Banner
ভাষা নেতা আবদুল মতিনের সাক্ষাৎকার

লিখেছেনঃ bangarashtra, আপডেটঃ October 11, 2008, 12:00 AM, Hits: 2962


  সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মোহাম্মদ আলী

    সাধারণ মানুষের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারে না – আবদুল মতিন

 
 ২০আগস্ট ২০০৮, বিকেলে মতিন ভাইয়ের বাসায় উপস্থিত হলাম। তিনি তখন একটি লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমি যেতেই বললেন, আরে, বসেন বসেন। আমরা দুজন বসে গল্প করছি। এমন সময় কয়েকটি কবুতর ঘরে ঢুকে পড়ল। বইয়ের তাকে বসে বাকবাকুম করতে লাগল।  

 
আমি তাকিয়ে থাকলাম। মনে পড়ে গেল ছোট্টবেলার কথা। আমাদের গ্রামের বাড়িতেও এক সময় কবুতরের আনাগোনা ছিল।

 
তিনি বললেন, এরা আমার বাসায় থাকে। আমি একবার অসুস্খ ছিলাম, তখন আমার এক ভক্ত দুটি কবুতর খেতে দিয়ে যায়। কবুতর দুটি খুব ছোট্ট। আমি ভাবলাম, এটা খেয়ে আর কী হবে? বরং দেখা যাক, কত বড় হয়। সেই থেকে ওরা বড় হচ্ছে। আসে-যায়, ঘোরাফেরা করে এভাবেই।  

 
তিনি কবুতরগুলো তাড়াতে চেষ্টা করলেন। আমি বললাম-না থাক, ভালোই তো লাগছে। তিনি হাসতে লাগলেন।  

 
একটু পরে ভাবী চা আর বিস্কুট নিয়ে এলেন। আমরা আলাপ করছি। ঘন্টাখানেক বাদে তিনি আবারও চা নিয়ে এলেন। আমি বললাম, ভাবী আমার তো চায়ে কোনো নেশা নেই। তিনি হেসে বললেন, লাল চা খেলে কোনো অসুবিধা নেই। একটা পত্রিকার পুরনো কাটিং বের করে তিনি আমাকে দেখালেন, লাল চা খেলে উপকার হয়, হার্ট ভালো থাকে। আমি কিছুটা অবাক হলাম, চা বিষয়ে তিনি এত খোঁজ-খবর রাখেন!

 
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাঁর সম্পর্কে আমার জানার কৌতুহল জাগল। মতিন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাবি কি আপনার সঙ্গে রাজনীতি করতেন? তিনি সরল উত্তর দিলেন, হ্যাঁ করত। তিনি তখন উল্টো আমাকে প্রশ্ন করলেন, এ কথা কেন জিজ্ঞেস করলেন? আমি এ প্রসঙ্গে আর বেশি না গিয়ে বললাম –  কিছু না, এমনিতেই জানতে ইচ্ছা হল।

 
আবদুল মতিন ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর শৈলজনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। থানা বাউনদি, পো: ঘোরযান, জেলা সিরাজগঞ্জ [পুরনো পাবনা জেলা]। বর্তমান ঠিকানা : গ্রাম : দীঘলিয়া, পো: মীরকুষ্টিয়া, থানা : চৌহালী, জেলা : সিরাজগঞ্জ। বাবা আবদুল জলিল। নদীভাঙনের ফলে চাকরির সন্ধানে দার্জিলিংয়ে যান। সেখানে অবস্থানরত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের অফিসে চাকরি করতেন। মা আমেনা বেগম একজন গৃহিনী ছিলেন।

 

আবদুল মতিন ক্লাস ওয়ান থেকে দার্জিলিংয়ের মহারাণী গার্লস হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। প্রিয় শিক্ষক ছিলেন লিলিদি, অনুদি, সাধনাদি। তাঁদের কথা তাঁর খুব মনে পড়ে। তিনি ছিলেন খুব দুষ্ট প্রকৃতির। ওই স্কুলে অধিকাংশ হিন্দু ছেলেমেয়ে পড়ত। তিনি শেরওয়ানি ও চোস্ত পাজামা পরতেন। একবার একজন ছাত্র তাঁকে ‘মসলেন্ডি’ বলাতে আবদুল মতিন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে তাকে একটা ঘুষি মারেন। স্কুলে ঘটনাটি জানাজানি হয়। তখন লিলিদি তাঁকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলে ওকে মারলে কেন! তখন তিনি বললেন, ও আমাকে ‘মসলেন্ডি’ বলে গালি দিল কেন? তাই আমি ওকে মেরেছি। লিলিদি একট মন্তব্য করেছিলেন, এ কী ছেলেরে বাবা, মারামারি করে!

 
প্রথম শ্রেণীতে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হয়েছিলেন। তখন তাঁকে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের একটি অঙ্ক বই পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। টু পর্যন্ত প্রথম হয়েছিলেন। থ্রিতে ওঠার আগে ডিসেম্বর মাসের কোনো এক তারিখে মা মারা যান। তখন রাত ১১টা। মরার আগে মা তাঁকে ডেকে বলেছিলেন, মতিন, তুই একা থাকতে পারবি? তখনই তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মা কেন এমন কথা বলছে? এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর মা মারা যান। তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তিনি তখন বুঝতে পারেন, মা তাঁর কাছ থেকে চির বিদায় নিয়েছেন। তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর মা আর নেই। মা তাঁর কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল, তিনি মা’র কথাটি আজও ভুলতে পারেন না। আর মা’র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে তাঁর সমস্ত বিশ্বাসে চিড় ধরে। তখন থেকে তিনি সকল বিশ্বাস থেকে সরে আসেন। মা’র অকাল মৃত্যু কিশোর মতিনের জীবন ওলটপালট করে দেয়। কোনো কিছুতেই আর তাঁর মন বসে না। তিনি আস্তে আস্তে বাউণ্ডুলে হয়ে ওঠেন।  

 
মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর বাবা আবার বিয়ে করলেন। তিনি তাঁর সৎমাকে কোনোদিনও মা বলে ডাকেননি। সৎমাকে তিনি এড়িয়ে চলতেন। বাবা তাঁকে একদমই স্নেহ করতেন না। তাই তিনি বাবার প্রতি বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ ছিলেন। একবার বাবা তাঁকে হুঁকোর নল দিয়ে মেরেছিলেন। তিনি একটুও নড়াচড়া করেননি। তখন তাঁর বাবা উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, এ কেমন ছেলেরে বাবা? এ ঘটনার পর থেকে বাবার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়ে গেল। তিনি তাঁকে ভয় করতেন। বাবাকে একদম পছন্দ করতেন না। তিনি সবকিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইতেন। সেই কারণে তিনি তাঁর কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেন।  

 
মা মারা যাওয়ার পর বাবার অযত্ন-অবহেলা-অনাদরে উঠতে লাগলেন তিনি। পড়াশোনায় একদম মন বসত না। সব সময় মা’র কথা মনে পড়ত। তখন তিনি ছোট অবুঝ বালক। কিন্তু মায়ের শূন্যতা যেন কোনোভাবেই পূরণ হয় না।  
 

বাবা নানাভাবে অত্যাচার করতে লাগলেন। তখন এত অত্যাচারের মধ্যে পড়াশুনা কী করে সম্ভব?

 
একবার স্কুলে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী চলছে। প্রধান শিক্ষক তাঁকে ডেকে বললেন, মতিন তোমাকে একটা পুরস্কার দেব ভাবছি। তখন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আমাকে কী পুরস্কার দেবেন স্যার? তখন তিনি বললেন, তুমি তো লেখাপড়ার ব্যাপারে পুরস্কার পাবে না। কিন্তু মুসলমান ছেলেদের মধ্যে তুমি কোনোদিন স্কুল কামাই দাওনি। তাই তোমাকে আমরা একটা ঘড়ি পুরস্কার দিচ্ছি। সুন্দর একটা পকেট ঘড়ি। ঘড়িটা পেয়ে তাঁর মন আনন্দে নেচে উঠল। এমন ঘড়ি তিনি কখনো দেখেননি। ঘড়ি নিয়ে তিনি বাসায় এলেন। কিন্তু রাতে তাঁর একটুও ঘুম হয়নি। পরদিন তিনি ঘড়িটা নিয়ে স্কুলে ফিরে এলেন। হেড স্যারের সঙ্গে দেখা করলেন। হেড স্যার তো তাঁকে দেখে অবাক। তিনি বললেন, মতিন কী খবর? তখন তিনি বললেন, স্যার ভুল হয়ে গেছে। আমার একদিন লেট ছিল। স্যার বললেন, কী বল, আমরা তো ভালো করে দেখেছি, তোমার তো কোনো লেট নেই। তখন তিনি বললেন, স্যার খাতাটা একটু দেখি? তিনি পিয়নকে ডেকে হাজিরার খাতাটা বের করতে বললেন। হাজিরার খাতাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে দেখা গেল, মে মাসে একটা তারিখের ওপর ‘এল’ লেখা আছে। মানে এক বছরের মধ্যে একদিন তিনি লেট করে স্কুলে এসেছিলেন। হেড স্যার তখন বললেন, মতিন তোমাকে আমরা পুরস্কারটা দিতে পারছিনে।কিন্তু তুমি যে সততার পরিচয় দিলে, তুমি একদিন বড় কিছু হবে।  

 
আস্তে আস্তে তিনি বখাটে হয়ে গেলেন। লেখাপড়ায় আর মন বসে না। তিনি এত খারাপ হয়ে গিয়েছিলেন যে, একজন সন্ত্রাসী কিংবা একজন বড় গুণ্ডা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। রাত-দিন বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো আর খারাপ কাজ করা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।  
 

ছোটবেলায় তিনি একবার ভূমিকম্প প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এখনো তা বেশ মনে আছে । তখন তিনি অনুভব করেন মৃত্যু কী জিনিস।  

 
আর একবার সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। হঠাৎ সমস্ত দার্জিলিং অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। তখন মা জীবিত ছিলেন। তিনি তাঁকে বলেছিলেন, বাবা, তুই নড়াচড়া করিস না, চুপ করে বসে থাক। তিনি তখন আর ঘর থেকে বের হননি।  

 
আবদুল মতিন যখন কিশোর তখন গান্ধীর ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন চলছিল। তবু তিনি ওই ছোট বয়সেই সামান্য হলেও ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলন সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করেন।  

 
ইতিমধ্যে তিনি এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিক) পাস করলেন তৃতীয় বিভাগে। সেই সময় বাবা একটা বই নিয়ে এসেছিলেন, ‘ওয়ান হানড্রেড গ্রেট লাইফস’। তিনি বইটি পড়তে শুরু করলেন। দেখলেন, সেখানে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর  জীবনী। তিনি দেখলেন, সেখানে লেখা আছে, তিনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন না, তিনি সত্যবাদী। তখন তাঁর মনে এ বিষয়টি গভীরভাবে দাগ কাটে। তখন  থেকেই তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, কখনো মিথ্যা কথা বলবেন না। সেই থেকে তিনি আবার নতুনভাবে জীবন গড়া শুরু করলেন। তিনি আর কখনো মিথ্যা কথা বলেন নি।  

 
কথায় কথায় একদিন সরদার ফজলুল করিম স্যার সম্পর্কে তাঁর মূল্যয়ান জানতে চাইলাম। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, লেনিনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বার্নার্ড  শ’ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী? লেনিন জবাব দিয়েছিলেন, ‘হি ইজ এ গুড ম্যান, বাট গুড ফর নাথিং।’ আমিও মনে করি ‘সরদার ভাই ভালো লোক’, কিন্তু ‘গুড ম্যান গুড ফর নাথিং’। আমি কখনো তাঁর রাজনীতি পছন্দ করতাম না। কারণ ভালো মানুষ এক জিনিস, বড় কোনো কাজ করা বা বিপ্লব করা অন্য জিনিস।  
 

১৯৭১ সালে রাজাকাররা আবদুল মতিনের বাবাকে ধরে নিয়ে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয় এবং পাকিস্তানি সেনারা তাঁর বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।  

 
তাঁরা নয় ভাই ও চার বোন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাঁর এক ভাই গোলাম হোসেন মনু নিহত হন। আর এক ভাইয়ের নাম আবদুল গাফফার। তার ডাক নাম ঘটু। তিনি স্বাধীনতার কয়েক বছর পর আবুজর গিফারী কলেজের এক শিক্ষক আব্দুর রশিদসহ রক্ষীবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, আব্দুর রশিদ মওলানা ভাসানীর আত্মীয় ছিলেন। তিনি শেখ মুজিবের কাছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার সুপারিশ করলে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু আবদুল গাফফার আজও নিখোঁজ।  

 
শুরু হলো তাঁর সঙ্গে খোলামেলা আলাপচারিতা –

 
মোহাম্মদ আলী : আপনার জন্মস্থান কোথায়?

আবদুল মতিন :  আমার জন্ম সিরাজগঞ্জে।

বাবার নাম কী?

আবদুল জলিল।

মা’র নাম কী?

আমেনা খাতুন।

আপনার বাবা কোথায় লেখাপড়া করেন?

পাবনায়।

আপনার বাবা কখন চাকরি পেলেন?

আগইে পেয়েছিলেন, করেননি। পুলিশের চাকরি।

কেন?

এত ছোট চাকুরি করে লাভ কী? এতে পোষায় নাকি?

সেটা কি পাবনায়?

হ্যাঁ, এখানেই।

তিনি কতদূর লেখাপড়া করেছেন?

এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিক) পাস করেছিলেন।

এন্ট্রান্স (ম্যাট্রিক) পাস করে কিসের চাকরি করতেন?

ওই যে ক্যান্টনমেন্টে সিভিলে একটা চাকরি করতেন, দার্জিলিংয়ে।

সেটা কত সালে?

ঠিক সাল বলতে পারব না।

কত সালে আপনি স্কুলে ভর্তি হলেন?

আমি যেটা জানি, আমি ১৯৩২ সালে স্কুলে ভর্তি হয়েছি।

আপনি প্রথম স্কুলে গেলেন কার সঙ্গে?

আমার বাবার সঙ্গে প্রথম স্কুলে গেছি।

তারপর ওখানে কোনো ক্লাস পর্যন্ত লেখাপড়া করলেন?

ম্যাট্রিাক পরীক্ষা দিলাম, ১৯৪৫ সালে।

Arts না Scinec   থেকে?

তখন Arts এবং Scinec এই ছিল।

লেখাপড়ার প্রতি আপনার বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল? যেমন, কারও ইংরেজির প্রতি আগ্রহ থাকে, কারও বাংলার প্রতি অথবা কারও ভূগোলের প্রতি।

লেখাপড়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল কম।

মানে কোনো Subject-এর প্রতি বিশেষ কোনো আগ্রহ ছিল না? লেখাপড়ার ব্যাপারে আপনার বাবা-মা’র মতামতকে বেশি প্রাধান্য দিতেন?

মা’র তো খুব ইচ্ছা ছিল তার ছেলে লেখাপড়া করবে। আমারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বাবার শেখানোর পদ্ধতি ছিল খুব সামন্তবাদী, তিনি খুব কড়া ছিলেন। আমাকে মারধরও করতেন।

না পড়লে বাবা ভীষণ মারতেন?

হ্যাঁ। তাছাড়া দুষ্টামি করলেই মারতেন। বলতেন, তুই এগুলো কী করেছিস, কিছুই হয় না।

 
তাহলে আপনার কি মনে হয়, কোনো ছেলেমেয়ে যদি দুষ্টামি করে, লেখাপড়া না করে, তাহলে তাকে কীভাবে সংশোধন করা যায়?

 
সংশোধন করার বহু পদ্ধতি আছে। মারাটাই একমাত্র পদ্ধতি নয়, এই পদ্ধতিতে ক্ষতিই বেশি হয়।

কীভাবে সংশোধন করা যায়?

সংশোধন করতে হয়, সে কি অবস্থায় কোনটি পারছে না। তার কী Lacking হচ্ছে, স্মরণ রাখতে পারছে না, নাকি মনোযোগ নেই – এ ব্যাপারগুলো বুঝতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও তো আছেই।

আপনার মা যখন মারা যান, তখন আপনার বয়স কত?

আমার বয়স তখন আট বছর।

আপনি দার্জিলিং ছেড়ে রাজশাহী চলে এলেন কেন?

আমি আমার দেশকে দেখব, জানব বলে।

রাজশাহীতে চলে এলেন কত বছর বয়সে?

ম্যাট্রিক পাস করার পর। তখন আমার বয়স ষোল বছর।

ওখানেই হোস্টেলে থাকতেন?

হ্যাঁ। ওখানে দুই বছর পড়েছি। ইন্টারমিডিয়েট পাস করলাম, তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন কত সালে?

১৯৪৭ সালে।

আপনি দলীয় রাজনীতিতে জড়িত হন নি?

কোনো পার্টি করা হয়নি।

সচেতন হলেন কীভাবে, কোন বন্ধু-বান্ধবের সংস্পর্শে?

এই এমনিই হলাম। আমার মনে হল, উর্দু কিভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে? পাকিস্তানিরা উর্দু বলে, বাংলা তারা বোঝে না। বাঙালিরা উর্দু বোঝে না। এ অবস্থার মধ্যে কী হবে? তখন তো এ দেশ ছিল পাকিস্তান। তার মধ্যে আমরা বাঙালিরাও থাকলাম। একটা বড় অংশ বাঙালি, আমাদের কথা, আমাদের ভাষা কোথাও, কোনো স্থান পাবে না! বাংলা থাকুক এবং উর্দুও থাকুক। বাংলা ও উর্দু দুটোই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হোক। It is correct„এটা একটা সঠিক সিদ্ধান্ত। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হলো কিন্তু সেই পাকিস্তানের শাসন থাকল পাকিস্তানিদের হাতে। তাহলে আমাদের কী থাকল? বাংলাকে রাষ্ট্র করতে দেবে না। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে জিন্নাহ সাহেব, তার বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালে আন্দোলন শুরু হয়।

কোথায় হচ্ছিল সমাবর্তন অনুষ্ঠান?

কার্জন হলে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে সেই বছর আমি বিএ পাস করেছিলাম। আমি ডিগ্রি নিতে গিয়েছি।

সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহর বক্তৃতার আপনি প্রতিবাদ করলেন?

হ্যাঁ, সেখানে প্রতিবাদ করলাম। আমি তখন চিìতা করিনি। কিছু বলিও নি অন্যদের। কারণ তখন ওই হলেই দেখলাম, ছাত্ররা মিটিং করছে এবং সেখান ওয়ার্নিং দিল কেউ যদি জিন্নাহকে অপমান করে তাহলে তাকে সহজে ছাড়বে না।

তারপর আপনি কী করলেন?

মাস্তান টাইপের ওইসব ছেলেপেলেরা এটা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিল। আমি তখন একটু অবাক হলাম।

আপনার তো কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না?

আমি দেখলাম, আমি প্রতিবাদ করবই, যা হবে। এতে যদি আমার মৃত্যু হয় হবে, যা হয় হবে। তারপর বললাম, No, No, এটা হতে পারে না। আমি বলা শেষ করেছি, তখন ছাত্ররা উঠে দাঁড়াল। তারাও বলল, No, No, এটা হতে পারে না। তখন পরিস্থিতি খারাপ দেখে জিন্নাহ সাহেব তাড়াতাড়ি বক্তৃতা শেষ করলেন। সিকিউরিটিতে নিয়োজিত লোক ছিল, তারা তো তটস্খ হয়ে পড়ল। দ্রুত তাকে গাড়িতে তুলল।  

 
এ ঘটনার তিন মাস পর জিন্নাহ সাহেব করাচিতেই মারা যান।  

 
এরপর খাজা নাজিমউদ্দিন, লিয়াকত আলীসহ আরও অনেকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে লাগলেন।  

আচ্ছা তার আগে একটু যদি জানতে চাই, জিন্নাহ কি একেবারে অসাম্প্রদায়িক ভারতবর্ষ করতে চান নি? না, ভিন্ন ধরনের কিছু চেয়েছিলেন?

আমি তো তাকে সাম্প্রদায়িক লোক বলেই জানি। কোথায় তাকে  অসাম্প্রদায়িক দেখলেন?

আপনি কি মনে করেন ভারতবর্ষ বিভক্তির জন্য তিনিই দায়ী?

বিভক্তির জন্য শেষ পর্যন্ত তিনিই তো দায়ী হলেন, এ দেশের জন্য তার কোনো অবদান নেই।

তিনিই কি বিভক্তির নাটের গুরু ছিলেন?

হ্যাঁ, তিনিই প্রধান ছিলেন।

কেন আপনি তাঁকে প্রধান মনে করেন?

সে চাইল, পাকিস্তান হয়ে গেল। ভারত হয়ে গেল। পাকিস্তান তো ভাঙল, ঠেকাতে পারল না। ইংরেজরাও চেয়েছিল কিছু একটা করার কংগ্রেসের সঙ্গে মিলে। কিন্তু পাকিস্তান হল ধর্মের ভিত্তিতে।

সোহরাওয়ার্দীর কথা কিছু বলবেন?

সোহরাওয়াদী সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা ছিলেন।

 
 এরপর তিনি বললেন­ ভাষা আন্দোলনের মধ্যে যা ধরতে পারলাম, অন্যাভাবে তা ধরা যাচ্ছিল না। এর ধারাবাহিকতায় কঠিন সংগ্রামে জয়লাভ করলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যা ফরসালা হয়ে গেল, যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হল।

পেছনে ফিরে আসি, ভাষা আন্দোলনের সেই সময় আপনি নেতৃত্বে ছিলেন?

হ্যাঁ, আমি ছিলাম। আমি তো কোনো অর্গানাইজেশনের নেতৃত্বে ছিলাম না। আমাকে নেতা মানে কে? আমার তো ওভাবে কোনো নেতৃত্ব ছিল না। আমি অ্যারেস্ট হয়ে গেলাম। তারপর দেখলাম যে, জনগণের শক্তি না পেলে কিছু করা যাবে না। ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের শক্তিকে আমাদের কাজে লাগানো দরকার। তারপর আস্তে আস্তে সাধারণ ছাত্রদের আমরা ভীষণভাবে পেয়ে গেলাম।

আমি জানতে চাচ্ছিলাম, ’৫২-তে আপনারা এটা করলেন। জিন্নাহ বলেছিলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। আপনারা যে No, No, করলেন, এর পেছনে আপনাদের কোনো সংগঠিত শক্তি ছিল না?

না, সংগঠিত শক্তি কোথায়? কাউকে তো সংগঠিত করি নি।

ভাষা আন্দোলনে সালাম, জব্বার, বরকত ও রফিকসহ আরও অনেকে মারা গেল, তারপর আপনারা কোন ধরনের কর্মসূচি দিলেন?

তখন বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে। তখন সমস্ত কথা আমি public-এর সামনে বলতে পারি নাই। স্পাইরা সরকারকে খবর দেবে বা প্রতিপক্ষকে বলে দেবে। আমরা এরপর এভাবেই বলেছি, কোনো গোপনীয় কিছু না।

 
আলোচনার রূপটা প্রকাশ্য ছিল। কোনো সেল ছিল না। এ ধরনের বিশেষ কিছু ছিল না। না, না।

আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম কমিটি সম্পর্কে কিছু বলবেন?

প্রকাশ্য মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম কমিটি ছিল। তারপর আমরা বুঝেছিলাম যে, একটা তত্ত্ব জিন্নাত যে রকম দিচ্ছে, তার পাশাপাশি আর একটি তত্ত্ব দিতে হবে। তিনি বলছেন, একমাত্র উর্দু হবেই রাষ্ট্রভাষা। আর আমরা বলেছি যে, না, বাংলা রাষ্ট্রভাষা।

আপনি তো সংগ্রাম পরিষদের নেতা ছিলেন?

সংগ্রাম পরিষদের আমি আহ্বায়ক হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হলাম ১৯৫০ সালে।

১৯৫২ সালে ১৪৪ধারা ভাঙার জন্য ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের ওই সময় ভূমিকা কী ছিল?

তারা ১৪৪ধারা ভাঙার পক্ষে ছিলেন না। তবে ছাত্র ইউনিয়নের নিচের সারির নেতারা ১৪৪ধারা ভাঙার পক্ষে ছিলেন।

বড় বড় নেতাদের ভূমিকা কী ছিল?

উল্টো তারা বলল, ১৪৪ধারা ভাঙা হঠকারিতা।

নেতারা বলছিলেন এটা হঠকারিতা?

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছিলেন, ১৪৪ধারা ভাঙা হঠকারিতা।

শামসুল হকও  বলেছিলেন?

হ্যাঁ, তিনিও বলেছিলেন­এটা ভুল হবে। পরের দিনটা তো মূল ঘটনার turning point.২১ ফেব্রুয়ারি গুলি হল। ওখানে কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা জীবন দিয়েছিল।

 
 সালাম, বরকত, জব্বার-এঁরা মারা গেছেন। তখন আমি দেখলাম, অনেকে আহত, তাঁদের আগে বাঁচানো দরকার। তখন তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। এ রকম বিভৎস চেহারা দেখা যায় না। আমার বন্ধুদের তখন আমি বললাম যে, ভাই আমার শরীরটা খারাপ লাগছে, ঘুম হয়নি। আমি কয়েকজনকে বললাম, আমাকে কেউ খোঁজ করলে বলবেন, আমি লনের পাশে বসে আছি, ওখানে বসে আমি তখন কাঁদছিলাম। এতগুলো প্রাণ গেল, এত মানুষকে হারালাম, কোনোভাবেই নিজেকে সান্তবনা দিতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর আবদুল সাত্তার খুঁজতে খুঁজতে আমার কাছে এলো। Emergency পার হয়ে লনের পাশে আমাকে পেল। আবদুল সাত্তার বলল, মতিন ভাই আপনি এখানে?। আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই। সাত্তার বলল, কি ব্যাপার আপনি কাঁদছেন নাকি? আমি বললাম, ভাই এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, মনকে কোনোভাবেই বুঝ দিতে পারছি না।

 
সাত্তার বলল, এখন কান্নাকাটি করলে চলবে? সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সাত্তার তখন কী বলল?

তারপর সাত্তার বলল, ছাত্ররা বলছে কালকে জানাজা কর্মসূচি দেওয়ার কথা। আমি বললাম, এটা একটা সঠিক কর্মসূচি। একেবারে বাড়াবাড়িও না, প্রয়োজনীয় যেটুকু cover  করে ততটুকু। তখন ও বলল, লিখছেন নাকি? এটা লিখে আনো। তোমরা সংক্ষেপে সহজ ভাষায় লিখে নিয়ে এসো ওইটা ছাপানো হবে। আমি বললাম, ছাপাতে পারবা। ও বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তাহলে আমরা ছাপিয়ে ফেলব। আমি তখন বললাম, ঠিক আছে। আমরা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি করেছি, আর আওয়ামী লিগ একটা সংগ্রাম কমিটি করেছে। তার নাম রাষ্ট্রভাষা পরিষদ।  

 
আমি গিয়ে কাজী গোলাম মাহমুদকে বললাম, মাহমুদ এটা কি করছো? বললাম, এটাতে সই করো। সে বলল, না, তোমরা হঠকারী তোমাদের সঙ্গে আমরা এসব কাজ করব না। পরে তার নামে লিফলেট ছাপা হল।  

 
পরের দিন ওই যে জানাজা হল। ওই জানাজাতে secretariate-এর বেশিরভাগ কর্মচারী উপস্থিত ছিল। তার মধ্যে বেশিরভাগ কর্মচারী নীলক্ষেত ও পলাশীর ওইসব জায়গায় থাকত। detail জানি না। তবে তাদের সঙ্গে পরিচয় হল, তাদের আমি বললাম, কালকে কিন্তু জানাজার কর্মসূচি, আপনারা আসবেন। শেষ পর্যন্ত জানাজা হলো, সেখানে মুষ্টিমেয় ছাত্র জানাজায় উপস্থিত ছিল। তার অনেক পর ১০টার দিকে মিছিল করে হাজার হাজার কর্মচারী secretariate থেকে বের হয়ে এলো। তখন তো বিশ-পঁচিশ হাজারের মতো জমায়েত হল, এটা নিয়ে জানাজা পড়া হলো। জানাজা পড়েই বের হলাম। দেখলাম আন্দোলনমুখী মানুষ, তাদের সঙ্গে আমি ছিলাম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর নূরুল আমীন পালিয়ে গেল চট্টগ্রামে।

 
এ সংবাদ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার পর প্রথমে পুলিশ উড্রো করা হল। তারপর আর্মিকেও উড্রো করা হল। এ খবর সাধারণ মানুষ রেডিওতে শুনেছে। রেডিওতে খবর শুনে আমাদের হলের ওখানে চল্লিশ-পঞ্চাশজন সিপাহি ছিল ওদের ডাকা হল। ডেকে ছাত্ররা বলল, তোমরা এখন ব্যারাকে ফিরে যাও। আমরা দেখলাম, এই তো সুবিধা; আমরা স্লোগান দিতে দিতে মেডিকেল কলেজের যেখানে আমাদের ঘাঁটি, সেখানে আমরা সারাদিন মিছিল করেছি।  

 
তখন মেডিকেল কলেজ আমাদের ঘাঁটি। ওখানে আমরা স্লোগান দিতে দিতে যাই। ওখানেই আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম প্রাণকেন্দ্র। এর মধ্যে আওয়ামী লিগের সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়। তারা আর কি বুঝবে? তারা এই আন্দোলনটাকে ভিন্নভাবে দেখেছে। ১০-১৫ মিনিট থেকে তারা চলে যেত। এইভাবে তারা আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকত। শেখ মুজিব তখন জেলে; সে থাকলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আবু হাসান সাহেব একদিন বললেন, তোমরা কী করবে? ছাত্রদের মতামত নাও,  ওরাই তো সব থেকে অগ্রসর। গাজীউল হক তখন খুব পপুলার। উনি বললেন, ওরা যতটুকু করে করবে। শামসুল হক বললেন, ‘এটা একটা হঠকারিতা হবে। আমি বললাম, কিসের হঠকারিতা? এখন এই অন্তিম সময়ে হঠকারিতা বিবেচনা করার কোনো অর্থ হয়? এখন আমাদের এটা করতে হবে।

গাজীউল হক সাহেব যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন? তার বক্তৃতার সময় তো টেবিল নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই টেবিল আনার বুদ্ধিটা কার মাথা থেকে এসেছিল?

গাজীউল হকের বক্তৃতার সময় আমি ওখানেই ছিলাম। আর টেবিল আনার বুদ্ধিটা এম আর আখতার মুকুলের মাথা থেকে এসেছিল। ছাত্রলিগের খালেক নেওয়াজের জন্য টেবিল এনেছিল ওরা। টেবিল এনে গাজীউল হক টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেন।

গাজীউল হক তখন কোনো ছাত্র সংগঠন করতেন?

হ্যাঁ, করত মানে সমর্থন করত। তখন গাজীউল হক হঠাৎ বলা শুরু করল যে, তাঁর শেল লেগেছে। আমি বললাম, আমরা তো সবাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, তুমি এর মধ্যে শেল পেলে কোথায়? হয় আমরা মারা যাব, নয় বিজয়ী হব। তুমি কি ভয় পাচ্ছ নাকি? তারপর ওখান থেকে ওরা জিল্লুর রহমানের কাছে গেল।

গাজীউল হক কি তখন আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সমর্থন ছিলেন? ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা প্রশ্নে তো উনি তখন নেতাদের কথা শোনেননি?

হ্যাঁ, উনি তখন ছাত্রলিগের সমর্থক ছিলেন। আর এখন তো তিনি পুরোপুরি আওয়ামী লিগের। ১৪৪ ধারা ভাঙার আগে সভায় শামসুল হক ও আমি দুজন বক্তা ছিলাম। শামসুল হক ছাত্রলিগের নেতা। ১৪৪ ধারা না ভাঙার পক্ষে কথা বলল। আর আমি ভাঙার পক্ষে বললাম। শামসুল হক হচ্ছে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আর আমি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির।

শামসুল হক না ভাঙার পক্ষে কী বললেন?

সে বলল, এখন ১৪৪ধারা ভাঙা যাবে না। এটা হঠকারিতা হয়ে যাবে। আমরা এখনো অসংগঠিত। আমি বললাম, আমরা কোথায় অসংগঠিত? আমরা এক মাস ধরে সংগ্রাম করছি। আপনারা সংগ্রাম করবেন না, এটা তো হতে পারে না। হয় আপনারা আন্দোলনে আসবেন, না হয় আমরা সাধারণ ছাত্ররাই এ আন্দোলন করব। তখন ওরা একজন ছাত্রেরও সমর্থন পায় নি। একজন ছাত্রও ওদের সঙ্গে যায়নি। পুরো ছাত্র সমাজ আমাদের পক্ষে ছিল।

শামসুল হক ওই ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার তাঁর পক্ষে রাখতে পারলেন না?

তো কী করবে? সে তো বলেই দিল এটা হঠকারিতা হবে। আমরা এর সঙ্গে থাকতে পারি না।

পরবর্তীতে সে কি আর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি?

না, আন্দোলনে থেকেছে। কিন্তু সেভাবে নয়। নেতৃত্বে থাকতে পারেনি, তবে চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লিগও শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছে।

 
২১ ফেব্রুয়ারি সফল হল, গুলি চলল। ছাত্র মারা গেল। এরপর ২২ ফেব্রুয়ারি বিপুল ছাত্র-জনতার এক রকম অভ্যুথান হয়ে গেল। বলা যায়, সাধারণ মানুষের বিজয় কেউ ঠেকাতে পারে না। সাধারণ ছাত্ররাই জানাজার পর মিছিল করে বেরুলাম। কার্জন হলের কাছে আবার গুলি চলল। মিছিল কিছু সময়ের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। খালি মানুষ আর মানুষ, চলছে তো চলছেই। প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত মিছিল চলল। এমন সময়ে খবর পাওয়া গেল যে নূরুল আমিন পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছেন এবং আর্মি প্রত্যাহার করা হবে। বাঙালি আর্মি বা পুলিশ ছাত্র-জনতার সঙ্গে মার্চ করতে পারে।

ওরা তো সচরাচর জনগণের কাতারে আসে না। একবার এসেছিল সিপাহি বিদ্রোহের সময়। আর একবার মুক্তিযুদ্ধের সময়...।

এর আগেও আওয়ামী লিগ বলেছিল, তোমরা ভোট (মতামত) নিয়ে এসো। আমরা বললাম, কিসের ভোটাভুটি করব?

কীসের ভোট?

কারা কোন পক্ষ নেবে এই ব্যাপারে। আমরা এক রকম বাধ্য হলাম ভোট করতে ওদের চাপে। আমরা জানতাম ভোটে আমরা ভালো করতে পারব না। ওরা ১১ জন, আমরা ৪ জন। ৪ আর ১১ ভোট নিয়ে কথা বলা যায় নাকি? কারণ এখানে ওরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। আমরা বললাম, আমরা তো আগেই বলেছিলাম, এখানের ভোট হবে অন্য রকম। কাল সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে ভোট হবে। ছাত্ররা যেটা চায়, আমরা সেটাই করব। আপনারা সেটা মানলেই হল। পরের দিন সাধারণ ছাত্রদের ভোট হল। ওরা একটি ভোটও পায়নি।

আচ্ছা আপনি তো তখন কোনো সাংগঠনিক রাজনীতি করতেন না। আপনি কিভাবে বুঝলেন সে সাধারণ ছাত্ররা আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে থাকবে?

না, আমি সাংগঠনিক রাজনীতিতে ছিলাম না। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের শুরুর থেকেই তো সক্রিয়ভাবে এর সঙ্গে ছিলাম। সেখান থেকেই এটা বুঝেছিলাম।

শোনা যায়, আওয়ামী লিগের ভূমিকা ছিল?

না, দেশ ভাগের পর প্রথম থেকে ভালো ভূমিকা ছিল। কিন্তু ’৫২-তে এসে কিছু করতে পারেনি। অত বড় দলটা কীভাবে Hero থেকে  Factor পার্টি হল! তারা জরুরি অবস্থা ভাঙার পক্ষে ছিল না। বড় ভয়ানক ব্যাপার সবাই own করতে পারেনি। ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আন্দোলন চলল। সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের চাঞ্চল্য তাতে থাকল না। ৩-৪ দিন পরই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হলো। তখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হল কিন্তু ভেতরে উত্তাপ ছিল।

 
আমরা কথা বলছি, হঠাৎ ভাবী দরজায় শব্দ করলেন। আমি দরজা খুলে দিতেই তিনি বললেন, বড় মেয়ে আর জামাই আসছে। তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবে। মতিন ভাই বললেন, এটা  আর কী এমন খবর হল? তখন ভাবি বললেন, ওরা একটা ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে এসেছে, তোমার সাক্ষাৎকার নেবে...। সেটা শুনেও তিনি বললেন, তাতে কী, আসবে, আসুক।

 
শীতকাল বারান্দায় তখনো বেশ রোদ আছে। ওরা এসে তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় মতিন ভাইকে নিয়ে বসিয়ে ইন্টারভিউ করতে লাগল। প্রশ্নগুলো ছিল বেশ। যেমন : বৃষ্টি আপনার কেমন লাগে? চাঁদ সম্পর্কে কিছু বলুন। নীলাকাশ আপনার কেমন লাগে। আপনার কাছে প্রেম কি? রাত সম্পর্কে কিছু বলুন।  

 

বড় মেয়ে সুকু আর ওর জামাই কথা বলে চলে গেল। আমরা আবার চায়ের পেয়ালায় ফিরে গেলাম। মেতে উঠলাম গল্পে।
ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে আপনাকে ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট করা হল?

আমি ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হলাম। আমাকে বলা হল, আপনি পার্টি করবেন কিনা? আমি বললাম করতে তো চাচ্ছি, তবে কৃষক ফন্সন্টে কাজ করতে চাই। তখন আমাকে বলা হল, আপনি অন্তত একটা টার্ম থাকেন। আমি শুধু এক বছর ছিলাম। সালটা আমার ঠিক মনে নেই।

আপনি যখন সভাপতি হলেন তখন সাধারণ সম্পাদক কে ছিলেন?

কে যেন ছিল। সম্ভবত সাত্তারই হবে।

এক বছর পর আপনি কৃষক ফন্সন্টে কাজ করতে গেলেন? কোন এলাকায়?

উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা পাবনায় সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছি। তারপর চেষ্টা করেছি কৃষক অভ্যুথান করার। কিন্তু পার্টি সেটা পারেনি। সেটা কি এত সহজ? দেখলাম যে পুঁজিবাদের এই যুগে পার্টির লাইনটা ভুল।

আপনি কীভাবে বুঝলেন পুঁজিবাদের এই যুগে পার্টি ভুল করছে?

গ্রামাঞ্চলে গিয়ে দেখেছি, কৃষকদের নানা সংকটে আমরা বড় বড় মার্ক্সিটরা, তাত্ত্বিকরা সমাধান দিতে পারি না। এক গ্রামে একজন কৃষক বধূ আমাদের ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁড় দিয়ে বসতে দিল। আমি তাকে ডেকে বললাম, আপনি বলেন তো টাকা কী?

কৃষক বধূটি বলল, টাকা বোঝেন না? ধরেন আমার একটা মুরগি আছে। সে ডিম পাড়ল, সেই ডিম বিক্রি করে টাকা পেলাম। ডিমটা টাকায় পরিণত হল, এই তো টাকা। ডিম হলো বলেই টাকা হল। এখন এই টাকা দিয়ে চাল-ডাল-তেল-লবণ কিনতে পারি। আমরা যত সহজে বলতে পারি না টাকা কী। অথচ এই নিরক্ষর মহিলা বলল, What is money? এটা বলার জন্য তার কিন্তু পড়াশোনার দরকার হয়নি। আমরা পড়াশোনা করা মানুষ উল্টাপাল্টা বুঝি।

এটা তো একটা উদাহরণ। কিন্তু তখন ওই সময়ে আপনার কেন মনে হলো যে, সমাজ পুঁজিবাদের দিকে যাচ্ছে? কী লক্ষণ দেখেছিলেন?

চোখের সামনেই তো উদাহরণ ছিল। জমিগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। জমিদারি প্রথা বিলোপ হওয়ায় পর জমিদারের জমি গেল কোথায়? হাওয়ায় মিলিয়ে গেল, না জমিদাররা নিয়ে গেল? টাউটরা-বাটপাড়ি করে একটা শ্রেণীর মধ্যে কি ভাগাভাগি হয়নি? আমাদের নেতারা, বড় বড় তাত্ত্বিক কেন এর বিরুদ্ধে কথা বলে না? ওই জমি কারা পেল? কেউ তো সত্যি বলে না। আমিও বলতে পারি নি অনেক সময়। এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই দেখেন, আওয়ামী লিগ বলবে সব শেখ মুজিব করেছে। আর বিএনপি বলবে শেখ মুজিব না জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক; মুজিব ঘোষণা দেয় নি। কি চাপান উত্তরই না চলল শেখ মুজিব আর জিয়াকে নিয়ে! সব জায়গাতেই ধাপ্পাবাজি। শেষ পর্যন্ত মুজিবকে সপরিবারে মেরে ফেলল।  

 
মতিন ভাইয়ের ছোট মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসে পৌঁছুল। ওর বিয়ে হয়েছে কুষ্টিয়ার কয়ায়। খানিক পর মেয়েটি আমাদের দুজনের চা আর নাস্তা দিল। আমরা চা খেয়ে দরজা চাপিয়ে দিলাম।

 আমি মতিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সাধারণত দরজা বন্ধ করে কথা বলি। কারণ দরজা খোলা থাকলে শব্দ আসে। কথা বলার মতো নিরিবিলি পরিবেশ হয় না।  
 

কথা বলতে বলতে ইতিমধ্যে দুই-তিনবার চা পান করেছি আমরা।

আপনি জেলে যাওয়ার পর কী দেখলেন?

সকলেই যার যার সেলে থাকে। আমরা টোয়েন্টি সেলে ছিলাম। আমরা সবাই Individual  সেলে থাকতাম। রাতে আমাকে সেলে ঢুকাল। ওরাও যার যার সেলে বদ্ধ থাকল। দেখা হওয়ার কোনো ঝধসহপ নেই। সকালে দেখা হবে। সব কিছু জমা দিয়ে সেলে ঢুকে দেখলাম, একটা খাট আছে, মশারিও টাঙানো আছে, শুয়ে পড়লাম। ওরা খুব হৈ হৈ করছিল, কাল আমরা মিলিত হব।  

 
সকালে বিশ নম্বর সেলে নাস্তা খাওয়ার আগে আবার আমরা একত্র হলাম। ওরা ভাষা আন্দোলনের ঘটনা শুনে চিৎকার করে উঠল, তখন ওরা সবাইকে ডেকে জড় করল। একজন বলল : একজন নতুন বন্দি এসেছে, ভাষা আন্দোলনের তরুণ সংগ্রামী। আমরা তাঁর কাছে থেকে ভাষা আন্দোলনের সব কাহিনী শুনব। জেলে তো ওরা আন্দোলনের কোনো খবরই জানে না। একেক জন চার-পাঁচ বছর ধরে জেলে আছে। ওরা সবাই ঘটনা শোনার জন্য নাস্তা খেয়ে কম্বল বিছিয়ে বসে পড়ল। ওরা বলল, ঘটনাটা বলতে কতক্ষণ লাগবে? বললাম, পাঁচ-সাত ঘন্টা তো হবেই। বলল বলুন আমরা শুনব। আমি ভাষা আন্দেলনের বর্ণনা করা শুরু করলাম। আমার বলার ব্যাপ্তি যত বাড়ছে, ওদের আগ্রহ ও মনোযোগ ততই বাড়ছে। একদিনে শেষ করা গেল না, দ্বিতীয় দিনে র্বণনা শুনে ওদের চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছিল। ওরা বিস্মিত হয়ে বলছিল, আরে, বলেন কী এই রকম আন্দোলন হয়েছে! এ রকম ঘটনা ঘটে গেল। মানুষ এমন বারুদের মতো হয়ে উঠেছে! মানুষ জীবন দেয় ভাষার জন্য এই প্রথম শুনলাম। ইস্ আপনারা যে কী সৌভাগ্যবান! আপনারা কী করেছেন, আর আমরা কিছুই করতে পারিনি, আমরা কী করলাম! আমি বললাম, ভাই আপনারাও পারবেন, আপনারাও তো করেছেন। এখন তো জেলে আছেন, এখন কী আর করবেন? আপনারা কিছু না করলে কিছু করার সুযোগ পেতাম না।  

 
যাই হোক দুদিন ধরে ভাষা আন্দোলনের সমস্ত কাহিনী বলতে বলতে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। অথচ জেলে ওই বিশজন মানুষ কান খাড়া করে শুনে ক্লান্ত হয় না!

 
দুদিন পর আমার সেলের ইনচার্জ আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি দুপুরে কি করেন, ঘুমান? আমি বললাম, না , আমি দুপুরে ঘুমাই না। ওরা তাস খেলে আমি দেখি। একটু আধটু তো বুঝি। দুপুরে দু-তিন ঘন্টা এভাবেই কেটে যায়।  
 

কৃষ্ণ বিনোদ রায় হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি কমিউনিস্ট হতে চান?’

 
আমি বললাম : এই প্রথম জেলে এসেছি। কমিউনিস্ট হতে পারলে তো  বেশ হতো। কৃষ্ণ বিনোদ রায় আমাকে বললেন, আপনি কমিউনিস্ট হবেন নাকি?

আমি বললাম : হতে তো চাই।  

তখন তিনি বললেন, কমিউনিস্ট হওয়ার অনেক ব্যাপার আছে, খুব কঠিনও না। লেগে  পড়ে থাকতে হয়, কাজ করতে হয়। পৃথিবীটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। আস্তে আস্তে মানুষের আয়ত্তের মধ্যে চলে আসছে পৃথিবীটা।  

অনেকক্ষণ এ কথা সে কথার পর উনি বললেন, আপনি যদি কমিউনিস্ট হতে চান, আমার ধারণা আপনি হতে পারবেন। আপনার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা আছে। আপনি তো ভাষা আন্দোলন করেছেন। আপনি তো তবু করেছেন কিছু একটা। আমি তো কিছু করি নি। আমি কী . . .?

আমি কৃষ্ণ  বিনোদ রায়। আমি শুধু প্রোভিন্সিয়াল কমিটির মেম্বর।

ওনার কথাবার্তা খুব পরিস্কার। আমি বললাম, আপনি যে কিছু করেন নি, তা তো বিশ্বাসই হয় না।

উনি আবারও বললেন, আপনি কি কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হবেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

উনি বললেন, এখনই হবেন?

আমি বললাম, এখনই আবার কী করে হব?

তখন উনি বললেন, জেলও তো একটা স্থান। এখানেও তো উপোস করতে হয়।

আমি তখন বললাম, থাকতে হলে থাকব। তিনি এবার বললেন, না, এখানে করার ব্যাপার নয়। আপনাকে গিয়েই করতে হবে। কোনো না কোনোদিন তো ছাড়া পাবেনই। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই হয়ে যাবেন।

এভাবেই আমি পার্টির মেম্বার হয়ে গেলাম।

ওখান থেকেই আপনার শুরু?

হ্যাঁ, ওখান থেকেই শুরু হল। আর break না করে continuous চলতে থাকল। তখনকার কমিউনিস্ট পার্টির সেল ইনচার্জ আমাকে বললেন, ‘আপনি যদি মেম্বার হন, তাহলে আপনাকে সই করতে হবে। তবে আপনার ফুল নাম বাদ দিয়ে, ছদ্মনাম দিতে হবে। তখন আমি নিজের একটা ছদ্মনাম নিলাম।

সে নামটি কী ছিল?

ওই গ্রামাঞ্চলের উপযোগী একটা নাম ‘দিঘু মিয়া’।

এ রকম কতগুলো ছদ্মনাম ছিল?

বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে এক এক রকম নাম করতে হয়, নাম রাখতে হয়। কৃষä বিনোদ আমাকে বললেন, এটা কিন্তু মেম্বারশিপ না, সেটা কিন্তু আপনাকে বাইরে গিয়ে অর্জন করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আপনি নিজের চিìতার বশবর্তী নন, এমনকি ঈশ্বর বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও। খোদার রাজত্ব আছে, ধর্ম, কর্ম ইত্যাদি। কিন্তু এটা সে রাজত্ব নয়। আপনি সেভাবেই কাজ করবেন। আপনার কথাবার্তা তো খুবই ভালো।  

 
জেলে আমি তো তখন নিতান্তই বালক মাত্র। দেড় বছর জেলে থেকে বেরিয়ে পার্টির কাজ শুরু করলাম। ছ’মাস যেতে না যেতেই আমি পাবনা জেলা কমিটির মেম্বার সিলেক্টেড হয়ে গেলাম। সেখানেও কৃষকদের মধ্যে কাজ করেছি, সেটাও একটা আলাদা জগৎ। সেখানে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। তখন কিন্তু একবারও মনে হতো না, এসব কাজ আমি আগে কখনো করিনি। পার্টির নেতৃত্বে কৃষক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখনই মওলানা ভসানীর সঙ্গে পরিচয়। একই সঙ্গে এক বাড়িতে ধরা পড়ি পুলিশের হাতে। এক সঙ্গেই ঢাকা জেলে গেলাম। লিস্ট করা হল। আমরা প্রায় দুই-তিন হাজার কর্মী বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার হলাম। সবার থেকে আমাদের দুজনকে আলাদা করা হল। আমাদের জেরা করা হল নানাভাবে।

  -আপনি কি করেছেন ঘটনাগুলো বিস্তারিত বলবেন।

 
-যা করেছি সেগুলো বলা যাবে। কিন্তু  যা করিনি সেটা বলব কী করে?

-তা কেন হবে? যেটা করেছেন সেটাই বলবেন। তবে যা বলবেন সত্যি কথাই বলবেন।

-আপনারা কি সত্যি কথা বলেন? এটা কি সত্যের জায়গা? আপনি কি আমাদের ভালো খাবার দেন? আমাদের প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা দেন? সত্যি উত্তর দেন। পারবেন না।

-এসব করতে হয়। এখানকার এটাই নিয়ম।

-এটা এই-ই জগৎ! আবার এখানে কেন আপনি আমাদের কাছ থেকে ‘সত্যি’ আশা করছেন?

-আপনি তো দেখছি খুব সাংঘাতিক লোক!

-আমি মোটেও সাংঘাতিক নই। আমি নিতান্তই সাধারণ।

-আপনি একজন সাধারণ মানুষ ঠিক আছে। কিন্তু আপনাকে বলতে হবে আপনি কোন কোন কমিউনিস্টের সংস্পর্শে ছিলেন, তাদের নাম বলতে হবে।

-আমি কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে ছিলাম না। ছিলাম এসব হাজার হাজার সাধারণ মানুষের সঙ্গে।

-যাদের সংস্পর্শে আপনি তাদের নামই লেখেন।

-কমিউনিস্টদের নাম আমি কিভাবে বলব?

-মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে জেরা করা হবে বলে ভয় দেখাল। আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, ভালোই হবে এই সুযোগে মিলিটারি ক্যাম্পটা ঘুরে আসা হবে।

তখন আমাকে ওরা ভয় দেখিয়ে বলল : আপনাকে কিন্তু পাঁচ বছর জেল খাটাব।

-It’s not more. ঠিক আছে খাটান। আমার আর বাড়িতে থেকে লাভ কী? এখানে ভালই থাকব, খারাপ লাগবে না।

-ও চেনেন নি তো এখনো, খুব ভালো লাগছে না? বুঝে যাবেন।

-আপনিও বুড়ো হবেন। প্রক্রিয়া সব সময় সব জায়গায় চলমান থাকবে।

-আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?

-আপনাকে কী ভয় দেখাব? আপনি হচ্ছেন এই জেলের কর্তা। ভূতকে কি ভূতের ভয় দেখানো যায়?

ওই সময় কত বছর জেল হয়েছিল?

দেড় বছর ওই সময় জেলে ছিলাম। জেল থেকে বেরিয়ে আবার কাজ শুরু করি। যতবার ধরা পড়ি ততবার, বেরিয়েই আবার পার্টির কাজ করি।

এটাই ছিল প্রবণতা।

সর্বমোট কত বছর জেল খেটেছেন?

সব মিলিয়ে বার বছর হবে। আরও দশ-বার বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিলাম, সব মিলিয়ে বিশ-বাইশ বছর তো হবেই।

একদিন বললেন, আপনার ছেলেকে নিয়ে আসবেন? আমি একদিন হঠাৎ করে ওকে নিয়ে মতিন ভাইয়ের বাসায় গেলাম। কীর্তিকে দেখে উনি খুব খুশি হলেন। কোথায় পড়ে, কী তার পছন্দ জিজ্ঞেস করলেন। বলতে বলতে ও বইয়ের তাকের কাছে শহীদ মিনারের ছবি দেখে এগিয়ে গেল। মতিন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিছু নেবে?

 
ও কিছু না, বলতেই আমি বললাম, তিন বছর বয়স থেকে ও শহীদ মিনার প্রায়ই দেখতে যায়। শহীদ মিনার ওর খুব প্রিয়। মতিন ভাই শুনে খুব খুশি হলেন। আমি কীর্তিকে বললাম, তুমি যে শহীদ মিনারে যাও, সেটা তৈরির পিছনে তোমার এই দাদুর খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মতিন ভাই নীরব হয়ে গেলেন, ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।...  

 
কিছুক্ষণ পর কীর্তিকে নানা প্রশ্ন করলেন। এক সময় কীর্তি বারান্দায় গিয়ে একা একাই খেলায় মেতে উঠল।  

 

মোহাম্মদ আলী
E-mail : nanditaali@gmail.com
অনলাইন প্রকাশ ১১ অক্টোবর ২০০৮
 
 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ