Banner
কারাকাব্য — শামসুজ্জোহা মানিক (কারাগারে লিখিত কবিতা সমগ্র)

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 28, 2017, 12:00 AM, Hits: 4360

 

(‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি প্রবন্ধ সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে উক্ত প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী হিসাবে শামসুজ্জোহা মানিককে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে পুলিশ ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে ৫৭(২) ধারায় গ্রেফতার করে জেলে নেয় এবং সেই সঙ্গে প্রকাশনের অফিস ও বিক্রয় কেন্দ্র সিলগালা করে বন্ধ করে দেয়। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, পুলিশ তাকে গ্রেফতারের সময় তার বাসগৃহ থেকে তার ব্যক্তিগত কম্পিউটার, দুইটি মোবাইল ফোন সেট এবং বিপুল পরিমাণ বইপত্র জব্দ করে নিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখযোগ্য যে, ব-দ্বীপ প্রকাশন সিলগালা করার পূর্বে পুলিশ সেখান থেকে এবং বাংলা একাডেমীর একুশে বই মেলার প্রাঙ্গনে ব-দ্বীপ প্রকাশনের স্টল বন্ধ করার পূর্বে সেখান থেকেও ‘ইসলাম-বিতর্ক’সহ বিভিন্ন লেখকের বহুসংখ্যক বই জব্দ করে নিয়ে যায়। আদালতের নির্দেশে ঐ একই বৎসরের ৩০ অক্টোবর তারিখে তিনি জামিনে মুক্ত হন। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ মাস এবং কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাড়ে তিন মাস থাকার সময়ে মোট যে আটাশটি কবিতা তিনি লিখেছিলেন সেগুলিকে ‘কারাকাব্য’ শিরোনামে এখানে প্রকাশ করা হল। — বঙ্গরাষ্ট্র, ২৮ অক্টোবর ২০১৭)

 

 


কাব্যসূচী :

১। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

২। তোমার পথ চলা

৩। রহস্যময়ী

৪। কবি! তখন তোমাকে

৫। সময়

৬। ছায়া তরু

৭। চণ্ডীদাস-রজকিনী

৮। ঝরা পাতা

৯। মানুষের পথ চলা

১০। জেনেটিক কোড ভেঙ্গে

১১। ভাঙ্গা রাজগৃহ

১২। কাল স্রোত

১৩। দেখা হল না যাকে

১৪। জীবন-মৃত্যুর পথ চলা

১৫। তোমাদের সুরে সুর মিলাব না

১৬। শেষ সত্য

১৭। হে সময়!

১৮। নির্জন বনবাস আমার

১৯। মনোবন

২০। পিছু টান

২১। মানুষের ইতিহাস

২২। জানে কি সে?

২৩। সভ্যতার ঘুম পায়

২৪। মুক্ত আকাশের সঙ্গী আমার মন

২৫। রচনা করে যাও তুমি

২৬। বৃক্ষ

২৭। কে তুমি

২৮। কবিতার গন্তব্য

 

 

 

১। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

এটা নন্দন কানন নয় যে,
সুবাতাস বয়ে যাবে
আর দূরাগত ফুলের সুঘাণ ছড়িয়ে দিবে।
এখানে তারাভরা ঝিলমিল রাত
বাতাসের ডানায় ভর করে এসে
ফিস ফিস করে শুনায় না
 প্রাণের আকুতি ভরা সান্ত্বনার ভাষা।
এখানে দিন-রাত চলে যায় শুধু
শূন্যে চাবুক হেনে,
সময় তার নাই।
ঘোড়ার পিঠে বসা
যেন এক নিষ্ঠুর আরোহী
ছুটে যায় আদিগন্ত সীমানায়,
একটু বিরতি যে নিবে সে সময় তার নাই।

এটা নন্দন কানন নয় যে,
পাখীর কাকলিতে এটা মুখরিত হবে
আর নির্ঝরিণী বয়ে যাবে
শীতল বাতাস ছড়িয়ে দিয়ে
সবুজ মাঠের বুক চিরে মৃদু স্বরে কথা ব’লে;
আর তার তীরে শুনা যাবে
নির্ভয় হাসি মানুষের ─
পুরুষ অথবা নারীর।

এটা নন্দন কানন নয়,
এখানে সেসব কিছুই নাই,
আছে লোহার গরাদ আর ইটের প্রাচীর,
এখানে আর আছে যেন অগণন
প্রস্তরীভূত মানুষ-শরীর।
তবু তারা চলে ফিরে আর কথা বলে,
জীবনের বিদ্রূপ যেন এক অতীব গভীর।

এটা নন্দন কানন নয়,
এখানে সবার উপরে আছে
আগ্নেয় অশ্বপৃষ্ঠে এক লৌহ আমীর
ক্রূর হেসে দলে চলে মানুষ আর
শুনে তাদের ভীত আর্তনাদ;
বিনিময়ে পায় সন্ত্রস্ত প্রণাম
আর স্তূপীকৃত মণি-কাঞ্চন
পায়ের কাছে।
আগ্নেয় অশ্বের পৃষ্ঠে লৌহ আমীর
সাপের মত বিষ তার জিভে
আর হাতে ধরা আইনের চাবুক তার
যখন তখন পড়ে যার তার কানে আর পিঠে।
লৌহ আমীর ক্রূর হাসি হাসে
তারপর আগ্নেয় ঘোড়ার পিঠে
লাফ দিয়ে উঠে আর
কত টাকা আয় হল সে কথা ভাবে।

এটা নন্দন কানন নয়,
এটা এক কারাগার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
এখানে রাজরোষে বন্দীরা থাকে।
আর সবার উপরে
আগ্নেয় অশ্বপৃষ্টে বসা
লৌহ আমীর
আইনের চাবুক হাতে নিয়ে
ক্রূর হাসি হাসে।

১৩ মার্চ ২০১৬
৩০ ফাল্গুন, ১৪২৩, রবিবার  
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২। তোমার পথ চলা

অনেক হাজার বছর
সভ্যতার পথে রক্ত কেন ঝরেছে এত
কেন এত অশ্রুপাত চারিদিকে
আছে কি এসবের কোনও প্রতিকার?
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে চেয়ে
বহুকাল আগে তুমি
এক অচেনা পথের পথিক হয়েছিলে।

দিনের পর আসে রাত
তারপর দিন,
কখনও তরুছায়া ঘেরা পথ
কখনও রৌদ্রস্নাত প্রান্তর
তপ্ত বালু কখনও উড়ে মুখের উপর,
কখনো কেউ উঁকি দেয়
তারপর যায় দূরে,
হয়ত কিছু কুশল বিনিময়
তার বেশী কিছু নয়।

বড়ই কঠিন এ পথ চলা, যেন
অন্তহীন দুঃখের পথ ধরে চলা
এক নিঃসঙ্গ পথের পথিক তুমি
এক অন্তহীন কালের।

এ পথ চলা কখন ফুরাবে
জেনেছ কি কখনো,
উত্তরও কি পেয়েছ কোনো
সব জিজ্ঞাসার?
শুধু জেনেছ তুমি
অন্তহীন পথ ধরে
তোমার চলা
আরও দূর দিগন্তের ওপার।

যেদিন ফুরাবে তোমার পথ চলা
তুমি জানবে না সে কথা
জানবে আর সকলে।
 
১৩ এপ্রিল ২০১৬,
৩০ চৈত্র ১৪২৩, বুধবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

৩। রহস্যময়ী

সমুদ্র তীর হতে দূরে, আরও অনেক দূরে
অগণন বৃক্ষের অন্তরাল থেকে যেমন উঁকি দেয় সূর্য
তেমন হঠাৎ করে যেন তার মুখ
উঁকি দেয় অনেক রহস্যের অন্তরাল থেকে।
পিছনে উড়ন্ত এলোমেলো কালো চুল
রহস্যের জাল বিছায়
মনের তলদেশে। মন কি বুঝে কিছু?
নাকি রহস্যের মায়াজালে আবদ্ধ থাকতে চেয়ে
বুঝে না কিছু আবার বুঝে কিছু?
দোদুল বাতাসে যেন সময় দুলতে থাকে
আর এলোমেলো বাতাসে উড়তে থাকা চুল
সামাল হাতে নিয়ে চকিতে চায় যে
বিস্ময় মাখা থাকে চোখে তার
অথবা মুখে। পিছনে কালো মেঘের মত
চুল তার উড়ে। মেঘের আড়ালে
রহস্যের হাসি হেসে
চাঁদের মত মুখ তার লুকায়।

শুধু রহস্য রয়ে যায়
জানা হয় নাই
কী ছিল তার চোখে অথবা মুখে।

২৭ মে, ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দ
১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

৪। কবি! তখন তোমাকে

কবি! তোমার হৃদয় হতে
যে কথা ঝরে পড়ে
তা কি বয়ে যায়
ঝর্ণাধারার মত
তারপর মিলিত হয়
নদীর ধারায়?

কবি! তোমার হৃদয় হতে
সুর কি মূর্ছনা তুলে
উড়ে যায় পাখীর ডানায়?
হৃদয়ের ব্যাকুল কথা
কাউকে শুনাতে চায়
গানের ভাষায়।

সব কথা বলা হলে
সব গান গাওয়া হলে
কবি! তখন তোমাকে
কোথায় পাওয়া যায়?

২৮ মে, ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দ
১৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৩ বঙ্গাব্দ, শনিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

৫। সময়

সময় বয়ে যায় সময়ের স্রোতে
কী কথা শুনাব তাকে?
শুনার কি মন আছে তার
কী হবে বলে?
সময়ের হাত কি ধরা যায়?
তবু ধরতে চাই
সময়কে ইচ্ছামত সাথে নিতে চেয়ে।
কী লাভ আছে
এসব কথা ভেবে
সময় কি নেয় কারো কথা কানে?
সময় সময়ের নিয়মে
বয়ে চলে যায়
আমাদেরো সাথে নেয় টেনে।

২৮ মে, ২০১৬
১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, শনিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

৬। ছায়া তরু

ছায়া তরু তুমি
কী করে এসেছিলে
কথা বলেছিলে?
তুমি ছিলে ছায়া তরু এক
ছায়া দিয়েছিলে।
রৌদ্রদগ্ধ দুপুরে
দূর পথ পাড়ি দিয়ে
শ্যাম তরু দেখে
আমি দাঁড়ালাম যখন
তখন তুমি ছায়া তরু হয়েছিলে।
ছায়া তরু তুমি
কোথা থেকে এলে তুমি
পাশে এসে দাঁড়ালে
তুমি ছায়া তরু হলে।
রোদের আড়াল হয়ে
আমাকে ছায়া দিয়েছিলে।

২৯ মে ২০১৬,
১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, রবিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

৭। চণ্ডীদাস-রজকিনী

চণ্ডীদাস! কী কথা বলেছিল রজকিনী তোমাকে?
যখন তুমি ছিলে একা ঘাটে বসে
তখন কী কথা হয়েছিল দু’জনের মাঝে?
কীসে মজেছিলে তুমি রজকিনী প্রেমে —
চোখের চকিত চাওয়া
নাকি মোহিনী হাসির রেখা
তার বাঁকা ঠোঁটে?
চণ্ডীদাস! কী কথা হয়েছিল দু’জনের মাঝে?
মনে কি কিছু আছে তার, নাকি বিস্মৃতির অতলে?
চণ্ডীদাস! কী কথা বলেছিল রজকিনী তোমাকে?
রইল না জাতকুল, রইল শুধু হৃদয়ের ব্যাকুল চাওয়া,
তুমি পথ ভুলে হারালে তাতে
চণ্ডীদাস! কী কথা তুমি বলেছিলে রজকিনীকে,
কী কথা হয়েছিল দু’জনের মাঝে?

৩০ মে ২০১৬,
১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, সোমবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

৮। ঝরা পাতা

বোঁটা হতে খসে পড়া ঝরা পাতা
ঝরে গাছের তলায়,
উড়ে এসে কিছু পড়ে দীঘির পাড়ে
কিছু পড়ে বাঁশের ঝাড়ে,
মরণের ঘ্রাণ যেন হলুদ পাতায়
করুণ বিলাপ তার বাতাসে ছড়ায়।
পাখীর ঝরা পালকের পাশে
কিছুটা সময় তার উড়াউড়ি হয়
বাতাসের এলোমেলো আঘাতে।
তারপর পড়ে থাকে যেন মরণ শয্যায়
মাটিতে ফিরবার প্রয়োজনে
সময় কাটাতে।
গাছ হতে ঝরা পাতা —
প্রয়োজন ফুরিয়েছে তার
শ্যামল তরুর কাছে।
ঝরা পাতা ঝরে গেছে
তাতে কার কী বা আর
যায় অথবা আসে?
শুধু মাটি তাকে টেনে নেয়
পরম মমতা ভরে তার বুকের কাছে,
হলুদ পাতার ঘ্রাণ
যেন মরণের মত তার শরীরে আছে।
ঝরা পাতা ঝরে গেছে,
অনেক ক্লান্তি নিয়ে
মাটির শয্যায়
ঝরা পাতা শুয়েছে।

৩০ মে, ২০১৬
১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, সোমবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

৯। মানুষের পথ চলা

কত লক্ষ বছর আগে মানুষের পথ চলা শুরু —
আফ্রিকার পর্বত, অরণ্য, প্রান্তর পার হয়ে
যারা এসেছিল ক্রমে অনেক অনেক পথ পাড়ি দিয়ে
এই বাংলায় গঙ্গা, দামোদর, ব্রক্ষপুত্র, মেঘনার তীরে
তুলেছিল ঘর, তারপর বার বার নদী ভাঙ্গা হয়ে
চর থেকে চরে গড়েছে বসত অনেক হাজার বছর
তাদের ছায়া দেখি আমি আমার রক্তের ভিতরে।
যেন নিজের ভিতর দিয়ে আমি পাই দেখতে
অগণন মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব,
কিংবা শুনতে পাই অগণন মানুষের কলরব।
তারা যেন ছায়া হয়ে উঁকি দিয়ে বলে,
‘চেয়ে দেখো সুদূরে, দেখো কীভাবে
মানুষ মানুষ হয়েছে কতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে।
সারা পৃথিবীর মানুষ যেন সেইসব মানুষের ছায়া
যারা আফ্রিকার বুক থেকে বের হয়ে এসে
অনেক ধূসর ঊষর পথ পাড়ি দিয়ে বিস্তার করেছে বসত
সারা পৃথিবীর বুকে, বলো তো তারা তোমার কে?’
জেনেটিক কোড ভেঙ্গে আমি দেখি আমার ভিতর
সংখ্যাতীত মানুষের ছায়া। অগণন মানবী ও মানব
যেন আমার ভিতরে কথা বলে উঠে, তারা আছে
আমার রক্তের ভিতরে অথবা শরীরের কোষে কোষে।
সে পথের শেষ কি রয়েছে কোনো?
বহমান সেই পথ ধরে মানুষ চলে যাবে একদিন
আরো দূর নক্ষত্রের সীমাতে। এ পথ ফুরাবে কোথায়
জানা কি আছে? যদি থাকে তবে তা বলো তো আমাকে!

৩১ মে ২০১৬
১৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, মঙ্গলবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


১০। জেনেটিক কোড ভেঙ্গে

জেনেটিক কোড ভেঙ্গে অনেক আগের নিজেকে
দেখতে চেয়েছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম
অনেক জন্ম আগে কোন উৎস ধারায়
আমি কেমন ছিলাম।
কত জন্ম আগে অনেক জন্মের ভিতরে
আমি কী করে খুঁজব আমাকে?
জেনেটিক কোড ভেঙ্গে খোঁজা কি যাবে?
বংশধারার শিকড়ে
অথবা শাখা-প্রশাখার বিস্তারে —
আমি শুধু দিশাহারা হলাম।
কত জন্ম ধরে আমার ভিতরে আমি হলাম
কত জন্মের প্রবাহে আজকের এই আমি হলাম
জেনেটিক কোড ভেঙ্গে সে ছবি কি আঁকা যাবে?

প্রশ্ন জাগে আরো,
জেনেটিক কোডে লেখা কি আছে
সকল প্রজন্মের যত স্মৃতিকথা?
জেনেটিক কোড ভেঙ্গে সে কি পড়া যাবে
জানা কি যাবে সবার লুকানো গোপন কথা?
যা কিছু জীবনের ইতিহাস হয়েছে?

১ জুন ২০১৬
১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, বুধবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


১১। ভাঙ্গা রাজগৃহ

রাজাগৃহ ছিল একদিন, এখনও লোকে বলে রাজগৃহ,
একদিন রাজা ছিল, রাজ্য ছিল, রাজবংশ ছিল,
এখন সেখানে কিছুই নাই
রাজা, রাজ্য, রাজবংশ সবই ছত্রখান
পুরাতন ধসে পড়া দালানের মত
যেমন হয়েছে রাজগৃহ নামে দালান আজ।
দিনমান বাদুড়, চামচিকা সেখানে ঘুমায়
আর চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি করে।
কিছু সাপের খোলস এখানে সেখানে পড়ে থাকে
আর আছে ঝোপঝাড় কিছু ভাঙ্গা ইটের ফাঁকে
অথবা পাশে। ভাঙ্গা ইটের টুকরাগুলি যেন এখন
বিস্মৃত রাজবংশের স্মারক হয়ে আছে,
যাদের কোথায়ও আর দাবীদার পাওয়া যায় না,
জানি না কেন। হয়ত রয়েছে ধ্বংস, লজ্জা, ভয়ের অনেক স্মৃতি
রাজবংশের গরিমার পতনের সাথে।
ভাঙ্গা রাজগৃহ আজ যেন অতীতকে বিদ্রূপ করে;
কী ছিল সেখানে একদিন, আজ কী আছে,
মিলানো যায় না কিছুতে দুই প্রান্তকে।
শুধু ভাঙ্গা রাজগৃহ পড়ে থাকে। জানি একদিন
সেসবও মাটি-ধূলা হয়ে যাবে,
বৃষ্টির জল ধুয়ে নিবে সাগরে,
ভাঙ্গা রাজগৃহও একদিন হারিয়ে যাবে।

পুরাতন এভাবে চলে যায় একদিন
নূতনকে আর কোনখানে জায়গা করে দিতে।
তবে দুঃখটা ঠিকই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে
এলোমেলো পড়ে থাকা ভাঙ্গা দালানের বুকে।

২ জুন ২০১৬
১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, বৃহস্পতিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


১২। কাল স্রোত

কতকাল আগে যে সব পথ পাড়ি দিয়েছিলাম
তার কিছু আজ স্মৃতিতে আছে,
কিছু একেবারে মনে নাই।
মেঘের আড়ালে সূর্যের মত
সেসব কি বিস্মৃতির আড়ালে লুকানো আছে?
নাকি সবই স্মৃতির ফিতা থেকে
একেবারে মুছে গেছে? হয়ত বা।
অনেক মানুষ মাঝে মাঝে উঁকি দেয়
স্মৃতির পর্দায়,
অনেক ভুলে যাওয়া নাম অথবা মুখ
হঠাৎ মনে পড়ে যায়
তারপর ভুলে যাই একেবারে।
কত নারী ও পুরুষ ছায়া ছবি হয়ে
দেখা দেয় মনের পর্দায়
জানি সেসব সবই হারিয়ে যাবে
কালের স্রোতে
একদিন সকলেই বিস্মৃত হবে।
এই আমিও একদিন কাল স্রোতে ভেসে
বিস্মৃত হব, জানি না শুধু কতকাল পরে।

২ জুন, ২০১৬
১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, বৃহস্পতিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

১৩। দেখা হল না যাকে

সেটা ছিল কুয়াশায় ঢাকা ভোর
তখন ঘুম ভাঙ্গা চোখে
গাছগাছালি আড়মোড়া ভাঙ্গে
আর যেন ভাবে কখন কুয়াশার চাদর
গা থেকে ফেলে দাঁড়াবে।
এমন অস্পষ্ট এক ভোর বেলায়
শিউলি গাছ তলায় ফুল কুড়াতে গিয়ে
দূর থেকে দেখা গেল যেন এক ছায়া মানবীকে।
চুল তার ছড়ানো পিঠে, কাছে যেতে
কুয়াশার আড়ালে কিছুটা হাসির রেখা
যেন তার মুখে এঁকে চকিতে হারালো সে
কুয়াশার মাঝে। কিছুটা পায়ের শব্দ
আর তার শরীরের কিছু ঘ্রাণ যেন
শিউলির ঘ্রাণের সঙ্গে মিশে
কিছুটা সময় রইল বাতাসে।

ঠিক দেখা হল না যাকে
সে যেন এখন মনের ভিতরে আসে
গাছের তলায় ঝরা ফুল কুড়াতে।

৩ জুন ২০১৬
২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, শুক্রবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


১৪। জীবন-মৃত্যুর পথ চলা

মরণ কি অন্ধকার, যেখানে প্রাণের বীজ
ঘুমিয়ে থাকে? তারপর কিছু রস পায়,
তাপ পায়, বাতাসেরও ছোঁয়া কিছু পায়
অবশেষে এক সময় বীজ অঙ্কুরিত হয়।

তবে কি আমাদের যাত্রা মরণের ভিতর থেকে
আবার ফিরে যাওয়া সেখানে?
এ যেন মরণের হাত ধরে জীবনের পথ চলা
অথবা জীবনের হাত ধরে মরণের পথ চলা।
সত্য কি দুইটিই তবে?

বিস্ময় মনে জাগে — কোথা থেকে প্রাণ আসে
কোথায় পুনরায় ফিরে যায়? সে কি চির নিদ্রা?
সে কি অন্ধকার? প্রাণের আধার, আবার
মরণেরও আধার সেটা?
সবটাই তবে কি চির অন্ধকার, শুধু মাঝখানে
প্রাণের চঞ্চল খেলায় কিছু আলো থাকে?

৪ জুন ২০১৬
২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, শনিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

১৫। তোমাদের সুরে সুর মিলাব না

তোমাদের সুরে সুরে মিলাব না বলে
আমি চলে গিয়েছিলাম
লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে
নির্জন বনবাসে,
চেয়েছিলাম থাকতে আপনার মনে
আমার রচিত বনগৃহে।
ইচ্ছা হলে কারও
শুনে যেত আমার রচিত গান
হয়ত বা সেটা শুনাত আর কাউকে।

তোমাদের সুরে সুর মিলে না বলে
তোমরা পেলে ভয়। আমার বনবাস
ভেঙ্গে দিলে। আমার একতারা, দোতারা
যা কিছু ছিল সেসবও ভেঙ্গে দিলে
আমাকে শিকল পরালে।
যেন মুক্ত ছিল যে পাখী
সে পাখী খাঁচায় বন্দী হল।
যেন তাতে থেমে যায় গান তার,
আসলে কি গান তার থেমেছে?

৭ জুন ২০১৬
২৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, মঙ্গবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


১৬। শেষ সত্য

সে রাতে ছিল
আকাশ ভরা তারা
আর ছিল গাছের ডালপালা নেড়ে
খুশীতে নেচে চলা হাওয়া।
কয়েকটা উল্কা হঠাৎ
আলোর রেখা টেনে
আকাশের গা থেকে পড়ছিল খসে
বাতাসের বুকে পুড়ে ছাই হতে।

ইচ্ছা হল এমন এক রাতে
এমন এক অভিযানে যেতে
যেখানে শেষ প্রান্তকে
আর তাই শেষ সত্যকে
খুঁজে পাওয়া যাবে।

প্রথমে মনে হল যাওয়া যাক তবে
বস্তুর কণা ভেঙ্গে তার কেন্দ্রের শেষ সীমানাতে
অস্তিত্বও যেখানে তার বিলীন হবে
আর এইভাবে শূন্যতে পৌঁছানো যাবে।
এবার মনের গতি নিয়ে ছুটলাম আর
অণু-পরমাণু ভেঙ্গে চললাম
 বস্তুর শেষ সীমানাতে পৌঁছাতে চেয়ে
যেখানে সকলই শূন্য হবে।

পেলাম না কোথায়ওই সেই শূন্যকে
শুধু বস্তুকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ক্লান্ত অবশেষে
ফিরলাম শূন্যকে না পেয়ে
শূন্য হাতে, সেই তারা ভরা রাতে
হাওয়ার দোলনায় দোল খাওয়া ভুবনে।

কিছু প্রশ্ন মনকে তবু দোলা দিয়ে গেল
শেষ কেন্দ্র, শেষ প্রান্তের মত
শেষ সত্যও নাই কি তাহলে?
সবই কি আবদ্ধ এখানে
আপেক্ষিকতার নিয়মে?
শূন্য কি তবে নাই কোনখানে
সবই কি বস্তুর আলোছায়া খেলা
এই বিশ্বচরাচরে?
আরও প্রশ্ন মনে জাগে
বস্তু থেকে শূন্যে, শূন্য থেকে বস্তুতে
কীভাবে সৃষ্টির আসা যাওয়া চলে?
‘বিগ ব্যাং’-ও মনে প্রশ্ন আনে
ঘটেছে যে ‘বিগ ব্যাং’
অগণন ‘বিগ ব্যাং’ আছে কি
সবশেষ সেই ঘটনারও পিছনে?

অনেক হয়েছে আজ, আর নয় ভেবে
ক্লান্ত শরীরে মনে
সেই হাওয়ার রাতে শুলাম বিছানাতে
অনন্ত নিদ্রার একটু কণার স্বাদ পেতে চেয়ে।

৭ জুন ২০১৬
২৪ জৈষ্ঠ্য ১৪২৩, মঙ্গলবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


১৭। হে সময়!

দুঃখ মনে রেখে লাভ কিছু নাই
জীবনের সত্যটা এমনই
সময়কে ফিরানো যায় না কখনই।
যে সময় চলে গেছে নদীর স্রোতের মত
সাগরের মোহনায়
তাকে আর ফিরাবে কী করে?
ভর ক’রে বাতাসের ডানাতে
যে সময় চলে গেছে আকাশের উঠানে,
সারা রাত তারাদের বাতি জ্বেলে
সেখানে কি তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে?
যে দিন চলে যায় সে দিন যেন স্বপ্ন হয়ে যায়
যে দিন আসে নাই এখনো সে দিনও স্বপ্ন দেখায়
মোহনীয়, মোহময়; দিন চলে যায়
যেন বেদনার বাঁশী বাজিয়ে হৃদয়ের গভীরে।
যে দিন চলে গেছে, সে দিন ফিরবে না আর
শুধু স্মৃতির মালায় ফুলের মত গাঁথা হয়ে
কিছু রয়ে যায়
বাকীগুলি ঝরে যায়।

সময়! আহ্ সময়! তুমি এসেছিলে কেন,
কেন বা এমন করে শুধু চলে যাও,
ক্লান্তিহীন গতি নিয়ে ছুটে চলা হে সময়!
দাঁড়াবে না জানি, তবু যদি দাঁড়াতে একটু তুমি
ফিরবে না জানি, তবু যদি ফিরতে একটুখানি
ফিরাতে আর একবার সেইসব সোনালী সময়
হে সময়! হে সময়! হে সময়!

১২ জুন ২০১৬
২৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, রবিবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

১৮। নির্জন বনবাস আমার

সেটা ছিল নির্জন বনবাস আমার
নগর প্রান্ত থেকে বহু দূরে
অরণ্যের অন্তরালে ছিল আমার পর্ণকুটীর
সবুজ গাছের ছায়াতলে।
অনেক প্রান্তর, নদী, পথ-ঘাট পার হয়ে
সেখানে যেতে হত যেখানে ছিল আমার বনবাস।
লোকালয় থেকে ছিল তা অনেক অনেক দূরে।
সেখানে ছিল অগণন পাখীর কুজন
গাছ-গাছালিতে। তারা গাইত যখন
যেন মধু ঝরে পড়ত তখন তাদের গানের সুরে।
পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথে
নেমে এসেছিল এক ঝর্ণাধারা
বয়ে গিয়েছিল তা
আমার কুটীরের পাশ দিয়ে
অজানা পথে।
সূর্যের আলোতে তা যেন হত এক
রূপালী আলোর রেখা বনভূমিতে।
হরিণেরা যখন করত জলপান সেখানে
চকিত দৃষ্টি হেনে, বাতাস নেচে যেত
তখন বনভূমি থেকে ঝর্ণার বুকে ঢেউ তুলে
আরও দূর দিগন্তের ওপারে।
মাঝে মাঝে রাতে অতিথি পাখীরা ঝাঁক বেঁধে
উড়ে যেত শব্দ করে দূর কোনো সরোবরে ঘুমাতে।
আমি কখনো সেসব দেখতাম চেয়ে, দেখতাম
কীভাবে তারা উড়ে চলে যায় বনভূমির ওপারে।
কখনও সারা দিনমান ঘুরতাম বনে
কখনও ফলমূল কুড়াতাম
বাকীটা সময় কেটে যেত
প্রাচীন অনেক পুঁথি পাঠ করে
আর কখনো বা লিখতাম
মনের ভাবনাকে রূপ দিতে ভাষাতে।
এভাবে কেটে গেছে দিন, মাস, বছর
কেটেছে আমার দীর্ঘ বারোটা বছর
লোকালয় থেকে দূরে নির্জন বনবাসে।

১৪ জুন ২০১৬
৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৩, মঙ্গবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


১৯। মনোবন

এক অরণ্য আছে আমার অধিকারে
যার কথা জানা নাই সকলের।
কখনো যখন ইচ্ছা হয়
চলে যাই সেখানে, কাটাই অনেক সময়।
কখনো কাটে দিন, কখনো বা রাত
এভাবে অনেক সময় কাটে নির্জনতায়।
সেখানে অগণন তারা সারা রাত জ্বালা থাকে
আকাশের আঙ্গিনায়,
সারা দিন বাতাস সেখানে স্নান করে
আলোর বন্যায়।
হরিণেরা সেখানে নির্ভয়ে হাঁটে, ছুটাছুটি করে
জল পান করে ছোট্ট নদীর ধারে,
পাখীরা গানের সুরে মাতোয়ারা হয়,
কখনো ময়ূর পেখম তুলে নাচে
যদি বা তাতে প্রেয়সীর মন হয় জয়।

যখন ইচ্ছা হয় চলে যাই সেখানে
এইসব জনারণ্য, মানুষের ভিড় থেকে দূরে
অনেক তিক্ততাকে ভুলে যেতে চেয়ে
চলে যাই সেখানে সারি সারি বৃক্ষের আড়ালে
যেখানে গেলে আমি একা হয়ে যেতে পারি
মুহূর্তের ভিতরে।

সেই বন থাকে সবার অগোচরে
সেটা আছে আমার মনের গভীরে।

১৭ জুন ২০১৬
৩ আষাঢ় ১৪২৩, শুক্রবার
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২০। পিছু টান

বৃক্ষ আমাকে কাছে টানে
যেমন কাছে টানে পাহাড়-পর্বত,
নদী-স্রোত, দূর দিগন্ত ছোঁওয়া আকাশ,
দিগন্ত বিস্তার প্রান্তর।
কত লক্ষ বছর পার করে
এখানে এলেও এখনো সেসব
আমাকে পিছু টানে, নিতে চায় সেখানে।
বুঝা যায় আমার ‘জেনেটিক কোডে’
অনেক লক্ষ বছর ধরে সেসব হয়ে আছে
লিখা, আর তাই মাঝে মাঝেই
আমাকে সেসব হাতছানি দেয়, টানে কাছে।
তখন হারাতে চাই সেইসব বনে
বৃক্ষরাজির ভিতর, পর্বত গুহাতে
যেতে চাই আর একবার। গাছের বাকল
অথবা পশুর চামড়া পরে
কারা আছে সেখানে
সেসব দেখতে ইচ্ছা করে।
জানি যতই লিখা থাক ‘জিনে’ —
শরীরে ও মনে,
আমার মনে উঁকি দেয় এখন
নক্ষত্রের দিকে ছুটে যাওয়া
ধাতব রকেট, আগুনের হল্কা ছুটানো
গর্জন করে বিদ্যুৎ গতিতে
ছুটে যাওয়া ধাতব রকেট।
দূর গ্রহ এখন আমাকে টানে
তবু মাঝে মাঝে পিছনে তাকাই।

১৭ জুন ২০১৬
৩ আষাঢ় ১৪২৩, শুক্রবার
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২১। মানুষের ইতিহাস

মানুষকে নিয়ে গর্ব করি বটে
কিন্তু তাকে নিয়ে গর্বের কতটুকু আছে?
এতটা পথ পাড়ি দিয়ে
মানুষ যে মানুষ হয়েছে তার কতটা ভাল?
এও তো সত্য সভ্যতার পিছনে আছে
বহু মানুষের যুগ যুগ সঞ্চিত
অশ্রু আর রক্ত ঝরানো ইতিহাস।
শুধু গান নয়, হাসি নয়,
কান্নার দীর্ঘ ইতিহাসও রয়েছে সেখানে
প্রস্ফুটিত সভ্যতার পরতে পরতে।
এসব কী করে ভোলা যাবে!
নারীর ইতিহাস আরও করুণ এখানে
কতটুকু সময় নারীকে মানুষ ভাবা হয়েছে?
চিরকাল নারী যেন সভ্যতার বেদনা
সবচেয়ে বেশী করে বহন করেছে।
মানুষ রচনা করে নিয়ম, আইন
আবার ইচ্ছামত লঙ্ঘন করে
নিজ স্বার্থ মত। এভাবে প্রকৃতির দ্বন্দ্ব
মানুষেই রয়েছে অন্তর্গত।
এই সব নিয়েই মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে,
মানুষ আগামীতে যেখানে যাবে
সেখানেও নিয়ে যাবে তার ইতিহাস
হয়ত অনেক পরিবর্তিত রূপে;
তবু মানুষ মানুষই রয়ে যাবে।
দ্বন্দ্ব-সংঘাত-মিলনের উচ্ছ্রিত স্রোতধারায়
মানুষ এগিয়ে যাবে নাক্ষত্রিক যাত্রার পথে।

২ জুলাই ২০১৬
১৮ আষাঢ় ১৪২৩, শনিবার
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২২। জানে কি সে?

চুলের আড়ালে মুখ তার ছিল অনেকটাই ঢাকা
যেন আলোছায়া খেলা করছিল
মুখের পাশটিতে, কাঁধে-পিঠে
যেন নেমেছিল কালো হয়ে আকাশের মেঘ
এমনই ছিল তার চুল।
কী ছিল তার মনে তখন, শান্ত শ্রাবণ?
নাকি বৃষ্টির ধারা ছিল চোখে?
সবই তো আড়ালে ছিল তার
দৃষ্টির অগোচর, গোচরে ছিল তার পিছন ফেরা
দাঁড়ানো শরীর, লুটানো চুলের রাশি,
সুঠাম দু’বাহু আর মুখের একটু ছায়া
যেন আলোকিত চাঁদের মত,
সেসব এখনও স্মৃতিতে আঁকা  হয়ে আছে।

জানে কি সে কথা সে
যে আছে এখনও তেমনই মনের মাঝে?

১২ জুলাই ২০১৬
২৮ আষাঢ় ১৪২৩, মঙ্গবার
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২৩। সভ্যতার ঘুম পায়

সভ্যতারও এক সময় ঘুম পায়
প্রবল গতি নিয়ে ছুটাছুটি ক’রে এক সময়
সভ্যতা ক্লান্ত হয়, অনেক দ্বন্দ্ব-বিরোধ এবং
সংঘাতের পথ পাড়ি দিয়ে এক সময়
ক্লান্ত-বিদীর্ণ সভ্যতা যেন ঘুমাতে চায়
যেন চলে যেতে চায় সভ্যতা থেকেও অনেক দূরে।
হয়ত তখন ধর্মের বিছানায় শুয়ে পড়ে সে
তারপর অঘোরে ঘুমায় অনেকটা সময়।
তারপর সভ্যতা জেগে উঠে আর কোনোখানে
দেখা দেয় প্রবল রূপে। বিছানা পড়ে থাকে
সভ্যতার গন্ধ কিছু মেখে; তার আর কী কাজ
বিলাপ করা ছাড়া?
সভ্যতা চলে গেছে আর কোনোখানে।

১৩ জুলাই ২০১৬
২৯ আষাঢ় ১৪২৩, বুধবার
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


২৪। মুক্ত আকাশের সঙ্গী আমার মন

এখন কারাগারে অবরূদ্ধ আমি,
তবু মন আমার অবরুদ্ধ নয় এখানে।
মুক্ত আকাশে প্রসারিত দৃষ্টি রেখে
আমি উড়ে যাই যেন পাখীর ডানায় ভর ক’রে
বাতাসের সাথে।
নীচে কিছু দালান, আর অগণিত
সবুজ গাছের সারি —
যেন মনোরম দৃশ্যপট আঁকা হয়ে আছে।
দূর আকাশে সারি সারি মেঘ
ভিড় করে আছে, সেখানে তারও ওপারে
নীলাকাশ সূর্যের আলোয় হাসে।
সেই আলোকিত মুক্ত আকাশ
আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে
বলে পুনরায় তার কাছে যেতে।
কারাগার থেকে মুক্ত হব এক দিন,
একদিন মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়াব
গৌরবে মাথা উঁচু করে।
এখন আমি রাজরোষে বন্দী
পারি না সেখানে যেতে।
তবু মন আমার বন্দী নয়,
তা এখন দুরন্ত বাতাসের সঙ্গী হয়ে
গাছ-গাছালি ঘেরা প্রান্তর, দূর দিগন্ত
আর আকাশ ছুঁয়ে উড়ে যায়
আরও দূর কোনও আকাশের দিকে।
মুক্ত আকাশের সঙ্গী আমার মন
তাই আমার মন সেখানে ছুট চলে যায়।

২৪ জুলাই ২০১৬
৯ শ্রাবণ ১৪২৩, রবিবার
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২৫। রচনা করে যাও তুমি

হে কারিগর। রচনা করে যাও তুমি,
ফল তার তুমি পাবে, কখনো না কখনো
কিছু না কিছু ফল তুমি পাবে —
এই আশা করা অযৌক্তিক কিছু নয় নিশ্চয়।
ছেড়ো না হাল তুমি সহজে
কঠিন শ্রমের ফল পেতে দেরী হলে।
ফল তো তুমি পাবেই জেনো
একদিন আগে অথবা পরে
আসবে তোমার ফল পাবার সময়।
হিম্মত রাখো মনের ভিতরে,
রচনা যা করেছ তুমি তার ফল নিশ্চয়
একদিন তুমি পাবে,
একদিন নিশ্চয় জয়
তোমার করতলগত হবে।

২৬ জুলাই ২০১৬
১১ শ্রাবণ ১৪২৩, মঙ্গল
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২৬। বৃক্ষ

বৃক্ষ! কী আছে তোমার ভিতর.
বলো তুমি মনকে কেন এতো টানো?
এতো দালান, বিদ্যুৎ-তারের ছড়াছড়ি
চারদিকে, তারপরেও তুমি মনকে টানো,
আর টানে দূরবর্তী আকাশ
যেন মুক্তির প্রতীক তা অবিরাম হাতছানি দেয়
অনন্ত, অসীমতায়।

কিন্তু বৃক্ষ! কী আছে তোমার ভিতর?
বলো তো কেন তুমি
মনকে এতো বিহ্বল করো,
এতো মুগ্ধ, উদাস করো?
তবু মানুষ তোমাকেই নিধন করে চলে
যেন সভ্যতার যাত্রাপথ নির্মাণ হয়েছে তার
তোমাকে অঙ্গার ক’রে। অবিরাম চলেছে
করাত ও কুঠার বনভূমি উজাড় ক’রে।
তবু বলো তো বৃক্ষ! কী আছে তোমার ভিতরে
কেন তুমি মনকে এতো উদাস করো
কেন তুমি তাকে কাছে এতো টানো?

৩ আগস্ট ২০১৬
১৯ শ্রাবণ ১৪২৩, বুধবার
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 


২৭। কে তুমি

কে তুমি রয়েছ আমার হৃদয় মাঝে
কত হাজার অথবা লক্ষ বছর ধরে করে আছ অধিষ্ঠান?
আমি যা করি, যেখানে যেতে চাই
তোমার ইঙ্গিত আমাকে মানতে হয়
বার বার ফিরি আমি তোমার দেখানো পথে।
কে তুমি বহু প্রাচীন এক নারী অথবা পুরুষ
কে তুমি আমাকে এভাবে করে আছ অধিকার?
তুমি কি মানুষের সভ্যতার ইতিহাস,
মহা নির্মাণের আড়ালে কান্নায় ভেজা, শোকাতুর
আর রক্ত মাখা ইতিহাস?
নারী ও শিশুর কান্না আর অসহায় পুরুষের বেদনায়
ক্লান্ত, ক্ষুব্ধ ইতিহাস কি তুমি
আমার ভিতরে কথা কও?
তুমি কি বহু হাজার বছরের মানুষের ইতিহাস?
কেন তুমি আমাকে যেতে বলো অবিরাম
যেন অনন্ত যাত্রার পথে বিরতিবিহীন?
কে তুমি আমার ভিতরে রেখেছ অধিষ্ঠান?

৫ আগস্ট ২০১৬
২১ শ্রাবণ ১৪২৩, শুক্রবার
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

 

 

২৮। কবিতার গন্তব্য

সব সময় আবেগ আসে না মনে
তাই চাইলেও কবিতা হয় না লিখা।
কবিতার ভাব নয় ইচ্ছাধীন সতত
যে চাইলেই লিখা হবে কবিতা।
ঝিরি ঝিরি দখিন হাওয়ার মত
তা যখন আসে আর মনের পরতে পরতে
মধুর পরশ বুলিয়ে যায়
হয়ত সেটা কবিতা লিখবার প্রকৃষ্ট সময়।
যেন কবিতার ভাব তখন
ঝরে পড়ে ঝর্ণাধারার মত।
ঝর্ণা ধারা বয়ে চলে যায়
পাহাড়ের বুকে মাথা রেখে
বনের বুক চিরে অজানা গন্তব্য পানে।
ঝর্ণা জানে না কোথায় যাবে সে
তবু গন্তব্য তার ঠিক থাকে, ঢালুপথ বেয়ে
অনেক ঝর্ণার সাথে মিলে নদী হয়ে
একদিন সে যায় সাগরে।
কবিতার ধারা কোথায় বয়ে যায়?
ঝর্ণার মত নদী হয়ে
এঁকে বেঁকে হৃদয়ের প্রান্তরে
বয়ে যায় সে কোন সময়ের মোহনায়?

৩০ আগস্ট ২০১৬
১৫ ভাদ্র ১৪২৩, মঙ্গল
কাশিমপুর-২ কেন্দ্রীয় কারাগার

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ