Banner
প্রথম অধ্যায় - আর্য আক্রমণ তত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশ

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 2:00 PM, Hits: 5624

 

প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি আমাদের এই উপমহাদেশ যাকে আমরা সাধারণভাবে ভারতবর্ষ নামে জানি। ইদানীংকালে দক্ষিণ এশিয়া নামেও তার পরিচিতি বাড়ছে। এক সময় ভারত বা India নামেও তাকে অভিহিত করা হত। তবে ভারতের প্রজাতন্ত্র বা ইউনিয়ন নামে একটি রাষ্ট্র থাকায় এই নাম অনেক সময় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। কারণ এই উপমহাদেশে একটি মাত্র রাষ্ট্র নেই, বরং বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সহ কয়েকটি রাষ্ট্র আছে।
পৃথিবীর জনসংখ্যার এক ষষ্ঠাংশেরও বেশী মানুষ এই উপমহাদেশে বাস করে। বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠী, ভাষা, ধর্ম, গাত্রবর্ণ, দেহগঠন, সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তার মানুষের এই উপমহাদেশ ভূ-প্রাকৃতিকভাবেও বৈচিত্র্যমণ্ডিত। সমভূমি এবং বন্ধুর পার্বত্য ভূমি, জলাভূমি, অরণ্য এবং মরুভূমি, বন্যা এবং খরা, উত্তরে বরফ আচ্ছাদিত পর্বত শিখর ও উচ্চভূমিতে তুষারপাত আর দক্ষিণের সমভূমিতে দাবদাহ এই উপমহাদেশে পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যেতে পারে।
এমন এক বহুবিচিত্র ভূ-ভাগ এবং তার মানুষের সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের কৌতূহল ও আগ্রহের শেষ নেই। উপমহাদেশের মানুষ হিসাবে আমাদের মনে আরও বেশী কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা তার সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে। উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতি, জনগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রের অনেক বিভিন্নতা ও পার্থক্য সত্ত্বেও মানব ইতিহাসের মত উপমহাদেশের ইতিহাসেও এমন কিছু অভিন্নতা বা ঐক্যসূত্র আছে যা আমাদের নিজেদের বর্তমানকে বোঝার জন্যও উপমহাদেশের অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করতে বাধ্য করে। বিশেষত প্রাচীন কালে উপমহাদেশে যেসব সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল আজকের সমাজ ও সভ্যতা সেগুলির ঐতিহ্য কোন না কোন ভাবে ধারণ করায় আমাদের উৎস সন্ধানের জন্য আমরা সেগুলির দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হই।
প্রত্যেক সমাজ ও সভ্যতার নিজস্ব কতকগুলি বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যা থাকে। ভারতবর্ষেরও তা ছিল বা আছে। প্রত্যেক সভ্যতায় উথান এবং পতন আছে, জন্ম এবং মৃত্যু আছে, আবার বংশধারার মত তার উত্তরাধিকার আছে। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম নয়।
কিন্তু অন্য সকল সভ্যতা নিয়ে এত রহস্য এবং জটিলতা সৃষ্টি হয় নি যতটা হয়েছে ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা এবং তার ইতিহাস নিয়ে। ১৯২০-এর দশকে হরপ্পা নগর আবিষ্কারের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষের সভ্যতার প্রাচীনতাকে স্বীকার করা হত না। বলা হত খ্রী:পূ: প্রথম সহস্রাব্দ পূর্বে অথবা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি কোন এক সময় বহিরাগত আর্য আক্রমণের পর তার সভ্যতার ইতিহাস শুরু হয়েছিল।

পাতা: ৭


 

কিন্তু প্রথমে হরপ্পা এবং পরবর্তীতে মহেঞ্জোদাড়ো নামে দুইটি নগরসহ বিভিন্ন প্রাগৈতিহাসিক বসতি আবিষ্কারের ফলে সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীনতা নিয়ে আর কোন সংশয় রইল না। মিসর এবং মেসোপটেমিয়ার মত ভারতবর্ষও যে প্রাচীন সভ্যতার সূতিকাগার এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেল। কিন্তু আর্য আক্রমণ তত্ত্ব ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার মূল ভিত্তি হয়ে রইল। সিন্ধু সভ্যতার প্রাপ্ত লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের পরেও উপমহাদেশের ইতিহাসের সঠিক ব্যাখ্যা নির্মাণের সমস্যা রয়ে গেল। বরং সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর থেকে কিছু কাল পূর্ব পর্যন্ত এমন মতও জোরালোভাবে চালু হয়েছিল যে, সিন্ধু সভ্যতা বহিরাগত আর্যদের আক্রমণে ধ্বংস হয়। তবে সিন্ধু সভ্যতার ক্রমবর্ধমান আবিষ্কারগুলি এই মতকে নস্যাৎ করেছে। এটা বিস্ময়কর যে, বহু সংখ্যক প্রাচীন সাহিত্য থেকে ভারতবর্ষের সমাজ, সংস্কৃতি এবং সভ্যতা নির্মাণে যে আর্যদেরকে চিহ্নিত করা যায় মূল নির্ধারক বা চালিকা শক্তি রূপে আজ অবধি সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নির্ণয়ের মত একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে। বলা যায় এটা প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস-চর্চার ব্যর্থতা।
ইদানীং কালে কিছু সংখ্যক পণ্ডিত বলছেন যে, আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা এবং তারা এই সভ্যতার সূচনাকাল থেকে যে ধর্মগ্রন্থ রচনা করেন তা হল বেদ, বিশেষত ঋগ্বেদ। অর্থাৎ শুরু থেকে সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম ছিল বৈদিক ধর্ম। স্বাভাবিকভাবে এই তত্ত্ব বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
আমরা এই গ্রন্থে এইসব বিতর্কে বেশী না জড়িয়ে বরং ভারতবর্ষের ইতিহাসের মূল সূত্রগুলি অনুসন্ধানের উপর গুরুত্ব দিব। সে প্রসঙ্গে আমরা প্রথমে আর্য প্রশ্নটিকে বোঝার চেষ্টা করব। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিব বৈদিক আর্যদের সর্বপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ বিশ্লেষণের উপর। সিন্ধু সভ্যতা আমাদের অন্যতম প্রধান বিচার্য বিষয় হওয়ায় তার আলোচনাও গুরুত্ব পাবে। প্রাসঙ্গিকভাবে আরও বিভিন্ন বিষয়ের উপর আমরা দৃষ্টি দিতে চেষ্টা করব ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের অনেক জটিল রহস্যের আবরণ উন্মোচনের জন্য।
এক সময় আর্য জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আমাদের মনে এমন ধারণা ছিল যে, ১০০০ বা ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, কটা চোখ ও উন্নত নাক বিশিষ্ট আর্য নামে এক যাযাবর জাতি হাতে বর্শা ও তরবারী নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অংশ দিয়ে প্রবেশ করে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের পরাজিত করে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। আর্য নামে যাযাবর ও হানাদার এই জনগোষ্ঠী এখানে আসার পর উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে। এরা প্রায় একই সময়ে ইরান, মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল ও সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং সব জায়গায় একইভাবে আর্য সভ্যতা, ভাষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়।
এই ছিল ইউরোপীয় পণ্ডিতদের সৃষ্ট তত্ত্ব যা এমন এক মিথ বা অতিকথা সৃষ্টি করেছিল যে, এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে তা টিকে ছিল এবং কিছুটা

পাতা: ৮


 

পরিবর্তিত রূপ নিয়ে এখন পর্যন্ত টিকে আছে। কিন্তু প্রশ্ন হল আর্য সম্পর্কে এই অতিকথা সৃষ্টি হল কিভাবে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয়রা বাণিজ্যের প্রয়োজনে ভারতবর্ষে আসতে শুরু করার পর তাদের সাথে কিছু মিশনারীও আসতে থাকেন খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচার করার জন্য। ধর্ম প্রচারের জন্য তাঁদের স্থানীয় মানুষের ভাষা শেখার প্রয়োজন হয়। ১৬শ শতাব্দীতে তারা সংস্কৃত ভাষা শিখতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন যে সংস্কৃতের সাথে ল্যাটিন ও গ্রীক ভাষার প্রচুর সাদৃশ্য আছে। তবে ইংরেজ প্রাচ্যবিদ ও আইনবিদ (jurist)  স্যার উইলিয়াম জোনস্ই প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৭৮৬ সালে সঠিকভাবে উল্লেখ করেন যে, গ্রীক ও ল্যাটিন উভয় ভাষাই ভারতবর্ষের প্রাচীন ও পরবর্তীকালে মৃত ভাষা সংস্কৃতের বৈশিষ্ট্য বহন করছে। পরে জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ ফন্সাঞ্জ বপ ১৮১৬ সালে কর্মকারক-এর সংস্থানের তুলনার উপর ভিত্তি করে সংস্কৃতের সাথে গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান ও ইরানী ভাষার সম্পর্ক দেখান। ডেনমার্কের ভাষাতত্ত্ববিদ রাসমুস রাস্ক ১৮১৪ সালে জার্মান ভাষার সাথে ল্যাটিন, গ্রীক, স্লাভিক ও বাল্টিক ভাষার মিল দেখান। এরপর ১৮২২ সালে গ্রীম ভ্রাতৃদ্বয়ের বড়জন জ্যাকব গ্রীম ভাষাতত্ত্বের উপর আরও কাজ করেন। ভাষাতত্ত্বের এই ধারায় আরও কাজ করেন অগাস্ট শ্লেইশার, কার্ল ব্রুগম্যান, প্রভৃতি পণ্ডিত। ১৮৪৫ সালে জার্মান পণ্ডিত এ, কুন (A. Kuhn) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Zur ältesten Geschichte der indogermanischen Völker (On the Most Ancient History of the Indo-European Peoples) প্রকাশ করার পর ভাষাতত্ত্বের সাথে প্রথম আর্য (ইন্দো-জার্মান) প্রশ্নটি যুক্ত হয়। বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্স মুলার একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেন। অন্যদিকে কাউন্ট জোসেপ আর্থার দ্য গোবিনিউ নামে এক ফরাসী পণ্ডিত ১৮৫৪ সালে তাঁর লেখা এক বইয়ে বললেন যে, আর্য একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বা ‘রেস’০এবং এটি সকল জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তিনি অন্যান্য শ্বেত বর্ণের জনগোষ্ঠীর মধ্যেও আর্যদের শ্রেষ্ঠ হিসাবে মত দিলেন। এই তত্ত্ব জার্মানীতে পণ্ডিতরা খুবই উৎসাহের সাথে গ্রহণ করেন। নানা পণ্ডিতের নানা মতের মধ্যে এই মতটাই জার্মানীতে প্রবল হল যে আর্যরা হল নর্ডিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মানুষ (জার্মানরা নিজেরাও নর্ডিক জনগোষ্ঠীর)। পরে বিংশ শতাব্দীতে এসে জার্মানীর এই প্রবল মতটি হিটলার গ্রহণ করেন এবং অন্য সকল জাতির উপর জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেরণা সৃষ্টির কাজে লাগান। তবে তিনি আর্য জাতির শত্রু হিসাবে সেমিটিক জাতিকে চিহ্নিত করেন এবং যুদ্ধের সময় জার্মানী ও অধিকৃত বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ইহুদী জনগোষ্ঠীর মানুষের উপর ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা শেষ হবার পর আর্য বিষয়ে ‘রেসিয়াল’মতবাদ নিয়ে তেমন মনোযোগ দিতে কাউকে দেখা যায় না। কারণ এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার ফলে পৃথিবীব্যাপী কোটি কোটি মানুষকে মূল্য দিতে হয়েছিল। এরপর থেকে আর্য সম্পর্কিত জাতিতাত্ত্বিক মতবাদ একেবারে বাতিল হয়ে গেছে বলা যায়। তবে বহু প্রাচীনকালে এক ভাষাগোষ্ঠী থেকে যে এশিয়া-ইউরোপের বহু সংখ্যক ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব বা বিকাশ হয়েছে সেই বিষয়ে সংশয় থাকে নি।

পাতা: ৯


 

যাইহোক, আর্যতত্ত্ব প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় ভিত্তি ছিল ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের উপর ইউরোপীয় পণ্ডিতদের কাজ। ভারতবর্ষের পবিত্র ও মৃত ভাষা সংস্কৃতের সাথে গ্রীক ও ল্যাটিন সহ ইউরোপীয় অন্যান্য ভাষার মিলের উপর ভিত্তি করে ইউরোপের পণ্ডিতরা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নামে ভাষাতত্ত্বের একটি শাখা তৈরী করলেন। আমাদের আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার প্রয়োজনে নীচে একটি তালিকায় বিষয়টি দেখানো হল :

 

বাংলা - আমি অর্থে সংস্কৃত - অহম, গ্রীক- এগো (ego), ল্যাটিন - এগো (ego), গথিক - ইক (ik), জার্মান - ইখ (Ich),  আবেস্তান বা প্রাচীন ইরানীয় আযেম (azem), ইংরাজী - আই (I)।

 

বাংলা - মানব বা মানুষ অর্থে সংস্কৃত - মনু, মানব, মনুষ্য, ডাচ - ম্যান (man),  জার্মান - মান (mann),  প্রাচীন ইংরাজী - ম্যান (mann),  ইংরাজী - ম্যান (man)।

 

বাংলা - পিতা, সংস্কৃত - পিতৃ, গ্রীক - পতের (pater), ল্যাটিন - পতের (pater) জার্মান - ফাটার (vater), প্রাচীন ইংরাজী - ফয়েডার (foeder), ইংরাজী - ফাদার (father)।

 

বাংলা - মাতা, সংস্কৃত - মাতৃ, ডাচ - মোয়েডার (moeder), ল্যাটিন - মতের (mater), জার্মান - মুটার (mutter), প্রাচীন ইংরাজী - মোডোর (modor), ইংরাজী - মাদার (mother)।

 

বাংলা - ভাই বা ভ্রাতা, সংস্কৃত - ভ্রাতৃ, ল্যাটিন - ফ্রাতের (frater), জার্মান - ব্রুডার (bruder) আবেস্তান - ব্রাতার (bratar),  ইংরাজী - ব্রাদার (brother)।

 

বাংলা - কন্যা বা দুহিতা, সংস্কৃত - দুহিতৃ, জার্মান –  টখ্টার (tochter), প্রাচীন ইংরাজী - ডোহ্টর (dohtor), ইংরাজী - ডটার ((daughter)„

 

বাংলা - এক, সংস্কৃত - এক, আবেস্তান - অয়েব, (aeva), ফার্সী - যক, গ্রীক - ওইস (ois), ল্যাটিন - অয়েকুস (aequu-s), ফরাসী - আঁ (un),  ইংরাজী - ওয়ান (one) ।

 

বাংলা - দুই, সংস্কৃত - দ্বি, গ্রীক - দুও (duo),, গথিক - টোয়াই ((twai),  প্রাচীন ইংরাজী - টোয়া ((twa),  ফরাসী - দো (deux), ইংরাজী - টু (two)।

পাতা: ১০

 


বাংলা - তিন, সংস্কৃত - ত্রি, গথিক - থ্রেইস (threis), জার্মান - দ্রাই (drei),  ল্যাটিন - ত্রেস (tres), ত্রিয়া (tria),  গ্রীক - ত্রেইস (treis),  ত্রিয়া - (tria),  ইংরাজী - থ্রি (three)„ ।
বাংলা - ছয়, সংস্কৃত - ষষ্, জার্মান - জেক্স্ (sechs),  ল্যাটিন - সেক্স  ((sex),  গ্রীক - হেক্স (hex), প্রাচীন ইংরাজী - সিয়েক্স (siex), ফরাসী - সিস্  (six),  ইংরাজী - সিক্স  (six)„
বাংলা - সাত, সংস্কৃত - সপ্ত, গ্রীক - হপ্ত (hapta), জার্মান - জিবেন (sieben),  প্রাচীন ইংরাজী - সিয়েফন (seafon),  ফরাসী - সেৎ (sept),  ইংরাজী - সেভ্ন্ (seven)„ ।
বাংলা - আট, সংস্কৃত - অষ্ট, জার্মান - আখ্ত্ (acht)„
বাংলা - নয়, সংস্কৃত - নবন, ল্যাটিন - নভেম (novem),  প্রাচীন ইংরাজী - নিগন (nigon), ফরাসী - নফ (neuf),  ইংরাজী - নাইন (nine)।
বাংলা - দশ, সংস্কৃত - দশন, জার্মান - সেন (zehn), ল্যাটিন - দেসেম (decem), গ্রীক - দেকা (deka),  ফরাসী - দিস (dix),  ইংরাজী - টেন (ten)।
বাংলা - শত, সংস্কৃত - শতম, আবেস্তান - সতম, ল্যাটিন - সেন্টাম (centum)।
বাংলা - বিধবা, সংস্কৃত - বিধবা, ল্যাটিন - ভিদুয়া (vidua), ইংরাজী - উইডো (widow)।
বাংলা - বীর, সংস্কৃত - বীর, গ্রীক - হেরস (heros), ল্যাটিন - ভির (vir), ইংরাজী - হিরো (hero)।
বাংলা - সম্মুখস্থ, সংস্কৃত - পুরস্, গ্রীক ও ল্যাটিন - প্রো (pro), জার্মান - ফোর (vor), ইংরাজী - ফোর (fore)।
বাংলা - আগুন, সংস্কৃত - অগ্নি, ল্যাটিন - ইগনিস (ignis), ইংরাজীতে আগ্নেয় - ইগনিঅ্যাস (igneous)  এবং প্রজ্বলিত করা বা হওয়া অর্থে ইগনাইট (ignite)„
বাংলা - গরু, সংস্কৃত - গো বা গৌস্, জার্মান - কু (kuh),  ইংরাজী - কাউ (cow)।
বাংলা - দুয়ার বা দরজা, সংস্কৃত - দ্বার, জার্মান ট্যুর্() ( tür), ইংরাজী - ডুওর (door)„

পাতা: ১১


 

এরকম আরো অনেক শব্দ আছে যেগুলোর মধ্যে প্রচুর মিল রয়েছে। এ থেকে পণ্ডিতরা মনে করলেন যে সমগ্র ইউরোপ, ইরান ও ভারতবর্ষের মানুষদের উৎস এক এবং তারা একই ভাষা পরিবারের। ইউরোপীয় পণ্ডিতরা এই পরিবারের নাম দিলেন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার। এই বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে যেসব পণ্ডিত আর্যতত্ত্ব দাঁড় করালেন তাঁরা সবাই হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকে যাত্রা শুরু করেন। সংস্কৃত ভাষার খুবই কাছাকাছি বৈদিক ভাষায় রচিত ঋগ্বেদকে হিন্দুদের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ হিসাবে বিচেনা করা হয়। চারটি বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য তিনটি বেদ হল সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ। আর্যতত্ত্ব নির্মাণে পণ্ডিতরা আরো যে সব সূত্রের সাহায্য নিলেন সেগুলো হল প্রাচীন ইরানীয়দের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা, প্রাচীন গ্রীকদের জনপ্রিয় সাহিত্য ইলিয়াড ও ওডেসি, স্ক্যাণ্ডিনেভীয় জাতিসমূহের পৌরাণিক কাহিনী এড্ডা এবং ইউরোপীয় সমাজের নীচু তলার মানুষদের মধ্যে প্রচলিত লোকগাথা, পৌরাণিক কাহিনী, রূপকথা, প্রথা এবং অভ্যাস ইত্যাদি। তাঁরা দেখতে পেলেন যে ভারতবর্ষ, ইরান ও সমগ্র ইউরোপের ভাষাগুলির মধ্যেই যে মিল আছে শুধু তাই নয়, উপরন্তু পৌরাণিক কাহিনী, ধর্মীয় প্রথা ও অন্যান্য প্রথার ক্ষেত্রেও মিল রয়েছে। ম্যাক্স মুলার তাঁর Lectures on the Science of Language (1864) বইতে লিখলেন যে, দুই মহাদেশের এত বিশাল দূরত্বের মানুষদের ভাষার ক্ষেত্রে যখন এত মিল তখন নিশ্চয়ই এই সকল মানবগোষ্ঠী একটি মাত্র ভাষাগোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং তারাই আদি আর্য। তিনি আর্যদের আদি ভূমি মধ্য এশিয়ার পার্বত্য অঞ্চল বলে অভিমত দিলেন। ইউরোপের অন্যান্য পণ্ডিত আর্যদের আদি বাসভূমি উত্তর ইউরোপ সহ ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে খোঁজার চেষ্টা করলেন। তবে সকলের চেয়ে ম্যাক্স মুলারের তত্ত্বই বেশী প্রচার পেল।
ভাষাতত্ত্ব ছাড়াও সাহিত্য ও ধর্মে যে সমস্ত মিল পাওয়া গেল তার কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। আর্যদের প্রাচীন দেবতা দ্যৌ ( ঋগ্বেদে যার নাম বহুবার উল্লেখ আছে) থেকে গ্রীক দেবতা জিউস, ল্যাটিনদের জু(পিতার) এবং জার্মানদের তিউ ও যিও দেবতার উৎপত্তি হয়েছে। মরুৎগণ দেবতা বা মরুৎ নাম থেকে ল্যাটিনদের যুদ্ধদেবতা মার্স এসেছে। প্রাচীনকালে আগুন উৎপন্ন করার একটি পদ্ধতি ছিল দু’টি কাঠের মাঝখানে একটি কাঠ ক্রমাগত ঘুরানো বা মন্থন করা। সেজন্য অগ্নিকে প্রমন্থ নামেও অভিহিত করা হত। প্রাচীন গ্রীকদের ধর্মে যে দেবতা মানুষের কল্যাণার্থে স্বর্গ হতে অগ্নি চুরি করে এনেছিলেন, পণ্ডিতদের মতে সেই প্রোমিথিউস নাম ‘প্রমন্থ’র রূপান্তর। অগ্নির আর একটি নাম ‘ভরণু’। পণ্ডিতরা মনে করেন গ্রীকদের অগ্নিদাতা ও সদাচার নিয়ন্তা দেবতা ‘ফোরোনিউস’ এবং রোমানদের ‘ভালকান’ দেবতার নাম ‘ভরণু’ থেকে এসেছে। এছাড়া ঋগ্বেদে বর্ণিত আর্যদের দেবী অহনা থেকে গ্রীকদের দেবী এথেনা নামের উদ্ভব হয়েছে। এভাবে প্রাচীন ভারতীয় আরো দেব বা দেবীর নাম পাওয়া যায় যেগুলির সাথে গ্রীক বা রোমানদের দেব বা দেবীর নামের মিল রয়েছে।
আমরা দেখলাম বিশাল এলাকার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাষার মিল এবং ধর্ম ও লোক সাহিত্যের ক্ষেত্রে মিল থেকে কিভাবে সকল জনগোষ্ঠীর একটি সাধারণ উৎস সম্পর্কে পণ্ডিতরা ধারণা করেন। কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর নাম পণ্ডিতরা  ‘আর্য’ রাখলেন কোন উৎস থেকে?

পাতা: ১২


 

বেদসমূহের মধ্যে ঋগ্বেদের রচনাকাল ১০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ বলে উল্লেখ করেন ম্যাক্স মুলার। পরবর্তীকালের অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর পণ্ডিতরা একে আরো কিছু পিছিয়ে ১২০০ বা ১৫০০ খ্রী:পূ: বলে ধরেছেন। ঋগ্বেদের রচনাকাল নির্ধারণ ছিল একেবারে কাল্পনিক ও অনুমান নির্ভর। এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। ঋগ্বেদের রচনাকারীরা যে আর্য তা ঋগ্বেদ থেকে জানা যায়। ঋগ্বেদে আর্য নাম গৌরব বা মর্যাদার দ্যোতক। এমন কি আর্য নামের সাথে সভ্যতার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও বোঝা যায়। ঋগ্বেদ আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে রচনাকাল থেকে এর মন্ত্রসমূহ অবিকৃতভাবে টিকে আছে। এছাড়া অন্যান্য সাহিত্য যেমন সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ এবং উপনিষদ, পুরাণসমূহ, ব্রাহ্মণ, মহাভারত এবং বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থসমূহেও আর্য নামের সাথে গৌরববোধ বিজড়িত।
প্রাচীন ইরানীয়দের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাতেও আর্য নামের সঙ্গে গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্ববোধ জড়িয়ে আছে। ইরান নামের উৎপত্তিও আর্য (সংস্কৃত বা বৈদিক ভাষায় আর্য শব্দের উচ্চারণ হচ্ছে আরিয়) নাম থেকে।
কাজেই দুই মহাদেশের বিশাল অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের ভাষা একই পরিবারভুক্ত হওয়ায় এবং একই সাথে ভারতবর্ষ ও ইরানের প্রাচীন সাহিত্যসমূহে আর্য নামের সাথে মর্যাদা ও সভ্যতার সংশ্লিষ্টতা থাকায় পণ্ডিতরা অনুমান করলেন যে, একটি শক্তিশালী আর্য জনগোষ্ঠীই এই সকল জনগোষ্ঠীর আদি উৎস, যারা কোন একটি স্থান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গিয়ে সভ্যতা গড়ে তোলে। পণ্ডিতরা এই জায়গায় ভুল বলেন নি। কিন্তু তাঁরা যখন স্ববিরোধিতার আশ্রয় নিয়ে এই জনগোষ্ঠীকে যাযাবর, পশুচারী ও বর্বর বলেন এবং কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই তাদের আদি বাসভূমি মধ্য এশিয়া বা ইউরোপের কোথায়ও বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন তখন তাঁদের বক্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায়। বিশেষ করে ঋগ্বেদকে যখন তাঁরা ভারতবর্ষ আক্রমণকারী যাযাবরদের দ্বারা রচিত ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন তখন এই প্রশ্ন আরও জোরালোভাবে তুলতে হয়। কারণ ঋগ্বেদ কোনভাবেই তাঁদের ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে না। এবং সর্বোপরি সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলিও তাঁদের বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানের বালুচিস্তানে মেহরগড় নামে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খননের পর সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে সবার ধারণা বদলে গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখন একমত যে, এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় সাড়ে নয় হাজার বছর আগে নব প্রস্তর যুগে যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থিতিশীল গ্রামীণ কৃষি সমাজ গঠনের পর প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছর ধরে সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। এমন কি দেহগত নৃতত্ত্ব থেকে এমন বিষয়ও জানা যাচ্ছে যে, প্রায় ৫০০০ খ্রী:পূ:-এ তাম্রযুগের সূচনা থেকে ৮০০ খ্রী:পূ:-এ ঐতিহাসিক কাল শুরুর কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলে কোন বাইরের জনগোষ্ঠীর আগমন ঘটে নি। ফলে উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব আর ধোপে টিকছে না। অন্যদিকে প্রাচীন সাহিত্যে এখানে আর্যদের পাওয়া যাচ্ছে। ফলে নূতন ও বিজ্ঞান মনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আর্য জনগোষ্ঠীর আদি বাসভূমির অনুসন্ধান প্রয়োজন হয়ে পড়ে। আমরা এই কাজ করতে গিয়ে অন্যদের মতো আর্যদের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকে যাত্রা শুরু করব। এবং এরপর এই উপমহাদেশের মাটিতে স্বাধীনভাবে বিকশিত সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যসমূহ পর্যালোচনা করব। আমরা এই পর্যালোচনার মাধ্যমে দেখব ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে সম্পর্ক আছে কি না। আর থাকলে তা কি ধরনের। এছাড়া আমরা প্রাচীন ইরানীয় ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা সহ অন্যান্য সাহিত্য সূত্রের সাহায্যও নিব উপমহাদেশের দূর অতীতের হারানো সূত্রগুলিকে খুঁজে পাবার জন্য, বিশেষত যেগুলি আর্য এবং সিন্ধু সভ্যতার তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই আলোচনায় মহাভারত এবং রামায়ণের মত পৌরাণিক মহাকাব্যগুলিও প্রসঙ্গক্রমে আসবে। পাঠক! এখন আমরা তাহলে হাজার হাজার বছরের গৌরবময় অতীতে যাত্রা শুরু করি।

পাতা: ১৩

 


 

 

 

pic-1

  চিত্র ১

পাতা: ১৪

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ