Banner
একটি ঐতিহাসিক দলিল : কর্নেল তাহেরের পদত্যাগ পত্র

লিখেছেনঃ bangarashtra, আপডেটঃ April 8, 2008, 12:00 AM, Hits: 3415



[অনেক ফাঁক ও ফাঁকি রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ রাষ্টন্স গঠন প্রক্রিয়ায়। আমরা মনে করি এই ফাঁক ও ফাঁকি ধরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনী থেকে কর্ণেল তাহেরের পদত্যাগ পত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। এই পদত্যাগ পত্রটি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ছাত্র লীগ(জাসদ) কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে’ নামক গ্রন্থ থেকে সংকলিত। গুরুত্ব বিবেচনা করে পদত্যাগ পত্রটির শেষে ঐ গ্রন্থের সম্পাদকের বক্তব্য সংযুক্ত করা হল। -  বঙ্গরাষ্টন্স]

                                                                                                                                 অনলাইন প্রকাশ: ৭ই এপ্রিল ২০০৮।

 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কুমিল্লা ব্রিগেড কমাণ্ড থেকে পদত্যাগ পত্র

মাননীয় প্রেসিডেন্ট,

গণ-প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সমীপেষু

মাধ্যম : যথাযথ কর্তৃপক্ষ

বিষয় : পদত্যাগ

 

মহাশয়,

আমি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করি এবং ১৯৭১ সালের ২৫শে জুলাই তারিখে এই সেনাবাহিনী ত্যাগ এবং সীমাìত অতিক্রম করে ভারতে আগমন করা পর্যন্ত সেখানে নিযুক্ত ছিলাম। সীমাìত অতিক্রম করে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং একজন সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে ১১নং সেক্টরে দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়ে কাজ শুরু করি। ১৯৭১ সালের ১৪ই নভেম্বর তারিখে একটি সম্মুখ সমরে আমি আঘাত প্রাপ্ত হই। আমাকে ভারতের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমি ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যìত অবস্খান করি। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর আমাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টারে এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। দু’মাস পরে আমাকে জেনারেল হেডকোয়ার্টার থেকে বদলি করা হয় এবং ৪৪নং ব্রীগেডের কমাণ্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এখন সেনা বাহিনীর চীফ অব স্টাফ, ডি• ডি• পি• হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আমাকে বলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরীতে অবস্খান করার আমার কোন ইচ্ছা আর নেই। এবং নিম্নলিখিত কারণে আমাকে অব্যাহতি দেয়ার ইচ্ছা আমি পোষণ করি।

(ক) ১৯৭১ সালের আগস্টের গোড়ার দিকে যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি আমি দেখতে পাই মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রকম অসুবিধার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গণ প্রতিনিধিরা যেমন এম• এন• এ• এবং এম• পি• এরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্খান করছে এবং কোনভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে তারা বিস্তৃত করার ব্যাপারে সাহায্য করেনি। এমনকি তারা এও বলাবলি করে যে তারা কেবল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। স্বাধীনতা চায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট এই ধরনের বহু প্রতিনিধি ঘৃণার বস্তুতে পর্যবসিত হয় এবং আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সব সময়ই উপদেশ দিতাম এম• এন• এ• এবং এম• পি• এদের প্রতি রূঢ় না হওয়ার জন্য। এই জন্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর এই ধরনের গণপ্রতিনিধিরা জনগণকে নেতৃত্ব দেবার সুযোগ পাবে না।

সম্ভবত এই ভয়েই মুজিবনগরে অবস্খিত অস্থায়ী সরকার ভারতের সাথে একটি অপমানজনক গোপন চুক্তিতে প্রবেশ করে এবং স্বাধীনতা এবং তাদের ক্ষমতায় বসাবার জন্য ভারতের সশস্ত্র সাহায্য এবং সহযোগিতা লাভ করে। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সমগ্র ক্ষেত্রই প্রস্তুত, তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং সম্পদ লুটে নিয়ে যায়। অস্থায়ী সরকার এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের প্রতি বিশবাসঘাতকতা করে। এ প্রসঙ্গে আমি হলিডে পত্রিকায় প্রকাশিত কর্ণেল জিয়াউদ্দিনের লেখা ‘হিডেন প্রাইস’ প্রবন্ধটির উল্লেখ করছি। এমনকি আমি এই চিìতাটুকু গ্রহণ করতে প্রস্তুত রয়েছি যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু চুক্তিটি সংশোধন করবেন এবং দেশের প্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য বিপ্নবকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। আমি চিন্তা করেছিলাম বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবজনক সেনাবাহিনী গড়ে তুলব। আমি ছাউনিতে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি এবং আমি বুঝতে পারি একটি অনুন্নত দেশের জন্য এই ব্যারাক আর্মি কতটুকু বিপজ্জনক হতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই বলেই এমন স্বেচ্ছাচারী ধরনের শাসনের ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এবং সর্বশেষে দেশটিকে ধ্বংস করে ফেলে। আমি উৎপাদনশীল গণমুখী সেনাবাহিনী যা দেশের প্রগতির জন্য অত্যìত কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে, সে ধরনের একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার ধারণা নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ এবং আরো কিছু উচ্চ পদস্থ অফিসার আমার এই ধারণার ব্যাপারে কোন ধরনের উৎসাহ ও সহযোগিতা দান করেননি। এই মৌলিক বিষয়ে, সেনা বাহিনীর চীফ অব স্টাফের সাথে আমি মতৈক্যে পৌঁছুতে পারিনি।

(খ) প্রধানমন্ত্রী আìতরিকভাবে চাইতেন চিকিৎসার জন্য যাতে আমি বিদেশে যাই। যখন আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম তখন আমি জানতে পারি যে মন্ত্রীসভার জনৈক সদস্যসহ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দেশে অনুস্থিতির সুযোগে দেশের ক্ষমাত গ্রহণের চেষ্টা করছে (সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন)। আমি তখন ভাবলাম প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরা পর্যন্ত আমার বিদেশে গমন স্খগিত রাখা উচিত। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলোই না উপরন্তু সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ আমাকে ৪৪নং ব্রীগেডের কমাণ্ড ত্যাগ করে ডি• ডি• পি• হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন। আমি অনুভব করছি ষড়যন্ত্র এখনো চলছে এবং আরো অনেকে এর সাথে জড়িত রয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতা দখল হচ্ছে সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে। এবং এটাকে অবশ্যই রুখতে হবে। যদি ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয় তা’হলে সেনাবাহিনীর যে সুনাম রয়েছে তা নষ্ট হবে এবং সেনাবাহিনীতে আমার কাজ করা সম্ভব নয়। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম একজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে নয় বরং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আমি এটাকে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করি। জনগণের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই। যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আমার চারিদিকে জড়ো হয়েছিল আমি তাদের বলবো কি ধরনের বিপদ তাদের দিকে আসছে।

 

আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলে আমি অত্যìত কৃতজ্ঞ থাকবো।

আপনার একান্ত বাধ্যগত

লে: কর্ণেল এম• এ• তাহের

কমাণ্ডার, ৪৪ ব্রীগেড

কুমিল্লা সেনানিবাস।

তারিখ ২২শে সেপ্টেম্বর ১৯৭২।

 

 [সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম• এ• জি• ওসমানী এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের পদটি শূন্য রাখেন। ওসমানী বিশবাস করতেন এই দায়িত্বে থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও নীতি নির্ধারণী বিষয়াবলীতে তাহের তার মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ ব্যবহার করতে পারবেন। ১৯৭২- এর এপ্রিলে তাহের পুনা আর্টিফিশিয়াল লিম্ব সেন্টার থেকে কৃত্রিম পা নিয়ে দেশে ফিরেন ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন। এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে তিনি ব্রীগেডিয়ার মীর শওকত ও মেজর জেনারেল শাফিউল্লাহসহ কিছু অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্খা নেয়ার উদ্যোগ নেন, এরা মুক্তিযুদ্ধকালে ও সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে অবৈধ পন্থায় অর্থ কুক্ষিগত করেন। পরে কর্ণেল তাহেরকে এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেলের পদ থেকে ৪৪ কুমিল্লা ব্রীগেড কমাণ্ডার হিসেবে বদলী করা হয়। সেখানে তিনি উৎপাদনমুখী বিপ্নবী গণবাহিনী (জ• চ• অ•) গড়ে তোলার লক্ষ্যে সেনাবাহিনীকে স্বাস্ব্য, শিক্ষা ও কৃষি উৎপাদনে সম্পৃক্ত করেন। শাসক গোষ্ঠী ভীত হয়ে তাকে প্রত্যক্ষ কমাণ্ড থেকে সরিয়ে সুবিধাজনক পদে বদলীর লোভ দেখায়। জেনারেল মিলিটারী পারচজের ডিরেক্টর হিসেবে বদলীর কথা বলা হলো। সেনাবাহিনীর এই ধরনের দুর্নীতি ও অভ্যìতরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতে তিনি পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ পত্রটি সংগৃহীত হয়েছে তাকে হত্যার পর ‘আমরা’ কর্তৃক প্রচারিত সমগ্র ‘জনতার মধ্যে আমি প্রকাশিত’ শীর্ষক পুস্তিকা থেকে। -  সম্পাদক, শহীদ কর্ণেল তাহেরের রচনা সংগ্রহ ‘ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে’।]
 
 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ