Banner
বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভূমিকা ─ শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 4, 2007, 8:25 AM, Hits: 2533

 

‘বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভূমিকা’ ১৯৯০ এবং ‘শ্রেণীতত্ত্ব ও বিপ্নব’ ১৯৮৯ সালে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে লেখা হলেও এই দুই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় এরশাদের শাসন উচ্ছেদের পর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সহযোগী অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন সম্পাদিত ‘রাজনীতি অর্থনীতি জার্নাল’-এর পর পর দুইটি সংখ্যায় প্রবন্ধ দুইটি প্রকাশিত হয়। ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভূমিকা’ প্রকাশিত হয় জুন-ডিসেম্বর ’৯১ এবং ‘শ্রেণীতত্ত্ব ও বিপ্নব’ প্রকাশিত হয় জুন ’৯২ সংখ্যায়।

 

বিশেষ করে ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভূমিকা’ দীর্ঘ সামরিক শাসনের যে প্রেক্ষিতে লিখিত হয় ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে সেই প্রেক্ষিতের পরিবর্তন হয়েছে। ১৬/১৭ বৎসরের নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক সরকার এবং অন্তর্বর্তী কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসন স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভূমিকায় প্রভাব ফেলেছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে রাষ্ট্রের মৌল চরিত্র ও ভূমিকায় বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটে নি। বিশেষত সমাজ ও রাষ্ট্রের গঠন ও চরিত্র বিশ্নেষণে প্রবন্ধটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য এখনও রয়েছে বিবেচনা করে এটি ওয়েব সাইটে অপরিবর্তিত রূপে প্রকাশ করা হল।

 

লেখক, ৪ নভেম্বর ২০০৭

অনলাইনঃ ৪ নভেম্বর, ২০০৭

 

 

 

এ দেশে যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের সৈনিক ও কর্মী তাঁদের ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ হ’ল এ দেশে প্রচলিত ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় কিংবা প্রধান শক্তি বা শক্তিগুলিকে ধরতে না পারা। ফলে তাঁরা এ যাবৎকাল ভুল জায়গায় ও ভুল পদ্ধতিতে আঘাত করেছেন।

 

এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের প্রয়োজনে সমাজকে বদলাতে চেয়ে মার্কসবাদকে তাঁদের ভাবাদর্শ এবং কর্মপদ্ধতির হাতিয়ার করায় তাঁদের এই ভুল হয়েছে। কারণ মার্কসবাদ অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করে। মার্কসবাদ সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে অর্থনীতি বা উৎপাদনকে ধরে নেয়। এ প্রসঙ্গে আমরা মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর বক্তব্য উল্লেখ করতে পারি।

 

মার্কস তাঁর ‘অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থের ভূমিকায় বলছেন,

 

‘মানব-জীবনের সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে মানুষ জড়িত হয় কতগুলি অনিবার্য ও ইচ্ছা-নিরপেক্ষ নির্দিষ্ট সম্পর্কে, উৎপাদন সম্পর্কে, যা মানুষের বৈষয়িক উৎপাদন-শক্তির বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের অনুরূপ। এই উৎপাদন-সম্পর্কগুলির সমষ্টি হ’ল সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, সেই আসল বনিয়াদ, যার উপর গড়ে ওঠে আইনগত আর রাজনৈতিক উপরিকাঠামো এবং সামাজিক চেতনার নির্দিষ্ট রূপগুলি হয় তারই অনুরূপ। বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন-পদ্ধতিই সাধারণভাবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন-প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে।’

 

এঙ্গেলস তাঁর ‘কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ গ্রন্থে বলছেন,

 

‘ইতিহাসের বস্তুবাদী বোধের শুরু এই প্রতিজ্ঞা থেকে যে, মনুষ্যজীবনের ভরণ-পোষণের উপায়ের উৎপাদন এবং উৎপাদনের পর উৎপাদিত বস্তুর বিনিময় ­ এই হ’ল সমাজ কাঠামোর ভিত্তি, এবং ইতিহাসে আবির্ভূত প্রতিটি সমাজের ধনবণ্টনের ধরন এবং শ্রেণী ও বর্গে সমাজের বিভাগ কী উৎপাদন হ’ল, কীভাবে উৎপাদিত হ’ল এবং কীভাবে উৎপন্নের বিনিময় হ’ল, তার উপর নির্ভরশীল।’

 

বস্তুত এই ধরনের বক্তব্য দ্বারা সমাজ সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণে অর্থনীতি কিংবা উৎপাদনের ভূমিকা প্রধান এবং কেন্দ্রীয় হিসাবে দেখা দেয়। কাজেই সমাজ পরিবর্তনের জন্য উৎপাদন বা অর্থনীতির উপর প্রত্যক্ষ
 



নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিগুলিকে খঁুজে বের করা এবং অর্থনীতির উপর থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণ ধ্বংস করা মার্কসবাদীদের মূল কাজ হয়ে দেখা দেয়।

 

কিন্তু আমাদের দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে সমাজ নিয়ন্ত্রণের প্রধান বস্তুগত শক্তি অর্থনীতি কিংবা পঁুজি নয়। এখানে রাষ্ট্রই এই শক্তি। এই রাষ্ট্র এ দেশে প্রধানত পঁুজি কিংবা উৎপাদনশক্তি দ্বারা সংগঠিত হয় নি। এটা সংগঠিত হয়েছে মূলত অস্ত্রশক্তি বা সেনাবাহিনী দ্বারা। আজকে যে রাষ্ট্রটি এ দেশে আছে তা মূলত ব্রিটিশ কর্তêৃক সংগঠিত। এই রাষ্ট্রের মূল উপাদান সেনাবাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাঠামো থেকে বিশেষ কোনও পরিবর্তন ছাড়া আগত। এখান থেকে বাদ গেছে শুধু উর্দূভাষী এবং পাকিস্তানীরা। আবার ১৯৭১-পূর্বকালের পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ব্রিটিশ এবং অমুসলিমদের বর্জন ক’রে মূলত ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারাই গঠিত। অর্থাৎ স্বাধীন ভারতীয় সেনাবাহিনী যেখানে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধানত হিন্দু এবং অমুসলিম অংশ নিয়ে গঠিত সেখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তার মুসলিম অংশ নিয়ে গঠিত। এই একই ঘটনা ঘটে রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রশাসনের ক্ষেত্রেও। সুতরাং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ যে দুই রাষ্ট্র রেখে যায় সেই দুইটির কোনটিই প্রকৃতপক্ষে এবং মূলগতভাবে নূতন রাষ্ট্র নয়। এই কারণে নাম ও পতাকার পরিবর্তন হলেও কাঠামো ও ঐতিহ্যের বিচারে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রটিও নূতন নয়।

 

বঙ্গে কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে তা কি প্রধানত পঁুজির জোরে করেছিল নাকি যুদ্ধ ও সেনাবাহিনীর জোরে? এটা ঠিক যে, ব্রিটিশ বঙ্গে এসেছিল বাণিজ্য করতে। বাণিজ্য করতে এসে তা এ দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংযোগ ও প্রভাবও সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ বণিক ও কর্মচারীরা কি তাদের নিয়ন্ত্রণে এ দেশে নূতন কোন উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা অর্থনীতি সংগঠিত করেছিল যার দ্বারা সমাজের গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এ দেশের মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র বিদারিত ও ধ্বংস হয়ে ব্রিটিশের উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র সংগঠিত হয়েছিল? তেমন কিছু হলে এ দেশে উপনিবেশবাদ নয় ভিন্ন কিছু সংগঠিত হ’ত। এ দেশে, সেক্ষেত্রে, অর্থনীতিতে দেখা দিত শিল্প পুঁজিবাদ, সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শে দেখা দিত লোকবাদ আর রাষ্ট্রে দেখা দিত গণতন্ত্র। তেমন কিছু হয় নি। বরং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা পুরাতন নওয়াবী সামরিক রাষ্ট্রটিকে মূলত একই সামরিক কায়দায় পরাজিত ও অধীনস্থ করেছিল যে সামরিক কায়দায় এই নওয়াবী রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশে। বহিরাগত মোগলরা অস্ত্রশক্তি বা সেনাবাহিনীর জোরে ভারতে তাদের সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। বঙ্গের নওয়াবী রাষ্ট্র ছিল এই মোগল সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রেরই সম্প্রসারণ। দিল্লীর মোগল সম্রাটরা দুর্বল হয়ে পড়লে বঙ্গ-বিহার-উড়িষ্যার সামরিক প্রদেশপালরা কার্যত স্বাধীন হয়ে যায়। নওয়াবী রাষ্ট্র হ’ল এই কার্যত স্বাধীন কিন্তু বৈধত মোগল সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের অংশ মাত্র। ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর রণক্ষেত্রে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত ক’রে বঙ্গ জয় করে। বস্তুত নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের নেতৃত্বে নওয়াবী রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের এক বৃহৎ কিংবা প্রধান অংশই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের নিকট ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নওয়াবী রাষ্ট্রের মূল নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য হস্তান্তর করে। সুতরাং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের নেতৃত্বে যে নূতন উপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার ভিতরে পুরাতন রাষ্ট্র কাঠামোরও অনেক কিছুই অনিবার্যভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। বহিরাগত মুসলিম তুর্কী-মোগলদের দ্বারা সংগঠিত ও পরিচালিত পুরাতন মধ্যযুগীয় ভূমিভিত্তিক রাষ্ট্রের অনেক উপাদান ও বৈশিষ্ট্য ইংল্যান্ডের বিকাশমান শিল্পশক্তির প্রতিনিধি বণিকদের এ দেশস্থ উপনিবেশিক রাষ্ট্রের অঙ্গীভূতও হ’ল। কিন্তু এটা ঠিক যে, ব্রিটিশের উপনিবেশিক রাষ্ট্র এখানকার পুরাতন রাষ্ট্রের পুরোপুরি রূপান্তরও নয়। ব্রিটিশ সামগ্রিকভাবে পুরাতন নওয়াবী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করল যদিও তার অনেক কিছুকে নিল অপরিবর্তিত রূপে এবং অনেক কিছুকে নিল পরিবর্তিত ক’রে। এইভাবে ব্রিটিশ ক্রমান্বয়ে মৃতুøমুখী মোগল সাম্রাজ্যের জায়গা নিল এবং ভারতব্যাপী পুনরায় একটা অধিকতর শক্তিশালী বৃহত্তর সাম্রাজ্য-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল।

 

 

 

মোগল রাষ্ট্র ছিল স্বৈরতান্ত্রিক এবং আমলাতান্ত্রিক। ইউরোপীয় ভূস্বামী সামন্তদের মত কোন সম্পত্তিবান শ্রেণী মূলত এই রাষ্ট্রের অধিপতি ছিল না। এই রাষ্ট্রের অধিপতি ছিল মূলত সামরিক আমলারা বা সমরনায়করা। এই রাষ্ট্রের প্রধান এবং কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল সেনাবাহিনী। মোগল সম্রাট ছিল সকল বৈষয়িক ক্ষমতার উৎস এবং সেনাবাহিনীর প্রধান, সর্বাধিনায়ক। মোগল সম্রাট শাহ্‌জাহান ও আওরঙ্গযেবের আমলে ভারতে আগত বিখ্যাত ফরাসী পর্যটক ফঁ্রাসোয়া বার্নিয়ের মোগল সম্রাটের ক্ষমতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, ‘হিন্দুস্থানের মোগল সম্রাট দেশের সমস্ত সম্পদের একমাত্র মালিক। দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির মালিকানা দেশীয় প্রথা বা বিধানসম্মত নয়। আমীর-ওমরাহ অথবা মনসবদার যাঁরা বাদশাহের অধীনে নিযুক্ত, তাঁদের যাবতীয় সম্পত্তি ও সম্পদের উত্তরাধিকারী হলেন বাদশাহ্‌ নিজে। হিন্দুস্থানের প্রতি বিঘা জমির মালিক বাদশাহ; চাষী বা জমিদার নয়। বসতবাড়ী, উদ্যান, দীঘি ইত্যাদি কয়েকটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি মধ্যে মধ্যে বাদশাহ্‌ নিজের খেয়াল ও মর্জি অনুযায়ী কোন কোন প্রিয়জনকে ভোগ করার জন্য দান করেন। এ ছাড়া “ব্যক্তিগত সম্পত্তি” বলে হিন্দুস্থানের রাষ্ট্রীয় বিধানে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।’

 

বস্তুত সম্রাট হ’ল মোগল রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দু। আদর্শিক ও নৈতিকভাবে সম্রাটের মাধ্যমে রাষ্ট্র ছিল ভারতবর্ষে সমস্ত সম্পদ ও সম্পত্তির চূড়ান্ত মালিক। ব্যক্তি মালিকানা ছিল। তবে তা ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের অধীনস্থ ও অংশ হয়ে। রাষ্ট্র প্রয়োজন বোধ করলে কিংবা ইচ্ছা করলে যে কোন নাগরিকের সম্পত্তি বা মালিকানায় হস্তক্ষেপ করতে পারত। রাষ্ট্রের এই নিরংকুশ বৈষয়িক ক্ষমতা বা অধিকারের ফলে অধিকাংশ এশীয় সমাজের মত ভারত ও বঙ্গের সমাজেও রাজা, সম্রাট তথা রাষ্ট্রের নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্র বিকাশ লাভ করেছিল।

 

ভারতীয় উপমহাদেশে মোগল শাসনকালে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবস্থা কিংবা ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক কি ধরনের ছিল সেটা স্পষ্ট করার জন্য আমরা পুনরায় বার্নিয়েরের সাহায্য নিতে পারি। একটু দীর্ঘ হলেও তখনকার ভারতীয় পরিস্থিতি বোঝার সুবিধার জন্য বার্নিয়েরের বিবরণ উদ্ধৃত করছি। বার্নিয়ের লিখছেন,

 

‘এখানে আমি আরও দু’টি ঘটনার কথা উল্লেখ করব যা থেকে হিন্দুস্থানের সামাজিক প্রথা সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা হবে। ঘটনা দু’টি সম্রাট শাহ্‌জাহানের রাজত্বকালে ঘটেছিল। ঘটনা দু’টি বিবৃত করা প্রয়োজন,কারণ ব্যক্তিগত সম্পত্তি সম্বন্ধে মোগল যুগেও হিন্দুস্তানে যে কি রকম বর্বর প্রথা চালু ছিল, তা এই ঘটনা থেকে বুঝতে পারা যায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোন পবিত্রতা রক্ষা করা হত না, নিরাপত্তাও ছিল না। সম্পত্তি সব হ’ল সম্রাটের। রাষ্ট্রের ও ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তির মালিক সম্রাট। সম্রাটের অধীনে যারা কাজ করেন তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তির কোন অধিকারই স্বীকৃত হয় না। তাঁদের মৃতুøর পর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হন সম্রাট নিজে। এইবার ঘটনা দু’টি বলছি।

 

‘নায়েক খাঁ নামে মোগল দরবারে একজন প্রবীণ আমীর ছিলেন। প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর রাজ-দরবারে নানা দায়িত্বপূর্ণ পদে তিনি নিযুক্ত থেকে যথেষ্ট ধনসম্পত্তি সঞ্চয় করেছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃতুøর পর সমস্ত সম্পত্তি যে সম্রাটের করতলগত হবে তা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন, এই বর্বর প্রথার জন্য কিভাবে ওমরাহ্‌দের মৃতুøর পর তাদের বিধবা পত্নীরা দুর্দশার চরম সীমায় উপস্থিত হন এবং সামান্য ভাতার জন্য সম্রাটের দারস্থ হতে বাধ্য হন। তিনি জানতেন, কিভাবে মৃত ওমরাহ্‌দের পুত্ররা সামান্য জীবিকার জন্য অন্যান্য ওমরাহ্‌দের ব্যক্তিগত সেনাদলে নাম লেখাতে রাজী হন। নায়েক খাঁ যখন দেখলেন যে, তাঁর অন্তিমকাল আসন্ন, তখন তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন ও কর্মচারীদের ডেকে তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ বিলিয়ে দিলেন এবং সিন্দুকের মধ্যে মোহর ও টাকার বদলে লোহা ও হাড়ের টুকরো, পুরনো ছেঁড়া জুতো, ছেঁড়া কাপড় ইত্যাদি ভর্তি করে রেখে দিলেন। এইভাবে সিন্দুক ভর্তি করে সিলমোহর করে দিয়ে তিনি সকলকে জানিয়ে দিলেন যে সিন্দুকে যেন কেউ হাত না দেন, কারণ তাঁর মৃতুøর পর এই সিন্দুকের সমস্ত সঞ্চিত অর্থ সম্রাট শাহ্‌জাহানের প্রাপ্য। নায়েক খাঁর মৃতুøর পর তাঁর কথানুযায়ী সেই সিন্দুক সম্রাট শাহ্‌জাহানের কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া হল। সম্রাট তখন রাজদরবারে আমলা-অমাত্য পরিবেষ্টিত হয়ে বসে আছেন। এমন সময় আমীর নায়েক খাঁর সিন্দুক সেখানে বহন করে আনা হ’ল। আনা মাত্রই সম্রাট সকলের সামনে তাদের সিন্দুক খোলার অনুমতি দিলেন। তারপর সিন্দুকের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত দ্রব্যাদি দেখে তাঁর কি অবস্থা হ’ল তা সহজেই অনুমান করা যায়। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সম্রাট শাহ্‌জাহান তাঁর সিংহাসন থেকে উঠে দরবার ছেড়ে চলে গেলেন। এই হ’ল প্রথম ঘটনা।

 

‘দ্বিতীয় ঘটনাটি একটি স্ত্রীলোকের উপস্থিত বুদ্ধির পরিচায়ক। একজন বিখ্যাত বেনিয়ানের* মৃত্যুর পর ঘটনাটি ঘটে। বেনিয়ান ভদ্রলোক দীর্ঘদিন সম্রাটের অধীনে নিযুক্ত ছিলেন এবং মহাজনী কারবার করে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পিতার সঞ্চিত অর্থের ভাগ চায়, কিন্তু বেনিয়ানের বিধবা পত্নী তা দিতে রাজী হন না। কারণ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটি অত্যন্ত অমিতব্যয়ী এবং কাঁচা পয়সা হাতে পেলে দু’দিনে যে সে ফুঁকে দেবে তা তিনি জানতেন। টাকা না পেয়ে পুত্র মায়ের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য পিতার সঞ্চিত অর্থের সংবাদ সম্রাটকে জানিয়ে দেয়। সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ হ’ল দু’লক্ষ টাকা। সংবাদ পেয়ে সম্রাট বেনিয়ানের বিধবা পত্নীকে ডেকে পাঠালেন। ওমরাহদের সামনে তাঁকে বললেন যে অবিলম্বে যেন তিনি এক লক্ষ টাকা তাঁকে পাঠিয়ে দেন এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে দেন। এই কথা বলে তিনি বিধবা স্ত্রীলোকটিকে হলঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন।

 

* ‘বেনিয়ান’ কথাটি বার্ণিয়েরের আমলে হিন্দু ব্যবসায়ীদের বলা হ’ত। পরে ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের বাঙ্গালী ব্যবসায়ী দালালদেরও ‘বেনিয়ান’ বলা হত। ­­­অনুবাদক।

 

 

 

‘স্ত্রীলোকটি কিন্তু সম্রাটের এই রূঢ় ব্যবহারে আদৌ বিচলিত হলেন না। জমাদাররা যখন তাঁকে হলঘর থেকে বাইরে বিতাড়িত করার জন্য উদ্যত, তখন তিনি বললেন যে, তিনি সম্রাটকে আরও দু-একটি কথা জানাতে চান। শাহ্‌জাহান শুনে বললেনঃ “বলতে দাও, কি বলতে চান উনি, শুনি।” স্ত্রীলোকটি বললেন, “ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। আমার কনিষ্ঠ পুত্র টাকা দাবী করেছে পুত্র হিসাবে। তার অধিকার আছে, সে চাইতে পারে। আপনিও দেখছি টাকা চাইছেন। জানি না, আপনার সঙ্গে আমার মৃত স্বামীর সম্পর্ক কি, তাহলে আমি আনন্দিত হব।’ সরল স্ত্রীলোকের এই সহজ উক্তি শুনে সম্রাট শাহ্‌জাহান প্রীত হলেন এবং সামান্য একজন সুদখোর ব্যবসায়ী-বেনিয়ানের সঙ্গে হিন্দুস্থানের সম্রাটের আত্মীয়তার প্রশ্নে বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেনঃ “টাকা আপনার চাই না, আপনিই নিশ্চিন্তে ভোগ করুন।”

 

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে কি ধরনের ‘সামন্তবাদ’ ছিল তা বুঝতে আমাদের যথেষ্ট সুবিধা হয় যখন আমরা বার্নিয়েরের বর্ণনা পড়ি। তিনি বলছেন,

 

‘এ কথা ভাববেন না যে, রাজদরবারের ওমরাহরা বনেদী পরিবারের বংশধর, ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণীর মত। আদৌ তা নয়। হিন্দুস্থানে সম্রাটই যেহেতু সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র মালিক, সেইজন্য সেখানে ইয়োরোপের মতন ‘লর্ড’ বা ‘ডিউক’-রা গজিয়ে ওঠার সুযোগ পান নি। বিরাট কোন সম্পত্তির মালিকানাস্বত্ব বংশ পরম্পরায় ভোগ করে কোন পরিবার হিন্দুস্থানে প্রচুর পরিমাণে ধন সঞ্চয় করার সুযোগ পান না, সম্রাটের সভাসদরা সকলে ওমরাহদের বংশধরও নন। সম্রাট সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে কোন ওমরাহের মৃতুø হলে তাঁর ধনসম্পত্তির মালিক হন সম্রাট। আমীর পরিবারের আভিজাত্য এক পুরুষ, কি দুই পুরুষের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় এবং তাঁর পুত্র বা পৌত্ররা প্রায় ভিক্ষান্নজীবীর স্তরে নেমে আসতে বাধ্য হন। তখন তাঁরা সম্রাটের সেনাবাহিনীতে সাধারণ অশ্বারোহী সেনাদলে নাম লেখান। সম্রাট অবশ্য সাধারণত মৃত আমীরের পত্নী ও নাবালকদের একটা ভাতার বন্দোবস্ত করে দেন, কিন্তু সেটা আমিরী আভিজাত্য অক্ষুণ্ন রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আর যদি কোন আমীর সৌভাগ্যক্রমে দীর্ঘায়ু হন তাহলে তাঁর জীবদ্দশায় তিনি চেষ্টা করে হয়ত তাঁর পুত্রদের একটা ভাল ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে পারেন। সেটা আর কিছু নয়, কোন রকমে সম্রাটের সুনজরে এনে আমীর নন্দনদের কোন যোগ্য পদে বহাল করে যেতে পারেন। কিন্তু সেরকম ব্যবস্থা করে যাওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাও আবার তার জন্য আমীর নন্দনের সুদর্শন শ্রী থাকা দরকার, যাতে তাঁকে দেখলে বনেদী মোগলবংশজাত বলে মনে হয়। তা না হলে সম্রাটের নেকনজরে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সাধারণত অবশ্য সম্রাট হঠাৎ কাউকে কোন উচ্চপদের মর্যাদা দিতে চান না। সাধারণ স্তর থেকে ক্রমে উচ্চস্তরে ধীরে ধীরে উঠতে হয় সকলকে। এই জন্য দেখা যায়, মোগল দরবারের ওমরাহরা সকলে বনেদী বংশের সন্তান নন, কারণ বংশানুক্রমে আমিরী মর্যাদা ভোগ করা হিন্দুস্থানের খুব কম ভাগ্যবানের পক্ষেই সম্ভব হয়। সাধারণত ওমরাহরা বিদেশী ভাগ্যান্বেষীর দল এবং অধিকাংশই অনভিজাত বংশজ। প্রায়ই দেখা যায় যে, তাঁরা ক্রীতদাসপুত্র এবং শিক্ষাদীক্ষার কোন বালাই নেই তাঁদের। সেইজন্যই সম্রাট নিজেই মর্জিমাফিক তাঁদের পদমর্যাদায় ভূষিত করতে পারেন এবং টেনে নিম্নপদে নামিয়েও দিতে পারেন। মান-অপমান বোধ তাঁদের বিশেষ নেই।’

 

ভারতের কৃষি সমাজের এই বৈশিষ্ট্য পশ্চিম ইউরোপের সামন্তবাদের বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্ন। বস্তুত দেহশক্তি নির্ভর প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কৃষি নির্ভরতার জন্য প্রাক-ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজকে যদি সামন্তবাদী বলা হয় তবে সেই সঙ্গে এটাও বলতে হবে যে, এই সামন্তবাদ ইউরোপের সামন্তবাদ থেকে অনেক ভিন্ন। ইউরোপে সামন্তবাদের ভিত্তি হ’ল ব্যক্তি মালিকানা, বড় বড় ভূস্বামী বা সামন্ত প্রভুদের মালিকানা। অন্যদিকে ভারতে এই ‘সামন্তবাদের’ ভিত্তি হ’ল মূলত রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হিসাবে রাজা বা সম্রাটের চূড়ান্ত মালিকানা। প্রকৃত অর্থে এটা ব্যক্তি-রাজা বা সম্রাটের মালিকানাও নয়। এটা সমাজ বা রাষ্ট্রের মালিকানা রাজা বা সম্রাট কর্তৃক প্রয়োগের ব্যাপার ছিল। ইউরোপ ও ভারত এই উভয় সমাজের পার্থক্য বোঝার জন্য আমরা অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারী বার্নিয়েরের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে পুনরায় উদ্ধৃত করছি।

 

 


 ‘যদি কেউ বলেন যে আমাদের দেশের সম্রাটেরও তো জমিদারী আছে এবং সেই জমিদারীতে চাষবাস হয় ভালভাবে, যথেষ্ট লোকজন বাস করে, তাহলে তার উত্তরে আমি বলব, যে রাজ্যের রাজা অন্যান্য আরও অনেকের মতন জাতীয় ভূসম্পত্তির সামান্য একাংশের মালিক, তাঁর সঙ্গে, যিনি সমস্ত সম্পত্তির মালিক, এমন কোন সম্রাটের তুলনা হ’তে পারে না। ফ্রান্সে এমন সুন্দর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যে সম্রাট নিজেই তা সর্বপ্রথম মান্য করে চলেন। তিনি যে ভূসম্পত্তির মালিক, সেখানেও তিনি সম্রাট বলে আইনকানুন অমান্য করে মালিকানা খাটাতে পারেন না। তাঁর জমিদারীর প্রত্যেকটি লোকের আইন-আদালতের সাহায্য নেবার ন্যায্য অধিকার আছে এবং প্রত্যেক চাষী ও কারিগরের অন্যায়ের প্রতিকার করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু এশিয়ায় তা নেই। এশিয়ায় দুর্বল ও অসহায়ের কোন আশ্রয় নেই। অন্যায় বা অবিচারের প্রতিকার করার কোন পন্থা বা সুযোগ নেই তাদের। একজন অত্যাচারী শাসকের চাবুক ও মর্জিই সেখানে একমাত্র ন্যায়দণ্ড, তার উপরে আর কিছু নেই।’

 

বার্নিয়ের যখন এই কথা লিখছেন তখন অবশ্য ফ্রান্সে মধ্যযুগীয় সামন্ত ব্যবস্থাও হুবহু নেই। তবু এই বক্তব্য থেকে তৎকালীন পাশ্চাত্য সামন্তবাদী সমাজের চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। বস্তুত ফ্রান্সে আইনের প্রতি সম্রাটের শ্রদ্ধাবোধ বা আনুগত্য তার ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা থেকে আসে নি। এটা এসেছিল সেখানে সম্রাটের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থেকে। সেখানে সম্রাট ছাড়াও আরও ভূস্বামী বা সামন্ত ছিল যারা রাজতন্ত্রের বা সম্রাটের ক্ষমতাকে নিরংকুশ হতে দেয় নি। ফলে অধীনস্থ সামন্তদের সঙ্গে প্রধান সামন্ত হিসাবে সম্রাট বা রাজার এবং সকল সামন্তের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে এমন আইন গড়ে ওঠে যা কারও ক্ষমতাকে নিরংকুশ হ’তে দেয় নি। পশ্চিম ইউরোপে উৎপাদনের মূল ভিত্তি হিসাবে ভূমি এবং অন্যান্য সম্পত্তি কিংবা উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তির দৃঢ়বদ্ধ অধিকার বা মালিকানা এই অবস্থা সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল। ব্যক্তির এমন কোনও অবস্থান প্রাচ্য কিংবা ভারতীয় সমাজে ছিল না।

 

ইউরোপে যেখানে সামন্ত ভূস্বামীরা অনেকাংশে রাষ্ট্রের প্রভাবকে খর্ব করতে পেরেছে এবং তাকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণও করেছে সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশে রাষ্ট্রই প্রধানত নিয়ন্ত্রণ করেছে সমস্ত সম্পত্তিবান ও উৎপাদক শ্রেণীসমূহকে। এই বাস্তবতায় ব্যক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে পশ্চিম ইউরোপে শিল্প পঁুজিপতি ও মধ্য শ্রেণী সংগঠিত করেছে শিল্প বিপ্লব ও রাষ্ট্র বিপ্লব। শিল্পপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণী এবং মধ্য শ্রেণী যন্ত্রের আবিষ্কার ও প্রসার ঘটিয়ে যেমন পশ্চাৎপদ কৃষি ও উৎপাদন পদ্ধতির অবসান ঘটিয়েছে তেমন জনগণের সমর্থন নিয়ে সেখানে সামন্তবাদী রাষ্ট্রকে পরাজিত করেছে এবং তাকে ধ্বংস করে প্রতিষ্ঠা করেছে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

 

এই বাস্তবতা থেকে ভারত কিংবা বঙ্গের বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। অতীতে এই উপমহাদেশে কিংবা দেশে যারা রাষ্ট্র সংগঠিত করেছিল তারা ছিল মূলত সমরনায়ক, যোদ্ধা। উৎপাদন ব্যবস্থা সংগঠনের মাধ্যমে তাদের উদ্ভব ঘটে নি। মোগল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের উদ্ভব ঘটে মধ্য এশিয়ায় সেনাবাহিনী সংগঠনের মাধ্যমে। তিনি এই সেনাবাহিনী দ্বারা উপমহাদেশ দখল করেন এবং এখানে তাঁর বহিরাগত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই মোগল রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে বঙ্গে পরবর্তীকালে নওয়াবী রাষ্ট্রের স্বতন্ত্র বিকাশ ঘটতে থাকে। এই রাষ্ট্র সেই অর্থে অর্থনীতি বা উৎপাদন ব্যবস্থার ফল নয়। এটা প্রধানত অর্থনীতির বিকাশ কিংবা উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে আসে নি। বরং এই রাষ্ট্র বিকাশ লাভ করেছে প্রধানত সামরিক ব্যবস্থা থেকে। উৎপাদন কিংবা অর্থনীতি ছাড়া রাষ্ট্র বাঁচে না। সুতরাং এই রাষ্ট্র অর্থনীতি পরিচালনা করেছে বৈকি। কিন্তু তাতে অর্থনীতি কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থার পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক হিসাবে রাষ্ট্রের গুরুত্ব কমে নি, বরং আরও বেড়েছে।

 

ব্রিটিশ বণিক শক্তি বঙ্গ কিংবা ভারত জয়ে তাদের স্বদেশের উৎপাদন শক্তির বিকাশ দ্বারা যতই সাহায্য প্রাপ্ত হোক এ দেশ জয়ে তাদের প্রধান শক্তি ছিল সেনাবাহিনী ও যুদ্ধ। এই বণিক শক্তি এ দেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যা কিছু পরিবর্তন এনেছিল তা এনেছিল নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই। মোগলদের রাষ্ট্রের মতই এটাও ছিল একটি বহিরাগত রাষ্ট্র, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-রাষ্ট্রের অংশ। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কতোকগুলি পার্থক্য ছিল। মোগলরা উপমহাদেশে বাইরে থেকে এসে বসবাস করত। কাজেই তাদের রাষ্ট্রের অধিপতিরা উপমহাদেশের সমাজ দেহের সঙ্গে কম বেশী মিশতে বাধ্য হ’ত। এবং সবচেয়ে বড় কথা তারা এই উপমহাদেশ থেকে বাইরে সম্পদ পাচার করতে পারত না এখানেই তারা স্থায়ী অভিবাসী হবার ফলে। অবশ্য বঙ্গ সম্পর্কে এই কথা পুরো প্রযোজ্য নয়। কারণ এখান থেকে মোগল শাসনকর্তারা যে শুধু বিপুল রাজস্ব বা কর পাঠাত দিল্লীতে তা-ই নয় উপরন্তু নিজেরাও নানানভাবে পাঠাত এবং যাবার সময় নিয়ে যেত বিপুল অর্থ ও সম্পদ দিল্লী কিংবা উত্তর ভারতে তাদের নিজস্ব বাসস্থানে। নওয়াবী আমলে শাসকরা যখন এ দেশে স্থায়ী হ’তে থাকে কেবলমাত্র তখন এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। অবশ্য তখনও রাজস্ব যেত দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে।

 

 

 

আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি যে, মোগল কিংবা নওয়াবী রাষ্ট্র ব্যক্তিগত মালিকানাকে সেভাবে স্বীকৃতি বা মর্যাদা দিত না। বিশেষত ভূমিতে। ভূমিতে ব্যক্তির অধিকার বা মালিকানা ছিল রাষ্ট্র কিংবা সমাজের চূড়ান্ত অধিকার বা মালিকানার অংশ হয়ে, অধীনস্থ হয়ে। কাজেই রাষ্ট্র যখন খুশী যে কারও মালিকানা বা অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারত।

 

মোগল বা নওয়াবী রাষ্ট্রের পরিবর্তে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের রাষ্ট্র এমন এক বহিরাগত রাষ্ট্র ছিল যা এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এ দেশের সমস্ত সম্পদ নানানভাবে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে। এই উপনিবেশবাদীরা এ দেশের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল না। তারা তাদের স্বদেশ ইংল্যান্ডের শিল্পের জন্য কাঁচামাল সরবরাহের এবং সেখানকার শিল্পপণ্য এখানে বিক্রির প্রয়োজনে এবং সেই সঙ্গে এ দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিজ দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখবার প্রয়োজনে তারা এখানে ভূমি ও উৎপাদন তথা অর্থনীতিকে রাষ্ট্রের নিরংকুশ ও নিঃশর্ত অধীনতা থেকে মুক্ত করে এবং ব্যক্তির মালিকানা বা সম্পত্তি ব্যবস্থাকে দৃঢ়তর বৈধ রূপ দেয় এবং এই মালিকানা যাতে নিজেদের অনুগত শ্রেণীর হাতে থাকে সেইজন্য ভূমিতে বৃহৎ মালিকানা বা জমিদারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এই দেশ ও উপমহাদেশে নিজস্ব বাজার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে তারা এখানকার পুরাতন দেহশ্রম নির্ভর বা হস্তচালিত শিল্প কাঠামোকে ধ্বংস করে এবং ক্রমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে একটা সীমিত যন্ত্রশিল্প কাঠামো গড়ে তোলে।

 

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের অধীনে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হ’ল তা উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠা করলেও এই মালিকানার স্বাধীনতা কিন্তু তা প্রতিষ্ঠা করে নি। অর্থাৎ নূতন যে বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠল সেই অর্থনীতির কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য এখনও রয়ে গেল পূর্বের মতই রাষ্ট্রের অধীনস্থ। যে অর্থনীতি গড়ে উঠল তা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির স্বাধীন উদ্যোগ ও উদ্যমে গড়ে উঠল না; বরং এই অর্থনীতি গড়ে উঠল রাষ্ট্রের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ, উদ্যোগ ও পরিচালনাধীনে ব্যক্তির সীমিত ও খণ্ডিত উদ্যোগ ও পরিচালনা দ্বারা। অর্থাৎ অর্থনীতিতে রাষ্ট্র অতীতের মত নিরংকুশ না হলেও এখনও তা হ’ল নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি, নিজ প্রাধান্য ও আধিপত্য রক্ষাকারী। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ব্যক্তির বদলে এখনও প্রধানত রাষ্ট্রই সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ করল অর্থনীতিকে, যদিও একটু ভিন্নভাবে।

 

এই দেশে যারা উপনিবেশিক রাষ্ট্র সংগঠিত করেছিল তারা ইউরোপের প্রেক্ষিতে অর্থনৈতিক শক্তি হলেও এ দেশের প্রেক্ষিতে সেটা তাদের প্রধান দিক নয়। কারণ এ দেশে তারা নূতন অর্থনীতি সংগঠন দ্বারা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে নি বরং সেনাবাহিনী সংগঠন দ্বারা, যুদ্ধ জয় দ্বারা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। তাই এই রাষ্ট্রের মূল শক্তি অর্থনীতি বা উৎপাদন নয় বরং সেটা ছিল সমরতন্ত্র বা সেনাবাহিনী। অর্থনীতির শক্তি কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন পঁুজির শক্তি ছিল এই সমরতন্ত্র কিংবা সেনাবাহিনীর অংশ বা অধীন।

 

উদীয়মান পঁুজি বা শিল্প শক্তি ইংল্যান্ডে যে পঁুজিবাদী রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল তা কিন্তু মূলত সেনাবাহিনী দ্বারা নয় বরং তারা তা গড়ে তুলেছিল মূলত পঁুজিবাদী অর্থনীতি সংগঠন দ্বারা। স্বেচ্ছাচারী রাজতন্ত্র ও সামন্তবাদকে আঘাত করতে গিয়ে সেখানেও অর্থনীতি ও সমাজ শক্তিকে সেনাবাহিনী গঠন করতে এবং যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে ক্রমওয়েলের বিদ্রোহ ও বিজয় সেখানে বিকাশমান পঁুজিবাদ ও গণতন্ত্রকে এমন শক্তি যোগায় যার ফলে ক্রমওয়েলের মৃতুøর পর রাজতন্ত্র ফিরে এলেও পুরাতন ব্যবস্থায় সেভাবে ফিরে যাওয়াও আর সম্ভব হয় নি। বরং এবার রাজতন্ত্রকে সামন্তবাদের তুলনায় পঁুজিবাদ এবং স্বৈরতন্ত্রের তুলনায় গণতন্ত্রের প্রতিই অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হয়েছে। ইংল্যান্ডে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিকশিত হ’ল তার প্রধান সংগঠক আমলাতন্ত্র বা সেনাবাহিনী নয় বরং উদীয়মান পঁুজির শক্তি। আমলাতন্ত্র বা সেনাবাহিনীর ভূমিকা এক্ষেত্রে সহায়ক বা অধীনস্থ। এই সঙ্গে এ কথা ভুলে গেলেও চলবে না যে, ইংল্যান্ডে সুদীর্ঘকাল স্থায়ী সেনাবাহিনীই ছিল না।

 

এ দেশে যে ব্রিটিশ সৈনিকরা যুদ্ধ দ্বারা একটা উপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তারা নিজেরা কিন্তু ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী অর্থাৎ আমলা। ইংল্যান্ড থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরা তাদের এ দেশস্থ ব্রিটিশ কর্মচারীদের মাধ্যমে উপনিবেশিক ভারত রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করত। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন বিলুপ্ত হয় এবং সরাসরি ব্রিটিশ রাজ-সরকার উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে। কিন্তু এই রাষ্ট্রের কাঠামো পূর্ববৎ বহাল থাকে। ব্রিটিশ সামরিক ও বেসামরিক আমলারা যে উপনিবেশিক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিল সেটিকে তারা ১৭৫৭ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত কোম্পানির নামে এবং ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজ-সরকারের নামে পরিচালনা করে।

 

 

 

অর্থাৎ ব্রিটিশ ভারতীয় উপনিবেশিক রাষ্ট্রটি ছিল মূলত আমলাতান্ত্রিক। সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের কর্মচারীরা ছিল এই রাষ্ট্রের অধিপতি। ব্রিটিশ শাসকরা উপমহাদেশের প্রশাসন পরিচালনার জন্য বেসামরিক কর্মচারী নিয়োগের উপর অধিকতর গুরুত্ব দিত এবং যুদ্ধ ও জরুরী প্রয়োজন ছাড়া সেনাবাহিনী নিয়োগ করাকে এড়িয়ে চলত। ফলে উপমহাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসন বা বেসামরিক আমলাতন্ত্র বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদার অধিকারী হয়। এইভাবে পূর্বতন মোগল বা নওয়াবী রাষ্ট্রের মত ব্রিটিশের উপনিবেশিক রাষ্ট্রও আমলাতান্ত্রিক হলেও তার সামরিক বৈশিষ্ট্য ততটা নগ্ন ও উগ্র হ’ল না। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও আন্দোলনের ধারা গড়ে তোলার প্রয়োজন উপলব্ধি করে। ফলে স্থানীয় সীমিত স্বায়ত্তশাসন ও নির্বাচনের প্রক্রিয়া গড়ে তোলার কাজ শুরু করা হয়। এই উদ্দেশ্যে ১৮৮২-তে বেঙ্গল মিউনিসিপ্যাল এক্ট প্রবর্তন করা হয়। ১৮৮৫-তে বৈধ রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। ১৯৩৫-এ ভারত শাসন আইন দ্বারা নির্বাচন ও নিয়মতন্ত্রের ধারাকে মোটামুটি পূর্ণতা দান করা হয়। এই ধারাতেই ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭-এ উপমহাদেশের উপনিবেশিক রাষ্ট্রকে দুই খণ্ডে বিভক্ত ক’রে নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের হাতে তার শাসনভার দিয়ে চলে যায়।

 

নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় সরকার গঠনের ফলে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় বেসামরিক আমলাদের প্রশাসন এবং সামরিক আমলাদের নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণের সঙ্গে সংযুক্ত হয় নির্বাচিত রাজনীতিকদের অংশগ্রহণ। ফলে রাষ্ট্রের প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা বা সেনাবাহিনীর পাশে নূতন একটি উপাদান এসে সংযুক্ত হয়, তা হচ্ছে রাজনীতি। রাষ্ট্র থাকলেই রাজনীতি থাকে। তবে ব্রিটিশ পূর্বকালে এটা ছিল রাজা-সম্রাটদের ব্যাপার। ব্রিটিশ শাসনামলে এটা ছিল কোম্পানি, রাজ-সরকার এবং তাদের এই উপমহাদেশস্থ গভর্ণর জেনারেল-ভাইসরয় ও তাদের সঙ্গেকার নীতিনির্ধারকদের ব্যাপার। নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এটা এখন ক্রমে জনগণেরও স্বীকৃত ও বৈধ ব্যাপারে পরিণত হ’ল। রাজনীতি বা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণ পূর্বের মত আর আমলাতন্ত্রের তথা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের একচেটিয়া ব্যাপার থাকল না। এখানে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও নির্বাচন দ্বারা একদল পেশাদার রাজনীতিকেরও ভূমিকা দেখা দিল। বরং ক্রমে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় রাজনীতি প্রশাসন ও প্রতিরক্ষার কর্মচারীদের পরিবর্তে রাজনীতিক কিংবা জন-প্রতিনিধিদের জন্যই বৈধ হয়ে দেখা দিল। ফলে মনে হ’তে পারত যে, রাষ্ট্র এখন আর আমলাতান্ত্রিক নয় বরং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধীনে থেকে গণতান্ত্রিক রূপ লাভ করেছে।

 

কিন্তু বাস্তবটা কি তা-ই? সমস্ত প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও আইনকে হুবহু ও অপরিবর্তিতভাবে গ্রহণ ক’রে উপমহাদেশে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান ও ভারত নামে যে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হ’ল তা ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। এই রাষ্ট্র দুইটির সর্বোচ্চ অধিকারীদের ভাষা, ধর্ম ও দেশ পরিচয় পরিবর্তিত হ’ল মাত্র। মূল কাঠামোতে তেমন কোন পরিবর্তন হ’ল না। যুগের ধারায় এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের আঘাতে কিছু পরিবর্তন হয়েছে বৈকি, কিন্তু সেসব মৌলিক নয়। এমনকি নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা দ্বারা ধর্ম-সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ১৯৪৭-এ যে রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নিকট রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বের হস্তান্তর হ’ল তারাও একটা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর আবরণ হ’ল মাত্র। তারা যে রাষ্ট্রটিকে পরিচালনা করার ক্ষমতা পেল সেটি মূলত সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের দ্বারা সংগঠিত এবং প্রকৃতপক্ষে তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ ১৯৪৭-এর নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা যেটা হ’ল সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়মতন্ত্রী রাজনীতিক ও নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের আপোস। এর ফলে জনগণের উপর আমলাতন্ত্রের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ বহাল রইল এই রাজনীতিক ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমর্থন নিয়ে। ব্রিটিশ শাসকরা পূর্ব থেকে পৌরসভা, পঞ্চায়েত, ইউনিয়ন বোর্ড ইত্যাদি পর্যায়ে আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে যে নির্বাচনমূলক জন-প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল এবং যে ব্যবস্থাকে ক্রমাগত এগিয়ে নিয়ে প্রদেশ পর্যায় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করেছিল, ১৯৪৬-এর নির্বাচন ও ১৯৪৭-এর রাষ্ট্রীয় পরিচালনাভার হস্তান্তর দ্বারা সেই শাসন ব্যবস্থাকেই জাতীয় বা কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে চলে গেল।

 

 

 

আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচনমূলক রাজনীতি যুক্ত হওয়ায় ১৯৪৭ পরবর্তী রাষ্ট্র ও সমাজ এক অস্বাভাবিক দ্বন্দ্বের শিকার হ’ল। রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের বলপ্রয়োগের ক্ষমতার বৈধ অধিকারী কেন্দ্রীয় সংগঠন। এই সংগঠন হ’ল আমলাতান্ত্রিক। অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের কর্মচারীদের ক্ষমতার উপর হস্তক্ষেপ করার বিশেষ কোনও অধিকার বা সুযোগ রইল না নির্বাচিত সরকারের। অথচ এই কর্মচারীরা কিংবা তাদের নিজস্ব প্রতিনিধিরাও বৈধ উপায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্বে রইল না। ফলে রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী প্রশাসন ও প্রতিরক্ষার আমলাদের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিকদের ঐক্য বা সমঝোতার পাশে দ্বন্দ্বও দেখা দিল। দায়িত্ব ও ক্ষমতার বিচ্ছিন্নতা থেকে এল এক জটিল দ্বন্দ্ব এবং তজ্জনিত সামাজিক-রাষ্ট্রিক অচলাবস্থা। বস্তুত ব্রিটিশ প্রবর্তিত এই নির্বাচনের ব্যবস্থার মাধ্যমে এই উপমহাদেশের ‘স্বাধীনতা’ প্রদানের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশিক শোষণ ও লুণ্ঠনের ব্যবস্থাকে নূতন অবস্থায় নূতন রূপে অব্যাহত রাখার কূটচালও।

 

এই রকম অবস্থায় নির্বাচিত রাজনীতিকরা যে শুধু উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কর্তৃক সংগঠিত ধনিক ও পেশাজীবীদের স্বার্থের প্রতিনিধি হয়ে দেখা দিল তা-ই নয়, উপরন্তু তারা আমলাতন্ত্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জনগণকে স্বৈরাচারমূলকভাবে অর্থাৎ মূলত আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই শোষণ ও লুণ্ঠন ক’রে অর্থ ও সম্পত্তি সঞ্চয়ের কাজে নেমে পড়ল। ভারতে আমরা দেখেছি যে, জনগণকে লুটতরাজে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র এবং নিয়মতন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের মধ্যে এই সমঝোতা ও আপোস বিনষ্ট হয় নি। সেখানে রাজনীতিকদের নেতৃত্বেই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি পরিচালিত হচ্ছে। এর একটি প্রধান কারণ, সেখানকার জাতি ও জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্য-বিভিন্নতা, বিশালতা ও জটিলতা। বহুসংখ্যক ভাষা ও জাতিসত্তার মধ্যে ঐক্য রক্ষায় সেখানে নিয়মতন্ত্রী রাজনীতির যে অপরিহার্যতা বা গুরুত্ব রয়েছে সেটা সেখানে রাজনৈতিক সরকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি প্রধান কারণ হয়ে আছে। উপরন্তু সেখানে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাষার জনগোষ্ঠীর অসন্তোষ কিংবা বিদ্রোহ এখনও এমন পর্যায়ে যায় নি যাতে সেখানে নিয়মতন্ত্রী রাজনীতিকরা রাজনৈতিক পদ্ধতিতে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূূমিকা রাখতে একেবারে অক্ষম হয় এবং অন্যদিকে আমলাদের পক্ষেও আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিকে নিরংকুশ করা সম্ভব কিংবা অপরিহার্য হয়।

 

কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অবস্থাটা ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক বৎসর পর আমলাতন্ত্রের কেন্দ্রীয় শক্তি সেনাবাহিনী রাজনীতিকদের কাছ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্ব কেড়ে নেয়। ১৯৫৮-তে যে সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তা-ই নির্বাচনের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে ১৯৬৯ পর্যন্ত। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের চাপে জেনারেল আইয়ুবের নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটলে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার রাষ্ট্রের নেতৃত্বে আসে।

 

১৯৭১-এ পূর্ব বঙ্গে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক সরকার এখানে ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব পায়। ১৯৭৫-এ সেনাবাহিনীর একাংশ কর্তৃক আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত হলে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পুনরায় এই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব বা সরকারী ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। এই সেনাবাহিনীর সেনাপতি জেনারেল জিয়া নিজের শাসনকে জেনারেল আইয়ুবের মত নির্বাচনের মাধ্যমে একটা পর্যায়ে অসামরিক রূপ দেন। জেনারেল জিয়া এক সামরিক অভুøত্থানে নিহত হলে তাঁর উপরাষ্ট্রপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হন। কিন্তু কয়েক মাস পরই তাঁকে সরিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এরশাদ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পুনরায় রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দখল করেন। বর্তমানে জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রূপ নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত আছেন।

 

এ দেশে এই সুদীর্ঘ ঘটনা প্রবাহ ও উলট-পালটের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতির কতকগুলি সত্য এবং রহস্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে। আমরা দেখেছি যে, এ দেশে রাষ্ট্রই জনগণকে নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় বস্তুগত হাতিয়ার এবং এই রাষ্ট্রই ধন-সম্পত্তি সঞ্চয় এবং প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা লাভের সবচেয়ে বড় উৎস। বস্তুত এ দেশের রাষ্ট্র অর্থনীতি বা উৎপাদনের পরিচালক শ্রেণীগুলির কিংবা পঁুজির অধীন নয় বরং রাষ্ট্রেরই অধীন এইসব শ্রেণী কিংবা পঁুজি। ইউরোপে আধুনিক শিল্পোন্নত সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে পঁুজি কিংবা শিল্প যে ভূমিকা পালন করেছে এ দেশে পশ্চিমের শিল্পোন্নত সমাজের অধীনস্থ ও নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সীমিত শিল্পায়িত সমাজ ও একটি বাজার অর্থনীতি গঠনে রাষ্ট্র সেই ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ এ দেশে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠেছে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক শ্রেণীসমূহ।

 

 

 

সুতরাং আমাদের প্রয়োজন দেখা দেয় রাষ্ট্রের অধিকারী শ্রেণী বা গোষ্ঠীগুলোকে চেনার। এ দেশে রাষ্ট্রের মূল অধিকারী হ’ল তার কর্মচারী বা আমলারাই। অর্থাৎ সেনাবাহিনী, প্রশাসন, পুলিশ, বিডিআর, বিচার, কারাগার, গোয়েন্দা, আবগারী, শুল্ক ও কর ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাগ সমন্বিত যে রাষ্ট্রযন্ত্রটি গড়ে উঠেছে তার কর্মচারীরাই এই রাষ্ট্রের মূল অধিকারী। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার প্রকৃত ও মূল ক্ষমতা তাদেরই হাতে। এই রাষ্ট্রকে মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এভাবে গড়ে তুলেছিল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। অর্থাৎ জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগ ও সামরিক স্বৈরতা হ’ল এই রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।

 

বহুদূর থেকে ক্ষুদ্র লোকবল নিয়ে এসে বিশাল উপমহাদেশ জয় ও শাসন করার সময় ব্রিটিশ শাসক বুঝেছিল যে, শুধু জবরদস্তি ও প্রচলিত পদ্ধতিতে এই উপমহাদেশের অন্তর্দ্বন্দ্ব ব্যবহার দ্বারা দীর্ঘকাল উপমহাদেশ শাসন করা যাবে না। সুতরাং ১৮৫৭-তে ভারতব্যাপী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ নূতন পদ্ধতি বা কৌশল অবলম্বন করতে দেরী করে নি। এর ফলশ্রুতি হ’ল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থার প্রতি ব্রিটিশের উৎসাহদান ও অনুমোদন। এই ব্যবস্থার ফলে শুধু রাষ্ট্রের আমলারা শাসনজাত সুযোগ-সুবিধা পেল না উপরন্তু ব্রিটিশের উপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতায় ও নিয়ন্ত্রণে ভূমি, শিল্প ও বাণিজ্যে যে সম্পত্তিবান শ্রেণীসমূহ গড়ে উঠেছিল তারা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই রাষ্ট্রের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ দ্বারা নিজেরাও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা অর্জনের পথ পেল। বস্তুত ব্রিটিশের উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এতে করে তার চরিত্র হারায় নি। বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরের বেসরকারী সম্পত্তিবান বা ধনিক শ্রেণীসমূহ এর দ্বারা নিজেদের সম্পদ-সম্পত্তি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ পেল মাত্র। এর ফলে শাসিত শ্রমজীবী ও উৎপাদক জনগণের ভাগ্যের কোনই পরিবর্তন হ’ল না, বরং তারা নির্বাচনকে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের পথ মনে করে প্রতারিত হ’ল।

 

নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা দ্বারা উপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ব্যবহার ক’রে সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিক ও জন-প্রতিনিধিদের নূতন একটা শ্রেণী গড়ে উঠল যাদের কাজ হ’ল উপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংরক্ষণ ও পরিচালনায় জনগণের সমর্থন সরবরাহ করা। ব্রিটিশ চলে গেলেও এমনকি পাকিস্তানী শাসনের অবসান হলেও এ দেশে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও রাজনীতির এই ভূমিকার অবসান হয় নি। তবে আজ এই রাষ্ট্রটি উপনিবেশিক না হয়ে নয়া উপনিবেশিক। শুধু ব্রিটিশ পুঁজির স্বার্থ নয় সেই সঙ্গে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র সহ বিভিন্ন উন্নত রাষ্ট্রের পঁুজির শোষণ, লুণ্ঠন ও আধিপত্যের স্বার্থ রক্ষা করা এই রাষ্ট্রের একটি প্রধান কাজ হয়ে আছে। অন্যদিকে এই রাষ্ট্র পূর্ববৎ আমলাতান্ত্রিক। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আমলাদের স্বৈরাচারী ও জবরদস্তিমূলক শাসন ও শোষণকে অব্যাহত রাখাও এই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কাজ হয়ে আছে। যেহেতু রাষ্ট্রটি আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী সেহেতু যে কোন ধরনের নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই রাজনৈতিক আবরণে ক্রিয়াশীল থাকে প্রধানত আমলাতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র। এই অবস্থায় এ দেশে সকল রাজনৈতিক শাসকই বাধ্য হয় স্বৈরতন্ত্রী ও সন্ত্রাসী হ’তে, কারণ তাদের উদ্ভব যে শুধু স্বৈরতন্ত্রী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামোতে এবং তার প্রয়োজনে হয় তা-ই নয় উপরন্তু তাদেরকে কাজও করতে হয় আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই।

 

বস্তুত এ দেশের রাষ্ট্রের এই ভূমিকা ও স্বরূপ বুঝতে ভুল হলে এ দেশে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়নে কোন সঠিক পদক্ষেপ দেওয়াই সম্ভব নয়। কারণ এ দেশে প্রচলিত ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বস্তুগত শক্তি হচ্ছে রাষ্ট্র। আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, এই রাষ্ট্র প্রধানত পঁুজি কর্তৃক সংগঠিত নয়। কিংবা সংগঠিত নয় জনগণের রাজনীতি কর্তêৃক। এই রাষ্ট্র সংগঠিত প্রধানত সেনাবাহিনী বা সামরিক আমলাতন্ত্র কর্তৃক। এটা এই রাষ্ট্রের মূল উপাদান।

 

এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এ যুদ্ধ দ্বারা এই রাষ্ট্রের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয় এবং ’৭১-এ যুদ্ধ পরিচালনায়ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল। কিন্তু ’৭১-এ ভারত থেকে যে যুদ্ধ পরিচালিত হয় তার মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধ জয় দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৭১-এ যে রাষ্ট্রটি লাভ করে তার সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের কাঠামো ছিল মূলত অপরিবর্তিত। অধিকন্তু এই কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগ বিকশিত হয়েছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোভুক্ত পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মাত্র। ফলে উপর তলায় যে পরিবর্তনই ঘটুক অবকাঠামোতে মূলত কোন পরিবর্তনই ঘটে নি। এবং এক সময় এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল শক্তি সেনাবাহিনী রাষ্ট্র পরিচালনা ক্ষমতার তথা রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের দাবীদার হয়েছে এবং সরকারী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা এবং জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব দখল করে নিয়েছে। এইভাবে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার ফলে সরকার এবং রাষ্ট্রের মধ্যে যে অমীমাংসেয় ও গুরুতর দ্বন্দ্ব ঘটে তার অবসান ঘটিয়েছে। এখন রাষ্ট্রটা প্রকৃতপক্ষে যাদের তারাই তার সরকার হয়েছে এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকদেরকে করে নিয়েছে নিজেদের শাসনের সহযোগী।

 

১০

 

এই ধরনের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংরক্ষণের উদ্দেশ্য দেশের বা জনগণের উন্নতি নয়। বরং তার বিপরীতে রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের উন্নয়ন ও শক্তিবৃদ্ধি রোধ করে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর উন্নয়ন সাধন করা। সঙ্গতভাবেই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রকৃত অধিকারী যারা সেই সামরিক-বেসামরিক আমলারাই এই রাষ্ট্র পরিচালনার ফল সবচেয়ে বেশী ভোগ করে। তারা অর্থ, সম্পদ, জমি, বাড়ী করে, জীবনের বিভিন্ন সুখ-ভোগের আয়োজন করে। তাদের চাকুরীর মেয়াদ সীমিত। সুতরাং চাকুরী থেকে অবসর নেবার পর যখন তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে না তখনও যাতে তাদের জীবনে ক্ষমতা, সম্পদ, নিরাপত্তা, প্রতিষ্ঠা ও সুখ-ভোগ থাকে চাকুরী জীবনে রাষ্ট্র ক্ষমতার বৈধ ও অবৈধ ব্যবহার দ্বারা তারা সেই ব্যবস্থা করে। এ দেশে তাই তারা শিল্প বিকাশ কিংবা জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজন থেকে ব্যক্তি মালিকানা কিংবা ব্যক্তি পঁুজির সংরক্ষণ চায় না এটা তারা চায় তাদের নিজেদের প্রয়োজনেই। এই ব্যক্তি মালিকানা তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সম্পদ সৃষ্টি ও রক্ষণের জন্যই প্রয়োজনীয়। সুতরাং এ দেশে ব্যক্তিগত সম্পদ ও সম্পত্তি সৃষ্টির সবচেয়ে বড় যন্ত্র কিংবা শিল্প হ’ল রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র দ্বারা আমলারা যেমন সম্পত্তিবান হয় তেমন নিজেদের চারপাশে সৃষ্টি করে রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত একদল সম্পত্তিবান বা ধনিক, চাকুরীর মেয়াদ ফুরালে যাদের কাতারে তারা নিজেরাও অবস্থান নেয়। তাছাড়া রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত এই ধনিক ও বিত্তবান শ্রেণী সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে আমলাদের নিজস্ব সম্পদ সৃষ্টির জন্য এবং পরবর্তীতে তাকে রক্ষার জন্যও। এই ধনিক শ্রেণীর আবেষ্টন যেমন আমলাদের সম্পত্তি সৃষ্টির সুযোগ করে দেয় তেমন তাদের অর্জিত সম্পত্তিকে রক্ষার সামাজিক ভিত্তিও যোগায়। এই কারণেও এ দেশে ১৭৫৭-এর পর বিজয়ী ব্রিটিশ আমলারা তাদের রাষ্ট্রের সাহায্যে নিজেদের চারপাশে সৃষ্টি করেছিল ভূস্বামী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আইনজীবী সহ অজস্র ধরনের পেশাজীবী ও বিত্তবান। অবস্থাটা এখনও প্রায় একই রকম। এই একই কারণে এ দেশের রাষ্ট্রের অধিপতি ও সম্পত্তিবান শক্তির মূল উৎস দেশের ভিতরে নয়, বাইরে। গোটা ব্যবস্থাটার লক্ষ্য উৎপাদক ও শ্রমশীল জনগণকে নির্দয়ভাবে লুণ্ঠন করা। এর সঙ্গে দেশের উৎপাদনশীলতা বা শক্তি বৃদ্ধির সম্পর্ক মূলত নেই। এই জন্য এই রাষ্ট্র নিজ অস্তিত্বের জন্য সর্বদা থাকে বিদেশ মুখাপেক্ষী। বিদেশী বিভিন্ন আধিপত্যবাদী ও বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তির সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে এই রাষ্ট্রের অধিপতিরা এ দেশে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।

 

এই রকম এক স্বৈরতন্ত্রী ও আমলাতন্ত্রী রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অন্যতম শর্তই হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণাধীন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও নির্বাচন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের রাষ্ট্রের চাপে ও বিরোধিতায় প্রকৃত গণতন্ত্র বা জনগণের গণতন্ত্র গড়ে ওঠারই পথ পায় না। সুতরাং এই দেশে প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও নির্বাচন জনগণের প্রতি প্রতারণার এক অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে দেখা দেয়। বস্তুত রাষ্ট্রের মালিক আমলা এবং সম্পত্তির মালিক ধনিকরা এই আমলাতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে জনরোষ ও গণ-বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে এক নিপুণ ফাঁদ হিসাবে গড়ে তুলেছে নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একদল রাজনীতিক ও জন-প্রতিনিধি গড়ে উঠেছে যাদের কাজ হ’ল জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে প্রতারিত করা, জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভকে রাস্তার মিছিল ও কথার জালে বেঁধে নির্বাচনের পথে নিয়ে শান্ত ও নিস্তেজ করা, জনগণের গতিশীলতাকে আমলাতান্ত্রিক নিয়মতন্ত্রের চোরাবালিতে নিয়ে আটকে দেওয়া। নিয়মতন্ত্রীদের মাধ্যমে সুবিধাভোগী শ্রেণী বা গোষ্ঠীগুলি জনগণের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনা ও অবস্থা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ন্ত্রিত পথে নিতে পারে এবং প্রয়োজনে বিভক্তি, অন্তর্দ্বন্দ্ব, দাঙ্গা এবং সরাসরি রাষ্ট্রীয় আক্রমণ দ্বারা তাকে বিনষ্ট করতে পারে। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এ পর্যন্ত এই ঘটনাই এ দেশে ঘটে আসছে নানানভাবে।

 

এমন অবস্থায় এ দেশে যতবারই সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হোক তৃতীয় বিশ্বের আরও বহু দেশের মত এখানেও রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের প্রয়োজনে, আমলানিয়ন্ত্রিত ধনিকদের প্রয়োজনে নির্বাচন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিবারই ফিরে আসতে বাধ্য। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি বেশী বেড়ে উঠে আমলাতন্ত্রের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিলে এ দেশে আমলাতন্ত্রের প্রধান শক্তি সেনাবাহিনী তাকে আঘাত ক’রে নিয়ন্ত্রণযোগ্য আকার দিয়ে ফিরিয়ে আনে মাত্র। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এবং আমলা-ধনিকতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এ দেশে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য এটাই অনিবার্য ও অপরিবর্তনীয় নিয়তি।

 

 

১১

 

নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও নির্বাচন যেমন এ দেশের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য অত্যাবশ্যক তেমন পরলোকবাদী ধর্মও তার জন্য অত্যাবশ্যক। বরং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা ও সংযত রাখার জন্য নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির তুলনায়ও ধর্ম বিশেষত ইসলাম ধর্মের গুরুত্ব এই রাষ্ট্রের নিকট অনেক বেশী। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি জনগণকে চিন্তার ক্ষেত্রে অন্তত অধিকার সচেতন করে এবং জিনিসটা জনগণকে অনেক বিষয়ে সক্রিয়ও করে। বিশেষত লোকবাদী দর্শন ও রাজনীতির প্রভাব এতে করে প্রবল হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। ফলে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেমন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তেমন মাঝে মাঝে এই রাজনীতি রাষ্ট্রের জন্য এত বিপদজনক হয় যে, তখন রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ছাড়াও রাষ্ট্রের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। ফলে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি নিয়ে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ঝামেলা ও দুশ্চিন্তাও থাকে। কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রে এটা সেভাবে থাকে না। কারণ পরলোকবাদী ধর্ম মানুষকে লোকবাদী বা জীবনবাদী করে না। বরং তার দৃষ্টিকে করে মৃতুøমনস্ক। ধর্মের মূল আবেদন মৃতুøর পরের সত্তা বা জীবন সম্পর্কে বিশ্বাসের প্রতি। সুতরাং সকল ধর্মের মত ইসলামও এ ক্ষেত্রে মানুষকে এ জীবনকে তুচ্ছ করতে এবং মৃতুøর পরের জীবন নিয়ে বেশী করে ভাবতে উৎসাহ দেয়। ইসলাম বৈষয়িক ভোগকে নাকচ করে নি; কিন্তু তা শিখিয়েছে ঘৃণা ও ভয়ের সাথে ভোগ করতে। কারণ এ জীবনের ভোগ নয় পরকালের ভোগই আসল ও স্থায়ী ভোগ। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কোর্‌আনে৭ বলা হচ্ছে, ‘তোমাদিগকে যাহা কিছু দেয়া হইয়াছে তাহা তো পার্থিব জীবনের ভোগ ও শোভা এবং যাহা আল্লাহ্‌র নিকট আছে তাহা উত্তম এবং স্থায়ী। তোমরা কি অনুধাবন করিবে না?’

( ২৮ সূরা কাসাসঃ ৬০ আয়াত)

 

৩নং সূরা আল ইমরানের ১৮৫নং আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘জীব মাত্রই মৃতুøর স্বাদ গ্রহণ করিবে। কিয়ামতের দিন তোমাদিগকে তোমাদের কর্মফল পূর্ণমাত্রায় দেওয়া হইবে। যাহাকে অগ্নি হইতে দূরে রাখা হইবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হইবে সে-ই সফলকাম। এবং পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছু্‌ই নয়।’

কোর্‌আনে আরও বলা হচ্ছে,

 

‘পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং যাহারা তাক্‌ওয়া অবলম্বন করে তাহাদিগের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেয়; তোমরা কি অনুধাবন কর না?’

(৬ সূরা আন্‌আমঃ ৩২ আয়াত)

 

‘এই জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নহে। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন, যদি উহারা জানিত।’

(২৯ সূরা আনকাবুতঃ ৬৪ আয়াত)

 

সুতরাং লোক বা জীবন নয়, মৃতুøই প্রকৃত জীবন। তার সুখ-ভোগের জন্য এ জীবনে প্রস্তুত হ’তে হবে মাত্র। মানুষ তার জীবনের পুণ্যকর্মের ফলই পাবে মৃতুøর পর। কিন্তু এই পুণ্যকর্মটা কি? এটা জ্ঞান-বিজ্ঞান কিংবা কর্মসাধনার স্বাধীন পথ অনুসরণ নয়। বরং এটা মূলত নামায, রোযা, হজ্জ্‌, যাকাত ইত্যাদি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কর্মধারা। এই কর্মধারার মূল লক্ষ্য পরকালে সুখলাভ করা। আল্লাহ্‌য় বিশ্বাস ও কোর্‌আন-হাদীস দ্বারা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ ক’রে পরজীবনে সুখলাভ করা সম্ভব। আল্লাহ্‌য় অন্ধ বিশ্বাস ও কোরআন-হাদীস দ্বারা নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ ক’রে পরজীবনে সুখলাভ করা সম্ভব। আল্লাহ্‌য় অন্ধ বিশ্বাস ও তার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য এই ধর্মের সবচেয়ে বড় দাবী। কোর্‌আনে বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহ্‌র নিকট নিকৃষ্ট জীব তাহারাই যাহারা কুফরী করে এবং ঈমান আনে না।’

(৮ সূরা আনফালঃ ৫৫ আয়াত)

 

অর্থাৎ আল্লাহ্‌র নিকট উৎকৃষ্ট জীব হতে হলে জ্ঞান সাধনা ও মনুষ্যত্ব চর্চার বদলে তার প্রতি ঈমান বা বিশ্বাস আনবার এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী চলবার গুরুত্ব অনেক বেশী। সুতরাং এই ধর্মাচরণের মূল কথা হ’ল আল্লাহ্‌য় বিশ্বাস এবং তার নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। কোরআনে বলা হচ্ছে,

 

‘যদি তাহারা তোমার সহিত বিতর্কে লিপ্ত হয় তবে তুমি বল, “আমি আল্লাহ্‌র নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছি এবং আমার অনুসারীগণও।” আর যাহাদিগকে কিতাব* দেওয়া হইয়াছে তাহাদিগকে ও নিরক্ষরদিগকে** বল তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করিয়াছ?” যদি তাহারা আত্মসমর্পণ করে তবে তাহারা পথ পাইবে।’

(৩ সূরা আল ইমরানঃ ২০ আয়াত)

 

অপরদিকে ইসলামে ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হ’ল মালিক ও বান্দা বা প্রভু ও দাসের সম্পর্ক। এ সম্পর্কে কোর্‌আনে বার বার বলা হয়েছে। শুধু মানুষকে নয়, সমস্ত বিশ্বজগতকেই সৃষ্টি করা হয়েছে আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য ­­এটাই হ’ল ইসলামের একটি মৌল ধারণা। তার আনুগত্য, উপাসনা ও প্রশংসা করার জন্যই সবকিছুর সৃষ্টি। সমস্ত সৃষ্টি ঈশ্বরের নিকট উপস্থিত হবে তার দাস রূপে। কোর্‌আন বলছে,

 

* বাইবেল ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ

** মক্কার মূর্তি পূজারী যাদের ধর্মগ্রন্থ ছিল না।

 

 

১২

 

‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেহ নাই, যে দয়াময়ের নিকট উপস্থিত হইবে না বান্দা রূপে।’

(১৯ সূরা মার্‌য়ামঃ ৯৩ আয়াত)

 

এই ‘দাস’ মানুষের প্রতি কোরআনে আহ্বান করা হচ্ছে ‘আমার বান্দাদিগের অন্তর্ভুক্ত হও, এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’

(৮৯ সূরা ফাজ্‌রঃ ২৯, ৩০ আয়াত)

 

কাজেই স্বাধীন মানুষ কিংবা মানুষের স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব ইসলামের ধারণা বিরোধী। এমন অবস্থায় ইসলাম চর্চার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ ও দাসত্বের চেতনাকে সমস্ত সমাজে অব্যাহতভাবে রক্ষা ও বর্ধন করা হয় যা ইসলামী সমাজ শাসকদের খুবই কাজে লাগে।

 

মানুষ আত্মসমর্পণকারী ও দাসত্বপরায়ণ হলে শাসকদের বড় সুবিধা। কারণ তাহলে তাকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা সহজ হয়। তাকে নিয়ে তখন যা খুশী তা-ই করা যায়। মানুষ যখন পরলোকে সুখ ভোগের আশায় জীবনের দুঃখ-কষ্ট বিনা প্রতিরোধে মেনে নেয় তখন শাসকের স্বেচ্ছাচার পরিতৃপ্ত হয় সহজে। যার এ জীবনের কাছে দাবী থাকে না তার কাছ থেকে শাসক সবই নির্বিবাদে আদায় করে নিতে পারে। অবশ্য এর জন্য ইসলামী সমাজের শাসককে ইসলামী বা মুসলমান হ’তে হবে। তাহলে তার পক্ষে ইসলামী বা মুসলমান সমাজকে শাসন করা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে নৈতিক ও বৈধ হয়। সুতরাং রাষ্ট্র-শাসক ও রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন হয় ধর্মকে লালন করা। এই রকম অবস্থায় ধর্মের প্রভাবে মানুষ জীবনের দুঃখ-কষ্টের জন্য, অধোগতি ও বিপর্যয়ের জন্য দেশের শাসক ও রাষ্ট্রকে দায়ী না করে দায়ী করে ভাগ্য ও ঈশ্বর বা আল্লাহর অসন্তোষকে। মনে করে, আল্লাহ্‌র পথ ঠিকমতো অনুসরণ না করায় বা ঠিকমতো ধর্মাচরণ না করায় এইসব দুঃখ-কষ্ট। কিংবা মনে করে, আল্লাহ্‌ এভাবে দুঃখ-কষ্ট দিয়েই মানুষকে পরীক্ষা করে এবং এই পরীক্ষায় আল্লাহ্‌র বিশ্বাসী দাস বা মুমিন বান্দা হিসাবে উত্তীর্ণ হতে পারলে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা অনুযায়ী পরকালে কিংবা ইহ ও পর উভয় কালেই পাবে পুরস্কার।

 

কোর্‌আনে বলা হচ্ছে,

 

‘তোমাদিগকে নিশ্চয় তোমাদের ধনৈশ্বর্য ও জীবন সম্বন্ধে পরীক্ষা করা হইবে।’

(৩ সূরা আল ইমরানঃ ১৮৬ আয়াত)

 

আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই হয় না। কাজেই দুঃখ ও বিপদও তো আসে আল্লাহর কাছ থেকে। ‘আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বিপদই আপতিত হয় না এবং যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে তিনি তাহার অন্তরকে সুপথে পরিচালিত করেন।’

(৬৪ সূরা তাগাবুনঃ ১১ আয়াত)

 

 ইসলামের দাবী মানুষ সকল বিষয়ে আল্লাহ্‌র উপর নির্ভর করুক। ৩নং সূরা আল ইমরানের ১৬০ নং আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহ্‌ তোমাদিগকে সাহায্য করিলে তোমাদের উপর জয়ী হইবার কেহই থাকিবে না। আর তিনি তোমাদিগকে সাহায্য না করিলে, তিনি ছাড়া কে এমন আছে, যে তোমাদিগকে সাহায্য করিবে? মুমিনগণ আল্লাহর উপরই নির্ভর করুক।’

 

 যারা বিশ্বাসী মুসলমান তারা জীবন ও জীবিকার জন্য, উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের কাছে দাবী রাখবে কেন? কোর্‌আন বলছে,

 

 ‘বল, “আমাদিগের জন্য আল্লাহ্‌ যাহা নির্দিষ্ট করিয়াছেন তাহা ব্যতীত আমাদিগের অন্য কিছু হইবে না; তিনি আমাদিগের কর্ম-বিধায়ক এবং আল্লাহ্‌র উপরই মুমিনদিগের নির্ভর করা উচিত।”

 

(৯ সূরা তাওবাঃ ৫১ আয়াত)

 

 

১৩


 আর রিয্‌ক্‌ তথা আহার কিংবা অন্ন সংস্থান তো সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ৩০নং সূরা রূম-এর ৩৭নং আয়াত -এ বলা হয়েছে,

 

 ‘উহারা কি লক্ষ্য করে না, আল্লাহ্‌ যাহার জন্য ইচ্ছা তাহার রিয্‌ক* প্রশস্ত করেন অথবা উহা সীমিত করেন? ইহাতে অবশ্যই নিদর্শন রহিয়াছে মুমিন ** সম্প্রদায়ের জন্য।’

 

 কোরআনে এই কথা বহুবার বিভিন্নভাবে বলা হয়েছে। যেমন,

 

 ‘বল, “আমার প্রতিপালক তাঁহার বান্দাদিগের মধ্যে যাহার প্রতি ইচ্ছা তাহার রিয্‌ক বর্ধিত করেন অথবা উহা সীমিত করেন।”

 

(৩৪ সূরা সাবাঃ ৩৯ আয়াত)

 

 ‘ইহারা কি জানে না, আল্লাহ্‌ যাহার জন্য ইচ্ছা তাহার রিয্‌ক বর্ধিত করেন অথবা হ্রাস করেন? ইহাতে অবশ্যই নিদর্শন রহিয়াছে মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য।’

 

(৩৯ সূরা যুমারঃ ৫২ আয়াত)

 

 ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী সকলের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ্‌রই; তিনি উহাদিগের স্থায়ী ও অস্থায়ী অবস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত; সুস্পষ্ট কিতাবে সব কিছুই আছে।’

 

(১১ সূরা হূদঃ ৬ আয়াত)

 

 অর্থাৎ জীবিকা ও অন্ন সংস্থানের জন্য জনগণ নির্ভর করবে আল্লাহ্‌র উপর। তারা কিছু দাবী করবে না বরং অনুগ্রহ প্রার্থনা করবে আল্লাহ্‌র কাছে। সুতরাং রাষ্ট্রের কাছে দাবীর কি আছে?

 

 এমন অবস্থায় যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দ্বারা জনগণকে স্বেচ্ছাচারীভাবে শাসন, নিয়ন্ত্রণ এবং শোষণ ও লুণ্ঠন করে ধর্মচর্চা তাদের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ও লাভজনক হয়ে দেখা দেয়। এই ধর্ম দ্বারা জনগণের অসন্তোষ ও ক্ষোভকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ হয়। বস্তুত এর ফলে রাষ্ট্র বা শাসকের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বা অসন্তোষ জাগবার কোন কার্যকর পথ পায় না। ইসলামের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অত্যন্ত দৃঢ়। প্রতি মসজিদ থেকে দৈনিক পাঁচ বার নামাযের আযান ও পাঁচ বার নামায, শুক্রবারে মসজিদে পুরুষদের বাধ্যতামূলক সম্মিলিত নামায, এক মাস ব্যাপী রোযা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্মীয় কর্তৃত্ব কঠোরভাবে সমাজ ও জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়া আছে জনমত নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করার জন্য বিভিন্ন সময় মিলাদ, ওয়াজ ইত্যাদি ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

 

* রিয্‌ক অর্থ আহার কিংবা অন্ন অথবা উপার্জন

** বিশ্বাসী

 

 এই ধর্মীয় কর্তৃত্ব, ইসলামী ব্যবস্থায়, মূলত রাষ্ট্র নিজেই। অর্থাৎ ইসলামে রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক কোন বস্তু নয়। ইসলামী শাসকই স্বয়ং ধর্মীয় নেতাও। ইসলামে রাষ্ট্র থেকে পৃথক মোল্লা বা পুরোহিত আছে বটে। তবে সেটা ধর্ম চর্চার বিশেষ বা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য। এবং সেটা নীতিগতভাবে প্রধান ধর্মীয় নেতা রাষ্ট্র -শাসককে সহায়তা দেবার জন্যও। কোরআন -হাদীস ও ধর্মীয় বিধির ব্যাখ্যা করা ছাড়া মোল্লার হাতে বিশেষ কোন ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্র বা শাসকের সহযোগী হিসাবে ভূমিকা পালনের জন্যই তার উদ্ভব। এর ফলে রাষ্ট্র থেকে আলাদা কোন পুরোহিততন্ত্র বা চার্চ জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইসলামে মোল্লাতন্ত্র গড়ে ওঠে নি। সেটা সম্ভব নয় রাষ্ট্র নিজেই একই সঙ্গে ইহলৌকিক বা জাগতিক এবং পরলোকবাদী প্রতিষ্ঠান হওয়ায়। ইসলামী বিধানে রাষ্ট্র শুধু জনগণের ঐহিক বা জাগতিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে না সেগুলিকে কোর্‌আন ও হাদীস দ্বারা নির্ধারিত ধর্মীয় বিধান অনুযায়ীও পরিচালনা করে। বস্তুত ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ মদীনাকে কেন্দ্র করে যে ইসলামী আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রথাগতভাবে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্র ও সমাজ হ’ল তারই সম্প্রসারণ ও ধারাবাহিকতা। ইসলামে সমাজ ও রাষ্ট্র শাসকদের জন্য মুসলিম জনগণের আনুগত্য দাবী করা হয়েছে। কোর্‌আনে বলা হয়েছে,

 

 ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌র, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাহাদের, যাহারা তোমাদের মধ্যে* ক্ষমতার অধিকারী, কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটিলে উহা উপস্থাপিত কর আল্লাহ্‌ ও রাসূলের নিকট। ইহাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।’

(৪ সূরা নিসাঃ ৫৯ আয়াত)

 

 এমন অবস্থায় সকল মুসলমান রাষ্ট্র শাসকই ধর্মকে ব্যবহার ক’রে মুসলমান জনগণের কাছ থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য দাবী করতে পারে। এই আনুগত্যকে ব্যবহার ক’রে ইসলামী শাসক স্বৈরাচারী ও একনায়ক হয়ে উঠতে সুবিধা পায়। বিশেষত ইসলামের বিকাশ পদ্ধতি এবং চিন্তা পদ্ধতির কারণে সামরিক শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক ও একনায়কী শাসন ইসলামী সমাজের সঙ্গে চমৎকার খাপ খায়। ইসলাম প্রসার লাভ করে প্রধানত যুদ্ধ বা জেহাদ দ্বারা। এই যুদ্ধের গুরুত্ব যে শুধু বাস্তবে ছিল তা নয় নৈতিকভাবেও এর উপর দেওয়া হয়েছে অসাধারণ গুরুত্ব। এই গুরুত্বের প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় কোর্‌আন ও হাদীসে। ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য কোর্‌আনে বহুবার যুদ্ধ করার ও ভিন্নধর্মী শত্রুদের প্রতি কঠোর হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন, ‘তোমরা তাহাদিগের সহিত সংগ্রাম করিবে। তোমাদিগের হস্তে আল্লাহ্‌ উহাদিগকে শাস্তি দিবেন, উহাদিগকে লাঞ্ছিত করিবেন, উহাদিগের বিরুদ্ধে তোমাদিগকে বিজয়ী করিবেন ও মুমিনদিগের চিত্ত প্রশান্ত করিবেন।’

 

* তোমাদের মধ্যে বলতে মুসলমানদের মধ্যে বুঝতে হবে। এ আয়াতে মুমিনগণ বা

 

বিশ্বাসীগণকে সম্বোধন করা হয়েছে। -লেখক।

 


১৪


(৯ সূরা তাওবাঃ ১৪ আয়াত)

 

 ‘হে মুমিনগণ! কাফিরদিগের* মধ্যে যাহারা তোমাদিগের নিকটবর্তী তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ কর এবং উহারা তোমাদিগের মধ্যে কঠোরতা দেখুক। জানিয়া রাখ, আল্লাহ্‌ মুত্তাকীদিগের** সহিত আছেন।’

 

(৯ সুরা তাওবাঃ ১২৩ আয়াত)

 এ ছাড়া হাদীসে মোহাম্মদ বলছেন,

 ‘আমার প্রতি আদেশ হইয়াছে লড়াই করিবার জন্য লোকদের বিরুদ্ধে যতক্ষণ না তাহারা সাক্ষ্য দেয় যে, নাই কোন মাবুদ খোদা ভিন্ন এবং মোহাম্মদ তাঁর রসূল এবং কায়েম করে নামায এবং আদায় করে যাকাত। যখন তাহারা উহা করিবে, তাহারা নিজেদের রক্ত ও ধন বাঁচাইবে আমা হইতে ইসলামের প্রাপ্য*** বাদে এবং তাহাদের বিচার থাকিবে (আন্তরিকতা সম্বন্ধে) খোদার কাছে।’ (তজরীদুল বুখারী)

 

 মোহাম্মদ আরও বলছেন,

 

 ‘তোমরা শুনিয়া ও জানিয়া রাখিও, নিশ্চয় বেহেশ্‌ত তরবারীর ছায়াতলে।’ (বোখারী শরীফ)

 

 সুতরাং ইসলামী সমাজ-মানসে সমরতন্ত্র বা সেনাবাহিনীর গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী। বস্তুত যোদ্ধা ছাড়া কেউই ইসলামী সমাজের স্বাভাবিক নেতা নয়। অন্যদিকে ইসলামের বিশেষ চিন্তা পদ্ধতি ইসলামী সমাজকে প্রভাবিত করেছে প্রচণ্ড ও গভীরভাবে। ইসলামে আল্লাহ্‌র প্রশ্নাতীত ও নিঃশর্ত একত্ব ও সর্বশক্তিমানতা বা নিরংকুশতার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর একত্ব সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে বিস্তৃত ও প্রতিফলিত হলেও এবং এক আল্লাহ্‌ সমস্ত সৃষ্টির উৎস হলেও আল্লাহ্‌ ও সৃষ্টির সম্পর্ক সমতাভিত্তিক নয় বরং প্রভু ও দাসের। অর্থাৎ যুক্তি অনুযায়ী, আল্লাহ্‌ জগত সৃষ্টি করলেও, সৃষ্ট জগতের মধ্যে তার শক্তি দেওয়া হয় নি, এটা সম্পূর্ণরূপেই তার নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত রয়েছে এবং সৃষ্ট জগত তার আজ্ঞাবহ দাস মাত্র। খ্রীষ্ট ধর্মে আমরা ঈশ্বর ও যীশু তথা মানুষের মধ্যে যে ধরনের প্রেমময় বা এক ধরনের সমতামূলক সম্পর্ক এবং ক্ষমতার বিভাজন দেখি, ইসলামে তেমন কিছুর চিহ্ন মাত্র নেই। খ্রীষ্ট ধর্মে যীশু ঈশ্বরের পুত্র। এই কারণে শুধু যে ঈশ্বর আরাধ্য তা-ই নয় মানুষ যীশুখ্রীষ্টও ঈশ্বর-পুত্র হিসাবে আরাধ্য। শুধু ঈশ্বর যে মানুষের প্রভু তা-ই নয়, যীশুও মানুষের প্রভু। খ্রীষ্ট ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে, ‘করিন্থীয়দের প্রতি প্রেরিত পৌলের প্রথম পত্র’-এ বলা হচ্ছে, ‘আমাদের পিতা ঈশ্বর এবং প্রভু যীশুখ্রীষ্ট হইতে অনুগ্রহ ও শান্তি তোমাদের প্রতি বর্ষুক।’ অর্থাৎ খ্রীষ্ট ধর্ম মতে ঈশ্বর সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত ক’রে রেখে মানুষকে তার যথেচ্ছাচারের দাস বা ক্রীড়নক মাত্র করে নি। শুধু তাই নয় এই পৃথিবী এবং স্বর্গের আধিপত্যও ঈশ্বর নিজের একার হাতে রাখে নি, তা এটা অর্পণ করেছে তার পুত্র যীশুখ্রীষ্টের হাতে।


* কাফির অর্থ সত্য প্রত্যাখ্যানকারী অর্থাৎ ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারী।

** মুত্তাকী অর্থ ধর্মভীরু বা সাবধানী

*** ‘রক্ত সম্পর্কে ইসলামের প্রাপ্য এই যে, তিনটি কাজের কোন একটি কাজ করিলে ইসলাম প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়। (১) অন্যায়ভাবে কাহাকেও হত্যা করিলে, (২) বিবাহসূত্রে যৌন-মিলন হওয়ার পর যিনা করিলে, (৩) ইসলাম ত্যাগ করিলে। ধন সম্বন্ধে ইসলামের প্রাপ্য হইতেছে যাকাৎ।’

 

তজরীদুল বুখারী


 বাইবেলে বলা হচ্ছে, ‘তখন যীশু নিকটে আসিয়া তাঁহাদের সহিত কথা কহিলেন, বলিলেন স্বর্গে ও পৃথিবীতে সমস্ত কর্তৃত্ব আমাকে দত্ত হইয়াছে।’ (মথিলিখিত সুসমাচার ২৮ঃ ১৮)। অর্থাৎ খ্রীষ্ট ধর্ম একেশ্বরবাদী হলেও নিরংকুশ একত্ববাদী কিংবা একাধিপত্যবাদী নয়। এখানে ক্ষমতার একটা বিভাজন আছে। ইসলামে বহু দেবতার স্থান তো নেই-ই এমন কি এক ঈশ্বরের ক্ষমতার কোন প্রকার বিভক্তিকেও সামান্যতম প্রশ্রয় দেওয়া হয় নি। ইসলামে আল্লাহ্‌র ক্ষমতার অংশীদার বা শরীক আছে মনে করাকে সবচেয়ে বড় অপরাধ মনে করা হয়। এটা এমন অপরাধ যার কোন ক্ষমা নেই। এইজন্য কোর্‌আনে ঘোষণা করা হয়েছে,

 


১৫


 ‘আল্লাহ্‌ তাঁহার শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। ইহা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যে-কেহ আল্লাহ্‌র শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।’

 

(৪ সূরা নিসাঃ ৪৮ আয়াত)

 

 ‘আল্লাহ্‌ তাঁহার শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না, ইহা ব্যতীত সব কিছু যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং কেহ আল্লাহ্‌র শরীক করিলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়।’

 

(৪ সূরা নিসাঃ ১১৬ আয়াত)

 

 বস্তুত ঈশ্বরের একত্বের উপর এই নিরংকুশ ও অসহিষ্ণু গুরুত্ব আরোপের ফলে যেটা অস্বীকৃত হয়েছে সেটা হ’ল বস্তু ও প্রকৃতির ভিতরের দ্বৈততা বা বহুত্ব এবং দ্বান্দ্বিকতা। মানুষের সমাজও প্রকৃতির নিয়মের অধীন। কাজেই এই ধরনের ধারণার ফল হয়েছে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলির প্রতি অস্বীকৃতি এবং সেগুলিকে সম্পূর্ণ জোর-জবরদস্তি দ্বারা চাপা দেবার প্রবণতা। এর জন্য প্রয়োজন হয় সমাজে একজন মাত্র শাসকের ক্ষমতা ছাড়া আর সবার ক্ষমতার চূড়ান্ত রকম অস্বীকৃতি। এইভাবে একত্ব কিংবা একাধিপত্যের প্রতি ইসলামের এই নিরংকুশ ও অসহিষ্ণু গুরুত্ব আরোপের ফলে সমাজ চেতনায় গড়ে উঠেছে একজনের নিরংকুশ স্বেচ্ছাচারী ও অসহিষ্ণু শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদানের অভ্যাস ও নৈতিকতা। এর ফলে সমাজ হয়ে ওঠে সম্পূর্ণরূপে একনায়কী। কাজেই ইসলামী চেতনা গণতন্ত্রের সঙ্গে খাপ খায় না। গণতন্ত্র তো নিরঙ্কুশভাবে একজনের শাসন নয়। এক ব্যক্তি প্রধান শাসক হলেও সে হয় নিয়ন্ত্রিত এবং পাশেই থাকে বিকল্প শাসক বা একটা নিয়ন্ত্রক। এই অর্থে গণতন্ত্র দুই বা বহুর শাসন। ইসলাম দুই বা বহুর অধিকারে বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু দেখে না। তাই কোর্‌আনে এক ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে,

 

 ‘যদি আল্লাহ্‌ ব্যতীত ইলাহ্‌* থাকিত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে, তবে উভয়ই ধ্বংস হইয়া যাইত। অতএব উহারা যাহা বলে তাহা হইতে আর্‌শের**  অধিপতি আল্লাহ্‌ পবিত্র, মহান।’

 

(২১ সূরা আম্বিয়াঃ ২২ আয়াত)

 

 সুতরাং ইসলামী চিন্তাপদ্ধতিতে নারী-পুরুষ কিংবা শাসক-শাসিত অথবা কোন দুই সত্তার মধ্যে সমতামূলক সম্পর্কের কোন স্থানই নেই। সমতা একটা আছে বৈকি, তবে সেটা অধীনস্থ ও অধিকারহীন দাসদের নিজেদের মধ্যে, শাসকের পুতুল শাসিতদের নিজেদের মধ্যে। অবশ্য বাস্তবে এখানেও থাকে যথেচ্ছাচারী প্রভু ও অধিকারহীন দাসের সম্পর্কের প্রতিফলন। স্তরভিত্তিক অসাম্য হচ্ছে এই চিন্তাপদ্ধতির বাস্তব দাবী। কারণ একের ভিতর সবার বিলীনতার মাধ্যমেই কেবলমাত্র এই নিরংকুশ একত্ব বা ‘সাম্য’ অর্জন করা সম্ভব। সুতরাং প্রতিটি ব্যক্তি বা সত্তা নিজেকে বিলীন করবে তার ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি বা সত্তার মধ্যে।

 

 এই রকম পরিস্থিতিতে ইসলামী সমাজে জনগণের নিকট জবরদস্ত সামরিক একনায়কই পছন্দনীয় বা গ্রহণযোগ্য। এই মনোভাবের পরিবর্তন সম্ভব শুধুমাত্র ভিন্ন সমাজের প্রভাবে ও চাপে সমাজ অভ্যন্তরে সূচিত আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা, শিল্প, প্রযুক্তি এবং রাজনৈতিক আন্দোলন ইত্যাদির কারণে।

 

 ইসলামী দুনিয়ায় দেশে দেশে সামরিক একনায়ক বা স্বেচ্ছাচারী শাসকদের স্বৈরতন্ত্রের উৎস মূলত অর্থনীতির মধ্যে খঁুজে লাভ নেই। বরং এটা আছে মূলত তার ধর্ম ও মনস্তত্ত্বের মধ্যে। এই রকম ধর্ম ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বরং এইসব সমাজে অর্থনীতি গড়ে উঠেছে এবং এমনকি অর্থনীতি যখন পরিবর্তিত হয়েছে তখন তা পরিবর্তিতও হয়েছে এই ধর্ম ও মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই।

 

 এমন এক সমাজে স্বেচ্ছাচারী এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র এবং তার কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসাবে সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন জনগণের নিকট সর্বোচ্চ নৈতিক ও বাস্তব কর্তৃত্বের শক্তি হিসাবে দেখা দেয়। ফলে রাষ্ট্রের বাইরে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে রাজনীতির কোন নৈতিক ভিত্তি থাকে না। ইসলাম শাসিত জনমতকে প্রতিনিধিত্ব করে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ও সরকার তথা একনায়কী শাসক। এবং জনমতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য থাকে রাষ্ট্র ছাড়াও মসজিদ এবং মোল্লা শ্রেণী। কাজেই জনগণের ভিতর থেকে ভিন্নভাবে রাজনীতি বেড়ে ওঠার জন্য স্থান বা ঢ়হথধপ পায় না।

 

* ইলাহ্‌- উপাস্য

** আর্‌শ- আল্লাহর আসন।

 


১৬


 পশ্চিম ইউরোপে গণতন্ত্রের বিকাশে রাষ্ট্র এবং খ্রীষ্টীয় ধর্ম প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার বিভাগের বিরাট ভূমিকা ছিল। ইউরোপে মধ্যযুগে ব্যক্তি শুধু ব্যক্তিগত মালিকানার সাহায্য নিয়ে নয় উপরন্তু রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যকার পার্থক্য ও দ্বন্দ্বের সাহায্য নিয়েও নিজ অস্তিত্ব রক্ষা করতে পেরেছিল। চার্চ যে শুধু রাষ্ট্রের নিরংকুশ স্বৈরশক্তিকে প্রতিহত করেছিল তা-ই নয় উপরন্তু এক দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রকে নিজ অধিকারে রেখেছিল। এটা ঠিক যে, রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে এর ফলে এমন এক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা সেখানে দীর্ঘকাল মধ্যযুগীয় অন্ধকার বজায় রেখেছিল। কিন্তু এই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, রাষ্ট্র ও চার্চ কখনই এক ছিল না। অর্থাৎ রাষ্ট্র যেমন চার্চ হয় নি তেমন চার্চ নিজেও পরিণত হয় নি রাষ্ট্রে। আধুনিক যুগের শুরুতে ইউরোপে যখন খ্রীষ্ট ধর্মের প্রভাব ও প্রতিপত্তিতে ক্ষয় দেখা দেয়, ফলে লোকবাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে থেকে রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান উদ্ভূত হয় এবং ধর্ম ও চার্চের স্থান দখল করতে শুরু করে।

 

 ইসলামী সমাজে রাষ্ট্র ও তার একক শাসক যেমন সকল ধর্মীয় ও নৈতিক ক্ষমতার আধার অন্যান্য অনিসলামী সমাজে তেমনটা না হওয়ায় এইসব সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত রাজনৈতিক নেতৃত্বে যেভাবে সমাজ বিপ্লব ঘটতে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হ’তে পেরেছে এবং রাষ্ট্রের উপর বহুদলীয় হোক আর একদলীয় হোক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হ’তে পেরেছে ইসলামী সমাজে সাধারণভাবে তেমন কিছু হ’তে পারে নি। সুকঠোর ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ফলে ইসলামী সমাজে জনগণের মধ্য থেকে পাল্টা রাষ্ট্র চিন্তা কিংবা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র শাসকের উপর পাল্টা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চিন্তা বিকাশ লাভ করতে পারে না। ফলে ইসলামী সমাজে সাধারণভাবে লোকবাদ ও প্রগতির সপক্ষে রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত তথা বেসরকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বে কোন গণ-বিপ্লব সংগঠিত হয় না। ভাল অথবা মন্দ যে কোন সামাজিক পরিবর্তন সংগঠনের শক্তি হয় সাধারণত রাষ্ট্র নিজেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে আমরা এটাই সাধারণত দেখি। ইরানে শাহ্‌ শক্তিশালী ইসলামী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠা শিয়াবাদকে দমন করেছিলেন। শাহের বিতাড়নের মধ্য দিয়ে সেখানে রাষ্ট্র ও ধর্মের ঐক্য ফিরে এসেছে।

 

 যাইহোক, আমাদের এই বিষয় বোঝা দরকার যে, ইসলামী রাষ্ট্র একই সঙ্গে পরলোকবাদ ও ইহলোকবাদকে এক বিন্দুতে সমন্বিত করে। এবং এই রাষ্ট্র তার ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব, নৈতিকতা ও সংস্কৃতি এবং বিশেষ ঐতিহাসিক বিকাশ পদ্ধতির কারণে হয় মূলত একনায়কতান্ত্রিক সামরিক আমলাতান্ত্রিক।

 

 এই রকম সমাজে তাই রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্দোলন বাইরের প্রভাবজাত। এটা সমাজতল হ’তে কোন উল্লেখ্য সরবরাহ পায় না। ফলে ইসলামী সমাজে রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে উপরতলায় সীমাবদ্ধ এবং শিকড়হীন। সংস্কারবাদী কিংবা বিপ্লবী কোন রাজনীতিই জনগণের বাস্তব সমর্থন ও অংশগ্রহণ দ্বারা পুষ্ট হ’তে পারে না। রাষ্ট্র সমস্ত ক্রিয়ার একমাত্র কেন্দ্র হওয়ায় এবং সেনাবাহিনী সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় জনগণের রাজনীতি কিংবা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বদলে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও সামরিক নেতৃত্ব দখল এই রকম সমাজে রাজনৈতিক ক্রিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ হিসাবে দেখা দেয়।

 

 এই রকম অবস্থায় ইসলামী সমাজে জনগণ নির্ভর রাজনীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ সামরিক আমলাতন্ত্র কিংবা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমর্থন ও ভূমিকার উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কিংবা সামরিক শাসকের সমর্থন ও আশ্রয় পেলেই এই সমাজে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিকাশ লাভ করতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্র-শাসকের সমর্থনচুøত হলে সেই রাজনীতিরও পতন ঘটে।

 

 আধুনিক যুগের প্রভাবে এবং শিক্ষা, শিল্প ও প্রযুক্তির বিস্তারের ফলে জনগণের উপর, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত ছাত্র-তরুণ সম্প্রদায়ের উপর লোকবাদের যে প্রভাব পড়ে তার ফলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্ভব কিংবা কিছু বিকাশ অপরিহার্য কিংবা অনিবার্য হলে রাষ্ট্র তাকে মেনে নেয় কিংবা ব্যবহার করে ঠিক, কিন্তু ইসলামী শাসকের সবচেয়ে বড় দুই হাতিয়ারের একটি হ’ল আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং অপরটি ইসলাম ধর্ম। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় যে, ধর্ম ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে সেনাবাহিনী এবং ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসাবে মোল্লা ও মসজিদ হচ্ছে ইসলামী সমাজে জনগণ ও সমাজ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ দুই শক্তি। একদিকে ইসলামী সেনাবাহিনী ও অপরদিকে মোল্লা ও মসজিদের চাপে ইসলামী সমাজে গণতন্ত্র অথবা রাজনৈতিক চেতনা ও প্রতিষ্ঠান বিকাশ লাভ করার সুযোগ পায় না। এই দুইটি সমন্বিতভাবে সমগ্র সমাজকে বস্তুগত ও ভাবগত উভয়ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে।

 

 

১৭


 এ দেশের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সামরিক আমলাতন্ত্র এটা বোঝে যে, এ দেশে জনগণের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য রক্ষার জন্য ইসলাম চর্চা তাদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। সুতরাং তারা ইসলামকে ক্রমবর্ধমানভাবে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে প্রকট করেছে। অপর দিকে, এ দেশে ইসলামকে কেন্দ্র করে যে বিশেষ সম্প্রদায়, সমাজ এবং রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে তার প্রয়োজনেও তারা ইসলামকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে লালন করে। ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে এ দেশে বহিরাগত মুসলিম হানাদার সমরনায়ক বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে যে প্রথম বহিরাগত মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তার মধ্যে ছিল এ দেশের বাঙ্গালী জনগণের সুদীর্ঘ পরাধীনতার ইতিহাসে এক নূতন পর্যায়ের সূচনা। কিন্তু ধর্মান্তরিত বাঙ্গালী জনগণের জন্য এটা বিশেষ কোন সমস্যা হয়ে দেখা দেয় নি। কারণ ধর্মীয় আনুগত্য তাদের স্বাজাত্যবোধের জাগরণে বাধা হয়ে ছিল। দেশাত্মবোধ ও জাতি চেতনা যদি না জাগে তবে জনগণের কাছে কোন বিদেশী শাসন ও নিয়ন্ত্রণই বিদেশী, বিজাতীয় নয় যদি তা হয় মুসলমান দ্বারা পরিচালিত।

 

 ব্রিটিশ এটা বুঝত বলে সে এ দেশে তার বৈদেশিক শাসনকে অব্যাহত রাখায় সাহায্য নিয়েছিল মূলত বৈদেশিক মুসলমান অভিজাত শ্রেণী দ্বারা সংগঠিত এ দেশের মুসলমান সামাজিক কর্তৃত্বের। অবশ্য তারা একই ভাবে উচ্চবর্ণের হিন্দু সামাজিক কর্তৃত্বের সহযোগিতাকেও ব্যবহার করেছিল এই শাসন রক্ষার জন্য। যাইহোক, মুসলমান জনগোষ্ঠীর উপর শাসন রক্ষায় মুসলিম সামাজিক কর্তৃত্বের সহযোগিতা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রচলিত সামাজিক-ধর্মীয় কর্তৃত্বের প্রতি সামাজিক আনুগত্যকে নানাভাবে ব্যবহার করলেও ব্রিটিশ শাসকরা নিজেরা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় তাদের অনেক অসুবিধাও ছিল যেটা এখনকার শাসকদের নেই। তবে ধর্ম দিয়েও আর আজকের দিনে পূর্বের মত জনগণকে নিরংকুশভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং আজকের রাষ্ট্রের শাসকরাও এ দেশে নানাবিধ সমস্যারই সম্মুখীন। এতদসত্ত্বেও প্রচলিত ব্যবস্থায় ধর্ম বর্তমান শাসকদের জন্য জনগণকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

 

 এই বিষয়টি আমাদের ভোলা উচিত হবে না যে, এ দেশে ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠিত হয়েছে। বিশেষত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পিছনে ছিল এ দেশের মুসলমান জনগণের মনে হিন্দুদের ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের বিপরীতে ইসলাম ধর্মের চেতনা ও অনুভূতি। ১৯৭১-এ বাঙ্গালী জনগণ দ্বারা সূচিত স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে যতই লোকবাদী ও বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা থাকুক বিভিন্ন কারণে এটা প্রাধান্য অর্জন করতে কিংবা প্রতিষ্ঠিত হ’তে পারে নি। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে মৌখিক স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তার ভিত্তিতেই ছিল মুসলমান বাঙ্গালীর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা। ফলে বাংলাদেশ দেখা দেয় বাঙ্গালীর জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে নয় বরং মুসলিম বাঙ্গালীর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ হয়েছে এক অর্থে খণ্ডিত পাকিস্তান যদিও এতে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ফলে ঘটেছে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিজড়ন। এই অবস্থায় এ দেশে ধর্ম এখনও জনগণের আনুগত্য জাগ্রত করার ক্ষেত্রে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে রয়েছে যাকে এ দেশের আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসকরা ব্যবহার করছে। জেনারেল এরশাদের সামরিক সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা দ্বারা এই সত্যের স্পষ্টতর প্রকাশ ঘটিয়েছে মাত্র।

 


১৮
 

 আমাদের সমগ্র আলোচনা হ’তে এ দেশে সমাজ ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে আমরা প্রধান বৈষয়িক শক্তি হিসাবে দেখতে পাচ্ছি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে। এই রাষ্ট্রের সহযোগী হিসাবে দেখতে পাচ্ছি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি ও নির্বাচন, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পঁুজি এবং ইসলাম ধর্মকে। অর্থাৎ এগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত শ্রেণী ও ব্যক্তিবর্গকে। আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল অধিকারী সামরিক ও বেসামরিক আমলা, নির্বাচিত জন-প্রতিনিধি ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিক, সম্পত্তিবান ও পঁুুজির মালিক ধনিক এবং ধর্মীয় শক্তি ইত্যাদি সবাই মিলে এ দেশে উৎপাদক, শ্রমজীবী ও গরীব জনগণের উপর শাসন, শোষণ, লুণ্ঠন, দমন ও নিয়ন্ত্রণের যে বর্বর, একনায়কী ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা চালু রেখেছে সেই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হলে এই শক্তিগুলির নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি এবং তাদের স্বরূপ উদঘাটন করা অত্যাবশ্যক। এর জন্য এ দেশে এতকাল যেভাবে অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা মালিকানা রূপের মধ্যে সমস্ত সমস্যার মূল হাতড়ে বেড়ানো হয়েছে সেটার অবসান ঘটানো দরকার। অবশ্যই অর্থনীতি ও উৎপাদনের স্তর ও বৈশিষ্ট্যসমূহও সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু এই অর্থনীতি ও উৎপাদনের স্তর ও বৈশিষ্ট্য সংগঠনে যে কখন রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র বা সেনাবাহিনী, কখন ধর্ম কিংবা রাজনীতি বা মতবাদ যে কেন্দ্রীয় বা প্রধান ভূমিকা নিতে পারে সেই বিষয়টিও আমাদের বোঝা দরকার।

 

 এ দেশে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংগঠন বা সংরক্ষণে আমরা যেমন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় ভূমিকা দেখতে পেয়েছি তেমন দেখতে পেয়েছি ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা। ইসলাম ধর্মের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এই আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এত শক্তিশালী হয়ে দেখা দেয়। অবশ্য এটা ঠিক যে, ইসলামী দুনিয়ার বাইরেও তৃতীয় বিশ্বে বহু রাষ্ট্রই সামরিক প্রাধান্য বিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক। কিন্তু সেইসব সমাজে সাধারণভাবে রাষ্ট্র এবং ধর্ম একীভূত নয়। বিশেষত খ্রীষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্মসংঘ বা প্রতিষ্ঠানগুলি রাষ্ট্রসত্তার বাইরে জনগণের বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে একটা ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রের বাইরে শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের ফলে এবং এইসব ধর্ম এবং সংস্কৃতির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ফলে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ একাধিপত্য নৈতিক ভিত্তি পায় না। রাষ্ট্র যা-ই করুক স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা সংঘগুলির সমর্থন কিংবা অনুমোদন নিতে বাধ্য হয়। অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বাধাকে যতোদূর সম্ভব এড়িয়ে চলতে হয়। যখন রাষ্ট্র নিরঙ্কুশ হ’তে চায় তখন রাষ্ট্র নিজের জন্য সৃষ্টি করে নৈতিক ফাঁক বা শূন্যতা ও সঙ্কট। এটা ঘটনা যে, আধুনিক শিল্প সভ্যতার প্রভাবে লোকবাদের বিস্তার অপ্রতিরোধ্য হওয়ায় এইসব দেশে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষয় ঘটছে। এই শূন্যতা পূরণ করার ক্ষমতা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সীমিত; বরং জনগণের বিপ্লবী রাজনৈতিক দল এই শূন্যতা পূরণ করছে।

 

 অবশ্য এটা ঠিক যে, এই শূন্যতা পূরণ করতে এবং জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে এইসব দেশে অধিকতর গণবিচ্ছিন্ন ও স্বৈরাচারী হ’তে হয়। ফলে রাষ্ট্রের জন্য বৃদ্ধি পায় নৈতিক শূন্যতা। বৌদ্ধ কিংবা খ্রীষ্ট ধর্ম তলোয়ারের শক্তি তথা বলপ্রয়োগের শক্তিকে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করে নি। কারণ বুদ্ধ বা যীশু কেউই মোহাম্মদের মত তলোয়ারধারী যোদ্ধা ছিলেন না। বরং ধর্ম প্রচারে তাঁরা ছিলেন যুদ্ধ ও শক্তিপ্রয়োগ বিরোধী। ফলে এইসব ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত কিংবা নিয়ন্ত্রিত সমাজে যার হাতে তলোয়ার বা অস্ত্রশক্তি থাকে জনগণের নৈতিক আনুগত্য ও সমর্থন লাভের জন্য তার পক্ষে ভাবাদর্শ তথা ধর্মের নিরস্ত্র শক্তির দ্বারস্থ না হয়ে উপায় থাকে না। অস্ত্রশক্তি বা সামরিক শক্তির হাতে ধর্ম রক্ষা ও প্রসারের সার্বিক ও চূড়ান্ত দায়িত্ব না থেকে সেই দায়িত্ব স্বতন্ত্র ও নিরস্ত্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকায় এবং এর ফলে রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি ও ধর্মের নৈতিক শক্তি এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত না হওয়ায় এবং সর্বোপরি ঈশ্বরের নিরংকুশ ও অবিভাজ্য ক্ষমতা এবং স্বেচ্ছাচারিতার উপর ইসলাম ধর্মের মত অসহিষ্ণু গুরুত্ব আরোপ না করায় ইসলামী সমাজের তুলনায় এইসব সমাজে সাধারণত অনেক বেশী সহিষ্ণুতা ও চিন্তাশীলতা থাকে যার ফলে নূতন ও ভিন্ন চিন্তা ও শক্তিগুলি সমাজ অভ্যন্তরে সরবরাহ ও পুষ্টি পেতে পারে। এমন অবস্থায় শিল্প বিপ্লব ও সামাজিক উন্নয়নের প্রয়োজনে এইসব সমাজে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের ভিতর থেকে বিপ্লবী রাজনৈতিক মতাদর্শ ও সংগঠনের বিকাশ ও বিজয় ঘটে চলেছে।

 

 এটা ঠিক যে, এই প্রক্রিয়ায় এইসব দেশে বিপ্লবী সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তিকে শুধু যে, আমলাতান্ত্রিক-স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হয় তা-ই নয় সেই সঙ্গে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ভাবাদর্শিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়। তবে সাধারণভাবে এইসব সমাজে ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করা সহজ হয়, কারণ ধর্ম সাধারণত প্রত্যক্ষ কোন রাজনৈতিক শক্তি নয়। যেহেতু ধর্ম সাংস্কৃতিক ও নৈতিক শক্তি হিসাবে অবস্থান করে সেহেতু ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চরিত্র হয় মূলত সাংস্কৃতিক ও নৈতিক।

 

 বস্তুত এইসব সমাজে প্রচলিত পরলোকবাদী ধর্ম সর্বদা সামাজিক প্রগতি ও পরিবর্তনে দুর্লংঘ্য বাধা হয়ে থাকে না যেমন থাকে প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও তার সেনাবাহিনী। তাই এইসব সমাজে রাষ্ট্রের উপর থেকে ধর্মের নিয়ন্ত্রণ ভাঙ্গা কিংবা রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের ঐক্য ভাঙ্গা এবং বৈষয়িক বা রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হস্তক্ষেপ বন্ধ করা সহজতর হয়। এই জন্য রাষ্ট্রীয়-সামাজিক অনেক পরিবর্তনের পরও পশ্চিম ইউরোপ বা পূর্ব ইউরোপের বহু দেশে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষা পেয়েছে। ধর্ম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সংরক্ষণ করেও এইসব সমাজে লোকবাদ বা বিজ্ঞান এবং গণতন্ত্রের ক্রমিক বিকাশ সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত ধর্ম স্বাভাবিক নিয়মে ধীর গতিতে শুকিয়ে মরছে কিংবা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ছে। আমরা শুধু পশ্চিম ইউরোপ কিংবা উত্তর আমেরিকাতেই এই বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছি না এমন কি পূর্ব ইউরোপ কিংবা অন্যত্র কমিউনিস্ট দেশগুলির জন্যও এই কথা অনেকাংশে প্রযোজ্য। কমিউনিস্ট দেশগুলিতে শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মকে কোথায়ও কম এবং কোথায়ও বেশী অনুমোদন দেওয়া সম্ভব হয়েছে এই কারণে যে, এখানে এগুলি নূতন রাষ্ট্র ব্যবস্থা কিংবা জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে কমিউনিস্ট দলের কর্তৃত্বের প্রতি তেমন কোন চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয় নি।

 


১৯


 বস্তুত আজকে কমিউনিস্ট পৃথিবীতে কমিউনিজমের প্রতি যে চ্যালেঞ্জ এসেছে তা ধর্ম কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আসে নি, বরং এটা এসেছে কমিউনিজম দ্বারা সৃষ্ট ও সংগঠিত নূতন বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ও জনগণ থেকে যাদের অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টিরই কর্মী ও সদস্য কিন্তু যারা এখন মার্কসবাদের প্রতি আস্থা হারিয়েছে ধর্মের প্রভাবে নয় বরং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আধুনিক শিক্ষা, চিন্তা এবং উন্নততর জীবনাকাঙ্ক্ষার প্রভাবে।

 

 এই ক্ষেত্রে ইসলামী সমাজের অবস্থা অবিশ্বাস্য রকম জটিল ও কঠিন। এখানে সুসংগঠিত কোন চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দেখা যায় না যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সহজতর। মসজিদ উপাসনা করার সাধারণ স্থান মাত্র। এটা সেই অর্থে কোন স্বতন্ত্র বা স্বাধীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়। কাজেই এখানে ধর্মের কেন্দ্রীয় শক্তি বা সংগঠন এমন এক স্থানে অবস্থান করে যে স্থানটিকে চিহ্নিত করতে না পারলে ইসলামী সমাজে প্রকৃত সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব করা অসম্ভব। সেই স্থান হ’ল নিরঙ্কুশভাবে একাধিপত্যবাদী ধর্ম ও সমাজের সামরিক প্রবণতার বা যুদ্ধশক্তির মূর্ত রূপ হিসাবে নিরংকুশভাবে একনায়কী আমলাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী এবং এই সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কাজেই ইসলামী সমাজে রাষ্ট্র কিংবা সেনাবাহিনীর উপর আঘাত গিয়ে পড়ে খোদ ইসলাম ধর্মের উপর এবং ইসলাম ধর্মের উপর আঘাত গিয়ে পড়ে আমলাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের উপর। ইসলাম ধর্ম মর্মগতভাবে এককেন্দ্রিক সামরিক-রাজনৈতিক ধর্ম হওয়ায় এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ইসলামী সমাজ মূলত একনায়কী সামরিক-রাজনৈতিক সমাজ।

 

 প্রথাগতভাবে ইসলামী সমাজে ধর্ম, যুদ্ধ ও রাজনীতি স্বতন্ত্র বা ভিন্ন সত্তা নয়। এখানে ধর্ম, রাজনীতি, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, রাষ্ট্র ও সমাজ সব মূলত একাকার। যেহেতু ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ মূলত একীভূত, এক ব্যক্তিরই হাতে কেন্দ্রীভূত সেহেতু ইসলামী সমাজে বিচ্ছিন্নভাবে কোন একটির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাফল্যের কোন আশাই নেই। বিশেষত ইসলাম ধর্মের একাধিপত্যবাদী ও আক্রমণাত্মক বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা সমাজে অব্যাহতভাবে যে উগ্র সমরবাদ এবং অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক স্বৈরতন্ত্র জন্ম দেয় তার ফলে ইসলামী সমাজে আধিপত্যবাদী সামরিক আমলাতন্ত্র ও একনায়কী স্বৈরতন্ত্রের অস্তিত্ব অনিবার্য ঘটনা। এই রকম সমাজে একটি বিশেষ সেনাবাহিনীর ধ্বংস ও বিলুপ্তিও তাই শেষ পর্যন্ত আর একটি নূতন আমলাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক সমরশক্তির উদ্ভব ও বিকাশের পথ করে দেয় মাত্র। বাস্তবে এই সমাজে স্বেচ্ছাতন্ত্র ও সমরবাদ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ধর্মের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও যুদ্ধবাদ গোটা সমাজ ও প্রতিটি ব্যক্তির সমগ্র চিন্তা পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্মচর্চা দ্বারা সমাজ মানস থেকে একনায়কতন্ত্র, সমরবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের যে অবিরাম উদ্ভব ঘটে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে অধিকার করে রাখে রাষ্ট্র ও সমাজকে। একনায়কী ধর্মের প্রভাবে সমাজ মানসে নারীর স্বাধীনতা, ব্যক্তিসত্তার স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র দাঁড়াবার মত কোন দৃঢ় ভিত্তি পায় না বলে সামরিক আমলাতন্ত্রের একনায়কতন্ত্র এবং বর্বর স্বৈরতন্ত্র এই সমাজের নিয়তি।

 

 সুতরাং ইসলাম ধর্মের নিরংকুশ একনায়কতান্ত্রিক, আমলাতান্ত্রিক এবং স্বৈরতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য যেখানে সবচেয়ে বেশী মূর্ত হয় সেই ইসলামী সেনাবাহিনী তার নিজ অস্তিত্ব রক্ষা কিংবা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে সমাজে ইসলাম চর্চা এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতির ইসলামীকরণের উপর জোর দিতে বাধ্য হয়। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশে বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের লোকবাদী, জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক প্রভাবকে নস্যাৎ করার কাজের নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত ইসলামী সেনাবাহিনীকেই নিতে হয়েছে। ইসলামী সমাজে স্বৈরতন্ত্র, সমরবাদ ও একনায়কতন্ত্রের মূল ভাবাদর্শ যেমন ইসলাম ধর্ম তেমন এই ইসলাম ধর্মের স্বৈরতন্ত্র, সমরবাদ ও একনায়কতন্ত্রের মূল বাস্তব রূপ হচ্ছে ইসলামী সেনাবাহিনী।

 

 সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ দীর্ঘকাল ধরে ইসলামী দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামী ব্যবস্থার এই দুর্বলতা বা বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করছে। হিংস্রভাবে একনায়কী ধর্ম এবং সেনাবাহিনীর চাপের কারণে লোকবাদ, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নারী অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিকাশ ও বিস্তার যেমন অসম্ভব হয়ে থাকছে তেমন ইসলামী দেশগুলোর প্রায় সবই কোন না কোনভাবে বিভিন্ন উন্নত অন-ইসলামী রাষ্ট্র বা সমাজের বাজার কিংবা ক্রীড়নক হিসাবে ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি এই বাস্তবতাকেই স্থূলরূপে প্রকাশ করছে মাত্র।

 


২০


 আমাদের সমগ্র আলোচনা থেকে এই বিষয় স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছে যে, এ দেশে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে এ দেশের সামরিক প্রাধান্য বিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় না নিয়ে উপায় নেই। সেই সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে একনায়কী ইসলাম ধর্মের প্রশ্নকে। কারণ সামরিক প্রাধান্য বিশিষ্ট বর্তমান একনায়কী আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র মূলত একনায়কী বা এককেন্দ্রিক ইসলাম ধর্মেরই রাজনৈতিক প্রকাশ মাত্র। এ ছাড়া আসে প্রচলিত আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধীনে নির্বাচন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রশ্ন। একইভাবে বিবেচনায় নিতে হবে পরশ্রমজীবী ধনিক তথা আমাদের দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে গড়ে ওঠা পঁুজি ও সম্পত্তির অধিকারী অনুৎপাদক ধনিক শ্রেণীর মালিকানা ব্যবস্থাকে। এ দেশে যাঁরা জনগণ ও দেশের মুক্তি ও উন্নয়নের স্বার্থে সমাজে পরিবর্তন কামনা করেন এবং যাঁরা এই সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের সৈনিক তাঁদের এই সমগ্র বিষয়ে আজ নূতনভাবে চিন্তা করা খুবই প্রয়োজন। বিশেষত যে সামাজিক বিপ্লব ও পরিবর্তনের পূর্ব-লক্ষণগুলি এখন দেখা যাচ্ছে সেই আসন্ন বিপ্লব ও পরিবর্তনকে সুসম্পন্ন ও সফল করার জন্য আজ এই মুহূর্তেই আমাদের রাষ্ট্র, ধর্ম ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলিকে নূতন ও সঠিক দৃষ্টিতে বিচার করা খুবই জরুরী।

 

রচনাঃ ১৫-১৭ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯০

ঈষৎ সংযোজিত ও পরিবর্ধিতঃ ১৯-২২ মার্চ, ১৯৯০

 

উদ্ধৃতিসমূহের উৎসঃ


১। মার্কস-এঙ্গেলস, নির্বাচিত রচনাবলি, খণ্ড ৪, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।

কার্ল মার্কস, ‘অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থের ভূমিকা। পৃষ্ঠাঃ ১৩৯

২। ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, কল্পস্বর্গ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, মস্কো। পৃষ্ঠাঃ ৫৭

৩। বিনয় ঘোষ, বাদশাহী আমল, ইন্ডিয়ান এসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ। প্রথম সংস্করণঃ ৭ই চৈত্র, ১৮৭৯ শকাব্দ। পৃষ্ঠাঃ ৮৩

৪। ঐ, পৃষ্ঠাঃ ৭১-৭৩

৫। ঐ, পৃষ্ঠাঃ ৯০-৯১

৬।ঐ, পৃষ্ঠাঃ ১২৪

৭। এই গ্রন্থে কোর্‌আনের সকল আয়াতের বঙ্গানুবাদ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কৃত কোর্‌আনের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ ‘আল-কুরআনুল করীম’ থেকে গৃহীত।

আল-কুরআনুল করীম, একাদশ মুদ্রণঃ ডিসেম্বর, ১৯৮৭।

৮। তজরীদুল বুখারী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, প্রথম সংস্করণ, নভেম্বর, ১৯৫৮। পৃষ্ঠাঃ ১৮-১৯

৯। বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, মাওলানা শামসুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক কর্তৃক অনূদিত; হামিদিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা, ১৯৬৭। পৃষ্ঠাঃ ৩০

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ