Banner
একটি গরু ও আমি — তামান্না ঝুমু

লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ November 11, 2022, 12:00 AM, Hits: 404

 

আমার শহর থেকে বের হলেই দেখা পাওয়া যায় অবারিত মাঠ-ঘাট-সবুজের। কাঁচের মতো মসৃণ সড়কের ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটে যেতে থাকে অতি দ্রুত বেগে। গাড়ির ভেতর থেকে কিছুক্ষণ পর পর সড়কের দু’ধারে মাঠে কিংবা খামারের পাশে গরুদের চরতে দেখা যায়। গরু দেখলেই আমি আমার কন্যাদ্বয়কে চমৎকৃত কণ্ঠে বলি, দেখো গরু! ওই যে গরুরা কী সুন্দর ঘাস খাচ্ছে! ওরা বলে, মা, তুমি সবসময় গরু দেখলে এমন করো কেন? গরু ঘাস খায়, এটা কি দেখার জিনিস হলো? 

আমার শহরে গরুর দেখা পাওয়া অসম্ভব। শহরের বাইরে গেলে গরু দেখতে পেলে আমার মনে হয়, গরু নয়, আমি আমার কোনো স্বজনের দেখা পেলাম। গরু আপনমনে ঘাস খাচ্ছে কিংবা উদাস দৃষ্টিতে কোনোদিকে তাকিয়ে আছে, এমন দৃশ্য আমার কছে শিল্পের মতো সুন্দর লাগে। কিন্তু কেন এমন হয়? গরুর প্রতি কেন আমার এমন হৃদয়গ্রাহিতা? অতীত খুঁড়ে-খুঁড়ে তা বোঝার চেষ্টা করি।

একেবারে জন্মলগ্ন থেকে দেখি, কী পাওয়া যায়! আমার জন্ম হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলায়, আমার নানাবাড়িতে। আমার জন্মের পর নবজাত আমাকে কোলে নিয়ে আমার  এক নানা, নূরুল ইসলাম খান,  যিনি আমার বড়মামির বাবা, সাতশত টাকা উপহার দিয়েছিলেন। বছর চল্লিশেক আগে সাতশত টাকা  অনেক টাকা। বর্তমান সময়ে সেই সাতশত টাকার সমমূল্য কত হবে, ঠিক জানি না। তবে বিশাল একটা অঙ্ক হবে, তা বুঝতে পারি। জন্মের কয়েকমাস পরে আমি আমার দাদাবাড়ি তথা বাবাবাড়িতে আসি। আমার পিতা সেই সাতশত টাকায় তখন একটি গরু কিনেছিলেন। 

বাবামায়ের বিবাহের অনেক আগেই আমার নিজের নানা মারা গিয়েছিলেন। আমার জন্মের সময় আমার নানা ছিলেন না। নানাবাড়িতে তখন ছিলেন আমার নানি, দুই মামা ও অবিবাহিত ছোটখালা। আমার নানা কাস্টমসে চাকরি করতেন। নানা মারা যাবার পরে তাই নানি পেনশন পেতেন। নানির জমিজমাও প্রচুর ছিল। বড়মামারও ভাল চাকরি ছিল। ছোটমামার তখনও রোজগারের বয়স হয় নি। কিন্তু নবজাত আমাকে কেবল বড়মামার শ্বশুর, নানা নূরুল ইসলামই উপহার দিয়েছিলেন। আর কেউ কিছুই দেন নি। 

আমার মায়ের তখনও স্কুল-মাস্টারির চাকরিটা হয় নি, পিতা হার্টের অসুখে জর্জরিত। আমাদের সংসারে তাই আর্থিক টানাপোড়েন চলছিল। এজন্য আমার প্রাপ্ত উপহারের টাকাটা দিয়ে আমার জন্য জামাকাপড় ইত্যাদি কিনে অপচয় না ক’রে পিতা তা দিয়ে একটি গরু কেনেন। গরুটি আমাদের কাছে আসবার পরে প্রথম বাচ্চা দেয়। আমি তখন দুগ্ধপোষ্য শিশু। মায়ের দুধের পাশাপাশি আমি সেই গরুর দুগ্ধও পান করি। আমি আস্তে-আস্তে বড় হতে থাকি, সঙ্গে গরুটিও বড় হতে থাকে। পরের কয়েকবছরে আমার ছোট দুইভাইয়েরও জন্ম হয়। আমাদের গরুটি বছর-বছর বাচ্চা দেয়। আমরা ওর দুধ পান করি, নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর কিছুটা বিক্রি করি। ওর দুগ্ধে আমাদের জন্য পায়েস রান্না হয়, শেমাই রান্না হয়, চা বানানো হয়, দই পাতা হয়। 

গরুটিকে খড় দেওয়া, ঘাসের মাঠে চরানো, ওকে গোসল দেওয়া,  ওর গোহালটি পরিষ্কার করা, দুধ দোহানো ইত্যাদি কাজ পিতা নিজেই করতেন। কখনো-সখনো ছোট্ট একটি বালক রাখা হতো এসব কাজে সাহায্যের জন্য। আমাদের গরুটি স্বভাবে খুব শান্ত আর নিরীহ ছিল। ও কখনো শিঙের গুঁতো মারতো না কাউকে। ওর গায়ের রঙ ছিল লালচে বাদামি। শরীরটি প্রশস্ত। ওর দুগ্ধের স্বাদ ছিল অমৃতের মতো। খুব ঘন মিষ্টি আর সুঘ্রাণযুক্ত ছিল সেই দুগ্ধ। আমাদের ক্রেতারা, যারা একবার সেই দুগ্ধের স্বাদ পেত, তারা বারবার কিনতে চাইতো। আমার পিতার এই ব্যাপারে কিছু গুণ ছিল। পিতা কখনো দুধে পানি মেশাতেন না, মাপে দুধ কম দিতেন না, আর দুধ দোহানোর বালতিটি খুব পরিষ্কার জীবাণুমুক্ত রাখতেন সবসময়। সকালে কিংবা বিকেলে দুধ দোহানোর সময় পিতা মাঝেমাঝে আমাকে ডাকতেন, ওর বাছুরটিকে ধ’রে রাখবার জন্য। ও কাজলমাখা দুটি মায়াময় ডাগর চোখে আমার ও ওর বাছুরের দিকে তাকিয়ে থাকতো। নাগালে পেলে বাছুরটির গায়ে জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে আদর করতো। ওর গায়ে  আঠালি হতো, যা দেখতে কিছুটা উকুনের মতো। পিতা ও আমি ওর গায়ের আঠালি বেছে দিতাম। সে-সময়টায় ও চুপ ক’রে আমাদের দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে থাকতো। হয়ত তাতে ও শরীরে আরাম পেতো। মনে হয়, তারই কৃতজ্ঞতা জানাতো অমন মায়ার চোখে আমাদের পানে চেয়ে থেকে। কখনো-কখনো আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে দিতাম। ও ছলছলে চোখে আমার দিকে চাইতো। আরাম আর কৃতজ্ঞতায় ওর চোখে জল এসে যেতো কি?

প্রতিবছর ওর বাচ্চারা একটু বড় হলে ওদের বিক্রি ক’রে দেওয়া হতো, কিংবা কারো কাছে বর্গা দিয়ে দেওয়া হতো। ও থেকে যেতো আমাদের পরিবারের একজন হয়ে। ওর দুগ্ধ এবং বাচ্চারা আমাদের পরিবারে এভাবে খাদ্য পুষ্টি ও অর্থের যোগান দিয়ে যেতে  থাকে। 

আমার কৈশোর সময়ে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর পিতা আমাকে প্রায়শই আমাদের প্রতিবেশীদের বাড়ি-বাড়ি পাঠাতেন, আমাদের গরুর জন্য ভাতের ফ্যান চাইতে।  অধিকাংশ মানুষে ফ্যান দিয়ে হাঁসমুরগির আদার বানাতো, কেউ কেউ তাদের নিজেদের গরুকে খাওয়াতো, আর কেউ কেউ আমি পৌঁছাবার আগেই ফেলে দিতো। দু-একজনের কাছে পেতাম অবশ্য। পিতা আমাদের ফ্যান ও সেই সংগৃহীত ফ্যান দিয়ে গরুর জন্য খাদ্য বানাতেন।  বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ফ্যান চাওয়া তখন আমার কাছে বিষম মানহানিকর ব্যাপার ছিল। কিন্তু পিতার হুকুমের অবাধ্য হবারও সাধ্য বা সাহস ছিল না।

একবার ওর বাছুরটির বয়েস যখন কয়েকমাস, পিতা একদিন সকালে দুধ দোহাতে গোহালে গেলেন। সেখান থেকে হাউমাউ কান্না শুনে আমরা ছুটে গেলাম, প্রতিবেশীরা ছুটে এলো। দেখলাম, ওর বাছুরটি গোহালের মেঝেতে মৃত প’ড়ে আছে। পাশে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে ও। আর আমার পিতা ওদের পাশে ব’সে হাউমাউ কাঁদছেন, স্বজন হারালে মানুষ যেভাবে কাঁদে, সেভাবে। ওর মৃত্যু আমাদের পরিবারের জন্য খাদ্য পুষ্টি ও আর্থিক সঙ্কট বয়ে এনেছিল। কিন্তু পিতার কান্না শুধু সেজন্য নয়, ওর জন্য পিতার ভালোবাসাও ছিল। বাছুরটির কোনো অসুখ করেছিল, নাকি ওকে সাপে কেটেছিল, আমরা কিছুই জানতে পারি নি।  

আমার উপহারের সাতশত টাকায় ওকে কিনে আনার, তারপর থেকে আমাদের পরিবারে ওর ও ওর বাছুরদের আর্থিক ও খাদ্য-পুষ্টি বিষয়ে ভূমিকার কথা পিতা বারবার বলতেন। কিন্তু পিতা মাঝেমাঝে ওকে খুব মারতেন। কারণে-অকারণে পিতার রাগ উঠে যেতো। সেই রাগ তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। কোনোদিন হয়ত ওর হাঁটা পিতার পছন্দ হলো না। ধ’রে লাগাতেন মার। কোনোদিন ওর চাহনী পছন্দ হলো না হয়ত। ধ’রে লাগাতেন মার। ও আঘাত সহ্য করতো নীরবে, কখনো প্রত্যাঘাত করার চেষ্টা করতো না।

এভাবে দিন যেতে-যেতে আমি আরো বড় হতে থাকলাম। আর আমাদের গাভীটি বৃদ্ধ হতে থাকলো। আমি যখন উচ্চমাধ্যমিকে পড়ি তখন ও এমন বৃদ্ধ হলো যে ওর চলতে-ফিরতেও খুব কষ্ট হতে শুরু হলো। ও মেঝেতে বসলে আর উঠতে পারতো না। অনেক কষ্টে উঠলেও হাঁটতে পারতো না। হাঁটার সময় পায়ে-পায়ে পেঁচিয়ে যেতো। আমাদের কোনো রাখাল ছিল না তখন।  পিতার একার পক্ষে ওর দেখভাল করা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। ওর প্রশস্ত ওজনদার শরীরটি মাটি থেকে টেনে তোলা বা মাটিতে শুইয়ে দেওয়া একজনের দ্বারা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। পিতা খুব বিমর্ষ আর চিন্তিত হয়ে পড়লেন ওকে নিয়ে। একদিন দেখলাম, এক অপরিচিত লোক এসে ওকে নিয়ে গেলো। ওকে বিদায় দিতে-দিতে পিতা আবার খুব কাঁদলেন, যেভাবে একদিন কেঁদেছিলেন ওর বাছুরের মৃত্যুতে। পরে জানলাম, ওকে কষাইয়ের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল। আমাদের মন খুব খারাপ হয়েছিল। আমাদের অন্নদাত্রী গাভীটি, যে আমাদের সারাজীবন দুগ্ধ দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে; তাকে পিতা অনন্যোপায় হয়ে কষাইয়ের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর ওর কী হয়েছিল, তা ভাবলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আজও।

ছোটবেলায় ওর জন্য লোকেদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভাতের ফ্যান চাইতে আমার মর্যাদাহানি হতো। আর এটা ভাবতে আমার এখন ভালো লাগে, যে তার পুরোটা জীবন আমাদেরকে শুধু দিয়েই গেছে, তার  জন্য আমি সামান্য খাদ্য সংগ্রহ করে আনবার সুযোগ পেতাম। এজন্যই কি এত বছর পরেও প্রবাসজীবনে কখনো কদাচিৎ  গরু দেখলে মনের ভেতরে এমন আপনজন দেখার মতো অনুভূতি হয়? কী জানি!

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ