Banner
সবেদার ঘ্রাণ -- মৃন্ময় চক্রবর্তী ( ছোট গল্প)

লিখেছেনঃ মৃন্ময় চক্রবর্তী, আপডেটঃ September 12, 2015, 12:00 AM, Hits: 1913

 

পিসি মারা গেল। এখনও চোখ বুজলে পিসিকে দেখতে পাই, তার কত কথা মনে পড়ে। পিসিকে আমি টগর পিসি বলেই জানতাম।আসলে তার নাম ছিল সবিতা। পিসির মেয়ের নাম টগর। টগর দিদি তার নিজের মেয়ে ছিলনা। সে ছিল কুড়োনো মেয়ে। নিঃসন্তান পিসি তাকে নিজের মেয়ের মতই মানুষ করেছিল। টগর দিদি কোনোদিন জানতে পারেনি যে সে পিসির নিজের মেয়ে নয়।

 

পিসির বাড়িটা ছিল সায়েবের খাল পেরিয়ে লাল সুরকি ঢালা রাস্তাটার গায়ে।তখনও খালের উপর পাকা পোল হয়নি, যখন পিসিরা এইগাঁয়ে এসেছিল। বাঁশের সাঁকো দিয়ে তখন খাল পারাপার চলত। খালের জল তখন এখনকার মত ময়লা ছিলনা। সেখানে চান,বাসনমাজা ইত্যাদি চলত। লোকেরা মাছ ধরত জাল ফেলে।কখনো কখনো এক আধটা নৌকো পসার নিয়ে গড়েরহাটের উদ্দেশ্যে তখনও যেত। সেসব অনেক আগের কথা। পিসির বাড়ির ত্রিসীমানায় তখন একটাও বাড়ি ছিলনা। চারদিকে কুল -ভাঁট -ভেরেন্ডার জঙ্গল,বনকচুর ঝোপ আর ধানমাঠ, এর ভেতরেই একা থাকত পিসি। তার ছিল বলিহারি সাহস।

 

আমি মাঝে মাঝে যখন মেঘা খাঁ'র মাটির ঘরের পিছনে চামড়ার ফুটবল খেলতে যেতাম, তখন তেঁতুলগাছের ছাতার নীচে পিসির তকতকে কুঁড়েঘরটাকে দূর থেকে দেখতাম বিকেলের রোদে পিঠ পেতে রয়েছে। আমার কল্পনার রাজ্যে পিসির বাড়িটা এক মায়াজগতের হাতছানি ছিল। ঠাকুমার মুখে যত উপকথার গল্প শুনতাম পিসির বাড়িটা যেন সেই গল্পের একটা চরিত্র হয়ে উঠত। তার ঘরে সেই কবে কোনকালে বিল্বমঙ্গলের কাঁটাবেঁধা চোখে রক্তঝরা ছবি দেখেছি ক্যালেন্ডার, দেখেছি ঊর্ধবাহু রামকৃষ্ণের ফটো। তারপর থেকে খালি মনে হয়েছে গাছগাছালি ঘেরা মাটির ঘরটি যেন কোনো আশ্রম। পিসি যেন সারদামণির মত একজন পরম সাধিকা। অথচ পিসি কিন্তু সুশ্রী গৌরবর্ণা নারী ছিলনা- তবুও মনে হত এসব। ঠাকুমার জন্য পান,সুপারি,কিম্বা দোক্তা আনতে কখনও কখনও যখন পিসির বাড়ি যেতাম, তখন মাটির ঘরের ভেতর কাঠের পালঙ্ক, দীর্ঘ পেন্ডুলাম দোলা দেওয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার সম্ভ্রম বেড়ে যেত আরো।

 

আমাদের বাড়িটা ছিল হেম নস্করের ধানজমির পাশে।আমাদের বাড়ি থেকে পিসির বাড়ির ব্যবধান একটা মাঠের। মা একা থাকলে বা ভয় পেলে পিসিকে ডাক দিত, আর মূহুর্তের মধ্যে পিসি এসে হাজির হত।বাবাকে পিসি ভাই বলে ডেকেছিল, ঠাকুমাকে মা'বলে- সেই থেকে পিসি আমাদের আপনজন। ঠাকুমা পিসিকে 'টগরের মা' বলে ডাকত বলেই হয়ত পিসিকে অলক্ষ্যে আমি টগর পিসি বলেই জানতাম। নিজের পিসিকে কতটুকু দেখেছি, কতটুকু ভালবাসা পেয়েছি- মনে পড়েনা। কিন্তু সবিতা পিসি আমার আপন পিসি ছিলনা- একথা আজও ভাবতেই পারিনা।

 

পিসি আমাকে 'বুড়ো'বা' বলে ডাকত। 'বুড়ো'বা' অর্থাৎ বুড়োবাবা। নিঃসন্তান এক অসহায় নারীর সন্তানপ্রেমী স্নেহকাঙাল মনকে আমি অনুভব করেছি। এখনও তার বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে স্নিগ্ধ তেঁতুলছায়ায়, সবেদাগাছের হাতছানিতে, কুলগাছের অন্ধকারে যেন পিসির মমতামাখানো হাসি লুকিয়ে আছে দেখতে পাই। এখনো কানে বাজে পিসির ডাক, 'বুড়ো'বা ওবুড়ো'বা'!

 

এই ডাক ঘরে থাকলে শুনতে পেলেই বুঝতাম পিসি এসেছে, নিশ্চই সবেদা এনেছে। স্বভাবলাজুক আমি পিসির কাছে খুব একটা আসতে চাইতাম না, কিন্তু পিসি কী আনল সেটা খেয়াল রাখতাম ঠিক। সারা বছর বিভিন্ন সময়ে পিসি আমার জন্য পাকা কুল, খেজুর, নোড়,পেয়ারা ফলসা নানা কিছু ঠোঙা ভরে নিয়ে আসত। বিছানায় শয্যাশায়ী হবার আগে পর্যন্ত তার আসা বন্ধ হয়নি।

 

আমার অক্ষম জীবনে পিসির জন্যে কিছুই কর্তব্য করতে পারিনি। তার স্নেহ উপভোগ করেছি কিন্তু প্রতিদান দিতে পারিনি। মনে হতে পারে এই মণিকাঞ্চনের যুগে কটা সবেদা, নোড়, ফলসার কী এমন দাম! কিন্তু তার ভেতর যে মায়ের অফুরন্ত স্নেহরস তার দাম দেবে কে?

 

স্বামী পরিত্যক্তা এক মহিলার পক্ষে বইবাঁধাই কারিগর কনিষ্ঠ দেওরের অতি সামান্য উপার্জনে, পালিত মেয়ে নিয়ে দিনগুজরান নিদারুণ কঠিন ছিল। চারপাশে চোর ডাকাতের বসবাসের মধ্যে তার এক চিলতে সংসার গড়িয়ে গড়িয়ে চলত। টগরদিদির কাকাকে জেঠু বলে ডাকতাম। মানুষটা ছিল অমায়িক, তার মুখে সবসময় লেগে থাকত প্রাণভরা হাসি। যেন দুঃখ কী তা সে জানেইনা। চোখে মাইনাস পাওয়ারের ডাঁটিভাঙা মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে বিস্ফারিত চোখের হাসিটা ছিল খুবই মায়াময়। জেঠু মারা যাবার পর পিসিও হাসতে হাসতে  চলে গেল কারো কাছে কোনো অভিযোগ না রেখে।

 

পিসি সুদে টাকা ধার দিত। আমাদের নৈতিকতাকে দোহাই জানিয়ে বলছি, পিসি সুদখোর মহাজন ছিলনা। তার অত টাকাই বা কোথায়। এছাড়া তার বেঁচে থাকার কোনো উপায় সে হাতের কাছে পায়নি। সঞ্চিত সামান্য কিছু টাকা সে এদিক ওদিক ধার খাটাত বাঁচবে বলে। অথচ মা'কে, যাকে পিসি নিজের বড়ভাইয়ের বৌ'য়ের মত 'বড়বৌ' বলে ডাকত-- বিপদে আপদে তাকে নিজে থেকে কতবার যে টাকা ধার দিয়েছে, অথচ একটিবারের জন্য সুদের কথা বলেনি, তার দৈনিক সামান্য উপার্জন না হলে তার দিনের ভাঙাগাড়িটা গড়াবেনা, তবু বলেনি টাকাকটা তাড়াতাড়ি ফেরত দিও বড়বৌ!

 

পিসি যখন মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে খেত, তখন দেখতাম সামান্য রান্না, সামান্য আয়োজন সত্বেও পরমান্ন খাওয়ার মত তৃপ্তি করে খেতে। এ বাড়িতে পিসির নেমন্তন্ন থাকলে, পিসি তার ঘর গেরস্থালী গুছিয়ে চান টান করে আসতে আসতে বেলা গড়িয়ে যেত পশ্চিমে। আসলে এটাই পিসি দীর্ঘদিন ধরে অভ্যাস করে নিয়েছিল। নানা  ঠাকুরের পুজো, ব্রত-পার্বণ এসবের মধ্যে পিসি তার অভাবকে লুকিয়ে ফেলেছিল। প্রায়ই একবেলা আহার ছিল তার রুটিন। দেবতার নাম করে উপোসের অছিলায় অন্নজল খরচের একটা অংশ পিসি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল।

 

পিসি আমার ঠাকুমার রান্নার এক বিশেষ পদ ' বেগুনচুকি' খেতে খুব ভালবাসত। রান্না হলেই মা প্রায়ই সেই পদ পিসির জন্য পাঠিয়ে দিত। মজার বিষয় পিসি আমার মেয়ের নাম দিয়েছিল ' বেগুনচুকি '। তার ভালবাসা, স্নেহের আন্তরিক প্রকাশ ছিল এই নামকরণ।

 

বাবাকে ওই রাস্তা দিয়ে গেলেই পিসির বাড়িতে অনেক্ষণ বসতে  দেখতাম। বাবা মুখে অনেককিছু না বললেও পিসির সান্নিধ্যে নিজের দিদির চেয়েও বেশী আনন্দ অনুভব করতেন। পরে একথা বাবা নিজেই একদিন বলেছিলেন আমাকে। পিসিও,বাবা যতদিন বেঁচেছিলেন, বাবাকে 'ভাইফোঁটা ' দিতে ভুলে যায়নি।

 

এই স্বামী পরিত্যক্তা নারী তার মনের গভীর থেকে সব ভালবাসা নিঃশেষ করে দিতে এসেছিল। বিনিময়ে সে কিছুই পেলনা। সে বিনিময়ের প্রত্যাশী ছিলনা। তবে অবহেলায় কেউ কোনো প্রতিদান দিলে কুড়িয়ে নিয়েছে পরম যত্নে।

 

তেঁতুলগাছটা আজ আর নেই, কিন্তু তার স্নিগ্ধ হাওয়াটা যেন এই ভাদ্রের গুমোট দুপুরে আচমকাই টের পেলাম। মরে যাওয়া ফলসা গাছের বড় বড় লালচে সবুজ পাতাগুলো হাতছানি দিয়ে যেন ডাকল। পিসির বুনোবাগানে এখন আর কিছু নেই। কালোমেঘ, যুক্তিফুলের ঝোপ কবেই অদৃশ্য হয়েছে। যে সন্ধ্যামণি গাছগুলো পিসির উঠোনের শোভা বাড়াত সেগুলোও কবে মরে হেজে গেছে। শুধু টিকে আছে নোড় গাছটা। আর বাড়ির কোণে যে কচি নিমগাছটা ছিল, সেটা এখন জোয়ান মদ্দর মত আকাশে মাথা তুলেছে। একটা লতানে গাঁদাল তার ঘাড়ে ভর দিয়ে পাল্লা দিতে চাইছে। বাগানে এখন কত নতুন গাছ নতুন জঙ্গল। তবে পিসির উঠোনে সেই কবেকার সবেদাগাছটা আজও মরেনি। পিসির স্মৃতি বুকে নিয়ে কুয়োর পাড়ে দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও।

 

এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাতই যেন পিসির গলা শুনতে পেলাম। সেই কবেকার ওপার থেকে ডাক-- 'বুড়োবা ওবুড়োবা'! মনে হল পিসি যেন আমাদের পুরোনো উঠোনের মনসাতলায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। তার শাড়ির আঁচলে গোল গোল কীসব যেন বাঁধা। আমি ' পিসি ' বলে দৌড়ে বাইরে এসে দেখি কেউ কোথাও নেই, বাদুলে হাওয়ায় দুলে দুলে আমাদের কল্কেফুলের ডালগুলো ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজছে।

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ