Banner
একাদশ অধ্যায় - রামায়ণ ও কৃষি-বিপ্লব

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 4:00 AM, Hits: 2176

 

অযোধ্যার রাজা দশরথের জ্যেষ্ঠপুত্র রাম। রাম বিয়ে করেন রাজা জনকের কন্যা সীতাকে। সীতা জনকের আপন কন্যা নন। একদা রাজা জনক যখন ক্ষেত্রে হল কর্ষণ বা লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করছিলেন, তখন লাঙ্গল দ্বারা কর্ষিত খাত থেকে শিশু কন্যা সীতা উঠে আসে। তিনি সীতাকে নিজ কন্যাসম লালন-পালন করেন। এদিকে রাজা দশরথ জ্যেষ্ঠপুত্র হিসাবে রামকে যৌবরাজ্যে অভিষেক করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু রামের বিমাতা কৈকেয়ী নিজ গর্ভজাত পুত্র ভরতকে সিংহাসনে বসাবার জন্য রাজা দশরথের পূর্ব অঙ্গীকার অনুযায়ী তাঁর নিকট রামের চৌদ্দ বৎসর বনবাস ও ভরতের রাজ্যাভিষেক এই দুই বর প্রার্থনা করেন। সত্য রক্ষার জন্য দশরথ তাতে সম্মত হন। এবং রামও পিতৃসত্য রক্ষার জন্য বনবাসে যান। তাঁকে অনুসরণ করেন তাঁর স্ত্রী সীতা এবং তাঁর একান্ত অনুগত অপর এক বৈমাত্রেয় অনুজ লক্ষ্মণ। রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ দণ্ডকারণ্যে আশ্রয় নেন। সেখানে লংকার রাক্ষস রাজা রাবণের বোন শূর্পণখা রামের প্রতি আসক্ত হয়ে তাঁর স্ত্রী সীতাকে আক্রমণ করলে লক্ষ্মণ তার নাসাকর্ণ ছেদন করেন। এর ফলে রাক্ষসরাজ রাবণ ক্রুদ্ধ হয়ে রামের স্ত্রী সীতাকে বলপূর্বক হরণ করে লংকায় নিয়ে যান। এই ঘটনায় রাম তাঁর স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের জন্য বানর সৈনিকদের সাহায্যে সাগর পার হয়ে লংকাদ্বীপ আক্রমণ করেন। তাঁর সহযোগী বানরদের সঙ্গে ভল্লুকরাও যোগ দেয়। এরপর তিনি প্রধানত বানর ও সেই সঙ্গে ভল্লুকদের সাহায্যে প্রবল যুদ্ধে রাবণকে বধ এবং রাক্ষসদেরকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। কিন্তু সীতা উদ্ধারের পর রাম তাঁর সতীত্বের পরীক্ষা নিতে চাইলে সীতা অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে তাতে উত্তীর্ণ হন। এরপর সীতাকে নিয়ে রাম-লক্ষ্মণ অযোধ্যায় ফিরে যান এবং চৌদ্দ বৎসর বনবাস শেষ হওয়ায় তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু লোকনিন্দার কারণে রাম সীতাকে দূর বনে নির্বাসন দেন। সেখানে লক্ষ্মণ সীতাকে ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে রেখে আসেন। সেখানে সীতার দুই জমজ পুত্র লব ও কুশ জন্মগ্রহণ করে। অনেক কাল পর তাঁর বালকপুত্রদের দেখার পর এবং তাদের কণ্ঠে বাল্মীকি রচিত রামায়ণ গাথা বা গীতিকাব্য শোনার পর তিনি সীতাকে সপুত্র ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। কিন্তু তার জন্য সর্বসমক্ষে রাজসভায় সীতাকে আত্মশুদ্ধি সম্পাদন করার শর্ত দিলেন। প্রকৃতপক্ষে তা ছিল দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা। রাজসভায় সীতা সবার সামনে ক্ষোভে-দু:খে ধরিত্রীর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করলে মাটি বিভক্ত হয়ে তাঁকে গ্রহণ করল। এইভাবে যে মাটি থেকে সীতার আগমন সেই মাটির গর্ভে তাঁর প্রত্যাগমন হল।
এই হল রামায়ণের সংক্ষিপ্তসার। উপরের এই কাহিনী থেকে মনে যে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক তা হল একজন নারীর অপহরণ নিয়ে যুদ্ধ হতে পারে, অনেক বিয়োগান্তক

পাতা: ২৪১


ঘটনাও ঘটতে পারে, কিন্তু তা কেন স্মরণাতীত কাল থেকে কোটি কোটি মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে? কেন রাম ও সীতাকে নিয়ে এত আবেগ ও বেদনাময়তার প্রবাহ কাল-কালান্তর ধরে বহমান রইবে? ভূমি, সম্পদ ও নারী নিয়ে মানবসমাজে যুদ্ধ কম হয় নি। হয়ত সেসবের কিছু নিয়ে গল্প-কাহিনী কিংবা ইতিহাস রচনা হয়। কিন্তু রামায়ণের মত মহাকাব্য রচনা হয় না। আর কেউ রাম বা সীতার মত অমর মহাকাব্যের নায়ক-নায়িকা হয় না। কারণ আর কেউ এমন কোন ঘটনার নায়ক বা নায়িকা নয় যে ঘটনা মানবসমাজের এক সুবিশাল উত্তরণ বা কালান্তর ঘটাবে। এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, রামায়ণ রচনার পিছনেও ছিল মহাভারতের মত আর একটি বিরাট সামাজিক সংঘাতের অভিঘাত যে অভিঘাত মানুষের জীবন-যাত্রায় কল্যাণমুখী যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের আবেগ, কল্পনা ও মননকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে এবং বেগবান করেছে।
সুতরাং যাকে নিয়ে রাম-রাবণের যুদ্ধ সেই সীতার দিকে আমরা দৃষ্টি দিব। প্রকৃতপক্ষে রাম নন বরং সীতা হলেন রামায়ণের কেন্দ্রবিন্দু। কারণ তাঁকে কেন্দ্র করেই যুদ্ধটা। সুতরাং সীতার তাৎপর্য বুঝতে আমরা তার উৎসের দিকে দৃষ্টি দিব। আর তখন এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে যে, প্রকৃত সীতা অর্থাৎ সীতা চরিত্রের মূল উৎস মানুষ নয়, বরং লাঙ্গল দ্বারা উৎপাদিত ফসল মাত্র। আর যে মুহূর্তে সীতার স্বরূপ আমাদের কাছে ধরা পড়বে সেই মুহূর্তে রামায়ণ সৃষ্টির প্রকৃত তাৎপর্যও আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করবে।
সংস্কৃতে সীতার অর্থ হচ্ছে ভূমিতে লাঙ্গল দ্বারা চিহ্নিত রেখা। অর্থাৎ লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের সময় জমিতে লাঙ্গলের ফালের আঘাতে গর্ত হয়ে যে লম্বা দাগ বা খাত সৃষ্টি হয় সেটাকে সীতা বলা হয়। এই কর্ষিত জমি বা সীতা থেকে ফসল উৎপন্ন হয় বলে ঋগ্বেদে সীতাকে ব্যক্তিরূপ দিয়ে তার উদ্দেশ্যেও প্রার্থনা করা হয়েছে : ‘হে সৌভাগ্যবতী সীতা! তুমি অভিমুখী হও, আমরা তোমাকে বন্দনা করছি, তুমি আমাদের সুন্দর ধন প্রদান কর ও সুফল প্রদান কর’ (৪/৫৭/৬)।
সুতরাং সীতার সূত্র ধরে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় নয় বরং আরও বহু পূর্বের এক কালে উপস্থিত হই যখন মানুষ কেবল প্রথম লাঙ্গল আবিষ্কার করেছে এবং লাঙ্গল-চাষ প্রবর্তন করেছে।
লাঙ্গল আবিষ্কার ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। আমরা অনুমান করি লাঙ্গল আবিষ্কারের পূর্বে মানবসমাজ মূলত পশু শিকার ও বনজঙ্গল হতে ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করত। হয়ত বাড়ীর আশপাশে পাথর বা শক্ত কাঠের খুরপি বা শাবল জাতীয় হাতিয়ার দিয়ে গর্ত করে বীজ বুনে উদ্যান বা বাগিচা চাষ এবং জঙ্গলের কিছু অংশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে একইভাবে বীজ বুনে কিছু চাষাবাদ করত। কিন্তু এর ফসল ছিল অত্যন্ত কম। কোন কোন উপজাতি বা গোত্র এমন ধরনের কিছু চাষাবাদ করলেও সম্ভবত ফসলের পরিমাণ কম এবং ফলন অনিশ্চিত হওয়ায় তারাও প্রধানত সংগ্রহ ও শিকার নির্ভর খাদ্যসংগ্রহ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রকৃতপক্ষে লাঙ্গল আবিষ্কারের পূর্বের মানবসমাজকে আমরা মূলত সংগ্রহ ও শিকার নির্ভর খাদ্যসংগ্রহ ব্যবস্থার অধীন বলতে পারি। তবে উদ্যান বা বাগিচা এবং এক ধরনের জুম চাষের মাধ্যমে ভবিষ্যতে উন্নত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রস্তুতি যে সুদীর্ঘ কাল ধরে চলছিল তা অনুমান

পাতা: ২৪২


করা যায়। কারণ লাঙ্গল আবিষ্কার একদিনে বা হঠাৎ করে সম্ভব ছিল না। তারও পূর্বে আরও আদিম ও পশ্চাৎপদ কৃষি বা ফসল উৎপাদন ছিল বলে অধিক ফসল উৎপাদনের তাগিদে মানুষ এক সময় লাঙ্গল আবিষ্কার ও প্রবর্তন করতে যেমন বাধ্য হয়েছিল তেমন পেরেওছিল। নতুবা শুধু বাধ্যতা থাকলেই নূতন আবিষ্কার হয় না।
তবে লাঙ্গল প্রবর্তন যে সহজ কাজ ছিল না রামায়ণ তার সাক্ষ্য দেয়। এটা বোধগম্য যে, লাঙ্গল আবিষ্কার আদিম সমাজের জন্য এক বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছিল। কারণ আদিম সমাজের প্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি-নির্ভর জীবনযাত্রা এর ফলে ভেঙ্গে পড়ে। বনজঙ্গলে ফলমূল সংগ্রহ ও শিকার এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অস্খায়ী বাগিচা চাষ-নির্ভর মূলত যাযাবর জীবনযাত্রা এবং এই ধরনের জীবনযাত্রার জন্য উপযোগী সমাজ-সংগঠনকে লাঙ্গল-চাষ ভেঙ্গে ফেলতে বাধ্য। কারণ লাঙ্গল-চাষের জন্য ভিন্ন ধরনের সমাজ-সংগঠন, রীতিনীতি এবং স্থিতিশীল জীবন-যাপন প্রণালী অপরিহার্য। লাঙ্গল-চাষ সমাজে প্রথম স্পষ্টরূপে পেশাগত বা বৃত্তিগত বিভাজন ঘটায়। বিশেষ করে বাড়তি উৎপাদন হয় বলে সমাজ যেমন খাদ্যশস্য সঞ্চয় করতে পারে তেমন এই সঞ্চয়ের সাহায্যে বিভিন্ন বৃত্তির বিকাশ ঘটাতেও পারে। এর ফলে সভ্যতার দিকে অগ্রযাত্রা সম্ভব হয়। তাছাড়া লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষি আর একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটায়। তা হচ্ছে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা। এই ব্যক্তিগত মালিকানার আবার দুইটি যুগান্তকারী ফল ঘটে। একটি হচ্ছে আদিম উপজাতি সমাজের আপেক্ষিক অখণ্ডতার অবসান এবং বিভিন্ন বৃত্তির বিভাজন এবং ক্ষমতা ও সম্পদের অসমতার ভিত্তিতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজন। অপরটি হচ্ছে পরিবার প্রথার উদ্ভব যার কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে পুরুষের হাতে চলে যায়। এমনিতে পশুটানা লাঙ্গল চালাতেও যে দৈহিক শক্তি লাগে তা নারীর নেই বলে ঐ কাজ মূলত পুরুষদেরকেই করতে হয়। আর এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, আদিতে লাঙ্গল পশু দিয়ে টানা হত না, মানুষই টানত দলবদ্ধভাবে। সুতরাং সেক্ষেত্রে নারীর পক্ষে শ্রম দেওয়া আরও সম্ভব ছিল না। এই অবস্থা খুব সহজেই সামাজিক ক্ষেত্রে পুরুষের অবস্থানকে নারীর তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী করে।
লাঙ্গল চাষের জমিতে অনেক বেশী পরিচর্যা দরকার। সুতরাং নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজনে একটা খণ্ড-জমি পরিবার কিংবা ক্ষুদ্র গোত্রের দায়িত্বে রাখা যুক্তিযুক্ত। ফলে ভূমিতে উপজাতির অভিন্ন বা সাধারণ মালিকানা থাকলেও পাশাপাশি লাঙ্গল-চাষকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি মালিকানার বিকাশ ছিল অনিবার্য। অন্যদিকে লাঙ্গল-চাষ যাযাবর বা ভ্রাম্যমাণ জীবনকেও অসম্ভব করে। কারণ লাঙ্গল চাষ যেমন জমির চরিত্র বদলে দিয়ে তাকে অনেক বেশী ফসল উৎপাদনের উপযোগী করে তেমন তার উৎপাদনশীলতা রক্ষার জন্য প্রতি বৎসর নিয়মিতভাবে জমিতে সার, জলসেচ এবং অন্যান্য পরিচর্যা অত্যাবশ্যক। ভাল ফসলের জন্য বীজ থেকে গাছ হবার পর মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে আগাছা দূর করতে হয়। স্বাভাবিকভাবে প্রাক-লাঙ্গল সমাজ কাঠামো এই ধরনের কৃষি পদ্ধতির উপযোগী ছিল না।
আগে ছিল উপজাতিগুলির মধ্যে এলাকার বিভাজন। সেখানে তারা নিজ নিজ এলাকায় শিকার বা খাদ্য সংগ্রহ করত। এলাকার দখল নিয়ে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে যুদ্ধ

পাতা: ২৪৩


হতে পারত। কিন্তু লাঙ্গল একটি ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। ফসল উৎপাদনের জমিগুলিকে ভাগ করা হল কিছু সংখ্যক মানুষ বা পরিবারের মধ্যে। পুরাতন উপজাতীয় সংহতি ভেঙ্গে ফেলার জন্য লাঙ্গল-চাষ যথেষ্ট ছিল। সুতরাং এর বিরুদ্ধে উপজাতির ভিতর থেকেই বাধা সৃষ্টি হল।
রামের বনবাস আমাদের নিকট তাকে উপজাতি-সমাজ থেকে বহিষ্কার বা বিতাড়নের দ্যোতক। সীতার পালক পিতা রাজা জনক। অনুমান করা যায় যে, লাঙ্গল আবিষ্কার আরও পূর্বে হয়েছিল। সেকালে বংশগত রাজা ছিল না। সুতরাং রাজা অর্থ এখানে উপজাতি বা গোত্র প্রধান। অবশ্য প্রাচীন কালে ভারতবর্ষে রাজা শব্দ সম্ভবত সমাজের নেতৃস্থানীয় যে কোন ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহার করা হত। যাইহোক, জনক নামে আদৌ কেউ লাঙ্গল প্রবর্তন করার চেষ্টা করছিল কিনা সেটা আজ আর বলা সম্ভব নয়। কিন্তু অন্তত এক্ষেত্রে নামে কিছু যায় আসে না। এটা ক খ গ একটা কিছু হলেই হল। আমাদের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে যে, কিছু গোত্র বা কিছু উপজাতি অথবা কিছু ব্যক্তি লাঙ্গল জাতীয় হাতিয়ার নির্মাণ করে তা দিয়ে জমি চাষ করার চেষ্টা করছিল। হতে পারে তাদের মধ্যে একজন কোন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বা গোত্রপ্রধান ছিলেন যার স্মৃতি ধারণ করছে জনক নামটি।
আমরা অনুমান করি লাঙ্গল প্রবর্তনের চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছিল সমাজের ভিতর এবং বাইরের বাধার মুখে। এমন একটা সময়ে কোন এক শক্তিশালী উপজাতির এক তেজস্বী ও বলবান ব্যক্তি এগিয়ে আসেন লাঙ্গল চাষ প্রবর্তনের জন্য। তাঁর নাম রাম বা আর কিছু। একটু আগে যে কথা বলেছি নামে কিছু যায় আসে না। ব্যক্তির ভূমিকাটাই বড় কথা। সুতরাং আমরা কবিদের দেওয়া নাম যেটা তাঁর আসল নাম অথবা পরবর্তীতে দেওয়া নামও হতে পারে সেই রাম নামেই এই বিপ্লবী চরিত্রকে সম্বোধন করছি।
প্রচলিত সামাজিক কাঠামোর ভিতর লাঙ্গল চাষ করা সম্ভব ছিল না বলে সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে হোক অথবা স্বেচ্ছায় হোক দূরে কোথায়ও গিয়ে রামকে লাঙ্গল-চাষ প্রবর্তন করতে হয়েছে। সঙ্গে ছিল কিছু অনুসারী তাঁরই উপজাতির।
আদিম উপজাতি সমাজের প্রতীক হলেন রাবণ। রামায়ণে রাবণকে রাক্ষস এবং নরমাংসভোজী বলা হয়েছে। তাঁর প্রজারাও তা-ই।
রামায়ণে রাবণের বোন হিসাবে শূর্পণখা চরিত্রের উপস্থিতি তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত রামায়ণের কাহিনী অনুযায়ী রাম-রাবণের সংঘাতের মূল কারণ হচ্ছেন শূর্পণখা। রাবণ সীতাকে হরণ করেন তাঁর বোন শূর্পণখার প্রতি লক্ষ্মণের নৃশংস আচরণের প্রতিশোধ নিতে। এ বিষয়ে আমরা এ অধ্যায়ের শুরুতে বলেছি। তাহলে দেখা যাচ্ছে রাম-রাবণের সংঘাতের মূলে আছে শূর্পণখা-সীতা সংঘাত।
বাল্মীকি রামায়ণে শূর্পণখা চরিত্রটি একজন স্বাধীন, সক্রিয়, প্রবল এবং প্রেমের প্রশ্নে সাহসী ও আক্রমণাত্মক নারীকে তুলে ধরে। আদিম মাতৃতন্ত্রের স্মৃতি শূর্পণখা চরিত্রে ছায়াপাত করেছে বলে মনে হয়। এভাবে শূর্পণখা-সীতার সংঘাত সম্ভবত সুদূর অতীতের বাগিচা বা খুরপি-চাষ নির্ভর মাতৃতন্ত্র এবং লাঙ্গল-চাষ নির্ভর পিতৃতন্ত্রের মধ্যকার সংঘাতের বিস্মৃত স্মৃতিকে ভিন্ন রূপে উপস্থিত করেছে।

পাতা: ২৪৪


প্রাক-লাঙ্গল আদিম ও পশ্চাৎপদ বাগিচা চাষ মাতৃতন্ত্রের মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিল বলে অনুমান করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। প্রাক-লাঙ্গল এই কৃষির আবিষ্কার প্রকৃতপক্ষে নারীর হাতে। বাড়ীর আশপাশে নারীরা খুরপি বা শাবল জাতীয় হাতিয়ার দিয়ে গর্ত করে তাতে বীজ বপন করে সহজে শস্য ফলাতে পারত। দেহশ্রম কম লাগত বলে এবং বাসস্থানের আশপাশে চাষ করা যেত বলে এতে পুরুষের তুলনায় নারীর ভূমিকা বেশী রাখা সহজ ছিল। তবে এ ধরনের কৃষিতে ফসল প্রাপ্তি ছিল কম এবং অনেকখানি অনিশ্চিত। ফলে পাশাপাশি অরণ্যে ফলমূল সংগ্রহ ও শিকারমূলক খাদ্যসংগ্রহ ব্যবস্থাও বিদ্যমান ছিল। তাছাড়া এই ধরনের কৃষিতে জমির উর্বরতা রক্ষা কিংবা বৃদ্ধির উপায় ছিল না বলে বর্তমান কালের জুম চাষের মত সেকালের চাষের জমিগুলিকেও প্রতি বৎসর অথবা ঘন ঘন বদলাতে হত। ফলে বাগিচা বা খুরপি চাষ স্থিতিশীল জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপযোগী ছিল না।
যাইহোক, এটা অনুমেয় যে, যেকালে লাঙ্গল-চাষ শুরু হয়েছিল সেকালে কোন কোন উপজাতি শুধু শিকার ও খাদ্যসংগ্রহ নির্ভর হলেও কোন কোন উপজাতির ভিতর শিকার ও খাদ্যসংগ্রহের পাশাপাশি বাগিচা বা খুরপি চাষ বিদ্যমান ছিল। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, উভয় ধরনের সমাজ ব্যবস্থার জন্য লাঙ্গল হুমকি সৃষ্টি করেছিল। বিশেষত মাতৃতন্ত্র এবং বাগিচা বা খুরপি চাষের জন্য লাঙ্গল ছিল আশু এবং প্রবলতর হুমকি। এই সম্ভাবনা বাস্তব সম্মত যে, লাঙ্গল-চাষকে প্রতিহত করার জন্য মাতৃতান্ত্রিক সমাজগুলিও আদিম শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী সমাজগুলির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়।
সুতরাং সীতাকে কেন্দ্র করে রাম-রাবণের যুদ্ধ মূলত দুইটি সমাজব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থার যুদ্ধ। রাম মানুষকে লাঙ্গল-নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন। হয়ত এই সঙ্গে তিনি নরমাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে একটা বড় ধরনের সাফল্য এনে দিয়েছিলেন।
সুতরাং সীতা হরণের পিছনের ঘটনা হচ্ছে ফসল হরণ। আমরা অনুমান করি রাম তাঁর অনুচর বা সঙ্গীদের নিয়ে যখন লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করে শস্য ফলিয়েছিলেন তখন রাবণ তাঁর উপজাতির লোকদের নিয়ে জোরপূর্বক সেই শস্য নিয়ে যান। সেই সঙ্গে রাম এবং তাঁর সঙ্গীদের নারীদেরকেও জোর করে নিয়ে গিয়ে থাকতে পারেন। যদি তেমন কিছু ঘটে থাকে তবে ফসলের সঙ্গে নারী বা স্ত্রী সংযুক্ত হয়ে পরবর্তীকালে সীতা উপাখ্যান সৃষ্টি সহজতর হয়েছে। অনুমান করা যায় এই ঘটনার পর রাম বানর টোটেমভুক্ত উপজাতির সমর্থন পান। এবং ভল্লুক টোটেম-উপজাতির সমর্থনও তিনি পান। এদের সবার সমর্থন নিয়ে তিনি রাবণকে পাল্টা আক্রমণ করে পরাজিত ও হত্যা করেন।
এটা দৃশ্যত হয়ত ছিল কয়টি ক্ষুদ্র উপজাতি ও গোত্র সদস্যদের মধ্যকার একটা সাধারণ যুদ্ধ। হয়ত লাঙ্গল-ভিত্তিক কৃষির প্রশ্নে দুইটি উপজাতি জোটের মধ্যে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু এই যুদ্ধ মানব সমাজে অনুষ্ঠিত নিত্য দিনের যুদ্ধ নয়। আকার আয়তনে ছোট বা বড় যা-ই হোক চরিত্রে এবং ফলাফল বিচারে এটা ছিল এক যুগান্তকারী যুদ্ধ। রাবণ বধ এবং পরাজয়ের সঙ্গে আদিম খাদ্যসংগ্রহ ব্যবস্থার সঙ্গে মানুষের বড় রকম এবং চিরকালীন ছেদ ঘটে গেল এবং সভ্যতার পথে মানুষের এগিয়ে যাবার পথ অবারিত হল।

পাতা: ২৪৫


এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী ফলাফল মানবসমাজের জন্য যে প্রচণ্ড হল শুধু তাই নয়, অধিকন্তু এর তাৎক্ষণিক ফলাফলও সংশ্লিষ্ট মানুষদের মনে প্রচণ্ড হল। তারা কখনই এই ঘটনার গুরুত্ব ভোলে নি, ভোলে নি এই ঘটনার নায়ককে। তারা এ নিয়ে গল্প-গাথা রচনা করেছে, গান গেয়েছে, বংশ পরম্পরায়। স্থান ও কালের প্রেক্ষিতে সেইসব গল্প ও গাথা বদলে গেছে একটু করে। মূল ঘটনায় যদি ফসলের সঙ্গে নারী থেকে থাকে তবে তা ফসলের সঙ্গে মিলে গিয়ে ফসলকে সহজে ব্যক্তিরূপ দিয়েছে। আর যদি মানবী না থেকে থাকে তবে মানুষের মনশ্চক্ষে ফসল মানবী-সীতার রূপে জন্ম নিয়ে নূতন তাৎপর্য ও শক্তি পেয়েছে।
তবু যুগে যুগে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসা রামায়ণের সীতার উদ্ভবের সূত্র হারিয়ে যায় নি। বরং তা স্পষ্টভাবে বিধৃত রয়ে গেছে। রামায়ণে বলা হচ্ছে, বৃহস্পতির পুত্র রাজর্ষি কুশধ্বজের কন্যা বেদবতী মুনিব্রত অবলম্বন করে যখন অরণ্যে তপস্যা করছিলেন তখন রাবণ তাঁকে বলাৎকার করলে তিনি ক্ষোভে রাবণকে অভিশাপ দেন এবং আত্মহত্যা করেন এবং তিনি সীতারূপে ক্ষেত্র থেকে জন্ম নেন। বাল্মীকি রামায়ণে ঋষি অগস্ত্য সীতার প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে রামকে বলতে গিয়ে বেদবতী উপাখ্যান বলেন। তাতে তিনি রামকে বলেন :
‘তখন কামার্ত রাবণ বলপূর্বক তাঁহার কেশমুষ্টি গ্রহণ করিল। বেদবতী ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কেশ আচ্ছিন্ন করিয়া লইলেন এবং দেহবিসর্জনের জন্য চিতা জ্বালিয়া ক্রোধানলে উহাকে দগ্ধ করিয়াই কহিতে লাগিলেন, নীচ! তুই আমার অবমাননা করিলি, আর আমি এ প্রাণ রাখিতে চাই না। এক্ষণে তোরই সমক্ষে অগ্নিপ্রবেশ করিব। রে পাপিষ্ঠ! তুই যখন এই অরণ্যমধ্যে আমায় কেশগ্রহণপূর্বক অবমাননা করিলি তখন তোর বিনাশের জন্য আমি পুনর্বার জন্মিব। পাপাশয় পুরুষকে বধ করা স্ত্রীলোকের সাধ্যায়ত্ত নহে। আর যদিও তোরে অভিসম্পাত দিয়া নষ্ট করি তাহাতে আমার তপ:ক্ষয় হইবার সম্ভাবনা। যাহাই হউক, এক্ষণে যদি কিছু পুণ্যসঞ্চয় করিয়া থাকি, যদি কিছু তপ জপ করিয়া থাকি, তবে তাহার ফলে আমি তোর বিনাশের জন্য কোন ধার্মিকের অযোনিজা কন্যারূপে জন্মিব।
‘এই বলিয়া বেদবতী জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করিলেন। অন্তরীক্ষ হইতে চতুর্দিকে দিব্য পুষ্পবৃষ্টি হইতে লাগিল। রাম! সেই বেদবতীই রাজর্ষি জনকের কন্যা ও তোমার ভার্যা। তুমি সাক্ষাৎ সনাতন বিষ্ণু। পূর্বে বেদবতী ক্রোধানলে যাহাকে বিনষ্টপ্রায় করিয়াছিলেন সেই শত্রুকে তিনিই আবার তোমার অলৌকিক বাহুবলের আশ্রয় লইয়া বিনাশ করিয়াছেন। এই অগ্নিশিখাসদৃশী বেদবতী মর্ত্যলোকে হলকর্ষিত ক্ষেত্রে পুন: পুন: উৎপন্ন হইবেন।’

_________________________________________________________________________________
উদ্ধৃতির উৎস : বাল্মীকি রামায়ণ। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য কর্তৃক গদ্যানুবাদ কৃত। তুলি-কলম, ১-এ কলেজ রো, কলকাতা--৯, নূতন সংস্করণ, জানুয়ারী ১৯৯৫। পৃ: ৮৮১-৮৮২।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২৪৬


সুতরাং সীতার জন্ম ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফসলের একটি চক্র বেরিয়ে আসছে। লাঙ্গল দ্বারা ভূমি কর্ষণ ও বীজ বপন এবং ফসল সংগ্রহ ; এবং পুনরায় কর্ষণ ও বীজ বপন। এইভাবে যে শস্যবীজ ভূমি থেকে আসছে তা পুনরায় ফিরে যাচ্ছে সীতার মত পৃথিবীর গর্ভে।
আর একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা দরকার। তাহল যে কালে সীতার আখ্যান তৈরী হচ্ছে সেকালে সীতা মানুষ না হলেও তাকে মানুষরূপে কল্পনা করতে মানুষের সমস্যা ছিল না। কারণ পশু-পাখীর মানুষের মত আত্মা এবং মন আছে মনে করা হত। প্রাচীন অনেক গল্পে বৃক্ষও মানুষের কথা বুঝতে পেরে সাড়া দিতে পারে। আমরা অনেকে সেই গল্পের কথা জানি যেখানে বৃক্ষ দুইভাগ হয়ে বিপন্ন মানুষকে ভিতরে আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রাখে। এক সময় ছিল যখন মানুষ নিষ্প্রাণ বস্তুর সঙ্গেও নিজেদের পার্থক্যকে ঠিকমত বুঝতে পারত না। সমস্ত কিছু ছিল তাদের কাছে তাদের মত প্রাণময়, মনময় ও বাঙময়। সুতরাং ফসলকে নিয়ে এমন একটি যুগান্তকারী সংঘাতের পর তাকে মানবীর রূপ দিয়ে আখ্যান রচনা অস্বাভাবিক বা কঠিন কিছু ছিল না। পরবর্তীকালে সীতার মানবী রূপ সামনে এলেও তার ফসলরূপ একেবারে বিলুপ্ত হল না। মানবী রূপের আড়ালে বা ভিতরে লুকিয়ে রইল মাত্র।
এখন আমরা রামায়ণের উৎস-ঘটনার কাল নির্ণয়ের চেষ্টা করতে পারি। পৃথিবীর কোন মৌল আবিষ্কার প্রবল সামাজিক বা বাস্তব চাপ ছাড়া ঘটে না। খুব বড় সামাজিক পরিবর্তনগুলিও তাই। বিশেষ করে লাঙ্গল আবিষ্কারের মত ঘটনার তাৎপর্য এমনই বিশাল যে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তা ঘটতে পারে না। একদিকে ফসল ফলাবার সামান্য কিছু বা প্রাথমিক ধারণা থাকতে হবে। অন্যদিকে থাকতে হবে প্রচণ্ড পারিপার্শ্বিক চাপ যার ফলে লাঙ্গল দিয়ে চাষ একমাত্র বিকল্প হবে অন্তত কিছু সংখ্যক মানুষের নিকট। অন্যদিকে এই চাষের একটা ভূ-প্রাকৃতিক সম্ভাব্যতাও থাকতে হবে। মরুভূমি কিংবা বরফের মধ্যে মানুষ চাষ করার কথা ভাববে না।
চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা মেহরগড় সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা জেনেছি যে, সেখানে ৭০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ কাল অথবা তার পূর্ব থেকে স্থিতিশীল জীবনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। লাঙ্গলের নিদর্শন পাওয়া না গেলেও এটা অনুমান করা চলে যে, এটা লাঙ্গল-চাষের ফলে সম্ভব হয়েছিল। অন্যদিকে সেখানে প্রাপ্ত শস্যদানা থেকে বোঝা যায় যে, কৃষির বিকাশ আরও অনেক পূর্বে হয়েছিল। যার ফলে মানুষ নূতন ও উন্নত জাতের শস্য সৃষ্টি করতে পারছিল। লাঙ্গল প্রবর্তন থেকে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে মানুষের বহু শত এমনকি কয়েক সহস্র বৎসর লাগতে পারে। কিন্তু মেহরগড় সহ উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চল মেহরগড় পর্যায় শুরুর অল্প কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত বরফ ও শীতের প্রভাবে থাকায় সেখানে এই অবস্থায় কৃষির উন্মেষ ও প্রাথমিক বিকাশ ঘটবার কথা নয়।   
ভূতাত্ত্বিকদের মতে, আজ থেকে আনুমানিক ২৫ হাজার বছর আগে শেষবারের মত পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল বরফাচ্ছাদিত হয় (last great glacial expansion)। আনুমানিক

পাতা: ২৪৭


১৮ হাজার বৎসর আগে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবার পর হিম-সংকোচন শুরু হয়। আজ থেকে ১০-১২ হাজার বৎসর পূর্বে পৃথিবীর বুকে শেষ হিম বা তুষার যুগের সমাপ্তি ঘটে। ঐ সময় পর্যন্ত পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বরফে ঢাকা পড়ে ছিল। সমগ্র ইউরোপ-এশিয়ার উত্তরাংশের এক বৃহদাংশ ছিল পুরু বরফের নীচে। ফলে এই অঞ্চল মনুষ্য বাসের প্রায় অনুপযুক্ত ছিল। বাকী অঞ্চলগুলিতেও শীত ও বরফের প্রচণ্ড প্রকোপে জীবজগৎ বিপন্ন ছিল।
এটা সহজে অনুমান করা যায় যে, এই হিম যুগে এশিয়া-ইউরোপের উত্তরাঞ্চল থেকে অধিকাংশ মানুষ ক্রমশ দক্ষিণ দিকে বিষুব বা নিরক্ষ রেখার নিকট সরে আসে। ফলে আফ্রিকার মধ্যভাগে একটা কেন্দ্রীভবন ঘটতে পারে। অপর একটি কেন্দ্রীভবন ঘটেছিল ভারতবর্ষে, বিশেষত তার দক্ষিণের উপদ্বীপে বা দাক্ষিণাত্যে।
হিম যুগ শেষ হয় ১০ থেকে ১২ হাজার বৎসর পূর্বে। বারো হাজার বৎসর পূর্বে শেষ হলেও স্বাভাবিকভাবে হিম যুগের প্রভাব কাটতে আরও কিছু সময় লেগেছে।
আমরা অনুমান করি হিম যুগের ভিতর ভারতবর্ষের মধ্যভাগে ও দাক্ষিণাত্যে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিভিন্ন উপজাতি ও জনগোষ্ঠীর সমাবেশে এখানে কিছু যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটে মানুষের সমাজ ও মনে। চারপাশের চরম প্রাকৃতিক বৈরিতা ও

_________________________________________________________________________________
পৃথিবীর আদিকাল থেকে কয়েকটি হিম কালপর্যায় এসেছিল যেগুলির কালদৈর্ঘ্য বিভিন্ন রকম। শেষ হিম কালপর্যায় শুরু হয় ২০ থেকে ২৫ লক্ষ বৎসর পূর্বে। এই সময় দুই মেরুর নিকট অঞ্চল, বিশেষ করে উত্তর মেরুর নিকটবর্তী এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার এক বৃহৎ অঞ্চল পুরু বরফের নীচে ঢাকা পড়ে। অবশ্য এই হিম কালপর্যায়ের ভিতর আবার তুলনায় ক্ষুদ্র সময়ের জন্য বরফ ও শীত হ্রাসের কিছু সংখ্যক পর্ব আছে। অর্থাৎ বিরতিসহ কয়েকটি হিম যুগ নিয়ে একটি সামগ্রিক বা বৃহত্তর হিম কালপর্যায় গঠিত। প্রায় ১২ হাজার বছর আগে সর্বশেষ হিম যুগের সমাপ্তি ঘটে বলে অনেক ভূতাত্ত্বিক মনে করেন। কারো মতে ১০ থেকে ১২ হাজার বছর আগে এর সমাপ্তি ঘটে। কারো মতে এই সময় সাড়ে ১১ হাজার বছর আগে। আবার কারো মতে ১০ হাজার বছর আগে। প্রকৃতপক্ষে সর্বত্র এক সময়ে হিম যুগ শেষ হয় নি। সুতরাং ১০ থেকে ১২ হাজার বছর আগে হিম যুগ শেষ হয় ধরে নেওয়া আমাদের জন্য নিরাপদ। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, যেটিকে আমরা ২৫ হাজার বছর আগে শুরু হওয়া শেষ হিম যুগ বলছি সেটি অনেকগুলি বিরতিসহ একটি বৃহত্তর হিম কালপর্যায়ের খণ্ডাংশ মাত্র।  
ভারতবর্ষের সমাজ ও মানুষের কিছু বৈশিষ্ট্যের বিকাশে হিম যুগের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভগবান সিং তাঁর The Vedic Harappans গ্রন্থের মুখবন্ধে যা বলেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন, , ‘Typical Indian value system — emphasis on personal ethics, self-restraint, non-violance, benevolence and charity, non-exhibitionistic material prosperity and harmonious living with Nature — arise from deeper sources than hitherto realised. Much of it appears to have come down from the “jungle days” when, roaming and hunting in this great zoological theatre, man had developed intimate association with animals, plants, water bodies, mountains and seasonal changes of the cosmic screen. The pressure of glaciation days on the tropical belt appears to have taught the various tribes to be parsimonious and charitable at the same time — consume as little as possible, waste nothing and preserve the savings with care for odd days and needy ones. This is the fountain of all that is typically Indian in thought, sentiment, value and behaviour.’ Bhagwan Singh, The Vedic Harappans, (Aditya Prokashan, New Delhi, 1995), p- XXIV.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২৪৮


বিপর্যয়ের মধ্যে পাশাপাশি হাজার হাজার বৎসর বাস করার মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তত একটা বড় অংশ নরমাংস ভক্ষণ এবং সহিংসতা ও যুদ্ধ পরিত্যাগ করার শিক্ষা পায়। কারণ ঐ অবস্থায় যারা বেঁচে ছিল তাদের মধ্যে কিছু প্রশ্নে ঐক্যমত না জন্মালে তাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হত। তবে সেটাও যে এমনিতে হয়েছে তা নয়। এর জন্য বিভিন্ন উপজাতিকে একমত হয়ে ঐক্যমতের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে হয়েছে। ক্রমশ নরমাংস ভক্ষণ কিছু সংখ্যক উপজাতির ভিতর থেকে উঠে গেছে এবং কিছু সংখ্যক উপজাতি যুদ্ধের পরিবর্তে পারস্পরিক সহনশীলতা, অনাক্রমণ এবং সহযোগিতার পথ গ্রহণ করে কিছু অভিন্ন রীতি-নীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে ভবিষ্যতের বৃহত্তর সমাজ নির্মাণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।
আমাদের ধারণা লাঙ্গল আবিষ্কার হয়েছে হিম যুগের ভিতর এবং সম্ভবত সেটা হয়েছে ভারতবর্ষের মধ্য থেকে দক্ষিণের কোথায়ও। তবে দাক্ষিণাত্যে তার সম্ভাবনা বেশী দেখি। যাইহোক, হিম যুগে লাঙ্গল আবিষ্কারের সম্ভাবনা আমরা সব দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত মনে করি। কারণ হিম যুগ শেষ হলে লাঙ্গল আবিষ্কারের তাড়না বা তাগিদ থাকত না। শীত এবং বরফ উত্তর দিকে পিছানোর সঙ্গে যখন উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের নূতন করে ব্যাপক প্রসার ঘটত তখন আদিম খাদ্য সংগ্রহকারী ও শিকারী মানুষ নূতন উদ্যমে তার আদিম জীবনেরও প্রসার ঘটাত।
আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, বরফ বা হিম যুগ শেষ হবার সঙ্গে পৃথিবীর জীবজগতে এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটেছিল। বহু কালের অবদমন থেকে মুক্ত হয়ে প্রাণের অজস্র ধারায় স্ফুরণ ও বিচ্ছুরণে সেটা ছিল উত্তাল কাল। মানুষও তার এত কালের অবদমন ও সংকুচিত জীবন শেষে বিপুল তেজ ও আবেগ নিয়ে নূতন সৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছিল। শুধু হিম যুগকে পিছনে ফেলে নয় সেই সঙ্গে তার আদিম জীবনকেও অনেক পিছনে ফেলে মানুষ বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া এবং মিসরের মত তিনটি প্রাচীন মহাসভ্যতা নির্মাণ করল। বস্তুত সভ্যতা নির্মাণের জন্য যে সমাজ-সংস্থা বা সমাজব্যবস্থা প্রয়োজন হয় এবং একই সঙ্গে এই রকম সমাজ-সংস্থার জন্য যে ধরনের উৎপাদনগত ভিত্তিরও প্রয়োজন হয় তা যদি হিম যুগের মধ্যেই তৈরী না হত তবে ঐ যুগ শেষ হবার চার-পাঁচ হাজার বৎসর পরই এত বড় তিনটি সভ্যতার ইমারত নির্মাণ শুরু করার প্রশ্নই উঠত না। বরং মানুষ তার চিরচেনা আদিম জীবনের খাত ধরে ভেসে যেত প্রবল প্রাণবন্যায়।

সুতরাং আমরা যুক্তিযুক্তভাবে অনুমান করতে পারি যে, হিম যুগের ভিতরে মানুষ লাঙ্গল আবিষ্কার এবং লাঙ্গল চাষ প্রবর্তন করেছিল। সম্ভবত দাক্ষিণাত্যের কোথায়ও এই বিস্ময়কর এবং যুগান্তকারী ঘটনা ঘটতে শুরু করে। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে খাদ্যের প্রয়োজনে ক্রমে আরও অনেক মানুষ খাদ্য উৎপাদনের এই নূতন প্রযুক্তিবিদ্যাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তার আগে এই প্রযুক্তিবিদ্যার বিরোধী শক্তি পরাজিত হয়েছে এবং যারা এই বিদ্যা আয়ত্ত করেছে তাদের শক্তির শ্রেষ্ঠত্বও প্রমাণিত হয়েছে।
যখন ভূপৃষ্ঠ স্থায়ীভাবে উত্তপ্ত হতে শুরু করায় দূর উত্তরের বরফ গলতে শুরু করে

পাতা: ২৪৯


এবং শীত উত্তরে সরতে থাকে তখন ভারতবর্ষের দক্ষিণ দিক থেকে দলে দলে মানুষ উত্তর দিকে যাত্রা করে। এবং সেখান থেকে যার যার সুবিধামত বিভিন্ন দিকে। তবে উত্তর-পশ্চিমে অপেক্ষাকৃত উর্বর কৃষিক্ষেত্র এবং অনুকূল ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থা থাকায় অভিগমন ঘটেছে প্রধানত সেই দিকে। এটা ছিল বহুকাল ছোট জায়গায় চাপাচাপি করে থাকা অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়া বহু সংখ্যক মানুষের এক মহাযাত্রার মত ঘটনা। একবারে নয়, ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে যাত্রা চলেছে। এদের একটা অংশ প্রথমে সরস্বতী নদীতীরে বসতি করেছে। কিছু অংশ আরও উত্তরে বিভিন্ন উপনদী এবং পশ্চিমে সিন্ধু নদীতীরে বসতি করেছে। বাকী অনেকে বিভিন্ন পথ ধরে উপমহাদেশ পার হয়ে আরও পশ্চিম দিকে চলে গেছে। এদের এক অংশ মেসোপটেমিয়ায় বসতি করেছে। কেউ আরও পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে মিসরের নীল নদীতীরে বসতি করেছে। হয়ত সেখানে একইভাবে আফ্রিকার বিষুবীয় মধ্যভাগ থেকেও বিভিন্ন উপজাতি বা গোত্র এসে বসতি করেছে।
আমরা অনুমান করি ভারতবর্ষ থেকে যারা লাঙ্গল-ভিত্তিক উন্নত কৃষির ধারণা নিয়ে গিয়েছিল তারাই মূলত মেসোপটেমিয়া ও মিসরে কৃষিভিত্তিক উন্নত সমাজ এবং নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। বিশেষত মেসোপটেমিয়ার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এটা স্বাভাবিক যে, এক্ষেত্রে তাদের ভিতর পূর্ব যোগাযোগের স্মৃতি কাজ করেছিল। এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, হাঁটুর উপর হাত রেখে বিশেষ ভঙ্গিতে বসে থাকা বানর মূর্তি বা নিদর্শন সিন্ধু সভ্যতার মত মেসোপটেমিয়াতেও পাওয়া গেছে। মিসরে তার পরিবর্তে একই ভঙ্গিমার বনমানুষ নিদর্শন পাওয়া গেছে। মিসরের প্রথম রাজার নাম মেনেস (আনুমানিক ৩,২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ)। এর সঙ্গে সংস্কৃত মনুষ্য কিংবা ভারতীয় পৌরাণিক আদি মানুষ মনু শব্দের মিল এই তাৎপর্যকে আরও বৃদ্ধি করে।
আমরা ইতিপূর্বে এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে চেয়েছি যে, হিম যুগের পর যখন চারদিকে বিপুল গাছপালা, ফলমূল এবং শিকারের পশু সহজলভ্য হল তখন আর মানুষ নূতন করে কষ্টসাধ্য এবং অনভ্যস্ত লাঙ্গল-চাষে যেত না। বস্তুত লাঙ্গল চাষে অভ্যস্ত ও দক্ষ হতে মানুষের হয়ত কয়েক কিংবা বহু সহস্র বৎসর লেগেছে। বিশেষ করে সামনে কোন দৃষ্টান্ত ছিল না যা দেখে সহজে এই ধরনের শ্রমসাধ্য ও নিবিড় কৃষিতে যাবে।

_________________________________________________________________________________
ভারতবর্ষের বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠীর সমাবেশে এবং ভাষা-সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও ঐক্য নির্মাণে হিম যুগের প্রভাব সম্পর্কে ভগবান সিং তাঁর The Vedic Harappans- এ চিত্তাকর্ষক এবং মূল্যবান আলোচনা করেছেন। দেখুন The Vedic Harappans p-443.
Bhagwan Singh, The Vedic Harappans, p-440.
এই গ্রন্থের অন্যতম লেখক শামসুজ্জোহা মানিক বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাসকারী গারো সমাজের মাতৃতন্ত্রের উপর কিছুকাল গবেষণা করেন। সেই সময় মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানের সময় তিনি জানতে পারেন যে, গারো কৃষকরা বাঙ্গালী কৃষকদের মত ধান বা শস্য উৎপাদন করতে পারে না। কারণ তারা প্রায় শত বৎসর পূর্বকাল পর্যন্ত জুম চাষে অভ্যস্ত ছিল। তারা একটা স্থানের গাছপালা পুড়িয়ে সেখানে কিছু শস্যবীজ বুনে আসত। এরপর শস্য কাটার সময় হলে কেটে নিয়ে আসত। শতাব্দী বা তারও অধিককাল ধরে তারা প্রতিবেশী বাঙ্গালী কৃষকদের দেখে লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করলেও লাঙ্গল চাষে জমি ও ফসলের যে ধরনের পরিচর্যা দরকার সেটা তারা পুরাতন সংস্কৃতি, রীতি এবং অভ্যাসের প্রভাবে এখনও ভালভাবে আয়ত্ত করতে পারে নি। অথচ আদিবাসী গারোরা খুব পরিশ্রমী। নারী-পুরুষ সবাই মাঠে কাজ করে। লাঙ্গল চাষ পুরুষরা করলেও সব মিলিয়ে নারীরা বেশী শ্রম দেয় কৃষিতে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২৫০



pic-59 
পাতা: ২৫১


সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি যে, লাঙ্গল-নির্ভর কৃষিব্যবস্থায় হিম যুগের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক উপজাতি দক্ষ এবং অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তার আগে হয়ত নরমাংস ভক্ষণ কিছু সংখ্যক সমাজে বন্ধ হয়েছে। এবং সেখানেও আছে বিভিন্ন সংঘাত এবং সেগুলির নায়ক বা নায়িকারা। কিন্তু পূর্ববর্তী এই সকল কৃতিত্ব লাঙ্গলের প্রবর্তক যে চরিত্র তার অঙ্গীভূত হয়েছে; পরবর্তীকালেরও অনেকের অনেক কীর্তি। এবং প্রতিনায়কের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। অনেকের কুকীর্তি নিতে হয়েছে তাকে। এইভাবে ক্রমে মহাকাব্যের রাম ও রাবণ সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই সঙ্গে সীতা। অন্তরালে চলে গেছে মূল ঘটনা। তবু সব কিছু ভেদ করে রাম এবং সীতা সেই এক বিস্মৃত কালে ঘটে যাওয়া হয়তবা পৃথিবীর প্রথম লাঙ্গল-ভিত্তিক কৃষি বিপ্লবের বার্তা আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। তবে যে বাহন বা মহাকাব্যের মাধ্যমে আমরা বার্তাটি পাই তার সবটা মিথ বা অতিকথা।
এর আগেও আমরা উল্লেখ করেছি যে, ইতিহাস ও পুরাণ বা মিথ এক নয়। ইতিহাস ঘটনার বিবরণ। তা ঘটনার অনেকটা প্রতিফলন। কিন্তু মিথ বা পুরাণ ঘটনার ছায়া মাত্র, যার ভিতর পূর্ণাঙ্গরূপে সত্য থাকে না। তবে সত্যের সূত্র থাকে। সেই সূত্রকে ব্যবহার করে ছায়ার পিছনে যে কায়া থাকে বা ছিল তাকে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করা যায় মাত্র। তবে কাজটা সুকঠিন। কারণ সময়ের সঙ্গে ছায়াও তার আদিরূপে থাকে না। সুতরাং নির্দিষ্ট ঘটনা খোঁজার চেয়েও অনেক বেশী বাস্তবসম্মত এবং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মিথের পিছনের সামাজিক সংঘাতের রূপটি আবিষ্কারের চেষ্টা করা।
ধরা যাক আজ থেকে সতেরো বা আঠারো হাজার বছর আগে লাঙ্গল-চাষকে কেন্দ্র করে একটি সামাজিক সংঘাত দাক্ষিণাত্যের কোথায়ও সংঘটিত হয়েছিল। সেই সংঘাতে লাঙ্গল-চাষ পক্ষের শক্তি জয়ী হওয়ায় লাঙ্গলে উৎপন্ন শস্য এবং তার বিজয়ী নেতাকে ঘিরে গল্প এবং গীতিকাব্য তৈরী হল। সেই কাল এবং তার পরের কালের চারণ কবিরা বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলল কৃষির প্রসারের সঙ্গে এই আখ্যানকে। ক্রমে আখ্যান পরিণত হল মিথ বা পৌরাণিক আখ্যানে। কাল থেকে কালে প্রেক্ষিত পরিবর্তিত হলে জনপ্রিয়তার ঢেউয়ে ভেসে এগিয়ে যাবার সময় এই মিথেও আরও অনেক পরিবর্তন হল। আরও বহু সংখ্যক ছোট ছোট মিথ এই বৃহৎ ও প্রবল মিথকে অবলম্বন করে টিকতে চাইল। এইভাবে ছোট একটি কাহিনী বা গীতিকাব্য কালক্রমে বিশাল এক মহাকাব্যে পরিণত হয়েছে, যেমন মহাভারত হয়েছে আরও বিশালতর। সেকালে মানুষের কাছে শ্রুতিমধুর এবং আনন্দদায়ক করার জন্য কাহিনী বা মহাকাব্য গান গেয়ে বা সুর করে শোনানো হত বলে এগুলো সব পদ্যে তৈরী। এতে মনে রাখারও সুবিধা ছিল। একজন যখন সুর করে পড়ে যেত তখন শ্রোতারা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনত এবং বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত।
লাঙ্গল-চাষকে কেন্দ্র করে যে যুগান্তকারী সংঘাত ঘটেছিল তার সঙ্গে বর্তমান কালের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না। বিশেষত লংকা দ্বীপ বা শ্রীলংকা এবং অযোধ্যার মধ্যে দূরত্ব এত বেশী যে, সেকালে এই দুই অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে

পাতা: ২৫২


এমন ধরনের সংযোগ এবং সংঘাত ঘটা ছিল অবাস্তব ও অসম্ভব। বরং এটা সম্ভব যে, বর্তমান শ্রীলংকার নিকটবর্তী দাক্ষিণাত্যের কোন এলাকা ছিল রামের জন্মভূমি যার নাম ছিল অযোধ্যা অথবা এই নামে হয়ত তা পরবর্তী সময়ে খ্যাত হয়। পরবর্তীকালে কোন কারণে তা হয়ত পরিত্যক্ত হয় এবং সেখানকার অধিবাসীদের একাংশ বর্তমান অযোধ্যা এলাকায় অভিগমন করে সেখানকার নাম অযোধ্যা রাখে।
যাইহোক, রামায়ণের মত কোন পুরাণ বা মিথের ভিতর বাস্তবের বেশী এবং নিখুঁত প্রতিফলন আশা করা উচিত নয়। মূল ঘটনা পরবর্তী কালে ভিন্ন চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এটা ধরে নেওয়াই বাস্তবসম্মত।
তবে এটা ঠিক যে, আজ থেকে সতেরো কিংবা আঠারো হাজার বৎসর কিংবা তারও পূর্বে এমন কোন ঘটনা দাক্ষিণাত্যের দক্ষিণ প্রান্ত এবং শ্রীলংকার উত্তরাংশকে ঘিরে ঘটাটা বিচিত্র নয়। কারণ হিম যুগে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় শ্রীলংকা এবং ভারতীয় উপদ্বীপের মধ্যে আজকের ব্যবধান না থাকাটা ছিল একান্ত স্বাভাবিক। বিশেষত দাক্ষিণাত্য এবং শ্রীলংকার মধ্যবর্তী পক প্রণালীতে সমুদ্র জলের গভীরতা এমনিতেও বেশী নয়। ভূতাত্ত্বিকদের হিসাব অনুযায়ী হিম যুগে জলের বিরাট অংশ বরফে পরিণত হওয়ায় সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমান উচ্চতার চেয়ে ৩৩০ ফুট (১০০ মিটার) পর্যন্ত নীচে নেমে গিয়েছিল। বর্তমানে জল দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে সে রকম অনেক এলাকা তখন সমুদ্র পৃষ্ঠের এই নিম্নতার ফলে ভূমি দ্বারা সংযুক্ত ছিল। যেমন হিম যুগে উত্তর আমেরিকার আলাস্কা এবং এশিয়ার সাইবেরিয়া ভূমি দ্বারা সংযুক্ত ছিল। বর্তমানের বেরিং প্রণালী তখন ছিল স্থল দ্বারা তৈরী একটি যোজক।
দাক্ষিণাত্য ও শ্রীলংকা এমন কোন ভূমি সংলগ্ন অঞ্চল অথবা স্বল্পায়াসে অতিক্রম যোগ্য প্রণালী বা জল দ্বারা সেকালে বিভক্ত ছিল কিনা ভূতাত্ত্বিকরা হয়ত সে কথা বলতে পারবেন। তবে তেমন ঘটনা ঘটে থাকলে দাক্ষিণাত্য ও শ্রীলংকার সংলগ্ন এলাকাকে প্রাগৈতিহাসিক কালের সেই যুগান্তকারী সংঘাতের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে হিম যুগের অবসানের সঙ্গে উপকূলের বিস্তীর্ণ ভূভাগ যখন সমুদ্র জলে তলিয়ে গেছে তখন হয়ত লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষি বিপ্লবের নায়ক রামের কথিত জন্মভূমি অযোধ্যাও তলিয়ে গেছে সমুদ্র জলে এবং সেখানকার অধিবাসীদের একাংশ হয়ত সেখানকার গৌরবময় স্মৃতি এবং পুরাণ কাহিনী নিয়ে অনেক দূরবর্তী উত্তরের এক জনপদের নাম অযোধ্যা রেখে সেখানে অভিবাসন করেছে।

_________________________________________________________________________________

 

আমরা ইতিপূর্বে ক্যাম্বে উপসাগরের নিমজ্জিত নগরটি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। সেখানে প্রাপ্ত কাঠের একটি টুকরোর কার্বন পরীক্ষায় এর সময়কাল এখন থেকে ৭৫০০ ও ৯৫০০ বৎসর পূর্বের বলে জানা যাচ্ছে। এই অঞ্চলে যে অনেক জনবসতি সে যুগে ছিল তা সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত বিভিন্ন তথ্য থেকে কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন। গবেষক গ্রাহাম হ্যানকক মাঠ পর্যায়ে তাঁর নিজের বিপুল অনুসন্ধানের সাথে সামুদ্রিক প্রত্নতত্ত্ব ও ভূতাত্ত্বিক তথ্যকে মিলিয়ে যে সিদ্ধান্ত পৌঁছেছেন তার কিছু বিষয় সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন থাকলেও সামগ্রিকভাবে এর গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা তাঁর ইন্টারনেটের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত নিবন্ধের অংশ বিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি :

 

In Underworld the simple new idea on which the whole investigation is founded arises from facts of geology that have been well-known for decades. At the end of the Ice Age, over a 10,000 year period between 17,000 and 7,000 years ago— just before the supposed beginnings of civilization— 25 million square kilometers of what were then the most habitable lands on earth were flooded by rising sea levels as the ice caps melted. That’s a landmass roughly equivalent in size to the whole of South America (17 million sq kms) and the United States (9.6 million sq kms) added together. It’s an area almost three times as large as Canada and much larger than China and Europe combined. And it’s also an area on which hardly any archaeology has ever been done. How can we be sure, therefore, that archaeology has got the story of the origins of civilization right when so many of the places where our ancestors lived shortly before what we think of as the start of civilization have never been studied by archaeologists at all? We have to remember that the world was very different just before the end of the Ice Age. Huge expanses of the northern hemisphere that are centres of habitation today were then buried beneath ice caps three kilometres thick and almost as unihabitable as the surface of the moon. Our ancestors were forced to migrate—typically to low-lying coastal areas close to fertile river deltas and the resources of the sea. They could not have anticipated that the ice-caps from which they had fled would melt, causing sea-level to rise more than 400 feet, flooding for ever the lowlands on which they had taken refuge. The result is a jigsaw-puzzle “lost continent”, scattered under the oceans at depths down to 400 feet that I have set myself the challenge of exploring. Since nobody else is doing it I’m searching for evidence of earlier civilizations that might have flourished there before history began.

.................. .................. .................. .................. .................. .................. ........

In January 2002 underwater cities off the coast of northwest India made news headlines all around the world. The two cities, which have been discovered by India’s National Institute of Ocean Technology, each cover an area of about 10 square miles and lie 120 feet deep in the Gulf of Cambay in an area that until as late as 6900 years ago formed a huge fertile valley that was entirely above water. Then the seas rose again and the Gulf of Cambay was flooded. It therefore seems probable, from the sea-level data alone, that these mysterious submerged cities, which had towering walls, massive geometrical buildings and huge engineering works such as dams, must be more than 7000 years old. Even greater antiquity has been suggested by the recovery of some 2000 man-made artefacts from the sites. Recently tested at two different laboratories in India, the artefacts produced radiocarbon dates ranging from 8500 to 9500 years old.
That’s more than 4000 years older than any advanced city-building culture so far recognised by archaeologists, and of course great cities like those now at the bottom of the Gulf of Cambay don’t grow up overnight. For technical reasons the carbon-dates are from artefacts lifted only from the upper strata of the sites. Once proper coring can be done to deeper layers of the submerged cities much more ancient dates are to be expected.

Graham Hancock. Online Introduction to Underworld: From Fingerprints of the Gods to Underworld: http://www.grahamhancock.com.

 

________________________________________________________________________________

 

পাতা: ২৫৩


ইউরোপের অভিবাসীরা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায় এমনটা করেছে। তাই ইয়র্ক থেকে নিউইয়র্ক, ইংল্যান্ড থেকে নিউ ইংল্যান্ড হয়েছে। থাইল্যান্ডে আমরা পাই অয়োথয়া নামে এক প্রাচীন নগরের নাম যা প্রায় ১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে সেখানকার রাজা ১ম রামাথিবোদি তাঁর রাজধানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অয়োথয়া অযোধ্যার (Ayodhya) রূপান্তর।
যাইহোক, মহাভারত ও রামায়ণ আলোচনার সময় এ কথা মনে হতে পারে যে, যে সব উপজাতি লাঙ্গল-চাষ প্রবর্তন করেছিল তারা বা তাদের উত্তর-পুরুষরা সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণ করেছিল। কিন্তু ঋগ্বেদ বা আবেস্তার সাহিত্য সে কথা বলে না। কোনটিতে রামায়ণের মূল চরিত্র এবং ঘটনার কোন উল্লেখ না থাকায় এটা মনে হয় যে, যারা সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তারা দক্ষিণ দিক থেকে একটা পরীক্ষিত কৃষি পদ্ধতিকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ তারা এর উদ্ভাবক নয়। কিন্তু লাঙ্গল-চাষের শিক্ষা বা বিদ্যাকে গ্রহণ করেছিল। এটা যুক্তিযুক্ত মনে হয় যে, যারা প্রথম লাঙ্গল-চাষ প্রবর্তন করেছিল, তারা নিয়োজিত ছিল এক দীর্ঘ ও কঠোর সংগ্রামে। আর এই সংগ্রামের মাধ্যমে তারা গড়ে তুলেছিল লাঙ্গল-চাষের জন্য উপযোগী সংস্কৃতি তথা মূল্যবোধ ও রীতিনীতি, যার ফলে এই কৃষির উপযোগী সমাজ সংগঠন গঠন করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু একদিকে দীর্ঘ সংগ্রাম এবং অপরদিকে তার সাফল্য তাদেরকে এমন এক রক্ষণশীল ঐতিহ্যে আবদ্ধ করেছিল যা তাদেরকে নগর-সভ্যতা নির্মাণের দিকে আর বেশী দূর


পাতা: ২৫৪


এগোতে দেয় নি। সেক্ষেত্রে তাদের অবদান কৃষি বিপ্লব পর্যন্ত। কিন্তু নগর সভ্যতা নির্মাণের জন্য যে সমাজ সংগঠনগত এবং উৎপাদন ব্যবস্থাগত বিপ্লব দরকার ছিল সেটা আর তাদের রক্ষণশীলতার জন্য সম্ভব হয়নি।
মানুষের ইতিহাসে এটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস কোন জাতি বা জনগোষ্ঠীর জন্য আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও নির্মাণে চিরকাল নেতৃত্বদানের জায়গা রাখে নি। এটা অনেকটা রিলে রেসের মত। এক এক সময় অনেক পিছন থেকে এক এক মানবগোষ্ঠী এগিয়ে আসে অনেক অগ্রগামী কিন্তু স্থবির হয়ে পড়া পুরাতনদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতার শিক্ষা নিয়ে নূতন উদ্যম ও তেজে বিপুল বেগে সবাইকে অনেক পিছনে ফেলে অনেক দূর এগিয়ে যাবার জন্য। এভাবে সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। এক ধারায়ও নয়, বিভিন্ন ধারায়।
এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে আসা বৈদিক পুরোহিত শ্রেণীর উত্তরাধিকারী ব্রাহ্মণদের উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব উপমহাদেশে তাদের ভূমিকার তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য।


পাতা: ২৫৫

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ