Banner
ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা ─ শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 25, 2009, 6:00 PM, Hits: 7580

 

প্রস্তাবনা

 

আমাদের সমাজে ধর্ম বিশেষত ইসলামের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে আমি বহুকাল ধরে মৌখিক ও লিখিত ভাবে আলোচনা করে আসছি। তবে ইসলামী সমাজে ধর্মের সমালোচনা খুব কঠিন এবং এমনকি বিপজ্জনক হওয়ায় আমার লিখিত আলোচনাকে অনেক ক্ষেত্রে সংযত রাখতে হয়েছে। অবশ্য ঝুঁকি যে তাতে সর্বদা কম ছিল তা নয়। তবু সমাজ চেতনাকে ধর্মের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়ে অনেক কথা বলেছি যার কিছু বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু “ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা” এমন একটি মৌল গ্রন্থ যার প্রকাশ সম্ভব ছিল না।

 

গ্রন্থটি লিখিত হয় ১৯৯০ সালের ১৮ মে থেকে ১৩ জুন সময়ে। এই দীর্ঘ সময়ে পাণ্ডুলিপির ফটোকপি বিভিন্ন জনকে পড়তে দিয়েছি। বাংলাদেশে এ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ করা এখন পর্যন্ত দুঃসাধ্য কিংবা প্রায় অসম্ভব হলেও বিশ্ব পরিসরে নূতন প্রচার মাধ্যম হিসাবে ইন্টারনেট প্রযুক্তির উদ্ভাবন এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং এটিকে ওয়েব সাইট বঙ্গরাষ্ট্রে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

 

বিভিন্ন ওয়েব সাইটে এখন ইসলামের বহুমুখী ও ব্যাপক বিস্তৃত সমালোচনা চলছে, যেগুলিকে বাধা দিবার উপায় কারোরই নাই। সুতরাং ইসলামের উপর সমালোচনামূলক এই গ্রন্থের এখন হয়ত আর তেমন কোন চমক নাই। তবে আশা করি ইসলাম সংক্রান্ত বিশ্লেষণ ও সমালোচনা মূলক এই গ্রন্থ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হবে।

 

উনিশ বৎসর পূর্বে লিখিত গ্রন্থটির শেষ তিনটি অধ্যায়কে বর্তমানে অপ্রয়োজনীয় মনে করে বাদ দিয়েছি। এ ছাড়া এখানে যে গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে তাতে সামান্য কিছু সংখ্যক শব্দ ও বাক্যের সংযোজন ও বিয়োজন বা সংশোধনের বাইরে আর কোনও প্রকার পরিবর্তন হবে না। তবে উচ্চারণ ও বানানের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছি। যেমন নেই-এর জায়গায় নাই অথবা মোহাম্মদ-এর জায়গায় মুহাম্মদ কিংবা কি-এর স্থানে সাধারণভাবে কী ব্যবহার করেছি। সুতরাং কিছু বানান ও উচ্চারণ রীতির পরিবর্তন এবং শেষ তিনটি অধ্যায় বাদে এটি ১৯৯০ সালে লিখিত গ্রন্থের প্রায় সম্পূর্ণরূপে অপরিবর্তিত প্রকাশ।

লেখক, ১৯ এপ্রিল, ২০০৯

 

 

 

 

বিষয়সূচী

প্রথম পরিচ্ছেদঃ ইসলাম ধর্মের ভূমিকা বিচারের গুরুত্ব

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ ইসলাম ও নিরংকুশ একত্ববাদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ স্বৈরতন্ত্র ইসলামের এক অনিবার্যতা

চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ইসলামে সাম্য এক অতিকথা

পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ ইসলামের বিজয়ে নারীর পরাজয়

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের ধর্ম

সপ্তম পরিচ্ছেদ : সভ্যতার অবক্ষয়ের ধর্ম

অষ্টম পরিচ্ছেদ: ইসলামের অশুভ ভূমিকা

 

 

 


প্রথম পরিচ্ছেদঃ ইসলাম ধর্মের ভূমিকা বিচারের গুরুত্ব

 

এ দেশে সমাজ উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা কোনটি? যে শক্তি সমাজ ও জনগণকে সবচেয়ে বেশী নিয়ন্ত্রণ করছে সেটিই যে, এ দেশে সমাজ ও জনগণের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। কারণ এই শক্তির নিয়ন্ত্রণের কারণেই এ দেশের সমাজ ও জনগণ দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা ও পঙ্গুতা দূর ক’রে শক্ত পায়ে উঠে দাঁড়াতে পারছে না।

 

এটা ঠিক যে, যে বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এ দেশে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে সেটা যেমন এ দেশের সমাজ উন্নয়নের বাধা তেমন এই ব্যবস্থার ফলভোগী শ্রেণী ও ব্যক্তিসমূহও সমাজ উন্নয়নের পথে বাধাদানকারী শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই ব্যবস্থা বা শ্রেণী ও ব্যক্তিসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য শুধু যে বাধ্য হয়ে মেনে নেয় তা নয় বরং এই ব্যবস্থা কিংবা শ্রেণী ও ব্যক্তিসমূহের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের মধ্যে সামগ্রিকভাবে কোনও অন্যায় দেখতে পায় না বলেও তাকে মেনে নেয়। অর্থাৎ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার সবচেয়ে বড় শক্তি নিহিত রয়েছে সাধারণ মানুষের চেতনার মধ্যেই, তাদের নৈতিক বোধের মধ্যেই। এ দেশে এই নৈতিক বোধের সবচেয়ে সংগঠিত ও কেন্দ্রীভূত প্রকাশ হ’ল অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস ভিত্তিক, পরলোকবাদী কিংবা পরজন্মবাদী ধর্ম। সুতরাং এ দেশে প্রচলিত ব্যবস্থা সংরক্ষণের সবচেয়ে বড় শক্তি হ’ল প্রচলিত অলোকবাদী-পরলোকবাদী ধর্ম।

 

এ দেশে সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠন ও সংরক্ষণে এই ধর্মের ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি এ দেশের ইতিহাসের বিকাশ ধারার দিকে একটু নজর দিলে। ১৯৪৭-এ এ দেশের বিপুলভাবে গরিষ্ঠ মানুষ বাঙ্গালী হওয়া সত্ত্বেও একটি অখণ্ড জাতীয় রাষ্ট্র গঠন করতে পারে নাই। পাকিস্তান ছিল মুসলমান ভারতীয়দের একটি রাষ্ট্র, যেমন ভারত ছিল প্রধানত হিন্দু ভারতীয়দের একটি রাষ্ট্র।

 

মুসলমান বাঙ্গালী এই জন্য অখণ্ড ভারত চায় নাই যে, সে সেখানে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ায় নিজের ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রাধান্য রক্ষা করতে পারবে না। অন্যদিকে সে নিজেকে বাঙ্গালী জাতি মনে করে নাই, তাই বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র সে কল্পনা করে নাই। সুতরাং সে মুসলমান ভারতীয়ের জন্য পৃথক রাষ্ট্র চেয়েছিল। একইভাবে হিন্দু বাঙ্গালী এই কারণে স্বাধীন অখণ্ড বঙ্গ চায় নাই যে, ভারত রাষ্ট্রে হিন্দু হিসাবে তার যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রাধান্য থাকবে বঙ্গে মুসলমান সংখ্যাগুরু হওয়ায় সেটা হবে না। উপরন্তু হিন্দু বাঙ্গালীর মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায় হিসাবে যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক আবেগ কাজ করেছিল তাও তাকে বাঙ্গালীর স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের বদলে ভারত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

 

অবশ্য পূর্ব বঙ্গে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান দ্রুত সঙ্কটের সম্মুখীন হয়। ১৯৭১-এ পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি হয় পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় পরই। ১৯৪৮-’৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল পূর্ব বঙ্গে বাঙ্গালী জনগণের মধ্যে যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্ভব হয় তার ফলে এখানকার মুসলমান বাঙ্গালী জনগণ ক্রমেই পাকিস্তানের পশ্চিমা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী ক্রমেই দেখতে পেল যে, ইসলামকে অবলম্বন করলে পশ্চিমা স্বার্থের আধিপত্য ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে তার দাঁড়াবার উপায় থাকে না। সুতরাং মুসলমান বাঙ্গালী ক্রমবর্ধমানভাবে ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে তার আত্মরক্ষা ও আত্মবিকাশের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করতে থাকে।

 

কিন্তু এটা ঠিক যে, সাধারণ মুসলমান বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে গ্রহণ করলেও সে সাধারণভাবে তার ইসলাম ধর্মকে পরিত্যাগ করে নাই। সুতরাং তার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিতর লুকিয়ে থাকল ইসলামী চেতনা ও সম্প্রদায় বোধ। এবং এটাও ঠিক যে, পূর্ব বঙ্গের ব্যাপক জনগণ স্বায়ত্তশাসন চাইলেও ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে বের হ’তে চায় নাই। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাকিস্তানের পশ্চিমা সেনাবাহিনী যখন পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী জনগণের উপর জাতিগতভাবে আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করে তখন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। এর আগে প্রকৃত এবং ধর্মমুক্ত লোকবাদী জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রধানত সীমিত ছিল মুষ্টিমেয় কমিউনিস্ট কর্মী এবং বিশেষত মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রী ছাত্র-তরুণদের মধ্যে। তারাই প্রধানত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং বাঙ্গালীর লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনাকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল সারা দেশব্যাপী।

 

কিন্তু বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ভারতের হাতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পরাজয়ের মাধ্যমে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর যখন পূর্ব বঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হ’ল তখন ঘটল ভিন্ন ঘটনা। যে আওয়ামী লীগের হাতে ছিল নয় মাস ব্যাপী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব এবং যে দল এ দেশে ভারত রাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হ’ল তার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে লোকবাদী চেতনা ছিল না। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হাতে পেয়ে প্রমাণ করল যে, তা ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী বাঙ্গালী জাতির রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয় বরং মুসলমান বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এটা ঠিক যে, পাকিস্তান আমল থেকে তা যেভাবে গড়ে উঠছিল এবং ছয় দফা আন্দোলন এবং বিশেষত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তার যেভাবে রূপান্তর হয় তাতে তার পক্ষে মুসলিম লীগ বা জামাতে ইসলামীর মত উগ্র ইসলামপন্থী হওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ইসলাম ধর্মের ভিত্তিকে ধ্বংস না ক’রে রাজনীতি করতে চেয়েছিল। তাই আওয়ামী লীগের ধর্ম নিরপেক্ষতা ঘোষণার অর্থ ছিল ইসলাম ধর্ম ও সম্প্রদায় চেতনা রক্ষা করেই রাজনীতি করা।

 

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই ইসলাম ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ সরকার স্ববিরোধ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। সমাজে ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক ভিত্তিকে রক্ষা করার জন্য শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার না করে কাল ক্ষেপণ করে এবং পাকিস্তানের দালালদের প্রতি ১৯৭৩-এ সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। এভাবে তারা ইসলামী রাজনীতির উগ্র অনুসারী এবং পাকিস্তানের দালাল জামাতী-রাজাকারদেরকে রক্ষা করে। ১৯৭৪-এ পাকিস্তানে ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সভায় মুসলিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার মুসলমান ও বাঙ্গালী একত্রে দুই থাকতে চাইল এবং এ দেশের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ইসলামের সম্মিলন রক্ষা করতে চাইল। বস্তুত এই ধারাকেই জিয়া এবং এরশাদ সরকার আরও এগিয়ে নিয়েছে এবং ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ফলে এ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ ইসলাম থেকে যেটুকু দূরে সরেছিল, সেখান থেকে তাকে সরিয়ে পুনরায় অনেকাংশে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়েছে। বলা যায় এখন বাংলাদেশ অনেকাংশে পাকিস্তানের ক্ষুদ্রতর রূপ। জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বস্তুত এই রাষ্ট্রের মুসলমান বাঙ্গালীদের ইসলামী সাম্প্রদায়িক পরিচয় এবং ইসলাম ধর্মের প্রাধান্যের কৌশলী ঘোষণা। জেনারেল এরশাদ সরকার ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম ঘোষণা দ্বারা এ দেশে ইসলাম ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা ও গুরুত্বকে স্পষ্টতর করেছে মাত্র।

 

সুতরাং আমরা এ দেশের সমাজ ও রাষ্ট্র তথা রাজনীতিতে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা কতো গভীর ও প্রবল তা দেখতে পাচ্ছি। এ কথা বললে ভুল হবে যে, এ দেশে সরকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক ইসলাম ধর্মের এই লালন সাধারণ মানুষের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে। বস্তুত যে ধর্মের প্রতি জনগণ অনুগত এবং যে ধর্ম ব্যাপক সংখ্যাগুরু জনগণের জীবন, মন-মানসিকতা ও আচরণকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সরকার ও রাষ্ট্র মূলত সেই ধর্মকেই ব্যবহার করছে। এর উদ্দেশ্য খুব সহজ। এই ধর্মের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের বিপদ থেকে বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে রক্ষা করা। যে গোষ্ঠী আজ জনগণকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করছে তারা যে জনগণেরই অংশ এই বোধ জাগাবার জন্য অর্থাৎ শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে জনগণের ঐক্য রক্ষার জন্য এবং জনগণকে শাসকদের প্রতি অনুগত ও বাধ্য করার জন্য এ দেশে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা অপরিসীম। নতুবা শুধু বল প্রয়োগের ক্ষমতা দ্বারা জনগণকে উপর থেকে শাসন করতে হয় যেটা সর্বকালেই খুব ব্যয়বহুল, কষ্টকর ও অনিশ্চিত এবং আজকের যুগে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এমন অবস্থায় আমাদের দেশে প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে উত্থান লাভ করতে হলে যেমন জনগণের সমর্থনকে ব্যবহার করতে গিয়ে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করতে হয় তেমন ক্ষমতায় আরোহণ ক’রে কিংবা সামাজিক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে জনগণের সমর্থন ও আনুগত্য লাভের জন্য এই ধর্মকে নানানভাবে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়। সুতরাং যারা প্রচলিত ব্যবস্থার সুফল ভোগ করতে চায় তাদের জন্য জনগণের ইসলামী বিশ্বাস, অনুভূতি ও স্বাতন্ত্র্যকে নানানভাবে রক্ষা ও ব্যবহার করার গুরুত্ব অপরিসীম।

 

হাজার হাজার বৎসর ধরে এ দেশে পরলৌকিক ধর্ম সমাজ জীবনে এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হিন্দু ধর্ম এবং এক সময় বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্ম যেমন এই ভূমিকা পালন করেছে তেমন বহু শত বৎসর যাবত ইসলাম ধর্মও এ দেশে এই ভূমিকা পালন করেছে। তবে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম যেমন এ দেশের কিংবা এ উপমহাদেশের ধর্ম, ইসলাম তেমন নয়। তা সম্পর্কিত এ দেশে বৈদেশিক আক্রমণ, আগ্রাসন, শাসন, আধিপত্য এবং সেসবের ফলস্বরূপ এ দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে। ইসলাম শুধু এ দেশের বহিরাগত হানাদার শাসকদের নিজেদের ঐক্য ও আধিপত্য রক্ষার হাতিয়ার হয় নাই, উপরন্তু তা বহিরাগত হানাদার শাসকদের এ দেশের ধর্মান্তরিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর নৈতিক আনুগত্য লাভেরও হাতিয়ার হয়েছে। কারণ শাসক কেমন বা কোন ভাষার বা জাতির বা দেশের লোক সেটা বড় কথা নয় শাসক মুসলমান হলেই হ’ল। তাহলেই সে হবে শাসিত জনতার আপনজন।

 

এ দেশে ইসলাম ধর্মের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে এ দেশের সমস্যা বুঝতে ও মুক্তির পথ খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও ভূমিকা বুঝতে হবে। সুতরাং আমাদেরকে এই ধর্ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে হবে।

 

 

 


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ ইসলাম ও নিরংকুশ একত্ববাদ
 

তত্ত্বগতভাবে সব অলৌকিকতাবাদী ও পরলোকবাদী ধর্মেরই মূল কথা মৃতুøর পরের জীবনের কল্পনা এবং সেই জীবনে কল্যাণ লাভের আকাঙ্ক্ষা হলেও, এই সব ধর্ম প্রকৃতপক্ষে পরলোকে বা পরজন্মে পুরস্কারের লোভ ও শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষের বাস্তব জীবনকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থাৎ এই ধরনের ধর্ম হ’ল অদৃশ্য ও অজ্ঞাত জগত ও শক্তির কল্পনা দ্বারা মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণের এক পদ্ধতি। তাই এই সব ধর্ম যতই অলোকবাদী ও পরলোকবাদী হোক তার কাজ লৌকিক বা জাগতিক এবং ঐহিক। তবে এই জাগতিকতা ও ঐহিকতা পরিচালিত হয় অলোক, পরলোক বা পরজন্মের প্রতি মানুষের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ ক’রে।


ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে আরবে আবির্ভূত হয়ে এই পরলোকবাদী ধর্ম এক বিশেষ ঐতিহাসিক ও সামাজিক ভূমিকা পালন করে। এই ধর্মের মূল কথা হ’ল সর্বশক্তিমান ও সর্বোচ্চ অলৌকিক সত্তা হিসাবে এক আল্লাহ্‌য় বিশ্বাস ও আনুগত্য এবং এই এক আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি বা নবী হিসাবে, আল্লাহ্‌র বাণী প্রচারক হিসাবে মুহাম্মদের উপর বিশ্বাস ও আনুগত্য। আল্লাহ্‌র অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ নাই। কাজেই মুহাম্মদের কথাই হ’ল প্রমাণ। ইসলামের যুক্তি হ’ল এটাই। মুহাম্মদের প্রবর্তিত ধর্ম ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ হ’ল কুরআন। কুরআনের কথাকে বলা হয় মুহাম্মদের কাছে ফেরেশতা জিবরাইল কর্তৃক আনীত আল্লাহ্‌র প্রত্যাদেশ বা ওহী। অর্থাৎ “বিশেষ ভাব-অবস্থায়” মুহাম্মদ ঈশ্বরের বাণী হিসাবে যেগুলো বলেছেন বলা হয় সেগুলোকে মুহাম্মদের সাধারণ কথা থেকে ভিন্ন হিসাবে ধরা হয়। নিশ্চয় কুরআনও মুহাম্মদেরই কথা। তবে “বিশেষ ভাব-অবস্থায়” এই কথাগুলো বলা যেগুলোকে মুহাম্মদ বলতেন আল্লাহ্‌র কাছ থেকে পাওয়া প্রত্যাদেশ বা ওহী।

 

কুরআন যে মানুষ মুহাম্মদের সৃষ্টি নয় বরং স্বয়ং অলৌকিক আল্লাহ্‌র সৃষ্টি বাণী এই বিশ্বাসের প্রতি ইসলাম উগ্রভাবে অন্ধ। প্রত্যেক মুহাম্মদপন্থীর জন্য কোরআনকে আল্লাহ্‌র বাণী হিসাবে বিশ্বাস করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু যে কোনও মুক্ত বুদ্ধি সম্পন্ন ও মনোযোগী পাঠক কুরআনের ছত্রে ছত্রে মুহাম্মদের বক্তব্য দেখতে পাবেন। তাঁর চিন্তার বৈশিষ্ট্য, সীমাবদ্ধতা ও স্বরিরোধ সবই এখানে প্রতিফলিত। খুব সতর্কভাবে সংকলিত হলেও কুরআনের কয়েকটি আয়াতে মুহাম্মদের ব্যক্তিগত উপস্থিতি রোধ করা যায় নাই। কুরআনের অন্ধবিশ্বাসী ভাষ্যকাররা এর যেভাবেই ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করুন না কেন এগুলোর অর্থ খুব স্পষ্ট। স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এগুলো মুহাম্মদ নিজেই বলছেন। যেমন কুরআনের ৩৯ নম্বর সূরা যুমার-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছেঃ

 

৫৩। বল, ‘হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যাহারা নিজদিগের প্রতি অবিচার করিয়াছ - আল্লাহর অনুগ্রহ হইতে নিরাশ হইও না; আল্লাহ্‌ সমুদয় পাপ ক্ষমা করিয়া দিবেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’*

৩৯ সূরা যুমার

 

অর্থাৎ আল্লাহ্‌ মুহাম্মদকে বলছে যাতে মুহাম্মদ আল্লাহ্‌র বান্দা বা দাসদেরকে বলেন, “হে আমার বান্দাগণ!. . . . . . . ইত্যাদি।” তা হলে আল্লাহ্‌র দাস যারা তারা কি মুহাম্মদেরও দাস হচ্ছে না? কিংবা কুর্‌আনের আরও দুইটি আয়াত উদ্ধৃত করা যাক যেখানে বলা হচ্ছেঃ

 

৫০। আল্লাহর দিকে ধাবিত হও; আমি তোমাদিগের প্রতি আল্লাহ্‌ - প্রেরিত স্পষ্ট সতর্ককারী।

 

৫১। তোমরা আল্লাহ্‌র সঙ্গে কোন ইলাহ্‌ (উপাস্য) স্থির করিও না; আমি তোমাদিগের প্রতি আল্লাহ-প্রেরিত স্পষ্ট সতর্ককারী।

৫১ সূরা যারিয়াত

 

_____________________________________________________________________________________________________________________

* এই গ্রন্থে উদ্ধৃত কুরআনের প্রায় সকল আয়াতের বঙ্গানুবাদ “ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ” কর্তৃক ডিসেম্বর ১৯৮৭ তে মুদ্রিত কুর্‌আনের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ “আল-কুরআনুল করীম” থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। তবে প্রয়োজনে কুরআনের ভিন্ন বঙ্গানুবাদের সাহায্য নেওয়া হলে তার কথা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের যে সব আয়াতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদে আরবী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে প্রয়োজন বোধে লেখক কর্তৃক সেসবের অর্থ পাশে বন্ধনীতে দেওয়া হয়েছে। যেমন মূল অনুবাদে শুধু মুমিন রাখা হলেও পাশে বন্ধনীতে বিশ্বাসী শব্দ দেওয়া হয়েছে। – লেখক।

_____________________________________________________________________________________________________________________


এই কথাগুলো কে বলছে, আল্লাহ্‌ না মুহাম্মদ? কুরআনের কথা, সেই জন্য ইসলামের দাবী অনুযায়ী এগুলো আল্লাহ্‌র কথা। কিন্তু কোনও সুস্থমস্তিষ্ক কিংবা বুদ্ধিমান মানুষ এগুলোকে কার কথা বলবে?

 

মনে রাখতে হবে মুহাম্মদ নিজে অত্যন্ত সতর্কভাবে কুরআন রচনা করেন। “আল্লাহ্‌র বাণী” প্রচারের পর প্রয়োজন বোধ করলে তিনি “আল্লাহ্‌র নির্দেশ” হাজির ক’রে অনেক আয়াত বা আল্লাহ্‌র বাণী প্রত্যাহার বা বাতিল করতেন। এ সম্পর্কে অনেক কথা উঠায় মুহাম্মদ আল্লাহ্‌র বাণী স্বরূপ নিম্নলিখিত আয়াত দুইটি উপস্থিত করেনঃ

 

১০৬। আমি কোন আয়াত রহিত করিলে কিংবা বিস্মৃত হইতে দিলে তাহা হইতে উত্তম কিংবা তাহার সমতুল্য কোন আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ্‌ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।

২ সূরা বাকারা

 

১০১। আমি যখন এক আয়াতের পরিবর্তে অন্য এক আয়াত উপস্থিত করি - আল্লাহ যাহা অবতীর্ণ করেন তাহা তিনিই ভাল জানেন; তখন তাহারা* বলে, ‘তুমি ** তো কেবল মিথ্যা উদ্ভাবনকারী;’ কিন্তু উহাদিগের অধিকাংশই জানে না।

১৬ সূরা নাহ্‌ল

 

ইসলাম ধর্ম কঠোরভাবে শৃংখলাবদ্ধ। এই শৃংখলার কেন্দ্র বিন্দু হ’ল কুরআন। অর্থাৎ কুরআনের বক্তব্য ও বিধিমালা। এ ছাড়া আছে হাদীস। মুহাম্মদের সমস্ত সাধারণ কথা, নির্দেশ, কাজ এবং কাজের অনুমোদনকে হাদীস বলা হয়। ইসলাম এবং মুসলমানের জীবন কুরআন ও হাদীসের নিয়ম ও অনুশাসন দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। মুহাম্মদের কোনও অনুসারী বা মুসলমানের কুরআন ও হাদীসের বিধি-নিষেধ অস্বীকার ক’রে চলার অধিকার নাই। ইসলাম এ ব্যাপারে সামান্য ফাঁক রাখে নাই। কুরআনের নিম্নবর্ণিত আয়াতও এ বিষয়কে স্পষ্ট করে।

 

_____________________________________________________________________________________________________________________

 * তাহারা অর্থাৎ অমুসলিম বা বিধর্মীরা।

** মুহাম্মদ।

_____________________________________________________________________________________________________________________


৩৬। আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মুমিন (বিশ্বাসী) পুরুষ কিংবা মুমিন (বিশ্বাসী) নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকিবে না। কেহ আল্লাহ্‌ এবং তাঁহার রাসূলকে অমান্য করিলে সে তো স্পষ্টই পথ ভ্রষ্ট হইবে।

৩৩ সূরা আহ্‌যাব

 

বস্তুত যেভাবে সতর্ক ও স্পষ্ট বিধি বা অনুশাসন দ্বারা ইসলাম ধর্ম তার অনুসারীদের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে তাতে তার বাইরে যাওয়া কোনও মুসলমানের পক্ষেই দুঃসাধ্য। কোন বৃহৎ ধর্মই মানষের সমগ্র জীবন ও আচরণকে এত কঠোর ও দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় নাই। ইসলামের এই দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার উৎস নিহিত রয়েছে তার ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মীয়-সামাজিক নিয়ম, অনুষ্ঠান দ্বারা সংগঠিত বিশেষ চিন্তা পদ্ধতি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যে।

 

ইসলামী তত্ত্ব নিরংকুশভাবে একত্ববাদী। ইসলাম মনে করে এক ঈশ্বর সমস্ত সৃষ্টি বা বস্তু জগতের উৎস। এবং এই ঈশ্বরের নাই আর কোনও অংশীদার। অর্থাৎ সৃষ্টি ক্ষমতা যেমন আর কোনও সত্তা বা শক্তির মধ্যে নেই তেমন আর কোনও শক্তি নাই যে, ইসলামের ঈশ্বরের শক্তি বা ক্ষমতার অংশীদার হ’তে পারে। বহু ঈশ্বরবাদ বা অংশীবাদের ধারণার প্রতি ইসলাম হিংস্রভাবে আক্রমণাত্মক। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার সামান্যতম বিভক্তির ধারণার প্রতি ইসলামের সামান্যতম সহিষ্ণুতা নাই। কাজেই ইসলাম বস্তুজগতের স্রষ্টা ও পরিচালক হিসাবে একজন মাত্র সত্তা বা শক্তিকে কল্পনা ক’রে নিচ্ছে। ইসলামের মূল গ্রন্থ কুরআনে আল্লাহ্‌র একত্বের উপর দেওয়া হয়েছে খুবই গুরুত্ব। বহু আয়াতে বহু বার বহু ভাবে এই কথা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে কুরআনের কয়েকটি আয়াত ও আয়াতের অংশ উদ্ধৃত করা যায়।

 

১১১। বল, ‘প্রশংসা আল্লাহ্‌রই যিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেন নাই, তাঁহার সার্বভৌমত্বে কোন অংশী নাই এবং যিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না যে-কারণে তাঁহার অভিভাবকের প্রয়োজন হইতে পারে। সুতরাং সসম্ভ্রমে তাঁহার মাহাত্ম্য ঘোষণা কর।’

১৭ সূরা বাণী ইস্‌রাঈল

 

২৬। তুমি বল, ‘তাহারা কত কাল ছিল তাহা আল্লাহ্‌ই ভাল জানেন,’ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অজ্ঞাত বিষয়ের জ্ঞান তাঁহারই। তিনি কত সুন্দর দ্রষ্টা ও শ্রোতা! তিনি ব্যতীত উহাদিগের অন্য কোন অভিভাবক নাই। তিনি কাহাকেও নিজ কর্তৃত্বের শরীক করেন না।

১৮ সূরা কাহ্‌ফ

 

৩০। . . . .। সুতরাং তোমরা বর্জন কর মূর্তি পূজার অপবিত্রতা এবং দূরে থাক মিথ্যা-কথন হইতে,

 

৩১। আল্লাহ্‌র প্রতি একনিষ্ঠ হইয়া এবং তাঁহার কোন শরীক না করিয়া ; এবং যে-কেহ আল্লাহ্‌র শরীক করে সে যেন আকাশ হইতে পড়িল, অতঃপর পাখী তাহাকে ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল, কিংবা বায়ু তাহাকে উড়াইয়া লইয়া গিয়া এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করিল।

২২ সূরা হাজ্জ


৩৪। . . . . । তোমাদিগের ইলাহ্‌ (উপাস্য) এক ইলাহ্‌, সুতরাং তাঁহারই নিকট আত্মসমর্পণ কর এবং সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে -


৩৫। যাহাদিগের হৃদয় ভয়-কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হইলে, যাহারা তাহাদিগের বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণ করে, এবং সালাত (নামায) কায়েম করে এবং আমি তাহাদিগকে যে রিয্‌ক (আহার, উপার্জন) দিয়াছি তাহা হইতে ব্যয় করে।

২২ সূরা হাজ্জ


ইসলাম ধর্ম মতে সব অপরাধ ক্ষমার যোগ্য হ’তে পারে কিন্তু আল্লাহ্‌র অংশীদার তথা একাধিক বা বহু ঈশ্বর বা দেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কুর্‌আনে বলা হচ্ছেঃ


৪৮। আল্লাহ্‌ তাঁহার শরীক (অংশীদার) করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। ইহা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; যে-কেহ আল্লাহ্‌র শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।

৪ সূরা নিসা


বস্তুত সমস্ত শক্তির একমাত্র কেন্দ্র ও নিয়ন্তা হিসাবে আল্লাহ্‌র একত্বের প্রতি এই নিরংকুশ গুরুত্ব আরোপের ফলে যেটা অস্বীকৃত হয় সেটা হল প্রকৃতি বা বস্তুজগতের দ্বৈততা ও দ্বন্দ্ব। প্রকৃতির কোনও বস্তুই নিরংকুশভাবে একক নয়। এক বস্তুর সঙ্গে আরেক বস্তুর দ্বন্দ্ব ও ঐক্য যেমন প্রকৃতির এক নিয়ম তেমন কোনও একটি বস্তুও অবিভাজ্য সত্তা নয়। এমন কি বস্তুর ক্ষুদ্রতম কণা হিসাবে যে পরমাণুকে কল্পনা করা হয় তাও অবিভাজ্য নয়। তাকেও অবিরামভাবে বিভক্ত করে যাওয়া যায়। এবং এই প্রক্রিয়ার শেষ নাই। বস্তুকে যতই ভাঙ্গা বা বিভক্ত করা যাক তাকে শূন্যে পরিণত করা সম্ভব নয়। তার আছে শুধু পরিবর্তন, রূপান্তর। দ্বন্দ্ব ও ঐক্য, ধ্বংস ও সৃষ্টি কিংবা ভাঙ্গন ও গঠনের অবিরাম প্রক্রিয়ায় চলে বস্তুর অবিরাম রূপ পরিবর্তন। কাজেই বস্তু জগতে স্থির কোনও সত্য কিংবা নিখাদ ঐক্য বা একত্ব সন্ধান করে লাভ নাই। ঐক্যের পাশে, একত্বের পাশে বহুসত্তার অস্তিত্ব ও দ্বৈততা বা দ্বন্দ্ব আর এক সত্য।


জীবের ক্ষেত্রেও আমরা এই নিয়ম দেখতে পাই। কারণ বস্তুরই উচ্চতর রূপ হল প্রাণ বা জীবন। বস্তুর অজৈব দ্বান্দ্বিক এক নিয়ম জীবদেহে নারী-পুরুষ সত্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করে। অনেক উদ্ভিদ বা নিম্নতর পর্যায়ের প্রাণে যেখানে স্ত্রী-পুরুষ পৃথক দেহ নয় সেখানে একই জীবদেহে আমরা স্ত্রী ও পুরুষ কোষকে পৃথকভাবে কিংবা পাশাপাশি বিদ্যমান দেখতে পাই। উচ্চতর প্রাণী জগতে স্ত্রী ও পুরুষের পৃথক দৈহিক অস্তিত্বের মধ্যে বস্তুর এই দ্বান্দ্বিকতা আর একভাবে মূর্ত হয়েছে।


কিন্তু এক স্ত্রী বা পুরুষ দেহও আবার তার বিপরীত বৈশিষ্ট্য বর্জিত নয়। স্ত্রী বৈশিষ্ট্য প্রধান হলে সেই প্রাণীদেহ স্ত্রীরূপে এবং পুরুষ বৈশিষ্ট্য প্রধান হলে সেই প্রাণীদেহ পুরুষরূপে নিজেকে প্রকাশ করে মাত্র। তাই প্রাণী জগতে কিংবা মানুষের মধ্যে স্ত্রীর পুরুষে এবং পুরুষের স্ত্রীতে রূপান্তর সম্ভব। যাইহোক, মূল কথা হল, প্রকৃতির সমস্ত গতি ও ক্রিয়াশীলতা স্থাপিত তার ঐক্যের পাশে দ্বৈততার উপর। এটাই হল প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার নিয়ম।


বস্তু জগতের দ্বৈততার এই নিয়মকে বাস্তব ক্ষেত্রে ইসলামও অস্বীকার করতে পারে নাই। তাই কুরআনে বলা হয়েছে,


৪৯। আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করিয়াছি জোড়ায় জোড়ায়, যাহাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।

৫১ সূরা যারিয়াত


এর উপদেশ তো একটাই হতে পারে, তা হ’ল, যে নিয়ম সৃষ্টের ক্ষেত্রে বর্তমান সেই একই নিয়ম স্রষ্টার ক্ষেত্রেও বর্তমান। বস্তুজগতে যদি দ্বৈত সত্তার মিলনের মাধ্যমে নূতন বা তৃতীয় সত্তা জন্ম নেয় তবে কেন সেই একই নিয়ম স্রষ্টার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে না? বস্তুজগতের স্রষ্টা যদি থাকেই তবে তা শুধু একজন কেন অন্তত পক্ষে দুইজন কি হওয়া উচিত নয়? আবার একই যুক্তি অনুযায়ী সেই স্রষ্টাদেরও পূর্ববর্তীদিগকে খঁুজতে হয়। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে বস্তুজগতের বাইরে কোনও অবাস্তব শক্তি খুঁজে লাভ নাই।


অবশ্য এটা যুক্তির কথা। অবস্তুবাদী ও পরলোকবাদী ধর্ম যুক্তির ধার ধারে না। যুক্তি ও জ্ঞান দ্বারা তা সত্যকে বুঝতে পারে না। তার সেই জ্ঞান, সাহস ও মানসিক শক্তি নাই বলে এই ধরনের গভীর চিন্তা বা প্রশ্নের সম্ভাবনাকেই তা শাস্তির ভয় দেখিয়ে বা ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। আমরা কুরআনের ছত্রে ছত্রে যুক্তির বদলে ইসলাম ধর্মের এই ভয়-সন্ত্রাসী রূপ দেখতে পাই। সৃষ্টি জিজ্ঞাসাকে ইসলাম কঠোরভাবে বেঁধে দিয়েছে। কুরআন, হাদীসের উপর আর কোনও কথা নাই। এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা না করে এই ধরনের জিজ্ঞাসা মনকে আলোড়িত করলে কী করতে হবে সে সম্পর্কে হাদীস থেকে মুহাম্মদের পরামর্শ উল্লেখ করতে পারি।


“আবু হোরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত রসুলুল্লাহ্‌ (সঃ) বলিয়াছেন, কোন কোন মানুষের নিকট শয়তান উপস্থিত হইয়া তাহার অন্তরে এইরূপ প্রশ্নের সৃষ্টি করে যে, অমুক বস্তুটাকে কে সৃষ্টি করিয়াছে? সে এইরূপ প্রশ্নে অগ্রসর হইতে থাকে, এমন কি অবশেষে এই প্রশ্নের সৃষ্টি করে যে, তোমার পরওয়ারদেগারকে সৃষ্টি করিয়াছে কে? যখনই এইরূপ প্রশ্নের উদয় হয় তখনই এই সম্পর্কে স্বীয় চিন্তা শক্তিকে এক মুহূর্তের জন্যও ব্যয় না করিয়া তৎক্ষণাৎ এই প্রশ্নকে পরিত্যাগ করিবে এবং “আউজুবিল্লাহে মিনাশ্‌শায়তানির রাজিম” বলিয়া শয়তানকে তাড়াইবে এবং আল্লাহ্‌ তায়ালার আশ্রয় প্রার্থনা করিবে।”

 

(বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড

অনুঃ শামছুল হক ও আজিজুল হক

হামিদিয়া লাইব্রেরী; ঢাকা, ১৯৬৭

পৃষ্ঠাঃ ৩৬৯)


যাইহোক, পরলোকবাদী ধর্ম বাস্তব নিয়মকে যতই অস্বীকার করুক তা যেহেতু মানুষ ও জীবনকে নিয়েই কারবার করে তাই বস্তুজগতের দ্বান্দ্বিক নিয়মকে ছদ্মাবরণে ও বিকৃত রূপে হলেও মেনে নিতে বাধ্য হয়। ইসলামও এই বাস্তব নিয়মকে মেনে নিয়েছে শয়তানের তত্ত্ব হাজির ক’রে।


ইসলামী সৃষ্টিতত্ত্বে আল্লাহ্‌ বিশ্ব সৃষ্টির পর স্বর্গে প্রথম মানুষ আদমকে সৃষ্টি করে। তারপর সকলকে তার প্রতি প্রণতি জানাতে বা তাকে সেজ্‌দা করতে নির্দেশ দেয়। সকলে আল্লাহ্‌র এই নির্দেশ পালন করল। কিন্তু আগুন দ্বারা তৈরী জিন ইবলীস্‌ মাটি দ্বারা তৈরী আদমকে সেজদা করতে অস্বীকার করল। তার আত্মমর্যাদা বোধে লাগল। আল্লাহ্‌র নির্দেশ অস্বীকার করায় আল্লাহ্‌ ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে বেহেশ্‌ত থেকে বিতাড়িত করল। এইভাবে ইবলীস্‌ শয়তানে পরিণত হল।


কুরআনে মানব সৃষ্টি, ইবলীসের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ, মানবী সৃষ্টি, আদি মানব আদম ও আদি মানবী হাওয়ার প্রতি আল্লাহ্‌র সতর্কবাণী, মানুষের স্বর্গ হতে পতন ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন সূরায় অনেক আয়াত আছে। আমরা সেসবে না গিয়ে সংক্ষিপ্ত ধারণা লাভের জন্য শুধু ১৫ সূরা হিজ্‌র থেকে কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করছি।

৩২। আল্লাহ্‌ বলিলেন, ‘হে ইবলীস! তোমার কি হইল যে, তুমি সিজ্‌দাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হইলে না?’


৩৩। সে বলিল, ‘আপনি ছাঁচে-ঢালা শুষ্ক ঠন্‌ঠনে মৃত্তিকা হইতে যে মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন আমি তাহাকে সিজ্‌দা করিবার নহি।’


৩৪। তিনি বলিলেন, ‘তবে তুমি এখান হইতে বাহির হইয়া যাও, কারণ তুমি অভিশপ্ত।’


৩৫। ‘এবং কর্মফল দিবস পর্যন্ত তোমার প্রতি রহিল লানত (অভিশাপ)।’


৩৬। সে বলিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন।’


৩৭। তিনি বলিলেন, ‘যাহাদিগকে অবকাশ দেওয়া হইয়াছে তুমি তাহাদিগের অন্তর্ভুক্ত হইলে,


৩৮। ‘অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত।’


৩৯। সে বলিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি যে আমাকে বিপথগামী করিলেন তজ্জন্য আমি পৃথিবীতে মানুষের নিকট পাপকর্মকে শোভন করিয়া তুলিব এবং আমি উহাদিগের সকলকেই শোভন করিয়া তুলিব এবং আমি উহাদিগের সকলকেই বিপথগামী করিব,


৪০। ‘তবে উহাদিগের মধ্যে তোমার নির্বাচিত বান্দাগণকে নহে।’


৪১। আল্লাহ্‌ বলিলেন, ‘ইহাই আমার নিকট পৌঁছিবার সরল পথ, *


৪২। ‘বিভ্রান্তদিগের মধ্যে যাহারা তোমার অনুসরণ করিবে তাহারা ব্যতীত আমার বান্দাদিগের উপর তোমার কোন ক্ষমতা থাকিবে না;


৪৩। ‘অবশ্যই তোমার অনুসারীদিগের সকলেরই নির্ধারিত স্থান হইবে জাহান্নাম;


৪৪। ‘উহার সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্য পৃথক পৃথক দল আছে।’


৪৫। ‘মুত্তাকীরা (ধর্মভীরু বা সাবধানী) থাকিবে প্রস্রবণ বহুল জান্নাতে।’


মজার কথা হল যে, আল্লাহ্‌ এবং ইবলীস বা শয়তানের মধ্যে যখন এই কথোপকথন চলছে তখনও আদি মানবী হাওয়ার জন্ম হয় নাই কিংবা মানুষের স্বর্গচুøতির প্রশ্ন উঠবার কথা নয়। অথচ তখনই আল্লাহ্‌ কর্মফল দিবস, আর শয়তান পুনরুত্থান দিবস অর্থাৎ কিয়ামত সম্পর্কে উল্লেখ করছে। অর্থাৎ আল্লাহ এবং শয়তান উভয়েরই জানা যে, আদম তথা মানুষের কপালে কী ঘটতে যাচ্ছে। অন্তত এই আয়াতগুলি দ্বারা আল্লাহ্‌র সৃষ্টিলীলার নামে মানুষকে নিয়ে স্বেচ্ছাচারী খেলার পূর্ব পরিকল্পনা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।


অবশ্য যুক্তি তোলা যায় যে, আল্লাহ যদি সর্বশক্তিমান ও সমস্ত অভাবমুক্ত হয় তবে তার জন্য বিশ্ব সৃষ্টি বা মানুষ সৃষ্টিরই বা কী প্রয়োজন আর মানুষ নিয়ে এই খেলারই বা কী প্রয়োজন?

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* ঈমান ও আমলের (বিশ্বাস ও কর্মের) পথ যাহা কুরআনে বর্ণিত আছে। – ইসলামিক ফাইণ্ডেশন বাংলাদেশ কৃত অনুবাদ আল কুরআনুল করীম।

____________________________________________________________________________________________________________________


আসলে সর্বশক্তিমান বা অভাবমুক্ত হ’লে স্রষ্টার জন্য সৃষ্টের দাসত্ব বা উপাসনা কিংবা কৃতজ্ঞতার যেমন প্রয়োজন থাকে না তেমন পুণ্যবান ও পাপী, বাধ্য ও অবাধ্য মানুষের পরীক্ষার পর তাকে স্বর্গ কিংবা নরকে দেবারও প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ এই সর্বশক্তিমানও সর্বশক্তিমান নয়। কারণ তার আছে অভাব, তার আছে মানুষের আনুগত্য লাভের আকাঙ্ক্ষা বা ক্ষুধা এবং মানুষ নিয়ে খেলবার প্রয়োজন।


কিন্তু এই তথাকথিত সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ একা মানুষ নিয়ে খেলতে কিংবা সৃষ্টি লীলা করতে পারে না। তাই তারও লাগে একজন প্রতিপক্ষ। অর্থাৎ শুধু এক দিয়ে কিছু হয় না, সৃষ্টি এগোয় না। তাই প্রয়োজন হয় ভিন্নতা বা দ্বৈততার। শয়তান হ’ল এই ভিন্নতা বা দ্বৈততার প্রতীক। সৃষ্টি লীলার জন্য তাই তথাকথিত সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌র প্রতিপক্ষ হিসবে হাজির করা হয় শয়তানকে।


এখন যুক্তিসঙ্গতভাবে এই প্রশ্ন আসে যে, শয়তানের অশুভ ইচ্ছা বা পাপ চিন্তা কিংবা শয়তানী আসে কোথা থেকে? শয়তান যদি আল্লাহর সৃৃষ্টি হয় তবে শয়তানের গুণ শয়তানীও কি আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি নয়? আল্লাহ্‌র সৃষ্টি তো তেমন হবে যেমন তা নিজে। কিন্তু ইসলাম তাকে শুধু সদগুণের আধার হিসাবে দেখাতে চায়। বদগুণ শুধু শয়তানের সৃষ্টি। তাহলে কি যুক্তি অনুযায়ী শয়তানও আরেক ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌ হিসাবে দেখা দেয় না? কিন্তু ইসলাম শয়তানকে আরেক আল্লাহ্‌ বা স্রষ্টা হিসাবে স্বীকার করে না। ইসলাম ধর্ম শয়তানকে আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি বলে। আল্লাহ্‌র আর সব দাসের মত সেও আল্লাহ্‌র এক দাস মাত্র। তবে অবাধ্য দাস। যেহেতু শয়তান আল্লাহ্‌র সৃষ্টি সেহেতু যুক্তি অনুযায়ী শয়তানের শয়তানীও আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি। অর্থাৎ আল্লাহ্‌র নিজেরই মধ্যে আছে শয়তানী। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যুক্তির বিচারে আল্লাহ্‌ এবং শয়তান একই সত্তার দুই দিক, শয়তান আল্লাহ্‌রই অপর রূপ। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ও যে শয়তানও সে।


কিন্তু অবৈজ্ঞানিক ও অলৌকিকতাবাদী ধর্ম এসব যুক্তির ধার ধারে না। বিশেষত ইসলাম অত্যন্ত হিংস্রভাবে যুক্তি বিরোধী। তা অত্যন্ত উগ্রভাবে ও আক্রমণাত্মভাবে সবার আত্মসমর্পণ দাবী করে। ইসলামের দাবী বিনা প্রশ্নে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের। কুরআনে বলা হচ্ছে,


২৩। তিনি যাহা করেন সে বিষয়ে তাঁহাকে প্রশ্ন করা যাইবে না; বরং উহাদিগকেই প্রশ্ন করা হইবে।

২১ সূরা আম্বিয়া


৮। মানুষের মধ্যে কেহ কেহ আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে; তাহাদিগের না আছে জ্ঞান, না আছে পথ নির্দেশক, না আছে কোন দীপ্তিমান কিতাব।


৯। সে বিতণ্ডা করে ঘাড় বাঁকাইয়া লোকদিগকে আল্লাহ্‌র পথ হইতে ভ্রষ্ট করিবার জন্য। তাহার জন্য লাঞ্ছনা আছে ইহলোকে এবং কিয়ামত দিবসে আমি তাহাকে আস্বাদ করাইব দহন যন্ত্রণা।

২২ সূরা হাজ্জ


৫১। মুমিনদিগের (বিশ্বাসীদের) উক্তি তো এই - যখন তাহাদিগের মধ্যে ফয়সালা করিয়া দিবার জন্য আল্লাহ্‌ এবং তাঁহার রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তাহারা বলে, ‘আমরা শ্রবণ করিলাম ও মান্য করিলাম।’ আর উহারাই তো সফলকাম।


৫২। যাহারা আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ্‌কে ভয় করে ও তাঁহার অবাধ্যতা হইতে সাবধান থাকে তাহারাই সফলকাম।

২৪ সূরা নূর


২। যাহারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহাতে বিশ্বাস করে, আর উহাই তাহাদিগের প্রতিপালক হইতে প্রেরিত সত্য; তিনি তাহাদিগের মন্দ কর্মগুলি ক্ষমা করিবেন এবং তাহাদিগের অবস্থা ভাল করিবেন।

৪৭ সূরা মুহাম্মাদ

ইত্যাদি।


ইসলামের আল্লাহ্‌ এক কঠোর সত্তা। তার নিষ্ঠুরতা, জিঘাংসা ও হিংস্রতার সীমা-পরিসীমা নাই। কুরআনের ছত্রে ছত্রে এই ভয়ংকর ও সন্ত্রাসী সত্তার প্রকাশ ঘটেছে। প্রেম ও ভালবাসা কিংবা ক্ষমার তুলনায় শাস্তির ভয় ও কঠোরতা প্রদর্শনেই আল্লাহ্‌ অনেক বেশী তৎপর। আল্লাহ্‌র প্রতি মানুষকে ভয়াতুরভাবে অনুগত করার জন্য মুহাম্মদ কুরআনে আল্লাহ্‌র যে কঠোর ও সন্ত্রাসী রূপ প্রকাশ করেছেন তা বোঝার জন্য এখানে আমরা কয়েকটি আয়াত ও আয়াতের অংশ উল্লেখ করতে পারি।


১০৪। . . . . . . ., এবং শুনিয়া রাখ, কাফিরদের (সত্য প্রত্যাখ্যানকারী অর্থাৎ ইসলাম প্রত্যাখ্যানকারীদের) জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রহিয়াছে।

২ সূরা বাকারা


৮৫। কেহ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দীন (ধর্ম) গ্রহণ করিতে চাহিলে তাহা কখনও কবুল করা হইবে না এবং সে হইবে পরলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।

৩ সূরা আল ইমরান


১৫১। কাফিরদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করিব, যেহেতু তাহারা আল্লাহ্‌র শরীক করিয়াছে, যাহার সপক্ষে আল্লাহ্‌ কোন সনদ পাঠান নাই। জাহান্নাম তাহাদের আবাস; কত নিকৃষ্ট আবাসস্থল জালিমদের (অত্যাচারী। এখানে যারা আল্লাহর অত্যাচার ডেকে আনে তাদেরকে বোঝানো হচ্ছে)!

৩ সূরা আল ইমরান


৫৬। যাহারা আমার আয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে তাহাদিগকে অগ্নিতে দগ্ধ করিবই; যখনই তাহাদের চর্ম দগ্ধ হইবে তখনই উহার স্থলে নূতন চর্ম সৃষ্টি করিব, যাহাতে তাহারা শাস্তি ভোগ করে। আল্লাহ্‌ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।

৪ সূরা নিসা


১০। যাহারা কুফরী (সত্য বা ইসলাম প্রত্যাখ্যান) করে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা জ্ঞান করে তাহারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নির অধিবাসী।

৫ সূরা মায়িদা


৪১। .......। এবং আল্লাহ্‌ যাহার পথচুøতি চাহেন তাহার জন্য আল্লাহ্‌র নিকট তোমার কিছুই করিবার নাই। তাহাদেরই হৃদয়কে আল্লাহ্‌ বিশুদ্ধ করিতে চাহেন না; তাহাদের জন্য আছে দুনিয়ায় লাঞ্ছনা ও পরকালে মহাশাস্তি।

৫ সূরা মায়িদা


৬৩। ইহারা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের বিরোধিতা করে তাহার জন্য আছে জাহান্নামের অগ্নি, যেথায় সে স্থায়ী হইবে? উহাই চরম লাঞ্ছনা।

৯ সূরা তাওবা


৭৭। বল, ‘তোমরা আমার প্রতিপালককে না ডাকিলে তাঁহার কিছু আসে যায় না। তোমরা অস্বীকার করিয়াছ, ফলে অচিরে নামিয়া আসিবে অপরিহার্য শাস্তি।’

২৫ সূরা ফুরকান


২৩। যাহারা আল্লাহ্‌র নিদর্শন ও তাঁহার সাক্ষাৎ অস্বীকার করে, তাহারাই আমার অনুগ্রহ হইতে নিরাশ হয়। তাহাদিগের জন্য আছে মর্মন্তুদ শাস্তি।

২৯ সূরা আনকাবূত


৪০। উহাদিগের প্রত্যেককেই তাহার অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়াছিলামঃ উহাদিগের কাহারও প্রতি প্রেরণ করিয়াছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড ঝটিকা, উহাদিগের কাহাকেও আঘাত করিয়াছিল মহানাদ, কাহাকেও আমি প্রোথিত করিয়াছিলাম ভূগর্ভে এবং কাহাকেও করিয়াছিলাম নিমজ্জিত। আল্লাহ, তাহাদিগের প্রতি কোন জুলুম (অত্যাচার) করেন নাই; তাহারা নিজেরাই নিজদিগের প্রতি জুলুম করিয়াছিল।

২৯ সূরা আনকাবূত


৫। যাহারা আমার আয়াতকে ব্যর্থ করিবার চেষ্টা করে তাহাদিগের জন্য রহিয়াছে ভয়ংকর মর্মন্তুদ শাস্তি।

৩৪ সূরা সাবা

 

২। এই কিতাব (কুরআন) অবতীর্ণ হইয়াছে পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহ্‌র নিকট হইতে -


৩। যিনি পাপ ক্ষমা করেন, তওবা কবুল করেন, যিনি শাস্তি দানে কঠোর, শক্তিশালী। তিনি ব্যতীত কোন ইলা্‌হ (উপাস্য) নাই। প্রত্যাবর্তন তাঁহারই নিকট।

৪০ সূরা মুমিন


৪। কেবল কাফিররাই (সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা) আল্লাহ্‌র নিদর্শন সম্বন্ধে বিতর্ক করে; সুতরাং দেশে দেশে তাহাদিগের অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে বিভ্রান্ত না করে।


৫। উহাদিগের পূর্বে নূহের সম্প্রদায় এবং তাহাদিগের পরে অন্যান্য দলও মিথ্যা আরোপ করিয়াছিল। প্রত্যেক সম্প্রদায় নিজ নিজ রাসূলকে আবদ্ধ করিবার অভিসন্ধি করিয়াছিল এবং উহারা অসার তর্কে লিপ্ত হইয়াছিল, সত্যকে ব্যর্থ করিয়া দিবার জন্য; ফলে আমি উহাদিগকে পাকড়াও করিলাম এবং কত কঠোর ছিল আমার শাস্তি।

৪০ সূরা মুমিন


৬০। তোমাদিগের প্রতিপালক বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদিগের ডাকে সাড়া দিব। যাহারা অহংকারে আমার ইবাদতে বিমুখ, উহারা অবশ্যই জাহান্নামে (নরকে) প্রবেশ করিবে লাঞ্ছিত হইয়া।

৪০ সূরা মুমিন


৭০। যাহারা অস্বীকার করে কিতাব ও যাহা সহ আমার রাসূলগণকে প্রেরণ করিয়াছিলাম তাহা; শীঘ্রই উহারা জানিতে পারিবে -


৭১। যখন উহাদিগের গলদেশে বেড়ি ও শৃঙ্খল থাকিবে, উহাদিগকে টানিয়া লইয়া যাওয়া হইবে


৭২। ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর উহাদিগকে দগ্ধ করা হইবে অগ্নিতে;


৭৩। পরে উহাদিগকে বলা হইবে, ‘ কোথায় তাহারা যাহাদিগকে তোমরা তাঁহার শরীক করিতে,


৭৪। ‘আল্লাহ ব্যতীত? উহারা বলিবে, ‘উহারা তো আমাদিগের নিকট হইতে অদৃশ্য হইয়াছে; বস্তুত পূর্বে আমরা এমন কিছুকেই আহ্বান করি নাই।’ এইভাবে আল্লাহ্‌ কাফিরদিগকে বিভ্রান্ত করেন।


৭৫। ইহা এই কারণে যে, তোমরা পৃথিবীতে অযথা উল্লাস করিতে এবং এই জন্য যে, তোমরা দম্ভ করিতে।

৪০ সূরা মুমিন


২৮। জাহান্নাম, ইহাই আল্লাহর শত্রুদিগের পরিণাম, সেথায় উহাদিগের জন্য রহিয়াছে স্থায়ী আবাস আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকৃতির প্রতিফল স্বরূপ।

৪১ সূরা হা-মীম আস্‌সাজদা


২৪। আদেশ করা হইবে, নিক্ষেপ কর, নিক্ষেপ কর জাহান্নামে প্রত্যেক উদ্ধত কাফিরকে -


২৫। কল্যাণকর কাজে প্রবল বাধাদানকারী, সীমা লংঘনকারী ও সন্দেহপোষণকারী।


২৬। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সঙ্গে অন্য ইলাহ্‌ (উপাস্য) গ্রহণ করিত তাহাকে কঠিন শাস্তিতে নিক্ষেপ কর।


২৭। তাহার সহচর শয়তান বলিবে ‘হে আমাদিগের প্রতিপালক! আমি তাহাকে অবাধ্য হইতে প্ররোচিত করি নাই। বস্তুত সে নিজেই ছিল ঘোর বিভ্রান্ত।’


২৮। আল্লাহ্‌ বলিবেন, ‘আমার সম্মুখে বাক-বিতণ্ডা করিও না; তোমাদিগকে আমি তো পূবেই সতর্ক করিয়াছি।


২৯। ‘আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি আমার বান্দাদিগের (দাসদের) প্রতি কোন অবিচার করি না।’


৩০। সেই দিন আমি জাহান্নামকে জিজ্ঞাসা করিব, ‘তুমি কি পূর্ণ হইয়া গিয়াছ?’ জাহান্নাম বলিবে, ‘আরও আছে কি?’

৫০ সূরা কাফ


৩৯। সেইদিন (কিয়ামত বা বিচার দিবসে) না মানুষকে তাহার অপরাধ সম্বান্ধে জিজ্ঞাসা করা হইবে, না জিনকে।


৪০। সুতরাং তোমরা উভয়ে (মানুষ ও জিন) তোমাদিগের প্রতিপালকের (আল্লাহ্‌র) কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করিবে?


৪১। অপরাধীদিগের পরিচয় পাওয়া যাইবে তাহাদিগের চেহারা হইতে; উহাদিগকে পাকড়াও করা হইবে পা ও মাথার ঝুঁটি ধরিয়া।


৪২। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদিগের প্রতিপালকের কোন্‌ অনুগ্রহ অস্বীকার করিবে?


৪৩। ইহাই সেই জাহান্নাম (নরক), যাহা অপরাধীরা অবিশ্বাস করিত,


৪৪। উহারা জাহান্নামের অগ্নি ও ফুটন্ত পানির মধ্যে ছুটাছুটি করিবে।


৪৫। সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদিগের প্রতিপালকের কোন্‌ অনুগ্রহ অস্বীকার করিবে।

৫৫ সূরা রাহমান


উদাহরণ বাড়াবার দরকার নাই। আল্লাহর হিংস্র, সন্ত্রাসী ও কঠোর রূপের এই ধরনের বর্ণনা কুরআনের বহু আয়াতেই পাওয়া যাবে। আল্লাহয় অবিশ্বাসী বা মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি বিরোধিতাকারীদের সম্পর্কে পৃথিবীতে কিংবা পরলোকে শাস্তির বহু বিবরণ আছে সেসবে। বিশেষত নরকের কঠোর ও ভয়ংকর শাস্তির বীভৎস বর্ণনা কুরআন ও হাদীসের বিপুল অংশ জুড়ে রয়েছে। এই সবেরই উদ্দেশ্য মানুষকে মুহাম্মদের আল্লাহ্‌ ও ধর্মের প্রতি সন্ত্রস্তভাবে ও অন্ধভাবে অনুগত ও বিশ্বাসী করে তোলা, যাতে কেউ মুহাম্মদের কোনও কথা বা আল্লাহ্‌ সম্পর্কে এমন কি নিজের মনের ভিতরেও কোনও প্রশ্ন তুলতে সাহস না পায়।


কুরআনে আল্লাহ্‌কে ক্ষমাপরায়ণ কিংবা দয়াময়, পরম দয়ালু ইত্যাদিও বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্‌র ক্ষমা, দয়া ইত্যাদি সবই এক সন্ত্রাসী ও অসহিষ্ণু, কঠোর সত্তার ক্ষমা বা দয়া মাত্র। শুধু কঠোরতা ও সন্ত্রাস নিয়ে জীবন চলে না। তাই সবচেয়ে সন্ত্রাসী ও স্বৈরাচারীর জীবনেও দয়া, প্রেম একেবারে অনুপস্থিত থাকতে পারে না। একজন স্বৈরাচারী নিপীড়ক নিজের প্রয়োজনেই কিংবা তার প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ কারও প্রতি দয়া বা করুণা করলে তা দিয়ে কি তার মূল চরিত্রকে ভিন্নভাবে বিচার করা যায়? কোনও সর্বশ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসীই তো আর সবার বিরুদ্ধেই এক সঙ্গে সন্ত্রাস করতে পারে না। কারণ একদল অনুসারী ছাড়া তার সন্ত্রাসের শক্তিও ফুরিয়ে যায়। কাজেই ইসলামের আল্লাহ্‌ও তেমন এক সন্ত্রাসী ও অত্যাচারী স্বৈরাচারী যার খামখেয়ালের শিকার অধিকাংশই হলেও তার কিছু বাধ্য কিংবা একান্ত অনুগত দাসকে তা ইচ্ছামত তার করুণা বিতরণ করে।


আসলে জবরদস্ত ও স্বেচ্ছাচারী সত্তাই ইসলামের পছন্দ। তাই কুরআনে বারংবার আল্লাহ্‌র স্বেচ্ছাচার তথা যা খুশী তা-ই করার ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। কুর্‌আনের ছত্রে ছত্রে আল্লাহ্‌র যে স্বেচ্ছাচারী রূপ প্রকাশ পেয়েছে সেটা বোঝার জন্য আমরা এখানে তা থেকে অল্প কয়টি আয়াত বা আয়াতের অংশ উল্লেখ করতে পারি।


২৪৭। এবং তাহাদের নবী তাহাদিগকে বলিয়াছিল, ‘আল্লাহ্‌ তালূতকে তোমাদের রাজা করিয়াছেন’; তাহারা বলিল, ‘আমাদের উপর তাহার কর্তৃত্ব কিরূপে হইবে, যখন আমরা তাহা অপেক্ষা কর্তৃত্বের অধিক হকদার! এবং তাহাকে প্রচুর ঐশ্বর্য দেওয়া হয় নাই!’ নবী বলিল, ‘আল্লাহ্‌ই তাহাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করিয়াছেন এবং তিনি তাহাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করিয়াছেন।’ আল্লাহ্‌ যাহাকে ইচ্ছা স্বীয় কর্তৃত্ব দান করেন। আল্লাহ্‌ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাময়।

২ সূরা বাকারা


২৫৩। ......। আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করিলে তাহারা পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হইত না; কিন্তু আল্লাহ্‌ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন।

২ সূরা বাকারা


৮৮। . . .. . .. . .। আল্লাহ্‌ যাহাকে পথভ্রষ্ট করেন তোমরা কি তাহাকে সৎপথে পরিচালিত করিতে চাও? এবং আল্লাহ্‌ কাহাকেও পথভ্রষ্ট করিলে তুমি তাহার জন্য কখনও কোন পথ পাইবে না ।

৪ সূরা নিসা

১।. . . .। আল্লাহ্‌ যাহা ইচ্ছা আদেশ করেন।

সূরা মায়িদা


১৮। . . . .। যাহাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন; আসমান ও যমীনের এবং ইহাদের মধ্যে যাহা কিছু আছে তাহার সার্বভৌমত্ব আল্লাহ্‌রই আর প্রত্যাবর্তন তাহারই দিকে।

৫ সূরা মায়িদা


৪০। তুমি কি জান না যে, আসমান ও যমীনের সার্বভৌমত্ব আল্লাহ্‌রই; যাহাকে ইচ্ছা তিনি শাস্তি দেন এবং যাহাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করেন এবং আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ে শক্তিমান?

৫ সূরা মায়িদা


৩৯। যাহারা আমার আয়াতকে অস্বীকার করে তাহারা বধির ও মূক, অন্ধকারে রহিয়াছে; যাহাকে ইচ্ছা আল্লাহ্‌ বিপথগামী করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা তিনি সরল পথে স্থাপন করেন!

৬ সূরা আন্‌আম

২৭। . . . .। আল্লাহ্‌ যাহা ইচ্ছা তাহা করেন।

১৪ সূরা ইব্‌রাহীম


২১। তিনি যাহাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন এবং যাহার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। তোমরা তাঁহারই নিকট প্রত্যাবর্তিত হইবে।

২৯ সূরা আনকাবূত


বস্তুত যে কোনও নিরংকুশভাবে একত্ববাদী দর্শন বা চিন্তাই চরম স্বেচ্ছাচারী বা স্বৈরতান্ত্রিক হতে বাধ্য। কারণ একক সত্তার জন্য কোনও নিয়ম, নীতির দরকার হয় না। নিয়ম বা নীতি গড়ে ওঠে উভয় বা বহু সত্তার মধ্যে শৃঙ্খলা কিংবা ঐক্য রক্ষার প্রয়োজনে। কিন্তু যার কোনও প্রতিপক্ষ নাই, কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বা সহযোগী, ক্ষমতার ভাগী বা অংশীদার নাই তার নিয়ম-নীতিরও প্রয়োজন নাই। সুতরাং আল্লাহ্‌ নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্রী বা স্বেচ্ছাচারী হতে বাধ্য।


একেশ্বরবাদী আরও ধর্মমত বা দর্শন থাকলেও সেগুলির অধিকাংশের সঙ্গে ইসলামের এক পার্থক্য হল এই জায়গায় যে, ইসলামে স্রষ্টা সৃষ্টি করলেও সৃষ্টের মধ্যে তার ক্ষমতা দেয় নাই বরং সমস্ত ক্ষমতা তার নিজের কাছে একচেটিয়া বা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে এবং সৃষ্ট তার ইচ্ছা বা আদেশের দাস মাত্র। কুর্‌আনে সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হচ্ছে,


৫৬। আমার দাসত্বের জন্যই মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি।*

৫১ সূরা যারিয়াত


এছাড়া আরও বলা হয়েছে,


৯৩। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেহ নাই, যে দয়াময়ের নিকট উপস্থিত হইবে না বান্দারূপে (দাসরূপে)।**

১৯ সূরা মার্‌য়াম

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* কোরানসূত্র, অনুঃ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

প্রকাশকঃ বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রকাশঃ ১৯৮৪।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কৃত কুরআনের অনুবাদ “আল-কুরআনুল করীম”-এ এই আয়াতের অনুবাদ এই রকম করা হয়েছেঃ

“আমি সৃষ্টি করিয়াছি জিন এবং মানুষকে এই জন্য যে, তাহারা আমারই ইবাদত করিবে।”

ইবাদত শব্দটির উৎপত্তি আরবী আব্‌দ্‌ থেকে। আব্‌দ্‌ অর্থ দাস। সুতরাং ইবাদতের প্রকৃত অর্থ এখানে দাসত্ব হবে।


** আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

সৃষ্টি বা বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন নিরংকুশ ক্ষমতার অস্তিত্ব সম্পর্কে কল্পনা থেকে আল্লাহ্‌ সম্পর্কে এই ধারণা এসেছে তা একজন দাসমালিক আর সমস্ত সৃষ্টি বা বস্তুজগত তার ইচ্ছার দাস বা পুতুল মাত্র। এ থেকে ইসলামে ক্ষমতার যে কোনও ধরনের বিভক্তি বা বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রবণতা গড়ে উঠেছে এবং সব সময় সমস্ত ক্ষমতা এক বিন্দুতে বা হাতে কেন্দ্রীভূত রাখা হয়।


খ্রীষ্ট ধর্মে আমরা ঈশ্বরের হাতে ক্ষমতার নিরংকুশ কেন্দ্রীভবন দেখি না। যীশু খ্রীষ্ট ঈশ্বরের পুত্র। শুধু তা-ই নয়, ঈশ্বর স্বর্গ ও পৃথিবীর কর্তৃত্বও তার পুত্র যীশুকে অর্পণ করেছে। বাইবেলে বলা হচ্ছে,


“তখন যীশু নিকটে আসিয়া তাঁহাদের সহিত কথা কহিলেন, বলিলেন স্বর্গে ও পৃথিবীতে সমস্ত কর্তৃত্ব আমাকে দত্ত হইয়াছে।” (মথিলিখিত সুসমাচার। ২৮; ১৮। পবিত্র বাইবেল, পুরাতন ও নূতন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা)।


এর ফলে খ্রীষ্ট ধর্মে ঈশ্বরের ক্ষমতা অনেকটা নিয়মতান্ত্রিক রাজা বা রাষ্ট্র প্রধানের মত যার ক্ষমতা নীতিগতভাবে সর্বোচ্চ হলেও নির্বাহের ক্ষমতা যার হাতে সেভাবে থাকে না। প্রকৃতপক্ষে একেশ্বরবাদী হলেও খ্রীষ্টধর্মে বহু ঈশ্বরবাদের উপাদান আছে। কারণ ঈশ্বরের সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিভক্তি আছে। এই ধর্মে তাই ঈশ্বর ইসলামী কিংবা ইহুদী ধর্মের মত নিপীড়ক, সন্ত্রাসী ও স্বেচ্ছাচারী নয়। তার সঙ্গে যীশু তথা মানুষের সম্পর্ক প্রভু ও দাসের নয়। বরং পিতা ও পুত্রের। বাইবেলে বলা হচ্ছে,


“যীশু তাহাকে কহিলেন, আমাকে স্পর্শ করিও না, কেননা এখনও আমি ঊর্ধ্বে পিতার নিকটে যাই নাই; কিন্তু তুমি আমার ভ্রাতৃগণের কাছে গিয়া তাহাদিগকে বল, যিনি আমার পিতা ও তোমাদের পিতা এবং আমার ঈশ্বর ও তোমাদের ঈশ্বর, তাঁহার নিকটে আমি ঊর্ধ্বে যাই। (যোহন লিখিত সুসমাচার। ২০ ; ১৭)।


যেহেতু খ্রীষ্টের ঈশ্বর একজন যা খুশী তা-ই করতে পারা দাসমালিক মাত্র নয় বরং একজন পিতা সেই হেতু ঈশ্বর যে ক্ষমতার অধিকারী নীতিগতভাবে তার অনেক ক্ষমতাই মানুষের মধ্যেও থাকে এবং মানুষ ঈশ্বরের কাছে অনেক ক্ষমা ও করুণা কিংবা ন্যায়ের দাবীদার হতে পারে যেটা ইসলামী চিন্তায় অচিন্তনীয় ব্যাপার।


বৌদ্ধ ধর্মে অবশ্য ঈশ্বর চিন্তার গুরুত্ব নাই। সেখানে জন্মান্তর চক্র থেকে জীবাত্মা বা জীবনের মুক্তি লাভই মুখ্য বিষয়। সুতরাং বৌদ্ধ ধর্মে সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী কোনও অলৌকিক শক্তি আমরা পাই না। যদিও পরবর্তী কালে বুদ্ধকে ঐশী বা দৈব শক্তির মানবীয় রূপ হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে তথাপি এই ধর্মে দেবতা বা অলৌকিকতার উপর গুরুত্ব অনেক কম বরং এখানে বাস্তব জীবনকে শাসন ও পরিচালনার জন্য ধ্যান ও গুণের অনুশীলনের উপর বেশী জোর দেওয়া হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম মানবিক ঐক্য, প্রেম, করুণা, সংযম, সততা ইত্যাদি সুনীতির উপর জোর দিয়েছে। কিন্তু তার চিন্তায় নিরংকুশ একত্ববাদ বা এককেন্দ্রিকতা নাই। অবশ্য জীবন চক্র হতে আত্মার মুক্তি লাভ তথা নির্বাণের তত্ত্ব জীবনের সম্পূর্ণ বিলোপবাদী হওয়ায় তার মধ্যে একটা নিরংকুশতা বা একত্ব আছে। কিন্তু নির্বাণ লাভ সর্বাত্মক কোনও ব্যাপার নয়। এটা ব্যক্তির নিজস্ব কর্ম ও প্রয়াসের উপর নির্ভরশীল এবং ব্যক্তির ব্যক্তিগত ব্যাপার। সবচেয়ে বড় কথা বিশ্বজগতের উপর কোনও নিরংকুশ সত্তার স্বেচ্ছাচারী আধিপত্য ও কর্তৃত্বকে যেমন স্থাপন করা হয় নাই তেমন তার দ্বান্দ্বিকতার নিয়মকেও মেনে নেওয়া হয়েছে ‘সর্বং ক্ষণিকং’ বা “সবকিছু অস্থায়ী” - বুদ্ধের এই মত দ্বারা।


হিন্দু ধর্মে আমরা বহু ঈশ্বরবাদ বা বহু দেবতাবাদ যেমন পাই তেমন তার পাশে পাই একেশ্বরবাদী ধারণাও। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে বহু দেবতার উদ্দেশ্যে মন্ত্র রচনা করা হলেও সেখানে আমরা একেশ্বরবাদী চিন্তার প্রকাশও দেখতে পাই। যেমন ১/১৬৪/৪৬ সূক্তে ঋষি বলছেন, “এই আদিত্যকে মেধাবীগণ ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ ও মাতরিশ্বা বলে থাকেন।...... ইনি এক হলেও একে বহু বলে বর্ণনা করে। একে অগ্নি, যম ও মাতরিশ্বা বলে।”*

 

____________________________________________________________________________________________________________________


* ঋগ্বেদ সংহিতা (প্রথম খণ্ড); রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে। প্রকাশকঃ হরফ প্রকাশনী।

এ - ১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলকাতা-৭। দ্বিতীয় প্রকাশঃ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭

____________________________________________________________________________________________________________________

 

বেদের ঋষি প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে দৈবশক্তি হিসাবে কল্পনা করায় যেমন বিভিন্ন দেবতার কল্পনা করেছেন তেমন প্রকৃতির বিভিন্ন কর্ম ও শক্তির মধ্যে বৈচিত্র্য ও অনৈক্যের পাশে যে ছন্দ ও ঐক্য আছে সেটাকে দেখেছেন বিভিন্ন দৈবশক্তির মধ্যে এক অখণ্ড দৈবশক্তির প্রকাশ হিসাবে। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলের পঞ্চান্ন সূক্তে সর্বমোট বাইশটি ঋক আছে। প্রত্যেক ঋকের শেষে এই কথা আছে, “মহদ্দেবানাম সুরত্বমেকম্‌।” এর বাংলা অর্থ হচ্ছে “দেবগণের মহৎ বল এক।”


অবশ্য ঋগ্বেদে আমরা দুই ধরনের ঈশ্বর চিন্তার বীজ পাই। একটি সর্বেশ্বরবাদ, অপরটি একেশ্বরবাদ। সর্বেশ্বরবাদের মূল কথা হল, ঈশ্বর বা মহাশক্তি সমস্ত বিশ্বের সমস্ত বস্তুর মধ্যে ব্যাপ্ত। এই শক্তি সকল বস্তু, জীব ও মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থেকে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সর্বব্যাপ্ত, সবকিছুতে অবস্থিত একক শক্তিকে ঋগ্বেদ পরবর্তী উপনিষদে ব্রহ্ম বা ভূমা বলা হয়েছে। এই মতবাদ ব্রহ্মবাদ হিসাবে পরিচিত। এটা ঋগবেদ পরবর্তী কালে রচিত উপনিষদে বিকশিত রূপ নেয়।


অন্যদিকে, একেশ্বরবাদ সম্পর্কে পরবর্তী কালে যে বিশেষ ভারতীয় ধারণা বিকাশ লাভ করে তার বীজও আমরা পাই ঋগ্বেদে। প্রজাপতি সূক্তে (১০।১২১) এবং বিশ্বকর্মা সূক্তে (১০।৮২) একেশ্বরবাদের প্রকাশ ঘটেছে। একেশ্বরবাদের বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণগুলি এখানে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে এইরূপ ধারণা করা হয়েছে যে, ঈশ্বর বিশ্বের স্রষ্টা এবং নিয়ন্ত্রক, তা বিশ্ব হতে পৃথকভাবে অবস্থান করে এবং ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট।


উপনিষদ পরবর্তী কালে বিশেষত পুরাণের যুগে এই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট একেশ্বরবাদী চিন্তা বিকাশ লাভ করে এবং এটাই একসময় মধ্যযুগে এসে ভক্তিবাদের ঈশ্বরে পরিণত হয়।


হিন্দু ধর্ম ও দর্শনের একেশ্বরবাদের সঙ্গে ইসলামের একেশ্বরবাদের তত্ত্বগত কিছু মিল থাকলেও উভয়ের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। বিশেষত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর চিন্তা নিয়ে সর্বদাই বিভিন্ন মত ও বিতর্কের সুযোগ থেকেছে এবং দর্শন চিন্তায় যা-ই বলা হোক সাধারণ মানুষ যার যেমন খুশী সেভাবে ধর্মচর্চা করেছে, ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির প্রকাশ হিসাবে বিভিন্ন দেবতার কল্পনা করে নিয়ে তাদের প্রতিমা পূজা করেছে। এর একটি প্রধান কারণ হল বেদসহ কোনও হিন্দু শাস্ত্রই একজনের লেখা নয়। আসলে বিভিন্ন মত ও তত্ত্বের এক সমাহার ঘটেছে হিন্দু ধর্ম ও দর্শনে যেখানে বেদ, ব্রাহ্মণ ও বর্ণজাতি প্রথার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক বৃহত্তর সমাজ কাঠামোর মধ্যে এই সবগুলোকেই ধারণ করা হয়েছে।


বহু ত্রুটি, দুর্বলতা ও স্ববিরোধ সত্ত্বেও হিন্দু ধর্মে দর্শন ও বিতর্কের যে ভূমিকা ও গুরুত্ব আছে ইসলামে তেমন কিছুর অস্তিত্বই সম্ভব নয়। কারণ কুরআন ও হাদীসে যা বলা হয়েছে সেটাকেই চূড়ান্ত সত্য বলে মানতে হবে। তাতে অসঙ্গতি থাকলেও সেগুলো ধরা বা বলা যাবে না। বরং কুরআন-হাদীসের কথাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে তার সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করতে হবে। এবং সেক্ষেত্রেও যেসব যুক্তি কিংবা বক্তব্য বিতর্ক সৃষ্টি করবে সেগুলোকে নিষিদ্ধ করা হবে। বস্তুত ইসলামে আল্লাহ্‌কে নিয়ে যুক্তি রচনা করতেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মূল কাজ হল তাকে মেনে চলা, তার কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে কুর্‌আন। সুতরাং যুক্তি-তর্কের কোনও অবকাশ নাই।


উন্নত দর্শন চিন্তার স্থান তাই ইসলামে নাই। কিংবা নাই অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে ভাববার উপায়ও। তাই এই প্রশ্ন তোলারও উপায় নাই যে, যদি স্রষ্টা সকল সৃষ্টির একমাত্র উৎস হয় তবে তা নিজেকে কীভাবে সৃষ্ট যেকে পৃথক রাখে? তার শক্তি ও গুণ কি সৃষ্টের মধ্যেও সঞ্চারিত হয় না? কিংবা এই প্রশ্নও তোলার উপায় নাই যে, স্রষ্টা যদি সৃষ্ট থেকে পৃথক হয় তাহলে স্রষ্টা কীভাবে সমস্ত সৃষ্টির একক উৎস হয়? সেক্ষেত্রে তো স্রষ্টার হস্তক্ষেপের পূর্ব থেকে বস্তুর অস্তিত্ব থেকে যায়। প্রাচীন ভারতীয় ষড়দর্শনে ঈশ্বর ও বস্তুজগতের স্বরূপ সন্ধানে এই ধরনের অনেক বিতর্ক ও যুক্তি দেখতে পাই যা ইসলামে অচিন্তনীয়।


ইসলামে আল্লাহ্‌ সর্বব্যাপী এবং সবকিছুর স্রষ্টা বা উৎস হলেও বস্তুজগত থেকে তা পৃথক এক সত্তা। অর্থাৎ তা একই সঙ্গে সৃষ্টের মধ্যে এবং সৃষ্ট থেকে পৃথক বা বাইরে। তাই তা সর্বব্যাপী ও সবকিছুর স্রষ্টা হলেও সাত আকাশের উপর তার আসন বা শাসন কেন্দ্র অবস্থিত। এই আসন বা শাসন কেন্দ্র থেকে তা সমস্ত বস্তুজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে।


১১৫।......। আল্লাহ্‌ সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ।

২ সূরা বাকারা

 

৫। দয়াময় আর্‌শে (সিংহাসনে) সমাসীন।

২০ সূরা তাহা


এবং

২৬। .....। সকলেই তাঁহার আজ্ঞাবহ।

৩০ সূরা রূম


সর্বব্যাপী আল্লাহ্‌র স্বতন্ত্র সিংহাসন বা আসন কল্পনা, সমস্ত বস্তুর একমাত্র স্রষ্টা হলেও বস্তু থেকে তার পৃথক অস্তিত্ব এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টের মধ্যে মালিক-দাস সম্পর্ক এবং সৃষ্ট বা বস্তুর নিজস্ব সত্তার অভাব বা শক্তিহীনতা ইত্যাদি বক্তব্যে কল্পনার উদ্দামতা থাকতে পারে কিন্তু যুক্তির তীক্ষ্মতা ও গভীর তত্ত্ব জিজ্ঞাসার চিহ্ন মাত্র নাই। আসলে আল্লাহ্‌ একজন কঠোর শাসক সে যা খুশী তা-ই করতে পারে অর্থাৎ স্বেচ্ছাচারী। সুতরাং মুহাম্মদ যেটা করেছেন সেটা হ’ল আল্লাহ্‌র নামে এক কঠোর অদৃশ্য শাসকের কল্পনা নির্মাণ করে মানুষকে শাসনের জন্য একটা ধর্মীয় শাসনতন্ত্র নির্মাণ করা, যে শাসনতন্ত্র ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের সমস্ত বিষয় প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তির তীক্ষ্মতার কী প্রয়োজন যদি থাকে তলোয়ারের তীক্ষ্মতা?


ইসলামের ইতিহাসে আমরা ভক্তিবাদ হিসাবে যে উদারনৈতিক সুফীবাদকে দেখি যা আল্লাহ্‌কে প্রেমময় হিসাবে দেখে এবং আল্লাহ্‌কে পাবার কিংবা আল্লাহ্‌র মধ্যে মানুষের বিলীনতার কামনা করে এবং সেই লক্ষ্যে উপাসনা করে তা প্রকৃতপক্ষে মৌলিক ইসলামের পরিপন্থী। কারণ কুরআন-হাদীস মানুষকে আল্লাহ্‌র চিরন্তন দাসত্বে নিক্ষেপ করেছে। মৃতুøর পর মানুষ আল্লাহ্‌য় বিলীন হবে না কিংবা তার উৎসে ফিরে গিয়ে তার অংশ হবে না। তার বদলে আছে স্বর্গ অথবা নরক যেখানে আল্লাহ্‌র বিচার বা ইচ্ছা অনুযায়ী আল্লাহ্‌র দাস মানুষ অনন্ত কাল সুখ অথবা কষ্ট ভোগ করবে। তবে পরিণতি যা-ই হোক তার কপালের দাসত্ব ঘুচবে না। নরকের দাসরা শুধু কষ্টই করবে আর স্বর্গের দাসরা বিবিধ সুখ ভোগ ও আমোদ-ফূর্তির সঙ্গে আল্লাহ্‌র দাসত্ব করবে।


যাইহোক, সুফীবাদ ইসলামের কঠোরতার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিদ্রোহ হলেও শাস্ত্রানুগ মোল্লা ও শাসকেরা অনেক স্থানে একে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। যে সব দেশে গায়ের জোরে ব্যাপক মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করা সম্ভব হয় নাই সেসব অনেক দেশে ইসলাম প্রচারে সুফীদের ভূমিকা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন ধর্ম থেকে ইসলামে প্রবেশের ক্ষেত্রে সুফীবাদ এক ধরনের সেতু হিসাবে কাজ করেছে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে সুফীদের উপর রক্ষণশীল শাসক ও মোল্লারা অত্যাচারও করেছে। ইরানের প্রসিদ্ধ সুফী সাধক মনসুর হাল্লাজ “আনাল হক” বা ‘আমি সত্য’ তথা “আমি ঈশ্বর” এ কথা বলায় তাঁকে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। তবু সুফীবাদকে দমন করা যায় নাই। বিশেষত আরব দেশগুলোর বাইরে ইসলামী সমাজে সুফীদের একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়ে গেছে।


কিন্তু সুফীবাদ ইসলামী শাস্ত্র বা কুর্‌আন-হাদীসের পাল্টা কিছু দেয় নাই বা দিতে পারে নাই। ইসলামী কাঠামোর ভিতরে থেকে সেটা করা অসম্ভব ব্যাপার। তাই তা কুরআন বা আল্লাহ্‌র যত নমনীয় ব্যাখ্যাই দেবার চেষ্টা করুক এবং তা আল্লাহকে যত প্রেমময় রূপেই দেখতে চেষ্টা করুক ইসলামের আল্লাহ্‌ তার সামান্যতম ক্ষমতাও হাত ছাড়া করতে রাজী হয় নাই। কাজেই আল্লাহ্‌র সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক পুত্র কিংবা বন্ধুর না হয়ে দাসেরই হয়ে থেকেছে। এরই সামাজিক বা বাস্তব প্রতিফলন হল সমাজ শাসকের সর্বময় কর্তৃত্ব ও স্বেচ্ছাচার এবং শাসিত জনগণের নিরুপায় দাসত্ব। অবশ্য সমাজ শাসকও প্রকৃত স্বাধীন ব্যক্তি নয়। তাকে মানতে হয় কুরআন-হাদীস। ইসলামের মূল নীতিমালা ও রীতির প্রতি স্বীকৃতি দিয়ে শাসক যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। কুরআন-হাদীসের বিধি-বিধান স্বাধীন মানুষ হিসাবে তারও সকল অধিকার বা ব্যক্তিত্ব কেড়ে নেয়। সুতরাং সবাই যেখানে দাস সেই রকম এক দাস সমাজের এই অধিপতি জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাবার সকল সুযোগ ও সম্ভাবনা হারিয়ে স্বেচ্ছাচারের অবাধ ও বিকৃত পথেই তার সকল ক্ষমতা চালিত করে।


এই রকম এক সমাজের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা ও শাসক হলেন মুহাম্মদ নিজে। আল্লাহ্‌ তো মানুষেরই সৃষ্টি। কাজেই এটা মুহাম্মদের মানস সৃষ্টি। মুহাম্মদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল এই রকম এক সন্ত্রাসী ও স্বেচ্ছাচারী মহাশক্তিমান অলৌকিক সত্তার কল্পনা এবং তার সর্বশ্রেষ্ঠ দাস প্রতিনিধি স্বরূপ তাঁর নিজেকে। এইভাবে আল্লাহ্‌র নিরংকুশ একত্ব ও স্বৈরতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা দ্বারা মুহাম্মদ যেটা করেছেন সেটা হল সমগ্র সমাজকে এক নিরংকুশ ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকের অধীনস্থ ও অনুগত হবার উপযুক্ত করা। বাস্তবে তিনিই হলেন কল্পনার আল্লাহ্‌র বাস্তব প্রতিনিধি ও মানবিক রূপ হিসাবে নিরংকুশ ও স্বৈরতান্ত্রিক এক শাসক যিনি মক্কা থেকে মদীনায় গমন করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি যুদ্ধবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক ইসলামী রাষ্ট্র।

 

 

 


তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ স্বৈরতন্ত্র ইসলামের এক অনিবার্যতা
 

অনেকে ইসলামে গণতন্ত্র দেখতে পান। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামে কোনও দিনই গণতন্ত্র ছিল না বা নাই। সেখানে এক ধরনের অনাড়ম্বর, আদিম ও কঠোর জীবনের চর্চা থাকতে পারে কিন্তু তার সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনও সম্পর্ক নাই। ইসলাম পা হ’তে মাথা পর্যন্ত একনায়কী। সমস্তবিশ্বের অলৌকিক স্বেচ্ছাচারী একনায়ক আল্লাহ্‌ যা খুশী তা-ই করে। আর এই অলৌকিক একনায়কের লৌকিক বা বাস্তব প্রতিনিধি হলেন মুহাম্মদ যিনি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দ্বারা আল্লাহ্‌র নামে নিজের একনায়কী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এই ইসলামী রাষ্ট্রের সংবিধান ছিল কুরআন ও হাদীস। অর্থাৎ মুহাম্মদের কথা, ইচ্ছা ও কাজ। আল্লাহ্‌র ধর্ম ইসলামের নাম দিয়ে মুহাম্মদ প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর ধর্ম বা মুহাম্মদবাদ এবং এই মুহাম্মদবাদের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র ও সমাজ, যার সংবিধানকার বা আইন প্রণেতা, রীতিনীতি প্রণেতা, পরিচালক ও একচ্ছত্র শাসক ছিলেন তিনিই।


মুহাম্মদের মৃতুøর পর চার খলীফার সময়কার খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ যেটাকে বলা হয় সেটাতেও গণতন্ত্রের তেমন কিছু ছিল না। এটাকে আমরা বড় জোর মক্কা-মদীনার মুসলমানদের জন্য জনপ্রিয় একনায়কতন্ত্র বলতে পারি। কিংবা এটা ছিল একজন একনায়কের নেতৃত্বে কুরাইশ অভিজাতদের গোষ্ঠীগত শাসন।


মুহাম্মদের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ ফেলে রেখে উমর যেভাবে আবু বকরকে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম খলীফা নির্বাচিত করেন তার মধ্যে ষড়যন্ত্র ও চাতুরী থাকতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক নীতি বা নিয়ম ছিল না। আবু বকর মৃত্যুর পূর্বে উমরকে পরবর্তী খলীফা হিসাবে মনোনীত করে যান। সুতরাং এটা ছিল সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ঘটনা। উমরের পর উসমান যে পদ্ধতিতে খলীফা হন সেটাও কতটা গণতন্ত্রসিদ্ধ এ প্রশ্ন তোলা যায়। কারণ উমর যে ছয়জনকে মনোনয়ন দিয়ে যান তাঁদের দ্বারাই খলীফা নির্বাচনের কথা ছিল। আসলে এই সকল খলীফা মনোনয়নে মুহাম্মদের আপন চাচাত ভাই ও জামাতা আলী এবং মদীনাবাসীদেরকে খলীফা পদ থেকে বাইরে রাখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।


মুহাম্মদ নিরংকুশ একনায়ক হিসাবে দেশ শাসন করে গেছেন এবং মৃত্যুর পূর্বে ক্ষমতা হস্তান্তর কিংবা ক্ষমতায় আরোহণের কোনও পদ্ধতি ঠিক করে দিয়ে যান নাই। গ্রীস বা রোমে যে ধরনের গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি ইতিপূর্বে চালু ছিল তেমন একটা পদ্ধতিও তিনি দিতে পারেন নাই। এর ফলে তার মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবে দেখা দেয় খলীফা বা শাসনকর্তার পদ দখলে সহিংসতার সম্ভাবনা ও ষড়যন্ত্র।


খলীফা পদে যেমন নির্বাচনের কোনও পদ্ধতি ছিল না তেমন তার কোনও মেয়াদও ছিল না। একবার খলীফা হলে তাকে অপসারণের কোনও পদ্ধতি ছিল না। এমতাবস্থায় আবু বকর ছাড়া আর তিন তথাকথিত নির্বাচিত খলীফাই হত্যাকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ দেন।


বস্তুত ঊনত্রিশ বৎসরের খোলাফায়ে রাশেদীন ছিল মুহাম্মদের প্রধান অনুসারী ও সহকর্মীদের সম্মতির ভিত্তিতে মনোনীত নির্বাচিত মুষ্টিমেয় কুরাইশ অভিজাতদের স্বৈরতন্ত্র। সমকালীন কিংবা পূর্ববর্তী আরব উপজাতীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্যের প্রভাবে খলীফাপদ প্রথমেই বংশগত হতে পারে নাই। অর্থাৎ খোলাফায়ে রাশেদীনের ভিত্তি ইসলামের ভিতরে নয় বরং পূর্ববর্তী পৌত্তলিক আরব উপজাতীয় ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে। ইসলামী ব্যবস্থার প্রসার ও সংহতি সাধনের সঙ্গে এই উপজাতীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যেরও বিনাশ ঘটেছে এবং ইসলামের জন্য যেটা স্বাভাবিক সেটাই হয়েছে। সমাজ সদস্যদের সম্মতি বা নির্বাচন নয়, বরং সবচেয়ে সবল ও ধূর্তের বলপ্রয়োগের ক্ষমতাই শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ শাসকের পদে মনোনয়নের অনিশ্চয়তা দূর করেছে। অন্যতম সমর নায়ক মোয়াবিয়া খলীফা পদ দখল করে বংশগত রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন। শাসক নির্বাচনের অনিশ্চয়তা দূর করা এবং সামাজিক-রাষ্ট্রিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনেই বংশগত রাজতন্ত্র অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়।


তবে এক্ষেত্রেও ইসলাম ইউরোপের মত কোনও প্রথা গড়তে পারে নাই যেখানে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী রাজার প্রথম পুত্র সিংহাসনের একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী হওয়ায় সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে হানাহানির তেমন কোনও সুযোগ থাকে নাই।


আসলে এটা সম্ভব এমন এক সমাজে যেখানে সমস্ত ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত নয়। কাজেই যে ব্যক্তি সমাজ বা রাষ্ট্রের শাসক হবে তাকে যে সর্বদা দক্ষ যোদ্ধা বা সমর নেতা হতে হবে এমন কোনও কথা নাই। যুদ্ধের জন্য সেনাপতি বা সামন্তরাই যথেষ্ট, যেহেতু যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারে।


কিন্তু ইসলামী সমাজে যেখানে গোটা ব্যবস্থা যুদ্ধ, একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে ক্ষমতা বিভাগের কোনও পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে না বলে সাধারণ নিয়মে রাষ্ট্র শাসককে অবশ্যই দক্ষ ও কঠোর যোদ্ধা হত হবে। সমস্ত ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এবং যুদ্ধের উপর সমাজ দাঁড়িয়ে থাকায় শেষ পর্যন্ত শাসক হবার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হয়ে দেখা দেয় সামরিক যোগ্যতা। কাজেই আলীর মৃত্যুর পর মোয়াবিয়ার নেতৃত্বে উমাইয়া রাজবংশ ও পরবর্তীতে উমাইয়াদের উৎখাত করে আব্বাসীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েও উত্তরাধিকারী মনোনয়নের কোনও নির্দিষ্ট প্রথা গড়ে উঠতে পারে নাই। কখনও খলীফা তার পুত্রদের মধ্য থেকে পছন্দনীয় একজনকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যেত আবার কখনও খলীফার মৃত্যুর পর ভাইদের কিংবা একই বংশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে লড়াইয়ের মাধ্যমে শাসক নির্ধারিত হত। অর্থাৎ ইসলামে শাসক নির্বাচনের প্রধান শক্তি তলোয়ার এবং শাসক হবার প্রধান যোগ্যতা তলোয়ার চালনার দক্ষতা।


প্রকৃতপক্ষে ইসলাম গণতন্ত্র দিতে পারে না। কারণ গণতন্ত্রের জন্য ভিন্ন মত ও বিশ্বাসের প্রতি যে সহিষ্ণুতা ও ধৈর্য এবং যে ধরণের সৃজনশীল সামাজিক অনুশীলন দরকার সেসবের কিছুই ইসলামে নাই। ইসলামে আল্লাহ্‌র একত্ব ও ধর্মের রীতিনীতির নামে সবকিছুকে তৈরী করা হয় এক ছাঁচে। এখানে ভিন্নতাই হল শয়তানী।


মুহাম্মদ মানুষকে গড়তে চেয়েছেন আল্লাহ্‌র ছাঁচে। কারণ আল্লাহ্‌ তাঁর আদর্শ। তাই তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ্‌র প্রকৃতির বা চরিত্রের অনুসরণ করতে। কুরআনে বলা হচ্ছে,


২৯। বস্তুত সীমালংঘনকারীগণ অজ্ঞানতাবশত তাহাদিগের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করিয়া থাকে; সুতরাং আল্লাহ্‌ যাহাকে পথভ্রষ্ট করিয়াছেন, কে তাহাকে সৎপথে পরিচালিত করিবে? তাহাদিগের কোন সাহায্যকারী নাই।


৩০। তুমি একনিষ্ঠ হইয়া নিজকে দীনে প্রতিষ্ঠিত কর। আল্লাহ্‌র প্রকৃতির অনুসরণ কর, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করিয়াছেন; আল্লাহ্‌র সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নাই। ইহাই সরল দীন (ধর্ম); কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।

৩০ সূরা রূম


শুধু যে আল্লাহ্‌্‌কে ভয় ক’রে এবং তার তার হুকুম মেনে চলতে হবে তা-ই নয়, উপরন্তু আল্লাহ্‌র আদর্শে নিজেকে গড়তে হবে। আল্লাহ্‌র প্রকৃতি সম্পর্কে মুহাম্মদ যে ধারণা তৈরী করেছিলেন সেইটিকেই তিনি বলেছেন শ্রেষ্ঠ আদর্শ। তাই মুহাম্মদ কুরআনের ৩০ নম্বর সূরা রূমের ৩০ নম্বর আয়াতে মানুষকে আল্লাহ্‌র প্রকৃতি অনুসরণ করতে বলেছেন।


এখন প্রশ্ন, আল্লাহ্‌র প্রকৃতি কী? সেটাও তো আমরা কুরআনের ছত্রে ছত্রে পেয়েছি। এক চরম স্বেচ্ছাচারীর চরম স্বেচ্ছাচার। এমন কি তা এই একই সূরায় ২৯ নম্বর আয়াতেও প্রকাশ পেয়েছে যখন বলা হয়, “সুতরাং আল্লাহ্‌ যাহাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করিয়াছেন।” কুরআনে অবশ্য এই মূল কথাটা নানানভাবে বহুবার বলা হয়েছে যার সহজ অর্থ হলঃ ভাল অথবা মন্দ হওয়া, আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুসরণ করা অথবা না করা মানুষের ইচ্ছাধীন নয়। এটাও খোদ আল্লাহ্‌রই ইচ্ছাধীন। যেমন,


১৭৮। আল্লাহ্‌ যাহাকে পথ দেখান সেই পথ পায় এবং যাহাদিগকে তিনি বিপথগামী করেন তাহারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

৭ সূরা আরাফ


১৮৬। আল্লাহ্‌ যাহাদিগকে বিপথগামী করেন তাহাদিগের কোন পথ প্রদর্শক নাই, আর তাহাদিগকে তিনি তাহাদিগের অবাধ্যতায় উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়াইতে দেন।

৭ সূরা আরাফ


৩৭। তুমি ইহাদিগের পথ-প্রদর্শন করিতে আগ্রহী হইলেও আল্লাহ্‌ যাহাকে বিভ্রান্ত করিয়াছেন, তাহাকে তিনি সৎপথে পরিচালিত করিবেন না এবং উহাদিগের কোন সাহায্যকারীও নাই।

১৬ সূরা নাহ্‌ল


৯৩। ইচ্ছা করিলে আল্লাহ্‌ তোমাদিগকে এক জাতি করিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি যাহাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। তোমরা যাহা কর সে-বিষয়ে অবশ্যই তোমাদিগকে প্রশ্ন করা হইবে।

১৬ সূরা নাহ্‌ল

ইত্যাদি।


কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, মানুষ স্বৈরাচারী আল্লাহ্‌র পুতুলমাত্র যার নিজস্ব কোনও ইচ্ছা বা স্বাধীনতাই নাই। তবু তার বিচার আছে, পুরস্কার ও শাস্তি আছে। আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্য তবে কী? কেন মানুষকে ইচ্ছা করে শাস্তির পথে ঠেলে দেওয়া? এর উদ্দেশ্য সম্পর্কেও অবশ্য কুরআনে বলা হয়েছে,


১৩। আমি ইচ্ছা করিলে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সৎপথে পরিচালিত করিতাম; কিন্তু আমার এই কথা অবশ্যই সত্যঃ আমি নিশ্চায়ই জিন ও মানুষ উভয় দ্বারা জাহান্নাম (নরক) পূর্ণ করিব।

৩২ সূরা সাজদা


এখন স্বভাবতই প্রশ্ন তোলা যায়, আল্লাহ্‌র এই প্রকৃতি বা স্বভাবে আছে কোন্‌ যুক্তি বা সঙ্গতি অথবা ন্যায়-নীতিবোধ? আল্লাহ্‌র প্রকৃতিই যদি এমন এক স্বেচ্ছাচারী ও বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন পীড়নবাদী বা ধর্ষকামীর হয় তবে এই আল্লাহ্‌র প্রকৃতি অনুসরণে মানুষ কোন্‌ চরিত্র অর্জন করতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এই রকম এক ধর্মের শিক্ষায় ও শাসনে তাই সবাই যেমন আল্লাহ্‌র ভয়ে হবে সন্ত্রস্ত ও ভয় কাতর তেমন একই সঙ্গে হবে সন্ত্রাসী ও ভয় প্রদর্শক। এই সন্ত্রাস ও ভয় প্রদর্শন চালিত হবে উচ্চতম স্তর থেকে নিম্নতম স্তর পর্যন্ত স্তরে স্তরে। সর্বোচ্চ শাসক হবে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী ও স্বেচ্ছাচারী যার সন্ত্রাস ও স্বেচ্ছাচার চলবে তার অধীনস্থ সমস্ত সমাজের উপর। আবার তার নীচেই যে থাকবে সেও একইভাবে সন্ত্রাস, স্বেচ্ছাচার ও পীড়নকে চালিত করবে তার অধীনস্থদের উপর। এইভাবে গোটা ব্যবস্থাটা হয়ে উঠে সন্ত্রাস, পীড়ন ও ভয় সৃষ্টি দ্বারা প্রতিটি মানুষকে অধীনস্থ ও শৃংখলাবদ্ধ ক’রে রাখার এক ভয়ংকর যন্ত্র। এটা এমন এক ভয়ংকর পীড়ন ও স্বৈরতন্ত্রের যন্ত্র যা আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয় ও পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে অবিশ্বাস্য পীড়নকেও সহনীয় করে তোলে।


সঙ্গত কারণেই এই ধর্মের একটি বড় আবেদন হল আল্লাহ্‌কে ভয় করার। আল্লাহ্‌ ভালবাসার কথা শুনতে পছন্দ করে না। ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ কুরআনে আল্লাহ্‌কে ভয় করার উপর অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা এখানে সামান্য কয়েকটি উদ্ধৃতি দিচ্ছিঃ


১৯৭। . . . .। হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ! তোমরা আমাকে ভয় কর।

২ সূরা বাকারা


১০২। হে মুমিনগণ (বিশ্বাসীগণ)! তোমরা আল্লাহ্‌কে যথার্থভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী না হইয়া কোন অবস্থায় মরিও না।

৩ সূরা আল ইমরান


২। . . . . . .। আল্লাহ্‌কে ভয় করিবে, আল্লাহ্‌ শাস্তি দানে কঠোর।

৫ সূরা মায়িদা


১১। . . . . . . . .; এবং আল্লাহকে ভয় কর আর আল্লাহ্‌রই প্রতি মুমিনগণ নির্ভর করুক।

৫ সূরা মায়িদা


১০০। বল, ‘মন্দ ও ভাল এক নহে যদিও মন্দের আধিক্য তোমাকে চমৎকৃত করে। সুতরাং হে বোধশক্তি-সম্পন্নেরা! আল্লাহ্‌কে ভয় কর - যাহাতে তোমরা সফলকাম হইতে পার।’

৫ সূরা মায়িদা


৫৭। যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালকের (আল্লাহ্‌র) ভয়ে সন্ত্রস্ত,


৫৮। যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলীতে ঈমান (বিশ্বাস) আনে,


৫৯। যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালকের সহিত শরীক (অংশী) করে না,


৬০। এবং যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করিবে এই বিশ্বাসে তাহাদিগের যাহা দান করিবার তাহা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে,


৬১। তাহারাই দ্রুত সম্পাদন করে কল্যাণকর কাজ এবং তাহারা উহাতে অগ্রগামী হয়।

২৩ সূরা মুমিনূন


১১। তুমি কেবল তাহাদিগকেই সতর্ক করিতে পার যাহারা উপদেশ মানিয়া চলে এবং না দেখিয়া দয়াময় আল্লাহ্‌কে ভয় করে। অতএব তাহাদিগকে তুমি ক্ষমা ও মহা-পুরস্কারের সংবাদ দাও।

৩৬ সূরা য়াসীন


২৩। আল্লাহ অবতীর্ণ করিয়াছেন উত্তম বাণীসম্বলিত কিতাব (কুর্‌আন) যাহা সুসমঞ্জস এবং যাহা পুনঃ পুনঃ আবৃত্তি করা হয়। ইহাতে, যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালকের ভয় করে, তাহাদিগের গাত্র রোমাঞ্চিত হয়, অতঃপর তাহাদিগের দেহ-মন প্রশান্ত হইয়া আল্লাহ্‌র স্মরণে ঝঁুকিয়া পড়ে; ইহাই আল্লাহ্‌র পথনির্দেশ, তিনি যাহাকে ইচ্ছা উহা দ্বারা পথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ্‌ যাহাকে বিভ্রান্ত করেন তাহার কোন পথ প্রদর্শক নাই।

৩৯ সূরা যুমার


৭৩। যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালককে ভয় করিত তাহাদিগকে দলে দলে জান্নাতের (স্বর্গের) দিকে লইয়া যাওয়া হইবে।. . . . . .

৩৯ সূরা যুমার


৩৩। যাহারা না দেখিয়া দয়াময় আল্লাহ্‌কে ভয় করে এবং বিনীতচিত্তে উপস্থিত হয় -


৩৪। তাহাদিগকে বলা হইবে, ‘শান্তির সহিত তোমরা উহাতে (স্বর্গে) প্রবেশ কর; ইহা অনন্ত জীবনের দিন।’

৫০ সূরা কাফ্‌


এইভাবে আল্লাহ্‌র ভয় দেখিয়ে মানুষের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাশক্তি ও আত্মমর্যাদাবোধ বিনষ্ট করে মুহাম্মদ প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর সর্বাত্মক দাস সমাজ যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্র। আল্লাহ্‌র নামে এই শাসক সর্বময় বাস্তব ক্ষমতা হস্তগত করে নিয়েছেন। সুতরাং কুরআন বলছে,


৫২। যাহারা আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের (মুহাম্মদের) আনুগত্য করে, আল্লাহ্‌কে ভয় করে ও তাঁহার অবাধ্যতা হইতে সাবধান থাকে তাহারাই সফলকাম।

২৪ সূরা নূর


১। হে মুমিনগণ। আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের সমক্ষে তোমরা কোন বিষয়ে অগ্রণী হইও না এবং আল্লাহ্‌কে ভয় করঃ আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।

৪৯ সূরা হুজুরাত


ইসলামের সর্বাত্মক অভিযান ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তির অধিকারের বিরুদ্ধে। আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পণের নামে তা নিরংকুশভাবে একনায়কী ক্ষমতার অধিকারী সমাজ ও রাষ্ট্র শাসকের কাছে ব্যক্তিকে নতজানু করেছে। স্বাভাবিকভাবে, মুহাম্মদ যে চরম ও নিরংকুশ এককেন্দ্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তারই ধারাবাহিক রূপ পরবর্তীকালের সকল ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র। আর সব নিরংকুশ স্বেচ্ছাতন্ত্রীর মত মুহাম্মদও ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতায় অকল্যাণ ও বিশৃংখলা ছাড়া কিছু দেখতে পান নাই। নিরংকুশ স্বেচ্ছাতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র অনিবার্যভাবে একের শাসন। আর ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা যেখানে কম-বেশী রক্ষা পায় সেই গণতন্ত্র হ’ল মূলত দুই বা বহুর শাসন। গণতন্ত্রে যদিও রাষ্ট্র শাসনে একজন প্রধান ভূমিকা পালন করে তথাপি তার পাশেই থাকে বিকল্প শাসক কিংবা তার শাসনকে নিয়ন্ত্রণ করার মত ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। সমাজে বিভিন্ন শাসক ব্যক্তি ও শক্তির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও ঐক্যের প্রক্রিয়ায় শাসন ব্যবস্থায় এমন একটি ছন্দ বা নিয়ম গড়ে উঠে যা কোনও ব্যক্তিকেই যেমন সমাজে নিরংকুশ বা একমাত্র নির্ধারক হ’তে দেয় না তেমন সমাজে রক্ষা করে বহু সংখ্যক ব্যক্তির স্বাধীনতা। এই রকম সমাজে যেহেতু একজনই মাত্র সমাজে নিরংকুশ শাসক বা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয় না এবং সমাজে থাকে একাধিক শাসক ও শাসন কেন্দ্র সেহেতু একাধিক শাসক ও শাসন কেন্দ্রর মধ্যকার বৈধ ও প্রকাশ্য পার্থক্য কিংবা দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে সমাজের নিম্নতর স্তরের জনগণ নিজেদের অনেক অধিকার অর্জন করতে পারে।


এর ফলে অবশ্য সমাজে অসন্তোষ বা নূতন চিন্তার আলোড়ন চাপা থাকে না। কাজেই সমাজ যতই সুশৃংখল হোক একটা বিশৃংখলা দৃশ্যমান হয়, যা স্বৈরতন্ত্রে সাধারণত থাকে চাপা বা গোপন। যারা জবরদস্ত শৃংখলা এবং শাসন পছন্দ করে তারা পছন্দ করে এমন স্বৈরতন্ত্রই। অবশ্য স্বৈরতন্ত্রে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ যে লোপ পায় তা নয়। তবে এগুলো আশ্রয় নেয় গোপনতায়। ব্যক্তি তার স্বাধীনতা হারায় ঠিক, কিন্তু বিলুপ্ত হয় না। কারণ ব্যক্তি দ্বারাই সমাজ গঠিত; কাজেই ব্যক্তি আশ্রয় নেয় ষড়যন্ত্র, গোপনতা ও বিকৃতির। সমাজের উত্তেজনা, অসন্তোষ প্রকাশের এবং নূতন শক্তিসমূহের উদ্ভবের স্বাভাবিক, সুস্থ ও প্রকাশ্য বা বৈধ পথ থাকে না বলে এগুলো কাজ করে গোপনে, এবং দীর্ঘ প্রয়াস ও ষড়যন্ত্রের ফল হিসাবে হঠাৎ এক সময় রাষ্ট্রের উপর তলায় ঘটায় বিস্ফোরণ। অর্থাৎ এককেন্দ্রিক সমাজে সামাজিক অসন্তোষ ও পরিবর্তনের শক্তি দীর্ঘ গোপন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে এক সময় আকস্মিক সহিংস আত্মপ্রকাশ দ্বারা সমাজ কেন্দ্রকে অধিকার করে। এই রকম সমাজের নিয়তি হয় ষড়যন্ত্র এবং মাঝে মাঝে ব্যাপক সহিংসতা ও রক্তপাতময় পরিবর্তন।


কিন্তু চরম একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের পূজারী মুহাম্মদ নিরংকুশ একের শাসনেই কল্যাণ দেখেছেন। তিনি বহুর শাসনের মধ্যে বিশৃংখলা ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছু দেখেন নাই। অর্থাৎ ব্যক্তির স্বাধীনতা তাঁর কাম্য ছিল না। সুতরাং কুরআনে বলা হয়েছে,


২২। যদি আল্লাহ্‌ ব্যতীত বহু ইলাহ্‌ থাকিত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে, তবে উভয়ই ধ্বংস হইয়া যাইত। অতএব উহারা যাহা বলে তাহা হইতে আর্‌শের (আল্লাহ্‌র আসনের বা বিশ্ব শাসন কেন্দ্রের) অধিপতি আল্লাহ্‌ পবিত্র, মহান।

২১ সূরা আম্বিয়া


৯১। আল্লাহ্‌ কোন সন্তান গ্রহণ করেন নাই এবং তাঁহার সহিত অপর কোন ইলাহ্‌ (উপাস্য অর্থাৎ ঈশ্বর বা দেবতা) নাই, যদি থাকিত তবে প্রত্যেক ইলাহ্‌ স্বীয় সৃষ্টি লইয়া পৃথক হইয়া যাইত এবং একে অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করিত।. . . . . . . .. . .. . . . .

২৩ সূরা মুমিনূন


২৯। আল্লাহ্‌ একটি দৃষ্টান্ত পেশ করিতেছেনঃ এক ব্যক্তির প্রভু অনেক যাহারা পরস্পর বিরুদ্ধ-ভাবাপন্ন এবং আর এক ব্যক্তির প্রভু কেবল একজন; এই দুইজনের অবস্থা কি সমান? প্রশংসা আল্লাহ্‌রই প্রাপ্য; কিন্তু উহাদিগের অধিকাংশই ইহা জানে না।

৩৯ সূরা যুমার


সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুহাম্মদ একাধিক শক্তি তথা ব্যক্তির ক্ষমতা কিংবা স্বাধীনতায় শত্রুতা, দ্বন্দ্ব ও ধ্বংস ছাড়া আর কিছু দেখতে পান নাই। তিনি ধরেই নিয়েছেন যে, একাধিক শক্তি তথা ব্যক্তিকে ক্ষমতা বা অধিকার দিলেই তারা একে অন্যকে অধীনস্থ করার জন্য মারামারি বা যুদ্ধ করবে কিংবা তারা সমাজ গঠনের পরিবর্তে সমাজকে ভেঙ্গে ফেলবে। কাজেই তিনি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার একটাই পথ দেখতে পেয়েছেন তা হল সবাইকে তথা জনগণকে একজন ব্যক্তির নিরংকুশ দাসত্বে নিক্ষেপ করা। আর এই তথাকথিত শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে পথ নিয়েছেন তা হল চিরন্তন বল প্রয়োগ ও যুদ্ধ যে বিষয়ে আমরা কিছু পরে অলোচনা করব।


মুহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে গণতন্ত্র জন্মই নিতে পারে না। প্রতিকারহীন স্বৈরতন্ত্র ও অনিয়ন্ত্রিত একনায়কতন্ত্র এই সমাজের চিরন্তন নিয়তি। ইসলামের প্রথম পর্যায়ে যখন ভিন্ন ধর্মীদের প্রবল বাধাকে ভাঙ্গতে হয়েছিল এবং জনগণকে দীক্ষিত ও প্রভাবিত করতে হয়েছিল তখন ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ এবং প্রথম চার খলীফার মধ্যে যে স্বৈরতন্ত্র ও বর্বরতা ছিল কখনও কিছুটা সংযত হয়ে, ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের মাধ্যমে সেই অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় ক্রমেই ইসলামের ভিতরের নিপীড়ক ও বর্বর স্বৈরতন্ত্র নিঃসংকোচে ও অবাধে আত্মপ্রকাশ করে এবং সমস্ত ইসলামী দুনিয়াকে গ্রাস করে। অর্থাৎ সুযোগ পাওয়া মাত্রই ইসলাম তার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।

 

 

 


চতুর্থ পরিচ্ছেদ: ইসলামে সাম্য এক অতিকথা

 

একটা কথা বহুল প্রচলিত যে, ইসলাম সাম্যের ধর্ম। যেন মসজিদে এক কাতারে নামায পড়লেই সব সমান হয়ে যায়। কিন্তু মসজিদ থেকে বের হওয়া মাত্র যে ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, শাসক-শাসিত, অত্যাচারী-অত্যাচারিত, ভাল-মন্দ প্রত্যেকে স্ব অবস্থানে ফিরে যায় সে কথাটা আমরা কী করে ভুলব? এই অর্থে তো আরও অনেক ধর্মই সাম্যের। খ্রীষ্টানদের গীর্জায় রাজার জন্যও কোন স্বতন্ত্র আসন নাই কিংবা রাজা যে গীর্জায় প্রবেশ করে সেই গীর্জায় সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ নয়। বৌদ্ধ মন্দিরেও সবারই প্রবেশাধিকার রয়েছে।


তবে হাঁ, ইসলামে ভিন্ন পুরোহিত শ্রেণী নাই। যে কেউ নামায বা উপাসনা পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট বা প্রতিষ্ঠানিক পুরোহিত শ্রেণী না থাকার কারণ সাম্য নয়, বরং ধর্মের নিয়ন্ত্রণ পুরোহিত বা মোল্লা শ্রেণীর হাতে না থাকা। অর্থাৎ ইসলামে ধর্ম ও সমাজ নিয়ন্ত্রণের প্রধান কেন্দ্র প্রকৃতপক্ষে মসজিদ বা ধর্মমন্দির নয়। মসজিদ বা মন্দিরে সমবেতভাবে উপাসনা হয় ঠিক কিন্তু এই উপাসনা যে পরিচালনা করে সে তা করে নীতিগতভাবে ইসলামী রাষ্ট্র-শাসকের পক্ষ হতে।


অবশ্য এই সঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, দৈনিক পাঁচবার নামায ব্যক্তিগত কিংবা সমষ্টিগতভাবে যে কোনও স্থানে পড়া যায়। অর্থাৎ সবাইকে যে দৈনিক পাঁচবার নামায মসজিদেই পড়তে হবে এমন কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নাই। তবে শুক্রবার জুম্মার নামায মসজিদে পড়া সকল পুরুষের জন্য বাধ্যতামূলক। মসজিদ হল সকল মুসলমানের সম্মিলিত উপাসনার সাধারণ স্থান। এবং শুরুতে মসজিদই ছিল ইসলামের শুধু ধর্মীয় নয় সেই সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক কেন্দ্র।


আসলে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ছিলেন একজন রাষ্ট্র-শাসক, যিনি মসজিদে নামায যেমন পরিচালনা করতেন তেমন এটাকে সাধারণত সভাগৃহ ও কার্যালয় হিসাবেও ব্যবহার করতেন। মসজিদে উপাসনার পাশে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা ও যুদ্ধের বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। মুহাম্মদ পরবর্তী চার খলীফার সময়েও মসজিদের রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক গুরুত্ব বেশী বা কম বজায় থাকে। কিন্তু ইসলামের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক প্রসার এবং প্রশাসনিক কাজকর্মের জটিলতা বৃদ্ধির সঙ্গে মসজিদের এই গুরুত্ব কমতে থাকে এবং ক্রমেই রাষ্ট্র-শাসক প্রশাসনিক কাজের জন্য আলাদা দফ্‌তর প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হয় এবং মসজিদের বদলে শাসনকেন্দ্র শাসকের বাসগৃহ বা প্রাসাদ ও দফ্‌তরে স্থানান্তরিত হয়। শাসকের পক্ষেও আর মসজিদে দৈনিক পাঁচবার নিয়মিত নামায পড়া বা পড়ানো সম্ভব হয় না। ফলে নামায পরিচালনা বা ইমামতি করার জন্য অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে হল। রাজধানীতে উপস্থিত থাকলে শাসক শুক্রবার প্রধান মসজিদে সাপ্তাহিক জুম্মার নামায পরিচালনা করত। এটাই খলীফা মোয়াবিয়া কর্তৃক ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনা থেকে দামেস্কে স্থানান্তরের পর সাধারণ নিয়মে বা প্রথায় পরিণত হয়। অর্থাৎ ইসলামে রাষ্ট্র শাসকই হচ্ছে সর্বপ্রধান ধর্মীয় নেতা বা পুরোহিত। এখানে রাষ্ট্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মূলত একীভূত। রাজনীতি ও ধর্ম এক।


যেহেতু খ্রীষ্টান পাদ্রী কিংবা বৌদ্ধ শ্রমণ তলোয়ার হাতে নিয়ে যুদ্ধ করে বেড়ায় না কিংবা তার হাতে থাকে না রাষ্ট্র পরিচালনার প্রত্যক্ষ দায়িত্ব অথবা উল্টাভাবে বললে খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ রাজা রাজকার্য পরিচালনার সঙ্গে উপাসনা ও ধর্মচর্চা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে না সেহেতু সেখানে ধর্ম রক্ষা ও চর্চার জন্য নির্দিষ্ট দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রাপ্ত ব্যক্তি বা শ্রেণী থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মানেও এই নয় যে, এইসব ধর্ম ধর্মনেতাদের বাদে অন্যদেরকে ঈশ্বরের জগতে অস্পৃশ্য বা নিকৃষ্ট করেছে। এই ধর্মগুলিও পরলোকে কিংবা পরজন্মে মুক্তি বা মোক্ষের পথ সংসারী ও সংসারত্যাগী ধর্মনেতা নির্বিশেষে সবার জন্যই খোলা রেখেছে।


বস্তুত ইসলামে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী পুরোহিততন্ত্র বা মোল্লাতন্ত্র গড়ে না উঠার কারণ হল পুরোহিত বা মোল্লা এবং শাসক একই ব্যক্তি হওয়া। মুহাম্মদ একই সঙ্গে ধর্মনেতা, আইন প্রণেতা, প্রশাসক, বিচারক এবং যোদ্ধা হওয়ায় ইসলামের ধর্মীয় ক্ষমতা কেন্দ্র হিসাবে রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত মোল্লাতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে নাই। বরং রাষ্ট্র শাসকই হয়েছে প্রধান ধর্মনেতা। মোল্লারা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র নেতার পক্ষ থেকে বা সহায়ক হিসাবে ধর্ম বা উপাসনার কাজ পরিচালনা করে। যেহেতু সমস্ত বৈষয়িক ক্ষমতার মত ধর্মীয় ক্ষমতারও উৎস রাষ্ট্রনেতা স্বয়ং সেহেতু মুসলিম সম্প্রদায় বা সমাজের নেতা কোনও আলাদা মোল্লা নয়, বরং রাষ্ট্রের শাসক বা রাষ্ট্র নেতা।


কাজেই ইসলাম ধর্মে সাম্য আছে কি না তা বোঝার জন্য আমাদেরকে মসজিদে গিয়ে লাভ নাই বরং এর জন্য আমাদেরকে যেতে হবে শাসন কেন্দ্রে। অর্থাৎ রাষ্ট্র শাসকের কাছে। এই রাষ্ট্র-শাসক কি সমাজের আর সবার সমান? হাঁ, আল্লাহ্‌র নিকট তার দাস ভিন্ন আর কোনও মর্যাদা নাই; আল্লাহ্‌র আর সব দাসের মতই সেও একজন দাস। কিন্তু সব দাস কি আল্লাহ্‌র কাছেও এক সমান? আল্লাহ্‌র এক দাস শয়তান আর এক দাস আদমকে সেজদা না করায় অর্থাৎ আদমের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করায় আল্লাহ্‌ শয়তানকে কী শাস্তি দিয়েছে সেটা আমরা জানি।


মুহাম্মদও কি আর দশজনের সমান ছিলেন? ছিলেন না। তাই কুর্‌আনে সবাইকে আল্লাহ্‌র সঙ্গে তাঁর প্রতিও আনুগত্য স্বীকার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক যে, মুহাম্মদ নিজেকে কখনও কখনও আর দশজন মানুষের মত বলেছেন। কিন্তু সেটা রক্তমাংসের বিচারে। ক্ষমতার বিচারে কি তিনি নিজেকে সবার সমান করেছেন? সেটা তিনি করেন নাই। তিনি তাঁর নিরংকুশ শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য রেখেছেন সবার উপর। শুধু যে মুহাম্মদের মর্যাদা ও অধিকার সর্বাধিক শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু এই মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া হয়েছে শাসিতের উপর শাসককে, দরিদ্রের উপর ধনীকে, দাসের উপর প্রভুকে এবং সর্বোপরি নারীর উপর পুরুষকে।


কুরআন মুসলিম জনগণকে মুসলমান শাসকের প্রতি অনুগত হতে নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন বলছে,


৫৯। হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আল্লাহ্‌ ও পরকালে বিশ্বাস কর তবে তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ্‌র, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাহাদের, যাহারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী; কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটিলে উহা উপস্থিত কর আল্লাহ্‌ ও রাসূলের নিকট। ইহাই উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর।

৪ সূরা নিসা


ইসলামের সবচেয়ে বড় অসাম্য এইখানে যে, তা শুধু একতরফা আনুগত্য দাবী করেছে। ইসলামে সাম্য নাই। তাই শাসিতকে শাসকের প্রতি শুধু অনুগতই হতে বলেছে কিন্তু শাসকের উপর তার অর্থাৎ জনগণের পাল্টা নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা দেয় নাই, গণতন্ত্র যেটা দেয় ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নির্বাচনমূলক মেয়াদী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা দ্বারা। ইসলাম অর্থাৎ মুহাম্মদ অবশ্য শাসক কীভাবে হবে তা বলেন নাই। তাই আমরা ধরে নিতে পারি যে, ছলে বলে একবার শাসক হতে পারলে সমস্ত মুসলমানকে তার দাস ও বাধ্য হতে হবে। শাসক ও শাসিত সবই তো আল্লাহ্‌র ইচ্ছা! সব ক্ষমতাই তো আল্লাহ্‌র দেওয়া। কাজেই শাসক যা খুশী তা-ই করলে বলবার কী থাকে? কুরআন বলছে,


২৬। বল, ‘হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ! তুমি যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান কর এবং যাহার নিকট হইতে ইচ্ছা ক্ষমতা কাড়িয়া লও; যাহাকে ইচ্ছা তুমি পরাক্রমশালী কর, আর যাহাকে ইচ্ছা তুমি হীন কর। কল্যাণ তোমার হাতেই। তুমি সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।


২৭। ‘তুমিই রাত্রিকে দিবসে পরিণত এবং দিবসকে রাত্রিতে পরিণত কর; তুমিই মৃত হইতে জীবন্তের আবির্ভাব ঘটাও, আবার জীবন্ত হইতে মৃতের আবির্ভাব ঘটাও। তুমি যাহাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবনোপকরণ দান কর।’

৩ সূরা আল ইমরান


কুরআন আরও বলছে,


৩২। . . . . . .? আমিই উহাদিগের মধ্যে জীবিকা বণ্টন করি উহাদিগের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নত করি যাহাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করাইয়া লইতে পারে; . . . . . . ..

৪৩ সূরা যুখ্‌রুফ


সুতরাং ধনী-গরীবও আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি। তবে এটা ঠিক যে, ইসলাম অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় ধন-বৈষম্যকে বাড়তে দিতে চায় নাই। এ ক্ষেত্রে ধন-বৈষম্যকে সীমিত মাত্রায় রাখতে চেয়েছে। তাই সুদ প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং দান ও যাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে গরীবকে দানের ব্যবস্থা সব ধর্মেই দেখা যায়। কিন্তু এটা অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনও ব্যবস্থা নয়। কাজেই ইসলাম উৎপাদন ও সম্পদের সুষম বণ্টনের জন্য কোনও নির্দিষ্ট ব্যবস্থা দিতে পারে নাই। সে কালে অবশ্য এটাই স্বাভাবিক ছিল। সুতরাং দান ও প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব পালনের আবেদন জানিয়ে ইসলাম যা করেছে তার মধ্যে সাম্যের প্রেরণা খঁুজে লাভ নাই। আদি খ্রীষ্টান সমাজে বরং আমরা এর চেয়ে অনেক বেশী সাম্যের প্রেরণা দেখতে পাই সেখানে খ্রীষ্টানরা তাদের নিজেদের সকল সম্পদ খ্রীষ্টানদের মধ্যে সমানুপাতে বণ্টন করে দিত। অবশ্য এটা ঠিক যে, মুহাম্মদের অনেক সহকর্মী ও শিষ্য ইসলাম প্রচারে অনেক সম্পদ ও অর্থ ত্যাগ বা ব্যয় করেছেন। কিন্তু সেটা আদি খ্রীষ্টান সমাজের এই সাম্যবাদী প্রেরণার সঙ্গে তুলনীয় নয়।


তবে এটা ঠিক যে, নির্দিষ্ট সম্পদের উপর যাকাতের ব্যবস্থা ব্যক্তির মালিকানায় ধন সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধিকে যথেষ্ট সংযত করেছে। কিন্তু যাকাত সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় কথা হল এই যে, এর মধ্যে বেশী মাহাত্ম্য খুঁজে এই জন্য লাভ নাই যে, সব রাষ্ট্রই কর ধার্যের মাধ্যমে ব্যক্তির সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিংবা ব্যক্তির সম্পদের একাংশকে রাষ্ট্র ও সমাজের কাজে ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। মুহাম্মদের পূর্বে মক্কা-মদীনায় কোনও রাষ্ট্র ছিল না। সুতরাং সেখানে বাধ্যতামূলক আয় করের ধারণাও ছিল না। এমতাবস্থায় মুহাম্মদ যাকাতের মাধ্যমে কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। অর্থাৎ যাকাত আদি ইসলামী রাষ্ট্রের করের রকমফের মাত্র, যাকে প্রবর্তন করা হয় ধর্মীয় বিধান দ্বারা।


অনেক ভ্রান্ত প্রচারের মত আর একটি প্রচার আছে যে, ইসলাম বংশীয় আভিজাত্য তথা অভিজাততন্ত্র বিরোধী। এটা ঠিক যে, তৎকালীন আরবে যে বংশগত অভিজাততন্ত্রের প্রভাব ও শক্তি ছিল মুহাম্মদ তাকে কিছু সংযত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ কুরাইশদের বংশগত আধিপত্য ও প্রভুত্বকে ভাঙ্গেন নাই, বরং সেটাকে সুকৌশলে ও নূতন রূপে তিনি রক্ষাই করেছিলেন। এই কারণে আমরা দেখি মুহাম্মদ ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে আরবের বহু উপজাতি ও গোত্রকে আক্রমণ ও পরাজিত করে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন এবং বন্দী নারী-পুরুষদেরকে দাসী ও দাসে পরিণত করলেও কুরাইশদের ব্যাপারে সেসব কিছুই করেন নাই। বরং তাঁর এই প্রাক্তন শত্রু ও বিরোধীরা তাঁর ধর্ম গ্রহণ ক’রে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করা মাত্র তিনি তাদেরকে বাস্তবে সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। শুধু মুহাম্মদ নিজে যে কুরাইশ বংশের ছিলেন তাই নয়, তাঁর পরবর্তী চার খলীফা এবং উমাইয়া ও আব্বাসীয় রাজবংশ সবাই ছিল কুরাইশ। অর্থাৎ সুদীর্ঘ কাল ইসলামী শাসন প্রকৃতপক্ষে কুরাইশ বংশের বা গোত্রের শাসন যদিও এই কাজ করা হয়েছে সুকৌশলে, এ ব্যাপারে কোনও ধর্মীয় বিধি জারী না করেই। মুহাম্মদ এই কাজ করেছেন কুরাইশ গোত্রের ঐতিহাসিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদাকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে রক্ষা ও ব্যবহার ক’রে। তবে মুহাম্মদকে অতিশয় কৌশলী বলে মানতেই হবে। আমরা নিম্নোক্ত হাদীসে মুহাম্মদ কুরাইশদের প্রতি তার পক্ষপাতমূলক আচরণের সপক্ষে কীভাবে যুক্তি দিচ্ছেন তা দেখতে পাইঃ


“আনাস (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, হযরত রসূলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন, কোন কোন সময় আমি (জেহাদে অধিকৃত ধন-সম্পদের বাইতুল-মালের অংশ হইতে অন্যদের তুলনায়)* কোরায়েশগণকে অধিক দিয়া থাকি। তখন আমার উদ্দেশ্য হয় তাহাদের মন রক্ষা, কারণ তাহারা সবেমাত্র অন্ধকার যুগ হইতে ইসলামের আলোতে প্রবেশ করিয়াছে।”**


(বোখারী শরীফ)


বংশীয় আভিজাত্যের উপর যে মুহাম্মদ বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তা বোখারী ও মুসলিম এই উভয় সুবিখ্যাত হাদীস সংকলনেই উদ্ধৃত তাঁর নিম্নোক্ত বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়ঃ


“নারীদিগকে চারিটি গুণের জন্য বিবাহ করা যাইতে পারে - প্রথম তাহার ঐশ্বর্য, দ্বিতীয় তাহার আভিজাত্য, তৃতীয় তাহার সৌন্দর্য, চতুর্থ তাহার চরিত্র।”***


এই হাদীসে আমরা দেখছি মুহাম্মদ কোনও নারীর বিয়ের যোগ্যতা হিসাবে সবচেয়ে জোর দিচ্ছেন অর্থের উপর এবং তারপর বংশ বা পরিবারের মর্যাদার উপর। আর সবচেয়ে শেষে স্থান দেওয়া হয়েছে চরিত্রের উপর। মনে রাখতে হবে যে, হাদীস সংকলন হিসাবে বোখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ এই উভয়েরই অশেষ মর্যাদা। যে ছয়টি হাদীস সংকলনকৌ ইসলামী বিদ্বান বা আলেম সম্প্রদায় কর্তৃক সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয় এবং সর্বাপেক্ষা সঠিক বা সহী হাদীস বলা হয় সেই ছয়টির মধ্যে আবার বোখারী বা বুখারী এবং মোসলেম বা মুসলিম কর্তৃক সংকলিত হাদীসসমূহের মর্যাদা সর্বাধিক। অনেকে বোখারীকে প্রথম স্থান দিলেও বোখারী এবং মুসলিম এই উভয়ের দ্বারা সংকলিত প্রতিটি হাদীসকে আলেম সম্প্রদায় সাধারণভাবে নির্ভুল ও প্রামাণ্য হিসাবে গ্রহণ করেন। সুতরাং এই উভয় হাদীস সংকলনে বর্ণিত হাদীসটির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ করার অবকাশ কম থাকে।

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* এই গ্রন্থে হাদীসের উদ্ধৃতিতে বন্ধনীর মধ্যে যে সকল ব্যাখ্যা বা বক্তব্য দেওয়া আছে সেগুলি আমার নয়। হাদীসের বঙ্গানুবাদে যেভাবে বন্ধনীর মধ্যে হাদীসের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে আমি হুবহু সেভাবে উদ্ধৃত করেছি। -- লেখক


**  বোখারী শরীফ (তৃতীয় খণ্ড), মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক; হামিদিয়া লাইব্রেরী; ঢাকা; ১৯৬৭। পৃষ্ঠাঃ ৮৬।


*** পবিত্র কোর্‌আন ও হাদীছে রাসূল (সাঃ) -  খোন্দকার মাওলানা মোহাম্মদ বশিরউদ্দিন; প্রকাশকঃ কোরান মঞ্জিল লাইব্রেরী; বরিশাল; প্রথম সংস্করণ ; ১৩৮২। পৃষ্ঠাঃ ৩৭৫।


# অসংখ্য হাদীস সংকলনের মধ্যে শিয়াগণ চারখানা এবং সুন্নীগণ ছয়খানা হাদীসকে সর্বাপেক্ষা সহীহ্‌ বা বিশুদ্ধ হিসাবে গ্রহণ করেছে। যথাঃ- সহীহ বোখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামেয়ে তিরমিজী, জামেয়ে নাসায়ী এবং সুনামে ইবনে মাজা। এগুলির মধ্যে বোখারী তথা বোখারী শরীফ এবং মুসলিম তথা মুসলিম শরীফ সর্বাপেক্ষা মর্যদার অধিকারী হাদীস গ্রন্থ।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, ইসলাম হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতি প্রথার মত কোনও অপরিবর্তনীয় সামাজিক স্তর সৃষ্টি করে নাই। ফলে এক বংশ বা গোত্রের সঙ্গে আর এক বংশ বা গোত্রের মিশ্রণ ও বিবাহ নিষিদ্ধ করে নাই। কিন্তু তার মানে বংশগত ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্যকে চূড়ান্তভাবে বা নিঃশর্তভাবে নাকচ করাও বুঝায় না। তাই ইসলামের বিজয় দ্বারা আরবে প্রতিষ্ঠিত হয় কুরাইশ প্রাধান্য ও আধিপত্য আর আরব অধিকৃত অনারব ভূভাগে প্রতিষ্ঠিত হয় আরব প্রাধান্য ও আধিপত্য। এমন কি অনারবরা ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তাদেরকে দীর্ঘ কাল দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের পর্যায়ে রাখা হয়। রাষ্ট্রের মূল পদে থাকত আরবরা। সাম্রাজ্যের কোথায়ও কোনও অনারবের বাসগৃহের ছাদ তার পাশ্ববর্তী বহিরাগত আরবের বাসগৃহের ছাদের সমান হতে পারত না। বিভিন্ন চাপে ফেলে বিশাল বিজিত এলাকার জনসাধারণকে শুধু ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয় নাই সেই সঙ্গে বাধ্য করা হয় আরব ভাষা ও সংস্কৃতিকেও গ্রহণ করতে। এইভাবে কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সিরিয়া, ইরাক, মিসর সহ বিশাল ভূভাগের অধিবাসীবৃন্দ নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে আরব জাতিতে পরিণত হয়। অনারব মুসলিমদের প্রতি দীর্ঘকাল যাবত যে বৈষম্যমূলক ও অত্যাচারী আচরণ করা হয় তার ফলে উমাইয়া শাসনের বিরুদ্ধে বিশাল অনারব ভূভাগে অসন্তোষ প্রবল হয়ে ওঠে। উমাইয়া বংশের পতন এবং আব্বাসীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠার পিছনে অনারব মুসলমানদের বিরাট ভূমিকা ছিল। বিশেষত ইরানের মুসলমান সম্প্রদায় এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।


এমন একটি তথাকথিত সাম্যের ধর্ম দাস ব্যবস্থাকে যে শুধু বৈধ করেছে তাই নয় উপরন্তু মানুষকে তার বিশ্বাসের কারণে জোরজবরদস্তি করে অর্থাৎ যুদ্ধে বন্দী করে এনে দাস-দাসীতেও পরিণত করেছে বিপুল সংখ্যায়। এই দাসত্বের অবাধ বিকাশ ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্য প্রাচীন গ্রীস বা রোমের মত দাস ব্যবস্থার বিকাশ ইসলামে হয় নি। সেটা হওয়া সম্ভবও ছিল না। কারণ প্রাচীন গ্রীস বা রোমে দাস ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে ছিল উৎপাদন ব্যবস্থার উপর। বিপুল সংখ্যক দাসের শ্রমশক্তি ব্যবহার করে সেখানে শিল্প, কৃষি, বাণিজ্য ইত্যাদি পরিচালনা করা হত। ইসলাম অর্থনীতি কিংবা উৎপাদন শক্তির বিকাশের সেই পথ দিতে পারে নাই। তখনকার ক্ষয়িষ্ণু ও সংকুচিত উৎপাদন ও অর্থনীতির পরিস্থিতিতে ইসলামের পক্ষে সেটা দেওয়া সম্ভবও ছিল না। তাই ইসলামে দাস ব্যবস্থা সামাজিক উৎপাদনের ভিত্তি হিসাবে দেখা না দিয়ে প্রধানত গৃহশ্রমের মধ্যে সীমিত রইল। যেহেতু গৃহকর্মের জন্য বেশী দাস রাখা বোঝা হয়ে দাঁড়ায় সেহেতু দাস করার পাশাপাশি ইসলাম দাস মুক্ত করায়ও উৎসাহ দিয়েছে। অর্থাৎ ইসলাম একদিকে মানুষকে দাস করে তার নৈতিক ও মানবিক মেরুদণ্ড ধ্বংস করেছে, তার মানবিক মর্যাদা বিনষ্ট করেছে, অপরদিকে মনিবের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী দাস মুক্ত করার ব্যবস্থা রেখে মনিবের গর্ববোধকে তৃপ্তি দেবার ব্যবস্থা করেছে।


মুহাম্মদ দাসদের প্রতিও মানবিক আচরণ করতে বলেছেন। কিন্তু সেটা একটা নৈতিক আবেদন মাত্র বাস্তবে যার বিশেষ কোনই গুরুত্ব নাই। কারণ ইসলাম দাসদের জীবনের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষার জন্য কোনই ব্যবস্থা দেয় নাই। ইসলাম নাকি সব মানুষকে সমান বলে। কুরআন কিন্তু সে কথা বলে না। বরং কুরআনে আমরা দেখব মালিক-দাসের অসাম্যের প্রতি দৃঢ়বদ্ধ স্বীকৃতি।


৭১। আল্লাহ্‌ জীবনোপকরণে তোমাদের কাহাকেও কাহারও উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়াছেন। যাহাদিগকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হইয়াছে তাহারা তাহাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদিগকে নিজেদের জীবনোপকরণ হইতে এমন কিছু দেয় না যাহাতে উহারা এ বিষয়ে তাহাদের সমান হইয়া যায়। তবে কি উহারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ অস্বীকার করে?

১৬ সূরা নাহ্‌ল


২৮। আল্লাহ্‌ তোমাদিগের জন্য তোমাদিগের নিজেদের মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত পেশ করিতেছেনঃ তোমাদিগকে আমি যে রিয্‌ক দিয়াছি, তোমাদিগের অধিকারভুক্ত দাস-দাসিগণের কেহ কি তাহাতে অংশীদার? ফলে তোমরা কি এই ব্যাপারে সমান? তোমরা কি উহাদিগকে সেইরূপ ভয় কর যেইরূপ তোমরা পরস্পরকে ভয় কর? এইভাবেই আমি বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের নিকট নিদর্শনাবলী বিবৃত করি।

৩০ সূরা রূম


ইত্যাদি

 

ইসলাম দাসদের শুধু হীন করে নাই ধর্মীয় বিধানেও দাসদের পলায়ন নিষিদ্ধ করেছে। কারণ মুহাম্মদ দাসদের পলায়ন নিষিদ্ধ করেছেন। মুহাম্মদের কথা শুধু নির্দেশ নয় তা একই সঙ্গে ধর্মীয় বিধান এবং আইন। মুসলিম শরীফে আমরা নিম্নোক্ত হাদীসটি পাইঃ


“সূত্রঃ আলী ইবনে হুজর ছা’দি, ইসমাইল ইবনে উল্লিয়া, মনসুর ইবনে আবদুর রহমান, শা’বী জরির হইতে।


হযরত জরির (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) বলিয়াছেন, যে দাস তাহার কর্তার নিকট হইতে পালাইয়া যায়, সে কাফের (বিধর্মী,সত্য প্রত্যাখ্যানকারী) হইয়া যাইবে, যাবৎ না সে তাহার কর্তার নিকট ফিরিয়া আসিবে। মনসুর বলেন, আল্লাহ্‌র কসম, এই হাদীসটি রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) হইতে বর্ণিত আছে, তবুও এই হাদীসটি বসরায় বর্ণনা করা আমার পছন্দনীয় নহে।”*


ইসলামের তুলনায় প্রাচীন ভারতে দাসদের প্রতি অনেক বেশী মানবিক আচরণের বিধান ছিল। মনুস্মৃতি ও অর্থশাস্ত্রে এ সম্পর্কে স্পষ্ট বিধান আছে। মৌর্য যুগে রচিত কৌটল্যের “অর্থশাস্ত্র” প্রভু কর্তৃক দাসীর উপর ধর্ষণকে গুরুতর অপরাধ বিবেচনা করে ধর্ষণকারীর কঠোর শাস্তি এবং দাসীর আপনা থেকেই মুক্তির বিধান দিয়েছে।


ইসলামে এই জাতীয় বিধান হবে ধর্ম বিরোধী। কারণ ইসলাম দাসীকে তার যৌনসঙ্গী নির্বাচনের কোনও অধিকার দেয় নাই। প্রভুর ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। তাই বাজার থেকে ক্রয় করে এনে কিংবা যুদ্ধ দ্বারা অন্যের স্ত্রী, কন্যাকে বন্দী ও দাসী করে বলাৎকার করলে সেটা কোনও অপরাধ বা পাপ নয়। কুরআনে বলা হয়েছে,


৫। যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে


৬। নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না,

২৩ সূরা মুমিনূন


২৭। আর যাহারা তাহাদিগের প্রতিপালকের শাস্তি সম্পর্কে ভীত-সন্ত্রস্ত -

২৮। নিশ্চয় তাহাদিগের প্রতিপালকের শাস্তি হইতে নিঃশঙ্ক থাকা যায় না -

২৯ । এবং যাহারা নিজদিগের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে,

৩০। তাহাদিগের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ক্ষেত্র ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না -

৩১ । তবে কেহ ইহাদিগকে ছাড়া অন্যকে কামনা করিলে তাহারা হইবে সীমালংঘনকারী, -

৩২। এবং যাহারা আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে,

৩৩। আর যাহারা তাহাদিগের সাক্ষ্যদানে** অটল,

৩৪। এবং নিজদিগের সালাতে (নামাযে) যত্নবান -

৩৫। তাহারাই সম্মানিত হইবে জান্নাতে (স্বর্গে)।

৭০ সূরা মা আরিজ


____________________________________________________________________________________________________________________

* বঙ্গানুবাদ মুসলিম শরীফ (১ম খণ্ড), অনুবাদকঃ মৌলানা নেছারুল হক; ইসলামিয়া লাইব্রেরী, চট্টগ্রাম; বাংলাদেশ; প্রথম সংস্করণঃ ১৯৭৩। পৃষ্ঠাঃ ৯৭।

**  আল্লাহ্‌র একত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব এবং আল্লাহ্‌র রাসূল বা বার্তাবাহক হিসাবে মুহাম্মদের ভূমিকার সমর্থনে সাক্ষ্য দান করা।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে প্রভুদের কামপাত্রী হিসাবে যথেচ্ছ ব্যবহারের সপক্ষে কুরআনে এ ধরনের আরও কয়েকটি আয়াত আছে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কুরআনের বিধান অনুযায়ী দাসীদের ক্ষেত্রে যৌন অঙ্গকে অসংযত করায় প্রভুর কোনও দোষ নাই এবং তাতে তার স্বর্গে প্রবেশেও কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। অর্থাৎ দাসী হলেই ইসলামের বিধানে প্রভু তাকে ধর্ষণ করতে পারবে।


অথচ ইসলাম ব্যভিচারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ব্যভিচারের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে তার শাস্তি সর্বসমক্ষে একশত কশাঘাত আর বিবাহিতদের ক্ষেত্রে তার শাস্তি প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপে মৃতুø। এখন পুরুষের একত্রে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখা তার জন্য ব্যভিচার নয় কিংবা পুরুষ প্রভু কর্তৃক নিজ ইচ্ছামত যে কোনও সংখ্যায় দাসীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনও ব্যভিচার নয়। তাহলে ইসলামে ব্যভিচারটা কি বস্তু? বস্তুত এ থেকেও বেরিয়ে আসে ইসলামে নারীর করুণ ও মর্মস্তুদ অবস্থা।


স্বাধীন নারীর অস্তিত্ব ইসলাম বিরোধী। সে পুরুষের অধীন ও সম্পত্তি মাত্র। তাই তার স্বামী ব্যতীত কিংবা সে দাসী হলে তার নিজ প্রভু ব্যতীত ভিন্ন পুরুষের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক অবৈধ অর্থাৎ ব্যভিচার। কারণ এটা হল একজন পুরুষের সম্পত্তিতে অপর পুরুষের হস্তক্ষেপ। তাই এই ধরনের সম্পর্ক করলে পুরুষ হবে ব্যভিচারী আর যদি তাতে নারীর সম্মতি থাকে তবে সে হবে ব্যভিচারিণী। এবং উভয়ের কঠোর ও ভয়ংকর শাস্তির ব্যবস্থা।


সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলামী বিধানে একজন নারীর যৌন সঙ্গী হবে একজন মাত্র পুরুষ যে তার স্বামী কিংবা প্রভু বা মালিক হবে। তার বাইরে কোনও পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক হবে কঠোর শাস্তিযোগ্য ব্যভিচার। অথচ তার বিপরীতে একজন পুরুষ চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখতে আর অর্থ-সামর্থø থাকলে শত শত বা যে কোনও সংখ্যায় দাসী রাখতে ও রমণ করতে পারবে; এটা অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা ব্যভিচার হবে না। ইসলামী সাম্যের অতুলনীয় (!) ব্যবস্থা বটে!


প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সমগ্র প্রয়াসের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিকই হল নারীর অধিকার হরণ করে তাকে সম্পূর্ণরূপে পুরুষ অধীন ও পুরুষের দয়ার বস্তু করা এবং তাকে সমাজ জীবন থেকে বিতাড়িত করে অবরোধে ও মানবেতর জীবনে ঠেলে দেওয়া।

 

 

 

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ ইসলামের বিজয়ে নারীর পরাজয়

 

আমাদের দেশে সমাজ জীবনে নারীর তুলনামূলক অনুপস্থিতি এবং নারীর উপর ধর্ষবাদী পুরুষদের যৌন আগ্রাসন ও ধর্ষণের আধিক্য যে কোনও মানুষের চোখে পড়বে। এটা অবশ্য আমাদের দেশের একক অবস্থা নয়। সমগ্র মুসলিম পৃথিবীর অবস্থাই কম-বেশী এই রকম।


অবশ্য পাশ্চাত্যে নারীর অবরোধ না থাকলেও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মত অনেক দেশে নারীর উপর যৌন আগ্রাসন কম উল্লেখ্য নয়। কিন্তু তবু পাশ্চাত্যের নারীর অবস্থা মুসলিম সমাজের তুলনায় বহু গুণ উন্নত। পাশ্চাত্যে নারীর উপর যেটুকু নিগ্রহ ঘটে তা সেখানকার উদার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কল্যাণে যেমন চোখে পড়ে তেমন তার বিরুদ্ধে সেখানে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। কিন্তু মুসলিম সমাজে নারীর অবরোধ এবং নারীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বৈরাচার ও সন্ত্রাসের কারণে নারী নিগ্রহের প্রচার যেমন খুব কমই হয় তেমন এর বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর আন্দোলনও গড়ে তোলা যায় না। বরং নারীর গৌণ অবস্থান ও লাঞ্ছনা এখানে সমাজের জন্য এতই স্বাভাবিক বিষয় যে এটা নিয়ে চিন্তাও করা হয় খুব কম। মাছ যেমন জন্ম থেকেই জলের চাপে অভ্যস্ত থাকায় তার চাপ অনুভব করে না কিংবা যেমন আমরা অনুভব করি না বায়ুর প্রচণ্ড চাপ তেমন মুসলিম সমাজে নারীর নিগৃহীত ও অসম্মানিত অবস্থানেও সমাজ অন্যায় ও অস্বাভাবিক কিছুই দেখতে পায় না।


অবশ্য ইদানীং বাংলাদেশে নারী নিগ্রহের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যেটা সমাজকে নাড়া দিচ্ছে। কিছুটা পাশ্চাত্যের আধুনিক মূল্যবোধের বিস্তার ও প্রচার মাধ্যমের কারণে এবং কিছুটা ঘটনার অতিবাহুল্যের কারণে নারী নিগ্রহের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হচ্ছে।


অনেকে নারী নিগ্রহকে দারিদ্র্য ও সামাজিক সঙ্কট থেকে উদ্ভূত মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ফল মনে করছেন। কিন্তু আমাদের তুলনায়ও দরিদ্রতর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভুটানে নারীর অবস্থা আমাদের সমাজের তুলনায় বহু উন্নত। সেখানে যেমন নাই নারীর অবরোধ তেমন নাই এই রকম নারী নিগ্রহও। ভুটান বলে কথা নয় যে কোনও অমুসলিম সমাজের তুলনায় মুসলিম সমাজে নারীর অবস্থা সাধারণভাবে হীন।


আমাদের সমাজে সামাজিক সঙ্কট ও অস্থিরতা আজ না হয় খুব বেড়েছে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে যখন এই মাত্রায় সামাজিক সঙ্কট ও অস্থিরতা ছিল না এবং ছিল না এই ধরনের মূল্যবোধের অবক্ষয় তখনও নারী নিগ্রহ আমাদের সমাজে প্রচুর ঘটত। এবং এটা বলা ভাল যে, তখন এ দেশে প্রচুর হিন্দু জনসংখ্যা ছিল এবং তাদের মধ্যে মুসলমানদের তুলনায় অনেক বেশী নারী স্বাধীনতা ছিল। এবং ফলে সাধারণত মুসলমান দুর্বৃত্ত কর্তৃক হিন্দু নারীদের উপর প্রচুর যৌন আগ্রাসন ঘটত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দু কর্তৃত্বের অবসান ঘটায় এই ঘটনা অনেক বেশী বৃদ্ধি পায়। বিশেষত একা যাতায়াতের পথে, ধর্মীয় উৎসব ও মেলায় হিন্দু নারীরা অনেক ক্ষেত্রে মুসলমান ধর্ষবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হত। অর্থাৎ তখনও হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান পুরুষদের মধ্যে ধর্ষবাদী প্রবণতা অনেক বেশী দেখা যেত। তখন মুসলমান সমাজের নারীরাও যে একই ধরনের ঘটনার শিকার হত না তা নয়। তবে তাদের উপর ছিল অবরোধ ব্যবস্থার অধিকতর চাপ। প্রকাশ্যে তাদের চলাফেরা ছিল কম। ফলে গোপনে যে সব নিগ্রহ ঘটত সেগুলো প্রচার পেত কম। এখন হিন্দু জনসংখ্যা খুব কমেছে এবং মুসলমান নারীরা যুগের প্রভাবে ও বিভিন্ন প্রয়োজনে ধর্মের শাসন ভেঙ্গে পথে বের হচ্ছে। ফলে এখন মুসলমান ধর্ষবাদীদের যৌন আগ্রাসন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে প্রধানত মুসলমান নারীরাই।


কাজেই আজকের সামাজিক সঙ্কট বা মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মধ্যে নারী নিগ্রহের কারণ খুঁজে লাভ নাই। বরং এর কারণ খুঁজেতে হবে ইসলাম ধর্ম দ্বারা সৃষ্ট ইসলামী মানসের মধ্যে। বস্তুত ইসলাম ধর্ম যেভাবে পুরুষের চেতনা গড়ে তোলে তাতে সমাজে নারীর অবদামিত ও গৌণ অবস্থান এবং নারীর উপর পুরুষের অসংখ্য ধরনের পীড়ন ও আগ্রাসন অনিবার্য। এই অবস্থাকে তাই বিশেষ অর্থনীতি কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থা দ্বারা ব্যাখ্যা করতে চাইলে আমরা কিছুই বুঝতে পারব না। আমাদেরকে বরং আমাদের সমাজসহ সব মুসলিম সমাজে নারীর নিগৃহীত ও হীন অবস্থানের মূল কারণ বুঝতে হলে ইসলাম ধর্ম নারীকে কীভাবে দেখছে এবং নারী পুরুষ সম্পর্ক কীভাবে নির্ধারণ করছে সেটা বুঝতে হবে।


আসলে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অসাধারণভাবে দৃঢ়। ইসলামের ধ্যান-ধারণা দ্বারা তার সমগ্র সমাজ এত কঠোরভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হয় যার তুলনা অন্য কোনও সমাজের ক্ষেত্রেই সাধারণত পাওয়া যায় না। বস্তুত ইসলামের নিয়ন্ত্রণে সমাজ এমন একটা নির্দিষ্ট বিন্যাস বা গড়ন নেয় যে গড়নকে শুধু অর্থনীতি কিংবা রাষ্ট্রের পরিবর্তন দিয়ে আদৌ বদলানো বা ভাঙ্গা সম্ভব নয় যদি তার মূল জায়গায় অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে হাত দেওয়া না যায়। এই বিষয় আমরা তখনই বুঝব যখন সমাজ গঠনে, সমাজের গড়ন গঠনে ইসলামের প্রকৃত ভূমিকা বুঝব।


আমরা একটু পর্যালোচনা করলেই দেখতে পাব যে, মূল্যবোধের অবক্ষয় কিংবা ইসলাম ধর্ম না বোঝা বা না মানা ইসলামী সমাজে নারীর অবস্থা হীন করার কারণ নয় বরং ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাই নারীর অবস্থাকে হীন করেছে। অর্থাৎ ইসলাম নিজেই মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটিয়েছে। এটা ঠিক যে, ইসলাম নারীর জন্য কিছু নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। যেমন তার সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভের ব্যবস্থা, পুরুষের সর্বোচ্চ স্ত্রী সংখ্যা নির্ধারণ, নারীর বিবাহ বিচ্ছেদ লাভের অধিকার ইত্যাদি। কিন্তু এই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, নারী-পুরুষ সমাধিকার দেওয়া হয় নাই। তাই কন্যা পায় পুত্রের অর্ধেক সম্পত্তি এবং একজন পুরুষ সাক্ষীর সমান দুইজন নারী সাক্ষী। আর পুরুষের একত্রে চার স্ত্রী রাখবার অধিকার দেওয়া মানেই নারীর অবস্থাকে হীন করা। এ ক্ষেত্রে খ্রীষ্ট ধর্ম নারীকে অন্তত এমন একটা ক্ষমতা দিয়েছে যা নারীর অবস্থার উন্নতি সাধনে এবং ইউরোপের আত্মবিকাশে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে। খ্রীষ্ট ধর্ম যেমন এক স্বামী এক স্ত্রীর বিধান দিয়ে পুরুষের বহু বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে এবং এইভাবে নারীকে একটি মূল ক্ষেত্রে পুরুষের সমাধিকার দিয়েছে তেমন তা ইসলামের মত পুরুষকে দাসী কিংবা বন্দী নারী উপভোগ বা ধর্ষণের জন্য কোনও ধর্মীয় অধিকার না দিয়ে নারীর মর্যাদা বহুল পরিমাণে রক্ষা করেছে।


ইসলামে নারীর কিছু সীমিত অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের এ কথা মনে রাখা দরকার যে, প্রাক-ইসলামী যুগে আরবে নারীর অবস্থা ইসলাম উত্তর যুগের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। ইসলামের প্রচারের কল্যাণে আমরা আরবের কিছু গোত্রে কিছু ক্ষেত্রে প্রধানত অর্থনৈতিক কারণে জন্মের পর কন্যা সন্তান কবর দিবার কথাটাই জানি কিন্তু আরবে সামগ্রিকভাবে নারীর যে মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল তার খোঁজ রাখি না। প্রাক-ইসলামী আরব সমাজে আমরা নারীদের মধ্যে দেখতে পাই কবি, ব্যবসায়ী ও যোদ্ধা পর্যন্ত। দেড় হাজার বৎসর পরেও যখন সেইসব কিছু নাম কিংবা স্মৃতি টিকে আছে তখন এটা সহজেই অনুমেয় যে, সেই যুগে ইসলামী যুগের তুলনায় নারীর অবস্থা কতখানি উন্নত ছিল! মনে রাখতে হবে যে, ইসলামের মতে ইসলাম-পূর্ব যুগ হল “আইয়ামে জাহেলিয়াত” বা অন্ধকারের যুগ। সুতরাং তার প্রায় সবই তার কাছে খারাপ। ফলে বিজয়ী হবার পর ইসলাম যে তার পূর্ববর্তী যুুগের গৌরবময় চিত্রকে পরবর্তীকালের জন্য রক্ষা করতে চাইবে না সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সামগ্রিকভাবে নারীর অবস্থা ইসলামী যুগের তুলনায় বরং ইসলাম-পূর্ব যুগেই অনেক ভাল ছিল। ইসলাম আরবের কয়েকটি গোত্রে কন্যা সন্তান জন্মালে তার জীবন্ত করব দেওয়া বন্ধ করেছে বটে কিন্তু সেই সঙ্গে কবর দিয়েছে নারীর সমস্ত অধিকার, মর্যাদা ও সম্ভাবনাকেও।


প্রাক-ইসলামী যুগের আরব সমাজে নারীর উন্নত অবস্থার সাক্ষী তো স্বয়ং ইসলাম প্রবর্তক মুহাম্মদ যিনি তৎকালীন আরবের অন্যমত শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্য নারী খাদীজার স্বামী ছিলেন। মুহাম্মদ প্রথম জীবনে ছিলেন তাঁর একজন কর্মচারী মাত্র। খাদীজার ব্যবসায়ে চাকুরীরত অবস্থায় পঁচিশ বৎসরের দরিদ্র কর্মচারী মুহাম্মদ এবং তাঁর চল্লিশ বৎসর বয়সী মনিব খাদীজার মধ্যে বিবাহ হয়।


বস্তুত তৎকালীন আরবে বিশেষত মক্কায় নারীর যে প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা ছিল মুহাম্মদ তার কিছু স্বীকৃতি দিয়েছেন মাত্র। তবে সবচেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হল এই যে, মুহাম্মদ নারীর যেটুকু অধিকার ও নিরাপত্তা দিতে চেয়েছেন সেটুকু দিতে চেয়েছেন পুরুষের আধিপত্যের অধীনে। তিনি ছিলেন স্বাধীন নারীর অস্তিত্ব বিরোধী। ফলে ইসলাম নারীকে যে অবরোধ, পশ্চাৎপদতা ও নিগ্রহ দান করে তা তুলনাহীন। আরবের কয়েকটি গোত্রে অবোধ কন্যাশিশু কবর দেওয়ার তুলনায় এটা হল আরও আনক বেশী বর্বর। ইসলাম সমগ্র নারী সমাজকে পর্দার নামে যে অবরোধ দিয়েছে তা হল জীবন্ত কবর তুল্য। এই কবরে নারীকে থাকতে হয় জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত জীবন। সমাজ জীবন থেকে বিতাড়িত হয়ে, সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার হারিয়ে, শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত হয়ে নারীও আর মানুষ থাকে না। আর এইভাবে মানুষের জননী নারী তার নিজের অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও অমানুষতা দিয়ে এক সময় অধিকার করে সমগ্র সমাজকে।


বস্তুত ইসলামের নিরংকুশ একত্ববাদী চিন্তাও নারীর এই হীন অবস্থা জন্ম দিতে বাধ্য। এক আল্লাহ্‌ সমস্ত সৃষ্টির একমাত্র উৎস। আর সমস্ত মানুষের উৎপত্তি এক আদম থেকে। নারীরও জন্ম আদি মানব আদম থেকে। কুরআন বলছে,


৬। তিনি তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন একই ব্যক্তি হইতে। অতঃপর তিনি তাহা হইতে তাহার সঙ্গিনী সৃষ্টি করিয়াছেন।. . . . .. .. .
৩৯ সূরা যুমার


কাজেই ইসলামী তত্ত্বে নারীর উৎপত্তি পুরুষ থেকে যে তত্ত্ব ইসলাম নিয়েছে খ্রীষ্ট ও ইহুদী ধর্ম থেকে। এখন এই আদি পুরুষকে আল্লাহ্‌ সৃষ্টি করেছে তার নিজস্ব রূপে। নিম্নবর্ণিত হাদীসে আমরা দেখিঃ


“হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম ফরমাইয়াছেন, আল্লাহ্‌ তায়ালা আদম (আঃ)-কে তাঁহার নিজস্ব দৈহিক গঠন ও আকারের উপরই সৃষ্টি করিয়াছিলেন - (সৃষ্টি ও জন্মের প্রথম হইতেই) তাঁহার দৈর্ঘ্য ও দেহের উচ্চতা ছিল ষাট হাত।”*


আসলে আল্লাহ্‌ তো পুরুষেরই কাল্পনিক ও অবাস্তব প্রতিরূপ। তাই মুহাম্মদ আল্লাহ্‌কে নিরাকার বললেও ক্লীব বলেন না। বরং মুহাম্মদের উপরোক্ত বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় যে, মুহাম্মদের আল্লাহ্‌ও একজন অদৃশ্য পুরুষ মাত্র যার অবয়বে সৃষ্ট পুরুষ-মানুষ। তাহলে নারী কার অবয়বে সৃষ্টি? শয়তানের কি? আমরা বোখারী শরীফে পাই,


“হযরত রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন, নারী শয়তানের আকৃতিতে সম্মুখে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে চলিয়া যায়।”**


সুতরাং নারীর প্রতি ইসলামের স্রষ্টা মুহাম্মদের প্রকৃত মনোভাব কী ছিল তা বুঝতে আর আমাদের বেগ পেতে হয় না। আসলে মানুষ হিসাবে নারীর অস্তিত্ব ইসলামের নিরংকুশ একত্ববাদী চিন্তার সঙ্গে খাপ খায় না। কারণ নারীর মানুষ হিসাবে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন অবস্থান পুরুষের মানুষ হিসাবে একত্ববাদী ধারণাকে আঘাত করে। পুরুষ দেখতে পায় যে, শুধু সে একাই মানুষ নয়, মানুষ হিসাবে আর একটি সত্তা তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে তার থেকে স্বতন্ত্র। নারীর অস্তিত্ব মানুষ হিসাবে পুরুষের অসম্পূর্ণতাকে ধরিয়ে দেয়। নারীর অস্তিত্ব দ্বৈততার দ্যোতক বা প্রকাশক। তাকে নাকচও করা যায় না। তাহলে মানুষেরই অস্তিত্ব থাকে না। সুতরাং তাকে হীন ক’রে, অধীনস্থ ক’রে, শাসন ক’রে এবং তাকে সমাজ জীবন হতে বিতাড়ন ক’রে পুরুষ খোঁজে নিজ একত্বের নিরংকুশ প্রতিষ্ঠা।


____________________________________________________________________________________________________________________

* বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), চতুর্থ খণ্ড, মাওলানা শামছুল হক সাহেব ফরিদপুরী ও মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, প্রকাশকঃ হামিদিয়া লাইব্রেরী, চকবাজার, ঢাকা; প্রথম সংস্করণ। পৃষ্ঠাঃ৭-৮।


**বোখারী শরীফ; ষষ্ঠ খণ্ড; অনুঃ ঐ। দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৩৮৪ বাংলা; পৃষ্ঠাঃ ৪১৪।

____________________________________________________________________________________________________________________


নারীর প্রতি মুহাম্মদ ও ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গী বোঝার জন্য বেশী আলোচনা না করে আমরা নিম্নে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করতে পারিঃ


“সূত্র - ইবনে আবি শায়বা - ইবনে ওলাইয়া - (সূত্র পরির্বতন) জুহাইর ইবনে হারব - ইবনে ইব্রাহিম - ইউনুস - হুমাইদ - ইবনে সামেত - আবু জর।


“আবু জর (রাঃ) বলেন, রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) বলিয়াছেন, যখন তোমাদের কেহ নামাযের উদ্দেশ্যে দাঁড়াইবে, সে তাহার সম্মুখে হাওদার পিছনের কাঠটির পরিমাণ একটি কাঠ রাখিয়া দিবে। যদি ঐ রূপ কোন কাঠ বা অন্য কিছু রাখা না হয় এমতাবস্থায় তাহার সম্মুখ দিয়া গাধা, স্ত্রীলোক অথবা কাল কুকুর গমন করিলে তাহার নামায ভঙ্গ হইয়া যাইবে। বর্ণনাকারী ইবনে সামেত বলেন, আমি বলিলাম, হে আবু জর, লাল কুকুর এবং হলুদ রং এর কুকুর হইতে কাল কুকুরকে পৃথক করিবার কারণটা কী? তিনি বলিলেন, হে আমার ভাতিজা, আমি তোমার মত এই বিষয়ে রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) এর নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, রসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) বলিলেন, কাল কুকুর একটি শয়তান।”*

(মুসলিম শরীফ)


“উসামা হইতে বর্ণিত আছে, হযরত নবী সাল্লাল্লাহ্‌ আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন, ...... দোযখ পরিদর্শনকালে আমি দোযখের দ্বারে দাঁড়াইলাম এবং জানিতে পারিলাম যে, দোযখীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হইবে।”**;

(বোখারী শরীফ)


নিম্নলিখিত হাদীসগুলি আমরা “পবিত্র কোরান ও হাদিছে রাসূল (সাঃ)”*** গ্রন্থ হতে উদ্ধৃত করছি,

“পুরুষ যে কারণে তাহার স্ত্রীকে প্রহার করে সে তৎসম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইবে না।”

(আবু দাউদ, ইবনে মাজা) পৃষ্ঠাঃ ১৩৪


“যদি কোন ব্যক্তি সঙ্গমের ইচ্ছায় নিজের স্ত্রীকে আহ্বান করে, তবে সে যেন তাহার নিকট উপস্থিত হয়, যদিও সে উনানের উপর (রন্ধন কার্যে ব্যাপৃত) থাকে”

(তিরমিজী) পৃষ্ঠাঃ ১৩৫

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* বঙ্গানুবাদ মুসলিম শরীফ (২য় খণ্ড) - অনুবাদকঃ আল্লামা মৌলানা নেছারুল হক; ইসলামিয়া লাইব্রেরী; চট্টগ্রাম; ১৯৭৫। পৃষ্ঠাঃ ৩১৭।


** বোখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড; অনুঃ মাওলানা আজিজুল হক; হামিদিয়া লাইব্রেরী। পৃষ্ঠা ২১১।


*** পবিত্র কোরান ও হাদিছে রাসুল (সাঃ) - খোন্দকার মাওলানা মুহাম্মদ বশির উদ্দিন; প্রকাশকঃ কোরান মঞ্জিল লাইব্রেরী; বরিশাল। প্রথম সংস্করণঃ ১৩৮২

____________________________________________________________________________________________________________________

 

“যে কোন স্ত্রীলোক মরিয়া যায় এবং তাহার স্বামী তাহার উপর সন্তুষ্ট থাকে, সে বেহেস্তে দাখিল হইবে।”

(তিরমিজী) পৃষ্ঠাঃ ১৩৫


“যদি স্বামী স্ত্রীকে আদেশ করে, তবে সে জরদ পর্বত হইতে কালো পর্বতের দিকে এবং কালো পর্বত হইতে সাদা পর্বতের দিকে স্থানান্তরিত করুক, তবু সে আদেশ প্রতিপালন করা তাহার কর্তব্য।”

(আহমাদ) পৃষ্ঠাঃ ১৩৬


“আমি যদি কোন ব্যক্তির উপর কাহারও নিমিত্ত সেজ্‌দা করার আদেশ করিতাম, তবে স্ত্রীলোকদিগকে তাহাদের স্বামীকে সেজ্‌দা করিবার আদেশ দিতাম, যেহেতু আল্লাহ্‌ তায়ালা স্ত্রীলোকদের উপর তাহাদের হক নির্ধারিত করিয়াছেন।”

(আবু দাউদ) পৃষ্ঠাঃ ১৩৬


“হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) বলেন, এমন পবিত্র জাতের কসম করিয়া বলিতেছি - যাহার মুঠার মধ্যে আমার প্রাণ রহিয়াছে যে নারী স্বামীর হক আদায় করে না, সে আল্লাহ্‌র নাফরমান। স্বামীর হক আদায় করার উপর আল্লাহ্‌তায়ালার হক নির্ভর করিতেছে।”

(ইবনে মাজা) পৃষ্ঠাঃ ১৩৮


“যদি কোন স্ত্রীলোক স্বামীর বিনা আদেশে ঘর হইতে বাহির হইয়া যায়, সে পুনঃ ফিরিয়া না আসা পর্যন্ত আসমানের যাবতীয় ফেরেশ্‌তা তাহার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করিতে থাকে। এবং যাহার উপর দিয়া সেই স্ত্রীলোক পথ চলে, সেও লানত করিতে থাকে।”

(তেবরানী) পৃষ্ঠাঃ ১৩৮


“স্ত্রীর প্রতি স্বামী অসন্তুষ্ট থাকা পর্যন্ত স্ত্রীর নামায রোযা প্রভৃতি কোন নেক আমল* আসমান পর্যন্ত পৌঁছে না।”

(তেবরানী) পৃষ্ঠাঃ ১৩৮

____________________________________________________________________________________________________________________

* নেক আমল - পুণ্যকর্ম। -- লেখক।

____________________________________________________________________________________________________________________


“হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফরমাইয়াছেন - স্ত্রীলোক গোপনীয় বস্তু, যখন সে পরর্দর বাহির হয়, শয়তান তাহাকে পুরুষদের চক্ষে মনোমুগ্ধকর করিয়া দেখায়।”

(তিরমিজী) পৃষ্ঠাঃ ১৮৭


“স্ত্রীলোক শয়তানের ফাঁদ এবং দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ প্রত্যেক গোনাহ্‌র মস্তক সদৃশ।”

(শোবল ঈমান) পৃষ্ঠা ১৮৮


ইসলামে নারীর অবস্থান বোঝার সময় আমাদের একথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, পুরুষ সৃষ্ট আজকের কোনও বৃহৎ ধর্মেই নারীর অবস্থা তেমন কিছু সুবিধার নয়। যদিও খ্রীষ্ট ধর্ম এক স্বামী এক স্ত্রী বিবাহ বিধান দ্বারা এবং স্ত্রী ব্যতিরেকে দাসী সহ যে কোনও নারীর সঙ্গে পুরুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধকরণ দ্বারা নারীকে ইসলামের তুলনায় অনেক বেশী অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে তবু তাও নারীর অবস্থান পুরুষের কর্তৃত্বের অধীনেই স্থাপন করেছে। বৌদ্ধ ধর্মও যথেষ্ট মানবিক হলেও নারীর অধিকার রক্ষায় বিশেষ কোনও ভূমিকা নেয় নাই। অন্য দিকে হিন্দু ধর্মে নারীর অবস্থাকে করা হয়েছে শোচনীয়।


বস্তুত প্রাচীন সভ্যতার একটি বৈশিষ্ট্য হল নারীর অবস্থার ক্রমিক অবনতি। ধর্মে তারই একটা প্রকাশ ঘটেছে। আসলে এটা সভ্যতার সঙ্কটের একটা ফল। তাই চীনে আমরা পরলোকবাদী ধর্ম কিংবা অজাগতিকতার প্রভাব ভারত ও পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় যথেষ্ট কম দেখলেও সেখানেও এক সময় দেখেছি নারীর অবস্থার নিদারুণ অবনতি। একটা পর্যায়ে চীনে অভিজাত কিংবা উচ্চ শ্রেণীর নারীদের গতিশীলতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে সৌন্দর্য চর্চার নামে নারীর পায়ে লোহা বা কাঠ দ্বারা তৈরী শক্ত জুতা পরানো শুরু হয়। মেয়েদের পা যাতে বড় হতে না পারে সেইজন্য শৈশব থেকে তাদের পা শক্ত জুতায় আবদ্ধ রাখা হত। এর ফলে তারা সমস্ত জীবন প্রায় পঙ্গু হয়ে থাকত এবং ছোট পায়ের দরুন দৃঢ়ভাবে হাঁটতে পারত না।


কিন্তু মানব সমাজে নারীর অবস্থা এক সময় এত খারাপ ছিল না। বরং আজ আমরা জানি যে, নারীর হাত দিয়েই প্রধানত মানুষের সভ্যতার সূচনা হয়। কৃষি, পশুপালন, বস্ত্র বয়ন, মৃৎ পাত্র নির্মাণ এগুলো মূলত নারীদের উদ্ভাবন এবং অনেক কাল পর্যন্ত এগুলো মূলত তাদেরই কাজ ছিল। এই অবস্থা চলে হয়ত কয়েক হাজার বৎসর। এগুলো তখন ছিল ক্ষুদ্র পরিসরে এবং গৃহ উৎপাদনের পর্যায়ে। মেয়েরা সন্তান পালন ও গৃহকর্মের সঙ্গে এগুলো করত। অর্থাৎ এগুলো ছিল গৃহকর্মেরই অঙ্গ। যেমন কৃষি হত গৃহের সংলগ্ন এলাকায়। কোদাল ও শাবলের অনুরূপ ভূমিকা পালনের জন্য কাঠ ও পাথরের হাতিয়ার ছিল কৃষি উপকরণ।


যখন কৃষি এবং অন্যান্য উৎপাদন, যেমন পশু পালন, বৃহৎ আয়তনে শুরু হল তখন আর নারীর পক্ষে সেগুলিতে শ্রম ও সময় দেওয়া সম্ভব হল না তাদের পারিবারিক ও সন্তান পালনের দায়িত্ব এবং দেহ শক্তির সীমাবদ্ধতার জন্য। এইভাবে নারী গৃহকর্মে ব্যস্ত হয়ে থাকল আর পুরুষ বনে পশু শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের কাজ ছেড়ে দিয়ে বৃহৎ আয়তনে কৃষি, পশুপালন, বস্ত্রবয়ন এবং মৃৎ পাত্র নির্মাণ ইত্যাদি কাজ করতে শুরু করল। পরিণতিতে নদী তীরবর্তী উর্বর এলাকায় নগর, রাষ্ট্র ও বৃহৎ সমাজ গড়ে উঠল। উৎপাদন ও সমাজ যত বৃহদায়তন ও জটিল হল সমাজে নারীর ভূমিকা তত গৌণ হয়ে এল। এর সুযোগ নিয়ে পুরুষ নিজের নিরংকুশ সামাজিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল।


কিন্তু সভ্যতার বিকাশের পরেও সমাজে নারীর ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণ অনেক কাল পর্যন্ত কিছু পরিমাণে টিকে ছিল। আমরা তার প্রমাণ পাই প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধুতে নারী অধিকারের বিভিন্ন প্রকাশের মধ্যে।


কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধ বা সমরবাদের শক্তিবৃদ্ধি নারীর অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটায়। বিশেষত যুদ্ধ ও সমরবাদ নারীর অবস্থার অবনতি ঘটাতে বাধ্য। কারণ যুদ্ধে নারীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখা সাধারণত সম্ভব হয় না। অশ্ব ও লৌহ আবিষ্কারের পর যখন তামা ও ব্রোঞ্জের নমনীয় অস্ত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করার যুগের অবসান হল তখন যুদ্ধ হাজির হল এক প্রচণ্ড শক্তি ও গতি এবং বিশাল আয়তন নিয়ে। অশ্বের গতি মানুষের জন্য হাজার মাইলের ব্যবধানকে তুচ্ছ করে দিল। যে পথ মানুষ আগে পায়ে হেঁটে বৎসর ধরেও পার হতে পারত না তা ঘোড়ার পিঠে চেপে পার হওয়া এখন এক মাসেরও ব্যাপার রইল না। এই অবস্থায় মানুষ যতটা প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটাল তার তুলনায় যুদ্ধ ও ধ্বংস দ্বারা সভ্যতার শক্তির ক্ষয়ও কম করল না। যুদ্ধ ছাড়াও সুদীর্ঘ কাল ধরে চাষাবাদ, ভূমিক্ষয়, ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সভ্যতার শক্তি ফুরিয়ে এল। এক সময় বিশাল অঞ্চল জুড়ে সভ্যতায় ক্ষয় ও রাত্রি নেমে এল। একই সঙ্গে সব সভ্যতায় নয়। বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সভ্যতায়। আর সেই সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে দেখা দিল নারীর অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি। সমাজকে বিকশিত করার শক্তি যখন মানুষ হারিয়েছে তখন তাকে কোনও রকমে ধরে রাখার জন্য রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দিতে শুরু করেছে। নূতন নূতন আবিষ্কার ও উদ্ভাবন আর মানুষের সামনে নূতন বিকাশের সম্ভাবনা হাজির করতে পারছে না। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধুর আলো অনেক আগেই নিভে গেছে। গ্রীসের জ্ঞানদীপ্ত সভ্যতার আলোও নিভে গেছে। গ্রীক সভ্যতার ভোগলিপ্সু ও সমরবাদী সন্তান রোমও বিধ্বস্ত।


সভ্যতার এই সঙ্কটের কালে সহিষ্ণুতা, সুকুমার বৃত্তি, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই সবের দিকে সমাজের শ্রম ও মেধা পরিচালিত করার উপায় কোথায়? নির্দয় স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র তখন সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করতে বাধ্য এবং সেই সথে চেষ্টা হয় রক্ষণশীলতা দ্বারা সমাজকে কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধবার। যেহেতু সমাজকে বাঁধবার বস্তুগত শক্তি, যান্ত্রিক ও উৎপাদনশীলতার শক্তি আর সেভাবে থাকে না তাই তার স্থান দখল করে ভাববাদী, অজাগতিক ও অলৌকিক বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম। এই রকম অবস্থায় সামাজিক স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের সহযোগী হয়েছে নূতন ধর্মগুলি। একদিকে মুষ্টিমেয় সমাজ শাসকের তলোয়ার ও চাবুকের শাসন, অপরদিকে ধর্মের দ্বারা চেতনা নিয়ন্ত্রণ মানুষকে পরিবর্তিত অবক্ষয়ী অবস্থার উপযোগী করেছে। ধর্ম ব্যাপক জনগণের নিদারুণ শ্রম ও বঞ্চনার বিনিময়ে মুষ্টিমেয় শাসক ও সুবিধাভোগীর শাসন, নেতৃত্ব ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করেছে এবং নারীর উপর সমাজ শাসক পুরুষের কর্তৃত্ব ও আধিপত্য নিশ্চিত করেছে। ফলে হিন্দু, ইহুদী, বৌদ্ধ, খ্রীষ্ট এবং ইসলাম ইত্যাদি সকল ধর্ম নারীকে কঠোর শিকলে বাঁধতে চেয়েছে। কিন্তু ইসলাম অনেক বেশী উগ্র ও আক্রমণাত্মক।


ইসলাম নারীকে কিছু ক্ষেত্রে দয়া করতে পারে, কিন্তু এতটুকু শ্রদ্ধা করতে পারে না। তার চিন্তাপদ্ধতিই নারীকে অবজ্ঞা করতে শিখায়। নারীকে থাকতে হবে পুরুষের কর্তৃত্বে এবং পর্দার অন্তরালে বা অবরোধে এমন বিধান নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গীকে করে অবজ্ঞাপূর্ণ। অন্যদিকে নারী-পুরুষ সহজ মেলামেশার সমস্ত পথ রুদ্ধ করে রাখায় নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ হয়ে উঠে দুর্নিবার। কাজেই একাকী বা দুর্বল অবস্থায় নারীকে পেলে পুরুষের ধর্ষবাদী প্রবণতা জেগে ওঠা স্বাভাবিক। বিশেষ করে যে ধর্ম মানুষের সুকুমার সমস্ত বৃত্তির চর্চা রুদ্ধ করে রাখায় মানুষের মানবিক বিকাশ ঘটতে পারে না সেই ধর্মে পুরুষের মধ্যে ধর্ষবাদী প্রবণতার আধিক্য দেখা দিলে বিস্ময়ের কিছু নাই।


অবশ্য নারী ধর্ষণ প্রবণতা ইসলামের জন্য খুব স্বাভাবিক। শুধু ধর্মের তত্ত্বগত দৃষ্টিভঙ্গী যে এর জন্য দায়ী তা নয়। বরং এর জন্য বেশী দায়ী ইসলামের বিশেষ বিকাশ পদ্ধতি। এ কথা সুবিদিত যে, ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যুদ্ধ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যে সব উপজাতি কিংবা গোত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত না মুহাম্মদ তাদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন এবং সেই সব যুদ্ধে পরাজিতদের বহুজনকে হত্যা করার পর ধন-সম্পদ লুণ্ঠনের সঙ্গে অসংখ্য নারী, পুরুষ ও শিশুকে বন্দী করে আনা হয়েছে। এরা হয়েছে দাস-দাসী। এই সব বন্দীর মধ্যে থাকত প্রচুর যুবতী নারী। মুহাম্মদ এইসব বন্দী নারীদেরকেও অন্যান্য বন্দী ও মালের মত ভাগ-বাটোয়ারা করতেন। তিনি নিজে যেমন ভাগ নিতেন তেমন অন্যদেরকেও দিতেন। অন্যের লুণ্ঠিত স্ত্রী-কন্যাদেরকে এইভাবে দাসী করা এবং এই অসহায় নারীদের ইচ্ছা ও মর্যাদার তোয়াক্কা না করে তাদের ধর্ষণ করাও ইসলামের বিচারে বৈধ। আমরা দেখেছি যে, কুরআন দাসী সম্ভোগ বৈধ করেছে। আমরা অনেক হাদীস থেকে যুদ্ধ বন্দী নারীদের প্রতি এই বিধানের প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে পারি। তবে মুহাম্মদ দলবদ্ধভাবে পাইকারী ধর্ষণ পছন্দ করতেন না। যার জন্য তিনি তাঁর যোদ্ধাদেরকে বন্দী নারীদের ভাগবাটোয়ারা শেষ করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে বলতেন। মুহাম্মদের যুদ্ধবন্দী নারীদের প্রতি কেমন আচরণ করা হত তা বোঝার জন্য আমরা এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করছিঃ


“আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, কোন এক জেহাদে শত্রু পক্ষের লোক আমাদের হাতে বন্দী হইল। (নারী বন্দিনীদের সুব্যবস্থাপনাকল্পে শরীয়ত সম্মত বৈধ সম্পর্ক সূত্রে) তাহারা আমাদের করায়ত্তে আসিলে পর আমরা নিজ নিজ প্রাপ্ত রমণীকে ব্যবহার করিলাম, কিন্তু গর্ভ নিরোধ উদ্দেশ্যে আমরা আয্‌ল* করিয়া থাকিতাম। এই সম্পর্কে আমরা রসূলুল্লাহ (দঃ) কে জিজ্ঞাসা করিলে হযরত (দঃ) চমকিত স্বরে বলিলেন ‘আচ্ছা তোমরা এরূপ করিয়া থাক?’ হযরত (দঃ) পুনঃ পুনঃ তিনবার এইভাবে প্রশ্ন করিলেন এবং আরও বলিলেন, ‘কেয়ামত পর্যন্ত যত লোক (আল্লাহ্‌তায়ালার নিকট) নির্ধারিত রহিয়াছে তাহার প্রত্যেকটি লোক অবশ্য অবশ্য জন্ম লাভ করিবেই।”**


উপরোক্ত হাদীস থেকে হাদীসের ব্যাখ্যাকারের মতে “নারী বন্দিনীদের সুব্যবস্থাপনাকল্পে শরীয়ত সম্মত বৈধ সম্পর্ক সূত্রে”(!) ইসলামের যোদ্ধারা যুদ্ধবন্দী ও লুণ্ঠিত নারীদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করত তা যেমন জানা যায় তেমন মুহাম্মদ যে জন্মনিয়ন্ত্রণে বিশ্বাস করতেন না তাও জানা যায়।


____________________________________________________________________________________________________________________

* নারীর যৌনাঙ্গের বাইরে পুরুষের শুক্রপাত ঘটানো।

** বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), ষষ্ঠ খণ্ড। পৃষ্ঠাঃ ২১৫

____________________________________________________________________________________________________________________


সুতরাং আমাদের মত ইসলামী সমাজে নারী নিগ্রহের এই ব্যাপকতার মূল উৎস কোথায় তা বুঝতে এখন আমাদের অসুবিধা হবার কথা নয়। চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং গ্রহণের সময় মুসলমান সমাজ লুণ্ঠন ও ধর্ষণের যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তা তার মনস্তত্ত্ব ও চরিত্রের মধ্যে গেঁথে গেছে। শত শত বৎসর যাবত ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যুদ্ধ যেমন অনুপস্থিত থাকে নাই তেমন পাশাপাশি অমুসলিম হত্যা, নির্যাতন এবং পরাজিতদের নারী নিগ্রহও অনুপস্থিত থাকে নাই। ইসলাম যেখানে গেছে তার নারী অধিকার হানিকর ধর্মীয় তত্ত্বের পাশাপাশি এই অভ্যাস বা প্রবণতাও ছড়িয়ে দিয়েছে।


আমাদের দেশে অনেক ইসলামপন্থী ব্যক্তি ইসলামের এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই ১৯৭১-এ পাক হানাদার বাহিনীর ব্যাপক আয়তনে নারী ধর্ষণকে ইসলাম সম্মত হিসাবে অনুমোদন দিয়েছে। নারী নিগ্রহ, ধর্ষণ দুঃখজনক হলেও ইতিহাসে নূতন কিছু নয়। যদিও মানুষ ক্রমেই অধিকতর সভ্য ও মানবিক হচ্ছে তবু তার পশুত্বের এই স্তরকে অতিক্রম করতে পারে নাই। কিন্তু মানুষকে মানুষ হতে হলে তার আর সব আমানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর মত নারীকে অবজ্ঞা ও হেয় করার এবং সর্বোপরি তার প্রতি সন্ত্রাসী যৌন আগ্রাসনের মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। এর জন্য সমাজে যে নূতন মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে হবে তার জন্য প্রয়োজন এক নূতন সামাজিক ও নৈতিক আন্দোলন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিরাট সমস্যা দেখা দেয় যখন কোনও ধর্ম নারীর প্রতি যৌন আগ্রাসনের দৃষ্টিভঙ্গীকে কোনও না কোনও ভাবে সমর্থন করে। বৌদ্ধ বা খ্রীষ্ট ধর্ম অন্ততপক্ষে ধর্মীয়ভাবে বা নৈতিকভাবে কোনও নারীর প্রতিই এমন কি সে শত্রু পক্ষের হলেও, এমন আচরণ সমর্থন করে না যা ইসলাম করে। এর ফলে ইসলামী সমাজ এই ধরনের নারী নিগ্রহের মধ্যে নৈতিকভাবে অন্যায় দেখতে পায় না। এই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই ইসলামী সমাজ ইসলাম প্রচারে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধে অন্যায় দেখতে পায় না। নিঃসন্দেহে খ্রীষ্ট ধর্মেও এক সময় ধর্ম প্রচারে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধ প্রবেশ করেছিল। কিন্তু সেটা অনেক পরে এবং সেটা যীশুর আদর্শ ছিল না। অর্থাৎ মূল ধর্মে এর পক্ষে কোনও সমর্থন নাই। কিন্তু ইসলাম শান্তির এই পথ গ্রহণ করে নাই। মুহাম্মদ তাঁর ধর্ম প্রচারে জবরদস্তি ও যুদ্ধের পথ গ্রহণ করেন, আর এইভাবে তার ধর্ম ও সমাজকে এক অস্বাভাবিক বিশিষ্টতা দান করেছেন, যা না বুঝলে আমরা ইসলামী সমাজের প্রকৃত সমস্যা যেমন বুঝতে পারব না তেমন তার সমাধানের পথও খুঁজে পাব না।

 

 

 

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের ধর্ম

 

ইসলামপন্থীরা ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে থাকেন। কিন্তু বাস্তবটা হল এই যে, গোটা ধর্মটাই একটা সামরিক ধর্ম কিংবা যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের ধর্ম ছাড়া আর কিছু নয়। মুহাম্মদ মদীনায় সমর্থন ও আশ্রয় লাভের পর সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের পথ গ্রহণ করেন। বিশেষত তাঁর লুণ্ঠন অভিযান পরিচালিত হত বিভিন্ন দিকে। এই অবস্থায় নিজেদের বাণিজ্য পথ ও বাণিজ্য বহরের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কুরাইশরা মদীনা আক্রমণ করতে বাধ্য হয়। মক্কার সঙ্গে মদীনার প্রথম যে যুদ্ধ হয় তা বদরের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। পর বৎসর কুরাইশ বাহিনী পুনরায় মদীনা আক্রমণ করে। ওহোদের যুদ্ধ নামে পরিচিত এই লড়াইয়ে মুহাম্মদের নেতৃত্বাধীন মদীনার ইসলামী বাহিনী পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ হয় এবং স্বয়ং মুহাম্মদ গুরুতরভাবে আহত হন। অথচ কুরাইশরা মুহাম্মদকে হত্যা না করে চলে যায়।


ওহোদের যুদ্ধে বিজয়ী কুরাইশরা ইচ্ছা করলেই মুহাম্মদকে হত্যা করতে পারত। কুরাইশরা মুহাম্মদকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে নাই বরং তাকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিল যাতে মুহাম্মদ শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর ধর্ম প্রচার করেন এবং বাড়াবাড়ি না করেন। এই একই মনোভাব থেকে মক্কায় এই উদ্ধত ও আপোসহীন পিতৃধর্মদ্রোহী মুহাম্মদকে প্রায় তেরো বৎসর তাঁর স্বগোত্রীয় কুরাইশরা সহ্য করেছিল এবং তাঁর ধর্মীয় মতবাদের বিরোধিতা করলেও তাঁকে হত্যা করে নাই। বস্তুত কুরাইশ বংশীয় মুহাম্মদ যে আল্লাহ্‌কে একমাত্র দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে উপাসনা করতে বলছিলেন তা আরব বা কুরাইশদেরও এক দেবতা যার স্ত্রী ও তিন কন্যা ছিল। আমরা কুর্‌আন থেকে লাত, উয্‌যা ও মানাত নামে তার এই তিন কন্যার কথা জানতে পারি। কুর্‌আন বলছে যে, আল্লাহ্‌র স্ত্রী ও কন্যা থাকার কথা একটা মিথ্যা প্রচার মাত্র, বরং আল্লাহ্‌ এক ও অদ্বিতীয়। কাজেই আল্লাহ্‌র পূজায় কুরাইশদের আপত্তি থাকবার কথা নয়, তাদের আপত্তি অন্যসব দেবতা এবং মূর্তি পূজা রদ করায়।


এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, ইসলামের মাধ্যমে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকামী মুহাম্মদ যতটা আপোসহীন এবং উগ্র ছিলেন কুরাইশরা ততটা ছিল না এবং মুহাম্মদ মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই ছলে, বলে অথবা কৌশলে যে কোনও প্রকারেই হোক তাঁর ধর্মীয় মতবাদ এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য বদ্ধপরিকর হন। সুতরাং বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায় ও গোত্রের সঙ্গে তাঁর সকল চুক্তিই ছিল কৌশল মাত্র। তিনি এই সকল চুক্তি দ্বারা এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের শত্রুতা ও দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করেন এবং যুদ্ধের মাধ্যমে নিজ প্রভাব বলয় সম্প্রসারিত করেন। শান্তিপূর্ণভাবে ধৈর্যের সঙ্গে ধর্ম প্রচারের কোনও ইচ্ছা বা মনোভাবই তাঁর ছিল না। নিম্নলিখিত হাদীসে মুহাম্মদের মনোভাব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিতঃ


“তিনিই (ইবনে উমর রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন রসূলুল্লাহ্‌ সঃ বলিয়াছেনঃ আমার প্রতি আদেশ হইয়াছে লড়াই করিবার জন্য লোকদের বিরুদ্ধে যতক্ষণ না তাহারা সাক্ষ্য দেয় যে, নাই কোন মাবুদ খোদা ভিন্ন এবং মুহম্মদ তাঁর রসূল এবং কায়েম করে নামায এবং আদায় করে যাকাত। যখন তাহারা উহা করিবে, তাহারা নিজেদের রক্ত ও ধন বাঁচাইবে আমা হইতে ইসলামের প্রাপ্য* বাদে এবং তাহাদের বিচার থাকিবে (আন্তরিকতা সম্বন্ধে) খোদার কাছে।”**

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* “রক্ত সম্বন্ধে ইসলামের প্রাপ্য এই যে, তিনটি কাজের কোন একটি কাজ করিলে ইসলাম প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়। (১) অন্যায়ভাবে কাহাকেও হত্যা করিলে; (২) বিবাহসূত্রে যৌনমিলন হওয়ার পর যিনা করিলে; (৩) ইসলাম ত্যাগ করিলে। ধন সমন্ধে ইসলামের প্রাপ্য হইতেছে যকাৎ।”¬ তজরীদুল বুখারী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, প্রথম সংস্করণ, নভেম্বর, ১৯৫৮।


**  তজ্‌রীদুল বুখারী। ঐ । পৃষ্ঠাঃ ১৮-১৯

____________________________________________________________________________________________________________________


সুতরাং অমুসলিমদের সঙ্গে মুহাম্মদের সকল চুক্তিই ছিল ছলনা বা ধাপ্পা মাত্র। অমুসলিম গোত্র বা উপজাতির সঙ্গে প্রয়োজন ফুরালেই চুক্তি ভঙ্গ করায় তাঁর ছল বা অজুহাতের অভাব হয় নাই। অবশ্য এই ধরনের চুক্তি ভঙ্গ নূতন ঘটনা নয়। প্রায় সব আধিপত্যবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনেতাই কম-বেশী এটা করে থাকে। তবে অন্যদের সঙ্গে মুহাম্মদের তফাৎ এইখানে যে, মুহাম্মদ এটা করেছেন ধর্মের নামে, মানুষের অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যবহার করে।


যুদ্ধ ইসলাম ধর্মকে এক বিশিষ্টতা দিয়েছে। আমরা কুরআনে যুদ্ধের সপক্ষে বহু আয়াত দেখতে পাই এবং বহু হাদীস থেকে বলপূর্বক ইসলাম গ্রহণ করাবার উদ্দেশ্যে লড়াই, হত্যা ও লুণ্ঠন সম্পর্কে বহু তথ্য পাই। ইসলাম তার প্রসারে যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের উপর কতটা গুরুত্ব দিয়েছে তা কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াত কয়টি থেকে বোঝা যায়ঃ


২১৬। তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়; কিন্তু তোমরা যাহা পছন্দ কর না সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা পছন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্‌ জানেন; তোমরা জান না।

২ সূরা বাকারা


৬০। তোমরা তাহাদিগের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত রাখিবে এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করিবে আল্লাহ্‌র শত্রুকে, তোমাদিগের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদিগকে যাহাদিগকে তোমরা জান না, আল্লাহ্‌ জানেন; আল্লাহ্‌র পথে তোমরা যাহা কিছু ব্যয় করিবে উহার পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হইবে এবং তোমাদিগের প্রতি জুলুম করা হইবে না।

৮ সূরা আনফাল


৫। অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হইলে মুশরিকদিগকে (বহুদেবতাবাদী বা অংশীবাদীদেরকে) যেখানে পাইবে হত্যা করিবে, তাহাদিগকে বন্দী করিবে, অবরোধ করিবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাহাদিগের জন্য ওৎ পাতিয়া থাকিবে; কিন্তু যদি তাহারা তওবা (অনুতাপ প্রকাশপূর্বক ইসলাম গ্রহণ) করে, সালাত কায়েম করে (নামায পড়ে) ও যাকাত দেয় তবে তাহাদিগের পথ ছাড়িয়া দিবে,আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৯ সূরা তাওবা


৩৮। হে মুমিনগণ! তোমাদিগের হইল কী যে, যখন তোমাদিগকে আল্লাহ্‌র পথে অভিযানে বাহির হইতে বলা হয় তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হইয়া ভূতলে ঝুঁকিয়া পড়? তোমরা কি পরকালের তুলনায় পার্থিব জীবনে পরিতুষ্ট হইয়াছ? পরকালের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগের উপকরণ তো অকিঞ্চিতকর!


৩৯। যদি তোমরা অভিযানে বাহির না হও, তবে তিনি তোমাদিগকে মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদিগের স্থলাভিষিক্ত করিবেন এবং তোমরা তাঁহার কোনই ক্ষতি করিতে পারিবে না। আল্লাহ্‌ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।

৯ সূরা তাওবা


৪১। অভিযানে বাহির হইয়া পড়, হালকা অবস্থায় হউক অথবা ভারি অবস্থায়*, এবং সংগ্রাম কর আল্লাহ্‌র পথে তোমাদিগের সম্পদ ও জীবন দ্বারা। উহাই তোমাদিগের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানিতে।

৯ সূরা তাওবা

 

___________________________________________________________________________________________

* অর্থাৎ লঘু রণসম্ভার কিংবা গুরু রণসম্ভার নিয়ে যুদ্ধাভিযানে বের হতে বলা হচ্ছে। - লেখক।

___________________________________________________________________________________________

 


৭৩। হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও উহাদিগের প্রতি কঠোর হও; উহাদিগের আবাসস্থল জাহান্নাম, উহা কত নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তনস্থল!

৬৬ সূরা তাহ্‌রীমঃ ৯ আয়াত


১২৩। হে মুমিনগণ! কাফিরদিগের মধ্যে যাহারা তোমাদিগের নিকটবর্তী তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ কর এবং উহারা তোমাদিগের মধ্যে কঠোরতা দেখুক। জানিয়া রাখ, আল্লাহ্‌ মুক্তাকীদিগের (ধর্মভীরুদের) সহিত আছেন।

৯ সূরা তাওবাঃ ১২৩


কুরআনের এই ধরনের বহু আয়াতে কাফির, মুশরিক কিংবা মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ও কঠোর হতে বলা হয়েছে। যারা মুহাম্মদের ধর্মাবলম্বী নয় তারা সবাই কাফির বা কাফের যার অর্থ হল সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। মুশ্‌রিক হল পৌত্তলিক বা বহু দেবতাবাদী অর্থাৎ অংশীবাদী। আর মুনাফিক বা মোনাফেক হল যারা চাপে পড়ে বাইরে বা মুখে ইসলাম গ্রহণ করলেও কিংবা ইসলামের প্রতি সমর্থন জানালেও অন্তরে ইসলাম বিরোধী।


কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলামের সবচেয়ে বড় যুক্তি তলোয়ার। মূল কথা হল ইসলাম বা মুহাম্মদের প্রচারিত ধর্ম যেহেতু একমাত্র সত্য ধর্ম সেহেতু এটা গ্রহণ করতেই হবে এবং মুহাম্মদের নিরংকুশ ও স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্যও গ্রহণ করতে হবে। যারা তা করবে না তাদের বিরুদ্ধে আছে তলোয়ার। আর যারা এই তলোয়ার চালনা করবে তাদের জন্য রয়েছে মৃতুøর পর অনন্ত সুখভোগ। বোখারীর নিম্নোক্ত হাদীসে বলা হয়েছেঃ


“হযরত রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহ্‌ আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন, তোমরা শুনিয়া ও জানিয়া রাখিও নিশ্চয় বেহেশ্‌ত তরবারীর ছায়াতলে।”*

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক। পৃষ্ঠাঃ ৩০।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

ইসলাম প্রচারে যুদ্ধের গুরুত্ব কত বেশী ছিল তা নিম্নবর্ণিত হাদীস থেকেও বোঝা যায় যেখানে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ করণীয় হিসাবে আল্লাহ্‌-মুহাম্মদে বিশ্বাসের পরই জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধকে স্থান দিয়েছেনঃ


“আবু হুরাইরা রাঃ হইতে বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ্‌ সঃ কে জিজ্ঞাসা করা হইল, ‘কোন আমল (কর্ম, চর্চা) সর্বশ্রেষ্ঠ?’ তিনি বলিলেন, ‘খোদা ও তাঁহার রসূলে বিশ্বাস।’ জিজ্ঞাসা করা হইল, ‘তারপর কী?’ তিনি বলিলেন, ‘খোদার পথে জিহাদ।’ জিজ্ঞাসা করা হইল, ‘ তাপর কী? তিনি বলিলেন, ‘ত্রুটিশূন্য হজ্জ্‌।’*


মুহাম্মদ শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। কথা শুনে ইসলাম গ্রহণ করলে ভাল, তা না হলে আছে তলোয়ার বা যুদ্ধ। এবং এই ধর্ম এমনই এক ধর্ম যা মুহাম্মদকে শুধু ধর্মনেতা করে না, তা তাকে একই সঙ্গে করে রাষ্ট্রনেতা বা শাসকও। অর্থাৎ আল্লাহ্‌ ও ধর্মের নামে মুহাম্মদের শুধু অনুসারী নয়, প্রজাও হতে হবে। আর ধর্মের মাধ্যমে নূতন সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে মুহাম্মদ যে সব বর্বরতা ও নৃশংসতা করেছেন তার কিছু সাক্ষ্য আমরা পাই তাঁর বহু সংখ্যক সাহাবা বা সঙ্গী কর্তৃক বর্ণিত বিভিন্ন হাদীসে। একটি হাদীসে আমরা তাঁর খয়বর অভিযান সম্পর্কে জানতে পারিঃ


“আনাস (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, খয়বর অভিযান কালে হযরত নবী (সঃ) ভোর বেলা সেই বস্তিতে প্রবেশ করিলেন, তথাকার অধিবাসীগণ তখন সবেমাত্র কোদাল ইত্যাদি কাঁধে লইয়া কার্যে যাত্রা করিতেছিল। তাহারা মোসলমান সৈন্য দলকে দেখা মাত্র দ্রুত কিল্লার ভিতর যাইয়া আশ্রয় লইল। হযরত নবী (সঃ) তখন স্বীয় হস্তদ্বয় উত্তোলন করিয়া - ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি প্রদান করতঃ বলিলেন, খয়বর ধ্বংস হউক; আমরা যেই বস্তিতে প্রবেশ করি সেই বস্তির জন্য ভাগ্য বিপর্যয় অনিবার্য।”**


অপর একটি হাদীস থেকে আমরা মুহাম্মদের হত্যা ও লুণ্ঠন সম্পর্কে জানতে পারিঃ


“আবদুল্লাহ্‌ ইবন উমর রাঃ হইতে বর্ণিত আছে, নবী সঃ বনু মুসতালিক গোষ্ঠীর উপর এমন অবস্থায় হঠাৎ আক্রমণ করেন যখন তাহারা অসাবধানে ছিল এবং তাহাদের পশুগুলিকে পানি খাওয়াইবার জন্য লইয়া যাওয়া হইতেছিল। তিনি তাহাদের যোদ্ধাদিগকে হত্যা করিলেন এবং তাহাদের স্ত্রীলোক ও বালকদিগকে কয়েদ করিলেন। সেই দিন তিনি জুওইরিয়া রাঃ-কে পাইয়াছিলেন।”***

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* তজরীদুল বুখারী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী। পৃষ্ঠাঃ ১৯।

 

**  বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা), তৃতীয় খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক। পৃষ্ঠাঃ ৬২।

 

***  তজরীদুল বুখারী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী। পৃষ্ঠাঃ ৪৮৪।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

নিম্নবর্ণিত হাদীসেও আমরা ইসলাম প্রচারে নৃশংসতার নমুনা পাইঃ


“আবদুল্লাহ্‌ ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম খালেদ ইবনে অলীদ (রাঃ)কে বনু-জযীমা গোত্রের প্রতি প্রেরণ করিলেন। তিনি তথায় পৌঁছিয়া তাহাদিগকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানাইলেন। তাহারা (তাড়াহুড়া ও সন্ত্রস্ততার মধ্যে) ভালভাবে ‘আমরা ইসলাম গ্রহণ করিলাম’ বাক্যটির উক্তি করিতে না পারিয়া ‘আমরা নিজ ধর্ম ত্যাগ করিলাম, নিজ ধর্ম ত্যাগ করিলাম’ বলিল।


(তাহারা স্পষ্টরূপে ইসলাম গ্রহণের স্বীকারোক্তি না করায়) খালেদ (রাঃ) (তাহাদের প্রতি বিদ্রোহীদের সম্পর্কে গ্রহণীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করিলেন-) তাহাদিগকে প্রাণদণ্ড দান ও বন্দী করিতে আরম্ভ করিলেন এবং বন্দীগণকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমাদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিলেন। একদিন তিনি আদেশ করিলেন যে, প্রত্যেকে নিজ নিজ বন্দীকে হত্যা করিয়া ফেলিবে। তখন আমি বলিলাম, আমি স্বীয় বন্দীকে হত্যা করিব না এবং আমার সঙ্গীগণের মধ্যেও কেহ কোন বন্দী হত্যা করিবে না।


আমরা যখন প্রত্যাবর্তন করিয়া হযরতের নিকট পৌঁছিলাম তখন আমরা সম্পূর্ণ ঘটনা হযরতের গোচরীভূত করিলাম। হযরত রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম ঘটনা শ্রবণ করিয়া স্বীয় হস্ত উত্তোলন করতঃ বলিলেন, ‘হে আল্লাহ্‌! খালেদ যাহা করিয়াছে উহার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নাই।’ এইরূপে দুইবার বলিলেন।”*


_________________________________________________________________________________

* বোখারী শরীফ, (বাংলা তরজমা), তৃতীয় খণ্ড। পৃষ্ঠাঃ ৩১৯।

_________________________________________________________________________________

 

ইসলাম প্রচার মূলত কীভাবে হয়েছে তা বোঝার জন্য এই একটি হাদীস যথেষ্ট। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য জযিমা গোত্রের জীবিত ধর্মান্তরিত মুসলমানদেরকে পরে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও খালেদের বিচার বা শাস্তি কিছুই হয় নাই। কারণ খালেদ যা-ই করুন ইসলাম প্রচারের জন্যই তো করেছেন, তবে এক্ষেত্রে ভুল বুঝে যারা তলোয়ারের ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে স্বীকৃত হয়েছিল তাদেরকেই হত্যা করেছিলেন। কিন্তু যে ব্যক্তি মুহাম্মদের একনায়কী আনুগত্য স্বীকার করবে না তাকে হত্যা ও পীড়ন করা বৈধ বা ইসলাম সম্মত।


যুদ্ধ ইসলামকে আর একটি বৈশিষ্ট্য দান করেছে তা হল লুণ্ঠনবৃত্তি। মুহাম্মদ যুদ্ধ করার জন্য তাঁর অনুসারীদেরকে শুধু আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয় এবং স্বর্গের লোভ দেখান নাই সেই সঙ্গে যুদ্ধে অপরের সম্পদ লুণ্ঠনেরও লোভ দেখিয়েছেন। এই লুণ্ঠনও ছিল ইসলামের যোদ্ধাদের প্রেরণার অন্যতম উৎস। লুণ্ঠনবৃত্তির সপক্ষে কুরআনে বলা হচ্ছে,


৬৯। যুদ্ধে যাহা তোমরা লাভ করিয়াছ তাহা বৈধ ও উত্তম বলিয়া ভোগ কর ও আল্লাহ্‌কে ভয় কর, আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

৮ সূরা আনফাল

কিংবা


২০। আল্লাহ্‌ তোমাদিগকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যুদ্ধে লভ্য বিপুল সম্পদের যাহার অধিকারী হইবে তোমরা। তিনি ইহা তোমাদিগের জন্য ত্বরান্বিত করিয়াছিলেন এবং তিনি তোমাদিগ হইতে মানুষের হস্ত নিবারিত করিয়াছেন যেন তোমরা কৃতজ্ঞ হও এবং ইহা মুমিনদিগের জন্য এক নিদর্শন এবং আল্লাহ্‌ তোমাদিগকে পরিচালিত করেন সরল পথে।


২১। আরও বহু সম্পদ রহিয়াছে যাহা এখনও তোমাদিগের অধিকারে আসে নাই, উহা* তো আল্লাহ্‌র নিকট রক্ষিত আছে। আল্লাহ্‌ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।

৪৮ সূরা ফাত্‌হ্‌


অর্থাৎ যারা মুহাম্মদের ধর্মাবলম্বী ও প্রজা নয় তাদের সম্পদ লুট করতে প্ররোচিত করা হচ্ছে আল্লাহ্‌র নামেই। এইভাবে আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয়, স্বর্গে অনন্ত সুখের লোভ এবং বাস্তব জীবনে লুটের লোভ দেখিয়ে মুহাম্মদ গোটা সমাজকে করেছেন যুদ্ধপরায়ণ।


এই রকম এক যুদ্ধপরায়ণ ধর্ম ও সমাজ সংগঠকের সামরিক শৃংখলার প্রতি আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। কঠোর সামরিক শৃঙ্খলার প্রতি এই আকর্ষণের প্রকাশ শুধু ধর্মীয় উপাসনা পদ্ধতিতে ঘটে নাই, উপরন্তু কুরআনের আয়াতেও আমরা দেখি তার প্রকাশ। নীচের আয়াত কয়টি কবিতার ভাষায় পাঠক বা শ্রোতার কল্পনায় এক যোদ্ধা বাহিনীর চিত্র আঁকেঃ


১। শপথ তাহাদিগের যাহারা সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান**

২। ও যাহারা কঠোর পরিচালক

৩। এবং যাহারা ‘যিক্‌র্‌’*** আবৃত্তিতে রত -

৪।নিশ্চয়ই তোমাদিগের ইলাহ্‌ এক।

৩৭ সূরা সাফ্‌ফাত

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* এখানে মুসলমানদের জন্য ভবিষ্যত আরও বহু বিজয় ও লুটের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।


**  তারা হচ্ছে ফেরেশ্‌তা কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রের মুজাহিদ বা যোদ্ধা কিংবা নামাযে দণ্ডায়মান মুসল্লীগণ।


***  অর্থাৎ কুরআন বা তাসবীহ্‌।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

বস্তুত গোটা ধর্মটাই একটা একনায়কী সামরিক সমাজের ধর্ম বিশেষ। ইসলাম সমগ্র সমাজকে যেন পরিণত করেছে এক কঠোর সমর নায়কের অধীনে শৃঙ্খলাবদ্ধ সামরিক শিবিরে। দৈনিক পাঁচবার বাধ্যতামূলক নামায, মসজিদে সারিবদ্ধভাবে নামায, শুক্রবার মসজিদে জুম্মার নামাযে সকলের বাধ্যতামূলক সম্মিলন, এক মাস ব্যাপী উপবাস বা রোযা ইত্যাদি এক কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে সবাইকে থাকতে বাধ্য করে। এক মাস উপবাসের কঠোর আত্মপীড়ন মানুষকে করে তোলে উগ্র ও হিংস্র। এর সঙ্গে আছে গলায় ছুরি চালিয়ে প্রাণী হত্যার এক নিষ্ঠুর পদ্ধতি। এটা মানুষের নিষ্ঠুরতাকে বাড়িয়ে তোলে। একদিকে কঠোর ও নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উপাসনা, অন্যদিকে যা কিছু মনকে সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি অনুরাগী করে, মনকে কোমল করে এবং স্বাচ্ছন্দ্য বা আরাম-আয়েশের প্রতি আকৃষ্ট করে সে সব কিছুর প্রতিই কঠোর ও আক্রমণাত্মক মনোভাব এই ধর্মের একটা বৈশিষ্ট্য। তাই সঙ্গীত, নৃত্য, অভিনয়, চিত্রকলা, সাহিত্য বা কাব্য এই সবের কোনও স্থানই এই ধর্মে নাই। বরং এগুলিকে নিরুৎসাহ ও সম্ভব হলে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সঙ্গীত সম্পর্কে নিম্নবর্ণিত হাদীস থেকে মুহাম্মদের বক্তব্য ও মনোভাব জানা যায়ঃ


“হযরত জাবের (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে - হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ (সঃ) বলিয়াছেন - যে রূপ পানি শস্য উৎপাদন করে, তদ্রূপ গান কপটতা জন্মায়।”*

(তেবরানী)


“যে ব্যক্তি উচ্চৈঃস্বরে গান গায়, আল্লাহ্‌ তাহার জন্য দুই জন শয়তান প্রেরণ করেন। যে পর্যন্ত সে না থামে, সে পর্যন্ত তাহাদের পায়ের দ্বারা তাহাকে দলিত করে।”**



কবি ও কবিতার প্রতি মুহাম্মদের ঘৃণা প্রকাশ প্রায় নিম্নলিখিত হাদীস এবং কুরআনের আয়াত দ্বারাঃ


“হযরত আবু সাইদ খুদরী হইতে বর্ণিত আছে - আরাজ নামক স্থানে আমরা হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) এর সহিত ভ্রমণ কালে একজন কবি কবিতা আবৃত্তি করিতে উপস্থিত হইল। তাহা শুনিয়া তিনি বলিলেন - শয়তানকে ধর। কোন লোকের উদরকে কবিতার দ্বারা পূর্ণ করা অপেক্ষা তাহা পুঁজ দ্বারা পূর্ণ করা অধিকতর উত্তম।”***


____________________________________________________________________________________________________________________

* পবিত্র কোরান ও হাদিছে রাসূল (সাঃ); খন্দকার মাওলানা মোহাম্মদ বশিরউদ্দিন; প্রকাশকঃ কোরান মঞ্জিল লাইব্রেরী, বরিশাল। পৃষ্ঠাঃ ৩০৩।

**  ঐ। পৃষ্ঠাঃ ৩০৩।

***  ঐ। পৃষ্ঠাঃ ৩০১।

____________________________________________________________________________________________________________________


২২৪। এবং কবিদিগকে অনুসরণ করে তাহারা যাহারা বিভ্রান্ত।


২২৫। তুমি কি দেখ না উহারা উদ্‌ভ্রান্ত হইয়া প্রত্যেক উপত্যকায় ঘুরিয়া বেড়ায়?


২২৬। এবং যাহা করে না তাহা বলে।

২৬ সূরা শুআরা


৬৯। অমি রাসূলকে কাব্য রচনা করিতে শিখাই নাই এবং ইহা তাহার পক্ষে শোভনীয় নহে। ইহা তো কেবল এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কুরআন।

৩৬ সূরা য়াসীন


আর প্রাণীর ছবি আঁকা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ সম্পর্কে আমরা নিম্নে তিনটি হাদীস বর্ণনা করছি যা থেকে মুহাম্মদের বক্তব্য জানা যায়ঃ


“ইবনে আব্বাস (রাঃ) আবু তালহা (রাঃ)-এর মুখে শুনিয়াছেন, তিনি বলিয়াছেন যে, হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহ আলাইহে অসাল্লামকে বলিতে শুনিয়াছি যে, (রহমতের) ফেরেশ্‌তা প্রবেশ করে না ঐ গৃহে যেই গৃহে কুকুর আছে এবং ঐ গৃহেও না যেই গৃহে চিত্র ও ছবি আছে।”*


“নিশ্চয় জানিও, আল্লাহ্‌ তাআলার নিকটে তথা আখেরাতে সর্বাধিক কঠিন আজাব ছবি তৈরীকারকদের হইবে।”**

 

“যদি কেহ জীব-জন্তুর ছবি অংকন করা হারাম জানা সত্ত্বেও উহা করে তবে সে কাফের হইয়া যায়। সে যেন হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর উপরে অবতীর্ণ বাণীকে অস্বীকার করিল।***

(আহমাদ)


বহুসংখ্যক হাদীস থেকে আমরা পাই বিলাস ও মূল্যবান দ্রব্যের প্রতি মুহাম্মদের ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী। আমরা একটি হাদীস উদ্ধৃত করছিঃ


“হোজায়ফা (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন, তোমরা স্বর্ণ-রৌপ্যের পাত্রে কিছু পান করিবে না। মোটা বা মিহি রেশমী বস্ত্র ব্যবহার করিবে না। এই সব বস্তু দুনিয়া বা ইহজগতে কাফেরগণ ব্যবহার করে, তোমরা ব্যবহার করিবে পরকাল বা আখেরাতে।”#

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড; হামিদিয়া লাইব্রেরী; পৃষ্ঠাঃ ৩৫৬।

** ঐ । পৃষ্ঠাঃ ৩৫৮।

***  পবিত্র কোরান ও হাদিছে রাসূল (সাঃ)। পৃষ্ঠাঃ ২৮১।

# বোখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, হামিদিয়া লাইব্রেরী। পৃষ্ঠাঃ ৩০৫।

____________________________________________________________________________________________________________________


এইভাবে ইসলাম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি মানুষকে বিমুখ এবং স্থূল ও বর্বর মানসিকতা সম্পন্ন করে তোলে। উন্নত উপকরণ ও বিলাস সামগ্রীর প্রতি ঘৃণাও এসেছে সভ্যতার প্রতি ঘৃণা থেকে। বস্তুত সভ্যতা মানে প্রকৃতি নির্ভর ও অনাড়ম্বর আদিম জীবনের বদলে আরাম-আয়েশ, বিশ্রাম এবং সুখ-সুবিধার জন্য জীবনের আয়োজন। সব মানুষ কম-বেশী এসব চায়।


বিশেষত মানুষের মানসিক বৃত্তির বিকাশ মানুষকে সভ্যতামুখী করে। তাই মনের সূক্ষ্ম অনুভূতি, চিন্তাশক্তি ও মেধাকে নষ্ট করা না গেলে মানুষ সভ্যতা গড়ে তোলে। এই কারণে মানুষ যাতে সভ্য ও সংস্কৃতিবান না হয়, সভ্যতামুখী না হয় সেই জন্য ইসলাম মানুষের চিন্তাশক্তি বা চেতনা নিয়ন্ত্রণের উপর সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগ করেছে। ইসলাম মনে করে এ জীবন অসার এবং পরলোকই সার।


৩২। পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত আর কিছুই নয় এবং যাহারা তাক্‌ওয়া (খোদাভীতি, সংযম, কর্তব্যনিষ্ঠা) অবলম্বন করে তাহাদিগের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেয়; তোমরা কি অনুধাবন কর না?

৬ সূরা আন্‌ আম


৬৪। এই পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক ব্যতীত কিছুই নহে। পারলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন, যদি উহারা জানিত!

২৯ সূরা আনকাবূত


কাজেই সবার কাজ হবে এই জীবনের সুখভোগকে তুচ্ছ করে পরলোকে সুখ লাভ করার চেষ্টা করা। এরই পথ হল আল্লাহ্‌-রাসূল তথা আল্লাহ্‌-মুহাম্মদের আনুগত্য করা, নামায-রোযা করা এবং পরলোকের ধ্যান করা। কিন্তু অন্যান্য সাধারণ ধর্মের মত ইসলাম ব্যক্তির বিশ্বাসের কাছে আবেদন রাখে না, বরং বাধ্যতামূলক দাবী রাখে। এটা বাধ্যতামূলক সামাজিক ধর্ম। প্রায় সব বৃহৎ ধর্ম সামাজিক ধর্মে পরিণত হয়েছে ব্যাপক জনগণ কর্তৃক স্বেচ্ছামূলকভাবে গৃহীত হবার ফলে। কিন্তু ইসলামের পথ ভিন্ন। তার কথা হল হয় তুমি মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করে তার যোদ্ধা সমাজের সদস্য হও, আর নয় তার আনুগত্য ও অধীনতা স্বীকার করে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে জিয্‌য়া কর দাও। এই দাবী প্রত্যাখ্যানের অর্থ হল অস্ত্র এবং যুদ্ধ দ্বারা নিষ্পত্তির পথ গ্রহণ করা। অবশ্য জিয্‌য়া করও ইসলাম বেশী দিন নিবে না। এটা একটা কৌশল মাত্র। ইসলাম গ্রহণের জন্য একটা অন্তর্বর্তী পর্যায় মাত্র যে পর্যায়ে নানানভাবে চাপ, ভীতি ও পীড়ন দ্বারা অধীনস্থদেরকে ইসলামী সমাজের মধ্যে মিশে যেতে বাধ্য করা হবে। কারণ আর সব ধর্মের উপর ইসলামকে জয়যুক্ত করাই যে মূল লক্ষ্য এটা ইসলাম গোপন করে না। মুহাম্মদ কুরআনের আল্লাহ্‌র বরাতে বলছেন,


২৮। তিনি তাঁহার রাসূলকে পথ-নির্দেশ ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করিয়াছেন, অপর সমস্ত দীনের (ধর্মের) উপর ইহাকে জয়যুক্ত করিবার জন্য। সাক্ষী হিসাবে আল্লাহ্‌ই যথেষ্ট।

৪৮ সূরা ফাত্‌হ্‌


হাঁ, কুর্‌আন যখন আল্লাহ্‌র বাণী তখন আর সাক্ষী-প্রমাণের দরকার কী? মুহাম্মদ যখন আল্লাহ্‌র নামে বলছেন তখন এই বাক্যই হল সাক্ষ্য-প্রমাণ। এই রকম জ্বলন্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের পরও ইসলাম গ্রহণ না করলে তাদেরকে বাধ্য করার জন্য তো আছেই তলোয়ার!


ভয় ও সন্ত্রাসই এই ধর্মের মূল চালিকা শক্তি। এবং সেই সঙ্গে লোভ। পৃথিবীতে মুহাম্মদের তলোয়ারের ভয় এবং যুদ্ধ দ্বারা সম্পদ ও নারী লুণ্ঠনের লোভ, আর পরলোকে আল্লাহ্‌র নরকের ভয় এবং স্বর্গের লোভ ইসলামের কঠোর ব্যবস্থায় আরব সমাজকে নিক্ষেপ করেছে। এই ব্যবস্থা সম্পসারিত হয়েছে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে।


এই রকম সমাজে মানুষের মানবিক বিকাশ হতে পারে না, উৎপাদন ও প্রযুক্তিরও নয়। তবে সমাজ চলবে কী করে? প্রযুক্তির নিম্ন মাত্রার প্রয়োগে যা উৎপাদন হয় তা-ই দিয়ে সমাজ চলবে কোনও রকমে। কিন্তু বস্তুত যেমন জোর দেওয়া হয় নাই জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপর কিংবা বৈষয়িক জীবনের উন্নয়নের উপর তেমন জোর দেওয়া হয় নাই উৎপাদনের উপরেও। জোর দেওয়া হয়েছে ধর্ম পালন আর যুদ্ধের উপর। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসবে লুন্ঠিত সম্পদ ও দাস-দাসী। ইসলাম মানে যুদ্ধ আর যুদ্ধ মানে লুঠ। লুঠ মানে বিনা শ্রমে সমৃদ্ধি ও ভোগ-সম্ভোগ। আরব মরুচারী-মরূদ্যানবাসী, অসভ্য-অর্ধসভ্য, যাযাবর-অর্ধ যাযাবর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই যে চেতনা ইসলাম বদ্ধমূল করে দিয়েছে তা-ই সমগ্র ইসলামকে দেড় হাজার বৎসর ধরে অধিকার করে আছে। তাই ইসলাম মানেই বিজয় এবং সব সমস্যার সমাধান। উৎপাদন ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার প্রয়োজন নাই, শ্রমের প্রয়োজন নাই। ধর্মের নামে ভিন্ন সমাজের সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বেরিয়ে পড়লেই হল। অভাব থাকে না। আল্লাহ্‌ সব দেয়। আসলেই “আল্লাহ্‌” সেই সময় আরবদেরকে সব দিয়েছিল, সব সমস্যার সমাধান করেছিল যেমনটা মুহাম্মদের প্রায় ছয় শতাব্দী পরে চেংগিস খান করেছিলেন তাঁর অধীনস্থ মোঙ্গল বর্বরদের জন্য পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সম্পদ লুণ্ঠন দ্বারা।

 

 

 

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ : সভ্যতার অবক্ষয়ের ধর্ম


প্রশ্ন হতে পারে যে, এমন একটা বর্বরতাপূর্ণ ও সন্ত্রাসী ধর্ম বিজয়ী ও প্রসারিত হল কীভাবে? এর উত্তর হল সভ্যতার সঙ্কটের কারণে। আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, প্রাচীন সভ্যতার পতনের পর এবং সবশেষে গ্রীস ও রোমের সভ্যতার পতনের পর পৃথিবীর এক বিস্তীর্ণ ভূভাগ জুড়ে সভ্যতায় প্রায় সার্বিক ক্ষয় ও ধ্বংস নেমে আসে। আদি সভ্যতার অন্যতম লালন ক্ষেত্র ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নগরগুলি কয়েকটি ব্যতিক্রম ব্যতীত বিনষ্ট অথবা বিনষ্ট প্রায় এবং শস্যক্ষেত্র মরুভূমিতে অথবা ঊষরভূমিতে পরিণত। সুদীর্ঘ চাষাবাদে ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা ইত্যাদি দ্বারা ভূমির উর্বরতা হ্রাস প্রাপ্ত হওয়ায় সভ্যতা তার দ্বারা সৃষ্ট বর্ধিত জনসংখ্যাকে আর ধারণ করতে পারে নাই। মানুষের প্রযুক্তির বিকাশও অবরুদ্ধ হয়েছে। পশু ও মানুষের দেহশ্রম ভিত্তিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটে গ্রীসে ও রোমে। কিন্তু এই যন্ত্রশক্তির বিকাশ শক্তিচালিত বা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের উদ্ভব ঘটাতে পারে নাই। বরং মানুষের দেহশক্তির উপর নির্ভরশীল থেকে যন্ত্র ও প্রযুক্তির বিকাশ দাস প্রথার ভয়ংকর বিকাশের কারণ হয়েছে। উন্নত যান্ত্রিক ও সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী হয়ে গ্রীক ও রোমানরা প্রতিবেশী দেশসমূহের মানুষদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে এবং জোর করে ধরে এনে দাস হিসাবে উৎপাদনে নিয়োগ করল। সহজে দাস শ্রম পাওয়ায় প্রযুক্তির বিকাশের তাগিদ কমে গেল। এর ফলে নূতন নূতন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের পথ রুদ্ধ হল এবং সভ্যতার কাজ হয়ে দাঁড়াল বিপুল সংখ্যক দাস ও শ্রমজীবী মানুষকে ভয়ংকর ও নির্দয়ভাবে খাটিয়ে মুষ্টিমেয় শাসক কিংবা দাস মালিকের নির্বিবেক স্বেচ্ছাচার ও উচ্ছৃংখল ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করা। সমাজ ও সভ্যতার সমস্ত বিকাশ তখন থেমে এসেছে। এমন অবস্থায় সভ্যতা মানুষের জন্য আশীর্বাদ না হয়ে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষ, মহামারী, অবিরাম আত্মক্ষয়ী যুদ্ধ এবং দুঃখ-কষ্ট ও হতাশা বিশাল অঞ্চলে ছায়া বিস্তার করে।


ইসলামের আবির্ভাব ও বিজয় অভিযান শুরু হয়েছে এমন একটা সময়েই। খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে উত্তর থেকে আগত বর্বরদের আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয় এবং সেই সঙ্গে রোম সভ্যতা চূড়ান্তভাবে ধ্বংস হয়। আর মুহাম্মদের জন্ম ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখতে পাব যে, সভ্যতার প্রতিরোধের শক্তি যেখানে ফুরিয়ে আসে নাই সেখানে সাধরণত ইসলাম ঢুকতে পারে নাই। পারস্য ও বাইযেণ্টাইন তৎকালীন পৃথিবীর এই দুই পরাশক্তিই তখন ধ্বংসের কিনারায় দাঁড়িয়ে। তাই ইসলামের আঘাতে এই দুই শক্তি অতি দ্রুত গঁুড়িয়ে গেল। ইসলামের বাহিনী মধ্য এশিয়ায় ঢুকে গেল। সুদূর স্পেন পর্যন্ত দখল করল। কিন্তু নিকটের ইথিওপিয়ায় ঢুকতে পারে নাই। সামান্য এলাকার বাইরে ইউরোপও জয় করতে পারে নাই। কারণ রোমের নগর সভ্যতা ধ্বংসের পর ইউরোপ কৃষিকে ভিত্তি করে যে সভ্যতা গড়ে তুলেছিল এবং খ্রীষ্ট ধর্মকে অবলম্বন করে যে সামাজিক সংহতি অর্জন করেছিল তা পূর্বের রোমান সভ্যতার তুলনায় যতই পশ্চাৎপদ হোক ইসলামের আক্রমণ অভিযান প্রতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল।


চীনেও ইসলামের বাহিনী যেতে পারে নাই। দূরত্বই তার কারণ নয়। সভ্য ও উন্নত চীনের প্রতিরোধ শক্তির মোকাবিলায় দাঁড়াবার ক্ষমতা ইসলামের ছিল না। এমন কি ভারতেও ইসলামের বিজয়ী বাহিনী সুদীর্ঘকাল সিন্ধুর বেশী এগোতে পারে নাই। এবং আরব বাহিনী সিন্ধু এলাকার বাইরে ভারতের আর কোথায়ও বিজয় লাভ করতে পারে নাই। অনেক পর একাদশ শতাব্দী থেকে তুর্কী অভিযানকারীরা ভারত বিজয় করতে শুরু করে। অবশ্য এখানে অর্থাৎ সিন্ধুর বাইরে ইসলামী বাহিনী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে কেবলমাত্র ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এসে। অর্থাৎ ভারতের সভ্যতার প্রতিরক্ষার শক্তি যত দিন না ফুরিয়েছে ততদিন ইসলাম এখানে প্রবেশ করতে পারে নাই। ইসলাম সাগর পার হয়ে সুদূর ইন্দোনেশিয়া, মালয় পর্যন্ত প্রবেশ করেছে। কিন্তু অনেক নিকটের সিংহলে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে।


সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলামের বিকাশ ও বিস্তারের সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের কোনই সম্পর্ক নাই। বরং তার সঙ্গে সমাজ ও সভ্যতার ক্ষয় ও সঙ্কটেরই সম্পর্ক আছে। আরবের পার্শ্ববর্তী সভ্য সমাজগুলি যখন ধ্বসে যাচ্ছিল তখন মূল আরবে মক্কাকে কেন্দ্র করে একটা নূতন সমাজ বিকাশ শুরু হয়েছিল। আমরা দেখেছি যে, এখানে ইসলামের পূর্বে রাষ্ট্র ছিল না। মক্কা, মদীনা, তায়েফ ইত্যাদি কয়েকটি বর্ধিষ্ণু বসতি বা নগর গড়ে উঠছিল। এই বর্ধিষ্ণু বসতিগুলি ছিল মূলত মরূদ্যান যেখানে কৃষি, হস্তশিল্প এবং বাণিজ্য গড়ে উঠছিল। বিশেষত বাণিজ্যের বিকাশ বিশাল মরুভূমিময় আরবের বুকে নূতন গতিশীলতা সৃষ্টি করছিল। বাণিজ্য ও উৎপাদনের বিকাশ পুরাতন আদিম উপজাতীয় সমাজকে ভেঙ্গে ফেলছিল। এই সব উপজাতির ভাঙ্গন এবং উৎপন্ন বিনিময় বা অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে বৃহত্তর আরব সমাজ গড়ে উঠছিল। বিভিন্ন উপজাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ ও ভাববিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে আরবী ভাষা বিকশিত হয়ে ওঠে।


পৌত্তলিক ও বহুদেবতাবাদী ধর্ম ছিল এই নূতন আরব সমাজ ও সভ্যতা সংগঠনের কেন্দ্রীয় ভাবগত শক্তি। এই ধর্মের পরিচালক ছিল কুরাইশ গোত্র। মক্কাকে কেন্দ্র করে কুরাইশরা একটা পুরোহিত বংশ হিসাবে আরবের বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে ঐক্য স্থাপন করছিল। ঐক্যবদ্ধ আরব সমাজের প্রতীক ছিল কাবা মন্দির। এখানে কুরাইশরা বিভিন্ন উপজাতির নিজ নিজ দেবতার প্রতীক হিসাবে প্রতিমা স্থাপন করেছিল। অর্থাৎ কাবা ছিল আরবের সকল উপজাতির কেন্দ্রীয় ও সর্বপ্রধান মন্দির।


এইভাবে প্রবল উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ ও সংঘাতের অস্তিত্ব সত্ত্বেও ধর্মের মাধ্যমে আরবে একটা মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে ওঠে। অন্যদিকে, কুরাইশরা নূতন বিকাশমান অর্থনীতিরও নায়ক। কাবা মন্দির সংরক্ষণ ও ধর্ম চর্চার পাশাপাশি তারা বাণিজ্য ও উৎপাদনমূলক কার্যকলাপেও মনোনিবেশ করে। এই সমস্তের ফলে প্রাচীন উপজাতীয় সমাজ বিন্যাস ভেঙ্গে পড়তে থাকে। একদিকে উপজাতীয় বন্ধন আলগা হতে থাকে অপরদিকে সমাজে ধন বৈষম্য প্রকট হতে শুরু করে। ঋণ ও সুদ বহু মানুষকে নিঃস্ব ও শ্রমদাসে পরিণত করে। ইসলামের আবির্ভাবের সময়ে মক্কায় ও তার আশেপাশে এই ধরণের বহু নিঃস্ব ও শ্রমদাস সৃষ্টি হয়েছিল যারা ইসলামের সুদ বিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল।


উপজাতীয় সমাজের রূপান্তরের সময় সমাজে যে অসন্তোষ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল মুহাম্মদ তাকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি অর্থনীতি তথা উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের যে বিকাশ হচ্ছিল তাকে রোধ করতে চাইলেন। তাঁর একটি উদ্দেশ্য ছিল সভ্যতার গতি রোধ করে সমাজের ধন বৈষম্যকে সংযত করা। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তিনি সাম্যবাদীও ছিলেন না। তাহলে একনায়কতন্ত্র বা দাসত্ব কিংবা নারীর অবরোধ অনুমোদন করতেন না। তিনি ছিলেন ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন উদ্যোগ এবং উন্নত সভ্যতার বিরোধী যা তখন আরবের চারপাশে অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের মধ্যে ছিল। মক্কা থেকে সিরিয়াসহ বিভিন্ন অনারব অঞ্চলে বাণিজ্য করতে মুহাম্মদকে একাধিকবার যেতে হয়েছিল। তখন আর সবার মত এই সামগ্রিক পরিস্থিতি তাঁরও চোখে পড়ার কথা।


মোট কথা মুহাম্মদ আরবের উদীয়মান সামাজিক অর্থনৈতিক শক্তিকে অর্থনীতি ও উৎপাদনের দিকে চালিত হতে না দিয়ে তাকে প্রধানত যুদ্ধের পথে চালিত করেছেন। এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছেন প্রচলিত ধর্ম ব্যবস্থার শক্তিকেই। গোটা আরব সমাজকে এক সেনানায়কের অধীনে অখণ্ড সমরবাদী জাতিতে পরিণত করার জন্য প্রয়োজন ছিল সমস্ত দেবতাকে নাকচ করে একটি মাত্র স্বৈরতান্ত্রিক দেবতা রাখা। তাহলে আরবে বহু ব্যক্তি ও উপজাতির স্বাতন্ত্র্য লোপ পায় এবং উৎপাদন, প্রযুক্তি ও বাণিজ্য বিকাশের বদলে যুদ্ধের মাধ্যমে সভ্য পৃথিবীর বিশাল অঞ্চল দখল করা সম্ভব হয়। সুতরাং মক্কার বা আরবের অনেক দেবতার মধ্যে মক্কা এবং কুরাইশদের প্রধান দেবতা আল্লাহ্‌কে বেছে নেওয়া হল।


জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ দ্বারা বিভিন্ন উপজাতির স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট করে তাদের এক কর্তৃত্বাধীনে আনতে গিয়ে গড়ে উঠল জিহাদী রাষ্ট্র বা ইসলামী সামরিক রাষ্ট্র। এইভাবে মূল আরব ভূভাগ পেল একটা রাষ্ট্র, যা উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য এবং বহু দেবতা ভিত্তিক স্বেচ্ছামূলক ঐক্যের সময় ছিল না। কুরাইশরা বিভিন্ন গোত্র ও উপজাতির স্বাতন্ত্র্যের প্রতি স্বীকৃতি দিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ আরব সমাজ সংগঠিত করছিল যার অনিবার্য পরিণতি ছিল রাষ্ট্র গঠন। মুহাম্মদ এই রাষ্ট্র গঠনই করলেন তবে ভিন্নভাবে। তিনি কুরাইশ গোত্রকেই একনায়কী নেতৃত্বে রেখে একটা নিরংকুশ এককেন্দ্রিক ধর্মীয় সামরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর এই রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে আরবরা চারপাশের শূন্যতা পূরণ করতে বেরিয়ে পড়ল।


একটি ঐক্যবদ্ধ আরব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু দরিদ্র আরবের তুলনায় বিপুল অর্থ ও সম্পদের অধিকারী বিশাল পারস্য ও বাইযেনটাইন রোমান সাম্রাজ্যদ্বয়ের উপর আরব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও তাদের সম্পদ লুণ্ঠনের মাধ্যমে আরবের সমৃদ্ধি অর্জনের এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা মুহাম্মদের অন্তরে সম্ভবত বহু পূর্ব থেকেই ছিল। এই পরিকল্পনাকে রূপ দিবার জন্য যে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন তা গড়ে তোলাই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। পুরোহিত গোষ্ঠী কুরাইশ বংশের একজন সদস্য হিসাবে এক্ষেত্রে তাঁর উপায় ছিল প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের সংস্কার কিংবা পুনর্গঠন দ্বারা তাকে তাঁর প্রয়োজন পূরণের উপযোগী করা। তিনি সেটাই করেছেন। আল্লাহ্‌ ছাড়া আরবের আর সব দেবতাকে বাতিল করে এবং আল্লাহ্‌র সর্ব শক্তিমান ও নিরাকার রূপ ঘোষণা করে তিনি নিজ নিরংকুশ নেতৃত্বাধীন এক দুর্ধর্ষ একনায়কতান্ত্রিক সেনাবাহিনী গঠন করেন যা তাঁর জীবদ্দশায় প্রায় সমগ্র আরবে নিরংকুশভাবে এককেন্দ্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে এবং তাঁর মৃত্যর পর পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলে আরব জাতির প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। বোখারী শরীফের ১২২২ নম্বর নিম্নোক্ত হাদীসটি মুহাম্মদের এই বিশ্বজয়ের পরিকল্পনাকেই প্রকাশ করছেঃ


“আবু হোরায়রা হইতে বর্ণিত আছে, হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম বলিয়াছেন, অচিরেই পারস্য সম্রাট ধ্বংস হইবে অতঃপর আর কেহ পারস্য সম্রাট হইবে না, তদ্রূপ অচিরেই রোম সম্রাট ধ্বংস হইবে অতঃপর আর কেহ রোম সম্রাট হইবে না (উভয় সাম্রাজ্য মোসলমানদের করতলগত হইয়া) তাহাদের ধন-ভাণ্ডার আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় হইয়া যাইবে।”


“হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লাম ইহাও বলিয়াছেন যে, গোপন ব্যবস্থা অবলম্বন করাই যুদ্ধের প্রাণ-বস্তু।”*

 

____________________________________________________________________________________________________________________

* বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা), তৃতীয় খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ও আজিজুল হক। পৃষ্ঠাঃ ৬৯।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

সভ্যতার গতি রোধ করার প্রয়োজনে এক নিরংকুশ ও স্বেচ্ছাতন্ত্রী সামরিক একনায়কের কঠোর শাসনাধীনে সমাজকে আবদ্ধ করার জন্য ইসলামের সন্ত্রাসী ও নিরংকুশ একেশ্বরবাদ ছিল খুবই উপযোগী। নিরংকুশ একেশ্বরবাদকে মানুষের উন্নত চিন্তার প্রকাশ বলে ভাববার কোনও কারণ নাই। বরং এটা মানুষের চিন্তার সঙ্কটেরই একটা প্রকাশ। আমরা আমাদের আলোচনায় ইতিপূর্বে দেখেছি যে, এই ধরনের একত্ববাদী চিন্তা বাস্তবতা বিরোধী। অবশ্য দৈব সত্তা সম্পর্কে যে কোনও ধারণাই ভুল। তবু বহু দেবতার চিন্তার মধ্যে রয়েছে বাস্তবতার প্রতিফলন যেটা নিরংকুশ একেশ্বরবাদের ধারণার মধ্যে নাই। অবশ্য একশ্বেরবাদ যত নিরংকুশ হোক প্রকৃতির নিয়ম বহুত্বকে একেবারে এড়াতে পারে নাই। তাই ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌কে সর্বব্যাপী কিংবা সর্বশক্তিমান কল্পনা করার পরেও আবার তার অধীন দেবদূত, পবিত্র আত্মা কিংবা ফেরেশ্‌তা কল্পনা করতে হয়েছে। যেন রাজার অধীন সামন্ত কিংবা কর্মচারী বা আমলার কল্পনা। তবে ইহুদী, খ্রীষ্ট ও ইসলাম এই তিন সেমিটিক ধর্মের একটা মূল বৈশিষ্ট্য হল ঈশ্বরের অবয়ব বা মূর্তি নির্মাণ না করা। এটা হল ঈশ্বরের সীমাবদ্ধতা যাতে ধরা না পড়ে তার একটা কৌশলী প্রয়াস মাত্র।


সভ্যতার জন্ম বহুর স্বীকৃতি থেকে। বহু মানুষের, বহু উপজাতি ও গোত্রের এবং বহু জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত অধিকারের কমবেশী স্বীকৃতি এবং বহুর কর্ম, চিন্তা, উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও প্রয়োগের প্রতি সামাজিক সহিষ্ণুতা ও অনুমোদন থেকে মানুষের সভ্যতার বিকাশ হয়েছে। যখনই জোর-জবরদস্তি করে সমস্ত ভিন্নতাকে দমন করে একেশ্বরবাদের নামে সবাইকে অজাগতিক ও অন্ধ এক ছাঁচে ফেলা হয়েছে তখন সভ্যতার বিকাশ স্তব্ধ হয়েছে। কিংবা এভাবেও বলা যায় যে, নিরংকুশ একেশ্বরবাদের বিকাশ তখন সম্ভব হয়েছে যখন সভ্যতার শক্তি ক্ষয় হয়েছে। এই অবস্থায় সমাজের বিকাশ না থাকলেও, উৎপাদন ও সংস্কৃতি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান খুব নীচু পর্যায়ে নেমে গেলেও মানুষের সমাজের সংহতি রক্ষা করা গেছে এই ধরনের ধর্মের প্রভাবে। সমাজের ঐক্যের বাস্তব বা বৈষয়িক শক্তি যখন হ্রাস পেয়েছে তখন এই ধরনের একেশ্বরবাদী ধর্ম সামাজিক সংকটের পরিবেশে সামাজিক ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় ভূমিকা পালন করেছে।


একেশ্বরবাদ এক অর্থে নূতন বস্তু নয়। কারণ এটা হল এক দেবতাবাদ যার উৎস রয়েছে আদিম উপজাতি বা গোত্রের টোটেম বিশ্বাসের মধ্যে। আদিম মানুষ মনে করত যে, কোনও নির্দিষ্ট গোত্র কোনও নির্দিষ্ট প্রাণী বা উদ্ভিদ বা বস্তু থেকে আবির্ভূত। এক এক গোত্রের এক একটি টোটেম থাকত। যেমন হরিণ, মহিষ, গরু, কিংবা বাজপাখী ইত্যাদি। গোত্রের সকলে মনে করত যে, সেই টোটেম থেকে তাদের গোত্রের জন্ম হয়েছে। এই টোটেমের ধারণার মধ্যে গোত্রের ঐক্য ও সংহতি প্রতিফলিত হত। ধীরে ধীরে মানুষ বিমূর্ত আত্মার ধারণার অধিকারী হয়। তখন মানুষ কল্পনা করত যে, সব বস্তু বা প্রাণীর আত্মা আছে এবং তখন স্বাভাবিকভাবে টোটেম বিশ্বাসের সঙ্গে আত্মার ধারণা সংযুক্ত হয়ে দেবতার ধারণা বিকাশ লাভ করে। এইভাবে প্রত্যেক উপজাতি বা গোত্রের নিজস্ব দেবতার ধারণা আবির্ভূত হয়। মানুষ যখন প্রকৃতির সমস্ত শক্তিকে দৈব ভাবতে শিখে তখন ঝড়, বৃষ্টি, নদী, পর্বত ইত্যাদিরও দেবতা বা আত্মা আছে বলে ভাবতে আরম্ভ করে। এইসব দেবতার রূপ মানবিক হতে শুরু করে। এবং দেবতা বা অদৃশ্য শক্তি রূপ পরিবর্তন করতে পারে মানুষ এমন ধরণাও করতে শিখে। এইভাবে মানুষের দেবতা কল্পনা ক্রমেই বিমূর্ত বা রূপহীন হতে থাকে। অবশ্য এটা ঠিক যে, এই বিমূর্ততার মধ্যেও মানুষের দৈহিক গঠনের কল্পনা কোনও না কোনও ভাবে থেকে যেত যার ছায়া আমরা এমন কি ইসলামের মত কঠোর নিরাকারবাদী ধর্মেও পাই। মুহাম্মদ ঈশ্বরকে মানুষের (অবশ্যই পুরুষ মানুষের) আকৃতিতে কল্পনা করেছেন বলেই একথা বলেছেন যে, আল্লাহ্‌ নিজের দৈহিক গঠন ও আকার অনুযায়ী আদমকে সৃষ্টি করেছেন। এই একই কারণে তিনি সাত আকাশের উপর আল্লাহ্‌র আসন কল্পনা করেছেন। আল্লাহ্‌র সীমাবদ্ধ রূপ-কল্পনা আছে বলেই মানুষের কর্মের সঙ্গী ও সাক্ষী হিসাবে রাখা হয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ বা সরকারী কর্মচারী স্বরূপ ফেরেশতাদেরকে যারা মানুষের কর্মের হিসাব লিখে রাখে এবং তা দাখিল করে আল্লাহ্‌র কাছে। অর্থাৎ বোঝাই যায় যে, আল্লাহ্‌র পক্ষে ফেরেশতা ছাড়া সবকিছু তদারক করা বা সবকিছুর খোঁজ রাখা সম্ভব নয়। অর্থাৎ মুহাম্মদ ও ইসলামের চিন্তার গভীরেও আছে আল্লাহ্‌র সমীম রূপ ও সীমাবদ্ধ ক্ষমতা। তবু আল্লাহ্‌র আকার কল্পনা এবং তার মূর্তি নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ তাতে ধরা পড়ে আল্লাহ্‌র ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তখন আল্লাহ্‌কে শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসাবে কল্পনা করা হলেও তার অধীনে অন্যান্য দেবতার আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। এর ফলে আল্লাহ্‌ আর সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান থাকে না, তার ক্ষমতা নিরংকুশ থাকে না।


একেশ্বরবাদের এই যে স্ববিরোধ ও দুর্বলতা তা ঢাকবার জন্যই সেমিটিক ধর্মগুলি ঈশ্বর বা আল্লাহ্‌র রূপ কল্পনার প্রতি এত হিংস্রভাবে আক্রমণাত্মক। এটাও হয়েছে মানুষের বৈষয়িক তথা সভ্যতার দুর্বলতা ও অবক্ষয়ের ফলে। মানুষকে একেশ্বরের কল্পনার মাধ্যমে একটি মাত্র ব্যক্তি ও সামাজিক কর্তৃত্বের প্রতি নিঃশর্তভাবে অনুগত করতে হলে নিরাকার ঈশ্বরের কল্পনা ছাড়া উপায় ছিল না। যখন বস্তু দুর্বল হয়েছে তখন বিমূর্ত বা নিরাকার কল্পনা সমাজের শক্তিকে সংহত করতে এগিয়ে এসেছে। এটাই ছিল মানুষকে কঠোর শাসনে বাঁধবার পথ। সুতরাং ঐতিহাসিক অনিবার্যতাতেই সভ্যতার অবক্ষয়িত অঞ্চলে মূলত তিন একেশ্বরবাদী ধর্মের উদ্ভব কিংবা বিস্তার ঘটে। ইহুদী ধর্মের উদ্ভব ঘটে মিসরীয় সভ্যতার অবক্ষয়ের পর্যায়ে*। খ্রীষ্ট ধর্মের বিশেষত বিকাশ ঘটে রোমান সভ্যতার অবক্ষয়ের পর্যায়ে। আর ইসলাম ধর্মের উদ্ভব ঘটে সমগ্র নিকট ও মধ্যপ্রাচ্যের সমস্ত সভ্যতায় সার্বিক ও চূড়ান্ত অবক্ষয়ের পর্যায়ে।


____________________________________________________________________________________________________________________

* মুসার সময়ের এক শতাব্দীর অধিককাল পূর্বে মিসরের এক ফারাও মিসরে একেশ্বরবাদ প্রচার করেন। চতুর্থ আমোনহটেপ বা ইখ্‌নাটন নামে পরিচিত এই রাজা খ্রীষ্টপূর্ব ১৩৮০ অব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং খ্রীষ্টপূর্ব ১৩৬২ অব্দে মাত্র ৩০ বৎসর বয়সে মৃতুøবরণ করেন। ইখ্‌নাটন প্রচলিত সকল দেবদেবীকে অস্বীকার করে একমাত্র ও মহাপরাক্রমশালী দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে সূর্য বা আটন দেবের উপাসনা প্রবর্তন করেন। তিনি তাঁর একেশ্বরবাদী ধর্ম সমস্ত মিসরের উপর জোর করে চাপাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর নূতন ধর্ম প্রবর্তনের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর প্রবর্তিত ধর্মও লোপ পায়। তাঁর অপরূপ ঈশ্বর স্তোত্রগুলির সঙ্গে আমরা ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে রচিত সাম সঙ্গীতগুলির ভাব ও আঙ্গিকের আশ্চর্য রকম মিল দেখতে পাই।

প্রসঙ্গক্রমে আমাদের এই বিষয়ও জেনে রাখা ভাল যে, ইহুদীদের মধ্যে খৎনা বা পরিচ্ছেদনের যে ধর্মীয় বিধান চালু হয় তা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রাচীন মিসরীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল। --  লেখক।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

ইহুদী ধর্ম একেশ্বরবাদী হলেও এর সর্বজনীন হওয়ার পথে বাধা ছিল বিরাট। এটা ছিল ইসরাইলীয় বা ইহুদী জাতির নিজস্ব ধর্ম যে ধর্ম এই জাতিকে আর সকল জাতির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। কারণ ইসরাইলীয় জাতি হল ইসরাইলীয়দের ঈশ্বর জিহোবা বা সদা প্রভুর মনোনীত জাতি। এর ফলে ইহুদী ধর্ম অন্য সকল জাতির উপর ইসরাইলীয় জাতির প্রভুত্বের সমার্থক।


ইহুদী ধর্মের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন মোশি বা মুসা। তিনি আনুমানিক তিন হাজার দুইশত বা ৩২০০ বৎসর পূর্বে জীবিত ছিলেন। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন মিসরে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ইসরাইলীয় জাতির এক সন্তান যিনি মিসরের রাজ পরিবারে প্রতিপালিত হন। হতে পারে যে, তিনি একজন রাজপুত্র তথা ফারাও পুত্র ছিলেন এবং পরবর্তী কালে নির্যাতিত ইসরাইলীয়দের মুক্তি ও তাদের নিয়ে নিজ একেশ্বরবাদী ধর্মচিন্তা বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই সম্ভাবনা যথেষ্ট যে মোশি বা মুসা ছিলেন এমন এক রাজপুত্র যার সিংহাসন লাভের সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এক্ষেত্রে তিনি ইসরাইলীয়দের ব্যবহার করে নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চান। সুতরাং নিজ জন্ম সংক্রান্ত কল্পকাহিনী প্রচার করে জন্মগতভাবে ইসরাইলীয়দের একজন হিসাবে তিনি নিজেকে উপস্থিত করেন এবং এভাবে মিসরে দাসত্বে আবদ্ধ ইসরাইলীয়দের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেন এবং তাদেরকে প্যালেস্টাইনে নিয়ে গিয়ে সেখানে নিজ ধর্ম ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে নিজ উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করেন।


মোশির জন্ম বৃত্তান্ত যেমনই হোক তিনি ছিলেন মিসর রাজপরিবারে প্রতিপালিত। কাজেই তিনি যেমন মিসরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির লালন লাভ করেছিলেন তেমন রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে লালিত হবার সুবিধাও ভোগ করেছিলেন। ইসরাইলীয়দেরকে মিসরের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে মুসার এই রাজগৃহের পটভূমি নিশ্চয় বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল।


মুসা ধর্মের মাধ্যমে ইসরাইলীয় বা ইহুদীদেরকে একটি জাতিতে পরিণত করেন এবং প্যালেস্টাইনে তাদের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মুসা প্যালেস্টাইন অঞ্চলে বিভিন্ন উপজাতি ও জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বস্তুত ইহুদী ধর্ম ছিল মুহাম্মদের আদর্শ বা মডেল। মুহাম্মদ ইহুদী ধর্মের গল্প, উপকথা, উপাসনা পদ্ধতি, রীতিনীতি ইত্যাদি থেকে তাঁর নিজ ধর্মের অনেক উপাদান গ্রহণ করেন। সেই সঙ্গে তিনি গ্রহণ করেন ইহুদী ধর্মের চরম অসহিষ্ণুতা ও আক্রমণাত্মক মনোভাব। তবে ইহুদী ধর্ম যেভাবে জাতিবাদী ছিল ইসলাম সেভাবে তা ছিল না। যে কেউ মুহাম্মদের নিরংকুশ কর্তৃত্ব ও নিয়ম বা বিধান গ্রহণ করে ইসলামী সমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। কিন্তু এই ইসলামী সমাজ প্রকৃতপক্ষে আরবীয় ধর্ম, ভাষা ও জাতির সম্প্রসারিত রূপ মাত্র। অর্থাৎ ইসলাম হল মুহাম্মদের নিয়ন্ত্রণাধীন আরব সম্প্রসারণের হাতিয়ার।


যীশু খ্রীষ্ট ইহুদী জাতিভুক্ত ছিলেন। তবে তাঁর ধর্ম শুধু ইহুদীদের জন্য নির্দিষ্ট থাকল না। আসলে যীশু ইহুদী ধর্মের উগ্র ও অসহিষ্ণু একেশ্বরবাদকে নম্র ও সহিষ্ণু রূপ দেন। এটা হল ইহুদী ধর্মের সামরিকতা বা সমরবাদ বর্জন করে তাকে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ রূপ দানের চেষ্টা। পরিণতিতে যীশুর সংস্কার একটি সম্পূর্ণ নূতন ধর্মের আবির্ভাব ঘটাল।


রোম তার পতনের যুগে প্যালেস্টাইনীয় খ্রীষ্ট ধর্মকে গ্রহণ করল। এটা ছিল প্রথমে রোমান সাম্রাজ্যের অধীন শাসিত ও দাসদের ধর্ম। খ্রীষ্টানদের ধর্মমত দমন করার জন্য রোমান শাসকরা দীর্ঘকাল খ্রীষ্টানদের উপর নৃশংস অত্যাচার করে। কিন্তু তাদের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে রোমের সর্বস্তরের জনসাধারণ ক্রমবর্ধমান গতিতে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। অবশেষে খ্রীষ্টের মৃতুøর তিনশত বৎসর পর খ্রীষ্টধর্ম রোমান সাম্রাটদের আনুকূল্য লাভ করতে শুরু করে।


আমরা আমাদের আলোচনায় ইতিপূর্বে দেখেছি যে, খ্রীষ্ট ধর্ম একেশ্বরবাদী হলেও ঐশ্বরিক ক্ষমতার নিরংকুশ কেন্দ্রীভবন ঘটায় না। যীশু ঈশ্বরের পুত্র হওয়ায় এবং বিচার দিবস পর্যন্ত পৃথিবী ও স্বর্গের কর্তৃত্ব তাঁর হাতে অর্পিত হওয়ায় খ্রীষ্ট ধর্ম নিরংকুশভাবে এককেন্দ্রিক নয়। বস্তুত এটা এক ধরনের দ্বি-ঈশ্বরবাদী বা দ্বি-কেন্দ্রিক ধর্ম। এই চিন্তা পদ্ধতির ফলে দ্বৈততার প্রতি যে সহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে তারই পরিণতিতে রাষ্ট্র ও চার্চের ভিন্নতা দেখা দিতে পেরেছে।


রোমান সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল। ইউরোপ উন্নত নগর সভ্যতা থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল পশ্চাৎপদ কৃষি সভ্যতায়। কিন্তু খ্রীষ্ট ধর্মের প্রভাবে অধঃপতিত হল না চরম স্বৈরতন্ত্রে । একদিকে সামাজিক বলপ্রয়োগের যন্ত্র স্বরূপ রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করল খ্রীষ্ট-ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চ যা রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত নয়, অপরদিকে চার্চ তার নিজের গর্ভে লালন করল প্রাচীন গ্রীস ও রোমের গণতন্ত্রের একটি মৌল উপাদান নির্বাচন। ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপের নির্বাচনের মধ্যে সুপ্ত থাকল গণতন্ত্রের বীজ।

 

এক সময় ইউরোপে রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ দেখা দিল এবং মানুষ জাগতিকতা ও বিজ্ঞানের দিকে ঝঁুকল। তখন চার্চ ও খ্রীষ্ট ধর্মের কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জেগে উঠল। এই সংগ্রামে ইউরোপ চার্চের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকেও ব্যবহার করল যেমন এর আগে রাষ্ট্রের নিরংকুশ হবার বিরুদ্ধে চার্চকে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু যখন ব্যক্তি জীবন ও রাষ্ট্রের উপর চার্চের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ইউরোপ জাগল তখন ইউরোপ তার সমস্ত ক্ষমতা রাষ্ট্র বা রাজার হাতে সমর্পণ না করে সংসদ বা পার্লামেন্ট তথা নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক সংস্থার হাতে ক্ষমতার এক বৃহদাংশ সমর্পণ করল। অবশ্য ইতিপূর্বেও সামন্ত ও পাদ্রীদের নিয়ে গঠিত পার্লামেন্ট বা প্রতিনিধি পরিষদ ছিল যা রাজাকে শাসন কার্যে সাহায্য-সহযোগিতা যেমন করত তেমন রাজার ক্ষমতাকে যথেষ্ট সংযতও রাখত। সামন্ত ভূস্বামীদের অস্তিত্ব রাজার ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। কিন্তু সবার উপরে যদি চার্চ বিশেষত ক্যাথলিক চার্চ না থাকত তবে রাজার ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরার ক্ষমতা তাদের কতটা হত তাতে সন্দেহ আছে। পূর্ব ইউরোপের রাশিয়া ইত্যাদি অর্থডক্স চার্চ নিয়ন্ত্রিত দেশে যেখানে চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য অল্প মাত্রায় ছিল কিংবা যেখানে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্র থেকে পৃথক সত্তা হিসাবে চার্চের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান অনুপস্থিত ছিল সেইসব দেশে আমরা রাষ্ট্রের প্রায় নিরংকুশ রূপ তথা একহাতে সমস্ত ক্ষমতার কম বেশী কেন্দ্রীভবন দেখতে পাই।


বস্তুত ইউরোপ বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ আধুনিক যুগে তার উত্তরণ ঘটাতে পেরেছে ব্যক্তিগত মালিকানার পাশাপাশি চার্চ ও রাষ্ট্রের এই পার্থক্য এবং চার্চের ভিতরে গণতন্ত্রের বীজ রক্ষা পাওয়ায়। আমরা আধুনিক যুগে ভিন্নরূপে কমিউনিস্ট দেশসমূহে অনুরূপ ঘটনা ঘটতে দেখেছি। প্রাচীন যুগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান জনমত সংগঠনে ও রাষ্ট্র বা ক্ষমতাযন্ত্রকে প্রভাবিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছে আধুনিক যুগে লোকবাদী রাজনৈতিক সংগঠন সেই ভূমিকা পালন করছে।


রাশিয়া এবং কমিউনিস্ট দলগুলি জনমতকে সংগঠিত ক’রে এবং রাষ্ট্রকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিজেদের নিরংকুশ শাসন প্রতিষ্ঠা করলেও এখানে দুইটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। একটি হল রাষ্ট্র ও দল এক সংস্থা নয় অর্থাৎ রাষ্ট্র ও রাজনীতির মধ্যে একটা পার্থক্য রইল এবং অপরটি হল রাষ্ট্র একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হলেও কমিউনিস্ট দল নির্বাচনমূলক ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংগঠনের ভিতরে যত সীমিত আকারেই থাকুক গণতন্ত্র বর্তমান। এই সব দেশে রাজনৈতিক সংগঠনের ভিতর কম বেশী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষা ক’রে এবং রাষ্ট্রের উপর এই জাগতিক ও উন্নয়নপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রণ রক্ষা ক’রে সমাজের আধুনিকায়ন সম্পন্ন করা হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক শক্তির ভিতর যত সীমিতই হোক গণতন্ত্রের এই অস্তিত্বের ফলে সমাজ ও অর্থনীতির বিকাশের একটা পর্যায়ে এসে সমাজের পক্ষে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পদ্ধতিতে উন্নত গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করা সম্ভব হয়েছে।


কিন্তু ইসলামে মৌলিকভাবে এবং নীতিগতভাবে সামাজিক সংস্থাসমূহের পৃথকীকরণের কোনও অস্তিত্ব নেই। এখানে সমাজের বেসরকারী ধর্মীয় সংগঠন যেটা সমাজের সরকারী সংগঠনও সেটাই। একনায়ক শাসকই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। একজন একনায়কের অধীনে থেকে প্রত্যেকে সব কাজ করবে। প্রত্যেকেই ধর্মপ্রচারক, যোদ্ধা, সংসারী, কর্মী ইত্যাদি। যেহেতু সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশের সঙ্গে ইসলামেও শ্রম বিভাগের জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে সেহেতু পেশাগত পার্থক্যও দেখা দিয়েছে। যেমন ধর্মনেতা ও রাষ্ট্রনেতা একজন হলেও মসজিদের নামাযে ইমামতি করার জন্য স্বতন্ত্র মোল্লা বা ধর্মনেতার প্রয়োজন হল। তাছাড়া ধর্মশাস্ত্র চর্চার প্রয়োজনে গড়ে উঠল “আলেম” সম্প্রদায়। কিন্তু সব সত্ত্বেও তত্ত্বগতভাবে, আদর্শগতভাবে সব এক রইল, আর বাস্তবে যেটা হল সেটা এই যে, সেনাবাহিনী দেখা দিল ধর্ম, রাষ্ট্র ও সমাজের কেন্দ্রীয় সংগঠন তথা সমন্বয়কারী ও পরিচালক সংস্থা হিসাবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনা তথা রাজনীতি নির্ধারণের বৈধ শক্তিও হল সেনাবাহিনী।


যে সমাজে ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ধর্ম প্রতিষ্ঠায় তলোয়ার ও যুদ্ধের আশ্রয় নেয় সেই সমাজের স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতেই চলে যায়। ধর্ম নেতারা পরলোকের ভয় ও লোভ দেখিয়ে জনগণকে ধর্মচর্চা করতে বললেও রাষ্ট্রের বৈষয়িক ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা নিজেরা পরলৌকিক ধর্মের পরলোকচর্চার তুলনায় বরং রাষ্ট্র ও সমাজ-সংসারের ইহলোক চর্চার উপরই বেশী জোর দেয়। এই জন্যই ধর্মনেতারা রাষ্ট্র চর্চার দায়িত্ব অন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে মসজিদে আশ্রয় নেয় না। বরং যখন ধর্ম চর্চা ও রাষ্ট্র চর্চা এক সঙ্গে এই দুই দিক সামাল দিতে পারে না তখন মসজিদ ছেড়ে রাষ্ট্র ভবনেই আশ্রয় নেয় এবং নিজেদের অধীনে কাউকে মসজিদের দায়িত্বে নিয়োগ করে। অর্থাৎ তারা নিজেরা বৈষয়িক ক্ষমতা ছাড়তে রাজী নয়। বরং রাষ্ট্র ক্ষমতার জোরে ধর্মকেও করে রাখে নিজ ক্ষমতা চর্চার হাতিয়ার। রাষ্ট্র শাসকের মত মোল্লাও ধর্মনেতা। কিন্তু শাসকের হাতে তলোয়ার ও সেনাবাহিনী থাকায় সে-ই হয় ইহলৌকিক ও পরলৌকিক সকল ক্ষমতার কেন্দ্র। আর নিরস্ত্র মোল্লা তার অনুগত ভৃত্য হিসাবে ধর্মের দৈনন্দিন ও শাস্ত্রচর্চা সহ বিশেষীকৃত দায়িত্ব পালন করে মাত্র।


যদিও ইসলামে নীতিগতভাবে সব সক্ষম পুরুষই সৈনিক, কিন্তু এ ক্ষেত্রেও বিশেষীকরণ ও পেশাগত নিয়োগের ব্যাপার গড়ে ওঠে। ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যাপ্তির সঙ্গে ক্রমে সেনাবাহিনী সমাজ থেকে স্বতন্ত্র একটি বিভাগ হিসাবে গড়ে ওঠে আর এখানেই কেন্দ্রীভূত হয় সমাজের সকল ক্ষমতা। এই সেনাবাহিনী হল ইসলামের প্রাণকেন্দ্র এবং মস্তক। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ধর্ম সব কিছুরই কেন্দ্রীয় সংগঠন হল সেনাবাহিনী। অর্থাৎ ইসলামী সমাজের কেন্দ্রীভূত ও ঘনীভূত রূপ হল সেনাবাহিনী আর এই সেনাবাহিনীরই কেন্দ্রীভূত রূপ হল একনায়কী, স্বৈরাচারী শাসক যে একাধারে সমরনেতা, ধর্মনেতা, সমাজনেতা. রাষ্ট্রনেতা, প্রশাসক ও বিচারপতি।


আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রে অবশ্য সেনাবাহিনী বা সামরিক নেতৃত্বের এতখানি নিরংকুশ গুরুত্ব নাই। তার একটা প্রধান কারণ এখানে ব্রিটিশের বিজয় ও শাসন প্রতিষ্ঠা দ্বারা রাষ্ট্রের এমন একটা বিন্যাস গড়ে উঠে যেখানে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নিরংকুশ নিয়ন্ত্রক হবার সুযোগ পায় নাই। পূর্ববর্তী মোগল ও নওয়াবী আমলে এ দেশে প্রশাসনে সেনাবাহিনীর যে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ও ভূমিকা ছিল ব্রিটিশ সেটার অবসান ঘটায় এবং সেনাবাহিনীর পাশে দৈনন্দিন প্রশাসনের জন্য একটি শক্তিশালী বেসামরিক আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন বিভাগ গড়ে তোলে। অপর দিকে বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বাইরে জনমত সংগঠন ও প্রতিফলনের একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া হিসাবে নির্বাচনমূলক সংস্থাসমূহ গড়ে তোলে। ১৯৪৭-এ ব্রিটিশ যখন মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র পাকিস্তানের শাসকদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা অর্পণ করে যায় তখন সেটা সেনাবাহিনীর হাতে করে নাই, বরং নির্বাচিত রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের হাতেই করেছিল। এইভাবে ব্রিটিশ এ দেশে ইসলামের ধ্রুপদী বিন্যাস ভেঙ্গে এক ভিন্ন ও নূতন সামাজিক প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে চলে যায়।


কিন্তু ব্রিটিশের রেখে যাওয়া এই ব্যবস্থা পাকিস্তানে বেশী দিন সেভাবে কাজ করে নাই। ১৯৫৮-তে পাকিস্তানে রাজনৈতিক শাসনের অবসান ঘটে এবং সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অবশ্য ব্রিটিশ সৃষ্ট বিন্যাসকে পুরোপুরি নাকচও করা যায় নাই। আধুনিক যুগে সেটা সম্ভবও নয়। তাই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি গড়ে তোলা হল। সেনাপতি আইয়ুবের “মৌলিক গণতন্ত্র” ছিল মূলত নির্বাচনমূলক সেনাশাসন। যুদ্ধ ও রাজনৈতিক সঙ্কটের কারণে মাঝে মাঝে সেনাশাসনে বিরতি ঘটলেও এবং রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। পুনরায় সেনাবাহিনীর শাসন ও আধিপত্য চেপে বসে।


বস্তুত সামরিক শাসন সমস্ত মুসলিম পৃথিবীর জন্য স্বাভাবিক। কারণ ইসলামী সেনাবাহিনী সমাজের মূল সংগঠক শক্তি হওয়ায় এখানে সেনাবাহিনীই জনগণের চেতনায় তাদের স্বাভাবিক নেতৃত্বের শক্তি হিসাবে দেখা দেয়। ফলে তারা তার বিরোধিতা করার জন্য কোনও নৈতিক প্রেরণা পায় না। যদিও আমাদের দেশের অবস্থা মধ্যপ্রাচ্য থেকে পৃথক এবং এখানে নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্দোলনের একটা মোটামুটি দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে তথাপি জনগণের প্রয়োজনীয় সমর্থন ও ভূমিকার অভাবের কারণে এ দেশে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আজও তেমন কোনও দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নাই। এর ফলে এ দেশে সেনাবাহিনী বারবার তার স্বৈরতান্ত্রিক ও একনায়কী শাসনকে চাপাতে সুবিধা পায়। শুধু তাই নয় এই বিশেষ পরিস্থিতির দরুন রাষ্ট্র কখনও গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করতে পারে না। কারণ রাজনীতি ও নির্বাচনের সমগ্র ব্যাপারটা সমাজের উপরতলায় ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে সীমিত থাকায় নির্বাচনমূলক রাজনৈতিক সরকারের সময়েও সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র বা প্রশাসন রাজনীতিকে সহজেই প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং বাস্তবে তা করেও।


অবশ্য এই সমস্যা শুধু ইসলামী সমাজের নয়, তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু সংখ্যক অমুসলিম দেশ প্রত্যক্ষ সেনাশাসনে কিংবা সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিন্তু এইসব দেশের সঙ্গে মুসলিম দেশের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তা হল প্রায় সকল ক্ষেত্রে খ্রীষ্টান অথবা বৌদ্ধ জনসংখ্যা অধুøষিত এইসব দেশে সেনাবাহিনী ইসলামী দেশের মত নৈতিক মর্যাদা ভোগ করে না। কারণ যীশু কিংবা বুদ্ধ কেউ-ই যোদ্ধা বা সেনাপতি ছিলেন না এবং তাঁরা যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন তা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে নিয়ন্ত্রণ করলেও তা রাষ্ট্র থেকে এবং সেনাবাহিনী থেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছে। ক্ষেত্র বিশেষে চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত হলেও অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রধান বা রাজা ধর্মীয় নেতার আসন নিলেও মূল ধর্মে তার কোনও সমর্থন থাকে নাই। ফলে এই ধরনের প্রয়াসের সীমাবদ্ধতা ও নৈতিক দুর্বলতা অনস্বীকার্য। যেমন অতীতে ইংল্যাণ্ডে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও পোপের বিরুদ্ধতায় সেখানকার রাজা বা রাণীকে ইংলাণ্ডের চার্চের প্রধান হিসাবে ঘোষণা করা হলেও তার বিশেষ কোনও সামাজিক গুরুত্ব নাই।


এমন পরিস্থিতিতে আধুনিক যুগে এইসব সমাজে সমাজ বিকাশ ও গণতন্ত্রের শক্তি যখন বস্তুবাদ কিংবা জাগতিকতাকে অবলম্বন করে দাঁড়াচ্ছে তখন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে তার সামনে প্রধান বাধা হয়ে দেখা দেয় প্রচলিত রাষ্ট্রশাসক ও সেনাবাহিনী। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী প্রচলিত ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিলেও কিংবা নিজেও রাষ্ট্র থেকে সমর্থন ও পৃষ্টপোষকতা পেলেও তার অবস্থান সামরিক নয় বলে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম সামরিক রূপ নাও নিতে পারে।


এই রকম পরিস্থিতিতে এইসব দেশে সমাজ বিপ্লব প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে আদর্শিক এবং রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক রূপ নিয়েছে। বস্তুত এইসব সমাজে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তার সার্বিক ও আশু বিলুপ্তির উদ্দেশ্যে পরিচালিত নাও হতে পারে। এই দাবী অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার মধ্যে সীমিত থাকতে পারে। আর যেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না সেখানে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চরিত্র মূলত বিশুদ্ধ আদর্শিক হতে পারে।


এই সব অমুসলিম সমাজে ধর্ম ও রাজনীতির পার্থক্যের মাধ্যমে সমাজে দ্বৈততার বৈধ অবস্থানের ফলে সমাজ মানসে যে তুলনামূলক সহিষ্ণুতা ও চিন্তাশীলতা থাকে তার ফলে এই সব সমাজে আধুনিক উন্নত জীবন চিন্তা ইসলামী সমাজের তুলনায় অনেক সহজে বিস্তার লাভ করে। এর ফল হয় পুরাতন পশ্চাৎপদ কৃষিভিত্তিক রক্ষণশীল সমাজের দ্রুত ভাঙ্গন এবং প্রগতিশীল শিল্পভিত্তিক সমাজের দ্রুত বিকাশ। এই অবস্থায় নিজেদের বাজার ব্যবস্থা ও আধিপত্য রক্ষার স্বার্থে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের মত বৃহৎ শক্তিবর্গ এই সব দেশের সমাজ প্রগতি রোধ করার উদ্দেশ্যে স্বৈরাচার ও প্রতিক্রিয়ার প্রধান শক্তি হিসাবে সেনাবাহিনী তথা সামরিক গোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে সংরক্ষণ করছে।* কিন্তু এই সব সমাজে সেনাবাহিনী ধর্মীয়-সামাজিক কারণেই নৈতিক মর্যাদার অধিকারী নয় বলে আধুনিক যুগের প্রভাবে যখন প্রচলিত অজাগতিক ও অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শক্তি ক্ষয় হচ্ছে তখন সেই শূন্যতা পূরণ করতে সমাজ থেকে সেনাবাহিনীর বাইরে স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তির উদ্ভব ঘটে।


____________________________________________________________________________________________________________________

* এই গ্রন্থ লেখার সময় যে বাস্তবতা ছিল তা থেকে অবশ্য বর্তমান পৃথিবীর অবস্থা অনেকখানি পরিবর্তিত হয়েছে। লাতিন আমেরিকার মত দেশগুলিতে আমরা অতীতে দীর্ঘ কাল সামরিক শাসনের সপক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরনের ভূমিকা দেখেছিলাম সে ধরনের ভূমিকা সেখানে অনেক দিন ধরেই অনুপস্থিত। বস্তুত জাগ্রত লাতিন আমেরিকায় এখন আর অনেক কিছুই তার পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। -- লেখক, ১৯ এপ্রিল, ২০০৯

____________________________________________________________________________________________________________________

 

কিন্তু ইসলামী সমাজে সমাজ বিপ্লব সংগঠিত করার সমস্যা এইখানে যে, সমাজের মূল সংগঠক হওয়ায় সেনাবাহিনীই এখানে জনগণের নেতৃত্বের মূল সংস্থা। সেনাবাহিনী ভোগ করে জনগণের শুধু রাজনৈতিক ও জাগতিক আস্থা ও আনুগত্য নয় একই সঙ্গে নৈতিক ও পরলৌকিক আস্থা ও আনুগত্যও । এখানে সেনাবাহিনী শুধু দেশ রক্ষা ও শাসন পরিচালনার বাহিনী নয় তা একই সঙ্গে ধর্ম রক্ষা ও প্রয়োগেরও বাহিনী।


সুতরাং ইসলামী পৃথিবীর প্রায় কোথায়ও প্রকৃত অর্থে সমাজ বিপ্লব হয় নাই। এখানে পরিবর্তন যখন অত্যাবশ্যক বা অনিবার্য হয়েছে তখন তা ঘটেছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে, সেনাবাহিনীতে ক্ষমতার হাতবদলের মাধ্যমে।


এই রকম ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ও পরিচালনায় সমাজের যেটুকু বৈষয়িক উন্নয়ন সাধিত হয় তা মূলত সমাজের তলদেশকে স্পর্শ করে না। কারণ সেনাবাহিনীর মূল চরিত্র স্বৈরতান্ত্রিক, হুকুমদারীর। হুকুমদারী দ্বারা রাস্তা, দালান এবং কিছু কল-কারখানাও হতে পারে। কিন্তু তা জনগণ ও সমাজের মানবিক সত্তা ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায় না কিংবা জনগণের নিজস্ব উদ্যেগের কোনও বিকাশ ঘটায় না। কাজেই সমাজের উপর তলায় কিংবা বাইরের অবয়বে কিছু প্রলেপ পড়লেও মন-মানসিকতা ও চরিত্র রয়ে যায় প্রায় সেই দেড় হাজার বৎসর আগের পর্যায়ে। হুকুমদারীমূলক ও আমলাতান্ত্রিক এই উন্নয়ন হয় মূলত সেনাবাহিনী ও সমরযন্ত্র এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও ব্যবস্থার প্রয়োজনে।


এই বাস্তবতায় বাহিরের অমুসলিম ও আধিপত্যকারী সমাজ ও সভ্যতার প্রভাবে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বা শক্তির বিকাশ ঘটলে তার চরিত্র ও আচরণে যেমন সমাজের স্বৈরতা ও একনায়কতন্ত্র গভীর প্রভাব ফেলে তেমন সমাজ মানসের অনুসারী হয়ে এগুলিও হয়ে থাকে খুব বেশী রকমভাবে সমরতন্ত্র বা সেনাবাহিনী নির্ভর। এগুলি সাধারণত সেনাবাহিনীর সম্প্রসারণ বা ইচ্ছাধীন সত্তা হিসাবে দেখা দেয়। আসলে ইসলামের প্রভাবে সমাজের ভিতর থেকে কোনও যুক্তিবাদী, সৃজনশীল ও মানবিক চেতনার বিকাশ অসম্ভব হয়ে থাকায় কোন ক্ষেত্রেই তার প্রকৃত প্রকাশ ঘটাটাও অসম্ভব হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত কখনও নূতন ও মানবিক কিছুর বিচ্ছুরণ ঘটলেও সমাজের সমর্থনের অভাবে অথবা বিরোধিতার আঘাতে সেসবেরই নিভে যেতে সময় লাগে না।

 

 

 


অষ্টম পরিচ্ছেদ: ইসলামের অশুভ ভূমিকা


অন্ধ ও যুক্তিহীন ধর্মকে আঘাত না করে কি কোনও সমাজ উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও আধুনিকতার পথে এগিয়ে যেতে পারে? অভিজ্ঞতা বলে পারে না। কারণ অন্ধ ও অলৌকিকতাবাদী ধর্মের ভিত্তি জ্ঞান ও বিজ্ঞান নয়। জ্ঞানের বদলে জ্ঞানের অভাব বা অজ্ঞতা তার ভিত্তি। যুক্তিহীন কল্পনা এবং অন্ধ ভয় ও লোভ তার শক্তি। তার মূল লক্ষ্য বস্তুগত বা জাগতিক উন্নয়ন নয়, তার বদলে পরলোকে বা পরজন্মে কল্যাণ অর্জন। তার মানে এই নয় যে, অন্ধ ধর্ম জ্ঞান, বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। তাহলে এই ধর্ম দাঁড়াতেই পারে না। সুতরাং তা জ্ঞান, বিজ্ঞানকেও তার প্রয়োজনে সতর্কভাবে ব্যবহার করে। কিন্তু সেক্ষেত্রে জ্ঞান অথবা বিজ্ঞান হয়ে দাঁড়ায় অজ্ঞান ও অবিজ্ঞানের বিকৃত হাতিয়ার মাত্র। অলোকবাদী ধর্মের ক্ষতিকর দিক এইখানে যে, তা মানুষের আত্মা ও মৃতুø পরবর্তী জীবন এবং অবাস্তব বা অলৌকিক সত্তায় অন্ধ ও যুক্তি-প্রমাণহীন ভ্রান্ত বিশ্বাসকে ব্যবহার ক’রে মানুষের জাগতিক জীবনকেই নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে অজ্ঞান ও ভ্রান্তি পূজারী অবস্তুবাদী ধর্ম শেষ পর্যন্ত মানব প্রগতির শত্রু হয়ে দেখা দেয়।


এটা ঠিক যে, এক সময় বর্তমানে প্রচলিত ধর্মগুলি সভ্যতার সঙ্কটের অবস্থাকে ধারণ করার জন্য এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। কিংবা এইভাবেও বলা যায় যে, এই রকম পরিস্থিতিরই উপযোগী কিংবা অনিবার্য পরিণতি ছিল এই ধর্মগুলির উত্থান। কিন্তু আজ যখন মানব সমাজ নূতন কালে পদার্পণ করেছে, জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অফুরন্ত সম্ভাবনার পথে পা দিয়েছে তখন এইসব ধর্মের এই ভূমিকা ও উপযোগ যেমন শেষ হয়েছে তেমন সেগুলি মানব প্রগতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে।


আধুনিক যুগ ও সভ্যতার সূত্রপাত প্রচলিত ধর্মের সঙ্গে বিরোধ করে। এই সূত্রপাত ঘটেছিল পশ্চিম ইউরোপে। সেখানে মধ্যযুগে ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রবল প্রতাপ। এই রোমান ক্যাথলিক চার্চের নিয়ন্ত্রণ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে গিয়ে সেখানে রেনেসাঁ পরবর্তী সময়ে দেখা দেয় ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। এর একটা ফল হল খ্রীষ্ট ধর্মের প্রোটেস্ট্যান্ট শাখার উদ্ভব। ক্রমেই দাবী উঠে চার্চ ও ধর্মের নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার। দাবী উঠে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের স্বাধীনতার এবং ধর্মকে যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস পালনের অধিকার হিসাবে সীমিত রাখার। রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক করার এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম তথা চার্চের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার দাবী ছিল ইউরোপের প্রেক্ষিতে বিরাট বিপ্লবী দাবী। কারণ এর অর্থ হল ধর্মকে নিরস্ত্র করা, তার হাত থেকে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস কিংবা সমাজ জীবনে হস্তক্ষেপ করার হাতিয়ার স্বরূপ রাষ্ট্রকে কেড়ে নেওয়া। এইভাবে ইউরোপে ধর্ম অজাগতিক ও পরলৌকিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হল আর রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে জাগতিক হল। অবশ্য এটা সম্ভব হল সমাজে বস্তুবাদী ও যুক্তিবাদী ধ্যান-ধারণার ক্রমবিস্তার ও প্রাধান্য অর্জনের ফলেই। নতুবা ধর্ম ও রাষ্ট্রের এই বিচ্ছেদ ও রাষ্ট্রের জাগতিকতা সম্ভব হত না।


এই সমগ্র প্রক্রিয়ার সূচনা ছিল রেনেসাঁ অর্থাৎ পুনরুজ্জীবন বা পুনর্জাগরণে। রেনেসাঁ ছিল প্রাচীন গ্রীক ও রোমান জ্ঞান-চর্চার পুনরুজ্জীবন। এর ফলে খ্রীষ্ট ধর্ম এতো কাল যেগুলির চর্চা নিষিদ্ধ করে রেখেছিল সেই জাগতিক বা লোকবাদী চিত্রকলা, ভাস্কর্য, দর্শন, সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চা নূতন উদ্যমে শুরু হল। এই চর্চার অনুপ্রেরণা ইউরোপের অতীত ইতিহাসে ছিল। কারণ ইউরোপে প্রথমে সভ্যতার উদ্ভব যেখানে ঘটে সেই গ্রীস ছিল মূলত জ্ঞানবাদী ও জাগতিক। এটা ঠিক যে, সমাজে পৌত্তলিক ধর্ম ছিল এবং তার একটা প্রভাবও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা সমাজের সাধারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে দেবতাদের নিয়ন্তা ভূমিকা ছিল না। রাষ্ট্র অনেকাংশে জাগতিক বা লোকবাদী হওয়ায় এবং সমাজে অনেকখানি উদার দৃষ্টিভঙ্গী থাকায় গ্রীসে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও সংস্কৃৃতি চর্চার অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। গ্রীসের পর রোমে সভ্যতার উত্থান হয়। রোম জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চায় গ্রীসের সমতুল্য না হলেও বৈষয়িক নির্মাণে বিরাট ভূমিকা রাখে।


রেনেসাঁ ছিল ইউরোপের সেই প্রাচীন লোকবাদী বা জাগতিক ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন যা খ্রীষ্টীয় ধর্ম ও চার্চের চাপে এতদিন অবদমিত হয়ে ছিল। অর্থাৎ ইউরোপে লোকবাদ ও জাগতিকতা ছিল প্রধানত সভ্যতার সমার্থক। সেখানে খ্রীষ্ট ধর্ম পরবর্তী কালের আরোপ যা সেখানকার মানুষ সভ্যতার ক্ষয় ও ধ্বংসের সময় গ্রহণ করেছিল। এমন অবস্থায় চার্চকে তার পুরাতন অবস্থানে ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারলে ইউরোপ পুনরায় তার সভ্যতা পুননির্মাণের পথে, জাগতিক উন্নয়নের পথে, আধুনিকতার পথে যাত্রা শুরু করতে পারে। ইউরোপ সেটাই করেছে।


খ্রীষ্ট ধর্মের পক্ষেও সেই অবস্থানে ফিরে যাওয়া সম্ভব। কারণ তার উদ্ভব ও বিকাশ রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীকে সংগঠিত করতে গিয়ে কিংবা তাকে অবলম্বন করে হয় নাই। ব্যক্তির হৃদয়ের কাছে, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের কাছে আবেদন রেখেই তার উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল। সুদীর্ঘ কাল তা ছিল রাষ্ট্রের আশ্রয়ের বাইরে। বরং তার দ্বারা অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়েছিল। কাজেই খ্রীষ্ট ধর্মের পক্ষে রাষ্ট্রকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব। তাতেও তা একটা সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে, যদিও তাতে তার প্রতাপ ও প্রভাব কমে। অসামরিকভাবে খ্রীষ্ট ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হওয়ায় অসামরিকভাবেই তার বিলুপ্তি সম্ভব। আজ ইউরোপে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্রমিক বিকাশ খ্রীষ্ট ধর্মের ক্রমিক অবক্ষয় ও বিলোপ অনিবার্য করছে।


পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার দাবীদার ইসলামের কাছ থেকে আমরা খ্রীষ্ট ধর্মের মত আচরণ আশা করতে পারি না। ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক হতে বলার অর্থ সোনার পাথরবাটি দাবী করা। ইসলামকে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের মধ্যে সীমিত রাখতে চাওয়া মানে ইসলামের মূল দাবীকেই সম্পূর্ণ অস্বীকার করা। তলোয়ার ও চাবুক হাতে হুকুমদারীর এই ধর্মে ব্যক্তিগত মতামত কিংবা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোনও মূল্যই নাই।


সুতরাং আমাদের মত সমাজে ইসলাম রক্ষা করে জাগতিকতা ও গণতন্ত্র কিংবা জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটানো অসম্ভব। যদি রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাগতিক ও গণতান্ত্রিক ঘোষণা করাও হয় তবু সেটা কার্যকর হতে পারবে না কিংবা রক্ষা পাবে না সমাজ মানস থেকে অবিরাম সমরবাদ ও একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব ও বিস্তারের ফলে। ১৯৭১ পরবর্তীকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তি বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা থেকেও আমাদের এই বিষয় বোঝা উচিত।


আসলে আমাদের দেশের সমস্যা ইউরোপের সমস্যা থেকে অনেক পৃথক। কাজেই সেখানকার মত করে আমরা এখানে জাগতিকতা বা লোকবাদ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। আমরা যদিও ইউরোপের মত উন্নত, জাগতিক ও গণতান্ত্রিক হতে চাই তবু সেটা আমরা ইউরোপের মত করে হতে পারব না। আমাদেরকে এটা হতে হবে আমাদের মত করে। অর্থাৎ এ দেশে জাগতিকতা, গণতন্ত্র ও উন্নয়ন অর্জনের পথ ইউরোপ থেকে ভিন্ন।


এ দেশে সমাজ উন্নয়ন ও প্রগতির পথে ইসলাম যে সবচেয়ে বড় বাধা এই সত্য আমরা যতদিন পর্যন্ত উপলব্ধি করতে না পারব ততদিন পর্যন্ত এ দেশের উন্নয়নের পথে প্রকৃত কোনও পদক্ষেপ দিতে পারব না। ইসলাম ধর্ম এ দেশের সামাজিক উন্নয়নের সর্বোচ্চ বাধা হয়ে থেকে আমাদেরকে উন্নত পৃথিবীর দয়ার উপর নির্ভরশীল এবং আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকতে বাধ্য করবে।


অবশ্য এই প্রসঙ্গে কথা উঠতে পারে যে, ইসলাম যদি সমাজ উন্নয়নের এত বড় বাধাই হয় তবে এক সময় বাগদাদকে কেন্দ্র করে কীভাবে উন্নত আরব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল? কিংবা আমরা কীভাবে সেকালে মুসলমানদের মধ্যে অনেক মনীষা পাই?


এর সহজ উত্তর হল যে, আরব বিজয়ের পর মূল আরব ভূখণ্ডের বাইরে আরব সভ্যতার যে বিকাশ ঘটে তা ইসলামের শক্তি বা ভূমিকার কারণে নয়, বরং সভ্যতার শক্তি বা ভূমিকার কারণেই ঘটেছে। বর্বরতার শক্তি যতই থাক তা সভ্যতাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারে না। বরং সভ্যতা শেষ পর্যন্ত কোনও না কোনও ভাবে এবং যত নিম্ন মাত্রাতেই হোক বর্বরতাকে অধিকার করে।


এর কারণ হল যে পাথর বা গাছের ডালধারী বন্য বা বর্বরের পক্ষে ব্রোঞ্জ বা লোহার তলোয়ারধারী সভ্য মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই-এ জয়লাভ করা সম্ভব নয়। কাজেই তলোয়ারের শক্তিকে পরাস্ত করতে হলে তলোয়ার ব্যবহারের কৌশল এবং তা তৈরীর প্রযুক্তিও শিখতে হয়। এইভাবে দেখা যায় যে, একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করতে গিয়ে তার ধ্বংসকারী বর্বরেরা তা থেকে কিছু উপকরণ গ্রহণ করে। সভ্যতার প্রতি যত ঘৃণা নিয়েই যাত্রা শুরু করা যাক সভ্যতাকে ধ্বংস করতে গিয়েই মানুষ সভ্যতার অনেক কিছু নিজের অনিচ্ছাতে হলেও গ্রহণ করতে বাধ্য। অবশ্য সভ্যতার একটা নিজস্ব মনস্তত্ত্ব বা সংস্কৃতি থাকে এবং সেই সঙ্গে থাকে নিজস্ব সমাজ সংগঠন। সভ্যতা থেকে কিছু বৈষয়িক উপকরণ গ্রহণ করা যত সহজ এটা গ্রহণ করা তত সহজ নয়। কাজেই সভ্যতার একটি উপকরণ উন্নত অস্ত্র ও তার প্রয়োগ কৌশল আয়ত্ত করে সভ্যতাকে ধ্বংস করা সম্ভব হলেও সমপর্যায়ের অপর একটি সভ্যতা নির্মাণ করা আর সম্ভব নাও হতে পারে। তবে এটা ঠিক যে, চাইলেও মানুষের পক্ষে আর লোহার যুগ ছেড়ে গাছের ডাল বা প্রস্তরের যুগে ফেরা সম্ভব হয় না।


এই কারণে সভ্যতা ধ্বংসকারী ও পৃথিবীত্রাস মোঙ্গল সমর নায়ক চেংগিয খানও শেষ পর্যন্ত সভ্যতার কাছেই পরাজিত হয়েছিলেন। চেংগিয খানের নামে এমন কথাও প্রচারিত হয়েছে যে, তিনি বলতেন যে, মানুষের থাকা উচিত গৃহের বদলে তাঁবুতে এবং পৃথিবীর সমস্ত শস্যক্ষেত্র হওয়া উচিত মোঙ্গল জাতির অশ্বচারণ ভূমি। চেংগিযের বাহিনীর আক্রমণে ও নৃশংসতায় পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ ধ্বংস হয়েছিল (শুধু চীনেই তিনি দশ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি মানুষকে হত্যা করেন)। এবং অসংখ্য নগর, গ্রাম ও শস্যক্ষেত্র বিধ্বস্ত হয়েছিল। চেংগিয ও তাঁর পুত্র ও পৌত্রদের বাহিনী চীন থেকে পূর্ব ইউরোপ এবং সাইবেরিয়া থেকে ইরান, ইরাক, প্যালেস্টাইন পর্যন্ত বিশাল ভূভাগ পদানত ও বিধ্বস্ত করে।


কিন্তু সভ্যতা ধ্বংসী মোঙ্গলদের এই বিজয়ের পর আমরা কী ঘটতে দেখি? মোঙ্গলদের অধীনেই ধ্বংসের সমস্ত প্রভাব কাটিয়ে উঠে চীন একটা শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও উন্নত দেশে পরিণত হল এবং মোঙ্গলিয়াও আর বর্বর অধুøষিত মরুভূমি মাত্র রইল না, বরং সেখানেও গড়ে উঠল একটি উন্নত সভ্যতা। চেংগিযের পৌত্র কুবলাই খানের রাজত্বকালে ভেনিসের বণিক-পর্যটক মার্কোপোলো মোঙ্গলিয়া ও চীন ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর বর্ণনা থেকে আমরা বহু উন্নত রাজপথ, নগর, গ্রাম, অট্টালিকা, ফল বাগিচা ও শস্যক্ষেত্র সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ মোঙ্গলিয়ার চিত্র পাই। অর্থাৎ পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলের লুণ্ঠিত বিপুল সম্পদ, মেধা ও শ্রমশক্তি দ্বারা সভ্যতা ধ্বংসী মোঙ্গলরা তাদের মরুপ্রায় ভূমি কিংবা মরুর বুকে ক্ষুদ্র আকারে হলেও একটি নূতন সভ্যতা গড়ে তোলে।


এখানে প্রসঙ্গক্রমে আমরা উল্লেখ করতে পারি যে, চেংগিয তাঁর প্রথম যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন চীনের বিরুদ্ধে। ইতিপূর্বে তিনি চীন সম্রাটের অধীন মোঙ্গলিয়ায় একজন ক্ষুদ্র গোত্র নেতা মাত্র ছিলেন। চীন বিজয়ের পর তিনি সেখানে তাঁর ধ্বংসলীলা বন্ধ করে তাঁর ধ্বংসাভিযান পরিচালনা করেন পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অর্থাৎ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল ও পূর্ব ইউরোপের দিকে। এই দিকে তাঁর বিশাল ও ভয়ঙ্কর যুদ্ধাভিযান পরিচালনার উপযোগী দুর্ধর্ষ সমরযন্ত্র গড়ার ক্ষেত্রে সুসভ্য ও উন্নত চীনের সম্পদ, মেধা ও প্রযুক্তি তাঁর কম কাজে লাগে নাই।


চেংগিযের সঙ্গে মুহাম্মদের একটা পার্থক্য ছিল। চেংগিয চেয়েছিলেন বৈষয়িক সভ্যতাকে ধ্বংস করে সমস্ত পৃথিবীতে মোঙ্গল জাতির প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। মুহাম্মদ চেয়েছিলেন মানুষের সভ্য ও সংস্কৃত চিন্তাকে ধ্বংস করে সমস্ত পৃথিবীর উপর অর্ধসভ্য আরব জাতির নিরংকুশ প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। চেংগিয অধিকাংশ ক্ষেত্রে অমোঙ্গলদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ সেক্ষেত্রে মানুষ হত্যা করতে চান নাই যদি তারা নৈতিক ও মানসিকভাবে আত্মহত্যা করতে রাজী হয়, অর্থাৎ যদি ইসলাম ও তার একাধিপত্য গ্রহণ করে। অর্থাৎ চেংগিয যেখানে আক্রমণ করেছিলেন মানুষের বৈষয়িক সভ্যতাকে মুহাম্মদ সেখানে মূলত আক্রমণ করেছিলেন মানুষের মেধাকে, মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে, মানুষের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতাকে। চেংগিযের তুলনায়ও মুহাম্মদ অনেক বেশী সফল। কারণ চেংগিয মুহাম্মদের তুলনায় বহু বিশাল অঞ্চল জয় করলেও তাঁর গড়া সাম্রাজ্য কয়েক শত বৎসরের বেশী টেকে নাই (চীনে মাত্র একশত বৎসরেরও কম সময় টিকেছিল), এবং বিশ্বত্রাস চেংগিয বহু যুগ ধরে স্মৃতি মাত্র। কিন্তু মুহাম্মদের ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া আজও চলছে এবং পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ দেড় হাজার বৎসর যাবত তাঁর সন্ত্রাসী ধর্মের জালে আবদ্ধ হয়ে মূঢ়, মূক ও অন্ধ হয়ে আছে।


ইসলামী সমাজ যে সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তার কৃতিত্ব মূলত আরবদের নয়। এর কৃতিত্ব মূলত অনারবদের। বস্তুত জ্ঞান-বিজ্ঞানে এক সময় ইসলামের যে ভূমিকার কথা বলা হয় তাতে মূল আরব ভূখণ্ডের আরবদের প্রায় কোনই অংশ নাই। যেসব উল্লেখ্য জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধকদের নাম আমরা জানি তাঁরা প্রায় সকলেই অনারব। বিখ্যাত দার্শনিক আবু নাসর আল ফারাবী (৮৭০-৯৫০ খ্রীঃ) জন্মসূত্রে একজন তুর্কী। তার পিতা-মাতার পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন পারসিক। বিশ্ববিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক আবু আলী হোসাইন ইবনে সীনা (৯৮০-১০৩৭ খ্রীঃ) বোখারার এক ইরানী বা পারস্যবাসী। সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসা বিজ্ঞানী মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়া আল রাযী (৮৬৫-৯৮৫ খ্রীঃ) একজন ইরানী যিনি আধুনিক ইরানের রাজধানী তেহরানের নিকটবর্তী রায নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এ ছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞানী মুহাম্মদ আল-খারাজামী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পণ্ডিত ও গণিতজ্ঞ আবু রায়হান আল বিরুনী (৯৭৩-১০৪৮ খ্রীঃ), ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬ খ্রীঃ), ঐতিহাসিক ইবনে আব্‌দ আল হাকীম (মৃতুø ৮৭০ খ্রীঃ), ঐতিহাসিক ইবনে ইয়াহ্‌ইয়া আল বালাজুরী (মৃতুø ৮৯২ খ্রীঃ), জ্যোতির্বিজ্ঞানী উলুঘ বেগ (দিগ্বীজয়ী তৈমুর লং-এর পৌত্র), গণিতবিদ ওমর খৈয়াম, সাহিত্যিক শেখ সাদী, হাফিজ, আবুল কাশেম ফেরদৌস - এঁরা সকলেই অনারব। নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখবার জন্য এঁরা আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন।


কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসলাম মূল আরববাসীদেরকে সামরিক শক্তিতে পরিণত করলেও জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার শক্তিতে পরিণত করতে পারে নাই। অবশ্য ইসলামের বিজয়ের পর মূল আরব ভূ-খণ্ডের বাইরে এশিয়ার ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন এবং উত্তর আফ্রিকার মিসর, লিবিয়া থেকে শুরু করে মরক্কো, মৌরিতানিয়া ও পশ্চিম সাহারা পর্যন্ত বিশাল ভূভাগের জনসংখ্যা নিজ নিজ মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে ক্রমশ আরবী ভাষাকে গ্রহণ করে এবং এইভাবে বৃহত্তর আরব জাতিভূক্ত হয়ে পড়ে।* এই সব এলাকায় মূলত অনারব কিন্তু পরবর্তী কালে আরবীকরণের মাধ্যমে আরবে পরিণত কিছু মুসলিম মনীষী দেখতে পাওয়া যায় যাদের সঙ্গে ধর্ম ও ভাষার বাইরে মূল আরবের কোনও সম্পর্ক নাই। এদের অবদান মূল আরবের অবদান নয়। বরং এই সব মনীষী সৃষ্টিতে ইসলামের কোনও ভূমিকা নাই। কারণ এই সব এলাকায় ইসলামের পূর্বেও যথেষ্ট সংখ্যক মনীষী ছিল যার প্রভাব ইসলামের বিজয়ের পরেও অনেক দিন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল ছিল।


____________________________________________________________________________________________________________________

* আরবকরণের জন্য অন্যান্য জাতির উপর আরবরা কম অত্যাচার করে নাই। ইয়াহ্‌হিয়া আরমাজনী তাঁর “মধ্য প্রাচ্যঃ অতীত ও বর্তমান” নামক গ্রন্থে লেখছেনঃ “তিনি (উমাইয়া খলীফা আব্‌দ আল মালিক) আরবী অক্ষরযুক্ত নূতন মুদ্রা চালু করেন এবং জনসাধারণকে চিঠিপত্র আরবী ভাষায় লিখিতে বাধ্য করেন। কথিত আছে যে, পারস্য ভাষায় লিখিবার অপরাধে হাজ্জাজ হাজার হাজার লোককে হত্যা করেন।” ¬ মধ্যপ্রাচ্যঃ অতীত ও বর্তমান; অনুঃ মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক; বাংলা একাডেমী; ঢাকা। জুন, ১৯৮৪। পৃঃ১০৬।

____________________________________________________________________________________________________________________

 

সুতরাং ইসলামের ইতিহাসে এক পর্যায়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনায় যেসব মুসলিম মনীষীর উদ্ভব ঘটে তাতে ইসলামের নিজস্ব কোনও কৃতিত্বই নাই। বরং এইসব মনীষীর বিকাশ সম্ভব হয় ইসলামের ধর্মীয়-সামাজিক বাধাকে অস্বীকার করেই। আমরা জানি এই জ্ঞানীদের বিপুল অংশকেই তাঁদের জ্ঞান সাধনার জন্য বিভিন্নভাবে ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কর্তৃত্ব দ্বারা সমালোচিত, নিন্দিত কিংবা লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম ¬ এঁরা তাঁদের বিশ্বাস বা চিন্তার কারণে তীব্র নিন্দা ও ধিক্কারের সম্মুখীন হয়েছেন যা ইসলামী সমাজে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক ব্যাপার। মুসলিম স্পেনের বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ইবনে রুশ্‌দকে তার স্বাধীন ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তাধারার জন্য লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছিল।


আসলে বিশাল ভূভাগ জয় করে আরবরা নিজেদের অধীনে বহু সভ্যতার ফসলকে কেন্দ্রীভূত করেছিল। মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ইরান অনেক পূর্ব থেকেই উন্নত সভ্যতার অধিকারী। সভ্যতায় অবক্ষয় ঘটলেও বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য চর্চা এইসব এলাকায় তখনও টিকে ছিল। মিসরের প্রাচীন সভ্যতা বিনষ্ট হলেও মিসর তখন ছিল গ্রীক-রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবাধীন। মিসর ও সিরিয়ায় গ্রীক-রোমান জ্ঞান চর্চার ক্ষীণ ধারা তখনও বহমান ছিল। অন্যদিকে পারস্য ছিল সভ্য ও সংস্কৃত দেশ। বিশেষত ভারতের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দর্শন চিন্তার প্রভাব সেখানে সুদীর্ঘ কাল ধরেই প্রবেশ করেছে। আর মধ্য এশিয়া ছিল চীন, ভারত ও পারস্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত। ইসলাম তার বিজয় দ্বারা এই বিশাল ভূভাগ করায়ত্ত করার সাথে তার জ্ঞান ও জ্ঞানীদেরকেও নিজ অধীনে নেয়। এই বিশাল অঞ্চলের জ্ঞান ও সভ্যতার শক্তির কারণেও ইসলাম প্রথমেই মোঙ্গলদের মত অতটা বর্বর হতে পারে নাই যদিও ইসলামও ধ্বংস ও পীড়ন কম করে নাই। ইরানী সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবাধীন বাগদাদকে কেন্দ্র করে আরব অধিকৃত সভ্যতা ও জ্ঞানের একটা কেন্দ্রীভূত প্রকাশ ঘটে। কিন্তু যখন ইসলাম একবার তার নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় তখন তা সভ্যতা ও জ্ঞানের এই কেন্দ্রীভূত বিকাশকেও ধ্বংস করে দেয়। নিরংকুশ সমরবাদী ধর্ম হওয়ায়ও তা সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশকে ভয় করে। কারণ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ তথা জ্ঞান মানুষের হিংস্রতা, বর্বরতা, পশুত্ব ও যুদ্ধপরায়ণতাকে সংযত করে, মানুষকে নম্র ও সহিষ্ণু করে। তাই ইসলামের জ্ঞান চর্চা বলতে মূলত কুর্‌আন-হাসীস কেন্দ্রিক শাস্ত্রচর্চা। আর ইসলামের সভ্যতা ও সংস্কৃতি মূলত তার যুদ্ধের সভ্যতা ও সংস্কৃতি।


সুতরাং ইসলামের বিজয়ে বিশাল এলাকার মেধার কেন্দ্রীভবনের ফলে জ্ঞান চর্চায় যে সাময়িক উজ্জীবন ঘটে তাকে ধ্বংস করার জন্য নবম শতাব্দীর শেষার্ধে পরিচালনা করা হল নির্মম নির্যাতন ও হত্যাভিযান। মুতাযিলা নামে পরিচিত সে যুগের যুক্তিবাদী ও অন্যান্য মুক্তচিন্তার অধিকারী হাজার হাজার পণ্ডিত ও চিন্তাবিদকে হত্যা করা হল। এইসবই করা হল প্রকৃত ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য।


অবশ্য আব্বাসীয় খলীফা মামুনের দুই উত্তরাধিকারীর পরবর্তী শাসকদের সময় পণ্ডিত ও জ্ঞানীদের বিরুদ্ধে যে হত্যাভিযান ও নির্যাতন পরিচালনা করা হয় সেটাই প্রথম ও শেষ ঘটনা ছিল না। পূর্ববর্তী আব্বাসীয় এমন কি উমাইয়াদের শাসনকালেও বহু জ্ঞানী-গুণীকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছিল এবং নবম শতাব্দীর পরবর্তী কালেও বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রে এই ধরনের নির্যাতন ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এইসব ক্রমিক নির্যাতন, সন্ত্রাস ও সামাজিক চাপ প্রকৃত জ্ঞান সাধনাকে শেষ পর্যন্ত ধ্বংস করে ফেলে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে অজ্ঞানের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়।


এটাই অনিবার্য ছিল। ইসলাম জ্ঞান ও মুক্তচিন্তাকে রোধ করে বলে সমাজ মানস বন্ধ্যা হয়ে যায়। বাইরের অন-ইসলামী সমাজ থেকে আগত বা অধিকৃত জ্ঞান চর্চা ক্ষুদ্র কেন্দ্রে টিকে থাকতে পারে। কিন্তু সমাজ মানসে অব্যাহত ধারায় উৎপন্ন অন্ধত্ব ও বর্বরতার বিস্তারের ফলে এই জ্ঞান চর্চা ভিতর থেকে কোনও সরবরাহ পায় না। ইসলাম গ্রহণ বা প্রতিষ্ঠার এক কিংবা দুই প্রজন্মে জ্ঞান চর্চায় অবক্ষয় ও সংকোচনের লক্ষণ দেখা দেয়। তাই যখন বাইরের জ্ঞানের সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় ইসলামী সমাজে সীমিত জ্ঞান কেন্দ্রও ধ্বংস হয়ে যায় চারপাশের অন্ধত্বের চাপে। এইভাবে সমাজ মানসে সৃষ্ট বিস্তীর্ণ মরুভূমি এক সময় জ্ঞানের সীমিত ও ক্ষুদ্র মরূদ্যানকে গ্রাস করে।


ইসলামের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এত দৃঢ় এবং তার ধর্মতত্ত্ব এমনই প্রভাব সৃষ্টিকারী যে মানুষের মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীন জ্ঞান চর্চাকে ধ্বংস করার জন্য একবার ইসলাম চাপিয়ে দিতে পারাই যথেষ্ট। বল প্রয়োগে বাধ্য হয়ে হোক আর স্বেচ্ছায় হোক একবার ইসলামের আওতার ভিতরে গেলে সেখান থেকে নিজ শক্তি বলে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। বিশেষত সাধারণ মানুষের পক্ষে তখন আর নিজেদের চেষ্টায় ইসলামের নিয়ন্ত্রণ ভাঙ্গা সম্ভব হয় না। শুধু যে শাসকের ভয় ও শাসন মানুষকে বেঁধে রাখে তা নয় তার চেয়েও বেশী কার্যকরভাবে বেঁধে রাখার শক্তি হল নামায, রোযা, হজ্জ্‌, মিলাদ, ওয়াজ এবং সর্বোপরি নরকের ভয় ও স্বর্গের লোভ। নরকের শাস্তির বীভৎস ও ভয়ঙ্কর বর্ণনা যে কোনও বিশ্বাসী মানুষকে সন্ত্রস্ত ও আতংকিত করার জন্য যথেষ্ট। কুর্‌আন ও হাদীসে নরকের শাস্তি ও কষ্টের দীর্ঘ ও বিস্তারিত বর্ণনা আছে। কুর্‌আনে বলা হয়েছে যে, পাপীকে নরকে আগুনে পোড়ানো হবে, ফুটন্ত গরম জলে সিদ্ধ করা হবে, পুঁজ খাওয়ানো হবে, কখনও ফুটন্ত জল ও পঁুজ মিশ্রিত করে খাওয়ানো হবে এবং আরও অজস্রভাবে লাঞ্ছিত করা হবে। হাদীসে আরও অনেক বিস্তারিতভাবে নরক শাস্তির বর্ণনা আছে।


কুরআনে নরক-শাস্তির কী ধরনের বর্ণনা আছে তা বোঝার জন্য আমরা কয়েকটি উদ্ধৃতি দিতে পারিঃ


১৬। উহাদিগের প্রত্যেকের জন্য পরিণামে জাহান্নাম রহিয়াছে এবং প্রত্যেককে পান করানো হইবে গলিত পুঁজ,

১৭। যাহা সে অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করিবে এবং উহা গলাধঃকরণ করা প্রায় অসম্ভব হইয়া পড়িবে। সর্বদিক হইতে তাহার নিকট আসিবে মৃত্যু-যন্ত্রণা কিন্তু তাহার মৃতুø ঘটিবে না এবং সে কঠোর শাস্তি ভোগ করিতেই থাকিবে।

১৪ সূরা ইব্‌রাহীম


১৯। ............; যাহারা কুফরী করে তাহাদিগের জন্য প্রস্তুত করা হইয়াছে আগুনের পোষাক; তাহাদিগের মাথার উপর ঢালিয়া দেওয়া হইবে ফুটন্ত পানি,

২০। যাহা দ্বারা উহাদিগের উদরে যাহা তাহা এবং উহাদিগের চর্ম বিগলিত করা হইবে।

২১। এবং উহাদিগের জন্য থাকিবে লৌহ মুদগর

২২। যখনই উহারা যন্ত্রণা-কাতর হইয়া জাহান্নাম হইতে বাহির হইতে চাহিবে তখনই তাহাদিগকে ফিরাইয়া দেওয়া হইবে উহাতে; উহাদিগকে বলা হইবে, ‘আস্বাদ কর দহন-যন্ত্রণা।’

২২ সূরা হাজ্জ


৭৪। নিশ্চয় অপরাধীরা জাহান্নামের শাস্তিতে থাকিবে স্থায়ী ¬

৭৫। উহাদিগের শাস্তি লাঘব করা হইবে না এবং উহারা হতাশ হইয়া পড়িবে।

৭৬। আমি উহাদিগের প্রতি জুলুম করি নাই, বরং উহারা নিজেরাই ছিল জালিম।

৭৭। উহারা চীৎকার করিয়া বলিবে, ‘হে মালিক*, তোমার প্রতিপালক আমাদিগকে নিঃশেষ করিয়া দিন।’ সে বলিবে, ‘তোমরা তো এইভাবেই থাকিবে।’

৪৩ সূরা যুখ্‌রুফ


৪৩। নিশ্চয়ই যাক্কূম বৃক্ষ হইবে ¬

৪৪। পাপীর খাদ্য;

৪৫। গলিত তাম্রের মত; উহা উহার উদরে ফুটিতে থাকিবে

৪৬। ফুটন্ত পানির মত।

৪৭। উহাকে ধর এবং টানিয়া লইয়া যাও জাহান্নামের মধ্যস্থলে

৪৮। অতঃপর উহার মস্তকের উপর ফুটন্ত পানি ঢালিয়া দাও।

৪৪ সূরা দুখান


কুরআনের তুলনায় হাদীসে নরক-শাস্তির বহু বিশদ বর্ণনা আছে। আমরা এ বিষয়ে বেশী সময় ব্যয় না করার জন্য একটি হাদীস বর্ণনা করছি;

“সূত্রঃ আবু বকর ইবনে আবু শায়বা, য়াহিয়া ইবনে আবু বুকাইর, জুবাইর ইবনে মুহাম্মদ, সুহাইল ইবনে আবু সালেহ্‌, নোমান ইবনে আবু আইয়াশ, আবু সায়ীদ খুদরী।

“আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন সর্বাপেক্ষা কম শাস্তি এই যে, কেবল মাত্র আগুনের দুইটি জুতা পরাইয়া দেওয়া হইবে, যাহার কারণে (তাহার) মাথার মগজ টগবগ করিতে থাকিবে।”**

(মুসলিম)

____________________________________________________________________________________________________________________

* জাহান্নামের অধিকর্তার নাম মালিক।


** বঙ্গানুবাদ মুসলিম শরীফ; ১ম খণ্ড; অনুঃ মৌলানা নেছারুল হক। পৃষ্ঠাঃ ২৭৬।

____________________________________________________________________________________________________________________


মানুষের আইনে অপরাধীর শাস্তির পরিমাণ নির্ধারিত হয় অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী এবং মৃত্যুদণ্ড যোগ্য অপরাধ ছাড়া লঘুতর অপরাধে শাস্তির মেয়াদ থাকে। আর মৃতুদণ্ড দ্বারা জীবনের পরিসমাপ্তির সঙ্গে শাস্তিরও পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আল্লাহ্‌র আইনে মেয়াদ কিংবা শাস্তির পরিসমাপ্তি নাই। স্থায়ী নরক বাসের রায় দিতেই আল্লাহ্‌র ঝোঁক দেখা যায়। কুরআনে বলা হচ্ছে,


১৬১। এবং যাহারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং কাফির রূপে মৃতুøমুখে পতিত হয় তাহাদিগকে আল্লাহ, ফিরিশ্‌তাগণ এবং মানুষ সকলেই লানত (অভিশাপ) দেয়।


১৬২। উহাতে (অভিশাপে) তাহারা স্থায়ী হইবে। তাহাদের শাস্তি লঘু করা হইবে না এবং তাহাদিগকে কোন বিরাম দেওয়া হইবে না।


১৬৩। এক ইলাহ্‌, তিনিই তোমাদের ইলাহ্‌, তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্‌ নাই। তিনি দয়াময়, অতি দয়ালু।

২ সূরা বাকারা

 

৬৩। উহারা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের বিরোধিতা করে তাহার জন্য আছে জাহান্নামের অগ্নি, যেথায় সে স্থায়ী হইবে? উহাই চরম লাঞ্ছনা।

৯ সূরা তাওবা


২৮। জাহান্নাম, ইহাই আল্লাহ্‌র শত্রুদিগের পরিণাম, সেথায় উহাদিগের জন্য রহিয়াছে স্থায়ী আবাস আমার নিদর্শনাবলী অস্বীকৃতির প্রতিফল স্বরূপ।

৪১ সূরা হা-মীম-আস্‌ সাজদ্‌া


২৩। ......। যাহারা আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলকে অমান্য করে তাহাদিগের জন্য রহিয়াছে জাহান্নামের অগ্নি, সেথায় তাহারা চিরস্থায়ী হইবে।

৭২ সূরা জিন্‌


কিন্তু বিশ্বাসী মানুষ আল্লাহ্‌র এই ধরনের বিচারের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় খুঁজবার সাহসই পায় না। পরলোকে ইসলামের নরক জাহান্নামে অনন্ত কালব্যাপী ভয়ঙ্কর শাস্তির বিশদ বর্ণনায় বিশ্বাসী মানুষ সঙ্গত কারণেই ভয়সন্ত্রস্ত হয়। সুতরাং আল্লাহ্‌ সম্পর্কে যদি মনে কোনও প্রশ্ন জাগে তৎক্ষণাৎ মনে হবে যদি আল্লাহ্‌ থাকেই তবে তো মৃত্যুর পর এই ভয়ঙ্কর শাস্তি পেতে হবে। এমন কি অনেক সংশয়বাদীও চিন্তা করে, নামায- রোযা করায় ও ইসলাম অনুসরণ করায় কী ক্ষতি? যদি পরকাল না থাকে তবে তো মৃত্যুর পর কোনও অসুবিধাই নাই, একবারে সব ঝামেলা শেষ! কিন্তু যদি আল্লাহ্‌ এবং পরকাল থাকে, তবে? তখন তো আর রক্ষা থাকবে না!


মুহাম্মদ অতি সতর্ক। তাই শুধু আল্লাহ্‌র শাস্তির ভয় দেখান নাই, পাশেই দেখিয়েছেন আল্লাহ্‌র পুরস্কারের লোভ। বিশেষত অনন্ত কালব্যাপী স্বর্গের সুখের বিশদ বর্ণনা আছে কুর্‌আন ও হাদীসে। আল্লাহ্‌ ও মুহাম্মদ ভক্তদের জন্য মদ, মেয়েমানুষ (হূর), চিরকিশোর বালক, ঝর্ণা, ফল ও অজস্র খাদ্য দ্বারা ইসলামের স্বর্গ জান্নাত পরিপূর্ণ। এইভাবে স্বর্গে উচ্ছৃংখল ভোগের চিত্র এঁকে মানুষকে করা হয় প্রলোভিত।


কুরআনের কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলে ইসলাম কীভাবে স্বর্গের ভোগ-সম্ভোগময় চিত্র এঁকেছে তা কিছুটা বোঝা যাবেঃ


৫৫। এইদিন জান্নাতবাসীগণ (স্বর্গবাসীগণ) আনন্দে মগ্ন থাকিবে,

৫৬। তাহারা এবং তাহাদিগের সংগিনীগণ সুশীতল ছায়ায় সুসজ্জিত আসনে হেলান দিয়া বসিবে।

৫৭। সেথায় থাকিবে তাহাদিগের জন্য ফলমূল এবং তাহাদিগের জন্য বাঞ্ছিত সমস্ত কিছু।


৩৬ সূরা য়াসীন


৪১। তাহাদিগের (আল্লাহ্‌র একনিষ্ঠ বান্দাদিগের) জন্য আছে নির্ধারিত রিয্‌ক্‌-

৪২। ফলমূল এবং তাহারা হইবে সম্মানিত,

৪৩। সুখদ¬কাননে

৪৪। তাহারা মুখামুখী হইয়া আসনে আসীন হইবে।

৪৫। তাহাদিগকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া পরিবেশন করা হইবে বিশুদ্ধ সূরাপূর্ণ পাত্র

৪৬। শুভ্র উজ্জ্বল যাহা হইবে পানকারীদিগের জন্য সুস্বাদু।

৪৭। উহাতে ক্ষতিকর কিছুই থাকিবে না এবং উহাতে তাহারা মাতালও হইবে না,

৪৮। তাহাদিগের সঙ্গে থাকিবে আয়ত নয়না, আয়ত লোচনা হূরীগণ (ইসলামী স্বর্গের অপ্সরা)।

৪৯। তাহারা যেন সুরক্ষিত ডিম্ব।

৩৭ সূরা সাফ্‌ফাত

 

৫০। চিরস্থায়ী জান্নাত, তাহাদিগের জন্য উন্মুক্ত যাহার দ্বার।

৫১। সেথায় তাহারা আসীন হইবে হেলান দিয়া, সেথায় তাহারা বহুবিধ ফলমূল ও পানীয়ের জন্য আদেশ দিবে।

৫১। এবং তাহাদিগের পার্শ্বে থাকিবে আনত নয়না সমবয়স্কা তরুণীগণ।

৩৮ সূরা সাদ


৭১। স্বর্ণের থালা ও পানপাত্র লইয়া তাহাদিগকে প্রদক্ষিণ করা হইবে; সেথায় রহিয়াছে সমস্ত কিছু অন্তর যাহা চাহে এবং নয়ন যাহাতে তৃপ্ত হয়। সেথায় তোমরা স্থায়ী হইবে।

৪৩ সূরা যুখ্‌রুফ

 

৫১। মুত্তাকীরা থাকিবে নিরাপদ স্থানে ¬

৫২। উদ্যান ও ঝর্ণার মাঝে,

৫৩। তাহারা পরিধান করিবে মিহি ও পুরু রেশমী বস্ত্র এবং মুখামুখী হইয়া বসিবে।

৫৪। এইরূপই ঘটিবে; উহাদিগকে সংগিনী দিব আয়ত লোচনা হূর,

৫৫। সেথায় তাহারা প্রশান্ত চিত্তে বিবিধ ফলমূল আনিতে বলিবে।

৪৪ সূরা দুখান


১৫। মুত্তাকীদিগকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছে তাহার দৃষ্টান্তঃ উহাতে আছে নির্মল পানির নহর (প্রস্রবণ বা জলধারা), আছে দুধের নহর যাহার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদিগের জন্য সুস্বাদু সূরার নহর, আছে পরিশোধিত মধুর নহর এবং সেথায় উহাদিগের জন্য থাকিবে বিবিধ ফলমূল ও তাহাদিগের প্রতিপালকের ক্ষমা। মুত্তাকীরা কি তাহাদিগকে ন্যায় যাহারা জাহান্নামে স্থায়ী হইবে এবং যাহাদিগকে পান করিতে দেওয়া হইবে ফুটন্ত পানি যাহা উহাদিগের নাড়িভুড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া দিবে?

৪৭ সূরা মুহাম্মাদ


১৭। তাহাদিগের সেবায় ঘোরাফিরা করিবে চিরকিশোরেরা

১৮। পানপাত্র, কুঁজা ও প্রস্রবণ-নিঃসৃত সূরাপূর্ণ পেয়ালা লইয়া,

১৯। সেই সূরা পানে তাহাদিগের শিরঃপীড়া হইবে না, তাহারা জ্ঞান হারাও হইবে না¬

২০। এবং তাহাদিগের পসন্দমত ফলমূল,

২১। আর তাহাদিগের ঈপ্সিত পাখীর গোশ্‌ত লইয়া,

২২। আর তাহাদিগের জন্য থাকিবে আয়ত লোচনা হূর,

২৩। সুরক্ষিত মুক্তাসদৃশ,

২৪। তাহাদিগের কর্মের পুরস্কার স্বরূপ।

. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .

২৮। তাহারা থকিবে এক উদ্যানে, সেখানে আছে কণ্টকহীন কুলবৃক্ষ,

২৯। কাঁদি ভরা কদলী বৃক্ষ,

৩০। সম্প্রসারিত ছায়া,

৩১। সদা প্রবহমান পানি,

৩২। ও প্রচুর ফলমূল,

. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . .

৩৪। আর সমুচ্চ শয্যাসমূহ;

৩৫। উহাদিগকে (হূরদিগকে) আমি সৃষ্টি করিয়াছি বিশেষরূপ -

৩৬। উহাদিগকে করিয়াছি কুমারী

৩৭। সোহাগিনী ও সমবয়স্কা,

৫৬ সূরা ওয়াকিআ


৩১। মুত্তাকীদিগের জন্য আছে সাফল্য,

৩২। উদ্যান, দ্রাক্ষা,

৩৩। সমরয়স্কা উদ্‌ভিন্ন যৌবনা তরুণী

৩৪। এবং পূর্ণ পান-পাত্র।

৭৮ সূরা নাবা


এই হল স্বর্গের আনন্দ, ভোগ ও যৌনসম্ভোগময় জীবনের কিছু কাল্পনিক চিত্র। এই চিত্রই আরও বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে হাদীসে। ইসলামী স্বর্গের ভোগ-সম্ভোগ চিত্র সম্পর্কে আরও কিছু ধারণা লাভের জন্য আমরা নিম্নে তিনটি হাদীস উদ্ধৃত করছি যেখানে মুহাম্মদ বলছেন;


“নিশ্চয় যদি বেহেশতী স্ত্রীলোকদের মধ্যে একটি স্ত্রীলোক দুনিয়াতে প্রকাশিত হয় তবে বেহেশ্‌ত ও দুনিয়ার মধ্যস্থিত যাবতীয় বস্তুকে আলোকময় করিয়া দিবে। এবং উভয়ের মধ্যস্থিত যাবতীয় বস্তুকে সুগন্ধিতে পরিপূর্ণ করিয়া দিবে। উক্ত স্ত্রীলোকের মস্তকের রুমাল দুনিয়া ও উহার মধ্যস্থিত যাবতীয় বস্তু হইতে উৎকৃষ্টতর।”*

(বোখারী, মোসলেম) পৃষ্ঠাঃ ৪২৪


“নিম্নতম মর্যাদার বেহেশতী ব্যক্তি আশি হাজার খিদমতগার ও বাহাত্তরটি স্ত্রী প্রাপ্ত হইবে। তাহার জন্য মুক্তা, জমরুদ ও ইয়াকুতের শিবির স্থাপন করা হইবে।....**

(তিরমিজী) পৃষ্ঠাঃ ৪২৫


“ঈমানদার ব্যক্তিকে বেহেশ্‌তে ‘এত এত’ স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করার শক্তি প্রদান করা হইবে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল - তাহারা কি এত স্ত্রীর সহিত সঙ্গম করিতে সক্ষম হইবে? হযরত (সাঃ) বলিলেন - তাহারা প্রত্যেকে একশত পুরুষের তুল্য সঙ্গমশক্তি লাভ করিবে।

(তিরমিজী) পৃষ্ঠাঃ ৩২৭

____________________________________________________________________________________________________________________

* পবিত্র কোরান ও হাদিছে রসুল (সাঃ)

**  ঐ

____________________________________________________________________________________________________________________

ইসলাম মহত্তর কোনও আবেদন দ্বারা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে না। নরকের ভয়ংকর ও কদর্য শাস্তির ভয় সৃষ্টি করে মানুষকে যেমন করা হয় ভীত-সন্ত্রস্ত, আত্মমর্যাদাহীন ও দাসমনোবৃত্তিসম্পন্ন তেমন স্বর্গের স্থূল ভোগ বর্ণনা দ্বারা মানুষকে করা হয় স্থূল ভোগপরায়ণ। ফলে সাধারণভাবে মুসলমান সূক্ষ্ম ও মানবিক চিন্তা করতে শিখে না এবং অনুভূতিপ্রবণ হয় না। এই সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে আছে ভিন্নধর্মীদেরকে হত্যা, তাদের সম্পদ লুণ্ঠন ও তাদের নারীদেরকে যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধর্ষণের প্রতি ইসলাম ধর্মের অনুমোদন, যা ইসলামের বিজয় ও সম্প্রসারণের কালে মুসলমানদের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুসৃত বা পালিত কর্মনীতি ছিল। আসলে গোটা ধর্মটাই মানুষের সূক্ষ্ম, গভীর, সুকুমার, সৃজনশীল ও মানবিক চিন্তাধারা ও চরিত্র ধ্বংসের এক অতি ভয়ংকর যন্ত্র।


স্থূলবুদ্ধি ও যুক্তিহীনতার ফলে ইসলাম আশ্চর্য রকম স্ববিরোধ ও অসঙ্গতিতে পরিপূর্ণ হয়েও নিজের কোনও ত্রুটি কিংবা স্ববিরোধই দেখতে পায় না। এই ধর্মের সংগঠক স্বয়ং স্ববিরোধের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি পৃথিবীকে ক্রীড়া-কৌতুকময় বলেছেন এবং সবাইকে দুই দিনের দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে পরলোকের উৎকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী আবাস স্বর্গের জন্য নিজেদেরকে তৈরী করতে বলেছেন। নিম্নোক্ত বক্তব্যে দুনিয়াদারীর প্রতি মুহাম্মদের ঘৃণা প্রকাশ পেয়েছেঃ


“যে ব্যক্তি তাহার সমস্ত মনোযোগ দুনিয়া হাসেল করার জন্য খরচ করে সেই ব্যক্তি আমার প্রতিবেশী নহে। আমি দুনিয়াবাসীকে দুনিয়াদার বানাইতে আসি নাই, বরং দুনিয়াদারকে ধ্বংস করিতে প্রেরিত হইয়াছি।*

(তেবরানী) পৃষ্ঠাঃ ২৮৪


কিন্তু বাস্তবে তিনি কি নিজে দুনিয়াদার বা সংসারী কম ছিলেন? তিনি বহু সংখ্যক যুবতী স্ত্রী ও দাস-দাসী পরিপূর্ণ একটি বৃহৎ সংসারের কর্তা ছিলেন। বোখারীর একটি হাদীস থেকে তাঁর পারিবারিক জীবনের একটি দিক সম্পর্কে আমরা জানতে পারিঃ


“আনাস রাঃ বলিয়াছেনঃ রসূলুল্লাহ্‌ সঃ দিন রাতের মধ্যে কোন এক সময়ে পর্যায়ক্রমে তাহার পত্নীদের নিকট গমন করিতেন। তাঁহারা ছিলেন এগারজন। অন্য বর্ণনায় নয়জন। জিজ্ঞাসা করা হইল - তিনি এত সামর্থø রাখিতেন কি? তিনি (আনাস) বলিলেনঃ আমরা বলাবলি করিতাম তাঁহাকে ত্রিশজন পুরুষের শক্তি দেওয়া হইয়াছিল।”**


তাছাড়া তিনি যে দাসী সহবাস করতেন না তেমনও নয়। আমরা তাঁর এক দাসীর গর্ভে এক স্বল্পায়ু পুত্র সন্তান জন্মাবার কথাও জানতে পারি। “মেশকাত শরীফে” এ সম্পর্কে বলা হচ্ছেঃ


“হুজুরের পুত্র হযরত ইব্রাহীম জন্মিয়াছিলেন তাঁহার দাসী হযরত মারিয়া কিবতীয়ার ঘরে।”***

____________________________________________________________________________________________________________________

* পবিত্র কোরান ও হাদিছে রাসুল (সাঃ)।


**  তজরীদুল বুখারী (প্রথম খণ্ড) বাংলা একাডেমী। পৃষ্ঠাঃ ৮৮।


*** মেশকাত শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, প্রকাশকঃ এমদাদিয়া লাইব্রেরী, চকবাজার, ঢাকা-১১; ১৯৮০। পৃষ্ঠা ২৭৩।

____________________________________________________________________________________________________________________


এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, অন্যান্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মত যুদ্ধবন্দী সুন্দরী নারীদেরকেও মুহাম্মদ যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করতেন এবং নিজ অংশেও নিতেন। সুতরাং তিনি ছিলেন বহু সংখ্যক যুদ্ধবন্দী নারীর মালিক।


আসলে ইসলামের এই প্রতিষ্ঠাতাই হলেন ইসলামের প্রথম হেরেম নির্মাতা যেখানে তিনি বহু সংখ্যক নারীকে তাঁর স্ত্রী কিংবা দাসী হিসাবে অবরুদ্ধ করে রাখেন। এই অবরোধের জন্য তাঁর সিপাই-সান্ত্রীর প্রয়োজন হয় নাই। কুর্‌আনের বিধান ও সামাজিক মত সৃষ্টিই যথেষ্ট ছিল। স্ত্রীদেরকে বশীভূত রাখবার জন্য মুহাম্মদ অনেক কয়টি আয়াত উপস্থিত করেন। নিম্নে আমরা কুর্‌আনের তিনটি আয়াত উল্লেখ করছি যা থেকে মুহাম্মদ তাঁর স্ত্রীদেরকে শাসনে রাখবার জন্য কতখানি সতর্ক ও কঠোর ছিলেন তার কিছুটা অনুমান করা যায়ঃ


৩২। হে নবী-পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নহ; যদি তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় কর তবে পর-পুরুষের সহিত কোমল কণ্ঠে এমনভাবে কথা বলিও না, যাহাতে অন্তরে যাহার ব্যাধি আছে, সে প্রলুব্ধ হয় এবং তোমরা ন্যায় সঙ্গত কথা বলিবে।


৩৩। এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করিবে; প্রাচীন যুগের মত (ইসলাম পূর্ব যুগের মত) নিজদিগকে প্রদর্শন করিয়া বেড়াইও না। তোমরা সালাত কায়েম করিবে ও যাকাত প্রদান করিবে এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের অনুগত থাকিবে; হে নবী-পরিবার! আল্লাহ্‌ তো কেবল চাহেন তোমাদিগ হইতে অপবিত্রতা দূর করিতে এবং তোমাদিগকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করিতে;


৩৪। আল্লাহ্‌র আয়াত ও জ্ঞানের কথা, যাহা তোমাদিগের গৃহে পঠিত হয়, তাহা তোমরা স্মরণ রাখিবে; আল্লাহ্‌ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সর্ব বিষয়ে অবহিত।

৩৩ সূরা আহ্‌যাব


মুহাম্মদ যখন আয়েশাকে বিবাহ করেন তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ বৎসর এবং আয়েশা তখন ছয় পূর্ণ করে সাত বৎসরে পা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ আয়েশা তখন ছয় বৎসরের শিশু মাত্র। মুহাম্মদ যখন আয়েশাকে সংসার ধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে নিজ গৃহে নিয়ে যান তখন আয়েশার বয়স ছিল নয়।


এই হল এই আল্লাহ্‌ওয়ালা ও দুনিয়াদার বিরোধী ধর্মগুরুর ব্যক্তি জীবনের কর্মকাণ্ডের কিছু বর্ণনা। এই কি একজন আদর্শ ব্যক্তির কাজ যিনি একটা ধর্মসম্প্রদায় ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ক’রে তাঁর জীবনের আদর্শ রেখে যাবেন সবার অন্ধ অনুসরণের জন্য? ইসলাম তো এই ব্যক্তির আদর্শকে মুসলমানদের জন্য উত্তম মনে করেছে যা তাদেরকে পালন করতে হবে! কুর্‌আনে বলা হয়েছেঃ


২১। তোমাদিগের মধ্যে যাহারা আল্লাহ্‌ ও আখিরাতকে (পরকালকে) ভয় করে এবং আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণ করে, তাহাদিগের জন্য রাসূলল্লাহ্‌র মধ্যে রহিয়াছে উত্তম আদর্শ।

৩৩ সূরা আহযাব


এটা ঠিক যে, ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে একটা সময়ে মুহাম্মদ কষ্ট করেছেন। কিন্তু এই কষ্ট কি আমরা চেংগিয ও বাবরের মত অনেক যোদ্ধা ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতার জীবনেও দেখতে পাই না? এইটুকু কষ্ট না করলে কে কোন্‌ দিন নূতন কিছু প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? আসলে তাঁর কষ্টকে আমরা বলতে পারি কঠোর ও সামরিক জীবন চর্চার কষ্ট। তিনি ভোগ্যদ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রেও আড়ম্বর ও বিলাসিতা বিরোধী ছিলেন। কিন্তু সেটা এসেছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা থেকেই। যে কারণে তিনি শুধু রেশম বস্ত্র ও স্বর্ণ, রৌপ্য ব্যবহার বিরোধী ছিলেন না উপরন্তু কবিতা, সঙ্গীত, চিত্রকলা ইত্যাদি সকল কলা চর্চারই বিরোধী ছিলেন। তাঁর আল্লাহ্‌র প্রিয় পাত্র হবার উপায় জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনা নয়, বরং নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি অনুশাসন পালনের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র দাসত্ব ও মুহাম্মদের আনুগত্য করা। কুর্‌আনে বলা হচ্ছে,


৫২। যাহারা আল্লাহ্‌ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ্‌কে ভয় করে ও তাঁহার অবাধ্যতা হইতে সাবধান থাকে তাহারাই সফলকাম।

২৪ সূরা নূর


কাজেই আল্লাহ্‌র দরবারে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সাধকদের কী মূল্য আছে অথবা যারা মানুষের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করে তাদেরই বা কী মূল্য?


আসলে মুহাম্মদের মধ্যে উন্নত চিন্তার মানুষ খুঁজে লাভ নাই। একজন অসংস্কৃত, পশ্চাৎপদ, স্থূল রুচিসম্পন্ন ও অনুন্নত মানুষের মতই তার মনে সূক্ষ্মতার প্রতি ঘৃণা ছিল।* সুতরাং তাঁর ঘৃণা ছিল না স্থূল ও অসংস্কৃত ভোগস্পৃহার প্রতি। কঠোর ধর্ম চর্চা ও নামায, রোযার নিয়ম পালন এবং অনুন্নত ও অনাড়ম্বর জীবন যাপনের সঙ্গে ছিল তাঁর সতর্ক কিন্তু অসংযত নারী সম্ভোগ এবং ধর্মের আবরণে নিরংকুশ একনায়কী ক্ষমতা চর্চা।


____________________________________________________________________________________________________________________

* মুহাম্মদের মন বোঝার জন্য এই হাদীসটি উল্লেখ করা যায়ঃ

 

তিনিই (আইশা রাঃ) বলিয়াছেন, (একদা) নবী সঃ চতুষ্কোণ কাল একটি চাদর পরিয়া নামায পড়িলেন। তাহাতে ছিল নকশা। তিনি উহার নকশার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিলেন। নামায শেষ করিয়া তিনি বলিলেন, ‘এই চাদরখানা আবু জহমের নিকট লইয়া যাও (উহা তাহাকে দাও) এবং আবু জহমের নকশাবিহীন মোটা চাদরখানা লইয়া আইস; কেননা ইহা আমাকে এইমাত্র নামাযে অমনোযোগী করিয়াছিল।’ ৯২ (৯২। নকশী চাদরখানা আবু জহমই হযরত সঃ কে উপহার দিয়াছিলেন।)

- তজরীদুল বুখারী; প্রথম খণ্ড;

বাংলা একাডেমী; ঢাকা; ১৯৫৮

____________________________________________________________________________________________________________________

 

নিজ লক্ষ্য সাধনে মুহাম্মদ নিঃসন্দেহে অসাধারণ বুদ্ধিমান ও প্রতিভাবান ছিলেন। মুহাম্মদ ভক্তরা তাঁর মধ্যে অতুলনীয় দয়া, বিবেচনা, ক্ষমা দেখতে পান। চেংগিয, আলেকজাণ্ডারের অনুসারীরাও নিশ্চয় তাদের নেতার মধ্যে অনেক দয়া, ক্ষমা, বিবেচনা দেখতে পেত। নিশ্চয় তাঁদের অনেক গুণাবলীও ছিল তা না হলে তাঁরা এত বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন না। শত্রুর জন্য তাঁরা যেমনই হোন নিজেদের অনুসারীদের প্রতি তাঁরা নিশ্চয়ই তেমন ছিলেন না। চেংগিযের মত বর্বরও তাঁর প্রথম স্ত্রীকে বিশেষভাবে ভালবাসতেন এবং নিজ সৈনিকদের স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিও ছিলেন যত্নবান। মুহাম্মদ একই সঙ্গে ধর্ম ও সাম্রাজ্য সংগঠক। কাজেই তাঁকে নিশ্চয় অনেক সতর্কভাবে ও হিসাব করে পদক্ষেপ দিতে হয়েছে। তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তো এই যে, তিনি সফল। কিন্তু শুধু সাফল্য কারও মহত্ত্ব বিচারের প্রধান মানদণ্ড হতে পারে না। তিনি মানব সভ্যতায় যে ধারা সৃষ্টি করে গেছেন তার ভূমিকা দিয়েই তাঁকে মূলত বিচার করতে হবে। এই বিচারে আমরা তাঁকে পাই সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ বিরোধী এক শক্তি হিসাবে।


সমস্ত বর্বরতার উত্থান সভ্যতার সঙ্কটের ফলে। ইসলামের উত্থানও একই কারণে। মানুষ তখন সভ্যতার ভবিষ্যতে আস্থা হারিয়েছে। মনে করেছে মানব জাতির বিলয় নিকটবর্তী। মুহাম্মদ এই অনাস্থা ও ধারণাকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছেন কিয়ামত তথা বিচার দিবস বা প্রলয়ের আসন্নতার কথা বলে এবং এইভাবে মানুষের অনাস্থা ও ভীতিকে চমৎকারভাবে কাজে লাগিয়েছেন। কুর্‌আন ও হাদীসে আমরা কিয়ামতের আসন্নতা সম্পর্কে অনেক ঘোষণা পাই। কুর্‌আনে বলা হচ্ছে,


১৮। উহারা কি কেবল এইজন্য অপেক্ষা করিতেছে যে, কিয়ামত উহাদিগের নিকট আসিয়া পড়ুক আকস্মিকভাবে? কিয়ামতের লক্ষণসমূহ তো আসিয়াই পড়িয়াছে! কিয়ামত আসিয়া পড়িলে উহারা উপদেশ গ্রহণ করিবে কি করিয়া!

৪৭ সূরা মুহাম্মাদ


৫৭। কিয়ামত আসন্ন,

৫৮। আল্লাহ্‌ ব্যতীত কেহই ইহা ব্যক্ত করিতে সক্ষম নহে।

৫৯। তোমরা কি এই কথায় বিস্ময়বোধ করিতেছ!

৬০। এবং হাসিঠাট্টা করিতেছে। ক্রন্দন করিতেছ না?

৬১। তোমরা তো উদাসীন,

৬২। অতএব আল্লাহ্‌কে সিজ্‌দা কর এবং তাঁহার ইবাদত (দাসত্ব) কর।

৫৩ সূরা নাজ্‌ম


১। কিয়ামত আসন্ন, চন্দ্র বিদীর্ণ হইয়াছে।

৫৪ সূরা কামার


কুর্‌আনের আরও কিছু আয়াতে কেয়ামতের আসন্নতার কথা বলা হয়েছে। সেসব থাক। বহু সংখ্যক হাদীসও বাদ দিয়ে নিম্নে আমরা দুইটি হাদীস বর্ণনা করব যা থেকে বোঝা যাবে মুহাম্মদ কীভাবে নিজ ধর্ম ও সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর ধ্বংস বা কিয়ামতের আসন্নতা সম্পর্কে ধারণা ও ভীতি সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে ব্যবহার করেছেন।


“জাবির বলিয়াছেন, আমি নবী সঃ কে মৃতুøর একমাস পূর্বে বলিতে শুনিয়াছিঃ তোমরা তো আমাকে জিজ্ঞাসা কর কিয়ামত সম্বন্ধে; কিন্তু উহার জ্ঞান খোদার কাছে; এবং শপথ খোদার, দুনিয়ার বুকে কেহ জীবিত নাই, যাহার উপর যাইবে শত বর্ষ এবং সে জীবিত থাকিবে তখন।”*

(মুসলিম)


“আইশা বলিয়াছেনঃ বহু বেদুইন নবী সঃ এর নিকট আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিত কিয়ামত সম্বন্ধে। তিনি তাকাইতেন তাহাদের সর্ব কনিষ্ঠের দিকে, তারপর বলিতেন, যদি জীবিত থাকে এই বালক, বার্ধক্য ধরিবে না তাহাকে এমন সময় কিয়ামত হইবে তোমাদের।”**

(ঐক্য সম্মত)


____________________________________________________________________________________________________________________

* হাদীস শরীফ; (বঙ্গানুবাদ সহ মিশকাতুল মসাবীহর প্রথম বিবৃতি); তৃতীয় খণ্ড; অনুঃ আবদুর রহমান খাঁ, ১৯৫৮; প্রথম সংস্করণ। পৃষ্ঠাঃ ৩৪২-৪৩।


**  ঐ। পৃষ্ঠাঃ ৩৪৩-৪৪।

____________________________________________________________________________________________________________________


পৃথিবীর ধ্বংস নিকটবর্তী। সুতরাং তিনি শেষ নবী। অল্প কিছু সময়ের মানব অস্তিত্বের জন্য আর নূতন ধর্ম বা নবীর প্রয়োজন কীসের? সুতরাং তিনি প্রলয় দিবস পর্যন্ত মানুষকে আল্লাহ্‌র পথে কঠোরভাবে পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। আসন্ন কেয়ামতের পূর্বে সমস্ত পৃথিবীতে তাঁর মত অনুযায়ী আল্লাহ্‌র রাজত্ব কায়েম করতে পারলে তিনি খুশী। তিনি বলেছেন এটাই তাঁর প্রতি আল্লাহ্‌ প্রদত্ত দায়িত্ব। সারা পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র শাসন প্রতিষ্ঠার আগে তাকে শাসনে নিতে হয়েছে আরবকে। এই কাজের অংশ হিসাবে তিনি সংসার করেছেন, যুদ্ধ করেছেন, রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। এর ফলে তিনি সংসারত্যাগী ধর্মনেতাদের মত শুদ্ধ, সরল, মানবিক ও নীতিবান হন নাই, হতে পারেন নাই। এই জন্য তাঁর জীবনে ও বক্তব্যে আমরা বহু পরস্পর বিরোধী উপাদান দেখতে পাই। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে রয়েছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে তাঁর প্রবল বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে অবিচল থেকে তিনি সবকিছু করেছেন।


নিজ উদ্দেশ্য সাধনে মুহাম্মদের নীতিবোধ কী ধরনের ছিল তা বোঝার জন্য আমরা নিম্নে একটি হাদীস উদ্ধৃত করছিঃ


“সাযাব ইবনে জাচ্ছামা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, আবওয়া অভিযান কালে হযরত নবী (সঃ) আমার নিকটবর্তী পথে যাইতেছিলেন। কোন এক ব্যক্তি তাঁহাকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিল যে, রাত্রিবেলা যখন মোশরেকদের বস্তির উপর আক্রমণ চালান হয়, তখন অনিচ্ছাকৃত অনেক শিশু এবং নারীও নিহত হয়। হযরত নবী (সঃ) বলিলেন, (যদিও নারী ও শিশু হত্যা নিষিদ্ধ, কিন্তু বস্তুত) তাহারা মোশরেকদেরই দলভুক্ত, (তাই তাহারা অনিচ্ছাকৃত নিহত হইলে গোনাহ হইবে না)।”*


____________________________________________________________________________________________________________________

* বোখারী শরীফ; তৃতীয় খণ্ড; হামিদিয়া লাইব্রেরী। পৃষ্ঠাঃ ৬৬

____________________________________________________________________________________________________________________


এই হাসীদ থেকে আমরা পাই ধর্ম ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ধর্মনেতার বদলে আর দশজন যুদ্ধবাজের মত মুহাম্মদেরও ব্যবহারিক ও সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয়। আর তিনি যে নিজ ব্যক্তিগত মর্যাদা ও একনায়কী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কতখানি নির্দয় ও নির্বিবেক ছিলেন তা বোঝা যায় কুর্‌আনের এই বক্তব্য থেকে,
৫৩। .......। তোমাদিগের কাহারও পক্ষে আল্লাহ্‌র রাসূলকে কষ্ট দেওয়া অথবা তাহার মৃতুøর পর তাহার পত্নীদিগকে বিবাহ করা কখনও সঙ্গত নহে। আল্লাহ্‌র দৃষ্টিতে ইহা ঘোরতর অপরাধ।

৩৩ সূরা আহ্‌যাব


মনে রাখতে হবে মুহাম্মদ যখন তেষট্টি বৎসর বয়সে মৃতুøবরণ করেন তখন তিনি নয়জন মতান্তরে এগারো জন স্ত্রী রেখে যান। তাঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন যুবতী। একমাত্র সাওদা ছিলেন বিগত যৌবনা। সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী আয়েশার বয়স তখন মাত্র ঊনিশ। আমরা অনুমান করতে পারি যে, এটা তাঁর যুবতী স্ত্রীদের জন্য কত নির্দয় বিধান ছিল।


মুহাম্মদ নিজ মতবাদ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও কাজেই পিছপা ছিলেন না এবং তৎকালীন অর্ধসভ্য, দরিদ্র ও মরুময় আরবের মানদণ্ড অনুযায়ী নিজ স্থূল সম্ভোগের ক্ষেত্রেও কম যান নাই। আসলে তিনি ছিলেন অসাধারণ কূট, ধূর্ত ও নির্দয়। কিন্তু এই সমুদয়কেই তিনি অসাধারণ কৌশলে ঢাকতে জানতেন। তিনি এমন মনস্তত্ত্ব তৈরী করে নিয়েছিলেন যে, তিনি নিজের কোনও কাজেই সামান্যতম অন্যায় দেখতে পেতেন না এবং নিজেকে মনে করতেন সমস্ত সমালোচনা ও নিন্দার ঊর্ধ্বে। তিনি এই মনস্তত্ত্ব ছড়িয়েছেন সবার মধ্যে। এই কাজে ধর্ম হয়েছে তাঁর হাতিয়ার। ফলে তাঁর অনুসারীরাও সেইভাবেই তাঁকে কল্পনা করে নিয়েছে এবং সেই কল্পনার মোড়কে মুহাম্মদকে ঢেকে রেখে তাঁর ও ইসলামের সকল স্ববিরোধ ও ফাঁকির প্রতি হয়েছে আশ্চর্য অন্ধ। আসলে এই মোড়কের ভিতর তারা লুকিয়ে রাখে নিজেদের বিশ্বাসের স্ববিরোধ ও ফাঁকি। তাই এই মোড়কের সামান্য উন্মোচন চেষ্টাতেই তারা আতংকিত ও হিংস্র হয়ে যায়। আর সব ধর্ম ও ধর্মনেতাদের সবলতা ও দুর্বলতা নিয়ে যে সমালোচনা চলে মুহাম্মদ ও তাঁর ধর্মকে নিয়ে তা করার সামান্যতম উপায়ও নেই। সম্প্রতি সাল্‌মান রুশদিকে নিয়ে যা হয়েছে এবং এখনও যার জের চলছে তা থেকে আমাদের অনেক কিছুই ভাববার ও শিখবার আছে।*

____________________________________________________________________________________________________________________

* সালমান রুশদির “স্যাটানিক ভার্সেস” নিয়ে সেই সময় অর্থাৎ এই গ্রন্থ লেখার সময় পর্যন্ত সমগ্র মুসলিম পৃথিবীতে তোলপাড় চলছিল। স্যাটানিক ভার্সেস লেখার জন্য ইরানের তৎকালীন ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় নেতা আয়াতুল্লাহ্‌ খোমেনী রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করেন।  -- লেখক

____________________________________________________________________________________________________________________


সভ্যতার প্রতি বিরূপ হলেও ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা একেবারে করে না তা নয়। কারণ শুধু নামায-রোযা দ্বারা রাষ্ট্র চলে না। প্রতিদ্বন্দ্বী অন-ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হতেও তার কিছু জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু ধর্মের কঠোর বিধিনিষেধ ও ঘৃণার কারণে এগুলির সহজ বিকাশ সম্ভব নয়। সমাজ মানস পরলোকমুখী ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সাধনার প্রতি বিরূপ হওয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র তার অস্তিত্বের প্রয়োজনেই প্রতিদ্বন্দ্বী অন-ইসলামী সমাজের কাছ থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার উপকরণ সংগ্রহের জন্য অব্যাহতভাবে যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে বাধ্য হয়।


এইভাবে লুণ্ঠন দ্বারা ভোগ ইসলামের এক বৈশিষ্ট্য। ঘৃণ্য “কাফেরদের” দ্বারা সৃষ্ট সভ্যতা ও ভোগের উপকরণ ঘৃণ্য হলেও আকর্ষণীয়। সুতরাং ঘৃণার সঙ্গে ভোগ ইসলামের আর এক বৈশিষ্ট্য। যেহেতু দু’দিনের দুনিয়ায় নিজে সৃষ্টি না করে পরের সৃষ্টি আত্মসাৎ ও ভোগে সে অভ্যস্ত তাই লুণ্ঠনবৃত্তি তার মজ্জাগত। এরই উল্টা দিক হল ভিক্ষাবৃত্তি। শ্রমোৎপাদনে ইসলামের যে অনীহা* এবং লুণ্ঠন দ্বারা অপরের শ্রমোৎপন্ন ও সম্পদ ভোগে যে রুচি তা-ই লুণ্ঠন ক্ষমতার অবসান হলে তাকে ঠেলে দেয় নির্বিকার ও নির্লজ্জ ভিক্ষাবৃত্তিতে। এটা ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্র সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

____________________________________________________________________________________________________________________

* উৎপাদন ও কৃষির প্রতি মুহাম্মদের কী ধরনের মনোভাব ছিল তা এই হাদীস থেকে জানা যায়ঃ “ সাহাবী আবু ওমামা (রাঃ) কোথাও লাঙ্গল জোঁয়াল দেখিতে পাইয়া বলিলেন, আমি হযরত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামকে বলিতে শুনিয়াছি যে, এই জিনিস যেই লোকদের ঘরে প্রবেশ করিবে আল্লাহ্‌ তায়ালার সাধারণ নিয়ম অনুসারে তাহাদের উপর সম্মানের লাঘব ও নীচতা নামিয়া আসিবে।”  -  বোখারী শরীফ; দ্বিতীয় খণ্ড; হামিদিয়া লাইব্রেরী। পৃষ্ঠাঃ ৩২৩

____________________________________________________________________________________________________________________

 

ইসলাম মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির মহত্তর চর্চায় শ্রদ্ধার কিছু দেখে না। জীবনের উচ্ছলতা ও সুন্দর আনন্দের প্রতি তার ঘৃণা। নৃত্য, সঙ্গীত, চিত্র এইসব কলার প্রতি তার ঘৃণা। তার মানে এই নয় যে, সুযোগ পেলে ভোগবাদী মুসলমান এগুলো ভোগ করে না। তার ধর্ম পরকালের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিলেও এ জীবনের সব রকম ভোগকেও একেবারে বর্জন করতে বলে নাই। বিশেষত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একনায়কী শাসক জনগণকে কঠোর হাতে ধর্ম ও রাষ্ট্রের নিপীড়ক শাসনে আবদ্ধ রেখে নিজে ইসলামের অনেক বিধি লংঘন করেই উচ্ছৃংখলভাবে ভোগ করেছে। এরও সূচনা করে গেছেন খোদ মুহাম্মদ যিনি সবার জন্য এক সঙ্গে চারজন পর্যন্ত স্ত্রী রাখবার অধিকার দিয়ে নিজের ক্ষেত্রে তার অন্যথা করেছেন। যাইহোক, আজ অন-ইসলামী উন্নত সমাজ দ্বারা সৃষ্ট যুগের প্রভাবে ভোগের সুযোগ শুধু শাসকের জন্য একচেটিয়া নাই। রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা ইত্যাদির আকর্ষণ ঠেকাবার উপায় আর ইসলামের নাই। তাই মানুষ ক্রমবর্ধমানভাবে ভোগমুখী হচ্ছে, চিত্তবিনোদনের দিকে ঝঁুকছে। কিন্তু এই ভোগের মধ্যে থাকে একটা গোপন অবজ্ঞা, অন্তর্গত ঘৃণা। কারণ তার ধর্ম এগুলিকে শিখিয়েছে পাপের বস্তু হিসাবে। কাজেই যে ব্যক্তি অন্যায় জেনে মদ পান করে তারই মত হয় তার দৃষ্টিভঙ্গী। যার সৃষ্টি সে উপভোগ করে তার প্রতি তার মর্যাদাবোধ থাকে না। এর ফলে সে সংস্কৃতি ও জ্ঞান সাধকদের মধ্যে যেমন মহত্ত্বের ও শ্রদ্ধার কিছু দেখে না তেমন এইসব সাধনার প্রতিও আকর্ষণ বোধ করে না। সে চায় তৈরী জিনিস ভোগ করতে। ফলে সভ্যতা ও সংস্কৃতি নির্মাণের জন্য অসংখ্য মানুষের যে কষ্টসাধ্য, নিরলস শ্রম ও সাধনা এবং সমাজের সামগ্রিক লালন প্রয়োজন সেসবের অভাবে ইসলামী সমাজে এ সবের তেমন কোনও বিকাশ হয় না। সমাজ চেতনার অনুন্নয়ন ও পশ্চাদমুখিতা সমাজের উন্নয়ন ও প্রগতিকে অসম্ভব করে রাখে।


যতদিন অন-ইসলামী সমাজসমূহ দেহশক্তি নির্ভর প্রযুক্তি ও তলোয়ারের স্তর থেকে শক্তিনির্ভর প্রযুক্তি ও বন্দুকের স্তরে উত্তরণের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে নাই ততদিন দেহশক্তি ও তলোয়ারের সাহায্যে ইসলামের প্রসার চলেছে; এবং সেই সঙ্গে চলেছে তার পরসম্পদ লুণ্ঠন ও আত্মসাৎ। যখন মানব সমাজ উন্নততর সভ্যতার পর্যায়ে প্রবেশ করেছে তখন সমরবাদী ও লুণ্ঠনপরায়ণ ইসলাম একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেছে; এবং পরের শ্রম, মেধা ও সম্পদ দখল ও আত্তীকরণ দ্বারা নিজস্ব সভ্যতার বুনিয়াদ রক্ষার ক্ষমতাও তার নিঃশেষ হয়েছে।


বস্তুত যুদ্ধ বিজয় ও লুণ্ঠন ছাড়া ইসলামী সমাজের সমৃদ্ধির আর কোনও স্বাভাবিক পথ নাই। সেই যুগ বহুযুগ আগেই চলে গেছে। আধুনিক যুগের মেধা ও বুদ্ধিনির্ভর সভ্যতা আয়ত্ত কিংবা নির্মাণ করার ক্ষমতা তার ধর্মের কারণেই নাই। কারণ ধর্ম ও সমাজ শাসন দ্বারা ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তির স্বাধীন চিন্তা ও মনন এবং নারীর মনুষ্যত্বকে এভাবে দলন ও দমন করে রেখে আধুনিক সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় মেধা, বুদ্ধি এবং সমাজ সংগঠনের বিকাশ ঘটানো অসম্ভব।


অবশ্য প্রশ্ন করা যায় যে, আজ তো মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ ইসলামকে রক্ষা কিংবা ব্যবহার করেই আধুনিকায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। লিবিয়া, কুয়েত, সৌদী আরব ইত্যাদি দেশ তার দৃষ্টান্ত।


কিন্তু বাস্তবে এই সব দেশের উন্নয়ন নিজেদের শ্রমশক্তি ও মেধার জোরে নয়। তারা ভূ-গর্ভস্থ তেল সম্পদের জোরে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে শিল্প-প্রযুক্তি ক্রয় করে এবং বিদেশের শ্রমশক্তি ভাড়া করে এনে উন্নতি সাধন করেছে। তেলের জোরে এই উন্নয়ন হল সম্পূর্ণ ভাসমান এবং তা মুখ্যত দালান, পথ তৈরী, বিলাস ও ভোগ্যপণ্য ব্যবহারে সীমিত। মৌলিক শিল্পায়নে রয়েছে সীমাবদ্ধতা। এবং সবচেয়ে বড় কথা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে রয়েছে সম্পূর্ণরূপে বিদেশ নির্ভরতা। বস্তুত মধ্যপ্রাচ্য এখন পাশ্চাত্য ও উন্নত দেশসমূহের এক বিরাট বাজার।


শিল্প সভ্যতাকে সচল রাখার জন্য যে সামাজিক সংগঠন ও গতিশীলতার প্রয়োজন, ব্যক্তির যে মেধার বিকাশের প্রয়োজন ইসলাম তার পথে দুর্লংঘ্য বাধা হয়ে থাকায় আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবস্থা এইসব দেশে এক সময় আটকে যেতে বাধ্য হবে। বিশেষত তেলের আয় সংকুচিত হবার পর যখন এই নূতন শিল্প ব্যবস্থা সচল রাখার দায়িত্ব নিজেদের উপর এসে পড়বে তখন এইসব দেশ গভীর ও প্রচণ্ড সঙ্কটের সম্মুখীন হবে। অবশ্য তখন এইসব দেশে ইসলাম খুব দ্রুত উৎখাত হবে বলেই মনে হয়। কারণ এই উন্নত জীবন ত্যাগ করে দুম্বা, তাঁবু নিয়ে উটের দড়ি ধরে মরুভূমিতে কিংবা অনুন্নত গ্রামীণ জীবনে ফেরা আর সম্ভব হবে না।


কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের দেশের অবস্থা ভিন্ন। লিবিয়া কিংবা সৌদী আরবের মত খনিজ তেল সম্পদ আমাদের দেশে নাই। কাজেই সহজ পথে আরামে উন্নয়ন অর্জন করা এ দেশের পক্ষে সম্ভব নয়। এ দেশের সমস্যা অত্যন্ত জটিল। ছোট একটা এলাকায় বিপুল জনসংখ্যার প্রচণ্ড চাপ রয়েছে। অথচ সোনা বা তেলের মত খনিজ সম্পদ বিশেষ কিছু নাই যা দিয়ে আমরা বিদেশের কাছ থেকে উন্নয়ন কিনে আনতে এবং মেধা ও শ্রমশক্তি ভাড়া করে আনতে পারি। এমন অবস্থায় আমাদেরকে সংগঠিত করতে হবে আমাদের নিজস্ব উন্নয়ন আর এর জন্য আমাদেরকে ব্যবহার করতে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে উন্নত করতে হবে আমাদের নিজস্ব মেধাকে। আমরা বিদেশের উন্নত প্রযুক্তি অর্জন করতে পারি আমাদের শ্রম ও মেধা দ্বারা। একইভাবে আমরা আমাদের শ্রম ও মেধা দ্বারা আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তিও সৃষ্টি করতে পারি।


কিন্তু এই সকল কাজ পরিচালনার জন্য আমাদের চেতনাকে মুক্ত করতে হবে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ থেকে। ইসলাম এ দেশে সমাজ নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে এ দেশের পশ্চাৎপদতা ও দুঃখের সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে আছে। ইসলাম প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞানের অন্ধকারে সমাজকে ধরে রেখেছে। এ দেশের সমাজ উন্নয়নের জন্য যে নূতন সমাজ সংগঠন বা সমাজ ব্যবস্থার প্রয়োজন সমাজ মানসে ইসলামের গভীর প্রভাবের ফলে সমাজের ভিতর থেকে তার উদ্ভব ঘটানো যাচ্ছে না।


বিশেষত ইসলাম ধর্ম এক ভয়ংকর সন্ত্রাসী ও পীড়নবাদী বা স্যাডিস্টিক একনায়কী ধর্ম। এই পীড়নবাদী বা স্যাডিস্টিক ধর্মের প্রচণ্ড প্রভাবের ফলে এ দেশে কোনও শুভ শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। এর ফলে এ দেশ সামাজিক-রাষ্ট্রিক স্বৈরতন্ত্র ও বৈদেশিক লুণ্ঠনের অবাধ ক্ষেত্র হয়ে আছে। যুগের প্রভাবে এ দেশে যেটুকু উন্নয়ন হচ্ছে তা হচ্ছে মূলত এ দেশের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণী এবং বিদেশী আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের প্রয়োজনে ও নিয়ন্ত্রণে। স্বদেশী শাসকদের সুবিধা ভোগ ও বিদেশী আধিপত্যবাদীদের বাজার রক্ষার প্রয়োজনে। কিন্তু এ দেশের এই উন্নয়ন কখনই বাধামুক্ত হয় না শুধু স্বদেশী শাসক ও বিদেশী নিয়ন্ত্রকদের বাধার কারণে নয় বরং মূলত সমাজ চেতনারই ভিতরের বাধার কারণে। ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে সমাজের ভিতরেই রাখা আছে প্রচণ্ড বাধার যন্ত্র। এটা বৃহৎ শোষক ও আধিপত্যবাদী আন্তর্জাতিক শক্তির জন্য খুবই উপযোগী। এ দেশের ভিতর থেকে কখনই উন্নয়নের স্বাধীন শক্তির বিকাশ হতে পারে না বলে বৈদেশিক আধিপত্যবাদী শক্তিসমূহের পক্ষে এ দেশের সীমিত উন্নয়ন পরিচালনা ও খবরদারী করার ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখা খুব সহজ হয়। একদিকে আছে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারী শাসক শ্রেণী যা জনগণের সকল উত্থান ও বিকাশকে বন্দুক ও বুটের আঘাতে দমন করে, অপর দিকে আছে ইসলাম ধর্ম যা জনগণের চেতনার ভিতর সন্ত্রাসী একনায়তন্ত্র ও স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত রেখে সমাজের ভিতর থেকে কোনও উন্নত চিন্তা ও উৎপাদনশীল শক্তির উদ্ভব অসম্ভব করে রাখে। অর্থাৎ একদিকে মূলত সেনাবাহিনী ও অপরদিকে ইসলাম এই উভয়ের চাপে ব্যক্তি ও সমাজ হয়ে থাকে পঙ্গু।* বস্তুত সেনাবাহিনীর আশ্রয়ে লালিত এ দেশের শাসক ও সুবিধাভোগী শ্রেণীসমূহ ব্যক্তি ও সমাজের এই পঙ্গুত্বের সুফলভোগী। তাই তারাও চায় ব্যক্তি ও সমাজের এই অসহায়ত্ব ও পঙ্গুত্বের মূল কারণ ধর্মীয়-সামাজিক একনায়কতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রকে রক্ষা করতে। অর্থাৎ নিরংকুশ একনায়কের অধীন সমাজ তাদের স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে খাপ খায়। সুতরাং তারা সমাজে অব্যাহতভাবে লালন করে ইসলাম ধর্মকে।


____________________________________________________________________________________________________________________

* এই গ্রন্থ রচনার কালে নির্বাচনমূলক ব্যবস্থার আড়াল নিয়ে সামরিক একনায়ক এরশাদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর শাসন চলছিল। ১৯৯০ সালে গণ-অভুøত্থানে সেনা শাসনের অবসান ঘটে এবং নির্বাচনের ভিত্তিতে জন-প্রতিনিধিদের শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত এক দীর্ঘ সময় রাজনৈতিক শাসনের অভিজ্ঞতাও আমাদের হয়। নির্বাচনমূলক গণতন্ত্রের নামে অবাধ লুণ্ঠন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও একনায়কতন্ত্র শাসিত এই কালের অভিজ্ঞতা সমাজ মানস ও চরিত্র গঠনে ইসলামের ক্ষতিকর ভূমিকাকেই নূতন করে চিহ্নিত করেছে মাত্র। ইসলাম যে মানুষের নৈতিক উন্নতি সাধন এবং উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক সেই সত্যটি এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসনকালে নূতন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। --  লেখক, ১৯ এপ্রিল ২০০৯

____________________________________________________________________________________________________________________


আসলে তো এই ধর্ম ছিল আল্লাহ্‌র নামে সমাজের উপর মুহাম্মদের নিজ নিরংকুশ ও স্বেচ্ছাচারী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার হাতিয়ার। সুতরাং এই ধর্ম বাস্তবে পরিণত হয়েছে সমাজে অব্যাহতভাবে নিরংকুশ একনায়ক সৃষ্টির যন্ত্রে। ইসলাম তার সার্বিক সামাজিক ও মানসিক নিয়ন্ত্রণ দ্বারা এমন এক পরিবেশ তৈরী করে যেখানে সমাজ তার সকল চিন্তা ও কর্মের বোঝা উপরে কাল্পনিক আল্লাহ্‌ ও নীচে বাস্তবে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একনায়কের হাতে ছেড়ে দেয়। কল্পনার আল্লাহ্‌র বাস্তব প্রতিরূপ হয়ে এই একনায়ক শাসকই হয় সমাজের সমস্ত ভাল-মন্দের বিষয়ে ভাববার ও সিদ্ধান্ত নিবার জন্য একমাত্র বৈধ ব্যক্তি। এই পরিস্থিতিতে যেমন সমাজে একনায়কের নিরংকুশ স্বেচ্ছাচার সৃষ্টি হয় তেমন সমাজের উপর তলায় তথা ক্ষমতাকেন্দ্রে অবস্থিত যে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিবর্গ নিয়ে একনায়কের নিরংকুশ একনায়কতন্ত্র পরিচালিত হয়, সমাজের উপরতলায় সেই ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সর্বময় ক্ষমতার আসনটি নিয়ে চলে প্রায় অব্যাহত ষড়যন্ত্র ও হানাহানি। তাই ইসলামের ইতিহাসে এত রক্তপাত ও একনায়কদের এত ঘন ঘন রক্তাপাতময় পরিবর্তন।


অবশ্য এই নিরংকুশবাদী সমাজে ব্যক্তিরও কোনও মূল্য নাই। তাই একনায়ক কে হল সেটাও বড় কথা নয়। একনায়কতন্ত্র ঠিক থাকলেই হল। ক্ষমতার বৃত্ত থেকে উঠে এসে (অর্থাৎ সেনাবাহিনী থেকে কিংবা সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে) যে ব্যক্তিই সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্রীয় আসনটি দখল করে নিতে পারবে সমগ্র সমাজ তাকেই প্রণতি জানাবে।


গণতন্ত্রেও শাসক চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু সেখানে তা পরিবর্তিত হয় জনগণের মত দ্বারা ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে। সেখানে শাসক পরিবর্তনের একটি বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি আছে যা ইসলামে অকল্পনীয়। কারণ ইসলাম হুকুমদারীর ধর্ম। আল্লাহ্‌, মুহাম্মদ ও শাসকের হুকুম এক সূত্রে গাঁথা। কাজেই ইসলাম আমাদের সমাজে সামরিক একনায়কতন্ত্র ও নিরংকুশ স্বৈরতন্ত্রের মূল উৎস হয়ে দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জবরদস্তি, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও নারী নিগ্রহের ব্যাপক বিস্তৃত চর্চাকে।


(সমাপ্ত)

রচনাঃ ১৮ মে - ১৩ জুন, ১৯৯০

 
সর্বশেষ আপডেট শনিবার, ০২ জুলাই ২০১১ ১৬:৩৯

 

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ