Banner
অষ্টম অধ্যায় - নদী নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ধু সভ্যতা

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 7:00 AM, Hits: 4486

সিন্ধু সভ্যতার ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু সম্পর্কে পণ্ডিতদের বিভিন্ন মত থাকলেও সাম্প্রতিক কালে এই মতটাই বেশী গ্রহণযোগ্য হচ্ছে যে, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে সেকালেও এখনকার মত কম বৃষ্টিপাত হত। অর্থাৎ সেকালে ঐ অঞ্চলে বহমান দুইটি প্রধান নদী সিন্ধু ও সরস্বতী মূলত মরুভূমি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ত। এই বিশাল এলাকাব্যাপী ছড়ানো বিপুল সংখ্যক বসতিতে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে হলে যে, কৃত্রিম ও উন্নত সেচ ব্যবস্থার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না সেটা সহজেই বোঝা যায়।
কাজেই এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতায় কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থার সাক্ষ্য থাকা যুক্তিসঙ্গত। আমরা জানি মিসরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নীল নদকে ভিত্তি করে। নীল নদে প্রতি বছর বন্যার ফলে যে পলি জমত তার ফলে প্রচুর কৃষি উৎপাদন হত। মেসোপটেমীয় সভ্যতায় ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদী থেকে জল নেবার জন্য অনেক কৃত্রিম খাল তৈরী করা হয়েছিল যেগুলো থেকে জমিতে সেচ দিয়ে প্রচুর ফসল ফলানো হত। এই জলসেচের খালগুলোর জলপ্রবাহ শাসকরা নিয়ন্ত্রণ করত এবং বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচুর লোকবল নিয়োগ করত। সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণে পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনের জন্য এ অঞ্চলের রুক্ষ ভূ-প্রকৃতি ও অল্প বৃষ্টিপাতের কারণে কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা প্রত্নতত্ত্ব, ভূ-তত্ত্ব, বা জলবিদ্যার সাহায্যে মানুষ কর্তৃক নির্মিত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক খাল বা বাঁধের কথা এখন পর্যন্ত জানি না। তবুও এখন পর্যন্ত পাওয়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক

_________________________________________________________________________________
পণ্ডিতদের একটি অংশ মনে করেন যে, হরপ্পান যুগে এখনকার চেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হত। ফলে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় জলাভূমি ও অরণ্য গড়ে উঠেছিল। অন্য অংশ মনে করেন সে সময়ের জলবায়ু প্রায় এখনকার মতই শুষ্ক ছিল। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন:
B.K. Thapar and M. Rafique Mughal, ‘The Indus Valley (3000-1500BC).’ History of Humanity: Science and Cultural Development, (1996), Vol-II, p. 249.
M.A. Courty, ‘Integration of Sediment and Soil Information in the Reconstruction of Protohistroric and Historic Landscapes of the Ghaggar Plain (North-West India).’ South Asian Archaeology 1985, ed. Karen rensen (The Riverdale Company, Copenhagen, 1989),Frifelt and Per S p-259.
Vishnu Mittre, ‘The Harappan Civilization and the Need for a New Approach.’ Harappan Civilizaton: A Contemoporary Perspective, (1982), pp. 36-37.Gurdip Singh, ‘The Indus Valley Culture’, in, Ancient Cities of the Indus (1979).
অতি সম্প্রতি ক্যাম্বে উপসাগরে জলের গভীরে যে নগরটি আবিষ্কৃত হয়েছে তার পাশে অবস্থিত প্রাচীন নদীখাতে মানুষ নির্মিত বাঁধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। পণ্ডিতরা একে প্রাচীনকালে বালুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে ছোট নদীতে দেওয়া বাঁধ বা গবরবন্দ্-এর সাথে তুলনা করেছেন। এই নগরে প্রাথমিক অনুসন্ধানে আদি হরপ্পান ও পরিণত হরপ্পান সংস্কৃতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৫৫


ও ভূ-তাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করে জলসেচের উদ্দেশ্যে নির্মিত বাঁধ ও খালের সম্ভাব্যতা পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
বালুচিস্তানের পাহাড়ী এলাকায় গবরবন্দ নামে প্রাগৈতিহাসিক এক ধরনের বাঁধের কথা স্টেইন ও অন্যান্য পণ্ডিত উল্লেখ করেছেন। খুব মজবুতভাবে পাথর দিয়ে তৈরী করে এই বাঁধগুলো পাহাড়ী ছোট ছোট নদীতে দেওয়া হত। এগুলোর উচ্চতা কখনো ১০ থেকে ১৫ ফুটও হত। প্রচুর পলি ও জল ধরে রাখত এগুলো, যা ফসল ফলাবার জন্য ব্যবহার করা হত। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন এগুলো প্রস্তর যুগ-তাম্র যুগের। অনুমান করা যায় যে, গবরবন্দ্ বা বাঁধ ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ফলে বালুচিস্তানের মত রুক্ষ ও বৃষ্টিহীন অঞ্চলে প্রচুর ফসল উৎপাদন হত। অর্থাৎ এটা বোঝা যায় যে, উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমের কোথাও কোথাও বাঁধ দ্বারা জল সংরক্ষণ করে সেচের সাহায্যে ফসল ফলানোর প্রযুক্তি বিদ্যা সিন্ধু সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই কোন কোন জনগোষ্ঠীর আয়ত্তে ছিল। হয়ত সমকালেই এই ধরনের বাঁধের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মানুষেরা সরস্বতী ও বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রথমে উত্তরে তুলনায় ছোট পাহাড়ী নদী বা জলধারাগুলোতে বাঁধ দিতে থাকে।
এই প্রক্রিয়া হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকে যার ফলে ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী যুগের অর্থাৎ তাম্র যুগ ও আদি হরপ্পান পর্যায়ের সমস্ত কাল জুড়ে। এ সময়ে বসতির সংখ্যা বাড়তে থাকে, বসতিগুলোতে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে বসতিগুলোতে সামাজিক স্তরবিন্যাস, স্থাপত্যের জটিলতা, আন্ত:আঞ্চলিক যোগাযোগ ও বিনিময়, হস্তশিল্পের প্রসার এবং অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের লক্ষণসমূহ দেখা যেতে থাকে; এবং এমনকি এর শুরু পঞ্চম সহস্রাব্দ থেকেও হতে পারে। তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম থেকে এই প্রবণতাসমূহ আরও স্পষ্ট ও বিকশিত হতে থাকে এবং তা ক্রমবর্ধমান ‘হরপ্পান’ প্রবণতার দিকে ঝুঁকতে থাকে। নগরায়ন শুরুর লক্ষণও তখন স্পষ্ট হতে থাকে । প্রাচীন যুগের কোন সমাজের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে শস্যাগার, বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানার চিহ্ন এবং মানুষের বসবাসের দালানের ধ্বংসাবশেষ থেকে। তাই নিশ্চিতভাবেই এ কথা বলা যায় যে, কেবলমাত্র কৃত্রিম সেচব্যবস্থার ফলেই এ অঞ্চলে সভ্যতার পথে ক্রমিক অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়েছিল। এরই চূড়ান্ত পরিণতি দেখতে পাওয়া যায় হরপ্পান পর্যায়ের অসাধারণ ও অভূতপূর্ব এক উন্নত নগর সভ্যতায়। স্বভাবতই এটি খুবই যুক্তিসঙ্গত যে, এ যুগে এত বিশাল অঞ্চলে এত ব্যাপক ভিত্তিক নগর সভ্যতার অপরিহার্য শর্ত বিপুল উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ফলে এটি সম্ভব হয়েছিল, যা এই সময়ে বাঁধ ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার ব্যাপক প্রয়োগের বৈদিক সাক্ষ্যকে সমর্থন করে।

_________________________________________________________________________________
দেখুন : Sir Mortimer Wheeler, The Indus Civilization, Supplimentary Volume to The Cambridge History of India, (Cambridge University Press, 1968), Third Edition, pp. 10-11.
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন  M. Rafique Mughul, ‘ Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley : 1971-90.’ South Asian Studies, (1990), pp.179-194.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৫৬


জলবিদ্যা (Hydrology), ভূ-তত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব থেকে বৃহত্তর সিন্ধু ও সরস্বতী উপত্যকার বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘ মেয়াদী বন্যা, প্রত্নযুগের অসংখ্য খাল ও নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কথা জানা যায়। তবে পণ্ডিতরা এগুলোর কোনটাকেই মানুষের দ্বারা সৃষ্ট বলে মনে করেন না।
উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি ও ভূমি-ভিত্তিক জরিপের সাহায্যে জানা গেছে যে, শতদ্রু (সুতলেজ) নদী এক সময়ে ঘাগর নদীতে পড়ত, যা এখন সিন্ধু নদীতে গিয়ে পড়েছে। এছাড়া শতদ্রু নদী থেকে অসংখ্য খাল বের হবারও প্রমাণ পাওয়া গেছে ।
মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, ঋষি বসিষ্ঠ যখন নিজেকে শতদ্রু নদীতে নিক্ষেপ করলেন তখন তা শত ধারায় বিভক্ত হলো। এটি যদিও রূপক বর্ণনা তবু এ থেকে নদীটি থেকে বের হওয়া অনেক খালের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এছাড়াও পণ্ডিতরা প্রমাণ পেয়েছেন যে, যমুনা নদী এখন যে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে প্রাচীন কালে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হত ও চৌটাং (প্রাচীন দৃষদ্বতী) নদীর ধারায় গিয়ে পড়ত এবং শেষে হাকরা নদীর ধারায় গিয়ে মিলিত হত। বাহাওয়ালপুরে ভূপৃষ্ঠের অনেক অবনতি এবং প্রাচীন খালের চিহ্ন দেখা যায় যেগুলো বিপাশা-শতদ্রু সংযোগ নদীর শুকিয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্রবাহ থাকার সাক্ষ্য দেয়। সে সময়ে ঘাগর, যমুনা (চৌটাং-এর ধারায়), শতদ্রু ও নাইওয়াল নদী মিলে যে ধারা তৈরী হয়েছিল তা পাঞ্জাবে এক বিশাল জলধারা তৈরী করে যা সেযুগে সরস্বতী নামে সুপরিচিত ছিল।
সম্প্রতি সরস্বতী নদীর প্রাচীন খাতের অধিকাংশই আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে জানা যাচ্ছে যে, হিমালয়ের হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণে কচ্ছের রান হয়ে এর একটি জলধারা ক্যাম্বে উপসাগরে গিয়ে পড়ত। ক্যাম্বে উপসাগরে বিপুল পরিমাণ পলি সঞ্চয় হিমালয় থেকে উৎপত্তি হওয়া কোন মহা-নদী দ্বারাই সম্ভব হতে পারে বলে পণ্ডিতরা মনে করেন। হিমালয় থেকে ক্যাম্বে উপসাগর পর্যন্ত এই নদী ১৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ। সরস্বতী নদী হরিয়ানা থেকে পাঞ্জাব ও রাজস্থান হয়ে কচ্ছের রান পর্যন্ত ডান ও বাম উভয় তীরে ৩০০ কিলোমিটার করে পলি ছড়িয়ে দিয়েছিল। কৃত্রিম উপগ্রহের প্রতিচ্ছবি থেকে সরস্বতী নদীর খাত হিমালয় থেকে গুজরাট পর্যন্ত তার সমস্ত গতিপথে গড়ে ৩ থেকে ৮ কি:মি: প্রশস্ত হিসাবে দেখা গেছে। এটি প্রমাণ করে যে, সরস্বতী নদী প্রাচীনকালে সিন্ধু নদীর চেয়েও প্রশস্ত ছিল। গুজরাটে সরস্বতী নদীর একটি সম্ভাব্য খাত সম্পর্কে মনে করা হয় যে, তা নাল সরোবর ধরে এগিয়ে সমুদ্র তীর ধরে প্রবাহিত হয়ে লোথাল ছাড়িয়ে রংপুর ও প্রভাস পটনের (সোমনাথ) দিকে গেছে। তার ফলে দক্ষিণ অংশে ধোলাভিরা, সুরকোটডা ও লোথাল সরস্বতী নদীর একটি ধারা বরাবর অবস্থান করত বলে ধারণা করা হয়।

_________________________________________________________________________________
ঐ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : D.P. Agrawal and R.K. Sood, ‘Ecological Factors and the Harappan Civilization, Harappan Civilization : A Contemporary Perspective. p.-226.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৫৭


ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীকে পবিত্র নদী বলা হয়েছে। এখন এই নদী নারা-ওয়াহিন্দা-হাকরা-ঘাগর নামে পরিচিত যার অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। এই ধারা উপরের অংশে ঘাগর, সরস্বতী ও দৃষদ্বতী এবং মধ্যবর্তী ও নীচের অংশের একটি ধারা পূর্ব নারা খান নামে টিকে আছে। পণ্ডিতরা জেনেছেন যে, ঘাগর নদী আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ে প্রবাহমান ছিল। কিন্তু চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের (PGW) পর্যায়ে তাকে আর প্রবাহিত হতে দেখা যায় না। এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে পণ্ডিতরা মনে করেন যে, উত্তর ও পশ্চিম রাজস্থানে ভূস্তরে পরিবর্তনের ফলে নদীর পরিবর্তিত স্রোতধারা আদি হরপ্পান পর্যায় থেকেই সেখানকার সমাজের উপর প্রভাব ফেলে। পাঞ্জাবেও ভূ-গঠনগত তথ্য থেকে জানা যায় যে, রাবি, বিপাশা ও শতদ্রু -- সব নদীর গতিপথেই বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছিল। দূর অতীতে রাবি আরো দক্ষিণে, মুলতানের কিছু নীচে বেলাব ও ঝিলাম-এর সঙ্গমস্থান থেকে প্রবাহিত হত। এক সময়ে বিপাশা নদী শতদ্রুতে সংযুক্ত না হয়ে একা সিন্ধু নদীতে গিয়ে পড়ত। উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি থেকে এইসব প্রাচীন নদীপথের পরিষ্কার চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া ভূমি-ভিত্তিক জরিপে সিন্ধু প্রদেশে সিন্ধু নদী থেকে বেরিয়ে আসা খালের মত অনেক ভূ-অবনতি দেখা যায়, যেগুলো এখন একেবারে শুকনো। দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান নদীগুলো হল লুনি, বনস, সবরমতি, মাহি, নর্মদা, তাপ্তি ও গোদাবরি। কাথিয়াওয়াড় মালভূমিতেও প্রাচীন যুগের অনেক শুকনো খাতের চিহ্ন দেখা গেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এগুলো ৬০ মিটার পর্যন্ত চওড়া।
উপরের বর্ণনায় প্রাচীন যুগের প্রবাহমান জলধারার বা খালের চিহ্ন হিসাবে থেকে যাওয়া অসংখ্য খাত থেকে এ বিষয়টি অনুমান করা যায় যে, এগুলো আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ের মানুষ কর্তৃক সেচের উদ্দেশ্যে নির্মিত খাল। এছাড়াও যমুনা নদীর খাত পরিবর্তন হয়ে পূর্ব দিকে সরে যাওয়া এবং শতদ্রু নদীর স্রোতধারা হাকরা-ঘাগর থেকে সরে গিয়ে পশ্চিমে সিন্ধু নদীর সাথে মেলাতেও আমরা অনুমান করতে পারি যে, নদীতে বাঁধ দেবার ফলেই এগুলো দীর্ঘকাল পর গতিপথ পরিবর্তন করে। আমাদের অনুমান আরো জোরালো হয় যখন আমরা দেখি যে, হরপ্পান পর্যায়ে সরস্বতী নদী (অর্থাৎ আজকের ঘাগর-হাকরা নদী) প্রবাহমান ছিল, কিন্তু হরপ্পান সভ্যতা ক্ষয়ের পর ঘাগর-হাকরা বা সরস্বতী নদী শুকিয়ে যায়।
আকাশ থেকে নেওয়া ছবিতে মাকরান উপকূলে বর্তমান সমুদ্র উপকূলের সমান্তরাল প্রাগৈতিহাসিক উঁচু উপকূল দেখা যায়। পণ্ডিতরা মনে করেন যে, ভূ-কম্পনের ফলে এসব স্থানে ভূ-স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি হয়েছে। ভূ-পৃষ্ঠের এই উচ্চতা বৃদ্ধি ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে বালুচিস্তানের কৃষি সমাজের ধ্বংস ডেকে এনেছিল বলে মনে করা হয়। সিন্ধু সভ্যতায় কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ করে সেচব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা এই সম্ভাবনা

_________________________________________________________________________________
দেখুন : Robert L. Raikes, ‘The End of the Ancient Cities of the Indus’. Ancient Cities of the Indus, ed. Gregory L. Possehl (1979), pp. 301-304.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৫৮



pic-56
পাতা: ১৫৯



দেখি যে, উপকূল বরাবর ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ভূ-কম্পন কিংবা ভূতাত্ত্বিক কারণে নয় বরং মানুষ কর্তৃক নির্মিত বাঁধের কারণে ঘটতে পারে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননে মহেঞ্জোদাড়োর দক্ষিণে আমরি এবং চানহু-দাড়োতে ব্যাপক বন্যার সাক্ষ্য পাওয়া গেছে। মহেঞ্জোদাড়োতে বহু-স্তর বিশিষ্ট পলির এবং বহু স্তরে ঘর-বাড়ীর পুনর্নির্মাণ থেকে পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে, সেখানে কমপক্ষে পাঁচ বার দীর্ঘ মেয়াদী ও ব্যাপক ক্ষতিকর বন্যা হয়েছিল। এই বন্যার স্থিতি ও অনুপস্থিতির চক্রটি ১০০ বছরের বেশী হতে পারে। এই বন্যার ফলে মহেঞ্জোদাড়োর উজানে বিশাল এক হ্রদ সৃষ্টি হয়। পণ্ডিতরা মনে করেন, ভূমিকম্পের কারণে ভূ-উন্নতি ঘটেছিল, ফলে সিন্ধু নদীর প্রবাহ রুদ্ধ হয়, যার ফলশ্রুতি হল মহেঞ্জোদাড়োর দীর্ঘ মেয়াদী বন্যা ।১  
আমরা মনে করি যে, মহেঞ্জোদাড়োতে কমপক্ষে পাঁচ বার হওয়া এই বন্যা মহেঞ্জোদাড়োর দক্ষিণে সিন্ধু নদীতে দেওয়া বাঁধের ফলে হয়েছিল, ভূ-কম্পনের ফলে নয়। যদি প্রচলিত মত অনুযায়ী ভূমিকম্পের ফলে মহেঞ্জোদাড়োর উজানে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি ঘটে থাকে যা সিন্ধু নদীর প্রবাহকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল, তাহলে তা একই জায়গায় পাঁচ বার হবে কেন? এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর ভূমিকম্প তত্ত্বে নেই। একটি বাস্তব উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৮১৯ সালে ভূমিকম্পের ফলে নারা নদীতে আল্লাহবান্দ্ নামে একটি বাঁধের সৃষ্টি হয় যা ১৯২৬ সালের বন্যার সময়ে জলের প্রবল প্রবাহের কারণে ভেসে যায়। সিন্ধু নদীর সংকীর্ণ খাতে প্রতি সেকেন্ডে ৫,০০,০০০ ঘন ফুট জল প্রবাহিত হয়। কাজেই নারা নদীর তুলনায় অনেক বৃহৎ সিন্ধু নদীতে কিভাবে ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট বাঁধ ৫০ বা ১০০ বৎসর টিকে থাকবে, তাও আবার পাঁচ বার একই জায়গায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে?
মহেঞ্জোদাড়োর উজানে হ্রদ সৃষ্টির যেমন প্রমাণ পাওয়া যায় তেমনই সিন্ধু ও শতদ্রু নদীর উপরের অংশে ভূ-তত্ত্ববিদরা হ্রদ থাকার বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছেন।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন, বাঁধের উপস্থিতি, দীর্ঘ জলাবদ্ধতা বা হ্রদ সৃষ্টি, বন্যা, নদীর শুকিয়ে যাওয়া এসবই প্রধানত হরপ্পান পর্যায়ে ঘটেছে। আমরা প্রায় সমস্ত ঘটনাই নদীর প্রবাহের পথে মানুষ কর্তৃক নির্মিত বাঁধ নির্মাণের ফলে ঘটেছে বলে মনে করি।
আগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নব প্রস্তর যুগের মানুষেরা ছোট ছোট নদীর মাঝখানে বাঁধ দিয়ে জল ও পলির সাহায্যে যে কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলে তার সাফল্যের পর আরও বড় নদীগুলোতে বাঁধ দিতে থাকে। প্রবাহমান নদীতে বাঁধ দেওয়া অত্যন্ত সাহসের কাজ, বিশেষভাবে প্রাচীন যুগের মানুষের জন্য। এর প্রথম কারণ হল, সে যুগের সাধারণ মানুষের কাছে নদী ছিল দেবতা এবং অনেক প্রাকৃতিক শক্তির উৎসের মতই একটি শক্তি, যার ক্ষতি করার ক্ষমতা প্রকাশ পায় বিশেষভাবে বন্যার সময়ে। কাজেই বাঁধ দিয়ে নদীর প্রবাহকে

_________________________________________________________________________________
দেখুন: George F. Dales, ‘The Decline of the Harappans’ Ancient Cities of the Indus, p. 311.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৬০


রুদ্ধ করা দেবতার বিরুদ্ধাচরণের শামিল। দ্বিতীয় কারণ হল, নদীর প্রবাহকে বাঁধ দিয়ে রুদ্ধ করায় উজান থেকে যে বিপুল জল আসতে থাকে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা বাঁধকে যেমন ধ্বংস করতে পারে তেমনই অতিরিক্ত সঞ্চিত জল ধ্বংসাত্মক বন্যার কারণ হতে পারে আশপাশের বসতির জন্য। পরবর্তীকালে তুলনামূলক বড় নদীতে বাঁধ দিতে গিয়ে সঞ্চিত জলকে অনেক খালের মাধ্যমে দূরবর্তী এলাকায় সেচের জন্য পাঠান হয়ে থাকবে। আবার অতিরিক্ত সঞ্চিত জলকে ভাটিতে ছেড়ে দেবার জন্য বাঁধের মাঝখানে জলকপাট বা স্লুইস গেট জাতীয় কোন ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। কারণ স্লুইস গেট ছাড়া জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। লোথালের ডকের জল ছেড়ে দেবার জন্য স্লুইস গেটের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। হরপ্পার কিছু কিছু ড্রেনে কাঠের স্লুইস গেট বা নগরে বহিরাগত প্রবেশ ঠেকানোর জন্য গ্রীল থাকার সম্ভাবনা কেনোয়ার উল্লেখ করেছেন। আমরা অনুমান করি নগরে ড্রেন ব্যবস্থা কার্যক্ষম রাখার জন্যই ড্রেনে স্লুইস গেট থাকতে পারে। এতে ড্রেনে জল ধরে রাখার ফলে ময়লা সহজেই নিষ্কাশিত হতে পারে। এসব সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা স্লুইস গেটের সাথে পরিচিত ছিল।
এখন নদীর মাঝখানে বাঁধ নির্মাণ করে তাতে স্লুইস গেট দিয়ে অতিরিক্ত জল ভাটিতে ছেড়ে দিলে সঞ্চিত অতিরিক্ত জল বাঁধের জন্য বিপদ ডেকে আনে না। তবে বড় নদীতে স্লুইস গেট হতে হবে খুবই শক্তিশালী যাতে জলের চাপে তা ভেঙ্গে না যায়। বাঁধের উজানে সঞ্চিত জলের একটি নিরাপদ উচ্চতা রক্ষা করতে পারলে জলের চাপে বাঁধ ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু বিপদ আসতে পারে অন্য জায়গা থেকে। সেটা হল বাঁধের উজানে এবং ভাটিতেও ক্রমশ পলি জমতে থাকবে এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করলে বহু বৎসর পর, হয়ত পঞ্চাশ-ষাট বৎসর কিংবা একশত বৎসর পর বাঁধের স্লুইস গেট অকেজো হয়ে যেতে পারে। বাঁধের এক পাশে জল সঞ্চয়ের ফলে যে হ্রদ সৃষ্টি হয় সেখানে অতিরিক্ত পলি খালের মাধ্যমে সেচের জল বিতরণ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলতে পারে। কাজেই এই সমগ্র বাঁধ ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ছিল জরুরী। স্লুইস গেট অকার্যকর হলে আরেকটি বড় বিপদ ঘটতে পারে। সেটা হল ভাটিতে অবস্থিত নদী বা খালগুলিতে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করতে না পারার ফলে জলশূন্যতা।
উপরের এই আলোচনা অবাস্তব ও অতিকল্পনা মনে হতে পারে এই অঞ্চলের কোন নদীতে এখন পর্যন্ত স্লুইস গেট সমন্বিত বাঁধ না পাওয়াতে। কিন্তু মিসরের পিরামিড যদি এখন পর্যন্ত টিকে না থাকত তাহলে সাহিত্য থেকে প্রাপ্ত পিরামিডের বর্ণনা জেনে কেউ কি বিশ্বাস করত যে, সত্যিই পিরামিডের মত এত বিশাল স্থাপত্য যান্ত্রিক ক্রেন, বিদ্যুৎ চালিত পাথর কাটা যন্ত্র ও উচ্চতর প্রকৌশল জ্ঞান ছাড়া তৈরী করা সম্ভব?

_________________________________________________________________________________
দেখুন: Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization (1998), p.61.
ক্যাম্বে উপসাগরের গর্ভে নিমজ্জিত নগরের পাশে নদী খাতে মানুষ নির্মিত বাঁধ পাওয়া গেছে। এখানে আরো অনুসন্ধান কাজ চলছে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৬১


একই কথা প্রযোজ্য মেক্সিকোর প্রাচীন মায়া বা ইনকা সভ্যতার স্থাপত্যগুলোর ক্ষেত্রে অথবা প্রাচীন ব্রিটেনের মানুষদের তৈরী স্টোনহেন্জ্-এর ক্ষেত্রে। সুতরাং এটি সত্য যে, প্রাচীন যুগে উন্নততর সমাজ সংগঠন গড়ে তোলার ফলে নগর সভ্যতাগুলি নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বিপুল সম্পদ, জনবল ও কৃৎকৌশলের সমাবেশ ঘটাতে পারত। কাজেই সিন্ধু সভ্যতাও যে বিশাল অঞ্চলের জন-সমাজগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বাঁধ ভিত্তিক এক জটিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছিল সেটা অসম্ভব কিছু নয়।
সিন্ধু সভ্যতার বিকাশের ক্রমপর্যায়ের দিকে তাকালে অনুমান করা যায় যে, নবপ্রস্তর যুগ থেকে বাঁধ-ভিত্তিক সেচব্যবস্থার যে সূচনা হয়েছিল তার চূড়ান্ত প্রয়োগ হরপ্পান পর্যায়ের শুরুতেই হয়েছিল যার প্রমাণ হরপ্পান পর্যায়ে নগর সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশ। কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া বিশাল এলাকায় ছড়ানো অনেক নদী ও অসংখ্য খালে যে জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয় এটা সহজবোধ্য। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রয়োজন অনুসারে জল সরবরাহ করা এবং সেচের জল বিতরণে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা নি:সন্দেহে জরুরী। এতে আঞ্চলিক ক্ষোভ ও অসন্তোষ এড়ানো যায়। এছাড়াও প্রতি বছর এসব বাঁধ, স্লুইস গেট, খাল ইত্যাদি রক্ষণাবেক্ষণেও প্রচুর সংখ্যক মানুষ প্রয়োজন। অনুমান করা যায় যে, এই জটিল ও সংবেদনশীল নদীনিয়ন্ত্রণ-ভিত্তিক সেচব্যবস্থা কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সম্ভব নয়। এই রাষ্ট্রকে এমনকি দূরবর্তী অঞ্চলগুলির উপরও অন্তত কিছু ক্ষেত্রে দৃঢ় নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। এই জন্যই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসাবে একদিকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে গুজরাট পর্যন্ত ও অন্যদিকে বালুচিস্তান থেকে আংশিক কাশ্মীর-উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত সিল, লিপি ও ইটের মাপে আশ্চর্য মিল দেখা যায়। তবে সিন্ধু সভ্যতায় সবকিছুই সব জায়গায় একরকম নয়, যেমন বিভিন্ন রকম ধর্মীয় স্থাপত্যে ও ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে অমিল। এছাড়াও নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে মূলত কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা গেলেও নগর বিন্যাসের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য দেখা যায়। এখানেই হরপ্পান সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। ঐক্যের সাথে অনৈক্যের সহাবস্থান বা মিলের সাথে অমিলের এক অপূর্ব সমন্বয়।
বাঁধ-ভিত্তিক সেচ ব্যবস্থার চূড়ান্ত প্রয়োগ ঘটে পরিণত হরপ্পান সভ্যতার সূচনাতে। এই সময় থেকে প্রায় ৭০০ বৎসরব্যাপী হরপ্পান সভ্যতা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত, যাকে আমরা হরপ্পান রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য বলতে পারি। অনুমান করা চলে যে, বিশেষত দীর্ঘকাল নদীতে বাঁধ থাকার ফলে অতিরিক্ত পলি জমে স্লুইস গেট সহ সমস্ত নদীর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ায় এবং ভূমির লবণাক্ততা বেড়ে যাবার ফলে হরপ্পান সভ্যতায় ক্ষয় দেখা যায়। ২১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দেই কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ক্ষয়ের কথা পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছেন। এরপর হরপ্পান সভ্যতা প্রায় ২০০ বৎসর টিকে ছিল। নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংকট আর দীর্ঘকাল একস্থানে নদীর জল সঞ্চিত হয়ে হন্সদ সৃষ্টির ফলে ভূমির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে সভ্যতায় ক্ষয় শুরু হয়।

পাতা: ১৬২


pic-57


পাতা: ১৬৩


নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংকটের কারণে অতিরিক্ত পলি জমে স্লুইস গেট অকার্যকর হওয়ায় ভাটিতে চাহিদা অনুযায়ী জল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এছাড়াও খালের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলে সেচের জল সরবরাহ ব্যবস্থাও উপরের কারণে ঠিকমত কাজ করছিল না। ভাটিতে জল সরবরাহ না হবার ফলে স্বাভাবিকভাবে উজানে জলাবদ্ধতা ও বন্যা হবে। এর ফলে ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হবে। নদীর ভাটিতে জল কম বা একেবারে না থাকায় নৌকার যোগাযোগ বিঘিíত হবে। অন্যদিকে উজানে জলাবদ্ধতার ফলে নগর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে. এমনকি ম্যালেরিয়ার মত মহামারীও হতে পারে। এই জলাবদ্ধতা বা বন্যা হবে দীর্ঘমেয়াদী। এইসব সমস্যার সঙ্গে আর একটি ভয়ানক সমস্যা যুক্ত হবে তা হল পলি জমে নদীখাত ভরাট হওয়ায় ঘন ঘন নদীখাত পরিবর্তন।
দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা, বন্যা এবং নদীখাত পরিবর্তন ছাড়াও বন্যার দরুন সর্বত্র পলি পড়ার ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উচ্চতা বৃদ্ধি সভ্যতার জন্য আর এক ভয়ানক সমস্যা সৃষ্টি করেছিল বলে অনুমান করা যায়। এর ফলে নগর, শহর ও গ্রামগুলির উচ্চতাই যে শুধু বৃদ্ধি করতে হচ্ছিল তাই নয়, উপরন্তু নদী ও জলাধারগুলির বাঁধের উচ্চতাও বৃদ্ধি করতে হচ্ছিল। মহেঞ্জোদাড়ো নগরে পলি সঞ্চয়ের ফলে ক্রমাগতভাবে নগরের উচ্চতা বৃদ্ধি করতে হয়েছে। কোথায়ও প্রাথমিক বা সর্বনিম্ন স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নগরের উচ্চতা ৭৪ ফুট পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সব জায়গায় অবস্থা এমন না হলেও পলি সঞ্চয়ের চিহ্ন ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে পাওয়া যায়।
এখন আমরা অনুমান করতে পারি মহেঞ্জোদাড়োতে কেন পাঁচ বা ততোধিকবার বন্যা হয়েছিল, যেগুলোর প্রতিটার স্থায়িত্বকাল মোটামুটি ৫০ বৎসর ছিল। সম্ভবত সিন্ধু নদী বড় বলে তার উপর নির্মাণ করা বাঁধও ছিল খুবই সংবেদনশীল, যার ফলে এখানে মোটামুটি ৫০/৬০ বৎসর বাঁধ কার্যকর থাকার পর সিন্ধু নদীর অতিরিক্ত পলি জমে বাঁধের স্লুইস গেট অকার্যকর হতে পারে, ফলে শুরু হয় উজানে দীর্ঘমেয়াদী বন্যা ও জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতার এই পর্যায়টি মোটামুটি ৫০ বৎসর থাকার পর নগর জীবন যখন একেবারেই অচল হয়ে পড়তে থাকে তখন মহেঞ্জোদাড়ো ও আশপাশের অধিবাসীরা মিলে বাঁধটি পুনর্নির্মাণ ও নূতন স্লুইস গেট তৈরী করে, ফলে আবার প্রায় ৫০/৬০ বৎসর বন্যার অনুপস্থিতি দেখা যায়। এভাবে মহেঞ্জোদাড়োতে জলাবদ্ধতা ও জলাবদ্ধতামুক্ত অবস্থার চক্রটি কমপক্ষে ১০০ বৎসর ছিল এবং এভাবে কমপক্ষে পাঁচটি চক্রের উপস্থিতি সেখানে দেখা গেছে।
কেনেথ কেনেডি হরপ্পান সভ্যতার যুগে বিভিন্ন নগরে পাওয়া ৩৫০টি নরকংকালের উপর গবেষণা চালান। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, হরপ্পান পর্যায়ের কংকালে ম্যালেরিয়া জাতীয় অসুখের সাক্ষ্য রয়েছে। এ কারণে তিনি মনে করেন যে, হরপ্পান পর্যায়ে জলাবদ্ধতা হল ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশার উৎপত্তির কারণ। কেনেডির এই গবেষণা মহেঞ্জোদাড়োর দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা, আমরি ও কোট দিজিতে হরপ্পান পর্যায়ে বন্যা এবং সিন্ধু ও শতদ্রু নদীর উপরের অংশে হন্সদের উপস্থিতির সপক্ষে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যকে আরও জোরালো করছে।
_________________________________________________________________________________
কেনেডি লিখছেন ‘.......... Our research indicates the presence of porotic hyperostosis of the frontal and parietal bones in the Harappan Skeletal series, certainly one indication that the Harappan population possessed an adoptive polymorphism with the capacity to act as a malarial prophylaxis. It would be unwarranted to suggest that malaria or genetic pathologies were fundamental causes for the Harappan decline ......’
Kenneth A.R. Kennedy, ‘Skulls, Arayns and Flowing Drains : The Interface of Archaeology and Skleletal Biology in the Study of the Harappan Civilization.’ Harappan Civilization : A Contemporary Perspective, (1982).
_________________________________________________________________________________


পাতা: ১৬৪


pic-58
পাতা: ১৬৫



পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে সিন্ধু-সরস্বতীর মত বড় বড় নদীতে বাঁধ দেবার পর বিপুল ফসল উৎপাদনের ফলে সভ্যতার শক্তি যেমন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমন শুরুতেই এই নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সুপ্ত বিপদ রয়ে গেল। প্রকৃতপক্ষে নদীর জলপ্রবাহকে রুদ্ধ করা সব যুগেই বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই যা হবার তাই হল। সম্ভবত ৫০০ বৎসর পর থেকে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে। নদীর শুকিয়ে যাওয়া কিংবা গতি পরিবর্তনের ফলে জলাভাবে মানুষ ফসল উৎপাদন করতে পারছিল না। নগর, শহর ও গ্রামগুলোতে পর্যাপ্ত জল সরবরাহ করতে না পারায় জন-জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছিল। অন্যদিকে উজানে দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা দেখা দিল, যার জন্য উজানের মানুষ দীর্ঘমেয়াদী কষ্টে পড়ল। সব জায়গায় এ ধরনের সমস্যা না হলেও বেশীর ভাগ অঞ্চলই জলাভাব বা বন্যার মত তীব্র সমস্যার মুখোমুখি হল। এছাড়াও ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ফসলের উৎপাদন কমে যেতে থাকল। এভাবে সভ্যতার ভিতরে ক্ষয় দেখা দিল আনুমানিক ২১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে।
বস্তুত এই যে ২১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ক্ষয়ের কথা বলা হয়েছে সেই সময়কে যদি আমরা সরস্বতী নদীর শুকিয়ে যাবার সময়ের সঙ্গে মেলাতে পারি এবং সেই এলাকা যদি সরস্বতী নদী উপত্যকায় অবস্থিত হয় তবে বৈদিক আন্দোলনের উদ্ভব বা শুরুর স্থান এবং মোটামুটি সময়টাও অনুমান করা আমাদের জন্য অসম্ভব হবে না। আর এ ক্ষেত্রে শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদী উপত্যকার উত্তর দিকের পাকিস্তানভুক্ত একটি মরু এলাকা যেটি চোলিস্তান নামে পরিচিত তার উপর রফিক মুঘল ব্যাপক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন সেটি আমাদের জন্য অমূল্য গুরুত্ব বহন করে। রফিক মুঘলের বক্তব্যের অসামান্য গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা এখানে তা থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করছি :

পাতা: ১৬৬

 

 ‘চোলিস্তানে ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে একটি বড় ধরনের জলতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে যেটিকে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে চিহ্নিত করা যায়। এই পরিবর্তনের ফলে আদি হরপ্পান (কোটদিজিয়ান এবং সোথি সম্পর্কিত) বসতিগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে নূতন জায়গায় পুনর্বসতি করতে হয়। মনে হয় নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে অধিবাসীদের জীবিকার ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং এই অবস্থায় তারা তাদের বসবাসের এলাকা এবং কৃষি জমি পুরোপুরিভাবে না হলেও আংশিকভাবে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অথবা প্রশাসনিক পর্যায়ে যেমন পুনর্বিন্যাস ঘটেছে তেমন অর্থনৈতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণও এক গোষ্ঠী থেকে আর এক গোষ্ঠীর হাতে গেছে।

.................. .................. .................. .................. ................

‘আর একটি বড় ধরনের জলতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটে ২১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে, যখন সুতলেজ নদী থেকে একটি খাত ধরে আসা জলপ্রবাহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। পুনরায় হাকরার জনবসতির বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটে। হাকরা এবং তার উপনদীসমূহ দ্বারা বিধৌত এলাকায় বিদায়ী হরপ্পান (সেমিট্রি এইচ সম্পর্কিত) পর্যায়ের আবিষ্কারসমূহের সঙ্গে এই পরিবর্তন মিলে যাচ্ছে। এই এলাকার অর্থনীতি এবং সমাজ-সংগঠনের বিপর্যয়ের জন্য বিভিন্ন লেখক বহিরাক্রমণ, মওসুমী অথবা অস্বাভাবিক বন্যা, ভূ-সম্পদের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করেছেন। কিন্তু এইগুলির চেয়ে অনেক বেশী বিপর্যয়কর ছিল নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং পরিণতিতে জলপ্রবাহ একেবারে কমে যাওয়া অথবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। এটা স্পষ্ট যে, চোলিস্তানে সিন্ধু সভ্যতার অবক্ষয় এবং পরিণতি স্বরূপ বিলুপ্তিকে সরাসরিভাবে নদী-পরিবর্তনগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।
রফিক মুঘলের এই মূল্যায়ন আমাদেরকে সিন্ধু সভ্যতার পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের উদ্ভব ও সমাপ্তির সূত্র খুঁজে পেতে বিরাটভাবে সাহায্য করে। তিনি হাকরা (সরস্বতীর উত্তর দিকের একাংশ) নদী-উপত্যকায় নদীর স্রোতধারায় পরিবর্তনের ফলে জনবসতির বিন্যাসে পর পর দুইটি বড় ধরনের পরিবর্তনের কথা বলেছেন। প্রথমটি ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এই সময় থেকে তাঁর মতে পরিণত হরপ্পান পর্যায় অর্থাৎ সিন্ধুর উন্নত নগর সভ্যতার শুরু। সরস্বতী নদীর দ্বিতীয় পরিবর্তন ঘটে ২১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে। এই সময় সরস্বতী নদীস্রোত লক্ষণীয়ভাবে কমে

_________________________________________________________________________________
M. Rafique Mughal, ‘The Consequences of River Changes for the Harappan Settlements in Cholistan.’ In, The Eastern Anthropologist, Vol. 45(1&2), (1992), pp.108-109
মুঘল পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শুরু ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ হিসাবে উল্লেখ করলেও এর ২৫৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পিছিয়ে যাবার জোরালো সম্ভাব্যতার কথা উল্লেখ করেন। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন যে, মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, কালিবঙ্গান পর্যায় ২, বালাকোট, নৌশারো, আল্লাহদিনো এবং শোরতুগাই-এর পরিণত হরপ্পান স্তর থেকে প্রাপ্ত কার্বন-১৪ পরীক্ষায় এই সময় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে হবার পরিষ্কার ঝোঁক দেখা যায়। তাঁর যুক্তিতে কেন্দ্রীয় এলাকায় হরপ্পান সভ্যতাকে যেহেতু ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে পুরোপরি পরিণত পর্যায়ে দেখা যায়, তাই ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শুরু হিসাবে গ্রহণযোগ্য। দেখুন: M. Rafique Mughal, ‘Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley.’ 1971-90. South Asian Studies 6, (1990), pp.195-197. অন্যদিকে কেনোয়ারও হরপ্পান সভ্যতা শুরুর সময় হিসাবে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ উল্লেখ করেছেন। দেখুন : J. M. Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization. (1998), p. 16.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৬৭


যায় এবং দেখা যাচ্ছে যে, হরপ্পান সভ্যতার মূল এলাকায় ক্ষয় শুরুও হয়েছে এই সময়। ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে সরস্বতী একটি মৃত নদী। এর পর সুদীর্ঘ কাল তা শুধু স্মৃতিতে ছিল। সাম্প্রতিক কালে সরস্বতী নদীখাত আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত তার অবস্থান এবং গতিপথ নিয়ে সংশয় এবং বিতর্ক ছিল। সাম্প্রতিক কালের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে এতদিনের ধারণায় বিরাট পরিবর্তন আনছে। এখন দেখা যাচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার জনবসতির বেশী কেন্দ্রীভবন ঘটেছে সরস্বতী উপত্যকায় অর্থাৎ সরস্বতী নদী এবং তার উপনদী ও শাখাসমূহের তীর বরাবর। কোন কোন লেখক এখন বলছেন যে, সিন্ধু নদী উপত্যকা নয়, বরং সরস্বতী নদী উপত্যকা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার মূলভূমি। এই ধারণার পক্ষে সবচেয়ে বড় সাক্ষ্য পাই আমরা ঋগ্বেদ থেকে। সরস্বতীর মত বিশেষণ আর কোন নদী এমনকি সিন্ধুকেও দেওয়া হয় নি। সরস্বতীকে বলা হয়েছে ‘পবিত্রা, অন্নযুক্তযজ্ঞবিশিষ্টা ও যজ্ঞফলরূপধনদাত্রী সরস্বতী’ (১/৩/১০), ‘শুচি’ (১/১৪২/৯), ‘নদীগণের মধ্যে শুদ্ধা’ (৭/৯৫/২)। বোঝা যায় পরবর্তী কালে হিন্দুদের নিকট গঙ্গার যে পবিত্র স্থান বৈদিক সমাজের নিকটও সরস্বতীর সেই স্থান ছিল। যেহেতু বৈদিক সমাজ বৃহত্তর আর্য তথা সিন্ধু সমাজের অংশ মাত্র সেহেতু একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বৃহত্তর আর্য তথা সিন্ধু সমাজেও সরস্বতী নদীর এই মর্যাদা ছিল। সভ্যতা নির্মাণে নদীর যে বিরাট ভূমিকা তার কারণে নদীর উপর এই পবিত্রতা আরোপ। গঙ্গা উপত্যকা ছিল পরবর্তী কালের প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার মূলভূমি এবং পাটলিপুত্রের মত এই সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র বা রাজধানী নগরও গড়ে উঠেছিল গঙ্গা নদীর তীরে। ফলে এই সভ্যতার ধারায় গড়ে ওঠা হিন্দু সমাজে গঙ্গা নদী সবচেয়ে পবিত্র এবং শ্রেষ্ঠ নদী।
আমাদের অনুমান সরস্বতী অঞ্চলে যে জনগোষ্ঠী বাস করত তাদের নেতৃত্বে এবং সেই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বর্তমানে হরপ্পান সভ্যতা নামে পরিচিত সিন্ধু সভ্যতার মূলধারা গড়ে ওঠে। এখন পর্যন্ত পাওয়া মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, রাখিগাড়ি এবং গানেরিওয়ালা এই চারটি বৃহৎ নগরের কোনটি হরপ্পান রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। এগুলি আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক রাজধানী হতে পারে। ধোলাভিরাকে বৃহৎ নগর হিসাবে ধরা যায় না। তবে ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীর উচ্চ মর্যাদা থেকে আমরা অনুমান করি যে, হরপ্পান রাষ্ট্রের রাজধানী কিংবা সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র ছিল মূল সরস্বতী নদী তীরে।
সরস্বতী নদী উপত্যকা থেকে যে বৈদিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সেই বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়। কারণ যে জলাভাব এবং মরুকরণের জন্য বৃত্রের বিরুদ্ধে

_________________________________________________________________________________
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘The Consequences of River Changes for the Harappan Settlements in Cholistan.’ The Eastern Anthrpologist, Vol. 45(1&2), (1992).
অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত ক্যাম্বে উপসাগরে নিমজ্জিত নগরটি এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সর্ববৃহৎ নগর। এখানকার স্থাপত্য কাঠামোগুলোও বৃহৎ। এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীকে অনেক পণ্ডিত সরস্বতী বলে মনে করেন। এটি আমাদের অনুমিত রাজধানী হওয়া অসম্ভব নয়।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৬৮


ঋগ্বেদের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ সেই ঘটনা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ঘটেছে সরস্বতী উপত্যকার বৃহৎ অঞ্চলে এবং আমরা বর্তমানে এই প্রায় সমগ্র অঞ্চলকে মরুভূমি হিসাবে দেখতে পাই। অন্যদিকে যে কোন নদীর তুলনায় সরস্বতীর উচ্চ মর্যাদা এই নদীর সঙ্গে বৈদিক আন্দোলনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক নিশ্চিত করে।
কিন্তু এই নদী তীরে যে হরপ্পান রাষ্ট্রের রাজধানী কিংবা সিন্ধু সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র ছিল তা আমরা কিভাবে অনুমান করতে পারি? তারও শক্তিশালী ভিত্তি আছে আমাদের হাতে। সেটি হচ্ছে ঋগ্বেদ।
এটা একটা অতি বিস্ময়কর ঘটনা যে, ঋগ্বেদ সপ্তসিন্ধুর বিশাল অঞ্চলব্যাপী গৃহযুদ্ধের বর্ণনা দিচ্ছে, শত্রুর বিরুদ্ধে নিদারুণ ঘৃণা প্রকাশ করছে, নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বা আর্য বলছে, ধার্মিক বা যজ্ঞপরায়ণ বলছে, শত্রুদেরকে দাস, দস্যু, রাক্ষস, যাতুধান, ধর্মহীন, যজ্ঞহীন, ইত্যাদি বলছে, শত্রুদের নগর ভেদ কিংবা ধ্বংসেরও কথা বলছে, শত্রুসেনা ধ্বংসের কথা বলছে, শত্রুসম্পদ লুণ্ঠনের কথা বলছে, কিন্তু আঞ্চলিকতাবাদ এবং আঞ্চলিক বিদ্বেষ কোথায়ও সেভাবে প্রকাশ করে নি। অন্তত ঋগ্বেদের সাধারণ বা মূল সুরে যে আঞ্চলিকতা বা সংকীর্ণ স্থানিকতা নেই সেটা ঋগ্বেদের যে কোন মনোযোগী পাঠক বুঝবেন। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা যে, এত ভয়ানক গৃহযুদ্ধেও কোন বিশেষ অঞ্চলের প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণা প্রকাশ পায় নি। বরং গোটা ঋগ্বেদের মূল সুর হচ্ছে সমগ্র সপ্তসিন্ধুকে ধারণ করা। সুতরাং ঋগ্বেদে বারংবার ভূ-ভাগ বা দেশ হিসাবেও সপ্তসিন্ধুর কথা বলা হয়েছে, বিভিন্ন নদীর নাম বলা হয়েছে, বলা হয়েছে পঞ্চজন, পঞ্চকৃষ্টি, পঞ্চক্ষিতির কথা। পঞ্চজন, পঞ্চকৃষ্টি এবং পঞ্চক্ষিতি সম্পর্কে অনেকের অনুমান যে, এগুলি আর্যদের পাঁচটি জনপদের বিবরণ। কেউ কেউ অবশ্য পঞ্চজনের অর্থ পাঁচ শ্রেণীর মানুষ কিংবা পাঁচ জাতি করেছেন। তবে ঋগ্বেদে যেভাবে বলা হয়েছে তাতে আমাদের অনুমান যে, হরপ্পান রাষ্ট্র মূলত পাঁচটি অঞ্চল বা প্রদেশ অথবা দেশ নিয়ে গঠিত ছিল।
আমরা আগেই বলেছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের চরিত্র ছিল মূলত গণতান্ত্রিক এবং যথেষ্ট পরিমাণে বিকেন্দ্রায়িত। আমাদের আরো অনুমান যে, হরপ্পান রাষ্ট্রের পাঁচটি অঞ্চলের প্রতিনিধিরা একটি কেন্দ্রে একত্র হয়ে যে পরিষদ বা সংসদ গঠন করেছিল তা রাষ্ট্র পরিচালনা করত। সম্ভবত

_________________________________________________________________________________
এ সম্পর্কে ঋগ্বেদ-সংহিতার ১/৮৯/১০ এবং ২/২/১০ ঋকের টীকাতে যে ব্যাখা দেওয়া হয়েছে তাকে সংক্ষেপে এভাবে উপস্থিত করা যায় : কৃষ্ ধাতু অর্থে কর্ষণ করা বা চাষ করা; কৃষ্টি অর্থে চাষ কার্য, অতএব পঞ্চকৃষ্টি অর্থে পাঁচটি কৃষি প্রধান জনপদ বা জাতি। আবার ‘পঞ্চক্ষিতি’ বা ‘পঞ্চকৃষ্টি’ বা ‘পঞ্চজন’ অর্থে পাঞ্জাব প্রদেশ ও পঞ্চনদকূলবাসী সমস্ত আর্য জাতি। দেখুন : ঋগ্বেদ-সংহিতা, প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় প্রকাশ, (১৯৮৭)।
উইলসন তাঁর ঋগ্বেদের ইংরাজী অনুবাদ গ্রন্থে ‘পঞ্চজন’ বা ‘পঞ্চকৃষ্টি’ অর্থ ‘Five classes of men’, ‘Five kindred sacrificing races’, ‘Five order of men,’ ইত্যাদি করেছেন।
দেখুন : Rig-Veda Sanhita, (in seven volumes), translated from the original Sanskrit by H.H. Wilson, (Cosmo Publications, New Delhi, reprited, 1977).
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৬৯


তাকে পঞ্চায়ত বলা হত। হয়ত এই পঞ্চায়ত ব্যবস্থা উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সর্বস্তরে ছিল। অবশ্য এটি এখন পর্যন্ত আমাদের একটি অনুমান মাত্র। তবে ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার যে সুগভীর প্রভাব আজ অবধি ক্রিয়াশীল রয়েছে তাতে করে প্রাক-ব্রিটিশ কাল পর্যন্ত বিদ্যমান গ্রাম পঞ্চায়েতের উৎস সিন্ধু সভ্যতার পঞ্চজনে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়।
যাইহোক, এটি এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়, বরং তা হচ্ছে ঋগ্বেদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সপ্তসিন্ধুর বিশাল ভূ-ভাগ ভিত্তিক সর্বজনীনতা। এই দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী কারা হতে পারে? যারা এই সমগ্র অঞ্চলকে ব্যবহারিক ও মনস্তাত্ত্বিক উভয়ভাবেই ঐতিহাসিক কালক্রমে প্রতিনিধিত্ব করে একমাত্র তারাই পারে। অর্থাৎ বৈদিক পক্ষ সিন্ধু সভ্যতার কোন প্রান্ত থেকে আসা শক্তি নয়, বরং কেন্দ্র থেকে আসা শক্তি। অর্থাৎ এ বিষয়টি আমাদের নিকট স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতা এবং কথিত হরপ্পান রাষ্ট্র যারা গড়ে তুলেছিল তাদের প্রত্যক্ষ উত্তরসূরিদের মধ্যেই বিবাদ বা বিভক্তি ঘটেছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে।
ঋগ্বেদে সরস্বতী নদীর সর্বোচ্চ মর্যাদা, সরস্বতী উপত্যকায় আদি ও পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে জনবসতির কেন্দ্রীভবনের ক্রমবর্ধমান প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য, পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শেষ দিকে সরস্বতীর শুকিয়ে যেতে থাকা এবং বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে তার প্রায় বিলুপ্তি, ঋগ্বেদে নদীরোধ ও জলাভাবের জন্য বৃত্রকে দায়ী করা এবং নদী মুক্ত করতে চাওয়ার জন্য তাকে বধ করতে চাওয়া এবং সর্বোপরি ঋগ্বেদের মধ্যে বৃহত্তর সপ্তসিন্ধু চেতনা এবং সেই সঙ্গে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতার অস্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পেলেও সামগ্রিকভাবে তার বিস্ময়কর অভাব আমাদেরকে উপরোক্ত সিদ্ধান্তের দিকে যেতে বাধ্য করে।
এখন আমরা অনুমান করতে পারি যে, পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শেষ দিকে যখন সরস্বতী নদীর প্রবাহ হ্রাস পায়, ঘন ঘন তার গতিপথ পরিবর্তিত হতে থাকে এবং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অকার্যকরতার ফলে বিভিন্ন এলাকায় শাখা নদী এবং খালগুলোর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করা যাচ্ছিল না তখন সমগ্র উপত্যকা জুড়ে ব্যাপক গণঅসন্তোষ দেখা দেয়। সম্ভবত সিন্ধু সহ অন্যান্য নদী-উপনদীতেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সিন্ধু উপত্যকার উত্তরে যে সমস্যাই থাক দক্ষিণে মহেঞ্জোদাড়ো সহ সমগ্র অঞ্চলের জন্য প্রধান সমস্যা বন্যা এবং জলাবদ্ধতা, যে বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। সুতরাং সেখানে জলাবদ্ধতার জন্য কষ্ট হলেও মানুষের বেঁচে থাকার পথ ছিল। কারণ যেখানে জলাবদ্ধতা ছিল না সেখানে জলমগ্ন এলাকা থেকে জল নিয়ে চাষ করা যেত বলে মানুষকে অন্তত খাইয়ে বাঁচানো যেত।
কিন্তু সরস্বতী উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জন্য অবস্থাটা হয়েছিল ভিন্ন রকম। বিশেষ করে যমুনা নদী পশ্চিম দিক থেকে গতিপথ পরিবর্তন করে পূর্বে গঙ্গায় গিয়ে পড়ার পর এবং শতদ্রুও সরস্বতীতে না পড়ে দিক পরিবর্তন করে সিন্ধু নদীতে পড়ায় সরস্বতী তখন মরণদশায় উপনীত। সেই সঙ্গে সেই অঞ্চলের সমগ্র সভ্যতাও। এই অবস্থায় সরস্বতী অঞ্চল থেকে বিভিন্ন দিকে অভিগমন শুরু হয়েছে। কিন্তু অনেকে দূরে যাবার উপায় না

পাতা: ১৭০


পেয়ে আশপাশে বসতি করে বাঁচার চেষ্টা করেছে। স্বাভাবিকভাবে এই অবস্থার জন্য যদি কোন ভূ-তাত্ত্বিক কারণও দায়ী হয়ে থাকে তবু দায়ী করা হবে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকেই।
বস্তুত বাঁধের ফলে শুধু সরস্বতী নয় সব নদীর শৃঙ্খলা বা স্বচ্ছন্দ গতিধারা যে এক সময় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ঋগ্বেদ সে কথাও বলে : ‘যখন ধেনুগণ বৎস হতে বিযুক্ত হয়েছিল, তখন তারা ইতস্তত গমন করেছিল। কিন্তু যখন যথাবিধি প্রদত্ত সোমরস ইন্দ্রকে প্রীত করেছিল তখন তিনি বলবান মরুৎ সকলের সাথে ধেনুগণকে পুনর্বার বৎসের সাথে যোজিত করেছিলেন।’ (৫/৩০/১০)
৫/৩০ সূক্তের অন্যান্য ঋকে বৃত্রবধ এবং নদী মুক্তির বর্ণনার সঙ্গে এই ঋক সন্নিবেশিত করায় এর অর্থ বোঝা কঠিন নয়। বাঁধ দেবার ফলে পলি জমে এক সময় যে নদীগুলোর গতিপথ এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল হয়েছিল উপরোক্ত ঋকটি উপমা দিয়ে সে কথা জানায়। বাঁধ দেবার ফলে মূল নদীর সঙ্গে উপ বা শাখা নদীগুলোর বিযুক্তি ঘটেছিল। মরুৎগণের অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে ইন্দ্রের অনুসারীরা যে বাঁধ ধ্বংস করে নদীগুলোর সুশৃঙ্খল গতিধারা পুন:প্রবর্তন করেছিল পরবর্তী বাক্য থেকে আমরা সে কথা বুঝতে পারি।
যাইহোক, আমরা অনুমান করতে পারি যে, সরস্বতী নদী তীরে বা তার সন্নিহিত এলাকায় অবস্থিত রাজধানীকে আর টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। এই অবস্থায় রাজধানীও পরিত্যাগ করতে হয়েছে। আমরা পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শেষ দিকে হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদাড়ো নগরের উপর মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের চিহ্ন দেখতে পাই। নগর দু’টি ঘিঞ্জি হয়ে পড়েছিল, বাড়ী-ঘর এলোমেলো হয়ে রাস্তার উপর আসছিল যা নগরপিতাদের নিয়ন্ত্রণ এবং নগর ব্যবস্থাপনা যে ভেঙ্গে পড়ছিল সে কথাও জানায়। এখন আমরা অনুমান করতে পারি সরস্বতী উপত্যকার জনসংখ্যা যেমন বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছিল তেমন এই দুই নগরেও তাদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল। বিশেষ করে রাজধানীর নাগরিকদের একাংশ মহেঞ্জোদাড়োকে রাজধানী হিসাবে বেছে নিয়ে সেখানে অভিগমন করতে পারে।
মহেঞ্জোদাড়োতে রাজধানী স্থানান্তরের অনুমানের সপক্ষে দু’টি যুক্তি পাওয়া যায়। একটি হল এ পর্যন্ত প্রাপ্ত নগরগুলির মধ্যে ক্যাম্বে উপসাগরে প্রাপ্ত নগর ছাড়া সেটি সবচেয়ে বড়। অপরটি হল সদ্য আবিষ্কৃত এই নগর ছাড়া শুধু মহেঞ্জোদাড়োতেই চৌবাচ্চা বা ‘গ্রেট বাথ’ পাওয়া গেছে। এতে সন্দেহ নেই যে, এটি নদী এবং জল নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা সম্ভূত ধর্মাচারের জন্য নির্মিত। গ্রেট বাথ হয়ত শুধু রাজধানীতেই ছিল। হয়ত এটি মহেঞ্জোদাড়োয় পরবর্তী পর্যায়ে নির্মিত। আমরা যেহেতু এর স্তর সম্পর্কে জানি না সেই জন্য এর নির্মাণের সময় সম্পর্কে ধারণা করতে পারব না। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সেটা বলতে পারা উচিত।
যাইহোক, আমাদের অনুমিত রাজধানী স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় শাসকদেরই একটা অংশ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কারণ এটা সহজবোধ্য যে, পুরাতন রাজধানী কিংবা সভ্যতা কেন্দ্রের পতন মানে পুরাতন শাসক শ্রেণীরও অনেকের পতন। নূতন জায়গায় সভ্যতা কেন্দ্র স্থানান্তরকরণের সঙ্গে পুরাতন পৃথিবীর অনেক কিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। হয়ত শাসকদের

পাতা: ১৭১


প্রধান বা এক বৃহৎ অংশ নূতন কেন্দ্রে সরে গেছে। কিন্তু সবাই তা যেতে পারে নি বা যায় নি। অনুমান করা যায় শাসক শ্রেণীর এই ক্ষুব্ধ অংশ জলবঞ্চিত অঞ্চলের ব্যাপক জনগণের অসন্তোষের প্রতিফলন ঘটিয়ে বিদ্রোহ করে। কিন্তু যেহেতু নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ছিল ধর্মের অংশ সেহেতু তাকে ভাঙ্গতে হলে ধর্মসংস্কারের প্রয়োজন ছিল। সুতরাং বৈদিক সংস্কার ঘটানো হয়। আমরা অনুমান করতে পারি যে, অঙ্গিরাগণ এমন একটি অবস্থায় সরস্বতী উপত্যকায় প্রথম কোন একটি বাঁধ ভাঙ্গেন একটি প্রাথমিক ধর্মসংস্কারের মাধ্যমে। আমরা ইতিপূর্বে এটিকে একটি প্রথম সফল প্রয়াস বলেছিলাম। এটা যে অন্তত উল্লেখযোগ্য প্রথম ধর্ম সংস্কার প্রয়াস এবং প্রথম বিদ্রোহ তার সপক্ষে আমরা আরও কিছু যুক্তি খুঁজে পাই ঋগ্বেদ থেকে। এটা লক্ষণীয় যে, অঙ্গিরাগণের সঙ্গে বৃত্রবধের সম্পর্ক নেই। তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত ইন্দ্র, অগ্নি, বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি ইত্যাদি দেবতা ধ্বংস করেছেন পর্বত বা বলকে। বিশেষ করে গো-অবরোধকারী হিসাবে বলকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। পণিদের প্রসঙ্গও এই উপাখ্যানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
বোঝা যায় যে, বল হচ্ছে বাঁধ বা ব্যারেজ। পর্বতও বাঁধ। আমরা দেখি যে, ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি দেবতাকেও অনেক সময় বলের পুত্র বলা হয়েছে। তার মানে বল সম্মান সূচক পরিচয় বা সম্বোধন। সম্ভবত এটা শক্তিশালী বা মহান বোঝাতে প্রয়োগ হত। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত অঙ্গিরাগণ বিশ্বরূপের মর্যাদাকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে তাকে বৃত্র বা অহির মত ঘৃণ্য শব্দ দ্বারা অভিহিত করতে পারেন নি। একইভাবে অঙ্গিরা উপাখ্যানের গো-অবরোধের নায়কদেরকে পণি বলা হয়েছে। পণি যে দাস-দস্যু-রাক্ষসের মত ঘৃণিত শব্দ নয় সেটা স্পষ্ট। হয়ত এর অর্থ বণিক বা ধনিক ছিল। অথবা হয়ত বাঁধের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনা যাদের হাতে ছিল তাদেরকে এই নাম দেওয়া হত। অথবা হয়ত এটা গো-এর মত দ্ব্যর্থক বা বহু অর্থবাচক কোন শব্দ।
অর্থাৎ অঙ্গিরাগণের ধর্মসংস্কার ও বিদ্রোহ ঋগ্বেদ রচনাকালীন বৈদিক আন্দোলনের পূর্বকালীন। বাঁধ ধ্বংসের ফলে উজানে সঞ্চিত জলস্রোত দক্ষিণে প্রবাহিত হবার সুযোগ পায়। এই দৃষ্টান্ত অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করে। তবে সরস্বতী নদী যদি তখন মরণোন্মুখ অবস্থায় উপস্থিত হয়ে থাকে তবে উজানের সঞ্চিত জলরাশি ভাটির দিকে বয়ে গেলে জলপ্রবাহ পুনরায় কমে যাবে। তখন মনে করা হবে আরো উত্তরের বাঁধ ভাঙ্গলে ঠিক হবে। সেই সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে নদী খাতগুলো পুনর্খননের পদক্ষেপও থাকতে পারে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, সমগ্র সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের সকল উল্লেখযোগ্য নদী তখন বহুসংখ্যক ব্যারেজ বা বাঁধে বাঁধা পড়েছিল। ঋগ্বেদের বর্ণনা থেকে একদিকে নদীর মাঝখানে স্লুইস গেট যুক্ত ব্যারেজ, অপর দিকে দুই তীর বরাবর বাঁধ এবং মাঝে মাঝে সুবিশাল বাঁধ ঘেরা বিরাট বিরাট জলাধার -- এমন এক সপ্তসিন্ধু ভূ-ভাগের চিত্র আমাদের মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তখন স্বাভাবিক নিয়মে মরণদশায় উপনীত। ফলে সমস্যা বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে দেখা দিয়েছে। কোথাও জলাবদ্ধতা, আবার কোথাও জল সরবরাহ একেবারেই না থাকায় মরুকরণ। বর্ষাকালে বন্যা আবার গ্রীষ্মে খরা। এলাকায় এলাকায় জলের ভাগ নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ছে।

পাতা: ১৭২


বালুচিস্তানের দক্ষিণে মাকরান উপকূলে সমুদ্র তীর বরাবর বাঁধের মত উঁচু হয়ে যে ভূমি গেছে সেটা মানুষ নির্মিত বাঁধ হওয়া সম্ভব। যদি তাই হয় তবে আমরা সিন্ধু নদীর জলপ্রবাহের একাংশকে সমুদ্রে যেতে না দিয়ে সেখানে চালিত করে বিশাল জলাধার বা হ্রদ সৃষ্টির কথা ভাবতে পারি। ভূ-তাত্ত্বিকগণ ভাল বলতে পারবেন ঐ অঞ্চলে ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতার ধরন সেখানে এভাবে সিন্ধু নদী থেকে জলপ্রবাহ নিয়ে যাওয়াকে সম্ভব করতে পারত কিনা। সেটা সম্ভব হলে তার সাহায্যে দক্ষিণ বালুচিস্তান ও মাকরানের বিস্তৃত মরু অঞ্চলে কৃষি গড়ে তোলা সম্ভব হতে পারত। কিন্তু এর ফলে সরস্বতী উপত্যকার মত বিভিন্ন জলবঞ্চিত অঞ্চলে ক্ষোভ জন্মাতে পারত। ঋগ্বেদে কিন্তু আমরা এমন একটা বক্তব্য পাই যেখানে দূর মরুপ্রদেশে জল নিয়ে সেখানকার প্রয়োজন পূরণের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে :

‘১। হে ইন্দ্র! তুমি মহান। পৃথিবী মহত্ত্বযুক্ত হয়ে তোমার বল অনুমোদন করেছেন, দ্যুলোকও তোমার বল অনুমোদন করেছেন। তুমি বল দ্বারা বৃত্রকে বধ করেছ। অহি যে সকল নদীকে গ্রাস করেছিল, তুমি তাদের মুক্ত করেছ। ২। তুমি দীপ্তিমান, তোমার জন্মের পর দ্যুলোক তোমার কোপভয়ে কম্পিত হয়েছিল, পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল, ঐ বৃহৎ মেঘসমূহ আবদ্ধ হয়েছিল। ঐ মেঘসমূহ প্রাণীগণের পিপাসা বিনাশ করেছিল এবং মরুপ্রদেশে জল প্রেরণ করেছিল।’ (৪ মণ্ডল, ১৭ সূক্ত)
প্রথম ঋকটি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও অহি বা বৃত্র কর্তৃক নদী অবরোধ এবং তা ধ্বংস করে নদীমুক্তির কথা এভাবে স্পষ্ট করে বলার জন্য আমরা এটিকে উদ্ধৃত করলাম। আর দ্বিতীয় ঋকটি থেকে আমরা জানছি ঐ মেঘ বা বাঁধগুলো কিভাবে মরুপ্রদেশে জল প্রেরণ করেছিল। নিম্নের ঋক দু’টিতে আমরা গাভীগণ তথা নদী স্রোত থেকে এলাকার জনগণকে বঞ্চিত বা বিচ্ছিন্ন করার জন্য ঋষিকে তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখছি:
‘৫। কে আমাদের লোকসমূহকে গাভীগণের সাথে বিযুক্ত করেছে? তাদের কি রক্ষক ছিল না ? যারা আমাদের লোকসমূহকে আক্রমণ করেছে তারা বিনষ্ট হোক।.......

_________________________________________________________________________________
বরার্ট রেইক্স তাঁর লেখায় ভূ-পৃষ্ঠের এই উচ্চতা বৃদ্ধি বালুচিস্তানের নিনদোওয়ারীতে হরপ্পান পর্যায়ে ঘটেছিল বলে উল্লেখ করেছেন। জল সরবরাহের উৎস থেকে নিনদোওয়ারীর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সাথে তার পরিত্যক্ত হওয়ার ঘটনাটিকে তিনি মাকরান উপকূলের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত করেছেন। তিনি মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংস ও বালুচিস্তানের পাহাড়ী এলাকায় কৃষিভিত্তিক বসতিগুলোর আকস্মিক সমাপ্তির সাথেও এই ঘটনার সম্পর্ক দেখিয়েছেন। দেখুন : Robert L, Raikes, ‘The End of the Ancient Cities of the Indus’. Ancient Cities of the Indus, (1979), pp. 303-304.
তাঁর যুক্তির গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে সন্দেহ থাকায় আমরা এই সম্ভাবনা দেখি যে মানুষ কর্তৃক নির্মিত উপকূলব্যাপী দীর্ঘ বাঁধের সাহায্যে বালুচিস্তানের পাহাড়ী এলাকায় কৃষিতে সেচের জন্য জল নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী কালে সামাজিক-রাজনৈতিক চাপে এখানে জলপ্রবাহ অব্যাহত রাখা যায় নি, ফলে নিনদোওয়ারী সহ অন্যান্য কৃষি নির্ভরশীল বসতি থেকে মানুষ চলে যায়।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৭৩


১১। হে বহুভাব প্রাপ্ত অগ্নি! আমি তোমার স্তোতা। ধীর কর্মকুশল ব্যক্তি যেরূপ রথ নির্মাণ করে, সেরূপ আমি তোমার জন্য এ স্তোত্র নির্মাণ করেছি। হে অগ্নিদেব! যদি তুমি এ গ্রহণ কর তাহলে আমরা বহুব্যাপ্ত জল লাভ করব।’ (৫ মণ্ডল, ২ সূক্ত)
সুতরাং জলের ভাগ নিয়ে, জল কোথায় পাঠান হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। এখানে এই বিষয়টা আমাদের মনে রাখা দরকার যে, যমুনা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এমনিতেই সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে জলপ্রবাহ কমে গেছে। সুতরাং নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিভিন্ন ধরনের বিপর্যয় ও ব্যর্থতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলাভাবের তীব্রতা বৃদ্ধি। কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, ঐ সময়ে পৃথিবীর এক বৃহৎ অংশে জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে এক দীর্ঘকাল স্থায়ী খরা দেখা দেয়। তাঁদের মতে এটা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের প্রধান কারণ। যাইহোক, যদি ঐ সময় জলবায়ুগত বিপর্যয় ঘটেও থাকে তবু আমরা সেটাকে সিন্ধু সভ্যতার বিপর্যয়ের প্রধান কারণ মনে করি না। এটা ঘটেছে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণে যেটা এক সময় অনিবার্য ছিল। নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংকট ও বিপর্যয়ের ফলে নদী প্রবাহে পরিবর্তন ঘটেছিল। রফিক মুঘল নদী প্রবাহের পরিবর্তনের দিকটিকে সঠিকভাবে দেখেছেন বলে আমরা মনে করি।
যাইহোক, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কয়েকশত বৎসর পর ব্যর্থ হতে কেন বাধ্য ছিল সেটা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। আসলে এটা একালেও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপজ্জনক। এটা আমরা দুই বাংলার অভিজ্ঞতা থেকেও দেখেছি। কিন্তু ফারাক্কা এবং অন্য ব্যারেজগুলো অর্ধশতাব্দীও পার করেছে কিনা সন্দেহ। পাঁচশত বৎসর পর কি হতে পারে? তবু এ কালে না হয় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আছে। তা দিয়ে বিপদের মাত্রা বা ক্ষতির পরিমাণকে হয়ত কমানো যাবে। কিন্তু আজ থেকে সাড়ে চার কিংবা পাঁচ অথবা ততোধিক সহস্র বৎসর পূর্বে যখন মানুষ এমন এক বিশাল এবং অবিশ্বাস্য রকম দু:সাহসী আয়োজন করছিল তখনকার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমাজ সংগঠনের মানের প্রেক্ষিতে আমাদের সমস্যাটাকে বিচার করতে হবে।
আমরা পূর্বেও বলেছি যে শত শত বৎসর ধরে পলি সঞ্চয়ে ভূমি বিন্যাসে পরিবর্তন, নদীখাতে পলি সঞ্চয় থেকে নদীখাত পরিবর্তন ঘটেছে। এক জায়গায় দীর্ঘকাল জল সঞ্চিত হলে লবণাক্ততা দেখা যায়। এই সমস্যা বর্তমান পাঞ্জাব-সিন্ধুর অনেক অঞ্চলে যে হচ্ছে সে কথা আমরা জানি । বৃষ্টির পরিমাণ প্রচুর হলে এই লবণাক্ততা সমুদ্রে ধুয়ে যেতে পারে। কিন্তু সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে কৃত্রিম উপায়ে জলসেচ করলে এবং এক জায়গায় জল সঞ্চিত হতে থাকলে সেখানে কয়েকশত বৎসর পর ভূমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন কমে যাওয়া অনিবার্য। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতায় উপরে বর্ণিত সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছিল।
এছাড়া নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য বিপুল জনশক্তিকে বিশাল অঞ্চলে

_________________________________________________________________________________
Christina Lamb -Gk Waiting for Allah: Pakistan’s Struggle for Democracy, (Viking, 1991)-তে বর্তমানে পাকিস্তানের কৃষির এই সমস্যা বলা হয়েছে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৭৪


নিয়োজিত রাখতে হয়েছে। অবিরাম বাঁধ নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ বা মেরামত এবং খাল-নদী খনন করতে হয়েছে। পলি জমে নদীখাত, জলাধার ভরাট ও উঁচু হওয়ায় বাঁধগুলোকে উঁচু করতে হয়েছে। বিশেষ করে যেখানে যেখানে ব্যারেজ এবং স্লুইস গেট ছিল সেখানে সেখানে সেগুলির পিছনে বিপুল অর্থ-সম্পদ এবং শ্রম ব্যয় করতে হয়েছে। পলি সঞ্চয়ের ফলে স্লুইস গেট অচল হয়ে পড়তে পারে। আবার বন্যার সময় জলের চাপে বিকল জলকপাটগুলি সহজে ভেঙ্গে যেতে পারে। তখন সেগুলি মেরামত অথবা নূতন করে তৈরী করার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাছাড়া ক্রমাগত পলি সঞ্চয়ের ফলে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বার বার উঁচু তথা পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে নগর, শহর ও গ্রামগুলিকে। সুতরাং এটা অনুমেয় যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যা কিনা সিন্ধু সভ্যতার এমন বিশাল ও চমকপ্রদ উথানের উৎস তাই আবার এক সময় সবদিক থেকে তার সমস্ত শক্তি নিংড়ে নিয়ে তাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।
যাইহোক, ঋগ্বেদ এবং প্রত্নতত্ত্ব উভয়ের সাক্ষ্য থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, সংকট শুরু হয়েছিল সভ্যতার মূলভূমি সরস্বতী উপত্যকায় যে কথা আমরা একটু আগে বলেছি এবং আমরা আমাদের এই অনুমানের কথা বলেছি যে, সেখানে ছিল রাষ্ট্রের রাজধানী অথবা সভ্যতার প্রধান কেন্দ্র। আমরা এও বলেছি যে, রাজধানী এবং অঞ্চলের সংকট কালে একদিকে রাজধানী যেমন পরিত্যক্ত হয়েছে অপরদিকে তেমন শাসক শ্রেণীর ভিতর বিভক্তি ঘটেছে এবং একটা অংশ সনাতন ব্যবস্থা অর্থাৎ নদী নিয়ন্ত্রণ এবং ধর্ম উভয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। অবশ্য নদী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্রোহ যেমন প্রত্যক্ষ এবং সর্বাত্মক ধর্মের বিরুদ্ধে সেটা তেমন ছিল না। কারণ সেটা সম্ভব ছিল না। এই ধর্মের ঐতিহ্যকে কিছুটা হলেও অবলম্বন করেই তাদেরকে নদী নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রে তারা ধর্ম সংস্কার করেছে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়ে।


_________________________________________________________________________________
ক্যাম্বে উপসাগরের সমুদ্রগর্ভে অতি সম্প্রতি আবিষ্কৃত নগরটি এই অনুমিত রাজধানী হতে পারে। এই নগর থেকে পাওয়া হরপ্পান লিপিযুক্ত সিল ও অন্যান্য কাঠামো থেকে একে পরিণত হরপ্পান সংস্কৃতির বলে ধারণা করা চলে। অবশ্য ড্রেজিং দ্বারা এখানে তার পূর্ববর্তী আদি হরপ্পান পর্যায়ের নিদর্শনাদিও পাওয়া গেছে। অন্যদিকে এই নগরটি যে কোন হরপ্পান নগর থেকে অনেক বড়। তাছাড়া এখানে পাওয়া গেছে অলিম্পিকের সুইমিংপুল আকৃতির চৌবাচ্চা যা মহেঞ্জোদাড়োর ‘গ্রেট বাথ’-এর চেয়েও অনেক বড়। এই নগরটি যে নদীর ধারে অবস্থিত সেটি সরস্বতী নদীর প্রাচীন খাত হতে পারে যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। তবে এই নগর হরপ্পান সভ্যতার মূল রাজধানী ছিল কিনা সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে নগরটির বয়স সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া দরকার। সমুদ্রতল থেকে প্রাপ্ত একটি মাত্র কাষ্ঠখণ্ডের পৃথক দুইটি রেডিও কার্বন টেস্ট থেকে যে দুইটি বয়স নির্ণীত হয়েছে (একটিতে বয়স পাওয়া গেছে খ্রী:পূ: ৫,৫০০ এবং অপরটিতে পাওয়া গেছে খ্রী:পৃ: ৭,৫০০) তা যদি সঠিক হয় তবে তার সঙ্গে পরিণত হরপ্পান এমনকি আদি হরপ্পান পর্যায়েরও বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হয়। বিশেষত পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের সঙ্গে তার সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় প্রায় ২,৫০০ কিংবা ৫,৫০০ বৎসর। সময়ের এত বড় ব্যবধান দ্বারা সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক স্থাপন করা সুকঠিন হবে। এবং সেক্ষেত্রে বহু কিছুরই নূতন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে। স্বাভাবিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক পণ্ডিত ও গবেষকদের মধ্যে এর বয়স নিয়ে সন্দেহ ও বিতর্ক দেখা দিয়েছে। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হলেও এই নগরের মর্যাদা ও ভূমিকা সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছবার আগে আরও বিভিন্ন উপকরণের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দ্বারা তার বয়স সম্পর্কে নি:সন্দেহ হতে হবে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৭৫


অঙ্গিরাগণকে আমরা প্রথম সংস্কারক হিসাবে উল্লেখ করেছি। সরস্বতীর সংকট কালে যদি তাদের উথান ঘটে তবে সেটাকে আমরা ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে হবার সম্ভাবনা কিছু বেশী দেখি। কারণ নদীখাতে পরিবর্তন হলেও একটা ধর্ম সংস্কার করতে বেশ কিছু সময় লাগার কথা। খ্রীষ্টপূর্ব ২১০০-এর দিকে সরস্বতীর প্রবাহ দক্ষিণে নীচের দিকে যথেষ্ট কমে যায়। এটা ঠিক যে উজানের বাঁধ ভাঙ্গার ফলে কিছু দিনের জন্য জল প্রবাহ বাড়তে পারে। ওটাকে প্রথম দিকে খুব বড় সাফল্য মনে হতে পারে যা ঋষিদের বিরাট প্রেরণা যুগিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জলপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় হয়ত সেই আনন্দ আর থাকে নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেটা একটা দৃষ্টান্ত হবে এবং এটা মনে হবে যে, একটা বাঁধ ভেঙ্গে লাভ নেই, অন্তত উজানের সব নদীর বাঁধ ভাঙ্গতে হবে। সুতরাং আন্দোলন এগিয়েছে। এবং সংকটটা যেহেতু মূলত একটা অঞ্চল এমনকি শুধু সরস্বতী নদী বিধৌত অঞ্চলের জন্য নয় বরং সমস্ত সভ্যতার জন্য হয়ে দেখা দিয়েছে সেহেতু অঙ্গিরাগণ দৃষ্টান্ত হয়ে গেছেন। তাঁরা তাঁদের অনুসারী হিসাবে পেয়েছেন একদল ধর্মসংস্কারক ঋষি যাঁরা কবিত্ব ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় মন্ত্র রচনা করতে জানতেন। এই কারণে ঋগ্বেদে মন্ত্র রচয়িতা ঋষিদেরকে কবি বলা হয়েছে।
আমাদের এই অনুমানের কথা ইতিপূর্বে বলেছি যে, বাঁধ ভাঙ্গার সাফল্য থাকলেও প্রথম পর্যায়ে বিদ্রোহ ব্যর্থ বা দমিত হয়েছিল। তখন বিদ্রোহের নেতারা ছড়িয়ে গিয়েছিলেন সরস্বতী উপত্যকার অভিগমনকারী বিভিন্ন লোকজনের মত বিভিন্ন দিকে। তাঁরা বিভিন্ন জন বিভিন্ন জায়গায় ধর্ম সংস্কার করেছেন, বিদ্রোহ সংগঠিত করেছেন। এই সমগ্র কর্মকাণ্ডে মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন ঋষিরা। প্রথম পর্যায়ে বিশেষত ইন্দ্রকে সামনে রেখে যারা বিদ্রোহ করে তারা যে একসময় সম্পূর্ণ নি:সঙ্গ বা একা হয়ে গিয়েছিল এটা স্পষ্ট। বহিরাগত যোদ্ধাদের সাহায্য ও সমর্থন নিয়ে তাদেরকে দাঁড়াতে হয়। তাদের আন্দোলন এগিয়ে যাবার সাথে সাথে কৃষক, কারিগর, যোদ্ধা, প্রশাসক থেকে শুরু করে অনেকে ক্রমে ক্রমে এসে যোগ দেয় এবং এটি একটি বিশাল গণআন্দোলন ও যুদ্ধে পরিণত হয়।
তবে এই আন্দোলনের যে কোন নির্দিষ্ট কেন্দ্র ছিল না সেটা স্পষ্ট। সম্ভবত অঙ্গিরাগণ অর্থাৎ অঙ্গিরা গোত্রের পূর্বতন পুরোহিতগণ ছিলেন প্রথম নেতৃত্বকারী গোষ্ঠী যারা একটি কেন্দ্র গঠন করেছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্নভাবে ধর্মসংস্কার আন্দোলন এগিয়েছে। কিন্তু অভিন্ন লক্ষ্য সবার কর্মকাণ্ডে একটা ঐক্যও দিয়েছে। সেটা ঋগ্বেদ থেকে স্পষ্ট। সম্ভবত অঙ্গিরাগণের পর এই আন্দোলন সংহত ও বিকশিত হতে একশত থেকে দেড়শত বৎসর কিংবা ততোধিক সময় লেগেছিল, যে কারণে পরবর্তী ঋষিরা অঙ্গিরার পুত্র সুধন্বা এবং তার পুত্র ঋভুগণ এভাবে বলেন এবং এই ঋভুগণও বৈদিক আন্দোলন অর্থাৎ ঋগ্বেদ রচনার কালে স্মৃতি মাত্র। তাঁরা তখন ত্বষ্টার চমস ভেঙ্গে বৈদিক ধর্ম সংস্কারকে সাহায্য করায় দেবত্ব প্রাপ্ত এবং তাদের স্তুতিতে মন্ত্র রচনা হচ্ছে।
সুতরাং বৈদিক আন্দোলনের গতিবেগ লাভের জন্য সম্ভবত অঙ্গিরাগণের পর এক বা

পাতা: ১৭৬


দেড়-দুই শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে। বলা হয় সিন্ধু সভ্যতার মূল এলাকায় হরপ্পান পর্যায়ে ক্ষয় শুরু হয় ২১০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে। তবে এর ধ্বংসের সময় নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে ভিন্ন মত আছে। অলচিনদ্বয় যেখানে কতকগুলি এলাকায় পরিণত হরপ্পান পর্যায়কালকে ১৮৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বিদ্যমান দেখতে পেয়েছেন সেখানে কেনোয়ার খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ শতককে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের অবসানের সাধারণ কাল হিসাবে ধরেছেন।
অবশ্য এ নিয়ে দ্বিমত নেই যে, বিশাল এলাকায় সিন্ধু সভ্যতার পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের অবসান একসাথে হয় নি। তবে পণ্ডিতগণ একটা মোটা দাগে সময় নির্দেশ করে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের অবসানের সময়টা বলেন। আমরা জানি যে, পরিণত হরপ্পান পর্যায়ই প্রকৃত পক্ষে নগর সভ্যতা। তারপরের বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়কে আর নগর সভ্যতা বলা যায় না। তখন অতীত নগর সভ্যতার সামান্য কিছু বৈশিষ্ট্য রয়ে গেলেও উন্নত সিন্ধু সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আর নেই, যেমন বৃহৎ নগর এবং ভবন, সোজা রাস্তা, আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন, সিল, অভিন্ন মাপ ও ওজন ইত্যাদি।
আমরা অনুমান করতে পারি পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের সাধারণ সমাপ্তির সময়ে ঋগ্বেদের বৈদিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা ধীরে ধীরে ছড়িয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ধ্বংস হয়েছে। তবে কিছু এলাকায় বৈদিক আন্দোলন সুবিধা করতে পারে নি বলে মনে হয়। যেমন মহেঞ্জোদাড়ো সহ বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত সিন্ধু প্রদেশের বেশীর ভাগ অঞ্চলে। এখানে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের পতন কিছু পরে হয়েছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে এখানে হরপ্পান পর্যায়ের পতনের পরেও উত্তরাঞ্চল থেকে সংস্কৃতির ভিন্নতা অনেক শতাব্দী কাল রক্ষা পাবার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়।
আমরা অনুমান করি মহেঞ্জোদাড়োতে বৈদিক শক্তির সামরিক বিজয় ঘটতে নাও পারে। তবে মহেঞ্জোদাড়োর দক্ষিণের বাঁধ ধ্বংসের জন্য সেখানে যাবার প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। উত্তরে উজানের বাঁধগুলো ধ্বংসের ফলে অনিয়ন্ত্রিত বিপুল জলস্রোতের তোড়ে দক্ষিণে সমুদ্রের নিকটবর্তী বাঁধ খড়কুটোর মত ভেসে গেছিল বলে আমরা অনুমান করতে পারি। যাইহোক, বাঁধ ধ্বংস হলে সঙ্গত কারণে নদীর কাছাকাছি এলাকা ছাড়া দূরবর্তী এলাকাগুলোতে চাষ বন্ধ হয়ে গেছে এবং বর্তমানের মত সিন্ধু উপত্যকার দুই পাশে বিস্তৃত মরু বা মরুপ্রায় অঞ্চল সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এইসব এলাকার জনগণও অন্যত্র অভিগমন করতে বাধ্য হয়েছে। সেক্ষেত্রে এক সময় রাষ্ট্রীয় অথবা আঞ্চলিক রাজধানী-নগর মহেঞ্জোদাড়োকেও আর রক্ষা বা ধারণ করার মত অর্থনৈতিক ভিত্তি থাকে নি বলে তা পরিত্যক্ত হয়েছে।

_________________________________________________________________________________
অলচিনদ্বয় বলছেন : ‘The growing number of radiocarbon dates from excavated Harappan sites indicate that the civilization continued down to around c. 2000 BC; a smaller number of dates suggest that, in some areas and some sites at least, it survived until c. 1850 BC.’ Bridget and Raymond Allchin, Origins of a Civilization : The Prehistory and Early Archaeology of South Asia, (Viking by Penguin Books India (P) Ltd., New Delhi, 1997), p. 209.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৭৭


এ বিষয়টি বিস্ময়কর যে, সিন্ধু সভ্যতার এমন উন্নতি ও বিস্তৃতি যে বিপুল খাদ্যোৎপাদন ছাড়া সম্ভব ছিল না সেই বিষয়ের উপর প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টি কমই পড়েছে বলে মনে হয়। এক বিশাল আয়তনে এত বহুসংখ্যক নগর, শহর এবং গ্রাম ভূ-প্রাকৃতিকভাবে ঐ রকম রুক্ষ ও নিরস অঞ্চলে কিভাবে গড়ে উঠেছে সেই প্রশ্ন সঙ্গত কারণে মনে জাগা উচিত। সেটা যে জলসেচ ছাড়া সম্ভব ছিল না তা সহজবোধ্য। কিন্তু কিভাবে এত ব্যাপক বিস্তৃত অঞ্চলে জলসেচ সম্ভব হয়েছিল? শুধু খাল কেটে কি এত জল নেওয়া সম্ভব ছিল চতুর্দিকে? সিন্ধু এবং সরস্বতী উভয় নদীরই জলপ্রবাহের পরিমাণ নিশ্চয় সেদিনও এত বেশী ছিল না যে, তার অধিকাংশ জলপ্রবাহকে ধারণ এবং সংরক্ষণ করা ছাড়া এত বিশাল অঞ্চলের সর্বত্র ঐভাবে জল বিতরণ করা যাবে।
সুতরাং ঋগ্বেদে বর্ণিত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে একান্ত বাস্তব বলে মনে হয়। ঋগ্বেদে বিভিন্ন স্থানে বৃত্র, নদীরোধ, নদীমুক্তি ইত্যাদিকে এমনভাবে উপস্থিত করা হয়েছে যে, এমনও মনে হয় যে, সুদীর্ঘ কাল ধরে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এমনভাবে কার্যকর হয়েছিল যাতে করে সপ্তসিন্ধুর জলরাশি সমুদ্রে যাবার উপায় পেত না, অর্থাৎ আরব সাগরের পরিবর্তে ভূমিতেই সম্পূর্ণ অথবা প্রায় সম্পূর্ণ জলরাশি বিতরণ হয়ে যেত। নিম্নবর্ণিত বক্তব্যগুলি গুরুত্ব পাবার দাবী রাখে :
‘হে হরিবান ইন্দ্র! যখন তুমি বদ্ধ এ নদীগণকে বহুকাল অবরোধের পর প্রবাহিত হবার জন্য মোচন করেছিলে, সে সময়ে প্রসিদ্ধ দ্যুতিমতী ভগিনীগণ তোমার আশ্রয় লাভের জন্য তোমাকে স্তুতি করলেন’ (৪/২২/৭)।
‘ .............. তিনি বজ্র দ্বারা নদীর নির্গমন দ্বার সকল খুলে দেন, তিনি অনায়াসে দীর্ঘকাল গন্তব্য পথে নদী সকলকে প্রেরণ করেন ..............’ (২/১৫/৩)।
‘এ মদকর সোমে আনন্দিত হয়ে ইন্দ্র হস্তে বজ্র ধারণ করে জলের আবরক অহিকে ছেদন করেছিলেন। তখন প্রীতিকর জলরাশি পক্ষীগণ যেরূপ কুলায়াভিমুখে যায়, সেরূপ সমুদ্র অভিমুখে গমন করতে লাগল (২/১৯/২)। অহিহন্তা পূজনীয় ইন্দ্র জলপ্রবাহকে সমুদ্রাভিমুখে প্রেরণ করলেন। ...........’ (২/১৯/৩)।
‘হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্র কর্তৃক সমাচ্ছাদিত নদী সকলের প্রকাণ্ড বারিরাশি উন্মুক্ত করেছ; তুমি জলরাশি মুক্ত করেছ। তুমি সে সমস্ত নদীকে নিম্নপথে প্রবাহিত করেছ; তুমি বেগবান সলিলরাশিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছ’ (৬/১৭/১২)।
‘হে ইন্দ্র! এ সম্পূর্ণ সত্য যে তোমার সমকক্ষ নেই। কি দেব, কি মনুষ্য, কেউই তোমাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নয়। তুমি বারিরাশি নিরোধ করে শয়ান অহিকে সংহার করেছ এবং বারিরাশিকে সমুদ্রে পতিত হবার নিমিত্ত বিমুক্ত করেছ’ (৬/৩০/৪)।
‘স্বভাবত তেজস্বী অশ্বগণের অধিপতি তুরাষাট দক্ষিণ হতে বারিরাশিকে বিমুক্ত করেন, এরূপে বিসৃষ্ট বারিসমূহ সে ক্ষোভশূন্য গন্তব্যস্থানে (সমুদ্রে) প্রত্যহ ব্যাপ্ত হয়ে পতিত হয়, যা হতে আর প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়’ (৬/৩২/৫)।

_________________________________________________________________________________
নদীসমূহ।
ইন্দ্র।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৭৮


যাইহোক, আমরা ঋগ্বেদের অনেক বর্ণনাকে যদি বৈদিক কবিদের আলংকারিক অতিকথনও মনে করি তবু সিন্ধু সভ্যতার স্লুইস গেট, ব্যারেজ, বাঁধ এবং জলাধার সমন্বিত বিশাল বিস্তৃত নদী নিয়ন্ত্রণের নেটওয়ার্ককে কাল্পনিক মনে করার কোন কারণই দেখি না।
এটা দু:খজনক যে মিসর, মেসোপটেমিয়ার তুলনায় অনেক বেশী বিস্তৃত হলেও সিন্ধু সভ্যতার উপর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়েছে। আর যেটুকু হয়েছে সেটুকুও হয়েছে জনবসতির উপর। আকাশ থেকে কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে কিছু চিত্রগ্রহণ, নদীর খাতগুলো বোঝার জন্য কিছু পর্যবেক্ষণ -- প্রধানত এগুলির মধ্যে নদী সংক্রান্ত কাজ সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফলে আমরি সংস্কৃতির একটি স্থানের নিকট হাব নদীর উজানে দেওয়া একটি বাঁধ, ধোলাভিরা বা কোটাডার জলাধার এবং লোথাল বন্দরের স্লুইস গেটের মত সামান্য কিছু সংখ্যক প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশন ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার মূল ভিত্তি যে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে ছিল তার সপক্ষে আর তেমন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদের হাতে নেই।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ঋগ্বেদের বিবরণকে আমরা গুরুত্ব দিই। কারণ তা আমাদের কাছে একদল অকর্মণ্য এবং সমাজবিচ্ছিন্ন পণ্ডিতের কতকগুলো শব্দ ও বাক্য নিয়ে অর্থহীন খেলা নয়। কালের প্রভাবে ঋগ্বেদের অনেক শব্দের অর্থ হারাতে পারে, অনেক ঘটনার তাৎপর্য বোঝা দু:সাধ্য হতে পারে। কিন্তু ঋগ্বেদ যদি একদল পণ্ডিতের কথার মারপ্যাঁচ মাত্র হত তবে যেসব পণ্ডিত দুর্বোধ্য কথার মারপ্যাঁচ ও ভাষার অলংকার দিয়ে অন্ত:সারশূন্য পাণ্ডিত্যের জাল রচনা করেন তাঁদের সে সকল সৃষ্টির মতই ঋগ্বেদও তার রচয়িতাদের মৃত্যুর সঙ্গে কালগর্ভে হারিয়ে যেত। বস্তুত যে সমাজসংঘাত ও আন্দোলনের অভিঘাতে ঋগ্বেদ সৃষ্টি হয়েছিল সেই অভিঘাতের শক্তি ঋগ্বেদের ভিতরে সঞ্চারিত হয়েছিল বলেই ঋগ্বেদের এই কালজয়িতা।
ঋগ্বেদের বক্তব্যের ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। অনেক বিষয়ে দ্বন্দ্বের হয়ত অবসান হবে না কখনও। ত সত্ত্বেও নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অস্তিত্বের সপক্ষে ঋগ্বেদের সাক্ষ্য সম্পর্কে আমাদের সামান্যতম সন্দেহ নেই। কারণ এটি যে শুধু ঋগ্বেদের কেন্দ্রীয় বিষয় তাই নয় অধিকন্তু সিন্ধু সভ্যতার মূল বৈশিষ্ট্যসমূহও খাদ্যোৎপাদনের জন্য নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা-ভিত্তিক একটি অত্যুন্নত কৃষির প্রতি দিকনির্দেশ করে।
আমরা ইতিপূর্বে সিন্ধু সভ্যতার মূলত অহিংস ধারায় উদ্ভব ও বিকাশের কথা বলেছি। সমস্ত প্রাচীন সভ্যতা যেখানে ব্যতিক্রমহীনভাবে ভয়ঙ্কর দলন, পীড়ন, বলপ্রয়োগ এবং যুদ্ধ নির্ভর ছিল সেখানে এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, যে জনগোষ্ঠীসমূহ সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন বাস্তব কারণেই তাদের মধ্যে শান্তিপ্রিয়তা ও অহিংসার দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল যার ফলে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের নগর বিন্যাসে আমরা এর ছাপ
_________________________________________________________________________________
ক্যাম্বে উপসাগরে নিমজ্জিত নগরের পাশে প্রাচীন নদীখাতে বাঁধ বা গবরবন্দ্ পাওয়া অবশ্যই একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কিন্তু এ বিষয়ে আরো অনুসন্ধান-লব্ধ তথ্য আমাদের হাতে এসে না পৌঁছানো পর্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা করা যাচ্ছে না।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৭৯


দেখতে পাই। সেখানে অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যাল্পতা এবং নিম্নমান শুধু লক্ষণীয় নয় , উপরন্তু অন্যান্য সভ্যতার মত শ্রেণী বৈষম্যের তীব্রতার অভাবও লক্ষণীয়। কিন্তু হরপ্পান নগর পরিকল্পনার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল তার আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন ব্যবস্থা। এটিকে বুঝলে আমরা সিন্ধু সভ্যতার অনেক কিছুকে বুঝব।
আমাদের ধারণা হরপ্পান নগরগুলোর সোজা রাস্তা এবং সুবিন্যস্ত ঘর-বাড়ীর পরিকল্পনার মূল কারণ ড্রেন ব্যবস্থা। কারণ ড্রেন সোজা না হলে তা ভালভাবে কাজ করে না। বিশেষ করে যেখানে ড্রেন মানুষের মল নিষ্কাশনের একমাত্র উপায় সেখানে ড্রেন সোজা করা ছাড়া উপায় ছিল না। এই ড্রেনে ঢাকনা দিতে হয়েছে শুধু দুর্গন্ধ নিবারণের জন্য নয় উপরন্তু তাকে সচল রাখার জন্যও। কারণ রোদ ও বাতাসে ড্রেনের জল ও ময়লা শুকিয়ে গেলে ড্রেন বন্ধ ও অচল হবে। ড্রেনগুলি সচল রাখার জন্য নগরগুলিতে জল ব্যবহারের এত বেশী আয়োজন করতে হয়েছে। অনুমান করা যায় যে, জল ব্যবহার ধর্মাচারের অঙ্গও ছিল যার প্রভাব পরবর্তী কালের হিন্দু সমাজে আমরা দেখতে পাই।
অর্থাৎ ড্রেন ব্যবস্থা নগর নির্মাতাদেরকে সোজা রাস্তা ও উন্নত নগর পরিকল্পনা তৈরী করতে বাধ্য করেছে। তা না হলে এভাবে সুবিন্যস্ত নগর পরিকল্পনা করা কেন? অন্তত সূচনায় এটা একটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল নগর পরিকল্পনার দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারি কেন এই ড্রেন ব্যবস্থা? মানুষ যখন কেবল প্রথম নগর গড়ছে সেই কালে তাদের কাছ থেকে এত উন্নত চেতনা কি করে আশা করি? নন্দনতাত্ত্বিক বা সৌন্দর্যবোধ থেকে এই শ্রমঘন ও ব্যয়বহুল ড্রেন নির্মাণ, নাকি বাধ্যতা থেকে? প্রাচীন আর কোন সভ্যতায় আমরা এই ধরনের আয়োজন দেখি না। এমনকি আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত কোথাও আমরা এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভিত্তিক নগর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখি নি। সুতরাং আমাদের ধারণা হরপ্পান ড্রেন ব্যবস্থার উদ্ভব সামাজিক বাধ্যতা থেকে। আমাদের আরও ধারণা যে, এই ব্যবস্থার উদ্ভবের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার নম্র ও গণতান্ত্রিক ধারায় বিকাশের তাৎপর্য নিহিত আছে।
আমরা অনুমান করি সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় নগর নির্মাণের সূচনায় বা আদি লগ্ন থেকেই সভ্যতার সংগঠকদেরকে মানুষের দেহবর্জ্য নগর থেকে দূরে নিয়ে ফেলার বিকল্প ব্যবস্থা ভাবতে হয়েছিল এই কারণে যে, কোন মানুষকে দিয়ে সেদিন পর্যন্ত উপমহাদেশের সর্বত্র বিদ্যমান মেথরের মাথায় দেহবর্জ্য বহন করে নিয়ে যাবার মত কোন ব্যবস্থা গড়া সিন্ধু সভ্যতায় সম্ভব ছিল না। কারণ বল প্রয়োগের সেই হিংস্র ব্যবস্থার অভাব যাতে মানুষকে দিয়ে যে কোন নোংরা এবং কষ্টসাধ্য কাজ করানো সম্ভব। সমাজে শ্রেণী বৈষম্য এবং ধন বৈষম্য বৃদ্ধি পেলেও আদিম উপজাতীয় সমাজ কাঠামোর মধ্যে যে সহমর্মিতা এবং গণতান্ত্রিকতা ছিল সভ্যতা সংগঠনের পর্যায়েও তার অনেকখানি টিকে ছিল। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে এই ধারাও এগিয়েছে। এর ফলে সিন্ধু সভ্যতার এভাবে এক বিশেষ নম্র ধারায় বিকাশ সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার নম্র ধারায় বিকাশের একটি প্রধান ভিত্তি ছিল মোটামুটি

পাতা: ১৮০


সব মানুষের প্রয়োজন পূরণের মত বিপুল খাদ্যোৎপাদন। এই খাদ্যোৎপাদনের জন্য যেমন শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে বলপ্রয়োগে সাধ্যাতীত শ্রম করাতে হয় নি তেমন ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবীর শ্রমোৎপাদিত প্রাচুর্যে তাদেরও একটা ভাল অংশ বা ভাগ থাকায় তারাও প্রয়োজনীয় শ্রম মূলত স্বেচ্ছায় দিয়েছে বলে সভ্যতা রক্ষার জন্য জবরদস্তির প্রয়োজনও খুব কম হয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টাকে আমরা এভাবে বলতে পারি অন্যান্য সভ্যতা যেখানে মানুষ গড়েছে প্রধানত মানুষের উপর আগ্রাসন চালিয়ে সেখানে সিন্ধু সভ্যতা মানুষ গড়েছে প্রধানত প্রকৃতির উপর আগ্রাসন চালিয়ে। এখানে মানুষ সভ্যতা গড়তে গিয়ে শুরু থেকেই প্রকৃতিকে নিংড়াতে পেরেছিল বা বাধ্য হয়েছিল বলে মানুষকে নিংড়াবার প্রয়োজন তার ছিল একান্ত সীমিত যার প্রতিফলন আমরা সিন্ধু সভ্যতার আদি থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সমগ্র কাল জুড়ে পাই।
আমরা অনুমান করি নব্য প্রস্তর যুগ থেকে এক বা একাধিক উপজাতি বা গোত্রের উদ্যোগে ছোট ছোট পাহাড়ী ঝর্ণা এবং স্রোতধারার উপরে বাঁধ দিয়ে জলপ্রবাহ আটকে সংলগ্ন এলাকায় যখন প্রচুর শস্য উৎপাদন করা হয়েছে তখন সেই দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হয়ে আরও বিভিন্ন উপজাতি একত্র হয়ে ক্ষুদ্র নদীর মাঝখানে বাঁধ দিয়েছে। এবং এই ধরনের নদীকে বাঁধ দিয়ে আটকাতে হলে অতিরিক্ত জলপ্রবাহ বের করে দেবার জন্য যে স্লুইস গেট রাখতে হয় সেই ধারণাও তাদের ততদিনে হয়েছে অথবা প্রাথমিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরবর্তী কালে হয়েছে। যেহেতু এ ধরনের নদীতে বাঁধ দিতে হলে অনেক শ্রমশক্তি দরকার এবং তার তীরে বসবাসকারী অনেক জনগোষ্ঠীর সম্মতি দরকার সেহেতু সবাইকে মিলিত হয়ে কাজটা করতে হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন উপজাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে কনফেডারেসি। সুতরাং এই কনফেডারেসির ধারায় সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্যে নিহিত রয়েছে এই সভ্যতার অনেক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম আদি কারণ। এই কারণে আমরা বৃহৎ নগরগুলির মধ্যে আয়তনের বেশী হেরফের দেখি না, যা আঞ্চলিক ক্ষমতার সুষম বন্টনের পরিচায়ক। নগর জীবনেও ঘর-বাড়ী এবং নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে খুব বেশী বৈষম্য দেখি না। এগুলি কালপ্রেক্ষিতে সম্পদ ও ক্ষমতা উভয়েরই সুষম বন্টনের বহি:প্রকাশ। বিশেষত ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে কনফেডারেসির ঐতিহ্য খুব শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি করেছিল বলে আমরা অনুমান করতে পারি।
সভ্যতার ঊষাকাল থেকে কনফেডারেসিমূলক ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রভাব পড়েছে সমাজের সংস্কৃতি ও ধর্মে। এর ফলে বিভিন্ন উপজাতি বা গোত্রের টোটেম অথবা দেবতার প্রতীক হিসাবে মূর্তি গড়ে উঠতে বা বিকাশ লাভ করতে পারে নি, যেহেতু তাহলে সমাজে বিভক্তির শক্তি প্রবল হয়। উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যও রইবে আবার ঐক্যও হবে এমনভাবে বৃহত্তর সমাজ গড়ার জন্য যেসব ভাবাদর্শিক ও সামাজিক আয়োজন ছিল তার মধ্যে একটি হল নিরাকার দেবতার ধারায় ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ। এই কারণে আমরা সিন্ধু সভ্যতার কোন পর্যায়ে বৃহৎ কোন দেবতা মূর্তি পাই না।

পাতা: ১৮১


আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, যেসব ছোট মাটির মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি যদি মাতৃদেবী মূর্তিও হয়ে থাকে তবে সেগুলির সঙ্গে সভ্যতা এবং রাষ্ট্রের মূল ধারার কোন সম্পর্ক ছিল না। এটা সমাজের নীচ তলার এবং অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত ছিল বলে আমরা মনে করতে পারি। তবে তার একটা পরোক্ষ প্রভাব সমাজের উচ্চবর্গের উপরেও পড়ে নানানভাবে। তাছাড়া সিন্ধু সভ্যতায় যে  সহিষ্ণুতা ছিল তার কারণে যে বহু বৈচিত্র্য ছিল তার একটি সাক্ষ্য হয়ে থাকতে পারে অযত্নে তৈরী ক্ষুদে, স্থূল ও অসুন্দর এই মূর্তিগুলি, যদি এইগুলি দেবী-মূর্তি হয়।
যাইহোক, এটা বোধগম্য যে, বৃহৎ নদী, উপনদীগুলিতে প্রথমে বাঁধ বা ব্যারেজ দেওয়া হয় নি। এবং যখন দেওয়া হয়েছে তখন অনেক উজানে যেখানে নদীস্রোত শীর্ণ এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য সেখানে প্রথমে দেওয়া হয়েছে। এবং তারও আগে দেওয়া হয়েছে এইসব নদী-উপনদীতে পতিত শীর্ণ স্রোতধারাগুলিতে। এইভাবে নদীর স্রোত নিয়ন্ত্রণ করে এবং বহু সংখ্যক খালের মাধ্যমে তা দূর দূরান্তে বিতরণ করে নদীর প্রমত্ততাকে যখন কমানো গেছে তখন আরও দক্ষিণের দিকে নদীকে বাঁধা হয়েছে। এভাবে এক সময় সমগ্র অঞ্চলের সব উল্লেখযোগ্য নদী বাঁধা পড়েছিল।
নদীকে বাঁধ দিয়ে বাঁধার সময় মানুষের ধর্মবিশ্বাসকেও মূল্য দিতে হয়েছে। কারণ এটা প্রকৃতির শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের এক দু:সাহসী পদক্ষেপ। সুতরাং নদীর দেবতার মত বাঁধের দেবতাও কল্পনা করতে হয়েছে। এভাবে সমাজে বাঁধ ক্রমে ধর্মব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শুষ্ক ঋতুগুলিতে শুকিয়ে যায় এমন ছোটখাট স্রোতধারা বা ঝর্ণায় দেওয়া বাঁধে প্রথমে এই দেবত্ব আরোপ যদি না হয়েও থাকে তবে একটু বড় স্রোতধারা বা নদীতে বাঁধ দিতে হলে বাঁধের দেবতার উদ্ভাবনের প্রয়োজন ছিল খুব বেশী। কারণ এগুলির নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল জনশক্তি নিয়োগের প্রয়োজন ছিল। সুতরাং শ্রমজীবী জনসাধারণ নদীর দেবতার চেয়েও শক্তিশালী বাঁধের দেবতার জন্য এসব কাজে সাহস ও প্রেরণা পেত। অন্যদিকে তাদের জন্য ছিল বিপুল ফসল লাভের প্রেরণা।
তবে আমাদের ধারণা যে, যেহেতু বাঁধ নির্মাণের পূর্বে তাতে দেবত্ব আরোপ সম্ভব নয় সেহেতু বাঁধ দিতে গিয়ে একদল অবিশ্বাস্য রকম সাহসী বস্তুবাদী বা লোকবাদী চিন্তাশীল মানুষ সেকালে জন্ম নিয়েছিল। আমরা অনুমান করতে পারি, যে সমাজ-সংগঠক, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের উদ্যোগে এই ধরনের নদীরোধক বাঁধ বা ব্যারেজ নির্মিত হয়েছিল তাদের মধ্যে লোকবাদী চেতনা প্রবল না হলে তাঁরা বাঁধ নির্মাণের কল্পনা করতে পারতেন না প্রথম থেকেই। আর সর্বোপরি বাঁধ প্রাকৃতিক বস্তু নয়, মানুষের নির্মাণ; তাও আবার প্রাকৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে এবং তার উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য। সেক্ষেত্রে বাঁধের উপর দেবত্ব আরোপ করলে যারা এর নির্মাতা তারা কি দেবতার প্রত্যক্ষ স্রষ্টা হয় না?

পাতা: ১৮২


এটা ঠিক যে, বাঁধের উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে এর নির্মাণে সামাজিক সমর্থনের প্রয়োজনে, পশ্চাৎপদ শ্রমজীবী জনসাধারণকে এর বিভিন্ন কষ্টসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করার প্রয়োজনে। কিন্তু সভ্যতার নায়কদের কাছে মূল বিষয়টা স্পষ্ট থাকার কথা। আমরা এখন খুব সহজে ভারতবর্ষে প্রাচীন কালের নিরীশ্বরবাদী এবং লোকবাদী দর্শনগুলোর উৎস হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকে এবং বিশেষ করে তার ঊষাকালকে চিহ্নিত করতে পারি। আমরা জানি বুদ্ধের মত ধর্মনেতার চিন্তায়ও নিরীশ্বরবাদের প্রভাব আছে। আসলে জনচেতনায় বস্তুবাদী দর্শন ও বিশ্বদৃষ্টির বেশ কিছু প্রভাব কিংবা এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহনশীলতা ছাড়া যে বুদ্ধের পক্ষে ঈশ্বর প্রশ্নকে পাশ কাটানো কিংবা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সরাসরি অস্বীকার করা সম্ভব হত না তা আমরা সহজেই বুঝি। তাছাড়া বুদ্ধের সমকালীন অজিত কেশকম্বলীর মত নাস্তিক এবং সংশয়বাদী হিসাবে পরিচিত চিন্তাবিদের কথা আমরা জানতে পারি

_________________________________________________________________________________
বৌদ্ধ দর্শন মতে, পৃথিবীতে অপরিবর্তনীয় বলে কিছু নেই। আমাদের দেহ, সংবেদনা, উপলব্ধি, সংস্কার সবই ক্ষণস্থায়ী, সবই দু:খময়। এসবই অনাত্ম। সারা বিশ্বে চলেছে এক অনন্ত বিরামহীন বস্তুর রূপান্তর ও পরিবর্তন। জীবন আবির্ভাব ও তিরোভাবের একটানা ছন্দ। জগতে সত্তা বলে কিছু নেই। যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। জগতে শাশ্বত, সনাতন বলে কিছু নেই। বৌদ্ধদের মতে ঈশ্বর নেই। বুদ্ধদেব অনাথ পিণ্ডিককে বলছেন : ‘এই জগৎ যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হত তাহলে পরিবর্তন ও বিনাশ বলে কিছু থাকত না। তাহলে দু:খ, দুর্বিপাক, ন্যায়, অন্যায়, পবিত্র, অপবিত্র বলে কোন জিনিস জগতে থাকত না। কারণ, এসব ঈশ্বর থেকেই আসত। সচেতন জীবে যে দু:খ, আনন্দ, প্রেম ও বিদ্বেষ দেখা যায়, এসব যদি ঈশ্বরের ক্রিয়া হত তাহলে ঈশ্বরও দু:খ, আনন্দ, প্রেম, বিদ্বেষ অনুভব করত। আর যদি তা হয় তাহলে কি করে সে ঈশ্বর সম্পূর্ণ হয়? ঈশ্বরই যদি সৃষ্টিকর্তা হন, সকলকেই যদি স্রষ্টার নিকট নি:শব্দে নতি স্বীকার করতে হয়, তাহলে পুণ্যাচরণের প্রয়োজন কোথায়? সকল কর্মই যদি তাঁর তৈরী হয়, তাঁর নিকট সব সমান হয়, তাহলে ন্যায় ও অন্যায় কর্ম করার অর্থ তো সমানই হবে? আর যদি বল, সুখ দু:খের অন্য কারণ আছে, তাহলে তোমায় মানতে হবে এমন জিনিস আছে যার কারণ ঈশ্বর নন। আর তাই যদি হয় তাহলে অন্যান্য জিনিসই বা অহেতুক হবে না কেন? ঈশ্বর যদি স্রষ্টা হন, তাহলে হয় তাঁর এই সৃষ্টির উদ্দেশ্য আছে অথবা তাঁর সৃষ্টির কোনও উদ্দেশ্য নেই। যদি তিনি উদ্দেশ্য নিয়ে সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তাঁকে সম্পূর্ণ বলা যেতে পারে না। কারণ উদ্দেশ্য মানেই অভাবের পূরণ। আর যদি তিনি বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করে থাকেন, তাহলে তিনি হয় বাতুল নয় দুগ্ধপোষ্য শিশু। .................।’
(অশ্বঘোষ, বুদ্ধচরিত)। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : মনোরঞ্জন রায়, দর্শনের ইতিবৃত্ত। পৃ: ১৯৬-২২৬।
শুধু বৌদ্ধ ধর্মই নয় ভারতবর্ষে উদ্ভব হওয়া বৌদ্ধ ধর্মের সমসাময়িক জৈন ধর্মও নাস্তিক্যবাদী। জৈনদর্শন মতে জগৎ এবং জীবন অসংখ্য দ্রব্য, গুণ এবং কর্মের পারস্পরিক কার্য ও সংঘাতের ফলে সৃষ্ট। দ্রব্য, গুণ এবং কর্মের সংঘাতের ফলেই সৃষ্টি এবং ধ্বংস হয়। কাজেই সৃষ্টিকর্তা এবং প্রলয়কর্তা হিসাবে একটি ঈশ্বরের কল্পনা জৈনদর্শনে নেই। দেখুন : রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, ভারতীয় দর্শন, (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৩), পৃ: ৮৫।
অজিত কেশকম্বলী বুদ্ধের সময়ে তাঁর বস্তুবাদী দার্শনিক মতবাদ প্রচার করতেন।
_________________________________________________________________________________


পাতা: ১৮৩


সাংখ্য দর্শনের মধ্যেও নিরীশ্বরবাদী প্রভাব স্পষ্ট । সর্বোপরি সম্পূর্ণরূপে বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী চার্বাক ও লোকায়তদের যে এক সময় বেশ প্রভাব ছিল তা আমরা পরবর্তী কালে তাদের বিরুদ্ধে লেখা ব্রাহ্মণদের রচিত বিভিন্ন সাহিত্য থেকে অনুমান করতে পারি।
এটি সহজে অনুমেয় যে, কোন অনুন্নত অথবা ধর্মাচ্ছন্ন সমাজজমিতে এইসব চিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে নি। অত্যন্ত প্রবল যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানমনস্কতা ছাড়া কিভাবে এই ধরনের বস্তুবাদী বা লোকবাদী চিন্তার প্রকাশ সম্ভব? আজও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এহেন অবিশ্বাস্য উন্নতির পরেও আমাদের দেশ সহ পৃথিবীর দেশে দেশে ধর্মাচ্ছন্নতা ও ধর্মোন্মাদনা এবং লোক ছেড়ে অলোক-পরলোকের দিকে দৃষ্টিপাতের যে ব্যাপক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় তার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা কি করে আজ থেকে আড়াই বা তিন হাজার বছর আগে যখন সমাজ সিন্ধুর নগর সভ্যতা থেকে পশ্চাৎপদ কৃষি সভ্যতায় ফিরে গেছে এবং গাঙ্গেয় উপত্যকায় কেবল নূতন করে নগর সভ্যতার উথানের প্রস্তুতি চলছে সেই রকম এক পশ্চাৎপদ অবস্থায় এমন বিজ্ঞানমনস্কতার উদ্ভব আশা করতে পারি? এখন আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এই বিজ্ঞানমনস্কতার উদ্ভব ঘটেছিল আরও কয়েক হাজার বছর আগে সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা ভূমিতে যেখানে প্রাচীন পৃথিবীর তুলনাবিহীন এক বিশাল নবসভ্যতা নির্মাণের আয়োজন করছেন একদল বিস্ময়কর সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ নদীর স্রোতধারাকে নিয়ন্ত্রণের মত কালব্যতিক্রমী কাজে হাত দিয়ে। অর্থাৎ ভারতবর্ষে পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে বিজ্ঞানমনস্কতা এবং বস্তুবাদী চিন্তার যে প্রকাশ আমরা দেখতে পাই তা প্রাচীনতর এক ধারার অবশেষ মাত্র যার মূল উৎস ছিল সিন্ধু সভ্যতার নায়কদের সেই চেতনার মধ্যে যে চেতনা দ্বারা তাঁরা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়তে পেরেছিলেন।

_________________________________________________________________________________
প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার নাম সাংখ্য। পৌরাণিক কাহিনীতে কপিল মুনিকে সাংখ্য শাখার প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। সাংখ্যদর্শন সৃষ্টিতত্ত্ব অপেক্ষা বিবর্তনতত্ত্বে বিশ্বাসী। সাংখ্যমতে এই জগৎ সৃষ্টি হয়নি, এই জগতের কেউ স্রষ্টা নেই। জগতের ক্রমবিকাশ হয়েছে। সত্তার ধারণায় সাংখ্য ছিল দ্বৈতবাদী। পুরুষ এবং প্রকৃতি উভয়ই মৌলশক্তি। পুরুষ হচ্ছে চেতনা, প্রকৃতি হচ্ছে বস্তু, প্রকৃতি জগৎ। সাংখ্য মতে পুরুষ দ্বারা ঈশ্বর বা স্রষ্টাকে বুঝায় না। পুরুষ হচ্ছে ব্যক্তির মধ্যে আশ্রয়প্রাপ্ত বা আবদ্ধ নিত্যকালের চেতনা। ব্যক্তি প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতি নিয়ত কার্যকারণের বিধান দ্বারা পরিবর্তিত হচ্ছে। সাংখ্যদর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। এতে বলা হয়েছে, ঈশ্বরকে যদি মুক্ত বলে স্বীকার করা যায়, তাহলে সৃষ্টি বিষয়ে তাঁর অক্ষমতা জন্মে। রাগাদি অভিমানই সৃষ্টি সম্বন্ধে প্রেরণা দেয়। মুক্তের এই রাগাদি অভিমান থাকতে পারে না। অতএব, ঈশ্বর যদি মুক্ত হন, তাঁর সৃষ্টি ক্ষমতা থাকে না। যদি মুক্ত হন, তিনি কোন স্বার্থে সৃষ্টিতে প্রবৃত্ত হবেন? জগৎ যদি ঈশ্বরের সৃষ্টি হয় তাহলে ঈশ্বরকে মুক্ত বলা যায় না। আর যদি ঈশ্বরকে বদ্ধ বলো, তাহলে ঈশ্বরের মূঢ়তা প্রযুক্ত সৃষ্টি ক্ষমতা থাকতে পারে না। অতএব, ঈশ্বরকে তুমি মুক্ত বা বদ্ধ কিছুই বলতে পার না, কারণ ঈশ্বর নেই।
বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : মনোরঞ্জন রায়, দর্শনের ইতিবৃত্ত, পৃ: ১৫৩-১৮১। অখিল বন্ধু সাহা, সাংখ্যদর্শন ও ন্যায়দর্শন, (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮২)।
চার্বাক দর্শনের মূলকথা হল : লোকায়তই একমাত্র শাস্ত্র, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ, পৃথিবী, জল, আগুন ও বায়ুই একমাত্র উপাদান; ভোগই মানুষের একমাত্র কামনীয় বস্তু, মন বস্তুর সৃষ্টিমাত্র; পরলোক বলতে কিছু নেই; মৃত্যুই মোক্ষ। ধীষণকে চার্বাক দর্শনের প্রণেতা বলে মনে করা হয়। ধীষণের মতে ঈশ্বর বলে কোন কিছু নেই। লোকায়ত দর্শন বলতে সাধারণ মানুষের দর্শন এবং ইহলৌকিক দর্শন বুঝায়। এই দর্শনের যেমন বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আছে, তেমন একটি দেহতত্ত্ববাদী সাধন পদ্ধতিও আছে। আউল-বাউল-সহজিয়া-কাপালিক-তান্ত্রিক সাধন পদ্ধতিতে এর সাক্ষ্য আছে। দেখুন : রমেন্দ্রনাথ ঘোষ, ভারতীয় দর্শন, (বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৩), পৃ: ৩-২৮।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৮৪


আবার এটা শুনতে স্ববিরোধী মনে হলেও সত্য যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে ছিল ভারতবর্ষে পরবর্তী কালের ধর্মাচ্ছন্নতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতার উদ্ভবের মূল উৎস। কারণ আমজনতার সমর্থন ও অংশগ্রহণের প্রয়োজনে বাঁধের উপর দেবত্ব আরোপ করতে হয়েছিল। ফলে বাঁধ ধ্বংসের প্রয়োজনে বাঁধকে নিষ্প্রাণ বাঁধ হিসাবে নয় বরং জীবন্ত কিন্তু অলৌকিক দানব হিসাবে চিহ্নিত করে তার বিপরীতে দৈবশক্তির উপর বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিতে হয়েছে। বাঁধ ধ্বংস তখন আর মানুষের কাজ হয় নি, বরং দেবতার কাজ হয়েছে। অথচ কাজটা করছে মানুষ। এইভাবে বৈদিক শক্তির ভূমিকা মানুষের কাল্পনিক ক্রীড়নক দেবতারই ক্রীড়নক হিসাবে মানুষকে তার মনোজগতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই যে চেতনা বৈদিক শক্তি ভারতবর্ষে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তা ক্রমে প্রবলতর হয়েছে। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিস্তারের সঙ্গে প্রাচীন লোকবাদী-যুক্তিবাদী চিন্তাধারাসমূহের অবশেষটুকুও মুছে গেল। এর কুপ্রভাব আজ অবধি সমগ্র ভারতবর্ষ বহন করছে তার ধর্মাচ্ছন্নতা ও পশ্চাৎপদতার মধ্য দিয়ে।
বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার গণতান্ত্রিকতা, প্রযুক্তির উন্নত মান, নগর পরিকল্পনা এবং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে আমাদের ধারণা যে, হরপ্পান রাষ্ট্র বা সভ্যতা যা-ই বলা যাক তার মূল নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনাভার ছিল কম বা বেশী সেকিউলার বা লোকবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং পেশার অধিকারী বিভিন্ন সামাজিক শক্তির হাতে। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান ভূমিকায় ছিল সম্ভবত বিভিন্ন ব্যবসায়ী-কারখানা মালিকগোষ্ঠী, প্রকৌশলী, ভূমিমালিক এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। পুরোহিত বা ধর্মীয় শ্রেণী ছিল রাষ্ট্রের পরিচালক শক্তির সহায়ক বা সহযোগী মাত্র। তবে সভ্যতার সংকটকালে পুরোহিত শ্রেণীর শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছিল বলে মনে হয়। কারণ শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মের ভূমিকা সভ্যতার বস্তুগত সংকটকালে যে বৃদ্ধি পাবে সেটা একান্ত স্বাভাবিক।

_________________________________________________________________________________
সিন্ধু সভ্যতার পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান ভূমিকা যে ধর্মীয় শক্তির পরিবর্তে লোকবাদী শ্রেণী অর্থাৎ সমাজের উৎপাদনী শক্তির হাতে ছিল তার একটি বড় প্রমাণ হল হরপ্পান সমাজ ও সংস্কৃতি যথেষ্ট উপযোগবাদী (Utilitarian) ছিল। জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে এমন জিনিসের প্রতিই তারা মনোযোগী ছিল। মেসোপটেমীয় সহ অন্যান্য সভ্যতার সাথে তুলনা করে শেফার এ বিষয়ে বলছেন:
ÔFrom this brief discussion, a very different picture of the nature of the Mature Harappan culture is beginning to emerge. Traditionally early urban literate cultures are associated with the development of profound social stratification and concentration of wealth and power in the hands of few social, presumably hereditary, elites. Archaeologically, this type of social pattern is symbolized in the appearence of ‘palaces’, ‘temples’, and ‘royal tombs’ with associated wealth objects (metals, semi and precious stones, works of art, etc.). Metal objects in the Mesopotamian context are usually interpreted as representing status symbols, and as a means of concentrating wealth in a limited number of relatively portable objects. The function of metal artifacts in early Mesopotamian culture is viewed as being mainly symbolic rather than utilitarian. This is a distinct contrast to the Mature Harappan culture where the primary function for a vast number of metal artifacts appears to have been utilitarian rather than symbolic.’
Jim G. Shaffer, ‘Harappan Culture : A Reconsideration.’ Harappan Civilization : A Recent Perspective, (1993), p. 48.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৮৫


সিন্ধু সভ্যতায় যে ধর্মীয় শক্তির হাতে রাষ্ট্রশাসন ছিল না এই ধারণার সপক্ষে ঋগ্বেদও সাক্ষ্য দেয়। বস্তুত ঋগ্বেদ থেকে আমরা তার রচয়িতা ঋষিদের জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সমস্যার বাইরের কিছুকে সেভাবে আশা করতে পারি না। ঋগ্বেদ থেকে একটি সমাজের বহু দিক সম্পর্কে অনেক ধারণা পেলেও তার রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে খুব সামান্যই অনুমান করা যায়। যেহেতু বৈদিক ঋষিরা সিন্ধু-হরপ্পান পুরোহিত শ্রেণীর ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে এসেছেন সেহেতু পূর্বেও এই ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনীতি ও রাষ্ট্র শাসনের প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলে আমরা অনুমান করতে পারি। তাঁরা যুদ্ধ এবং বাঁধ ধ্বংসের জন্য মূলত ধর্ম ও সমাজ সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন মাত্র। অর্থাৎ রাষ্ট্র শাসনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। অথচ বাইবেল পুরাতন নিয়ম এবং কোরআন থেকে আমরা সমকালীন রাষ্ট্র এবং রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট ধর্মনেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা করতে পারি।
অনেক লেখক সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মীয় শক্তির প্রাধান্যের উপর জোর দেন তার অহিংস পদ্ধতির প্রাধান্যের কারণে। তাঁরা মনে করেন, ধর্মের মাধ্যমে সমগ্র সমাজকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে যে, বল প্রয়োগের প্রয়োজন হয় নি। সমগ্র সভ্যতায় হরপ্পান পর্যায়ে সর্বত্র যে মিল বা অভিন্নতার প্রাধান্য দেখা গেছে সেটাও তাঁরা ধর্মের কারণে বলে মনে করেন। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী পুরোহিত শ্রেণী সভ্যতা ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল বলে যুদ্ধের যেমন বিশেষ একটা প্রয়োজন হয় নি তেমন সর্বত্র ঐক্য এবং অনুরূপতাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
কিন্তু ধর্ম সমাজের সামগ্রিক বস্তুগত অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। সেক্ষেত্রে আমরা পেয়েছি সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণভাবে বৃহত্তর সমাজ গঠনের বাধ্যবাধকতা। বিশেষত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শুরুতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার গুরুত্ব ছিল খুব বেশী। জবরদস্তি ও যুদ্ধ সামান্য কিছু ক্ষেত্রে হতে পারে। কিন্তু এর উপর বেশী গুরুত্ব দিয়ে শুরুতে নদীনিয়ন্ত্রণের মত স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু একবার নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে এটা এমন শৃঙ্খলা এবং বাধ্যতা সেই নদীর উপর নির্ভরশীল সবার উপর আরোপ করেছে যে, সেখান থেকে আর বের হওয়ার উপায় থাকে নি। অর্থাৎ নদীর উপর যেসব শ্রেণী বা গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে আর সকলে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তবে শুরুতে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ায় বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণীকে শান্তিপূর্ণভাবে সমন্বিত করতে হয়েছে বলে নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে ক্ষমতার একটা ভারসাম্যও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সুতরাং সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের বিকাশে অহিংস ধারাকে রক্ষা করা গেছে। নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণের সঙ্গে অভিন্ন রাষ্ট্র সহজে বিস্তার লাভ করেছে। অভিন্ন কেন্দ্র বা নেতৃত্ব ছাড়া বিভিন্ন এলাকার মধ্যে জল ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা সম্ভব ছিল না। সুতরাং বিভিন্ন নদীর উপর বাঁধ দিতে গিয়ে নূতন নূতন এলাকার নদী নিয়ন্ত্রণকারী

পাতা: ১৮৬


শক্তিগুলোকে হরপ্পান রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছে। মানচিত্রে আমরা সিন্ধু সভ্যতার বিশালতার দিকে দৃষ্টি দিলে সহজে বুঝতে পারব আজ থেকে সাড়ে চার বা প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে কত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সভ্যতা অনায়াসে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরেছে। আর একবার যখন নূতন কোন অঞ্চল বা জনগোষ্ঠী এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তখন তারা নিজ অস্তিত্বের স্বার্থে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐক্য ও স্থিতিশীলতার পক্ষে চলে গেছে। কারণ সামাজিক অনৈক্য এবং বিবাদ নিদারুণ স্পর্শকাতর নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্য ধ্বংসাত্মক হতে পারত যা আবার ঐ এলাকার জীবন যাত্রার জন্য ধ্বংসাত্মক হত। আবার রাষ্ট্র প্রয়োজনে কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে শাস্তি দিতে পারত জল সরবরাহ বন্ধ করে। পরবর্তী কালেও আমরা দেখেছি যে, ভারতবর্ষে সমাজচ্যুত ও জল অচল করে সমাজের প্রথা-বিরুদ্ধ এবং অবাধ্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোকে দমন করা হত। সুতরাং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শক্তিই সমাজে বলপ্রয়োগের প্রয়োজনকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল। কাজেই সিন্ধু সভ্যতার নম্রধারায় বিকাশ বলা যাক, ঐক্য এবং অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ক্রমবিস্তার বলা যাক, এই সবকিছুর মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে বাঁধ-ব্যারেজ ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
তবে কি আমরা বলব যে, সিন্ধু সভ্যতায় যুদ্ধের কখনও কোন ভূমিকা ছিল না? প্রত্নতত্ত্ব থেকে অবশ্য আমরা যুদ্ধের কিছু ইঙ্গিত পাই। কারণ আমরি এবং কোট দিজিতে আদি হরপ্পান থেকে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণের সময়ে আগুন দ্বারা ধ্বংসের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তাছাড়া আমরা রফিক মুঘলের বিবরণ থেকে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শুরুর সময় সরস্বতী নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে বেশ কিছু পরিবর্তনের কথা জানছি। তাঁর অভিমত অনুযায়ী এই সময় সামাজিক অস্থিরতা ও পট পরিবর্তন ঘটেছিল।
আমরা অনুমান করি আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণ কালে একটা যুদ্ধ ঘটেছিল। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, বড় নদীগুলিকে বাঁধবার পূর্বে একটি বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজন ঐ অঞ্চলের নেতৃত্বকারী শক্তি অনুভব করছিল। কিন্তু স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতায় অভ্যস্ত পুরাতন শক্তিগুলোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধী হওয়া সঙ্গত। সেক্ষেত্রে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রাথমিক সাফল্যে আস্থাশীল ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামাজিক নেতৃত্ব সমগ্র সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকাকে একটা ঐক্যবদ্ধ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যুদ্ধের পথ গ্রহণ করতে পারে। আমরা অনুমান করি এর সঙ্গে বৃহত্তর সামাজিক-রাষ্ট্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে বরুণকেন্দ্রিক ধর্ম প্রতিষ্ঠাও সংযুক্ত ছিল। আমরা আরও অনুমান করি এই যুদ্ধের পর সমগ্র অঞ্চলে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হরপ্পান পর্যায় শুরু হয় এবং এই সময় থেকে সিন্ধু-সরস্বতী অঞ্চলে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য হ্রাস পেয়ে সর্বত্র অনুরূপতার দ্রুত বিস্তার ঘটতে থাকে যা আমাদের মতে অখণ্ড নেতৃত্বাধীন নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দ্রুত প্রসারের একটি

_________________________________________________________________________________
আমরা দশম অধ্যায়ে ‘মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা’ শীর্ষক আলোচনায় মহাভারতে উল্লিখিত যুদ্ধকে ঐ উত্তরণকালীন যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেছি।
_________________________________________________________________________________


পাতা: ১৮৭


ফল। আমরা অনুমান করি একটি মাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও তা প্রাচীন কনফেডারেসির ঐতিহ্য অনুযায়ী বিকশিত হওয়া যুক্তরাষ্ট্র ছিল। এই কনফেডারেসির গণতান্ত্রিক শাসন ঐতিহ্য অনেকাংশে টিকে গিয়েছিল বলে আমরা তার প্রতিফলন হরপ্পান নগর পরিকল্পনায় দেখতে পাই।
সম্ভবত আদি হরপ্পান পর্যায়ে সমাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ ঘটছিল। এই সময়টা নূতন নূতন আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও নির্মাণের সময়। পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে সেসব অনেকটা থিতিয়েছে। এরপর সভ্যতার ঊর্ধে বিকাশ ততটা হয় নি যতটা হয়েছে পার্শ্বে। অন্যদিকে পুরাতন কনফেডারেসির স্তরে গণতন্ত্রের যে শক্তি ছিল সম্ভবত সেটাও অনেকটা খর্ব হয়েছে। তা সত্ত্বেও সেটা লোপ পায় নি এবং স্বৈরতন্ত্র ততটা প্রবল হতে পারে নি বা তার প্রয়োজনও সেভাবে হয় নি বলে মনে হয়
আসলে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আরোপ সামাজিক অসন্তোষ এবং বৈপরীত্যের শক্তি ও প্রবণতাকে অবদমিত রাখার জন্য প্রধান প্রভাবক হিসাবে কাজ করেছে যে কথাটা একটু আগে আমরা বলেছি। সভ্যতার শক্তি যতদিন নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সজীবতা ও শক্তির কারণে প্রবল ছিল ততদিন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য তেমন কোন বিপদ ছিল না। এই অবস্থা চলেছে আনুমানিক পাঁচ বা সাতশত বৎসর। তারপর যখন পূর্বে আলোচিত বিভিন্ন কারণে সভ্যতাকে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আর এগিয়ে নিতে বা ধারণ করতে পারে নি ফলে দেখা দিয়েছে সভ্যতায় সংকট তখন নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে সভ্যতার আধিপত্যকারী ও নিয়ন্ত্রণকারী শ্রেণীগুলির বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে এবং একটা বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে সভ্যতার চূড়ান্ত অবসান হয়েছে।
তবে সভ্যতার ধ্বংসের জন্য বৈদিক আন্দোলনকে সেভাবে দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও সংকট এই ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার অবসানের

_________________________________________________________________________________
হরপ্পান পর্যায়ে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে সমাজের সকল স্তরে সম্পদের সুষম বন্টনের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো সহ অন্যান্য হরপ্পান বসতিতে ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র নগর বা শহরের বিশেষ কোন ভবনে না থেকে সকল স্থানে সমানভাবে পাওয়া গেছে। এই বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে সমাজে গণতন্ত্র ও ধনী-দরিদ্রের ন্যূনতম ব্যবধান নির্দেশ করে। শেফার এ সম্পর্কে জানাচ্ছেন :
‘Fentress states that the highest frequency of metal objects was in the habitation area at Mohenjodaro -- not in the high mound with all of its public or monumental architectural units. Similarly, at Harappa, Fentress states that metal artifacts are relatively evenly distributed throughout the city rather than being concentrated in any particular area. At Allahdino, as at Harappa, metal artifacts were found distributed throughout the site in a variety of contents : inside structures and outside structures (in streets, drain and trash deposits). Even a gold, silver and carnelian beaded belt crammed into a small, plain red jar was located on the floor of a structure. At present there appears to be no definite association of metal artifacts with any particular area of a Harappan site or type of architecture within a particular site.’ Jim G. Shaffer, ‘Harappan Culture : A Reconsideration,’ Harappan Civilization: A Recent Perspective, (1993), p. 47.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৮৮


প্রায় সব শর্ত পূরণ করেছিল। সভ্যতায় ধ্বংস ও ক্ষয় শুরু হয়েছিল। বৈদিক আন্দোলন ও যুদ্ধ সম্ভবত ধ্বংসটাকে ত্বরান্বিত করেছিল এবং তাকে একটা বিশেষ গতিপথ এবং অভিমুখ দিয়েছিল। সভ্যতার ধ্বংসে এর বেশী ভূমিকা তার ছিল না।
বৈদিক আন্দোলনের স্বরূপ এবং তাৎপর্য অনুধাবনে লেখকদের যেসব ভুলের সঙ্গে আমরা পরিচিত তার জন্য আংশিকভাবে ঋগ্বেদও দায়ী। অবশ্য তার যাযাবর এবং বহিরাগত হানাদার উৎসতত্ত্ব নেহায়েতই একদল পাশ্চাত্য পণ্ডিত এবং তাদের অন্ধ অনুসারী উপমহাদেশীয় পণ্ডিতদের একান্ত কষ্টকল্পিত। কিন্তু এছাড়াও ঋগ্বেদে যুদ্ধকে যেভাবে উপস্থিত করা হয়েছে, যেভাবে নগর বিদারণ এবং শত্রুবধের কথা বলা হয়েছে তাতে মনে হওয়া একান্ত স্বাভাবিক যে, বৈদিকরা বুঝি বিশাল ও ভয়ঙ্কর এবং সর্বধ্বংসী এক গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি করেছিল। আমরাও ঋগ্বেদ আলোচনায় বৈদিক যুদ্ধের উপর যে গুরুত্ব দিয়েছি তাতে পাঠকের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি হতে পারে।  
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৈদিক যুদ্ধকে অন্যান্য যুদ্ধ নির্ভর সমাজের যুদ্ধের মত অত প্রচণ্ড, হিংস্র এবং ধ্বংসাত্মক মনে করার কারণ নেই। সরস্বতী-সিন্ধু উপত্যকার প্রধানত শান্তিপূর্ণ ও অহিংস সমাজে একটি সাধারণ যুদ্ধও যে অনেক বেশী বিশালতা, প্রচণ্ডতা এবং ভয়াবহ রূপ নিয়ে জনকল্পনায় ধরা দিবে সেটা একান্ত স্বাভাবিক। আমদের দৃঢ় ধারণা বৈদিক যুদ্ধকে যে রকম মনে হয় সে রকম নগরধ্বংসী এবং হিংস্র ছিল না। যদি তা হত তবে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের সমাপ্তির সময় সিন্ধু সভ্যতার সর্বত্র ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ডের প্রমাণ বা চিহ্ন পাওয়া যেত। কিন্তু যেটুকু হত্যা এবং ধ্বংসের চিহ্ন পাওয়া গেছে তা তুলনায় নগণ্য। বরং এটাই মনে হয় যে, সাধারণভাবে নগরগুলি পরিত্যক্ত হয়েছিল যার প্রধান কারণ নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং জলাভাব, সেটা নদী নিয়ন্ত্রণের কারণে হোক অথবা তার ধ্বংসের কারণে হোক। ব্যাপক কোন ধ্বংসকাণ্ড ছাড়াই শহর এবং বসতিগুলি পরিত্যাগের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যকে আমাদের গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, ঋগ্বেদে ইন্দ্র কর্তৃক হত যেসব শত্রুর নাম খুব বেশী বার বলা হয়েছে তার সবগুলিকে ব্যারেজ হিসাবে বোঝা যায়। অর্থাৎ ঋগ্বেদে ইন্দ্র কর্তৃক যেসব প্রবল শত্রু বধের কথা খুব বেশী গৌরব করে বার বার বলা হয়েছে সেগুলি বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন ব্যারেজের নাম। বৃত্র বা অহি ব্যারেজ-বাঁধের সাধারণ নাম। কিন্তু নির্দিষ্ট ব্যারেজ এবং স্লুইস গেটের যে নির্দিষ্ট নাম দেওয়া হয়েছে সেটা বোঝা যায়। বিষয়টি কিছুটা স্পষ্ট করার জন্য আমরা সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি:
‘ইন্দ্র যুদ্ধে আর্য যজমানকে রক্ষা করেন। অসংখ্যবার রক্ষাকারী ইন্দ্র সমস্ত যুদ্ধে তাকে রক্ষা করেন। সুখপ্রদ সংগ্রামে তাকে রক্ষা করেন। ইন্দ্র মানুষের জন্য ব্রতরহিত ব্যক্তিদের শাসন করেন। তিনি কৃষ্ণের কৃষ্ণত্বক উন্মোচন করে তাকে বধ করেন, তিনি তাকে ভস্মীভূত করেন। তিনি সমস্ত হিংসকদের এবং সমস্ত নিষ্ঠুর ব্যক্তিদের দগ্ধ করেন।’ (১/১৩০/৮)
‘ইন্দ্র বললেন, দ্রুতগামী কৃষ্ণকে দেখতে পেলাম, সে অংশুমতী নদীর গূঢ় স্থানে বিস্তৃত প্রদেশে বিচরণ করছে ও সূর্যের ন্যায় অবস্থিতি করছে। হে অভিলাষপ্রদ মরুৎগণ!  

পাতা: ১৮৯


আমি ইচ্ছা করি, তোমরা যুদ্ধ কর এবং যুদ্ধে তাকে সংহার কর।’ (৮/৯৬/১৪)।
১/১৩০/৮ ঋকে কৃষ্ণের কৃষ্ণত্বক উন্মোচন করে তাকে বধ এবং ভস্মীভূত করা তাৎপর্যপূর্ণ। আরও বেশী তাৎপযপূর্ণ ৮/৯৬/১৪ ঋকে অংশুমতী নদীর গূঢ়স্থানে কৃষ্ণের বিচরণ। কারণ এটা নদীর গভীরে বা জলের তলায় কৃষ্ণের অবস্থান বুঝাচ্ছে। নদীর গূঢ়স্থানে বিস্তৃত প্রদেশে বিচরণ বলতে সেখানে জলের ভিতরে থেকে স্লুইস গেট বা জলকপাট দ্বারা জল নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হচ্ছে বলে বোঝা যায়। সুতরাং কাঠের তৈরী জলকপাট এবং স্থাপনা ধ্বংস এবং আগুন দিয়ে পোড়ানোর বিবরণ আমরা পাচ্ছি উপরোক্ত ঋক দুইটি থেকে। অনুমান করা চলে যে, জলের নীচে থেকে যাতে সহজে ও দ্রুত পচে না যায় সেই জন্য কাঠের স্তম্ভ এবং জলকপাট বা তক্তাগুলিতে গাব ফলের রস বা আলকাতরা জাতীয় কালো পদার্থ লেপন করে এগুলিকে জলরোধক করে দীর্ঘস্থায়িত্ব দেওয়া হত। সুতরাং ঋগ্বেদে কয়েকটি ক্ষেত্রে ইন্দ্রের কৃষ্ণ বা কৃষ্ণত্বকের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ পেয়ে থাকতে পারে বলে এমন কথাও ঋগ্বেদে এসেছে : ‘যেকৃষ্ণবর্ণ চর্মকে ইন্দ্র দেখতে পারেন না তার ক্ষমতাবলে সে কৃষ্ণবর্ণ চর্মকে ভূ-লোক ও দ্যুলোক হতে দূর করে দেয়’ (৯/৭৩/৫) ।  
ইন্দ্রের এক প্রবল শত্রু শুষ্ণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে : ‘হে ইন্দ্র ! তুমি ভয়ানক শুষ্ণকে আক্রমণ করেছ এবং তাকে বধ করে কুৎসকে স্বগৃহে নিয়ে গিয়েছ’ (৫/৩১/৮)। ‘হে ইন্দ্র ! হে কুৎস! ..... তোমরা শুষ্ণকে তার আবাসভূত জল হতে দূরীভূত করেছ’ (৫/৩১/৯)।
৫/৩১/৯ ঋক থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, ভয়ানক ও প্রবল শত্রু শুষ্ণ জলকপাট সমন্বিত ব্যারেজ মাত্র। নিম্নলিখিত ঋকটিও সেকথা জানায় : ‘জলপূর্ণ মেঘের বিদারণকারী বজ্রধর ইন্দ্র বজ্র দ্বারা বলবান শুষ্ণকে বধ করেছিলেন; শুষ্ণ বৃত্রাসুরের ক্রোধ হতে উৎপন্ন হয়ে অন্ধকারে বিচরণ করত: বারিপূর্ণ মেঘকে রক্ষা করত এবং এই সকল জীবিত প্রাণীর খাদ্য আত্মসাৎ করে উল্লসিত হত’ (৫/৩২/৪)।
এবার আমরা আর একটি বিবরণ দেখি :
‘কুযব পরের ধন জানতে পেরে স্বয়ং অপহরণ করে, জলে বর্তমান থেকে স্বয়ং ফেনযুক্ত জল অপহরণ করে। কুযবের দু’ভার্যা সে জলে স্নান করে, তারা যেন শিফা নদীর গভীর নিম্নভাগে হত হয়’ (১/১০৪/৩)।
সুতরাং আমরা কুযব নামে আরেক ব্যারেজের সন্ধান পাচ্ছি। কুযবের দু’ভার্যা বলতে সম্ভবত ব্যারেজের দুইটি জলকপাট বোঝানো হচ্ছে। অবশ্য নদী প্রবাহ বা স্রোতধারাকেও অনেক সময় ভার্যা বা পত্নী বলা হয়েছে : ‘ইন্দ্র দাস স্বরূপ বৃত্রের পত্নী বারিসমূহকে জয় করেছিলেন’ (৫/৩০/৫)। কিন্তু এখানে কুযবের দুই ভার্যা বলতে দুইটি কৃত্রিম খাল বা জলধারা না বুঝিয়ে সম্ভবত জলকপাট বোঝাচ্ছে। সম্ভবত এটি একটি ছোট নদীর ব্যারেজের বিবরণ যার দুইটি মাত্র জলকপাট ছিল। এবার আমরা আরও একটি ঋক দেখি :
‘অযু জল মধ্যে অবস্থান করে এবং তার বাসস্থান গুপ্ত ছিল; সে শূর পূর্ব অপহৃত জলের

_________________________________________________________________________________
কুৎস একজন বৈদিক রাজা এবং ঋষি।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৯০


সাথে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং বিরাজ করে। অঞ্জসী, কুলিশী ও বীরপত্নী নদীত্রয় স্বকীয় জল দিয়ে তাকে প্রীত করে জল দ্বারা তাকে ধারণ করে’ (১/১০৪/৪)।
অযু নামক ব্যারেজকে যে পলি সঞ্চয়ের ফলে ক্রমাগত উঁচু করতে হয়েছে উপরোক্ত ঋক থেকে সে কথা অনুমান করা যায়। কুৎস ঋষি যখন ১/১০৪ সূক্তটি রচনা করেন তখন তাঁর এলাকার বাঁধ-ব্যারেজ অক্ষত ছিল এবং শত্রুরা প্রবল ছিল বলে বোঝা যায়। কারণ ১/১০৪/৫ ঋকে ঋষি বলছেন : ‘হে মঘবন! সে শত্রুর পুন: পুন: কৃত উপদ্রব হতে আমাদের রক্ষা কর’ (১/১০৪/৫)। এবং ১/১০৪/৮ ঋকে ঋষির আর্ত প্রার্থনা প্রণিধানযোগ্য: ‘হে ইন্দ্র! আমাদের বধ করো না, আমাদের পরিত্যাগ করো না, আমাদের প্রিয় আহার উপভোগাদি কেড়ে নিও না। হে মঘবন শক্র! গর্ভস্থিত আমাদের অপত্যদের নষ্ট করো না, যারা জানু দ্বারা চলে এরূপ গমনসমর্থ অপত্যদের নষ্ট করো না’ (১/১০৪/৮)।
যাইহোক, এই আলোচনা থেকে যে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে তা হল বিভিন্ন ব্যারেজের ভিন্ন ভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ বৃত্র বা অহি বাঁধ-ব্যারেজের সাধারণ নাম। তবে জলকপাট যুক্ত যেসব ব্যারেজ বা নদীনিয়ন্ত্রণ স্থাপনা ছিল সেগুলির প্রত্যেকটির আলাদা নাম ছিল। হতে পারে যে, বৈদিক ঋষিগণ ঘৃণা এবং বিদ্বেষ প্রকাশক শব্দ হিসাবে নামগুলো দিয়েছিলেন। যেমন কুযব নামের অর্থ স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এর আক্ষরিক অর্থ মন্দ যব। কিন্তু এটা ফসলহানি বা মন্দ ফসলের রূপক।  
প্রাচীন বেদভাষ্যকারগণ একটি বিষয় সঠিকভাবে ধরেছিলেন যে, বৃত্র, অহি, শুষ্ণ, নমুচি, পিপ্রু, শম্বর, উরণ, কুযব, বর্চী, অর্বুদ প্রভৃতি দানব। সায়ণ এদের দনুপুত্র দানব বলেছেন। বৃত্র এবং অহি যদি বাঁধ-ব্যারেজের সাধারণ নাম হয় তবে বাকীগুলির মধ্যে  শুষ্ণ, নমুচি, শম্বর, পিপ্রু ইত্যাদি সম্ভবত খুব বড় বা প্রধান কয়েকটি ব্যারেজের নাম।
অবশ্য এই প্রসঙ্গে এমন সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না যে, বৈদিক পক্ষ কোন একজন বিশিষ্ট শত্রু নেতার নামে ব্যারেজ বা জলকপাটেরও নামকরণ করত। এ দিয়ে একসঙ্গে দুইটি উদ্দেশ্য পূরণ করতে চাওয়া হতে পারে। হয়ত ধারণা করা হত যে, যখন ব্যারেজ ধ্বংস এবং জলকপাট দগ্ধ করা হবে তখন ঐ নামীয় শত্রুও মৃত্যুবরণ করবে। বস্তুত শক্তিশালী শত্রুবধের তুলনায় রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে কোন একটি ব্যারেজ ধ্বংস করা অনেক সহজ কাজ। আবার অভিন্ন নামীয় শত্রুকে কোনভাবে হত্যা করা গেলে ব্যারেজ ধ্বংসও সেই একই ধারণা অনুযায়ী সহজ মনে করা হতে পারে। এটা প্রাচীন যাদু বিশ্বাস অনুযায়ী কারও কুশপুত্তলিকা দাহ কিংবা তাকে শলাকাবিদ্ধ করার মত হতে পারে। যাইহোক, এটা এখন একটা অনুমান মাত্র। তবে শুষ্ণ, শম্বর ইত্যাদি নামে যদি শত্রু নাও থেকে থাকে তবু ব্যারেজগুলির এই নামকরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া চলে ঋগ্বেদের বহুসংখ্যক মন্ত্রে তাদের সম্পর্কে বর্ণনার ধরন থেকে।
তাহলে আমরা দেখছি যে, বৈদিক শক্তি বিভিন্ন বাঁধ-ব্যারেজের ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করে সেগুলি ধ্বংস করার জন্য সেগুলির সংরক্ষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ঋগ্বেদের যুদ্ধ তো মূলত মানুষ করে না ! দেবতারা করে! তাই বৈদিক পক্ষেও রাজা বা সেনাপতিদের

পাতা: ১৯১


যুদ্ধের কৃতিত্ব উল্লেখ করা হয় না। তাদের যুদ্ধের বিবরণও সাধারণত দেওয়া হয় না। কারণ তা দিলে তো দেবতাদের কৃতিত্ব কমবে। ফলে কমবে ধর্মসংস্কারক ও মন্ত্র রচয়িতা বৈদিক ঋষিদের কৃতিত্ব। কাজেই বলা হয় অমুককে দেবতা শত্রুসেনার হাত হতে রক্ষা করেছেন অথবা অমুকের সহায় হয়ে দেবতা অমুক দাস বা দস্যু বা রাক্ষস শত্রুকে বধ করেছেন। কাজেই বলা হয় :
‘হে অধ্বর্যুগণ! শত্রুহননকারী যে ইন্দ্র ভূমির ক্রোড়ে শত সহস্র অসুরকে পাতিত করেছিলেন এবং যে ইন্দ্র কুৎস, আয়ু ও অতিথিগ্বেবের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বধ করেছিলেন, সে ইন্দ্রের জন্য সোম আহরণ কর’ (২/১৪/৭)। কিংবা ‘হে ইন্দ্র! তুমি কুৎসের জন্য সুখরহিত শুষ্ণকে বধ করেছিলে, দিবসের প্রারম্ভে কুযবকে বিনাশ করেছিলে এবং বহুজন পরিবৃত হয়ে সে সময়েই বজ্র দ্বারা দস্যুদের বিনাশ করেছিলে’ (৪/১৬/১২)। অথবা
‘হে ইন্দ্র! ......... তুমি শত শত ও সহস্র সহস্র শম্বর সৈন্য বিদারিত করেছ; পর্বত হতে নির্গত শম্বরকে বধ করেছ এবং বিচিত্র রক্ষা দ্বারা দিবোদাসকে রক্ষা করেছ’ (৬/২৬/৫)।
আবার ইন্দ্র ‘দভীতি রাজার নিমিত্ত চুমুরিকে বধ’ (৬/২৬/৬) করেছেন বলা হচ্ছে। অবশ্য স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এমন কিছু সংখ্যক মানুষ-শত্রুর নামও ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। তবে ঋগ্বেদে বৈদিক পক্ষে অনেক রাজা, ঋষি বা রাজর্ষির নাম পাওয়া গেলেও মানুষ হিসাবে শত্রুদের নাম তুলনামূলকভাবে কম। বোঝা যায় যুদ্ধের মূল অভিমুখ বাঁধ ধ্বংস হওয়ায় এবং যুদ্ধটাকে দেব-দানবের মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ হিসাবে দেখাবার প্রয়োজনবোধ থেকে মানুষকে সেভাবে সামনে আনা হয় নি অথবা শত্রুপক্ষে ব্যক্তির ভূমিকা গৌণ ছিল।
ঋগ্বেদ থেকে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় বাঁধ ও ব্যারেজের গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভব করতে পারি। খাল খনন করে নদীর জলপ্রবাহ নিয়ে যাওয়া, নদীর দুই পাড় বরাবর বাঁধ দিয়ে বন্যা প্রতিরোধ ইত্যাদি প্রাচীন মানুষের নিকট অস্বাভাবিক কিংবা অজানা কোনটাই ছিল না। কিন্তু প্রাচীন মানুষের নিকট এক ব্যতিক্রমী ঘটনা হল জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ দিয়ে নদীকে রোধ করে তার প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং এইভাবে বিভিন্ন কৃত্রিম খাল দিয়ে তাকে বিভিন্ন দূরবর্তী স্থানে ইচ্ছানুরূপ পাঠানো এবং সেইসব খালের জলপ্রবাহও ছোট ছোট আরও অসংখ্য জলকপাট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়াও হয়ত ছিল জলকপাট সংযুক্ত বিশাল সব জলাধারে জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা। বস্তুত সেকালে মানুষের দৃষ্টিতে এই সমগ্র ঘটনা ছিল মহাবিস্ময়।
সব সভ্যতা তার নির্মাণে কিছু দর্শনীয় বৈশিষ্ট্য উপস্থিত করে যা সভ্যতার এবং সেই সঙ্গে তার নির্মাতা-নিয়ন্ত্রক-শাসকদের ক্ষমতাকে প্রকাশ করে। সেটা হতে পারে পিরামিড নামক মহাকায় সমাধি সৌধ অথবা হতে পারে মহাকায় মন্দির বা বৃহৎ প্রতিমা, হতে পারে শূন্যোদ্যান বা রাজপ্রাসাদ বা এ ধরনের কিছু। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় আমরা মহাকায় সৌধ বা নির্মাণ দেখি না।
অথচ এই সভ্যতার আয়ত্তে ছিল অসাধারণ কৃৎকৌশল বা প্রযুক্তি বিদ্যা এবং

পাতা: ১৯২


সৌন্দর্যবোধ। শুধু উন্নত নগর পরিকল্পনা এবং সর্বত্র সভ্যতার বস্তুগত প্রকাশে বিভিন্নতার সঙ্গে আশ্চর্য রকম সমরূপতা বিস্ময় জাগায় না, তার সিলগুলিও বিস্ময়কর সৌন্দর্যবোধ, নিপুণতা এবং কারিগরী দক্ষতার পরিচায়ক। এখনও সেগুলির লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় এই সিলগুলি নিয়ে কৌতূহল এবং রহস্যের শেষ নেই। কি কাজে লাগত এগুলো তার সহজ কোন উত্তরও জানা নেই।
কোন কোন লেখক মনে করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার সিলগুলি সেই সভ্যতার শাসক, প্রশাসক এবং ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করত। সিলগুলি প্রায় সব পাওয়া গেছে নগরে বা শহরে। এ থেকে এগুলির নাগরিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝা যায়। কেউ কেউ মনে করেন এগুলির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আছে। কিন্তু সিন্ধুর নিরাকার দেবতা পূজার সঙ্গে প্রাণীর চিত্র সম্বলিত সিলের সম্পর্ক থাকার কথা নয়। ঋগ্বেদেও সিলের উল্লেখ আমরা পাই নি। এটা যদি প্রাচীন ধর্মের অংশ হত তবে বৈদিক ঋষিরা এ ব্যাপারে কিছু বলতেন। আর এটাও লক্ষণীয় যে, পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের পর থেকে সিলের ব্যবহার দ্রুত শেষ হয়। অর্থাৎ সিল যে সভ্যতার বস্তুগত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল আমরা তেমন ধারণা করতে পারি। অনেক লেখক মনে করেন এগুলি বাণিজ্যের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হত যেমন মেসোপটেমিয়ায় দেখা যায়। এই সম্ভাবনা বেশী মনে হয়। রাষ্ট্রীয় কিছু কাজের সঙ্গেও সিলের সম্পর্ক থাকতে পারে।
আমরা মনে করি যে, সিল ব্যক্তির ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু সভ্যতার বা রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতীক তা নয়। কারণ এটা স্বাভাবিক যে, অত বিশাল এবং প্রবল এক সভ্যতা কোথাও না কোথাও কোনও না কোনওভাবে আর সব প্রবল সভ্যতার মত তার ক্ষমতার প্রকাশ স্বরূপ বৃহৎ নির্মাণ করবে যার বিশালতা অথবা প্রবল প্রকাশের সামনে দর্শকরা বিস্ময় বিহ্বল এবং অভিভূত হবে।
অর্থাৎ সভ্যতা গড়তে একটা কেন্দ্রীয় সামাজিক শক্তি বা শ্রেণী চাই যার কিছু বিশাল নির্মাণ থাকবে তার এবং সেই সঙ্গে সভ্যতারও ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতীক হিসাবে। মিসরে ফারাও এবং পুরোহিত শ্রেণী এমন এক ধর্মের সাহায্যে রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মাণ করেছিল যার মূল প্রেরণা ছিল মৃত্যুর পর সমাধিস্থ দেহের পুনরুজ্জীবন লাভ। এ থেকে সভ্যতা সমাধি নির্মাণে তার বিপুল শক্তি নিয়োজিত ও নি:শেষ করেছিল। ফলে তৈরী হয়েছে পিরামিড। মেসোপটেমিয়াতেও ধর্ম ছিল সুমেরিয়ানদের কেন্দ্রীয় শক্তি। সেখানে মন্দির এবং দেবতা ছিল যাকে কেন্দ্র করে নগর-রাষ্ট্রগুলি গড়ে উঠেছিল। পুরোহিতরা দেবতাদের নামে নগর-রাষ্ট্রগুলিকে পরিচালনা করতেন। জিগ্গুরাট নামে পরিচিত দেবতা মন্দিরগুলি ছিল বিশাল স্থাপনা। মধ্যযুগে মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে আমরা মসজিদ এবং শাসকদের প্রাসাদ অথবা সমাধিতে বিশাল স্থাপনা দেখতে পাই। আধুনিক সভ্যতায়ও এর ব্যতিক্রম
_________________________________________________________________________________
দেখুন: S. R. Rao, ‘New Light on Indus Script and Language’, in, Frontiers of the Indus Civilization (1984), p. 197.
_________________________________________________________________________________


পাতা: ১৯৩


নেই। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস বা স্ট্যাচু অব লিবার্টি, ব্রিটেনের বাকিংহাম প্যালেস, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, রাশিয়ার ক্রেমলিন, অথবা যে কোথায়ও বাণিজ্যিক ভবন, বিমানবন্দর ইত্যাদি যাই হোক না কেন।
কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় বিস্ময়করভাবে তা নেই। অর্থাৎ ভূমির উপরে তেমন কোন নির্মাণ আমাদের সামনে নেই যা তার মহাকায় কাঠামো দিয়ে মানুষের মনকে অভিভূত করতে পারে। তবে আমরা যদি উচ্চ ভূমি ছেড়ে নদী খাতের দিকে দৃষ্টি দিই তবে হয়ত ভিন্ন এক বিস্ময়ের সম্মুখীন হব। আমরা অনুমান করতে পারি প্রাচীন মিসরের মহাকায় পিরামিড বা প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অতিকায় মন্দিরগুলির তুলনায় সিন্ধু সভ্যতার বিশাল বাঁধ এবং জটিল জলকপাটগুলি প্রাচীন মানুষের কাছে কম বিস্ময়ের ছিল না, বরং অনেক বেশীই হবার কথা। কারণ আর কোন সভ্যতাই এভাবে প্রকৃতির প্রচণ্ড শক্তিকে লাগাম পরিয়ে এবং পোষ মানিয়ে বহু শতাব্দী ধরে সভ্যতা নির্মাণ ও সম্প্রসারণের কাজে লাগাতে পারে নি। মহাকায় পিরামিড কিংবা জিগ্গুরাট প্রাচীন মানুষের বিরাট বিস্ময়, ভক্তি এবং এগুলির নির্মাতা এবং অধিকারী শাসক শ্রেণীর প্রতি ভয় ও ভক্তি মিশ্রিত আনুগত্য সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সপ্তসিন্ধুর নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দূরবিস্তারী আয়োজন ছিল সেগুলির চেয়ে অনেক বেশী বিস্ময়কর এবং ভীতিজনক। উপরন্তু বাঁধ-ব্যারেজের উপর যে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছিল তার স্পষ্ট স্বীকৃতি আমরা ঋগ্বেদ থেকেও পাই : ‘হে ইন্দ্র! যখন সেই এক দেব বৃত্র তোমার বজ্রের প্রতি আঘাত করেছিল’ (১/৩২/১২)। কিংবা ‘ইন্দ্র বৃত্রাসুরের নিবারক হয়েছিলেন’ (৮/৯৩/১৫)। অসুর মানেও দেবতা। সুতরাং যারা দৈবীকৃত এইসব বাঁধ এবং জলকপাটগুলির কার্যাবলী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করত সাধারণ মানুষের নিকট তারা মানুষের দেহধারী দেবতার মত শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে প্রতীয়মান হত। কাজেই আমরা অনুমান করতে পারি সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের প্রতীক ছিল বাঁধ-জলকপাট তথা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
আমরা ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহাসিক কালে ক্ষমতা ও শক্তির প্রতীক হিসাবে চক্রকে দেখতে পাই। অশোক স্তম্ভেও চক্র ব্যবহৃত হয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকটি সিন্ধু সভ্যতার জলকপাট নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া অসম্ভব মনে হয় না। হয়ত কাষ্ঠ নির্মিত বৃহৎ জলকপাট জলে ওঠানো-নামানোর সময় উপরে চাকার মত কোন যন্ত্র ব্যবহার করা হত। যদি তা হয়ে থাকে তবে এই চক্রের মর্যাদা ছিল বিরাট। সম্ভবত বৃহৎ কয়টি ব্যারেজের জলকপাটের নিয়ন্ত্রণ সরাসরি কেন্দ্রীয় শাসকদের হাতে থাকত। কারণ এর সঙ্গে সংযুক্ত ছিল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে জলবন্টনের মত অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। এখন এইসব জলকপাটের সঙ্গে চক্র সংযুক্ত হলে স্বাভাবিকভাবে চক্র ছিল ক্ষমতা পরিচালনা বা সঞ্চালনের একটি প্রতীক।
ঋগ্বেদের কিছু সংখ্যক মন্ত্রে ইন্দ্র কর্তৃক সূর্যের চক্র ছিন্ন করা বা নিক্ষেপ করার বর্ণনা আছে, যেমন : ‘তুমি সংগ্রামে সূর্যের চক্র ছিন্ন করেছিলে’ (৪/১৬/১২); ‘এ ইন্দ্র সূর্যের চক্র নিক্ষেপ করেছেন’ (৪/১৭/১৪), ইত্যাদি।

পাতা: ১৯৪


অবশ্য ঋগ্বেদে বর্ণিত সূর্য চক্রের তাৎপর্য সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। তবে মূল প্রসঙ্গে ফিরে আমরা বলতে পারি যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বিশেষত বড় বড় বা মূল কয়টি ব্যারেজ বা জলকপাট ছিল সিন্ধু সভ্যতার শক্তি, ক্ষমতা ও গৌরবের প্রতীক। সুতরাং বৈদিক আন্দোলন সেগুলির বিরুদ্ধে তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োজিত করেছিল। ঋগ্বেদের প্রধান শত্রু হিসাবে মানুষের নাম না এসে ব্যারেজগুলির নাম আসার তাৎপর্যও যথেষ্ট। সম্ভবত এটা ক্ষমতার প্রতীক হিসাবে মানুষ বা ব্যক্তির চেয়েও ব্যারেজের গুরুত্বকে প্রকাশ করে। হয়ত নির্বাচনমূলক শাসন ব্যবস্থায় ক্ষমতায় ব্যক্তি আসত যেত বলে তাদের গুরুত্ব সেভাবে গড়ে উঠত না। কিন্তু ব্যারেজ ছিল দীর্ঘস্থায়ী।
যাইহোক, আমাদের অনুমান সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনার তুলনায়ও অনেক বেশী বিস্ময়কর নির্মাণ হচ্ছে নদীনিয়ন্ত্রণের জলকপাট ও বাঁধ ব্যবস্থা। অর্থাৎ অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার ক্ষমতা, গর্ব এবং আড়ম্বরের প্রতীক হিসাবে মাটির উপরে যেসব মহানির্মাণ আজ অবধি দাঁড়িয়ে আছে সেগুলির চেয়েও বিস্ময়কর মহানির্মাণ সপ্তসিন্ধুর নদীখাতগুলিতে লুকিয়ে আছে। হয়ত বৈদিক আক্রমণের আঘাতে প্রধানত কাঠের তৈরী বৃহৎ সবকয়টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। তাছাড়া কাঠের কাঠামোও চার হাজার বছর মাটির নীচে টিকে থাকার কথা নয়। তবু প্রাচীন কোন নদী খাতে আজ হোক কাল হোক জলকপাট যুক্ত ব্যারেজের চিহ্ন পাওয়া যাবে বলে আমরা মনে করি। আর সেদিন ঘটবে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার ও মূল্যায়নে নূতন মাত্রার সংযোজন।
তখন এই বিষয় নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রইবে না কেন ঋগ্বেদে যুদ্ধ এবং বাঁধ ধ্বংসকে এত বড় করে এবং এভাবে উপস্থিত করা হয়েছে। এই বিষয় তখন সহজেই বোধগম্য হবে যে, প্রাচীন ঐ মহানির্মাণ যখন মরণদশায় উপনীত হয়ে অন্তত বৃহত্তর অঞ্চলের ব্যাপক সংখ্যক জনগণের জন্য সংকট ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল তখন দেবতার অধীন ঐসব স্থাপনার বিরুদ্ধে তাদের আর্তি, আকাঙ্ক্ষা, সংশয়, প্রয়োজনবোধ এবং বিদ্রোহকে ঋগ্বেদের ঋষিরা ঐ কালের জনমানসের উপযোগী করে এভাবে ভাষা দিয়েছিলেন।
কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের পর ফলাফল কি হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণে পূর্ব থেকে সভ্যতায় সংকট ঘনীভূত হয়েছিল। কোথাও বন্যা ও জলাবদ্ধতা আবার কোথাও মরুকরণ সভ্যতার বিরাট সংখ্যক মানুষকে বাধ্য করছিল সভ্যতার কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে প্রান্তে বা দূরে অভিগমন করতে। আদি হরপ্পান পর্যায় থেকেই সিন্ধু সভ্যতার দূর বিস্তারী যোগাযোগ ছিল। বিশেষত নিকটে পূর্ব দিকে ছিল উর্বর, অরণ্যময় ও জলাকীর্ণ গাঙ্গেয় উপত্যকা। সুতরাং সেখানে অনেক পূর্ব থেকে চলে আসা অভিগমন হরপ্পান পর্যায়ের শেষে এসে ব্যাপক মাত্রা পায়। বস্তুত হরপ্পান জনগোষ্ঠী যে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শেষ দিক থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় অভিগমন করছিল তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতায় সেই সময়

পাতা: ১৯৫


এমনিতেও জনসংখ্যার চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তার সঙ্গে সমাপ্তি পর্বে এসে যুক্ত হয়েছে ব্যাপকতর অভিগমন। তবে অন্যান্য দিকেও সবসময় কম-বেশী অভিগমন ঘটছিল বলে বোঝা যায়। সমুদ্র পথে দক্ষিণ আরব, পারস্য উপসাগরীয় এলাকা এবং দক্ষিণ ইরাকের সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে বাণিজ্য ও উপনিবেশ বা বসতি স্থাপনের প্রয়োজনে কিছু অভিগমন ঘটতে আমরা দেখি।
কিন্তু যখন গৃহযুদ্ধ এবং তার পরিণতিতে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়েছে তখন দ্রুত সভ্যতার পতন হয়েছে এবং চারদিকে ব্যাপক অভিগমন ঘটেছে। কারণ স্বাভাবিক নদীপ্রবাহ দিয়ে এবং নদী রোধ না করে শুধু খাল দিয়ে জল নিয়ে ব্যাপক ও উন্নত কোন কৃষি-ভিত্তিক সভ্যতা যে ঐ অঞ্চলে গড়া সম্ভব নয় তার প্রমাণ আমরা পাই ব্রিটিশ শাসন কালের পূর্ব পর্যন্ত অভিজ্ঞতা থেকে। সুতরাং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে বৈদিক পক্ষ সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের স্বাভাবিক নদী ব্যবস্থা ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জনজীবন গড়তে চাইলেও বাস্তবে আর সেটা সম্ভব হয় নি। নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের সঙ্গে বিজয়ী এবং পরাজিত উভয়ের এক দশা হয়েছে। যেহেতু বহিরাগত আক্রমণে সভ্যতার পতন ঘটে নি এবং ফলে ব্যাপক হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞও ঘটে নি সেহেতু আমরা মনে করি অভিগমন ঘটেছে দীর্ঘ সময় ধরে সংগঠিতভাবে এবং বিশাল জনসংখ্যায়। রোগে, ক্ষুধায় এবং অন্যান্য কারণে এলাকায় এবং যাত্রাপথে বহু মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। তা সত্ত্বেও ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যে দূর-দূরান্তে অভিগমন করতে সমর্থ হয়েছে তার প্রমাণ আমরা পাই এশিয়া ও ইউরোপের বিশাল অঞ্চলব্যাপী আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির বিস্তারের বিভিন্ন প্রমাণ থেকে। তবে আমরা অনুমান করি বিজয়ী বৈদিক পক্ষ প্রধানত অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী এবং উর্বর গঙ্গা উপত্যকায় অভিগমন এবং বসতি স্থাপন করেছে, অন্য দিকে পরাজিত পক্ষ প্রধানত ইরান সহ পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমের অপেক্ষাকৃত অনুর্বর এবং রুক্ষ এবং দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে অভিগমন করেছে। সুতরাং এখন আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিতে পারি।

_________________________________________________________________________________
গ্রেগরি পোসেল হরপ্পান পর্যায়ের শেষ দিকে গঙ্গা নদীর উপরের অংশে হরপ্পানদের বসতি স্থাপনের কথা উল্লেখ করেছেন। দেখুন: Gregory L. Possehl, Indus Civilization in Sourashtra, (1980), p. 18.
_________________________________________________________________________________


পাতা: ১৯৬

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ