উদারনৈতিক অথবা ধর্ম পালন বিমুখ, এমনকি হয়ত ধর্ম বিশ্বাসে সংশয়গ্রস্ত, এমন ব্যক্তিও যে বিশেষ ধর্ম বিশ্বাস এবং পরিচিতিকে ব্যবহার ক’রে ধর্মীয় রাজনীতির প্রবল জোয়ার সৃষ্টি করতে পারে তার দৃষ্টান্ত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌। অথচ তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ইউরোপীয় পোশাকে সজ্জিত এবং ইউরোপীয় আচার-আচরণে অভ্যস্ত। তাঁর ব্যক্তি জীবনে ধর্মের লেশমাত্র ছিল না। নামাজ-রোজা না করে তাঁর মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নায়কে পরিণত হতে সমস্যা হয় নি। প্রায় এক কথা প্রযোজ্য ব্রিটিশ বাংলার মুসলিম লীগ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে। ইউরোপীয় জীবন-যাত্রায় অভ্যস্ত এই ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এখানে আলোচনা করার প্রয়োজন নেই।

আসলে আমি একটা বিপদের সম্ভাবনাকে মাথায় রাখতে বলছি যার বাস্তব ভিত্তি বাংলাদেশে আফগানিস্তানের মত করে না হলেও আমাদের দেশের মত করেই তৈরী হয়ে আছে। দীর্ঘ কাল ধরে অনেকের ভূমিকার ফলে ভিত্তিটা যথেষ্ট মজবুত হয়েছে। এটা কতটা মজবুত তার প্রমাণ হল কয়েক মাস আগে আওয়ামী লীগ কর্তৃক খেলাফত মজলিশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন। এই ঘটনা এই ইঙ্গিত দেয় আমাদের দেশের বৃহৎ দলগুলির পক্ষেও তেমন একটি মোড় পরিবর্তন সম্ভব।

সম্প্রতি ছয় জঙ্গীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকরণ এবং ইসলামী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড় ও দমন অভিযানের ফলে ইসলামী রাজনীতির ঝুঁকি  সাময়িকভাবে কমলেও প্রবলতর শক্তি নিয়ে তা আত্মপ্রকাশ করতে পারে। পুনরায় বলি মনে রাখতে হবে বৃহৎ বহিঃশক্তিগুলোর চাহিদার কথা। তাদের চাওয়া যদি বর্তমান সরকার পূরণ করতে না পারে তবে কি তারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য কিংবা এখানে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করার সুযোগ সৃষ্টির জন্য তাদের ট্রাম্প কার্ড হিসাবে ইসলামী রাজনীতি ও শক্তিকে ব্যবহারে মনোযোগী হতে পারে না? আফগানিস্তানে বাদশাহ্‌ আমানুল্লাহ্‌র সংস্কারের বিরুদ্ধে আফগান জনগণকে ক্ষেপাবার জন্য মোল্লাদেরকে প্রয়োজনীয সরঞ্জাম এবং অর্থের যোগানটা দিয়েছিল ব্রিটেন। পরিণতিতে আমানুল্লাহ্‌ সিংহাসনচ্যুত হন এবং মোল্লাদের দ্বারা সমর্থিত হয়ে ডাকাত দলের সর্দার বাচ্চাই সাকো ইসলাম কায়েমের কথা বলে অল্প কিছু দিনের জন্য রাজধানী কাবুল দখল করে।

আমার ধারণা বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের প্রয়োজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট ফুরিয়েছে। এই রকম অবস্থায় মার্কিন-ভারত সমঝোতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অনুকূল নয়।

একটি কঠিন বাস্তবতার মধ্যে থেকে আমাদেরকে একদিকে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন এবং অপরদিকে জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিকে বিচার করতে হবে। বস্তুত বাংলাদেশের দুর্বৃত্ত ধনিক শ্রেণীটি বৈদেশিক শক্তিসমূহের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠায় তার অস্তিত্ব শুধু দেশের সুস্থ, জন-কল্যাণবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশের পথে প্রধান বাধা হয়ে নেই, উপরন্তু দেশের অস্তিত্বের প্রতিও হুমকি হয়ে আছে। তা নিজ স্বার্থে যে কোন সময় দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বহিঃশক্তির কাছে বিসর্জন দিতে পারে, যেমন এক সময় নওয়াবী রাষ্ট্রের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি যে মীর জাফর শুধু একটা ব্যক্তি নয়, এটা একটা শ্রেণীও। নানান সংযোজন, বিয়োজন এবং পরিবর্তনের মধ্য দিয়েও এই শ্রেণীটি তার অন্তর্গত চরিত্র-বৈশিষ্ট্য রক্ষা করে আজ অবধি অধিপতি শ্রেণীরূপে বিদ্যমান রয়েছে।

সুতরাং বাংলাদেশকে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সুসংহত ও বিপদমুক্ত করতে হলে এই শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটানো অপরিহার্য। নতুবা কিছু কিছু রাজনৈতিক সংস্কার দ্বারা অল্প কিছু দিনের জন্য আওয়ামী লীগ বা বিএনপি-এর পক্ষে রাজনীতি করা কঠিন হবে। কিন্তু এই শ্রেণী টিকে থাকলে তা বিপন্ন এবং ব্যর্থ করবে সংস্কারের সকল প্রয়াস। শেষ পর্যন্ত তার উপর নির্ভর করে লীগ-বিএনপি একই সঙ্গে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী এবং সহযোগী রূপে রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হবে।

এটা ঠিক যে, ইতিহাস এই শ্রেণীর পক্ষেও নয়। কারণ দানবীয় আকার ও আয়তন ধারণকারী এ রকম একটা অনুৎপাদনশীল, লুণ্ঠনকারী এবং নীতি-নৈতিকতাহীন শ্রেণীর ভার এ দেশ আর বহন করতে পারছে না। অন্যদিকে, এর বিদেশী প্রভু বা মুরুব্বী তথা দাতাদের নিকটও এ রকম অনুৎপাদনশীল ও লুঠেরা শ্রেণীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এ দেশে তাদের বাজার সম্প্রসারণের পথে এটা এখন বাধা। সুতরাং এখন তাকে যেতে হবে।

তবে কে তাকে বিদায় করবে তার উপর নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ। যদি সমাজ অভ্যন্তরের শক্তি তাকে উৎখাত করতে পারে তবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা পাবে এবং সেই সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামর আমূল পরিবর্তন ঘটবে। ফলে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে একটি জন-কল্যাণবাদী এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আর কাজটা যদি বহিঃশক্তি করে কিংবা তার ছত্রছায়ায় ও নিয়ন্ত্রণে সম্পাদিত হয় তবে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যেমন থাকবে না তেমন দুর্বৃত্ত ধনিক শ্রেণীর বহিরঙ্গ ধ্বংস হলেও মূলগতভাবে তা রক্ষা পাবে।

এটাই নিয়ম। ১৭৫৭-তে বাংলার রাষ্ট্র ও সমাজের যে নেতারা ব্রিটিশদের নিকট ক্ষমতা তুলে দিয়েছিল তারা নিজেরাও তারপর প্রায় কেউ টিকে থাকতে পারে নি। কয়েক বৎসরের মধ্যে পুতুল নওয়াবীরও অবসান ঘটানো হল। জগৎ শেঠ, ইয়ার লতিফ, উমি চাঁদ, রাজ বল্লভ, রায় দুর্লভ সকলে হারিয়ে গেল। ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের পক্ষে থাকা মহারাজ নন্দকুমারকে কয়েক বৎসরের মধ্যে তারা ফাঁসি দিয়ে হত্যা করল। আসলে পুরাতন শাসক এবং নেতৃত্বকারী শ্রেণীর মূল অংশ এবং শীর্ষ স্তরটিকে ধ্বংস না করে নূতন শোষণ ও লুণ্ঠনের ব্যবস্থাও ভালভাবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং মূল ব্যবস্থাটিকে অনেকাংশে রক্ষা করা হলেও পুরাতন ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত ও শীর্ষের অনেককেই ফেলে দিতে হয়েছে এবং সমাজের নীচ তলা থেকে নূতন অনেককে উপরে তুলে এনে নিজেদের সহযোগী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। নীচ তলা থেকে উঠে আসা এই সুবিধাভোগী অংশটি তাদের নূতন প্রভুদের প্রতি হয় অনেক বেশী অনুগত ও নির্ভরযোগ্য। বহিঃশক্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এবারও তেমন কিছু হবে। ফলে দুর্বৃত্তয়ানের দানবীয় আয়তন আপাতত কমলেও এবং তার রূপ অনেকটা আড়াল হলেও ব্যবস্থাটা মূলত অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং দুর্বৃত্ত শ্রেণীটিও মর্মমূলে রয়ে যাবে এবং ফলে আবার ক্রমে বিকাশমান হবে। এভাবে এ হয়ে থাকবে এক অন্তহীন চক্র।

নির্বাচন দ্বারা দুর্বৃত্ত ধনিক শ্রেণীর পতন ঘটানো সম্ভব নয়। কারণ ভোট নির্ভর রাজনীতির মাধ্যমে এই শ্রেণীর পতনের শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। প্রচলিত ব্যবস্থার অধীনে ভোটের রাজনীতিতে সেই শক্তি এগিয়ে থাকবে যারা জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বিদ্যমান চিন্তা-চেতনার নিকট সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে আবেদন রাখতে পারবে। যেহেতু জনগণের গরিষ্ঠ অংশ পাশ্চাৎপদ, অনুন্নত চিন্তা-চেতনার অধিকারী, ধর্মাচ্ছন্ন সেহেতু যারা তাদের পশ্চাৎপদতা, অনুন্নত চিন্তা-চেতনা এবং ধর্মাচ্ছন্নতাকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবে তারাই হবে তাদের নেতা, প্রতিনিধি -- তাদের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি। ফলে টাকার খেলা বন্ধ করেও তেমন একটা লাভ হবে না। তাতে সাময়িক কিছু লাভ হলেও এ ধরনের ভোটের রাজনীতির প্রক্রিয়ায় রাজনীতির যে ক্রমিক অধঃপতন হবে সে কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সর্বোপরি বিদ্যমান শ্রেণী ভিত্তি রক্ষা করে একটা রাজনৈতিক সংস্কার দ্বারা লীগ-বিএনপি-এর মূল ধারাকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন করা হলে সেই নির্বাচনে জয়ী সরকারের পরিণতি যে করুণ হবে তাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কেন হবে সে কথা ইতিপূর্বেকার আলোচনা থেকেই আশা করি স্পষ্ট। সুতরাং এ নিয়ে আর নূতন করে বলার দরকার নেই।

প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে আমূল ও বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ছাড়া একটা যুগোপযোগী এবং উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই সম্ভব নয়, যেমন সম্ভব নয় জনগণের চেতনারও উন্নতি সাধন। আসলে একটা উন্নত ও জন-কল্যাণবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বস্তরে দৃঢ় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার পূর্বশর্ত প্রথমে জনগণকে তার উপযোগী করে নেওয়া। অভিজ্ঞতা বলে এই কাজটা আমাদের দেশে নীচ তলা থেকে আমজনতাকে নিয়ে শুরু করা সম্ভব নয়। বরং কাজটা উপরে শুরু করে নীচ তলার জনগণকে তার অঙ্গীভূত করতে হবে। এটা একটা বিরাট সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন করার ব্যাপার।

এই প্রক্রিয়ায় যে কাজটি সম্পন্ন করা অপরিহার্য তা হচ্ছে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে যে বিত্তবান বা ধনিক শ্রেণী গড়ে উঠেছে শ্রেণী হিসাবে তার ধ্বংস সাধন। এর উপায় হচ্ছে দুর্নীতির মাধ্যমে যারা এ দেশে সম্পদ ও সম্পত্তির পাহাড় গড়েছে তাদের সে সকল সম্পদ ও সম্পত্তি রাষ্ট্র কর্তৃক বাজোয়াপ্ত করা। হাঁ, এটা জাতীয়করণ। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করতে হলে এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

কিন্তু এই জাতীয়করণ দ্বারা একটা সর্বত্র পরিব্যাপ্ত স্থায়ী রাষ্টায়ত্ত খাত প্রতিষ্ঠা করা হবে না। রাষ্ট্রায়ত্ত খাত আছে এবং থাকবে। কিন্তু সেটা অপ্রয়োজনে নয়। যেসব প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগ দেশের নিরাপত্তা ও জন-কল্যাণের জন্য অপরিহার্য হবে সেগুলি রাষ্ট্রের হাতে থাকবে। তবে রাষ্ট্র জোর দিবে সৎ, দেশ প্রেমিক ও উৎপাদনশীল ব্যক্তিসমূহের উদ্যোগের সর্বোচ্চ বিকাশের উপর। সুতরাং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত ধনিকদের সকল সম্পদ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্র সেগুলিকে যতটা সম্ভব সৎ, দেশ প্রেমিক ও উৎপাদনশীল ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করবে। অর্থ দেওয়া যেতে পারে সহজ শর্তে ও অল্প সুদে ঋণ আকারে আর প্রতিষ্ঠানগুলিকে কিস্তিতে বিক্রয় করা বা ইজারা দেওয়া যেতে পারে। অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়াবার জন্য বেসরকারী ব্যাংককেও বেছে নেওয়া যেতে পারে। এই সমগ্র প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার দিতে হবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদেরকে। এভাবে দেশে গড়ে উঠবে বা প্রবল হবে একটি ন্যায়, সততা, দেশ প্রেম এবং প্রকৃত উৎপাদনশীলতা ভিত্তিক অর্থনীতি এবং শ্রেণী।

বাংলাদেশে এমন একটি অর্থনীতি এবং শ্রেণী গঠনের বাস্তবতা গড়ে উঠেছে বিগত পঁয়ত্রিশ বৎসরে। যারা লুটপাট করে নি, চুরি ও দুর্নীতি করে নি এবং প্রবল শ্রম ও অধ্যবসায় সহকারে এবং এই দুর্বৃত্তায়িত ব্যবস্থার মধ্যেও যতটুকু সম্ভব সৎভাবে উৎপাদনমূলক অসংখ্য উদ্যোগ গড়ে তুলেছে রাষ্ট্র এখন তাদেরকে আগামী দিনের অর্থনীতির মূল নির্ধারক ও নিয়ন্তা শ্রেণী হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে পারে।

সাধারণভাবে নীচ তলায় এই ধরনের একটি সামাজিক শক্তিও বাংলাদেশে মোটামুটি বিকাশ লাভ করেছে বলে এত লুটপাট, দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের ভিতরেও বাংলাদেশ এত দ্রুত এতটা অগ্রসর হতে পেরেছে। অর্থাৎ দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক রাজনীতিক-আমলা এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির সব নয়। বাংলাদেশে অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির চাকাকে যারা এত প্রতিকূলতার ভিতরেও সচল রেখেছে আজ তাদেরকে প্রাধান্যে আনার কাজ শুরু করতে হবে; এবং সেই সুযোগ ইতিমধ্যে এসেছেও।

বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি বিরোধী যে অভিযান শুরু করেছে আমার বিবেচনায় তা এ দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঘটনাধারার সূচনা হতে পারে যদি এই অভিযানকে ক্রম প্রসারিত করে সমগ্র দুর্বৃত্ত শ্রেণীটিকে এর আওতায় আনা যায় এবং একই সঙ্গে এই দুর্নীতি বিরোধী অভিযানকে একটি সামগ্রিক মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি প্রদান করা যায়।

তবে বর্তমান সরকার দ্বারা এ কাজ হবে না। এর জন্য এখন প্রয়োজন একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার, যা হতে পারে বর্তমান সরকারের একটা পরিবর্তিত এবং সম্প্রসারিত রূপ। এবং এই সরকারের সুনির্দিষ্ট মতাদর্শিক ভিত্তি হওয়া উচিত ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি। মনে রাখতে হবে ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের শক্তি যেমন একা আওয়ামী লীগ ছিল না বরং এই যুদ্ধের মূল রাজনীতি অনেক আগে থেকে গড়ে তুলেছিল বামপন্থীরা এবং ’৭১-এ আওয়ামী লীগসহ আরও অনেকে অংশ নিয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে তুলেছিল তেমন ’৭২-এর সংবিধানও একা আওয়ামী লীগের নয়। বরং এই চার মূলনীতি মূলত জাতির অর্জন। এই চার মূলনীতির প্রকৃত শক্তি আওয়ামী লীগ ছিল না বলে তার এই ব্যর্থতা। আজ সেই চার মূলনীতির ভিত্তিতে সকল জাতীয়তাবাদী, দেশ প্রেমিক, সৎ এবং যোগ্য ব্যক্তি ও শক্তিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি করতে হবে জাতীয় সরকারকে। সুতরাং জাতীয় সরকার ভাল-মন্দ নির্বিশেষে সবার মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার নামে আবর্জনার উপচে পড়া ডাস্ট্‌বিন হবে না, বরং তা হবে দেশের আবর্জনা সাফ করার হাতিয়ার।

রচনাঃ ৮ - ১৩ এপ্রিল, ২০০৭

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ