Banner
সপ্তম অধ্যায় - বৈদিক সংস্কারের গতি-প্রকৃতি

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 8:00 AM, Hits: 1978

ঋগ্বেদে বহু সংখ্যক দেবতার নাম পাওয়া যায়। তবে দেবতার সংখ্যা কত ছিল তার নির্দিষ্ট উল্লেখ স্ববিরোধী। যেমন কয়েক জায়গায় আমরা পাই ৩৩ সংখ্যক দেবতার কথা (৮/২৮/১, ৮/৩০/২)। কিন্তু দুইটি ঋকে তার সংখ্যা বলা হয়েছে ৩৩৩৯ (৩/৯/৯, ১০/৫২/৬)। ঋগ্বেদে যেসব দেবতার নাম উল্লেখ আছে তাদের সংখ্যা ৩৩ সংখ্যার কাছাকাছি, তবে কিছু বেশী হবে।
প্রকৃতপক্ষে ঋগ্বেদের দেবতার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। এর সহজ কারণ ঋষিরা যে কোন শক্তির বা গুণের উপর দেবত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা যে শক্তিকে তুষ্ট করার প্রয়োজন বোধ করেছেন, যার কাছ থেকে সাহায্য বা লাভ আশা করেছেন তার স্তুতিতে মন্ত্র রচনা করেছেন। অবশ্য তাঁদের আর একটি ধারণা ছিল যে, মন্ত্র রচনা করে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পূজা করলে স্তুত বা উপাস্য দেবতার শক্তি বৃদ্ধি হয়। ফলে তার উপকার বা ফলদান করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। এই কারণে ইক্ষু বা সোমের মত উদ্ভিদেরও উপর দেবত্ব আরোপ করে মন্ত্র রচনা করা হয় সোমরসের মিষ্টতা এবং মাদক গুণের জন্য।
আদিম মানুষের চেতনায় বস্তুর শক্তি সম্পর্কে ধারণা বা কল্পনা বুঝলে আমরা দেবতার উদ্ভব সম্পর্কে ধারণা করতে পারব। আদিম মানুষের কল্পনা অনুযায়ী বস্তুর ভিতরে ক্রিয়াশীল শক্তি তার মত প্রাণময় ও সচেতন। অর্থাৎ শুধু প্রাণীর নয় বরং প্রতিটি বস্তুর আত্মা আছে বলে আদিম মানুষের একটা ধারণা ছিল। এই ধারণা থেকে নদী, সমুদ্র, পর্বত, বৃক্ষ, ঝড়, বৃষ্টি, আগুন, আকাশ, পৃথিবী সবেরই আত্মা আছে বলে কল্পনা করা হত। যারা বেশী শক্তিমান এবং যাদের ক্ষতি করার ক্ষমতা এবং সেই সঙ্গে উপকার করার ক্ষমতাও বেশী মনে করা হত তাদেরকে দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত করা হত। আত্মার এই কল্পনা কিভাবে দেবতার জন্ম দেয় তা আমরা বুঝতে পারি হিন্দু সমাজে গ্রাম-দেবতা এমন কি গৃহ-দেবতার কল্পনা থেকে। অর্থাৎ প্রতিটি গ্রাম এবং গৃহের নিজস্ব দেবতা থাকে বলে বিশ্বাস করা হয়।
সুতরাং প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসের উদ্ভব কিংবা বিকাশের কাল থেকে যখন বিভিন্ন উপজাতি বা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের বিভিন্ন দেবতায় বিশ্বাস নিয়ে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছিল তখন তাদের দেবতাদের মধ্যেও সহাবস্থান ও সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে। কারণ এটা স্বাভাবিক যে, প্রত্যেকটা উপজাতিরও একটা নিজস্ব দেবতা ছিল অথবা তা না থাকলেও তার পূর্বরূপ টোটেম ছিল। আমরা জানি যে, টোটেম কোন প্রাণী, উদ্ভিদ বা বস্তু হত। ধারণা করা হত যে, ঐ প্রাণী বা উদ্ভিদ বা বস্তু থেকে ঐ উপজাতি বা গোত্রের জন্ম বা উদ্ভব হয়েছে। এটা ধর্ম বিশ্বাসের উদ্ভব বা বিকাশের পূর্বাবস্খা। যাইহোক, একটা

পাতা: ১৩১


পর্যায়ে সমাজের বৃহত্তর ও দৃঢ়তর ঐক্যের শক্তিকে সহায়তা দেবার জন্য বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের উথান ঘটে, যে বিষয়টি ইতিপূর্বে আমাদের আলোচনায় এসেছে। সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ঈশ্বর হিসাবে এবং নিরাকার দেবতা হিসাবে বরুণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলেও সিন্ধু সভ্যতায় শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির প্রাধান্যের কারণে অসংখ্য জনগোষ্ঠীর মত অসংখ্য ধর্মবিশ্বাস এবং দেবতা-উপদেবতারও যে এক ধরনের সমন্বয় কিংবা পারস্পরিক সহাবস্থান ঘটেছিল তা অনুমান করা যায়। ঋগ্বেদে ৩৩৩৯ দেবতার সংখ্যার উল্লেখে এই ঐতিহ্যের প্রকাশ ঘটেছে।
কিন্তু আমরা বুঝি যে, সিন্ধুর অন্তত সরকারী ধর্মে সেইসব দেবতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেসব দেবতার পূজারী বা অনুসারী গোষ্ঠীগুলি সমাজ, রাষ্ট্র ও অর্থনীতিতে প্রবল বা নিয়ন্ত্রণকারী ভূমিকা রাখত।
প্রাচীন সমাজে জনচেতনায় দেবতার ধারণার এই অবস্থানের কারণে অনেক সময় দুই উপজাতির দ্বন্দ্বকে দুই দেবতার মধ্যে দ্বন্দ্ব হিসাবে ব্যাখ্যা করা হত। এক পক্ষ নিজ দেবতাকে দেবতা এবং প্রতিপক্ষের দেবতাকে দানব হিসাবে অভিহিত করত। ফলে বিজয়ী পক্ষের দেবতা দেবতা হিসাবে এবং পরাজিত পক্ষের দেবতা দানব বা অপদেবতা হিসাবে পৌরাণিক উপাখ্যানের অন্তর্ভুক্ত হত। আর যদি পরাজিত উপজাতিকে অধীনতামূলক স্থান দিয়ে বিজয়ীরা বৃহত্তর সমাজের অন্তর্ভুক্ত করত তবে পরাজিত পক্ষের দেবতা বিজয়ী পক্ষের দেবতার অধস্তন কোন দেবতা হিসাবে স্থান পেতে পারত।১
এর বিপরীতে একই সমাজ ভেঙ্গে গেলে প্রতিপক্ষের দেবতা এবং পক্ষের দেবতা অভিন্ন হওয়ায় প্রতিপক্ষের দেবতার ভিন্ন নামকরণ করে তাকে অপদেবতা বা দানব হিসাবে যে আখ্যায়িত করা হত সেটাও বোধগম্য। স্বাভাবিকভাবে উভয় পক্ষই এক কাজ করত। আর এই ব্যাপারটা আমরা বৈদিক সংস্কারেও ঘটতে দেখেছি অন্তত বিশ্বরূপের মত ২/১টি দেবতার ক্ষেত্রে। তবে সিন্ধু সভ্যতার সমাজ উন্নত ও জটিল হওয়ায় এখানে ধর্ম বা দেবতা কাঠামোও ছিল উন্নত ও জটিল। বিশেষ করে এতকাল পরে আদি ধর্মের সাহিত্যের অভাবে তার প্রকৃত রূপ বোঝা অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু বৈদিক ধর্ম ঐ আদি ধর্ম থেকে আসায় ঋগ্বেদ-বিশ্লেষণ থেকেও তার অনেকটা বোঝা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যসমূহও আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে।

_________________________________________________________________________________
ডোনাল্ড ম্যাকেঞ্জি মিথ, দেবতা ও ধর্মের উদ্ভবে সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভূমিকাকে সঠিকভাবে ধরেছেন। তিনি তাঁর লেখা Teutonic Myth and Legend বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন : ‘As religion and law had in ancient times most intimate association, an official religion was ever a necessity in a well-organized State, and especially in one composed of mingled peoples. A Mythology, therefore, was probably the product of a national movement, and closely connected with the process of adjusting laws and uniting tribes under a central government. In the union and classification of gods we have suggested the union of peoples and the probable political relations of one tribe with another. No deity could be overlooked, if the interests of all sections were to be embraced, because the destinies of each were controlled by a particular god or group of gods of immemorial import. The gods of subject peoples would, of course, become subject to those of their rulers.
‘.... The lesser gods were accepted by those who imposed the greater, and new tales had to be invented to adjust their relationships one to another. Contradictory elements were thus introduced. The gods differed greatly. Some had evolved from natural phenomena; others were diefied heroes.’ Donald A. Mackenzie, Teutonic Myth and Legend, (Gresham Publishing Company, No date), pp. xxviii-xxiv.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৩২


আমরা ঋগ্বেদে যেসব দেবতার নাম পাই তাদের মধ্যে ইন্দ্র, অগ্নি, মরুৎগণ, বরুণ, মিত্র, সোম, বায়ু, বৃহস্পতি, ব্রহ্মণস্পতি, আদিত্যগণ, পূষা, দ্যৌ, অশ্বিদ্বয়, ঊষা, পৃথিবী, রুদ্র, অদিতি, বিষ্ণু , পর্জন্য, ঋভুগণ, ত্বষ্টা, সরস্বতী, যম, সবিতা, সূর্য, রাত্রি, অহির্বুধ্ন্য, ভগ, অর্যমা প্রভৃতির নাম উল্লেখ করা যায়।
এই সব দেবতার প্রায় সবাই সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যিক দেবতা হলেও বৈদিক সংস্কারে যেমন সামান্য সংখ্যক নূতন দেবতা প্রবর্তিত হয়েছে তেমন সামান্য সংখ্যক পুরাতন দেবতা বাদ পড়েছে বলে অনুমান করা যায়। তাছাড়া পুরাতন দেবতাদের রাখা হলেও তাদের ক্ষমতা কাঠামোয় বিরাট পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে বিদ্যমান সমাজের ক্ষমতা কাঠামোয় পরিবর্তনের প্রতিফলন। দেবতাদের ক্ষমতা কাঠামোয় পরিবর্তন বিষয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ বা অবকাশ আমাদের নেই। তবে বৈদিক সংস্কারের প্রশ্নে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিক কয়েকটি দেবতার উথান-পতন এবং বর্জন ও অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আমরা আলোচনা করব।
ঋগ্বেদ বিশ্লেষণ করলে সিন্ধু সভ্যতার বরুণকেন্দ্রিক ধর্ম কাঠামো এবং তার পরিবর্তন সম্পর্কে অন্তত কিছু ধারণা করা যায়। এটা সহজে অনুমেয় যে, সিন্ধু সভ্যতার ধর্মেও ইন্দ্রের কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল। তা না হলে বৈদিক সংস্কার দাঁড়াতে পারত না। ইন্দ্র পূর্ব থেকে মোটামুটি প্রভাবশালী একজন দেবতা হওয়ায় বৈদিক সংস্কার দ্বারা তাকে বরুণের সমান্তরাল হিসাবে দাঁড় করানো গেছে। হয়ত হরপ্পান রাষ্ট্রের ধর্মে ইন্দ্রের মর্যাদা কিছুটা গৌণ হলেও তিনি ছিলেন কোন অঞ্চলের প্রধান দেবতা।
অগ্নি পূজাও আঞ্চলিক বলে মনে হয়। কারণ মহেঞ্জোদাড়ো বা হরপ্পার মত বৃহৎ নগরে আমরা অগ্নিবেদি পাই নি। আমরা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের উপর আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি যে, কালিবঙ্গান, লোথাল এবং বনওয়ালিতে অগ্নিবেদি পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ঐ সব এলাকায় তথা সিন্ধু সভ্যতার এক উল্লেখযোগ্য অঞ্চলে অন্ততপক্ষে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শুরু থেকেই যে অগ্নিপূজা প্রচলিত ছিল তা নিশ্চিত। তবে তা একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ আঞ্চলিক ধর্মাচার ছিল। এ থেকে অনুমান করা চলে যে, বৈদিক আন্দোলন ও যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় ধ্বংসকাণ্ডে অগ্নির ব্যবহারের প্রয়োজনে ধর্মসংস্কার দ্বারা অগ্নিপূজাকে সর্বজনীনতা দেওয়া হয়।
বিশাল অঞ্চল জুড়ে যে বৈদিক ধর্মসংস্কার আন্দোলন হয়েছিল তা অনুমান করা যায় ঋগ্বেদে বর্ণিত শুধু নদীসমূহের নাম থেকে নয় সেই সাথে বৈদিক পক্ষ ও প্রতিপক্ষের বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় প্রথা থেকেও। বৈদিকদের চেয়ে প্রতিপক্ষের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথা ও পূজাপদ্ধতিতে বৈচিত্র্য বেশী ছিল বলে অনুমান করা চলে। শত্রুকে যজ্ঞরহিত বলা হচ্ছে

পাতা: ১৩৩


১/১০১/২, ৭/৮৩/৭, ১০/৪৯/১ ইত্যাদি ঋকে। হয়ত সমাজের অনেকে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করত না, যে উদাহরণ টেনে এখানে শত্রুকে গালি দেওয়া হয়েছে। আবার ১০/৭৩/৭ ঋকে শত্রুকে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করতে দেখা যাচ্ছে : যজ্ঞানুষ্ঠানোদ্যত নমুচিকে তুমি১ বধ করেছ।’ অনেক জায়গায় বলা হচ্ছে তারা সোমাভিষব করে না, অর্থাৎ পূজায় সোম রস ব্যবহার করে না, যেমন : ‘ হে ইন্দ্র! তুমি সোম পান করে উৎকৃষ্টতর হয়ে সোমাভিষবহীন জনসংঘদের পরস্পর বিরোধী করে বিনাশ কর’ (৮/১৪/১৫)। অথচ অন্য একটি ঋকে বলা হচ্ছে শত্রুরা সোমের সাথে মিশ্রিত হবার দুধ দেয় না; অর্থাৎ বোঝা যায় যে তারা দুধহীন সোমাভিষব করে : ‘ওরা সোমের সাথে মিশ্রিত হবার যোগ্য দুগ্ধ দান করে না, দুগ্ধ প্রদান করার পাত্রকেও দীপ্ত করে না’ (৩/৫৩/১৪)।
অনুমান করা যায় যে, যে বিশাল অঞ্চলে ধর্মসংস্কার আন্দোলন হচ্ছিল তার বিভিন্ন এলাকায় বরুণকেন্দ্রিক ঐক্য সত্ত্বেও ধর্মীয় প্রথায় কিছু ভিন্নতা ছিল। তবে এই ভিন্নতা সত্ত্বেও বৈদিকদের প্রতিপক্ষের যেমন একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাঠামো এবং পূজা-পদ্ধতি ছিল তেমন বৈদিকরাও তাদের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাঠামো এবং পূজা-পদ্ধতি গড়ে তুলছিল। আর এইভাবে ক্রমে তারা নিজেদেরকে আদি ধর্ম থেকে পৃথক করে নেয়।
ইন্দ্র ও অগ্নি ছাড়া অশ্বিদ্বয় নামে যুগ্ম দেবতা ঋগ্বেদের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। তারা ব্যাধি নিরাময়, পরিত্রাণ এবং সম্পদেরও দেবতা। সম্ভবত পুরাতন ধর্মে তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।
কিন্তু ঋগ্বেদের মরুৎগণ দেবতারা বহিরাগত এবং নূতন বলে মনে হয়। ঋগ্বেদে তাদের খুব উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে যুদ্ধে ইন্দ্রকে সহায়তা দেবার জন্য। মরুৎগণের পূজায় প্রথম দিকে বৈদিক শক্তির বৃহত্তর অংশের আপত্তি ছিল বলে মনে হয়। তা না হলে ১/১৭১ সূক্তে এই কথা কেন বলা হবে : ‘৪। হে মরুৎগণ! আমরা এ বেগবান ইন্দ্রের নিকট হতে ভয়ে পালিয়ে কাঁপছিলাম। তোমাদের জন্য যে হব্য সংস্কৃত করেছিলাম তা দূরে করেছি। আমাদের সুখী কর। ৫। হে ইন্দ্র! .... হে অভীষ্টবর্ষী, উগ্র, বলপ্রদায়ী, পুরাতন ইন্দ্র! তুমি মরুৎগণের সাথে অন্নধারণ কর।’ (১/১৭১)
ঋগ্বেদে মরুৎগণের সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে আগমন পথের যে বর্ণনা আছে তা থেকে সহজেই অনুমান করা চলে মরুৎগণ নামে ঋগ্বেদে অভিহিত দেবতাদের পূজারী বা অনুসারী উপজাতি বা উপজাতিসমূহ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল কিংবা বর্তমান আফগানিস্তান অথবা আরও দূর মধ্য এশিয়ার অধিবাসী ছিল যারা বৈদিক শক্তির আহ্বানে সিন্ধু সভ্যতার গৃহযুদ্ধে অংশ নেবার জন্য এসেছিল :
‘৮। হে মরুৎগণ! তোমরা স্বর্গ হতে, অন্তরীক্ষ অথবা এ পৃথিবী হতে এস। দূরে অবস্থান কর না। ৯। হে মরুৎগণ! রসা, অনিতভা ও কুভা নামক নদীসকল এবং সর্বত্র গমনশীল সিন্ধু নদী তোমাদের যেন বিলম্ব উৎপাদন না করে। জলময়ী সরযু যেন তোমাদের নিরুদ্ধ করে না রাখে; আমরা যেন তোমাদের আগমনজনিত সুখ লাভ করি।’ (৫ মণ্ডল, ৫৩ সূক্ত)

_________________________________________________________________________________
ইন্দ্র।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৩৪


উপরে উদ্ধৃত ৫/৫৩ সূক্তের ঋক দুইটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রসা, অনিতভা ও কুভা সিন্ধু নদী-উপত্যকার পশ্চিম দিকস্থ তিনটি নদী। কুভা বর্তমানে কাবুল নদী নামে পরিচিত। অর্থাৎ এ তিনটি আফগানিস্তানের নদী। আর সরযু তৎকালীন পাঞ্জাব অঞ্চলের একটি নদীর নাম।
ঋগ্বেদ থেকে এটা স্পষ্ট যে, মরুৎগণ ছিল অশ্ব ব্যবহারকারী পরাক্রমশালী যোদ্ধা। তারা যুদ্ধে অশ্ববাহিত রথ যেমন ব্যবহার করত তেমন অশ্বারোহণ করতে জানত বলে বোঝা যায়। এ প্রসঙ্গে মরুৎগণ দেবতার উদ্দেশ্যে ঋক দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ : ‘হে শ্রেষ্ঠতম নেতাগণ! কে তোমরা সুদূরবর্তী প্রদেশ হতে একে একে উপস্থিত হয়েছ (৫/৬১/১)? তোমাদের অশ্বগণ কোথায়? বল্গা কোথায়? কিরূপ সামর্থ্য? কিরূপেই বা গমন করছ ? অশ্বগণের পৃষ্ঠদেশে আস্তরণ ও নাসিকাদ্বয়ে বন্ধনরজ্জু লক্ষিত হচ্ছে’ (৫/৬১/২)। ঘোড়ার পিঠে না বসলে সেখানে আস্তরণ দেবার প্রশ্ন ওঠে না। হতে পারে যে সিন্ধু সভ্যতার যুদ্ধে মরুৎগণের পূজারী বহিরাগত যোদ্ধারা অশ্বের ব্যবহার প্রবর্তন করে।
বৈদিক সংস্কার আন্দোলনের বিজয়ে মরুৎগণ দেবতাদের নামে তাদের অনুসারী বা উপাসক যোদ্ধাদের যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা বোঝা যায় ৮/৯৬/৭ ঋক থেকে : ‘হে ইন্দ্র! যে বিশ্বদেবগণ তোমার সখা হয়েছিলেন, তাঁরা বৃত্রের নি:শ্বাস হতে ভীত হয়ে পলায়ন করে তোমায় ত্যাগ করে গেলেন। মরুৎগণের সাথে তোমার সখ্য হল। পরে তুমি সমস্ত শত্রুসেনা জয় করলে।’ (৮/৯৬/৭)
উপরের মন্ত্র থেকে এটা স্পষ্ট যে, একটা পর্যায়ে ইন্দ্রের অনুসারী তথা বৈদিক শক্তি সিন্ধু-হরপ্পান রাষ্ট্রের আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েছিল। এই সময় মরুৎগণের পূজারী দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের সাহায্যে তারা বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে বৈদিক আন্দোলনে ক্রমবর্ধমানভাবে বিভিন্ন শক্তি যোগ দেয়।
বিশেষত বহিরাগতদের যোগদানের ঘটনাটি উভয় পক্ষেই ঘটতে পারে। এটা গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে সিন্ধু সভ্যতার জন্য অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কারণ সমুদ্রপথ ছাড়াও শুধু স্থলপথেই তার বহু দূর বিস্তৃত অঞ্চলে যে যোগাযোগ এবং বাণিজ্য ছিল তা আমরা দেখেছি। ইরান ও আফগানিস্তান, মধ্য-এশিয়া, উত্তর ও পূর্ব ভারত, দক্ষিণ ভারত ইত্যাদি অঞ্চলে শুধু যোগাযোগ নয় উপরন্তু উপনিবেশ এবং বসবাসও যে ছিল সেটা বোধগম্য। সুতরাং একটা শান্তিপূর্ণ সভ্যতায় অভ্যস্ত এবং যুদ্ধ বিমুখ জনগোষ্ঠী যে যুদ্ধের প্রয়োজনে বহির্দেশ থেকে বিভিন্ন যুদ্ধবাজ উপজাতি বা গোষ্ঠীর সাহায্য নিতে চাইবে সেটা যেমন অস্বাভাবিক নয় তেমন পূর্ব থেকেই যোগাযোগ এবং ধারণা থাকায় অর্থ-সম্পদ এবং লুণ্ঠনের প্রলোভনে এই যুদ্ধবাজদের ভাড়াটিয়া হিসাবে আসার আগ্রহে ঘাটতি থাকারও কারণ নেই। তবে বৈদিক পক্ষে যোগদানে বহিরাগত যুদ্ধবাজদের লাভ বেশী। কারণ সেক্ষেত্রে সম্পদশালী শাসকদের সম্পদ লুণ্ঠনের সম্ভাবনা থাকে। সেই সঙ্গে প্রতিপক্ষের নগর ও অঞ্চল লুণ্ঠনও করা যায়। সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে অসংখ্যবার শুধু দেবতাদের কাছ থেকে ধন-সম্পদ, অন্ন, সুখ, নিরাপত্তা, যুদ্ধজয় ইত্যাদি কামনা করা হয় নি সেই সঙ্গে শত্রুদের ধন-সম্পদ লুণ্ঠনের আকাঙ্ক্ষাও কখনও কখনও প্রকাশ পেয়েছে:

পাতা: ১৩৫


‘হে ইন্দ্র! যে সকল লোক সোমাভিষব করে না এবং যাদের নাশ করা দু:সাধ্য তাদের হত্যা কর, যেহেতু তারা তোমার সুখের জন্য নয়। ওদের ধন আমাদের দাও, তোমার স্তোতাই ধন প্রাপ্ত হয়।’ (১/১৭৬/৪)
‘যে ইন্দ্রকে আমরা স্তব করলাম, যিনি ধনসম্পন্ন এবং আমাদের কামনা পূর্ণ করেছেন। শত্রু এঁর নিকট হতে দূরে পলায়ন করুক, শত্রুর দেশের সকল সম্পত্তি এঁর করতলগত হোক।’ (১০/৪২/৬)
‘হে অতিশয় পূজনীয়, শ্রেষ্ঠনেতা ইন্দ্র! মহাফল লাভার্থে উদর সিক্ত কর। হে মঘবা! তুমি দৃঢ় শত্রুপুরসকল ধনলাভার্থে নষ্ট কর।’
(৮/২৪/১০)
বৈদিক পক্ষে অংশগ্রহণকারী যদু এবং তুর্বশদের সম্পর্কে ঋগ্বেদে অনেকবার উল্লেখ আছে। তারা যে মূলত সিন্ধু সভ্যতার বাইরের অথবা প্রান্তস্খ এবং বিদ্যমান ধর্ম বহির্ভূত জনগোষ্ঠী বা উপজাতি ছিল তা মোটামুটি স্পষ্ট এবং তা নিয়ে বৈদিক পক্ষে যে দ্বিমত এবং দ্বন্দ্ব বা বিরোধ ছিল তাও স্পষ্ট। বলা হচ্ছে :
‘যিনি উৎকৃষ্ট নীতি দ্বারা তুর্বশ ও যদুকে দূরদেশ হতে এনেছিলেন, সে তরুণ ইন্দ্র যেন আমাদের সখা হন।’(৬/৪৫/১)
কিন্তু নীচের ৪/৩০ সূক্তের ঋক দুইটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ :
‘১৭। যজ্ঞপতি বিদ্বান ইন্দ্র অনভিষিক্ত সে তুর্বশ ও যদুকে অভিষেকের যোগ্য করেছিলেন। ১৮। হে ইন্দ্র! তুমি তৎক্ষণাৎ সরযু নদীর পারে আর্য অর্ণ ও চিত্ররথকে বধ করেছিলে।’
উপরের ঋক দুইটি থেকে এটা বোঝা যায় যে, ঋগ্বেদে বহুবার উল্লিখিত তুর্বশ ও যদু নামে উপজাতিদেরকে বৈদিক শক্তি নিজেদের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য বাহির তথা দূরদেশ থেকে এনেছিল। এ নিয়ে তাদের মধ্যে একদল আপত্তি করায় হত্যার মধ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা হয় এবং যদু ও তুর্বশদেরকে বৈদিক ধর্ম ও সমাজের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তুর্বশ এবং যদুদের মধ্যে যারা উত্তর-পশ্চিমের পথ দিয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল সম্ভবত তাদের দেবতা ছিল মরুৎগণ।
ঋগ্বেদ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার ধর্মে বরুণের সঙ্গে মিত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। যেভাবে মিত্রকে বরুণের সঙ্গে উপস্থিত করা হয়েছে তাতে এমন সম্ভাবনা দেখা যায় যে, বরুণের ধর্ম যিনি সিন্ধু সভ্যতায় প্রবর্তন করেছিলেন তাঁর নাম মিত্র। ফলে তাঁকে পরবর্তী কালে দৈব রূপ দেওয়া হতে পারে। এই সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা পরবর্তী একটি অধ্যায়ে আলোচনা করব।
সিন্ধু সভ্যতায় বরুণকেন্দ্রিক ধর্মে অত্যন্ত উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন ত্বষ্টা। তা না

পাতা: ১৩৬


হলে ঋষি কেন এ কথা বলবেন : ‘হে স্তোতা! ত্বষ্টার ন্যায় ইন্দ্রের স্তুতি প্রদীপ্ত করো’ (৩/৩৮/১)। ত্বষ্টাকে বৈদিক সংস্কার দ্বারা নামানো যে হয়েছে সেটা ঋগ্বেদ থেকে সুস্পষ্ট। প্রবল দেবতা হিসাবে বহুবার ত্বষ্টার স্তুতি করা হলেও তার উদ্দেশ্যে সমগ্র ঋগ্বেদে একটি সূক্তও নেই। বস্তুত ঋগ্বেদ থেকে এটা বোঝা যায় যে, বিরাট মর্যাদায় অধিষ্ঠিত দেবতা ত্বষ্টার মর্যাদা ধ্বংস করে ইন্দ্রের উথান শুরু হয়েছে। এবং সর্বোপরি ইন্দ্র ত্বষ্টার পুত্রেরও হত্যাকারী। অবশ্য ইন্দ্রকে আপন পিতারও হত্যাকারী বলা হয়েছে : ‘হে ইন্দ্র! তুমি ভিন্ন কে আপন মাতাকে বিধবা করেছে? তুমি যখন শয়ান থাক অথবা সঞ্চরণ করতে থাক, তখন কে তোমাকে বধ করতে ইচ্ছা করেছে? কোন দেবতা সুখদান বিষয়ে তোমার থেকে বড়? যেহেতু তুমি তোমার পিতার পদদ্বয় গ্রহণ করে পিতাকে বধ করেছ।’ (৪/১৮/১২)
প্রাচীন ধর্মের ঐতিহ্য ও অনুশাসন ভঙ্গ করে যে, ইন্দ্রের উথান ঘটানো হয়েছে উপরের ঋক দ্বারা সেই ঘটনাকে স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে। অপর একটি মন্ত্রও বৈদিক সংস্কারের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ : ‘ইন্দ্র ত্বষ্টাকে সামর্থ্য দ্বারা পরাভূত করে তাঁর চমসস্থিত সোম পান করেছিলেন।’ (৩/৪৮/৪)
এ থেকে বোঝা যায় যে, সিন্ধু ধর্মে দেবতা ত্বষ্টার উদ্দেশ্যে চমসে১ করে সোম আহুতি দেওয়া হত। ত্বষ্টার পরিবর্তে ইন্দ্রের জন্য সোমাভিষব করা হতে লাগল :
‘ইন্দ্র অভিষবকারী ত্বষ্টার গৃহে বলপূর্বক সোমাভিষব ফলদ্বয়ে অভিষুত সোম পান করেছিলেন।’ (৪/১৮/৩)
‘যখন তোমরা২ প্রকাশমান সবিতাকে তোমাদের (সোমপানের) ইচ্ছা জানিয়ে এসেছিলে এবং অসুর ত্বষ্টার নির্মিত সেই একটি সোমপাত্রকে চারখানা করেছিলে, তখন সবিতা তোমাদের অমরত্ব দান করেছিলেন।’ (১/১১০/৩)
অঙ্গিরার পুত্র সুধন্বা, তাঁর ঋভু, বিভু ও বাজ নামে তিন পুত্র ছিলেন। এই তিন ভাই ঋগ্বেদে একত্রে ঋভুগণ নামে অভিহিত। তাঁরা প্রথম ত্বষ্টার মর্যাদা অস্বীকার করেন আর এইভাবে বৈদিক সংস্কারের সূচনায় খুব বড় ভূমিকা রাখেন। এই কারণে পরবর্তী কালে ঋষিগণ তাঁদের দেবতার মর্যাদা দেন এবং তাঁদের স্তুতিতে কিছু সংখ্যক সূক্ত রচনা করেন। তাছাড়া বিভিন্ন স্থানে ঋভুগণের প্রশংসায় ঋষিরা অকৃপণ। এতে আদি ধর্মের প্রথা ভাঙ্গায় ঋভুগণের ভূমিকার গুরুত্ব স্পষ্ট। সুতরাং ঋগ্বেদে ঋভুদের কীর্তি ঘোষণা করা হয়েছে :
‘ত্বষ্টাদেবের নতুন সে চমস নি:শেষিতরূপে নির্মিত হয়েছিল, ঋভুগণ সে চমস পুনরায় চারখানি করেছিলেন।’ (১/২০/৬)
কিংবা ঋভু দেবতার প্রশংসায় ১/১৬১ সূক্ত থেকে সামান্য কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যায় :
‘২। হে সুধন্বার পুত্রগণ! তোমরা একখানি চমসকে চারখানি কর এ কথা দেবতারা

_________________________________________________________________________________
চমস : যজ্ঞপাত্র বা চামচ বিশেষ।
ঋভুগণ।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৩৭


তোমাদের বলে পাঠাচ্ছেন।১ .... ৪। হে ঋভুগণ! তোমরা এ কার্য সম্পন্ন করে জিজ্ঞাসা করলে এ যে দূত আমাদের নিকট এসেছিলেন, তিনি কোথায় গেলেন ? যখন ত্বষ্টা দেখলেন চমস চারখানি হল তখনি তিনি লজ্জায় স্ত্রীলোকদের মধ্যে লুকিয়ে গেলেন। ৫। ত্বষ্টা যখন বললেন, যাঁরা দেবতাগণের পানপাত্র চমসের অবমাননা করেছে, তাদের বধ করতে হবে তখন অবধি ভয়ে ঋভুগণ সোম প্রস্তুত হলে অন্য নাম গ্রহণ করেন এবং কন্যা সে নাম ধরেই তাঁদের প্রীত করেন।’ (১ মণ্ডল, ১৬১ সূক্ত)
ত্বষ্টার সঙ্গে ইন্দ্রের দ্বন্দ্বের কিছু বিবরণ আমরা ইতিপূর্বে দিয়েছি। ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপকে যে ইন্দ্র হত্যা করেছিলেন সে কথাও আমরা জেনেছি। অনুমান করা চলে যে, ত্বষ্টা ছিলেন সিন্ধু সভ্যতার কারিগরী ও প্রকৌশল বিদ্যার দেবতা। কাজেই সিন্ধু সভ্যতার বাঁধগুলি তাঁর নামেও প্রবর্তন করা হত বলে অনুমেয়। তবে বাঁধের দেবতা যে স্বতন্ত্র ছিল সেটা বোঝা যায়। ঋগ্বেদ থেকে এটা স্পষ্ট যে, ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপ ছিলেন বাঁধের দেবতা। অর্থাৎ বৃত্র এবং বিশ্বরূপ এক। নীচের মন্ত্র কয়টি মনোযোগ দিয়ে পড়লে বিশ্বরূপের সঙ্গে বাঁধ এবং জলের সম্পর্ক আছে বলে বোঝা যায় :
‘৮। আপ্তের পুত্র সেই ত্রিত, ইন্দ্র কর্তৃক প্রেরিত হয়ে নিজ পিতার যুদ্ধাস্ত্র সকল গ্রহণপূর্বক যুদ্ধ করলেন। সপ্তরশ্মি ত্রিশিরাকে বধ করলেন। ত্বষ্টার পুত্রের গাভী সমস্ত অপহরণ করলেন। ৯। শিষ্ট পালনকর্তা ইন্দ্র, অভিমানী ও সর্বব্যাপিতেজোবিশিষ্ট ত্বষ্টার পুত্রকে বিদীর্ণ করলেন। তিনি গাভীদের আহ্বান করতে করতে ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপের তিন মস্তক ছেদন করলেন।’ (১০ মণ্ডল, ৮ সূক্ত)
ঋগ্বেদের গো বা ধেনু শব্দ নিয়ে বহু বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়লে এটা স্পষ্ট হয় যে, অনেক সময় গো বা গাভী শব্দ দিয়ে গরু বা ধেনু নয় বরং জলপ্রবাহকে বোঝানো হচ্ছে। এখানেও ঋষিগণ রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। অবশ্য বৈদিক ভাষায় গো-এর অনেক অর্থ ছিল বা আছে। সেগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে জল। আমরা অনুমান করতে পারি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে প্রবলভাবে ধর্মীয় অনুশাসনে প্রভাবিত আমজনতাকে স্বপক্ষে আনার জন্য এবং প্রতিপক্ষের বিরোধিতা এবং আঘাতকে যতটা সম্ভব এড়াবার উদ্দেশ্যে যেসব কৌশলপূর্ণ রূপক বা শব্দ ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে গো বা গাভী একটি। আমরা পূর্ববর্তী একটি অধ্যায়ে, ১/৩২ সূক্তের উদ্ধৃতিতে দেখেছি যে, বলা হচ্ছে : ‘তারপর বৎসের সাথে ধেনুর ন্যায় বৃত্রের মাতা দনু শুয়ে পড়ল’ (১/৩২/৯)। তারপর বলা হচ্ছে ‘হে ইন্দ্র! ....তুমি গাভী জয় করেছ, সোমরস জয় করেছ এবং সপ্তসিন্ধু প্রবাহ ছেড়ে দিয়েছ’ (১/৩২/১২)। আমরা জল বা জলপ্রবাহ হিসাবে গো বা ধেনু শব্দের ব্যবহার সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে অজস্রবার দেখতে পাই।
এখন এটা স্পষ্ট যে, পুরাতন ধর্মের প্রভাবের কারণে একই ধর্মীয় ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত

_________________________________________________________________________________
অগ্নি দেবতা একথা বলছেন। অগ্নিতে দেবতাদের উদ্দেশ্যে খাদ্য আহুতি দেওয়া হয় বলে তাকে দেবতাদের দূত বা জিহ্বা বা মুখও বলা হয়।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৩৮


হয়ে থাকা বাঁধকে বৈদিক ঋষিরা সরাসরি বাঁধের দেবতার নামে আক্রমণ করতে পারেন নি। সেই জন্য কয়েক জায়গায় বিশ্বরূপের নাম উল্লেখ করা হলেও বৃত্র শব্দের সঙ্গে তাকে সরাসরি সংযুক্ত করা হয় নি।
এটা বোঝা যায় যে, বৈদিক ঋষিরা বাঁধের দেবতার নাম না দিয়ে বিভিন্ন নাম দিয়ে বাঁধকে বুঝিয়েছেন যে নামগুলো ব্যবহার করলে সকলে বুঝলেও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতায় নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা বাঁধগুলি একটা পর্যায়ে এসে লাভজনক হবার পরিবর্তে ব্যাপক জনগণের জন্য সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তথা বাঁধগুলি ভাঙ্গার জন্য একটি ধর্মসংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। এইজন্য ধর্মসংস্কারের রূপ আপাত দৃষ্টিতে খুব বড় কিছু না। পূর্ববর্তী ধর্মের প্রায় সব দেবতার অবস্থান কমবেশী রক্ষা করা হয়েছে। এমন কি বাঁধের দেবতার পিতা ত্বষ্টাকেও একেবারে নাকচ করা হয় নি। কিন্তু বিশ্বরূপ বা বাঁধের দেবতাকে নাকচ করা হয়েছে। অর্থাৎ বৈদিক সংস্কারের লক্ষ্য খুবই কেন্দ্রীভূত একটি বিন্দুতে, তা হচ্ছে বাঁধ ধ্বংস করা।
আমরা অনুমান করি ঋগ্বেদে বৃত্র, অহি ইত্যাদি যেসব নাম বাঁধের উপর আরোপ করা হয়েছে সেগুলির কিছু সংখ্যক সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন মিথ বা পৌরাণিক কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেমন অহি। অহি মানে সাপ। সুতরাং নদীর দুইপাশ ঘিরে আঁকাবাঁকা হয়ে থাকা বাঁধকে বোঝাবার জন্য এই শব্দ চমৎকার রূপকল্প তৈরী করে। এটা দিয়ে বাঁধ বোঝানো সহজ। আবার অহি হয়ত বিদ্যমান ধর্ম বা পুরাণকাহিনীগুলিতে এক অপদেবতার নাম ছিল যাকে হত্যা করেছিল কোন পৌরাণিক বীর বা যোদ্ধা। সুতরাং বাঁধ অর্থে অহি এবং বাঁধ ধ্বংসকারী অর্থে ইন্দ্রকে উপস্থাপিত করে প্রাচীন এবং খুব পরিচিত এক জনপ্রিয় মিথকে ঋষিরা সহজে নূতন তাৎপর্য দিতে পারেন। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে ঋষিরা অহি হত্যা বিষয়ে জনপ্রিয় একটি মিথকে ব্যবহার করেছেন বাঁধ ধ্বংসের প্রয়োজনে। স্বাভাবিকভাবে সেক্ষেত্রে বাঁধ ধ্বংসের প্রক্রিয়ায় পুরাতন মিথ তার আদি মর্মবস্তু বা অর্থ হারিয়ে নূতন অর্থ গ্রহণ করেছে।
বৃত্র নিয়েও তেমন কিছু হয়ে থাকতে পারে। এর ফলে জনমানস দেবতা থেকে অপদেবতায় রূপান্তরিত বাঁধের দেবতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য সহজ প্রেরণা ও মানসিক বল লাভ করেছে। অথবা হতে পারে যে, রূপকার্থে বাঁধ বা ব্যারেজ বোঝাতে যেমন পর্বত, অদ্রি, গিরি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তেমন প্রতিবন্ধক (নদীর মাঝখানে বাঁধ বা ব্যারেজ দিলে প্রতিবন্ধক জাতীয় শব্দই অধিকতর উপযুক্ত হয়) অর্থে বৃত্র শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং এক সময় ধর্মীয়ভাবে বহু ব্যবহারে বৃত্র শব্দ অপদেবতার সমার্থক হয়েছে। আমরা দেখতে পাই যে, ঋগ্বেদেও বৃত্রকে ‘নদী প্রতিরোধকারী’ বলা হয়েছে : ‘যখন যজ্ঞান্নপ্রিয় ইন্দ্র জল বর্ষণ করে নদী প্রতিরোধকারী বৃত্রকে হত করলেন’ (১/৫২/২)।
যাইহোক, বিশ্বরূপের যে বৃত্র নামকরণ করা হয়েছে এই যুক্তির সমর্থনে আমরা মহাভারত সহ ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্যের মিথগুলির সাহায্য নিতে পারি। এইসব উপাখ্যান অনুযায়ী ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপকে ইন্দ্র হত্যা করলে তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বৃত্র নামে অপর একটি দানব সৃষ্টি করেন ইন্দ্রকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু ইন্দ্র বৃত্রকেও হত্যা করেন। অর্থাৎ পরবর্তী পুরাণ শাস্ত্রকাররা ভালভাবে জানতেন যে, বৃত্র ত্বষ্টাপুত্র। তবে ঋগ্বেদ বিশ্বরূপকে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থিত করায় তাঁরা ব্যক্তির অভিন্নতা ধরতে পারেন নি কিংবা ঋগ্বেদের মর্যাদা রক্ষার জন্য ত্বষ্টার দ্বিতীয় পুত্র হিসাবে বৃত্র উপাখ্যান তৈরী করেন।

পাতা: ১৩৯


আমরা এখন অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার বরুণের অধীনস্থ অন্যতম প্রধান দেবতা ত্বষ্টার স্থানে প্রথমে ইন্দ্রকে বসানো হয়েছে ত্বষ্টার উদ্দেশ্যে সোমাভিষব বন্ধ করে এবং তা ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রবর্তন করে, এবং অত:পর ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপ হত্যা তথা বাঁধ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রকে বরুণের চেয়েও উচ্চে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে।
বাঁধ ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষা বা প্রয়োজনবোধকে কেন্দ্র করে এই ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন যে একদিনে গড়ে ওঠে নি সেটা ঋগ্বেদ থেকেই স্পষ্ট হয়। এটা স্পষ্ট যে, নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় যে সংকট দেখা দিক তা ছিল একটি শক্তিশালী ও বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত রাষ্ট্রব্যবস্থা দ্বারা সংরক্ষিত। অবশ্য এই রাষ্ট্র তখন পতনোন্মুখ হয়েছিল। তবু তার বিরুদ্ধে জনমত সংগঠন করা বৈদিক শক্তির পক্ষে যে সহজ ছিল না সে সম্পর্কে আমরা বলেছি। সুতরাং ঋগ্বেদে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বহু দ্ব্যর্থক শব্দ এবং রূপক বা উপমার ব্যবহার ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে আসে গো বা ধেনু শব্দ। ঋগ্বেদ এক দুর্বোধ্য রহস্য বা ধাঁধা সৃষ্টি করেছে গো১ বা গাভী কিংবা ধেনু শব্দ প্রয়োগ দ্বারা। এর প্রকৃত অর্থ কিংবা তাৎপর্য না বোঝায় ঋগ্বেদের অনেক ভ্রান্ত ব্যাখ্যা হয়েছে। অথচ আমরা একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে বুঝব যে, বিশেষ কতকগুলি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গাভী বা গরুর সঙ্গে আমাদের বহু পরিচিত দুই শৃঙ্গযুক্ত চতুষ্পদ প্রাণীটির কোন সম্পর্ক নেই, এগুলি নদী বা নদীস্রোতের বর্ণনা মাত্র। আর এই বিষয় ধরতে পারলে বৈদিক আন্দোলনের এক অজ্ঞাত ও চমকপ্রদ অধ্যায় আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়।
গাভীকে কিভাবে জলের বা নদীজলের রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা বোঝার জন্য আগে আমরা কয়টি উপমার প্রয়োগ দেখি :
‘ইন্দ্র পর্বতাশ্রিত অহিকে হনন করেছিলেন; ত্বষ্টা ইন্দ্রের জন্য সুদূরপাতী বজ্র নির্মাণ করেছিলেন; তারপর যেরূপ গাভী সবেগে বৎসের দিকে যায়, ধারাবাহী জল সেরূপ সবেগে সমুদ্রাভিমুখে গমন করেছিল।’ (১/৩২/২)
‘ইন্দ্র স্বকীয় বল দ্বারা জলশোষক বৃত্রকে বজ্র দ্বারা ছেদন করেছিলেন; এবং গাভীসমূহের ন্যায় বৃত্র দ্বারা অবরুদ্ধ জগতের রক্ষণশীল জলসমুদয় ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ (১/৬১/১০)
উপরের মন্ত্র দুইটিতে উপমার প্রয়োগ সহজবোধ্য। এখন আমরা একটু জটিল রূপকে প্রবেশ করতে পারি :
‘হে অঙ্গিরাবংশীয় বৃহস্পতি! পর্বত গোসমূহ আবরণ করেছিল। তোমার সম্পদের জন্য যখন তা উদ্ঘাটিত হল এবং তুমি গোসমূহকে বার করে দিলে, তখন ইন্দ্রকে সহায় পেয়ে তুমি বৃত্র কর্তৃক আক্রান্ত জলের আধারভূত জলরাশিকে আধোমুখ করেছিলে।’ (২/২৩/১৮)

_________________________________________________________________________________
গো শব্দের অর্থ গরু মনে করা হলেও বৈদিক যুগে এর বহু অর্থ ছিল। যেমন গো শব্দ দ্বারা গাভী বা গরু, জল, আলোকরশ্মি, পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, অশ্ব ইত্যাদি অনেক কিছু বোঝানো হত।

_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৪০


উপরের মন্ত্রের তাৎপর্য কি এই নয় যে, বাঁধ জলধারাকে রুদ্ধ করে রেখেছিল এবং যখন তার দরজা খোলা বা ভাঙ্গা হল তখন জলরাশি মুক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছিল? অঙ্গিরা গোত্রের পূর্বকালের ঋষিদের দ্বারা সংঘটিত এই ঘটনার বর্ণনা ঋগ্বেদে বহুবার করা হয়েছে। এবং এটি ঋগ্বেদের বিরাট রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য একটি অসাধারণ সূত্র। এই ধরনের আরও কয়েকটি মন্ত্র উল্লেখ করা যায় :
‘২। যে ব্রহ্মণস্পতি১ স্বীয় বলে অবমানযোগ্যগণকে অবমানিত করেছিলেন, যিনি ক্রোধপরবশ হয়ে শম্বরকে বিদারিত করেছিলেন, নিশ্চল জলকে চালিত করেছিলেন এবং গোধনপূর্ণ পর্বতে প্রবেশ করেছিলেন। ৩। দেবগণের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট দেবতা সে ব্রহ্মণস্পতির কার্য দ্বারা দৃঢ় পর্বত শ্রথিত হয়েছিল ও সংস্তম্ভিত বৃক্ষাদি ভগ্ন হয়েছিল, তিনি গোসকলকে উদ্ধার করেছিলেন, মন্ত্রের দ্বারা বলকে ভেদ করেছিলেন, অন্ধকারকে অদৃশ্য করেছিলেন, এবং আদিত্যকে প্রকাশ করেছিলেন। ৪। যে প্রস্তরবৎ দৃঢ়মুখ বিশিষ্ট, মধুর জলপূর্ণ, নিম্নবিলম্বিত মেঘকে ব্রহ্মণস্পতি বলপ্রয়োগ দ্বারা বধ করেছিলেন, আদিত্যরশ্মি সকল তা পান করেছে এবং তারাই আবার জলধারাময় বৃষ্টিসেক করেছেন।’
(২ মণ্ডল, ২৪ সূক্ত)
‘হে ইন্দ্র! বল নামক গোব্রজ বজ্র প্রহারের পূর্বেই ভীত হয়ে বিশ্লিষ্ট হয়েছিল। ইন্দ্র গাভীর নির্গমনের জন্য পথ সুগম করেছেন, রমণীয় শব্দায়মান জল সকল, বহু লোকের আহূত ইন্দ্রের অভিমুখে আগমন করেছিল।’ (৩/৩০/১০)
‘২। তিনি মেধাবী অঙ্গিরাগণের জন্য জননী স্বরূপ স্বর্গ ও পৃথিবীকে সূর্য দ্বারা প্রকাশিত করেছেন এবং তাঁদের দ্বারা স্তূয়মান হয়ে পর্বতকে চূর্ণ করেছেন এবং ধ্যানপরায়ণ স্তোতৃবর্গ অঙ্গিরাগণ কর্তৃক বার বার প্রার্থিত হয়ে ধেনুগণের বন্ধন মোচন করেছেন। ৩। বহুকর্মের অনুষ্ঠানকারী ইন্দ্র ধেনুগণের উদ্ধারের জন্য জলপাতন পূর্বক নিরন্তর হব্য প্রদানকারী স্তোতৃবর্গ অঙ্গিরাগণের সাথে মিলিত হয়ে শত্রুদের পরাজিত করেছেন। মিত্রভূত, মেধাবী অঙ্গিরাগণের সাথে মিত্রাভিলাষী ও দূরদর্শী হয়ে সে পুরন্দর দৃঢ় পুরীসকল ধ্বংস করেছেন।’ (৬ মণ্ডল, ৩২ সূক্ত) সম্ভবত আর উদাহরণের দরকার হবে না। উপরের মন্ত্রগুলিতে এটা স্পষ্ট যে, এখানে গাভী নদী বা নদীস্রোতের রূপক। দুগ্ধবতী গাভীর দুগ্ধদানের সঙ্গে স্রোতবতী নদীর জলদানের তুলনা থেকে যে ঋষিগণ জলপূর্ণ নদীর স্রোতধারা বোঝাতে গাভীর রূপক ব্যবহার করেছেন সেটা স্পষ্ট।
ঋগ্বেদ আমাদের নিকট এই বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, এই অঙ্গিরাগণ হলেন

_________________________________________________________________________________
ব্রহ্মণস্পতি এখানে অঙ্গিরাগণ ঋষি।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৪১


নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা প্রথম উত্তোলনকারী যাঁরা বৃত্র বা ব্যারেজ যা-ই বলা যাক ভেঙ্গেছিলেন। সম্ভবত নদীর দুই পাড়ের বাঁধ ছাড়াও ছিল দুর্গ এবং নদীর মাঝখানে ছিল বাঁধ, সেতু ও জলকপাট। মাঝখানে সম্ভবত পাথরের কাঠামো ছিল। ঋগ্বেদের বর্ণনার ধরন থেকে মনে হয় যে, মাঝখানে প্রস্তর-কাঠামো এবং সেইসঙ্গে কাঠেরও কাঠামো এবং কাঠের জলকপাট ছিল। ২/২৪/৩ ঋকে বলা হচ্ছে, ‘দৃঢ় পর্বত শ্রথিত হয়েছিল এবং সংস্তম্ভিত বৃক্ষাদি ভগ্ন হয়েছিল’। সংস্তম্ভিত বৃক্ষাদি নদীখাতে বা ব্যারেজে কাষ্ঠস্তম্ভ ও জলকপাটের বর্ণনা বলে মনে হয়। ২/২৪/৪ ঋকে বলা হচ্ছে, ‘যে প্রস্তরবৎ দৃঢ়মুখবিশিষ্ট, মধুর জলপূর্ণ, নিম্নবিলম্বিত মেঘকে ব্রহ্মণস্পতি বলপ্রয়োগ দ্বারা বধ করেছিলেন।’ এটা নদীর মধ্যস্থ অবরোধক বাঁধ বা ব্যারেজে পাথর ব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়। এই কথাগুলিও তাৎপর্যপূর্ণ : ‘১৪। তাঁরা পর্বত বিদারণ সময়ে অগ্নির পরিচর্যা করেছিলেন। অন্য ঋষিগণ সর্বত্র তাঁদের সে কর্ম কীর্তন করেছিলেন। ........... ১৫। তাঁরা কর্মনেতা এবং অগ্নিকাম। তাঁরা মনে মনে গো লাভ ইচ্ছা করে দ্বার নিরোধক, দৃঢ়বদ্ধ, সুদৃঢ়, গাভীগণের অবরোধক এবং সর্বতোব্যাপ্ত গোপূর্ণ গোষ্ঠরূপ পর্বতকে অগ্নি বিষয়ক স্তুতি দ্বারা উদ্ঘাটন করেছিলেন।’ (৪ মণ্ডল, ১ সূক্ত)
উপরের মন্ত্রগুলির অর্থ তো এই যে, অগ্নিদগ্ধ করে জলের নির্গমন দ্বার বা স্লুইস গেট ধ্বংস করা হয়েছিল। নদীখাত মাটি দ্বারা সম্পূর্ণ রুদ্ধ করলে সেখানে নদীমুক্ত করার জন্য অগ্নি প্রয়োগের প্রয়োজন হত না।
বিশেষত বৃহস্পতি দেবতার স্তুতিতে অযাস্য ঋষি কর্র্তৃক রচিত ১০/৬৭ সূক্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার রূপ উপলব্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তার কিছু মন্ত্র বল নামক পর্বত বা বাঁধ দ্বারা নির্মিত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় প্রস্তর এবং জলকপাট সংযুক্ত কাঠামোর চিত্র দেয় :
‘২। অঙ্গিরার বংশধরেরা যজ্ঞের সুন্দর স্থানে যেতে মনস্থ করল। ......... ৩। বৃহস্পতির সহায়গণ হংসের ন্যায় কোলাহল করতে লাগল, তাদের সাহায্যে তিনি প্রস্তরময় দ্বার খুলে দিলেন। অভ্যন্তরে রুদ্ধ গাভীগণ চীৎকার করে উঠল। তিনি উৎকৃষ্টরূপে স্তব ও উচ্চৈ:স্বরে গান করে উঠলেন। ৪। গাভীগণ নিম্নের দিকে একটি দ্বারের দ্বারা এবং উপরের দিকে দু’টি দ্বারের দ্বারা অধর্মের আলয় স্বরূপ সে গুহার মধ্যে রুদ্ধ ছিল। বৃহস্পতি অন্ধকারের মধ্যে আলোক নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে তিনটি দ্বার খুলে দিলেন এবং গাভীগণকে নিষ্কাশিত করলেন। ৫। তিনি রাত্রে নিভৃতভাবে শয়নপূর্বক পুরীর পশ্চাৎভাগ বিদীর্ণ করলেন এবং সমুদ্রতুল্য সে গুহার তিনটি দ্বারই খুলে দিলেন। প্রাত:কালে তিনি পূজনীয় সূর্য আর গাভী একসঙ্গে দর্শন পেলেন, তখন তিনি মেঘের ন্যায় বীরহুঙ্কার ছেড়েছিলেন। ৬। যে বল গাভী রুদ্ধ করেছিল, তাকে ইন্দ্র আপনার হুঙ্কাররবেই ছেদন করলেন। ......... তিনি পণিকে কাঁদালেন, তার গাভী কেড়ে নিলেন। ৭। তিনিই সত্যবাদী, দীপ্তিমান, ধনদানকারী সহায়দের সাথে গাভীরোধকারী বলকে বিদীর্ণ করলেন। আর ব্রহ্মণস্পতি বিপুলমূর্তি, বদান্য, ঘর্মাক্ত কলেবর দেবতাদের সাথে সে গোধন অধিকার করলেন।’ (১০ মণ্ডল, ৬৭ সূক্ত)

পাতা: ১৪২


উপরের মন্ত্রে অঙ্গিরাবংশীয় পূর্বতন বা প্রাচীন ঋষিগণ যে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করেন তার রূপকল্পময় এবং আলঙ্কারিক বর্ণনা আমরা পাচ্ছি। এখানে ব্রহ্মণস্পতি বা বৃহস্পতি শব্দ দ্বারা এই প্রাচীন ঋষিদেরকে বোঝানো হয়েছে যারা এই ধ্বংসের কাজ প্রথম সম্পন্ন করেন। ঋগ্বেদে বহুবার বলের বিদারণ বা বিনাশের প্রসঙ্গ এসেছে। হতে পারে যে, ঐ বিশেষ বাঁধ বা ব্যারেজের নাম ছিল বল বা ঐ বাঁধের দেবতার নাম ছিল বল। আর এই ঘটনায় অঙ্গিরাগণ বৃত্রবিরোধী বৈদিক আন্দোলনে বীরে পরিণত হয়েছেন।
কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, অঙ্গিরাগণ নামে পরিচিত অঙ্গিরা গোত্রের ঐ ঋষিগণ ছিলেন পরবর্তী সফল বৈদিক আন্দোলনের অনেক কাল পূর্বের মানুষ। এই কারণে ঋগ্বেদের ঋষিগণ তাঁদের সম্পর্কে এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষ অঙ্গিরাগণ’ (১/৬২/২)অথবা ‘অঙ্গিরা নামক আমাদের পিতৃগণ’ (১/৭১/২) কিংবা ‘আমাদের পিতৃপুরুষগণ’ (৪/১/১৩)। ঋগ্বেদে তাঁদের প্রাচীন কীর্তির উল্লেখ বহুবার বহুভাবে হয়েছে। এর সঙ্গে আবার পণি এবং সরমার নামও অনেক বার যুক্ত হয়েছে।
এই অঙ্গিরাগণই বৃত্রবধের উদ্দেশ্যে প্রথম ইন্দ্র এবং অগ্নি দেবতাকে প্রাধান্যে আনেন বলে মনে হয়। গৃৎসমদ ঋষি বলছেন, ‘হে স্তোতাগণ! তোমরা অঙ্গিরাগণের ন্যায় নূতন স্তুতি দ্বারা ইন্দ্রকে উপাসনা কর। যেহেতু ইন্দ্রের শোষক তেজ: পূর্বকালের ন্যায় উদিত হচ্ছে। যেহেতু সোম জনিত হর্ষ উৎপন্ন হলে ইন্দ্র বৃত্র কর্তৃক আক্রান্ত সমস্ত মেঘরাশি উদ্ঘাটিত করেছিলেন’ (২/১৭/১)।
কুশিক অথবা বিশ্বামিত্র ঋষি বলছেন, ‘হে ইন্দ্র! তুমি পুরাতন, অঙ্গিরাগণের ন্যায় আমি তোমাকে পূজা করছি, আমি তোমাকে ভজনা করবার জন্য নূতন করছি। তুমি দেবশূন্য বহুদ্রোহকারীদের মেরে ফেল’ (৩/৩১/১৯)।
একজন অঙ্গিরার পুত্র হিরণ্যস্তূপ ঋষি বলছেন, ‘হে অগ্নি! তুমি অঙ্গিরা ঋষিদের আদি ঋষি ছিলে’ (১/৩১/১)। ‘হে অগ্নি! তুমি অঙ্গিরাদের মধ্যে প্রথম ও সর্বোত্তম’ (১/৩১/২)।
অত্রির অপত্য সুতম্ভর ঋষি বলছেন, ‘হে অগ্নি! তুমি গুহামধ্যে নিগূঢ় হয়ে এবং বনে আশ্রয় গ্রহণ করে অবস্থান করছিলে, অঙ্গিরাগণ তোমাকে আবিষ্কার করেছেন’ (৫/১১/৬)।
ঋগ্বেদের বর্ণনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, অঙ্গিরাগণ বৃত্র ধ্বংসের জন্য প্রথম ধর্ম সংস্কার করেন এবং বরুণের পরিবর্তে ইন্দ্র এবং অগ্নিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদান করেন এবং সর্বোপরি প্রথম বৃত্র বা একটি জলনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ধ্বংস করেন।
অর্থাৎ এটি ছিল বিদ্যমান সিন্ধু-হরপ্পান রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কর্র্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ। কিন্তু এটি প্রথম পর্যায়, একটি ধর্মীয় সশস্ত্র অভ্যুথানের পর্যায়। হয়ত এটি ছিল একটি অঞ্চলের গণ-অভ্যুথান। কিন্তু সম্ভবত এটি সফল হয়েও ব্যর্থ হয়েছিল। সম্ভবত হরপ্পান রাষ্ট্র এই অভ্যুথানকে দমন করতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ ঋগ্বেদ থেকে এটা স্পষ্ট যে, এই ঘটনা অনেক কাল পূর্বের। হয়ত দুই, তিন অথবা চার প্রজন্ম পূর্বের ঘটনা ছিল এটা। এই অঙ্গিরাগণের কোন মন্ত্র পর্যন্ত ঋগ্বেদে নেই। কিন্তু এই ঘটনাই পরবর্তী সাফল্যের ভিত্তি নির্মাণ করেছে এবং সমস্ত আন্দোলনের জন্য অগ্নি মশাল হয়ে পথ দেখিয়েছে।

পাতা: ১৪৩


এখন এটা স্পষ্ট যে, অঙ্গিরাদের মত অনেক ঋষি, রাজর্ষি ও ব্যক্তি বৈদিক আন্দোলন গড়ে তুললেও ঋগ্বেদ এই আন্দোলনের পরিণত ও চূড়ান্ত পর্যায়ের সৃষ্টি। এই কারণে আমরা ঋগ্বেদে বৈদিক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসাবে অনুমান করা যায় এমন কিছু সংখ্যক ঋষি-রাজর্ষির নাম পেলেও তাঁদের কোন মন্ত্র পাই না। অর্থাৎ অনুমান করা চলে যে, বৈদিক সমাজ শুধু তাঁদের মন্ত্রগুলিকে রক্ষা করেছে যাঁরা মোটামুটি একটা স্থিতিশীল ও বর্ধিষ্ণু গণভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বৈদিক আন্দোলনকে পরিণত ও সফল রূপ দিতে পেরেছেন।
যাইহোক, ঋগ্বেদ থেকে আমরা নদীনিয়ন্ত্রণকারী বাঁধে জলকপাটের সপক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন পাচ্ছি। পূর্বোল্লিখিত ১০/৬৭/৪ ঋকে তিনটি দ্বারের উল্লেখ পাচ্ছি। বোঝা যায় যে, জলকপাট তিনটির সাহায্যে নদীর জলপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হত। বস্তুত জলকপাট বা স্লুইস গেট ছাড়া নদী নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের যে, জলকপাটের সাহায্যে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারিগরী বিদ্যা জানা ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় লোথাল ডকইয়ার্ডে জলকপাটের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ থেকে। এখন এটা অনুমেয় যে, নদীমধ্যস্থ কিছু সংখ্যক বাঁধ বা বৃত্রে তিনটি দ্বার থাকত যেগুলি পোক্ত কাষ্ঠনির্মিত হত এবং এগুলি কোন পদ্ধতিতে নদীমধ্যে ওঠানো নামানো যেত এবং এইভাবে নদীপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা হত। সম্ভবত নীচের জলকপাটের উপরে সেতুর মত কাঠামোতে সংযুক্ত ছিল আরও উচ্চে উথিত তিনটি কাষ্ঠ নির্মিত ত্রিকোণ কাঠামো যেগুলিকে দূর থেকে তিনটি মস্তক বা মাথার মত দেখাত। ফলে এগুলিকে বাঁধ দেবতা বিশ্বরূপের তিন মাথা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। ত্রিশিরা১ মানেও তাই। অর্থাৎ তিন শীর্ষধারী জলকপাট সমন্বিত বাঁধ ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে পূর্বোল্লিখিত ১০/৮/৯ ঋকে।
সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে, ঋগ্বেদ সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের মধ্যকার একটি গৃহযুদ্ধের বিবরণ আমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে যার সঙ্গে কল্পিত বহিরাগত যাযাবর আর্য এবং স্থানীয় অনার্যদের মধ্যে যুদ্ধের কোন সম্পর্কই নেই।
আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, যজ্ঞহীন, দেববিরোধী, সোমাভিষবহীন দাস, দস্যু, রাক্ষস ইত্যাদি নামে ঋগ্বেদে যাদেরকে অভিহিত করা হয়েছে তারা বৈদিক পক্ষের মত একই সমাজভুক্ত প্রতিপক্ষ মাত্র। অর্থাৎ উপরোক্ত শব্দগুলি জাতিবাচক পরিচয় বহন করে না। এগুলি গুণবাচক শব্দ বা বিশেষণ মাত্র। সুতরাং আর্যও ঠিক তাই। এর সঙ্গে গাত্রবর্ণ বা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী কিংবা জাতির কোন সম্পর্ক নেই।
এটা বিস্ময়কর যে, সমগ্র ঋগ্বেদে সামান্য কয়বার দাস-দস্যুদের সঙ্গে কৃষ্ণ বর্ণের উল্লেখ করা হলেও এটাকে খুব বড় করে দেখিয়ে ইউরোপীয় পণ্ডিতদের এক বৃহদাংশ আর্যের সঙ্গে শ্বেতবর্ণ এবং দাস-দস্যুর সঙ্গে কৃষ্ণবর্ণ পরিচয় যুক্ত করে দিয়েছিলেন।

_________________________________________________________________________________
১০/৮/৮ ঋকে কথিত ত্রিশিরাকে বৈদিক ভাষায় ত্রিশীর্ষাণং বলা হয়েছে, যার মানে তিন মস্তকবিশিষ্ট। বাংলা ত্রিশিরা মানেও তা হতে পারে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৪৪


আমরা শ্বেতবর্ণ আর্যের উল্লেখ পাই :
‘তিনি১ অনেকের দ্বারা আহূত হয়ে এবং গমনশীল মরুৎগণের দ্বারা যুক্ত হয়ে পৃথিবী নিবাসী দস্যু ও শিম্যুদের প্রহার করে হননকারী বজ্র দ্বারা বধ করলেন, পরে আপন শ্বেতবর্ণ মিত্রদের সাথে ক্ষেত্র ভাগ করে নিলেন, শোভনীয় বজ্রযুক্ত ইন্দ্র সূর্য এবং জল সমুদয় প্রাপ্ত হলেন।’
(১/১০০/১৮)
কৃষ্ণবর্ণ বা কৃষ্ণত্বক দস্যুর উল্লেখ পাই :
‘১। যে সোমসকল জলের ন্যায় শীঘ্র দীপ্তিযুক্ত ও গমনশীল হয়ে কৃষ্ণত্বকদের হনন করে বিচরণ করেন তাদের স্তব কর। ২। ব্রতরহিত দস্যুকে অভিভব করে আমরা সুন্দর সোমের রাক্ষসবন্ধন ও রাক্ষস হনন ইচ্ছায় স্তব করব।’ (৯ মণ্ডল, ৪১ সূক্ত)
১/১০০/১৮ ঋকে যে শ্বেতবর্ণ মিত্রদের সঙ্গে ক্ষেত্র ভাগ করে নেবার কথা বলা হয়েছে মন্ত্রের বর্ণনাভঙ্গি থেকে তাদের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বহিরাগত বলে অনুমান করা যায়। সেক্ষেত্রে তারা তুলনায় বেশী শ্বেতবর্ণের হতে পারে।
কিন্তু এটা লক্ষণীয় যে, দাস-দস্যুদের প্রসঙ্গে সামান্য কয়বার কৃষ্ণবর্ণ বা ত্বকের কথা থাকলেও আর্যদের প্রসঙ্গে শ্বেতবর্ণের উল্লেখ আরও কম পাওয়া যায়। এমন কি কৃষ্ণ বা শ্যামবর্ণ আর্যের বিবরণও আমরা ঋগ্বেদে পাই :
‘৩৬। পুরুকুৎসের পুত্র ত্রসদস্যু আমাকে পঞ্চাশ জন বন্ধু প্রদান করেছেন; তিনি দাতাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আর্য এবং সৎপতি। ৩৭। সুনিবাসবিশিষ্ট নদীর ঘাটে, শ্যামবর্ণদের নেতা, পূজনীয় ধনদানার্হ ২১০ সংখ্যক গোসমূহের পতি ত্রসদস্যু অন্ন ও ধন দান করেছিলেন।’ (৮ মণ্ডল, ১৯ সূক্ত)
অর্থাৎ আর্যত্বের সঙ্গে গাত্রবর্ণের সম্পর্কের কোন প্রমাণই আমরা ঋগ্বেদ থেকে পাই না। বস্তুত দাস-দস্যু সম্পর্কে যে অতি সামান্য কয়বার কৃষ্ণ বর্ণের উল্লেখ আছে তার প্রকৃত অর্থ সম্পর্কেও আমরা নি:সংশয় নই। কৃষ্ণ দ্বারা অশুভ শক্তি বা বস্তু বোঝানো হতে পারে। অর্থাৎ এগুলি পর্বত, গাভীর মত দ্ব্যর্থক হতে পারে। আর এটাও ঠিক যে, গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল বা শ্বেত হলে আজকের মত গৌরববোধ সেকালেও থাকা স্বাভাবিক। ফলে কদাচিত শ্যাম বা কৃষ্ণবর্ণের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশের জন্য কোন ঋষি প্রতিপক্ষের কৃষ্ণবর্ণের কথা উল্লেখ করতে পারেন। অবশ্য তেমন উদাহরণও আমাদের সামনে এতই সামান্য যে, এটা সহজবোধ্য যে, উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমের বিশাল অঞ্চলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ভিতর গাত্রবর্ণের বিভিন্নতা আজকের মত সেকালেও ছিল। ফলে সেটা আর্যদের ভিতর থাকায় এই বিষয় নিয়ে বৈদিক পক্ষের অহংকার করার মত তেমন কিছু ছিল না।
বস্তুত ঋগ্বেদ মনোযোগ দিয়ে পড়লে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, আর্য শব্দ একটি গুণবাচক শব্দ মাত্র। পণ্ডিতদের মতে আর্য শব্দের উদ্ভব ‘ঋ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ কৃষি। অর্থাৎ আর্য শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে কৃষক। বোঝা যায় অরণ্যের বর্বরতা থেকে যারা কৃষির উদ্ভব ও

_________________________________________________________________________________
ইন্দ্র
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৪৫


বিকাশ ঘটিয়েছিল তাদের পরিচয় হিসাবে আর্য শব্দের উদ্ভব হয়। এটা তখনই ছিল একটি গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক শব্দ। পরবর্তী কালে কৃষি থেকে নগর সভ্যতা গড়ে উঠলে আর্য শব্দটি সভ্যতার সঙ্গে জড়িত হয়ে যায়। ফলে তার অর্থের আরও উত্তরণ ঘটে। এটা বোধগম্য যে, সিন্ধু সভ্যতার উচ্চবর্গের লোকেরা নিজেদেরকে আর্য বলত। ভারতবর্ষে পরবর্তী কালের হিন্দু, বৌদ্ধ ও অন্যান্য সাহিত্য থেকে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সভ্য, ভদ্র, প্রভু, মাননীয়, শ্রেষ্ঠ, সাধু, কর্তব্যাচারী ইত্যাদি শব্দের সমার্থক ছিল আর্য। আর তাই আর্য একটি ভদ্রতা বা সম্মানসূচক সম্বোধনও ছিল।
সুতরাং আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, বৈদিক সংস্কার আন্দোলন শুরু হলে বৈদিক পক্ষ প্রতিপক্ষকে হেয় এবং নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করার জন্য তাদেরকে যেমন দাস, দস্যু, রাক্ষস ইত্যাদি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যসূচক অভিধায় ভূষিত করেছে তেমন নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব সূচক আর্য নামে অভিহিত করেছে। আর এইভাবে আর্য শব্দ বৈদিক ধর্মমতে বিশ্বাসীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হল বৈদিক সংস্কার দ্বারা। ইসলামে যেমন শত্রুকে কাফের এবং নিজেদেরকে মুমিন বলা হয়েছে ব্যাপারটা যেন তেমন। সুতরাং আমরা ঋগ্বেদে বৈদিক আর্যদের মধ্যকার যেসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্র পাই তা অভিন্ন বৈদিক ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রকাশ।
আর্য যে একটি গুণবাচক নাম বা শব্দ মাত্র তা ঋগ্বেদের একটি ঋক দ্বারাও স্পষ্ট হয় : ‘...... আমি শুষ্ণ নামক ব্যক্তির বধের জন্য বজ্র ধারণ করেছিলাম। আমি দস্যুকে১ “আর্য” এ নাম হতে বঞ্চিত রেখেছি’ (১০/৪৯/৩)। অর্থাৎ আর্য এমন একটি নাম যা কাউকে দেওয়া যায়, আবার কাউকে এই নাম থেকে বঞ্চিতও করা যায়।
আবার আর্য যে বৈদিক ধর্ম বিশ্বাসের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটাও বোঝা যায় : ‘হে ইন্দ্র! কারা আর্য এবং কারা দস্যু তা অবগত হও। কুশযুক্ত যজ্ঞের বিরোধীদের শাসন করে বশীভূত কর।’ (১/৫১/৮)
উপরের ঋক থেকে এটাও স্পষ্ট যে, যুদ্ধে উভয়পক্ষ নিজেদেরকে আর্য বলে দাবী করত।
_________________________________________________________________________________
উপরের উদ্ধৃত দস্যু শব্দ প্রসঙ্গে এটা বলা দরকার যে, আমরা যে বাংলা অনুবাদ গ্রন্থের মন্ত্রগুলি আমাদের এই গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছি সেখানে অনুবাদে বলা আছে, ‘আমি দস্যু জাতিকে আর্য এ নাম থেকে বঞ্চিত রেখেছি।’ অনুবাদক কিছু জায়গায় দাস, দস্যু, আর্য ইত্যাদির সঙ্গে ‘জাতি’ শব্দ যুক্ত করেছেন। কিন্তু বৈদিক ভাষার মূল গ্রন্থে কোথায়ও জাতি বা তার সমার্থক শব্দ ব্যবহার করা হয় নি। উপরের ঋকেও নয়। অবশ্য কতিপয় ক্ষেত্রে আর্য-বর্ণ বলা হয়েছে যার অর্থ আর্য-সমাজ বা সম্প্রদায় হওয়া সঙ্গত। বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষায় বর্ণের অনেক অর্থ আছে যার মধ্যে শ্রেণী, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ইত্যাদি পড়ে। বস্তুত ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দ্বারা সৃষ্ট বৈদেশিক ও বহিরাগত ‘আর্য জাতি’ দ্বারা দাস-দস্যু নামে স্থানীয় জাতিগুলো পরাজিত হয়েছিল এমন একটা ধারণা অনুবাদকের মনে প্রভাব ফেলায় অনেক সময় অনুবাদেও তার ছাপ পড়েছে। কাজেই এক্ষেত্রে এমনভাবে অনুবাদ করা হয়েছে যেন এটি একটি জাতিবাচক শব্দ যা মূলে আছে। কিন্তু প্রকৃত অনুবাদ হবে, ‘আমি দস্যুকে আর্য এ নাম হতে বঞ্চিত রেখেছি।’ মূল ঋকের দ্বিতীয় বাক্যটি নিম্নরূপ :
অহং শুষ্ণস্য শ্রথিতা বধর্য়মং ন যো রর আর্যং নাম দস্যবে।’
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৪৬


খুব সম্ভবত বৈদিক শক্তির প্রতিপক্ষ বা শত্রুরাও একইভাবে বৈদিকদেরকে দাস, দস্যু, রাক্ষস, যাতুধান, দেবতা-বিরোধী বা অসুর-বিরোধী, যজ্ঞরহিত, অমানুষ ইত্যাদি বলে নিন্দা করত এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্র রচনা বা পাঠ করে বৈদিকদের ধ্বংস ও বিনাশ প্রার্থনা করত।
আধুনিক কালের পণ্ডিতগণ ঋগ্বেদে গরুর বেশী উল্লেখ দেখে মনে করেছেন যে, আর্যরা ছিল পশুপালক। আর তাই এত গরুর উল্লেখ। কিন্তু আমরা দেখেছি যে, ঋগ্বেদের সব গরু গরু নয়। তবে এটা ঠিক যে, ঋগ্বেদে গরু বা গোধন কামনা করা হয়েছে অসংখ্য বার। কিন্তু এটা সহজবোধ্য ঘটনা যে, পশুপালনের জন্য গরুর এত গুরুত্ব নয়, এটা কৃষির কারণে। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতায় লাঙ্গল-ভিত্তিক কৃষির ব্যাপকতার ফলে গরুর যে গুরুত্ব সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রতিফলন আমরা পাই শুধু ঋগ্বেদে নয় অধিকন্তু সিন্ধু সভ্যতার সিলেও, যেগুলিতে বৃষ-চিত্রের প্রাচুর্য রয়েছে। আধুনিক পণ্ডিতগণের বিভ্রান্তির অপর একটি কারণ অশ্ব বা ঘোড়া। ঋগ্বেদে অশ্বের প্রচুর উল্লেখ আছে। বিভিন্ন দেবতার বাহন অশ্বরথ। বিশেষত ইন্দ্রের সঙ্গে অশ্ব খুব ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়ার ব্যবহার ছিল না বলে তাঁরা সাধারণত মনে করেন।
কিন্তু আমরা ইতিপূর্বে আলোচনায় দেখেছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় ঘোড়ার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এটা ঠিক যে, সাক্ষ্য খুব কম এবং ঋগ্বেদে ঘোড়া বা অশ্ব ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হলেও একটা সিলেও অশ্বের চিত্র পাওয়া যায় নি।
এ ক্ষেত্রে আমরা কিছু ব্যাখ্যা খুঁজে পাই। প্রথমত অশ্ব শব্দ নিয়েও অয়সের মত বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বৈদিক ভাষায় অশ্ব শব্দ দ্বারা প্রথমে গাধা বোঝান হত। সেই সময় ঘোড়ার ব্যবহার জানা ছিল না। পরবর্তী কালে ঘোড়ার ব্যবহার শুরু হলে অশ্ব শব্দ ঘোড়ার জন্যও প্রযুক্ত হতে শুরু করে।১ তখন রাসভ বা গর্দভ শব্দ গাধার জন্য প্রযুক্ত হয়। কিন্তু অশ্ব দ্বারা যে অনেক কাল পর্যন্ত দ্রুতগামী ঘোড়া এবং মন্থরগতি গাধা দেখতে প্রায় এক রকম এই দুই পশুকেই বোঝান হত তা ঋগ্বেদ থেকেও বোঝা যায়। কারণ ঋগ্বেদে ইন্দ্রের প্রসঙ্গে মন্থরগতি অশ্বের উল্লেখও পাই : ‘তিনি মন্থরগতি অশ্বে আরোহণপূর্বক শত্রুদের মধ্যে নিহিত ধনসকল জয় করেন’ (৬/৪৫/২)। অথচ ইন্দ্রকে আমরা সচরাচর বেগবান অশ্বচালিত রথের আরোহী যোদ্ধা-দেবতা হিসাবে দেখতে পাই : ‘হে ইন্দ্র! .... শুষ্ণকে বধ করবার জন্য কর্তনসাধন বজ্র নিয়ে বায়ুবৎ বেগশালী অশ্বের সাথে এস’ (১/১৭৫/৪)।
যাইহোক, অশ্ব যে গাধার জন্য এককালে প্রযুক্ত ছিল তার প্রমাণ হচ্ছে অশ্ব থেকে গাধা অর্থে বিভিন্ন ভাষায় শব্দের উদ্ভব। যেমন অশ্ব থেকে ইংরাজী অ্যাস বা Ass শব্দ যার অর্থ গাধা। পুরাতন ইংরাজীতে শব্দটি ছিল Assa. লাতিন ভাষায় গাধা হচ্ছে Asinus.
_________________________________________________________________________________
Bhagwan Singh -এর The Vedic Harappans নামক গ্রন্থে অশ্ব শব্দের গাধা থেকে ঘোড়ায় উত্তরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে। দেখুন, The Vedic Harappans, pp. 56-73
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৪৭


তবে এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, ইন্দ্র এবং মরুৎগণ দেবতাদের সঙ্গে দ্রুতগতিসম্পন্ন ঘোড়া বা অশ্বের ব্যবহার বেশী দেখা যায়। অন্যান্য দেবতা অশ্বরথ ব্যবহার করলেও যে, সেগুলো সব ঘোড়া চালিত ছিল তা মনে হয় না। অর্থাৎ ঋগ্বেদের সব অশ্ব ঘোড়া নয়। এমনকি ইন্দ্রের অশ্বও সর্বদা তা নয়। আমরা অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ুগত কারণে অশ্ব তেমন উন্নত মানের হত না। ফলে এখানে তার প্রচলন কিংবা জনপ্রিয়তা থাকার কারণ ছিল না। কিন্তু বৈদিক যুদ্ধে যখন বহিরাগতরা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এসে বৈদিক শক্তির সঙ্গে যোগ দেয় তখন অন্তত তাদের এক বৃহৎ অংশ দ্রুতগতি অশ্ব বা ঘোড়া নিয়ে এসেছিল। অন্যদিকে বৈদিক ঋষিগণ যুদ্ধে প্রবলতর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রয়োজনে বৈদিক সংস্কার দ্বারা যুদ্ধে অশ্ব ব্যবহার প্রবর্তন করেন। সুতরাং ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি দেবতার বাহন হিসাবে ঘোড়া অর্থে অশ্ব ব্যবহার শুরু করেন। অর্থাৎ পুরাতন ধর্ম সংস্কারের সঙ্গে সমাজে যেসব নূতন উপাদান প্রবর্তন বা সংযোজন করা হয় তার মধ্যে অশ্ব একটি বলে মনে হয়।
তবে যুদ্ধেও অশ্ব ব্যবহার কতটা ব্যাপক ছিল সন্দেহজনক। সম্ভবত দেবতাদের ক্ষেত্রে অশ্বের ব্যবহার করা হয়েছে তার দ্রুতগতির জন্য প্রতীকী অর্থে। ঘোড়া হচ্ছে যুদ্ধে গতিশক্তির দ্যোতক। সুতরাং এটিকে দেবতাদের বাহন বা দেবতাদের রথের বাহন করা হয়েছে। অর্থাৎ বৈদিক যুদ্ধে ঋগ্বেদের ঘোড়ার ব্যবহার প্রধানত প্রতীকী বলে আমরা ধরে নিতে পারি। কাজেই সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ঋগ্বেদের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সেখানে ঘোড়ার ব্যাপক প্রচলন এমনকি তার অস্তিত্বেরও কোন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের প্রয়োজন নেই। এটি সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের সময়ে গৃহযুদ্ধের প্রয়োজনে একটি নূতন প্রবর্তিত উপাদান মাত্র যার ব্যবহার পূর্বে যদি থেকেও থাকে তবে তা একেবারে নগণ্য ছিল।
বস্তুত শুধু প্রত্নতত্ত্ব দ্বারা কোন একটি সমাজের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সবকিছু বোঝা সম্ভব নয়। এমনকি প্রত্নতত্ত্ব অনেক সময় সত্যের বিপরীতে নিতে পারে। একটি সহজ উদাহরণ দিলে প্রত্নতত্ত্বের সীমাবদ্ধতা বোঝা যাবে। এক সময় আরবের মক্কার কাবা ঘরে শত শত দেবদেবীর মূর্তি ছিল। দেড় হাজার বছর আগে এক ধর্মসংস্কারের মাধ্যমে কাবা নিরাকার আল্লাহর উপাসনা গৃহে পরিণত হয়েছে। এখন কোন্ প্রত্নতত্ত্ব আমাদেরকে দেড় হাজার বছর আগের প্রকৃত চিত্র দিতে পারবে? বরং প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য-প্রমাণকে মানতে হলে বলতে হবে যে, কাবা চিরকালই মূর্তিহীন উপাসনা গৃহ। সুতরাং শুধু প্রত্নতত্ত্ব ভুল সিদ্ধান্তে নিতে পারে। সাহিত্যেরও দরকার হয়, দরকার হয় আরও অনেক কিছুর, যেমন ভূ-তত্ত্ব।   
আসলে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সাহিত্য হিসাবে ঋগ্বেদকে দেখতে না চাইলে কখনই সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তার সঠিক সম্পর্ক নির্ণয় করা যাবে না। আরব এবং ইসলামের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে বলতে পারি যে, ইসলাম এবং কোরআন মানেই চিরকালের আরব সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নয়। দেড় হাজার বছর পূর্বে ভিন্ন ধরনের আরব সমাজ ছিল যার ভিতর থেকে ইসলাম উঠে এলেও পুরাতন আরব সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার একটা বড় ধরনের বিচ্ছেদও আছে।

পাতা: ১৪৮


ঋগ্বেদের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। ঋগ্বেদ মানেই চিরকালের সিন্ধু সভ্যতা নয়। তা সিন্ধু সভ্যতার একটা পর্যায়ের একটা অংশকে মাত্র তুলে ধরে। তার বাইরে সেখানে বহু কিছু আমরা নাও পেতে পারি। বস্তুত যুদ্ধের প্রয়োজনে বৈদিক সংস্কারের মাধ্যমে বাহির থেকে আনা বিভিন্ন উপাদান যেমন সমাজে প্রবর্তন করা হয়েছে তেমন সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন অবদমিত কিংবা গৌণ উপাদানকে মুক্ত করা অথবা প্রাধান্যে আনা হয়েছে। আর এ প্রসঙ্গে আমরা সোমের উপর আলোচনা করতে পারি বৈদিক সংস্কারের তাৎপর্যের আরও একটু গভীরে যাবার জন্য।
বৈদিক সংস্কারে সোমের গুরুত্ব কতখানি তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি অশ্বের গতির উল্লেখ অনেকবার করা হলেও এবং ইন্দ্রের সঙ্গে অশ্বের সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ অসংখ্যবার হওয়া সত্ত্বেও অশ্বদেবতার উপর সামান্য কয়েকটি মাত্র সূক্ত রচনা করা হয়েছে, অথচ সোমের উপর সম্পূর্ণ সূক্ত বহু সংখ্যক। সমস্ত ঋগ্বেদ জুড়ে সোমের উল্লেখ অজস্রবার করা হয়েছে। কারণ এটা দেবতাদের আহার যা স্তুতির সঙ্গে অগ্নিতে আহুতি দিতে হত। বিভিন্ন মণ্ডলে সোমের স্তুতিতে শুধু ঋক নয় সূক্তও রচিত হয়েছে যেখানে বহু সংখ্যক ঋক আছে। এর পরেও সোমের স্তুতিতে রচিত ১১৪টি সম্পূর্ণ সূক্ত নিয়ে পবমান সোম দেবতা নাম দিয়ে ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলের সম্পূর্ণটা গঠিত হয়েছে। একটা উদ্ভিদের উপর এত গুরুত্ব দেবার পিছনে নিশ্চয় একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে, যার অনুসন্ধান বৈদিক সংস্কারের একটা বিশেষ দিককে আমাদের সামনে উন্মোচিত করতে পারে।
আমরা আগে জেনেছি যে, ত্বষ্টার উদ্দেশ্যে পূর্বে সোমরস অভিষব করা এবং আহুতি দেওয়া হত। সম্ভবত আরও কিছু দেবতার উদ্দেশ্যে সোমাভিষব করা হত। তবে সেটা মদকর বা মাদক করে আহুতি দেওয়া হত কিনা বলা কঠিন। হতে পারে যে, নদীর বাঁধ, জলকপাট নির্মাণ ও মেরামতের মত যেসব কাজ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য, কষ্টকর ও বিপজ্জনক ছিল সেসব কাজকে সহজসাধ্যের অনুভূতি দেবার জন্য ঐসব কাজে নিয়োজিত জনশক্তিকে মদ বা সুরা পানের অনুমোদন ও উৎসাহ দেওয়া হত। ফলে বাঁধের দেবতা হিসাবে বিশ্বরূপের মত দেবতার উদ্দেশ্যে সোমরস থেকে প্রস্তুত মদ পূজায় আহুতি দেওয়া হতে পারে।
তবে বৈদিক সংস্কারের মাধ্যমে সোমাভিষব ইন্দ্র সহ বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে প্রচলন করা হলেও এটা ছিল বিশেষভাবে ইন্দ্রের জন্য নির্ধারিত এবং ইন্দ্রকে যে সাধারণত মাদক সোম বা সোমরস থেকে প্রস্তুত মদ আহুতি দেওয়া হত সেটা ঋগ্বেদ থেকে ভালভাবে বোঝা যায়। আমরা বৈদিক ধর্ম সংস্কারে সোমাভিষবের তাৎপর্য বোঝার জন্য কয়েকটি মন্ত্র উদ্ধৃত করব :
‘শূর ইন্দ্র এ সোমপানে মত্ত হয়ে সমস্ত শত্রু বিনাশ করেন এবং যজমানগণকে ধন দান করেন।’ ৯/১/১০)
‘দেবগণ পান করে মত্ত হবেন বলে অভিষুত এবং অভিষ্টবর্ষী সে সোমরসে সংগ্রামার্থে গব্য মিশ্রিত কর।’ (৯/৬/৬)

পাতা: ১৪৯


 ‘হে মদকর সোম! তুমি ইন্দ্রাভিলাষী হয়ে তাঁর পানার্থে ক্ষরিত হয়ে যজ্ঞশালায় শব্দ উৎপন্ন কর।’ (৯/৬/৯)
‘হে দ্যাবাপৃথিবী! তোমরা মদকর সোমরূপ অন্ন লাভার্থে আমাদের ধন, অন্ন ও বসু দান কর।’ (৯/৭/৯)
‘সোম ইন্দ্রের প্রিয় ও মদকর। হে পবমান সোম! তুমি শব্দ করে সমস্ত শত্রু বিনাশ কর।’ (৯/১৩/৮)
‘হে পবমান শত্রু হিংসক সর্বদর্শী সোমগণ! তোমরা যজ্ঞস্থানে উপবেশন কর।’ (৯/১৩/৯)
‘হে সোম! .... তুমি মাদক পদার্থের মধ্যে সকলের ধারক।’ (৯/১৮/২)
‘হে সর্বাপেক্ষা বৃত্রহা১! (৯/২৪/৬)। .... তিনি২ দেবগণের প্রীতিকর এবং শত্রুগণের বিনাশক।’ (৯/২৪/৭)
‘ব্রতরহিত দস্যুকে অভিভব করে আমরা সুন্দর সোমের রাক্ষসবন্ধন ও রাক্ষস হনন ইচ্ছায় স্তব করব।’ (৯/৪১/২)
‘যে সোম অশ্বের ন্যায় দেবগণের মত্ততার জন্য গব্যদ্বারা মিশ্রিত হন, যিনি কমনীয় সে সোমকে স্তুতি দ্বারা প্রসন্ন করি।’ (৯/৪৩/১)
‘হে সোমরস! তোমাকে পানপূর্বক বীর্যবান হয়ে শত্রুর সম্পত্তি জয় করা যায়, বিস্তর অন্ন আহরণ করা যায়, দুর্গম স্থানে তুমি পথ প্রকাশ করে দাও।’ (৯/৪৬/৫)
‘ইনি৩ মত্ততা আনেন, ইনি ইন্দ্রের আনন্দ বৃদ্ধি করেন।’ (৯/৪৬/৬)
উপরের উদাহরণ কয়টি বৈদিক সংস্কারে সোমের ভূমিকার তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদেরকে একটা স্বচ্ছ ধারণা দিতে পারে। এটা সহজবোধ্য যে, ঋগ্বেদে সোমের গুরুত্ব মূলত মিষ্টতার জন্য দেওয়া হয় নি। এটা আনুষঙ্গিক বিষয় মাত্র। আসলে সোমের গুরুত্ব যুদ্ধে সৈনিকদের মধ্যে মত্ততা এবং সাহস আনায় সাহায্য করার জন্য। সিন্ধু সভ্যতার মত একটা প্রধানত শান্তিনির্ভর ও অহিংস সমাজে এত সহজে বিরাট জনগোষ্ঠীকে যুদ্ধে নেওয়া গেছে এটা মনে করার কারণ নেই। এমনকি আমরা আরবের মত তুলনামূলকভাবে অনেক বেশী সংঘাতপূর্ণ এবং যুদ্ধনির্ভর সমাজেও দেখি মোহাম্মদ -এর ধর্ম সংস্কারে জিহাদ বা যুদ্ধ প্রবর্তন করতে কম বেগ পেতে হয় নি। আমরা ইতিপূর্বে যুদ্ধকে অনুমোদন দিয়ে র্কোআনের আয়াত দেখেছি। কিন্তু তার পরেও ব্যাপারটা এত সহজ হয় নি যার প্রমাণ আমরা র্কোআন থেকেও পাই :
৩৮। হে মুমিনগণ!৪ তোমাদিগের হইল কী যে, যখন তোমাদিগকে আল্লাহর পথে অভিযানে বাহির হইতে বলা হয় তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হইয়া ভূতলে ঝুঁকিয়া পড়? তোমরা কি পরকালের পরিবর্তে পার্থিব জীবনে পরিতুষ্ট হইয়াছ? পরকালের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগের উপকরণ তো অকিঞ্চিতকর!

_________________________________________________________________________________
সোমকে সবচেয়ে বড় বৃত্রঘাতক বলা হচ্ছে।
সোম।
সোম।
মুমিন অর্থ বিশ্বাসী। এখানে মুসলমানদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ১৫০


৩৯। যদি তোমরা অভিযানে বাহির না হও, তবে তিনি তোমাদিগকে মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদিগের স্থলাভিষিক্ত করিবেন এবং তোমরা তাঁহার কোনই ক্ষতি করিতে পারিবে না। আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।

........................... ............................ ............................

৪১। অভিযানে বাহির হইয়া পড়, হালকা অবস্থায় হউক অথবা ভারী অবস্থায়, এবং সংগ্রাম কর আল্লাহর পথে তোমাদিগের সম্পদ ও জীবন দ্বারা। উহাই তোমাদিগের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানিতে! (৯-সূরা তাওবা)
৫৯। কাফিরগণ যেন কখনও মনে না করে যে, তাহারা পরিত্রাণ পাইয়াছে, তাহারা মুমিনগণকে হতবল করিতে পারিবে না।
৬০। তোমরা তাহাদিগের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত রাখিবে এতদ্দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করিবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদিগের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদিগকে যাহাদিগকে তোমরা জানা না, আল্লাহ জানেন; আল্লাহর পথে তোমরা যাহা কিছু ব্যয় করিবে উহার পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হইবে এবং তোমাদিগের প্রতি জুলুম করা হইবে না।  

........................... ............................ ............................

৬৫। হে নবী! মুমিনদিগকে সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ কর; তোমাদিগের মধ্যে কুড়িজন ধৈর্যশীল থাকিলে তাহারা দুইশত জনের উপর বিজয়ী হইবে এবং তোমাদিগের মধ্যে একশত জন থাকিলে তাহারা এক সহস্র কাফিরের উপর বিজয়ী হইবে। কারণ তাহারা এমন এক সম্প্রদায় যাহার বোধশক্তি নাই। (৮-সূরা আনফাল)
এখন সিন্ধু সভ্যতার প্রেক্ষিতে আমরা অনুমান করতে পারি যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংকট ও বিপর্যয়ের ফলে অবর্ণনীয় কষ্টের কারণে অন্তত এক বৃহৎ অঞ্চলের ব্যাপক জনমনে ক্ষোভ জন্মালেও সুদীর্ঘ কালের নিয়ম এবং ধর্ম জনগণকে এমনভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল যে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াতে সাহস বা উৎসাহ পাচ্ছিল না। এখানে দীর্ঘকালের অভ্যাসেরও একটা শক্তি কাজ করেছে। সেটা শুধু প্রাচীন বাঁধ দেবতার প্রতি আনুগত্য ও ভীতি নয় উপরন্তু যুদ্ধ বা সহিংসতার সঙ্গে অপরিচয় বা কম পরিচয়ও। বাঁধ দেবতা তথা বৃত্রের ভয়েও যে সকলে তটস্থ ছিল সেকথা ঋগ্বেদ বলে :
‘৯। স্তোতৃগণ বৃত্রের ভয়ে স্তোত্র রচনা করেছে, সে স্তোত্র বৃহৎ আহ্লাদজনক, বলযুক্ত এবং স্বর্গের সোপান স্বরূপ; তখন স্বর্গ রক্ষক মরুৎগণ মানুষের জন্য যুদ্ধ করে এবং মানুষগণকে পালন করে ইন্দ্রকে প্রোৎসাহিত করেছিলেন। ১০। হে ইন্দ্র! তুমি অভিষুত সোমপান করে হৃষ্ট হলে যখন বজ্র দ্যু ও পৃথিবীর বাঁধনকারী বৃত্রের মস্তক বেগে ছিন্ন করেছিল, তখন বলবান আকাশও সে অহির শব্দের ভয়ে কম্পিত হয়েছিল।’ (১ মণ্ডল, ৫২ সূক্ত)

পাতা: ১৫১


উপরের মন্ত্র থেকে আমরা দেখছি যে, বৃত্রের ভয়ে মন্ত্র রচনা তথা ধর্মসংস্কার করতে হয়েছে। অর্থাৎ তা না হলে ঋগ্বেদের ভাষায় বৃত্রবধ তথা বাঁধ ধ্বংসের সাহস করা যেত না। দ্বিতীয়ত, ইন্দ্রের নামে যারা বাঁধ ভেঙ্গেছিল তারা তখন পর্যন্ত মরুৎগণ ছাড়া অন্যান্য দেবতার অনুসারী জনগোষ্ঠীর সমর্থন বা অংশগ্রহণ পায় নি। তৃতীয়ত, যারা ইন্দ্রের নামে বাঁধ ভেঙ্গেছিল তারাও মদ পান করে মত্ত না হয়ে সে কাজ করতে সাহসী হয় নি। আর বৃত্রের মস্তক ছিন্নে অহির শব্দে আকাশের ভয়ে কম্পিত হওয়ার অর্থ এই যে, জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ ভাঙ্গায় নদীর সঞ্চিত বিপুল জলস্রোতের প্রচণ্ড শব্দের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রবল বেগে ছুটে যাওয়া।
যাইহোক, সোমের প্রশ্নে এখন এটা বোধগম্য যে, ধর্মাচ্ছন্ন জনসাধারণকে ধর্মের অংশ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসে অনুপ্রাণিত করার জন্য এবং যুদ্ধে অনভ্যস্ত জনগোষ্ঠীকে প্রবলতর রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামাবার জন্য শুধু মন্ত্র রচনায় কাজ হয় নি। তাদেরকে সুরাপানেও উৎসাহিত করতে হয়েছে। সুতরাং সুরার তৎকালীন জনপ্রিয় অথবা সহজ উৎস হিসাবে সোম পূজার উপরেও জোর দিতে হয়েছে এবং সোমের উদ্দেশ্যে মন্ত্র রচনা করতে হয়েছে।
আসলে ধর্মের মাধ্যমে মানুষ শুধু অতিপ্রাকৃতিক শক্তির আশ্রয় এবং সমর্থন চায় না, এটা প্রাকৃতিক শক্তির উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষারও একটা প্রকাশ ঘটায়। কারণ সে ধরে নেয় যে, যে বস্তু বা কার্যের যে দেবতা থাকে সেই দেবতাকে তুষ্ট এবং মন্ত্রপুত করতে পারলে সেই বস্তু বা কার্যের উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে সে ঈপ্সিত ফল পাবে। এ কারণে সিন্ধু সভ্যতায় প্রযুক্তি বিদ্যার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনবোধ থেকে ত্বষ্টার পূজাকে গুরুত্ব দেওয়া হত। সিন্ধু সভ্যতার উচ্চ প্রযুক্তি নির্ভরতার ফলে ত্বষ্টার মর্যাদা এত বেশী ছিল। অর্থাৎ সমাজ ও সভ্যতায় বিজ্ঞান, কারিগরী বিদ্যা বা প্রকৌশল বিদ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশার জনগোষ্ঠীর উচ্চ মর্যাদারও প্রকাশ এটা। বৈদিক সংস্কারেও ত্বষ্টাকে বাদ দেওয়া যায় নি। বরং তার পুত্র স্বরূপ বাঁধ বা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করার পরেও বৈদিক শক্তি তার মর্যাদাকে কিছুটা হলেও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে।
ত্বষ্টার পুত্রকে হত্যা করার পরেও ত্বষ্টা দ্বারা নির্মিত বজ্র ছাড়া ইন্দ্র অচল। কারণ সমাজে যারা কারিগর, হস্তশিল্পী বা প্রকৌশলী তাদের সবার দেবতা ত্বষ্টা। অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণের প্রয়োজনে তাদের একাংশের সমর্থন চাই। সুতরাং বৈদিক পক্ষও ত্বষ্টাকে রাখছে তাদের দেবতা হিসাবে। তবে তাকে পূর্ব মর্যাদা থেকে অনেক নীচে নামিয়েছে। এটা বৈদিক ধর্মসংস্কারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অধোগতি ও নিম্ন মর্যাদারও প্রকাশ, যা আবার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নির্ভর সভ্যতার সংকটের একটা ফল।
যাইহোক, আমরা যদি আদিম যাদু বিশ্বাস থেকে ধর্মের উদ্ভবের বিষয়টা বুঝি তবে সোম পূজার তাৎপর্য সহজে বুঝব। আদিম সমাজে মানুষ পশু শিকারে যাবার আগে দলবদ্ধভাবে নেচে গেয়ে শিকারের মহড়া করত। তারা মনে করত এর ফলে শিকারের পশুরা তাদের ইচ্ছামত তাদের কাছে ধরা বা মারা পড়তে বাধ্য হবে। অর্থাৎ তারা যেন তাদেরকে আগেই মানসিকভাবে বন্দী বা আহত করে রেখেছে।

পাতা: ১৫২


একই ধারণা থেকে তারা গুহা গাত্রে শিকারের প্রাণীর ছবি আঁকত। মনে করত এর ফলে সেই প্রাণী বন্দী বা শিকার হবে। এও প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যবহারিক প্রচেষ্টার ভাবগত রূপ। এভাবে সে তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে বাস্তব প্রেরণা বা শক্তি লাভ করে। ধর্মে এই বিষয়টা একটা নূতন মাত্রা এবং রূপ নিয়েছে। কিন্তু দেবতা বা ঈশ্বর যা-ই বলা যাক তা মানুষেরই ইচ্ছা পূরণের মানসিক হাতিয়ার মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের ইচ্ছাপূরণ ঠাকুরের মত দেবতা বা ঈশ্বর মানুষের ইচ্ছাপূরণ ঠাকুর।
সুতরাং সোমের ব্যাপারও তাই। তবে সেটা সোমের খাদ্যগুণ বা মিষ্টতার জন্য নয়। তাহলে যব, গম, ধান, মধু থেকে শুরু করে আরও বহু কিছুর জন্য এভাবে মন্ত্র রচনা করতে হত। আসলে ওগুলোর উৎপাদন তথা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা মানুষের কাছে তখন প্রবল ছিল না। প্রয়োজন ছিল মাদকতার উপর এমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা যাতে সেটা পুরাতন ধর্ম ও সামাজিক ঐতিহ্যের অনুশাসন ভাঙ্গায় এবং যুদ্ধে সাহায্য করে। সুতরাং মদোন্মত্ততার যে প্রয়োজন ছিল যুদ্ধোন্মত্ততার জন্য তা সোমকে ঋগ্বেদে এতটা গুরুত্ব দিয়েছে এবং উচ্চাসনে বসিয়েছে বলে আমাদের ধারণা। সুতরাং এ বিষয়ও আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হয় যে, প্রাচীন এক যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্রকে গৌণ দশা থেকে তুলে এনে প্রধান দেবতা করা হয়েছে যুদ্ধের শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধকে প্রাধান্যে আনার তাগিদ থেকে। একই কারণে ঋগ্বেদে অগ্নির এত মর্যাদা। কারণ স্তুতিমন্ত্র এবং পূজা দ্বারা আগুনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে যুদ্ধে অগ্নি দ্বারা শত্রুর স্খাপনা ধ্বংস করার ক্ষমতার উপরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। এই কাজ শত্রু তাদের বিরুদ্ধে করতে পারবে না যদি অগ্নিকে নিজেদের পক্ষে রাখা যায়, অর্থাৎ অগ্নির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়।
সুতরাং আমরা ঋগ্বেদের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতায় এমন একটি গৃহযুদ্ধের সাক্ষ্য পাচ্ছি যে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু ও পতনোন্মুখ সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস বা অবসান ত্বরান্বিত হয়েছিল বলে আমরা মনে করতে পারি। এবং এই গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় যে নদীনিয়ন্ত্রণ সেটাও এখন স্পষ্ট। ঋগ্বেদ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার অন্তত শেষ পর্যায়ে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেয়, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে জলাভাব দেখা দেয় এবং মরুকরণ শুরু হয়। এই অবস্থায় বাঁধ ভাঙ্গার দাবীতে সভ্যতার বিশাল অঞ্চল জুড়ে যে গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হয় ঋগ্বেদ তাকে ভাষা দিয়েছে। সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত উল্লেখযোগ্য নদী যে বাঁধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল ঋগ্বেদ সে কথা স্পষ্টভাবে জানায় : ‘তুমি সে সর্বত্র বর্তমান ও সর্বভুক বৃত্রকে মহৎ বজ্র দ্বারা বহনশীল জলে নিক্ষেপ করেছিলে’ (১/১২১/১১)। অন্তত সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের সাতটি প্রধান নদীই যে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অধীন ছিল তা আমরা জানতে পারি ইন্দ্র কর্তৃক অবরুদ্ধ সপ্তসিন্ধু বা সাতটি প্রধান নদীকে মুক্ত করার বহু সংখ্যক বর্ণনা থেকে : ‘যিনি অহিকে বিনাশ করে সপ্তসংখ্যক নদী প্রবাহিত করেছিলেন’ (২/১২/৩), ‘যিনি সাতটি নদীকে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন’ (২/১২/১২), ‘হে সোম!....... ইন্দ্র ......... বৃত্রকে বধ করেছেন, সপ্তসিন্ধুকে প্রেরণ করেছেন এবং বদ্ধদ্বার উদ্ঘাটিত করেছেন’ (৪/২৮/১); ইত্যাদি।

পাতা: ১৫৩


বিভিন্ন নদীতে যে বহু সংখ্যক বাঁধ দিয়ে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল সেটা জানা যায় ঋগ্বেদের বহু জায়গায় ‘বৃত্রগণ’ বা ‘বহুসংখ্যক বৃত্র’- এর উল্লেখ থেকে (১/৮৪/১৩; ৩/৩০/৪; ৬/৭৩/২;৭/১৯/৪; ৭/২২/২; ৭/৮৩/৯; ৮/১৫/৩; ৮/৯০/৫;১০/৮৩/৭ ইত্যাদি)। একটি ঋকে বৃত্রবধ প্রসঙ্গে আলংকারিকভাবে যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে সেটা সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বাঁধের বিপুল সংখ্যা জানায় : ‘অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দ্র দধীচি ঋষির অস্খি দ্বারা বৃত্রগণকে নবগুণ নবতিবার বধ করেছিলেন’ (১/৮৪/১৩)।
সর্বোপরি জলাভাবের কারণে যে বৃত্র বধ বা বাঁধ ধ্বংস করা হয়েছিল সেকথাও ঋগ্বেদ স্পষ্টভাবে জানায় :
‘যখন জল দিব্যলোক হতে পৃথিবীর অন্ত প্রাপ্ত হল না এবং ধনপ্রদ ভূমিকে উপকারী দ্রব্য দ্বারা পূর্ণ করল না, তখন বর্ষণকারী ইন্দ্র হস্তে বজ্র ধারণ করলেন এবং দ্যুতিমান বজ্র দ্বারা অন্ধকার রূপ মেঘ হতে পতনশীল জল নি:শেষিতরূপে দোহন করলেন।’ (১/৩৩/১০)
‘হে ধনবান ইন্দ্র! তুমি জলবিশিষ্ট দেশসমূহকে লক্ষ্য করে, যে অহি শয়ন করেছিল, তাকে বজ্র দ্বারা ছিন্ন করেছ।’
(৪/১৭/৭)
‘ইন্দ্র শত্রুহিংসক সৈন্যের ন্যায় কূলসমূহের ধ্বংসকারিণী, যুবতী অন্নজনয়িত্রী নদীসকল পরিপূর্ণ করেছেন। তিনি নির্জল প্রদেশসমূহ পরিপূর্ণ করেছেন, পিপাসাতুর পথিকদের পরিপূর্ণ করেছেন। তিনি দস্যুদের অধিকৃতা প্রসবনিবৃত্তা গাভীসকলকে দোহন করেছেন।’ (৪/১৯/৭)
সুতরাং ঋগ্বেদ থেকে এ বিষয়টি আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, জলাভাব ছিল বৈদিক আন্দোলনের উথানের মূল কারণ। এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঋগ্বেদের সাক্ষ্যকে যাচাই করব। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে যেমন সিন্ধু সভ্যতায় কৃষির জন্য জলসেচের প্রয়োজনে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার দিকটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে তেমন তার সংকট বা ব্যর্থতার কারণও স্পষ্ট হবে।

পাতা: ১৫৪

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ