Banner
ষষ্ঠ অধ্যায় - সিন্ধুর ঈশ্বর ও ঋগ্বেদের বরুণ

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 9:00 AM, Hits: 1686

ঋগ্বেদে ইন্দ্রের বিপরীতে বরুণ নম্র, ক্ষমাপরায়ণ এবং ন্যায়-নীতিবান দেবতা। বরুণ সমস্ত বিশ্বের অধিপতি ও জলের স্রষ্টা। ঋগ্বেদে বরুণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে :
‘জগতের ধারক অদিতির পুত্র বরুণ প্রকৃষ্টরূপে জল সৃষ্টি করেছেন। বরুণের মহিমায় নদী সকল প্রবাহিত হয়, এরা বিশ্রাম করে না, নিবৃত্ত হয় না। এরা পাখীদের ন্যায় বেগে ভূমিতে গমন করে।’ (২/২৮/৪)
‘বৃষ্টি যেরূপ যব, শস্য সিক্ত করে সেরূপ অখিল ভুবনের অধিপতি বরুণ সমগ্র ভূমিকে আর্দ্র করেন।’ (৫/৮৫/৩)
‘উগ্র সহস্রচক্ষু বরুণ এ নদীগণের জল দর্শন করেন’ (৭/৩৪/১০)। ‘বরুণ রাষ্ট্রের রাজা, নদীর রূপ, তার বল অবারিত ও সর্বতোগামী।’ (৭/৩৪/১১)
‘১। এ বরুণদেব সূর্যের পথ প্রদান করেছেন, নদীসকলকে অন্তরীক্ষভব জল প্রদান করেছেন। অশ্ব যেরূপ বড়বার প্রতি ধাবমান হয়, সেরূপ শীঘ্র যেতে ইচ্ছা করে তিনি মহতী রজনীসমূহকে দিবস হতে পৃথক করেছেন। ...... ৩। বরুণের চরসকলের গতি প্রশস্ত, তারা সুন্দর রূপবিশিষ্ট দ্যাবাপৃথিবী সন্দর্শন করে এবং কর্মবান, যজ্ঞধারী, প্রাজ্ঞ কবিগণ যে স্তোত্র প্রেরণ করেন তাও চারদিকে দর্শন করে। ...... ৫। এ বরুণ দেবের মধ্যেই তিন প্রকার দ্যুলোক নিহিত আছে, তিন প্রকার ভূমি ছয় অবস্থায় এতে অন্তর্ভূত আছে। স্তুতিযোগ্য রাজা অন্তরীক্ষে হিরণ্ময় দোলার ন্যায় সূর্যকে দীপ্তির জন্য নির্মাণ করেছেন। ৬। সূর্যের ন্যায় দীপ্ত বরুণ সমুদ্রকে স্থাপিত করেছেন। তিনি জলবিন্দুর ন্যায় শ্বেতবর্ণ, গৌর মৃগের ন্যায় বলবান, গভীর স্তোত্রবিশিষ্ট, উদকের নির্মাতা, পারক্ষম বলযুক্ত এবং সমস্ত সৎ পদার্থের রাজা। ৭। অপরাধ করলেও যে বরুণ দয়া করেন অদীন বরুণের ব্রত সকল যথাক্রমে সমৃদ্ধ করে আমরা যেন তাঁর নিকটেই অনপরাধী হই। তোমরা সর্বদা আমাদের স্বস্তি দ্বারা পালন কর।’ (৭ মণ্ডল, ৮৭ সূক্ত)
‘সর্বজ্ঞানী অসুর বরুণ দ্যুলোককে স্তম্ভিত করেছেন, পৃথিবীর বিস্তারের পরিমাণ করেছেন, সমস্ত ভুবনের সম্রাটরূপে আসীন হয়েছেন। বরুণের এ সকল কর্ম অনেক।’(৮/৪২/১)
আমাদের নিকট এ বিষয় স্পষ্ট যে, দেবতা বরুণ সম্পর্কে যাঁরা এইসব মন্ত্র রচনা করেছেন তাঁদের সমগ্র ধর্মসংস্কারের একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অসুর বরুণ বা জগৎ সম্রাট বরুণের ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ দেবতা হিসাবে অবস্থান ধ্বংস করা। কিন্তু তার পরেও তাঁরা বরুণকে নাকচ করেন নি বা করতে পারেন নি। তাঁরা ঐতিহ্যের শক্তির বিরুদ্ধে পুরোপুরি দাঁড়াতে পারেন নি। সুতরাং বৈদিক সংস্কার দ্বারা বরুণের সর্বোচ্চ অবস্থান কৌশলে ধ্বংস করা হয়েছে ইন্দ্র, অগ্নি, মরুৎগণ, অশ্বিদ্বয় ইত্যাদি দেবতার মর্যাদা অনেক বেশী বাড়িয়ে, বিশেষ করে ইন্দ্রকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে।

_________________________________________________________________________________
বেদের মন্ত্র রচনাকারী ঋষিগণ।
উদক অর্থ জল।
স্তম্ভযুক্ত।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১২৭


সমাজচেতনায় বরুণের প্রভাব সুগভীর থাকায় এবং তা একবারে নষ্ট করা সম্ভব ছিল না বলে ইন্দ্রের সঙ্গে বরুণের সমন্বয়ের অনেক চেষ্টাও হয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে :
‘হে ইন্দ্র ও বরুণ! তোমরা মহান ও মহাধন বিশিষ্ট। তোমাদের একজন সম্রাট আর একজন স্বরাট’ (৭/৮২/২); ইত্যাদি।
বরুণ যে এক সময় প্রবল ঈশ্বর ছিলেন তা ঋগ্বেদ থেকে বোঝা যায়। বৈদিক যুগের এক খ্যাতিমান রাজা ও যোদ্ধা পুরুকুৎসের পুত্র রাজর্ষি ত্রসদস্যু রচিত কয়েকটি ঋক থেকে ঋগ্বেদের ধর্মসংস্কার দ্বারা সঙ্কুচিত ক্ষমতা এই প্রাচীন ঈশ্বরের গর্বিত কণ্ঠ শুনতে পাই :
১। আমি বলবান ও সমস্ত বিশ্বের অধিপতি। আমার রাজ্য দ্বিবিধ। সমস্ত অমরগণ আমার। আমি রূপবান ও অন্তিকস্থ বরুণ। দেবগণ আমার যজ্ঞসেবা করেন। আমি মনুষ্যেরও রাজা। ২। আমি রাজা বরুণ! দেবগণ আমার জন্যই অসূর্য শ্রেষ্ঠ বল ধারণ করেছেন। আমি রূপবান ও অন্তিকস্থ বরুণ। দেবগণ আমার যজ্ঞ সেবা করেন। আমি মনুষ্যেরও রাজা’। (৪ মণ্ডল, ৪২ সূক্ত)
কিন্তু বরুণের এই দম্ভোক্তি ক্ষমতা হারানো একজন নায়কের অসার উক্তি মাত্র। তাই ৩য় ঋকেই তাঁকে দিয়ে ঋষি বলাচ্ছেন, ‘আমি ইন্দ্র ও বরুণ!’ (৪/৪২/৩)। এবং ঋষি যখন ৭ম ঋকে বলছেন, ‘হে বরুণ! সমস্ত ভূতজাত তোমাকে জানে। হে স্তোতা বরুণকে স্তব কর। হে ইন্দ্র! তুমি শত্রুগণকে বধ করেছ বলে বিখ্যাত আছ। তুমি বদ্ধ সিন্ধুগণকে উন্মুক্ত করেছ’ (৪/৪২/৭) তখন বোঝা যায় মুখে বরুণকে যেটুকুই স্তুতি করা যাক আসলে তাঁর সময় ফুরিয়েছে এবং শত্রুবধ এবং বদ্ধ সিন্ধুগণকে মুক্ত করেছেন যিনি সেই ইন্দ্রের এখন সময় এসেছে।
পুরাতন ঐতিহ্যের নাড়ী ছেঁড়া খুব কঠিন, বিশেষত যদি সেই ঐতিহ্য হয় শত শত কিংবা সহস্র বৎসরের কিংবা তারও বেশী সময়ের। সম্ভবত ঋগ্বেদের অন্যতম বিখ্যাত ঋষি বসিষ্ঠের গোত্র খুবই প্রাচীনকাল থেকে সিন্ধুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিল। কারণ ৭/৩৩/১১ ঋকে বসিষ্ঠ পুত্রগণ ঋষি বলছেন, ‘আরও হে বসিষ্ঠ! তুমি মিত্র ও বরুণের পুত্র। হে ব্রহ্মণ! উর্বশীর মন হতে তুমি জাত! তখন মিত্র ও বরুণের তেজ নির্গত হয়েছিল, বিশ্বদেবগণ দৈব স্তোত্র দ্বারা পুষ্কর মধ্যে তোমায় ধারণ করেছিলেন।’ অনুমান করা যায় যে, এটা আদি বসিষ্ঠ ঋষি সম্পর্কে বলা হচ্ছে। বসিষ্ঠের উর্বশীর মানসপুত্র এবং মিত্র ও বরুণের পুত্র হবার যে ব্যাখ্যাই থাক বোঝা যায় যে, বরুণ উপাসনার সঙ্গে তথা সিন্ধু সভ্যতার সরকারী ধর্মের সঙ্গে বসিষ্ঠ গোত্রের সম্পর্ক খুব গভীর এবং প্রাচীন।
বসিষ্ঠ ঋষির রচিত কয়েকটি মন্ত্র দ্বারা আমরা সেই সময়কার ধর্মীয় আন্দোলনের অন্তর্গত জটিল টানাপোড়েন এবং সময়ের সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়া প্রবল স্রোতের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের মর্মবেদনা ইত্যাদি অনেক কিছুই অনুভব করতে পারি। ৭ম মণ্ডল থেকে ঋষি বসিষ্ঠ রচিত ৮৬ সূক্তের কয়েকটি ঋক উদ্ধৃত করা যায় :

_________________________________________________________________________________
ত্রসদস্যু নিজেও একজন বড় যোদ্ধা।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১২৮


‘১। এ বরুণের জন্ম মহিমাপ্রযুক্ত স্থির হয়েছে। ইনি বিস্তীর্ণ দ্যাবাপৃথিবীকে স্তম্ভিত করেছেন, ইনি বৃহৎ আকাশ ও দর্শনীয় নক্ষত্রকে দ্বিধা প্রেরণ করেন। ইনি ভূমিকেও বিস্তীর্ণ করেছেন। ২। আমি কি স্বীয় শরীরের সঙ্গে বরুণের স্তুতি করব? কখন বরুণদেবের সন্নিকট থাকব? বরুণ কি ক্রোধরহিত হয়ে আমার হব্য সেবা সেবন করবেন? আমি সুমনা হয়ে কখন সুখপ্রদ বরুণকে দেখতে পাব? ৩। হে বরুণ! আমি দিদৃক্ষু হয়ে সে পাপের কথা তোমায় জিজ্ঞাসা করছি। আমি বিবিধ প্রশ্নের জন্য বিদ্বান জনের নিকট গিয়েছি। কবিরা সকলেই আমাকে একরূপ বলছেন যে, “ এ বরুণ তোমার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন।” ৪। হে বরুণ! আমি এমন কি করেছি যে তুমি মিত্রভূত স্তোতাকে হনন করতে ইচ্ছা কর! হে দুর্ধর্ষ তেজস্বিন! আমাকে তা বল যাতে আমি ত্বরমান হয়ে নমস্কারের সাথে তোমার নিকট গমন করি। ৫। হে বরুণ! আমাদের পিতৃক্রমাগত দ্রোহ বিশ্লিষ্ট কর। আমার নিজ শরীর দ্বারা যা করেছি, তাও বিশ্লিষ্ট কর। হে রাজা! পশুখাদক চৌরের ন্যায়, রজ্জুবদ্ধ গোবৎসের ন্যায়, আমাকে পাপ হতে বিশ্লিষ্ট কর। ৬। হে বরুণ! সে পাপ নিজের দোষে নয়। এ ভ্রম বা সুরা বা মন্যু বা দূত্যক্রীড়া বা অবিবেকবশত ঘটেছে। কনিষ্ঠকে জ্যেষ্ঠও বিপথে নিয়ে যায়, স্বপ্নেও পাপ উৎপন্ন হয়।’ (৭ মণ্ডল, ৮৬ সূক্ত)।
ঋষি কোন পাপের কথা বলছেন? একি দ্রোহের পাপ? পুরাতন পথ থেকে বিচ্যুত হবার কিংবা সনাতন ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য হারাবার আত্মগ্লানি থেকে কি ঋষির এই অনুতাপ? ঐ একই ঋষি বসিষ্ঠ ৭/৮৮ সূক্তে বলছেন :
‘৫। হে বরুণ! আমাদের সে সখ্য কোথায় হয়েছিল? পূর্বকালে যে হিংসারহিত সখ্য ছিল তাই সেবা করছি। হে অন্নবান বরুণ! তোমার মহান ভূতগণের বিচ্ছেদকারী সহস্রদ্বারবিশিষ্ট গৃহে যাব। ৬। হে বরুণ! যে বসিষ্ঠ নিত্যবন্ধু, যে পূর্বে প্রিয় হয়ে তোমার প্রতি অপরাধ করেছিল, সে তোমার সখা হোক। হে যজনীয় বরুণ! আমরা তোমার আত্মীয়, আমরা পাপযুক্ত হয়ে যেন ভোগ না করি। তুমি মেধাবী, স্তুতিকারীকে বরণীয় গৃহ প্রদান কর।’ (৭ মণ্ডল, ৮৮ সূক্ত)
৭/৮৮/৫ ঋকে সহস্রদ্বারবিশিষ্ট গৃহ বলতে ঋষি যে মহেঞ্জোদাড়ো কিংবা হরপ্পা বা আর কোন নগরের বৃহৎ এবং পাকা মন্দির গৃহের কথা বলছেন সেটা অনুমান করা চলে। অর্থাৎ ঋগ্বেদের ঋষিরা সহস্রস্তম্ভ ও সহস্রদ্বারবিশিষ্ট যে পূজা গৃহের উল্লেখ করেছেন তা সিন্ধু সভ্যতার বৃহৎ অট্টালিকা ছাড়া আর কিছু নয় এবং এটা মূলত বরুণের পূজা গৃহ। আমরা মহেঞ্জোদাড়োতে চৌবাচ্চা সংযুক্ত যে বৃহৎ ভবন পেয়েছি সেটি এই ধরনের একটি গৃহ। এটা অনুমেয় যে, সিন্ধু সভ্যতার ঈশ্বর বরুণের সঙ্গে ছিল চৌবাচ্চা বা ‘গ্রেট বাথ’ এবং জলাচারের সম্পর্ক। আমরা বহু পরবর্তী ঐতিহাসিক কালেও ভারতবর্ষে পবিত্র পুষ্করিণী দেখতে পাই। এই ধরনের স্থানে পবিত্র জল দ্বারা রাজাদের অভিষেক করা হত। বহু পরবর্তী কালে বরুণ দেবতার আর সব পরিচয় মুছে গেলেও তাঁকে পুরাণ কাহিনীগুলোতে আমরা জলের দেবতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে দেখি। আসলে বরুণের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার একটি অত্যাবশ্যক ও প্রধান উৎস নদীনিয়ন্ত্রণ ও জলসেচের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ছিল বলে শেষ পর্যন্ত সব হারিয়েও বরুণের স্মৃতি জলের দেবতা হিসাবে বেঁচে থেকেছে।

পাতা: ১২৯


বরুণ সিন্ধুর মূলত শান্তিপূর্ণ শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি ভিত্তিক নগর সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দেবতা বা ঈশ্বর। আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় ক্ষমতার খুব বেশী কেন্দ্রীভবন ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবে সিন্ধু সভ্যতার যিনি প্রধান দেবতা হবেন তিনিও নিরংকুশ কিংবা একনায়কী ক্ষমতার অধিকারী যে হবেন না সেটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ এই ধর্মে বরুণকে প্রধান দেবতা রেখে আরও বিভিন্ন দেবতা থাকবে। সে যুগে বিভিন্ন উপজাতির বিভিন্ন স্বতন্ত্র দেবতা থাকত। কাজেই এইসব উপজাতিকে এক বৃহত্তর সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে হয় বলপূর্বক বিজয়ীর দেবতা বা ধর্মকে তাদের উপর চাপাতে হত নয় তাদের দেবতাকে অধীনতামূলক স্থান দিয়ে হলেও বৃহত্তর ধর্মীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হত। পরবর্তী পদ্ধতিতে ধীর প্রক্রিয়ায় এইসব দেবতা এবং সেই সঙ্গে উপজাতিগুলি স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে বৃহত্তর ধর্ম বা সমাজের মধ্যে বিলীন হতে
পারত।
কিন্তু এই বিলীনতার পথে এক প্রবল বাধা হয়ে থাকে প্রত্যেক উপজাতির নিজস্ব দেবতার মূর্তি। সুতরাং অধীনস্থ দেবতাদের স্বাতন্ত্র্য লোপ করার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হল প্রধান ও অপ্রধান কোন দেবতার মূর্তি নির্মাণ না করা। অর্থাৎ নিরাকার দেবতার উপাসনা পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার প্রধান কিংবা সবচেয়ে শক্তিশালী মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানই ভেঙ্গে পড়ে। এবং এর জন্য ভিন্ন উপজাতিকে বলপূর্বক আত্মস্থকরণ প্রক্রিয়ায় নেবার প্রয়োজন হয় না। সিন্ধু সভ্যতা এই পদ্ধতি নিয়েছিল, যার ফলে আমরা সমগ্র সিন্ধু সভ্যতায় বৃহৎ কোন দেব মূর্তি বা দেবতার মূর্তি যুক্ত মন্দির গৃহ খুঁজে পাই না। বৈদিক ধর্ম সিন্ধু সভ্যতার সরকারী বা রাষ্ট্রীয় ধর্মের ঐতিহ্য থেকে এসেছিল বলে বৈদিক ধর্মে মূর্তি পূজা ছিল না। মূর্তি পূজা ছিল না বলে বহু দেবতাকে প্রায় সমগুরুত্ব দিয়ে আনা হলেও বৈদিক ধর্মে একেশ্বরবাদের প্রবণতা এত শক্তিশালী।
সিন্ধু সভ্যতা প্রকৃত অর্থে যুদ্ধবাদী ছিল না। কাজেই প্রয়োজনে বিভিন্ন উপজাতি ও সমাজকে বলপূর্বক অধীনস্থ করলেও তাদের দেবতাকে নিরাকার রূপে নিরাকার বরুণ কেন্দ্রিক ধর্মের বৃহত্তর কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করেছে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু যখন সভ্যতায় সংকট দেখা দিয়েছে, সভ্যতার ধারণ ক্ষমতা ফুরিয়েছে তখন সমাজের বিভক্তি ও ধ্বংসের শক্তিগুলো যেমন প্রবল হয়েছে তেমন সমাজে বেড়েছে পশ্চাদগামিতা, ধর্মীয় অন্ধত্ব ও উগ্রতা এবং বিভিন্ন দেবতাকে অবলম্বন করে সামাজিক বিভক্তি ও বিচ্ছেদের প্রবণতা। কাজেই শান্তিপূর্ণ সভ্যতার দেবতা, নগরকেন্দ্রিক সভ্য সমাজের ঐক্যরক্ষাকারী দেবতা হিসাবে বরুণের ভূমিকাও ফুরিয়েছে। সুতরাং ঋগ্বেদে এমন মন্ত্রও রয়েছে যেখানে বরুণকে ইন্দ্রের অধীনস্থ ঘোষণা করা হয়েছে : ‘দ্যাবাপৃথিবী যাঁর বিপুল বল অনুধাবন করে, বরুণ ও সূর্য যাঁর নিয়মে চলছেন, নদীসমূহ যাঁর নিয়ম অনুসারে প্রবাহিত হয়, সে ইন্দ্রকে মরুৎগণের সাথে আমাদের সখা হবার জন্য আহ্বান করি।’ (১/১০১/৩)
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বরুণের পতনের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রের এবং সেই সঙ্গে অন্যান্য দেবতারও উথান ঘটেছে। এখন আমারা বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের সংস্কার সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ ধারণার জন্য ঋগ্বেদের সাহায্য নিব।

পাতা: ১৩০

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ