Banner
মুখবন্ধ

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 4:00 PM, Hits: 1505

বিজ্ঞানীদের মতে আমরা এমন অনেক নক্ষত্র আকাশে দেখতে পাই যেগুলো বহুকাল আগে, হয়ত অনেক লক্ষ বছর আগে ধ্বংস হয়েছে বা নিভে গেছে। কিন্তু আমরা এখনও তাদেরকে রাতের আকাশে দেখতে পাই, কারণ সেগুলোর কোন কোনটা থেকে পৃথিবীতে আলো পৌঁছতে অনেক লক্ষ বছর লাগে। তাই সে আলো নেভার খবর জানতেও পৃথিবীকে সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়ায় বহিরাগত, যাযাবর আর্য আক্রমণ তত্ত্ব তেমন এক মৃত তত্ত্ব মাত্র যা বহুকাল যাবত সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের ফলে তার অস্তিত্বের ভিত্তি হারিয়েছে। তথাপি এখনও সেই মৃত তত্ত্ব পাঠ্য পুস্তকে পড়ানো হয়। তা এখনও ইতিহাস রচনার ভিত্তি হয়ে আছে। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে, ঐ তত্ত্ব যে একটা ভিত্তিহীন এবং ভ্রান্ত তত্ত্ব মাত্র সেই খবরই সাধারণ শিক্ষিত জনের জানা নেই।
এর কারণ সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত প্রত্নতত্ত্বের ক্রমবর্ধমান আবিষ্কারের অনেক কিছুই যেমন এখন পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষিত জনের জানা নেই তেমন দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা সংশ্লিষ্ট বিষয়ক একাডেমিক কায়েমী স্বার্থও, বহুকাল দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজত্ব করার পর ভ্রান্ত প্রমাণিত হলেও আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান এবং মৃত ঘোষণা করার পথে বাধা হয়ে আছে।
আমরা এই গ্রন্থে বহিরাগত, যাযাবর এবং পশুপালক আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছি শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের অকাট্য ও সর্বজন গৃহীত প্রমাণগুলির সাহায্যে নয়, সেই সঙ্গে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ মূলত যে ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদকে ভিত্তি করে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন সেই ঋগ্বেদেরও সাহায্য নিয়ে। বরং ঋগ্বেদই আমাদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ মূলত ঋগ্বেদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়েই ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এই ভ্রান্ত ইতিহাস তত্ত্ব গড়েছিলেন যে, ভারতবর্ষে আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী এবং তারা পশুপালক ও যাযাবর ছিল। আমরা সিন্ধু সভ্যতা এবং ভারতবর্ষের দূর অতীতের হারানো ইতিহাস বিস্মৃতির মাটি খুঁড়ে তুলে আনার কাজে ঋগ্বেদকে এক অমূল্য হাতিয়ার হিসাবে দেখতে পেয়েছি।
এই গ্রন্থ রচনার পটভূমি সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু বলা যায়। এই গ্রন্থের একজন লেখক শামসুজ্জোহা মানিক ঋগ্বেদ পাঠের পর এই বিষয়ে নিশ্চিত হন যে, তার সঙ্গে বহিরাগত এবং যাযাবরদের আক্রমণের কোন সম্পর্ক নেই, বরং এটি সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফসল। তিনি সিন্ধু সভ্যতার উপর কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি এ ছাড়াও মহাভারত ও আবেস্তা সহ বিভিন্ন গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। ১৯৯০ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত তাঁর নূতন উপলব্ধির ভিত্তিতে ‘ভারত- ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু এটি অপ্রকাশিত থেকে যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, সেই সময় বর্তমান গ্রন্থের অপর লেখক শামসুল আলম চঞ্চল তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনায় যোগ দেন।
এরপর চঞ্চল বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। তিনি পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘরের প্রাক্তন মহাপরিচালক এবং বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক রফিক মুঘলের নিকট সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের উপর সর্বশেষ তথ্য লাভের উপায় সম্পর্কে জানতে চেয়ে চিঠি লিখলে মুঘল তাঁকে তাঁর কতকগুলি লেখা পাঠান যেগুলি আমাদের জন্য অমূল্য তথ্যভাণ্ডার ছিল। তাঁর প্রদত্ত এইসব তথ্য এবং আরও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং সাহিত্য পাঠ করে এবং মানিকের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে ১৯৯৪ সালে চঞ্চল ইংরাজীতে  The Indus Civilization and the Aryans নামে একটি খসড়া নিবন্ধ লিখে মুঘলের নিকট মতামতের জন্য পাঠান। মুঘল নিবন্ধটিকে একটি সফল প্রয়াস হিসাবে উল্লেখ করে এটিকে অবিলম্বে প্রকাশ করার জন্য চঞ্চলকে তাগিদ দেন।
এটা ছিল আমাদের উভয়ের জন্য বিরাট অনুপ্রেরণা সঞ্চারী ঘটনা। নিবন্ধটি ছিল আমাদের উভয়ের চিন্তা ও শ্রমের ফসল। সেহেতু আমরা উভয়ে যৌথভাবে নিবন্ধটিকে ভিত্তি করে ইংরাজীতে একটি গ্রন্থ রচনার সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৯৫ সালে আমাদের লেখা The Aryans and the Indus Civilization  দিনরাত্রি প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশে যাঁরা আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামালের নাম এখানে আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করছি। এর পর বিগত প্রায় সাড়ে ছয় বৎসর কাল আমরা আমাদের গ্রন্থের ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের চেষ্টা করেছি। এছাড়া আমরা এই সময়ে আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ এবং অধ্যয়ন করেছি। এইসব মতবিনিময়, অধ্যয়ন এবং তথ্য আমাদেরকে অনেক বেশী সমৃদ্ধ এবং প্রত্যয়ী করেছে। আমাদের ধারণাও এই সময়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে নি যেটা আমাদের ইংরাজী বইয়ের সঙ্গে বর্তমান বইটিকে তুলনা করলে যে কোন পাঠক বুঝতে পারবেন।
পাতা: ৪  

এখানে এ বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, গ্রন্থটি ২০০২-এ প্রকাশিতব্য হলেও এটি লিখা সম্পূর্ণ হয় মূলত ২০০০ সালের শেষ দিকে। সুতরাং  সিন্ধু সভ্যতার উপর আমরা যেসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছি সেগুলির প্রত্নতাত্ত্বিক উৎস প্রধানত সেই সময় পর্যন্ত প্রাপ্ত আবিষ্কার সমূহের তথ্য। কিন্তু ২০০২-এ আমরা যখন এই গ্রন্থ প্রকাশের জন্য চূড়ান্তভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করি তার অল্প সময় পূর্বে হঠাৎ করে একটি যুগান্তকারী প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ঘটে ভারতের ক্যাম্বে উপসাগরের গর্ভে নিমজ্জিত এক হারানো নগরের সন্ধান পাবার ফলে। এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ২০০১ সালে। গুজরাটের সুরাট উপকূল থেকে পশ্চিমে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে এবং সমুদ্র জলের ৩০-৪০ মিটার নীচে আবিষ্কৃত নগরটি সিন্ধু সভ্যতার এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সকল নগর থেকে অনেক বড়। প্রায় ৫ মাইল দীর্ঘ এবং ২ মাইল প্রশস্ত এ নগর সাগরতলে থাকায় এবং জল ঘোলা এবং সমুদ্র স্রোত প্রবল থাকায় আবিষ্কারের কাজের গতি অত্যন্ত ধীর। তা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে যেটুকু আবিষ্কার হয়েছে তা শুধু সিন্ধু সভ্যতা নয় উপরন্তু সমগ্র মানব ইতিহাস সম্পর্কে ধারণার অনেক কিছুকে উল্টেপাল্টে দিতে পারে।
ইতিমধ্যে সেখানকার একটি কাঠের টুকরোর রেডিও কার্বন টেস্টে তার প্রাচীনত্ব সম্পর্কে যে তারিখ পাওয়া গেছে তাতে এটিকে আজ থেকে সাড়ে সাত কিংবা সাড়ে নয় হাজার বছর পূর্বের বলে সনাক্ত করা হয়েছে। নগরটি যে সিন্ধু সভ্যতার এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সকল নগরের মধ্যে বৃহত্তম সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলেও এর প্রাচীনত্বের বিষয়ে আরও পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে পণ্ডিতরা মনে করছেন। নিমজ্জিত নগরে প্রাপ্ত এক খণ্ড কাঠের উপর নির্ভর করে স্বাভাবিকভাবে নগরের বয়স নির্ধারণ করা যায় না।
সদ্য আবিষ্কৃত এ নগর সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের হয়ত আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষত ঘোলা জল ও প্রবল স্রোতপূর্ণ সমুদ্রতলে নগরটি অবস্থিত হওয়ায় খনন কার্য এবং অনুসন্ধান চালানো অত্যন্ত কঠিন বলে আমরা জানতে পেরেছি। এই রকম এক আবিষ্কারের একেবারে প্রাথমিক অবস্থায় প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের স্বল্পতার দরুন খুব সামান্য তথ্যই পাওয়া সম্ভব। তবু সংবাদপত্র এবং বিশেষ করে ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা কিছু আলোচনা করেছি। তবে সঙ্গত কারণেই ক্যাম্বে নগর সম্পর্কে আমাদের আলোচনা ও মূল্যায়ন থেকেছে অত্যন্ত সতর্ক ও সীমিত।
১৯৯০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত এক দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় আমরা আর্য ও সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের নূতন ধারণাকে বিকশিত করার চেষ্টা করেছি। বস্তুত আমরা ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের একটা ভিন্ন ও নূতন ধারণাগত কাঠামো গড়ার চেষ্টা করেছি যার সর্বশেষ ফসল হচ্ছে বর্তমান গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’। এ গ্রন্থে আমরা বাংলাভাষী সাধারণ পাঠকদের নিকট ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সহজভাবে তুলে ধরতে চেয়েছি। সেটা কতটা পেরেছি সে বিচার পাঠক করবেন।
আমাদের এই কাজে যাঁরা উৎসাহ ও মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছেন তাঁদের মধ্যে অবিভক্ত পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক এবং বাংলাদেশে ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজ প্রজেক্টের প্রাক্তন ন্যাশনাল প্রজেক্ট অ্যাডভাইজার নাজিমুদ্দীন আহমেদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক অসিত বরণ পালের নাম উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বর্তমান পরিচালক শফিকুল আলম তাঁদের গ্রন্থাগার ব্যবহার করার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন। পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ববিদ রফিক মুঘলের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। এছাড়া চিঠিপত্রের মাধ্যমে যাঁদের মতামত আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য কিংবা অনুপ্রাণিত করেছে তাঁদের মধ্যে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক এম কে ধবলিকর, ঐতিহাসিক হরবন্স্ মুখিয়া (জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়) এবং বেদ-পণ্ডিত ও লেখক ভগবান সিং-এর নাম উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে আমরা ভগবান সিং-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই দিল্লীতে চঞ্চলের সঙ্গে তাঁর আলোচনা এবং পরবর্তী সময়েও আমাদের চিঠির উত্তরে বিভিন্ন প্রশ্নে তাঁর মূল্যবান মতামত এবং পরামর্শ দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য ও উৎসাহিত করার জন্য। দিল্লীতে চঞ্চল ভারতীয় আর যেসব পণ্ডিতের নিকট থেকে মূল্যবান পরামর্শ, তথ্য এবং উৎসাহ পান তাঁদের মধ্যে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পরিচালক আর এস বিশ্ট্ এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ-এর অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সবশেষে বলতে হয় আমেরিকার কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক জিম জি শেফারের কথা যিনি তাঁর সাম্প্রতিক লেখা পাঠিয়ে আমাদের সাহায্য করেছেন। তাঁদের সবার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

শামসুজ্জোহা মানিক
শামসুল আলম চঞ্চল
ঢাকা, ১ জুলাই, ২০০২
পাতা: ৫

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ